মুহূর্তেরা বন্দী
সাথী দাস
দ্বিতীয় পর্ব
কতটা সময় পেরিয়ে গেছে খেয়াল করেনি উজ্জয়িনী। ট্যাক্সি চালকের ডাকে ওর তন্দ্রা উবে গেল। ধড়মড় করে উঠে চোখ মেলে উজ্জয়িনী দেখলো ট্যাক্সিটা রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ও কাঁদতে-কাঁদতে একটু ঘুমিয়েই পড়েছিলো বুঝি। ব্যাগটা বুকে আঁকড়ে ধরে উজ্জয়িনী জিজ্ঞেস করলো,
-এটা কোন জায়গা? কতদূর এলাম আমি?
-আধঘন্টা ধরে ঘুরছি দিদি। কোথায় যাবেন না বললে তো এভাবে সারারাত ট্যাক্সি নিয়ে ঘোরা সম্ভব না। আপনি ভাড়া মিটিয়ে আমাকে ছেড়ে দিন। আমার অন্য কাজ আছে। আমার ট্যাক্সিটা আপনার ঘুমোনোর জায়গা না।
-চলুন না দাদা!
-আরে কোথায় যাবো? মহা ঝামেলা তো। নামুন আপনি! আমার গাড়ি ফাঁকা করুন। দিনকাল ভালো না। রাতদুপুরে গাড়ির মধ্যে মেয়েছেলে নিয়ে এভাবে ঘুরতে পারবো না। কোন সিগন্যালে গাড়ি থামিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে আপনি কি বলে ফাঁসিয়ে দেবেন, তারপর আমাকে জেলের ভাত খেতে হবে! বাড়িতে আমার বউ-বাচ্চা আছে দিদি। আপনার মাথাটা মনে হয় একটু খারাপ আছে। আপনি আমার ট্যাক্সি থেকে নেমে যেদিকে যেতে ইচ্ছে হয়, হেঁটে যান। অন্য ট্যাক্সি নিয়ে যান। নামুন! নইলে আমিই টেনে নামিয়ে দেব। টাকা দিন আমার!
ভাড়াটা মিটিয়ে দিতেই ট্যাক্সি থেকে উজ্জয়িনীকে একপ্রকার জোর করে রাস্তায় নামিয়ে দিলো ওই চালক। উদ্দেশ্যহীনভাবে ব্যাগটুকু সম্বল করে ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করলো উজ্জয়িনী। ঈশ্বর বেশ কয়েকটি ক্ষমতা উজ্জয়িনীকে দুহাতে উজাড় করে দিয়েছেন। সহ্যশক্তি, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আর ঈগলের মতো ক্ষুরধার দৃষ্টি। সহ্য করতে-করতেই ভবিতব্য আজ ওকে এই পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। আর চর্মচক্ষে নিজের আশেপাশে ও যা দেখে, যতটুকু দেখে, সবটুকু নিখুঁতভাবে ওর অবচেতন মনে অনেকখানি জায়গা করে নেয় চুপিসাড়েই। ঝাপসা দৃষ্টিতে উজ্জয়িনী দেখলো, গোটা শহর আলোকমালায় সজ্জিত। সারি-সারি ছোট-বড় দোকান, প্রতিপদে রাস্তার পাশে স্ট্রীট-ফুডের দোকানগুলো খাবারের পসরা সাজিয়ে বসে আছে।দৈহিক পরিশ্রম ও শত ব্যস্ততার মধ্যেও, ঘর্মাক্ত বিক্রেতাদের চোখে অর্থলাভের প্রশান্তি সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়লো উজ্জয়িনীর অনুভবে। প্রায় প্রত্যেকটা দোকানের সামনে অসংখ্য যুগল খাবার খেতে-খেতে খুনসুটিতে মগ্ন। কত প্রাণবন্ত এই শহর! একমাত্র উজ্জয়িনী এই প্রাণের শহরে মৃতদেহের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রতি জোড়া কপোত-কপোতীর মধ্যে সদাহাস্য কোনো পুরুষের মুখমন্ডল চোখে পড়লে, তাদের প্রত্যেকের মধ্যেই উজ্জয়িনী শৌনককে খুঁজে বেড়াতে লাগলো। অনেকদিন পর আজ একটু কেঁদে বুকটা যেন আরও ভারী হয়ে গেছে। বড় রাস্তা বরাবর মাম্মামের বয়সী একটি মেয়ে, তার বাবার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। মাম্মামকে বুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করলো উজ্জয়িনীর। নিজে ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো সবটুকু বুক দিয়ে আগলে ধরতে ইচ্ছে করলো। কান্না সামলাতে না পেরে অন্ধকারে নিজেকে মিশিয়ে দিতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু অন্ধকার মানেই তো একাকীত্ব! উজ্জয়িনী একাকীত্বকে বড় ভয় পায়। সবাইকে নিয়ে আনন্দ করে বাঁচতে ভালোবাসে ও। ছোটবেলা থেকেই অন্ধকারকে ওর খুব ভয় করে। বাবা জানতো এটা। তাই বিদ্যুৎ বিভ্রাট হলেই নিজের বুকের মধ্যে পেখমরানিকে জড়িয়ে ধরে রাখতো। বাবাকে জড়িয়ে বাবার বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকলে, পেখমের আর একটুও ভয় করতো না। কিন্তু বটের ছায়ার মতো সেই আশ্রয়টাই হঠাৎ করে হারিয়ে গেছে। আজ উজ্জয়িনীর নিজেকেও হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করলো।নিজেকে হারিয়ে ফেলার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো উজ্জ্বল আলোকবৃত্ত। যেখানে অনেক আলো, সেখানে নিশ্চয়ই কোনো একাকীত্ব নেই। উজ্জ্বল আলো চোখের ওপর এসে পড়লে, আপনা হতেই বন্ধ হয়ে আসে চোখ। তারপর চোখ বন্ধ করে থাকতে-থাকতে এক সময় জগৎ ভুলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়া যায়। সদ্যোজাত শিশুর মতো নিশ্চিন্ত ঘুম। বড় শান্তির ঘুম। উজ্জ্বল আলোকবৃত্তে আবৃত একটা শপিং মলের দরজা ঠেলে, উদভ্রান্তের মতো ভিতরে প্রবেশ করলো উজ্জয়িনী। তারপর সোজা পৌঁছে গেলো ওয়াশরুমে। হাতঘড়িতে তখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা বেজে গেছে....
লেডিজ বাথরুমে ঢুকে চশমা খুলে নিজেকে দেখে অবাক হয়ে গেলো উজ্জয়িনী। কিছুক্ষণ আগে কান্নার কারণে দুচোখের কাজল সম্পূর্ণ ঘেঁটে, গালে কালি লেপ্টে গিয়ে ওকে এখন বীভৎস দেখাচ্ছে। সযত্নে মূল্যবান প্রসাধনের আড়ালে, বরাবরই নিজেকে লুকিয়ে রাখতো উজ্জয়িনী। কিন্তু আজ সমস্ত আলগা প্রসাধন লবণাক্ত চোখের জলে নষ্ট হয়ে, ওর নগ্ন দগ্ধ রূপটা বেরিয়ে পড়ছে জনসমক্ষে। নিজের স্বরূপ প্রকাশ্যে উন্মুক্ত হওয়ার ভয়ে, ও ব্যাগ হাতড়াতে শুরু করলো। নিষিদ্ধ ওই খোপে ভুলেও হাত দিলো না। অন্য জায়গা থেকে টিস্যু পেপার টেনে বের করে, পাগলের মতো মুখে-চোখে-ঠোঁটে ঘষতে শুরু করলো। আলগা প্রসাধনী আবছা হয়ে গেলো মুহূর্তেই। কল খুলে মুখে ভালো করে জল ছিটিয়ে, নিজের আসল চেহারাটা নিজে একবার ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করলো। বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে বছর দুয়েক আগেই। আর তিন মাস পর বিয়াল্লিশ পেরিয়ে তেতাল্লিশে পা রাখবে উজ্জয়িনী সেনগুপ্ত। আলগা প্রসাধনী জলে ধুয়ে যেতেই বলিরেখা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠলো। দীর্ঘদিন ধরে লেখার কারণে বিনিদ্র রাত্রিযাপনের ফলে চোখের তলায় সময়ের আগেই মৃদু ভাঁজ পড়েছে। তবে নিয়মিত শরীরচর্চা ও ত্বকের পরিচর্যার ফলে, চামড়া এখনও টানটান রয়েছে। ভালোভাবে টিস্যু পেপার দিয়ে মুখ মুছে, ও পেপারটা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। ব্যাগ নিয়ে একছুটে বেরিয়ে এলো বাইরে। যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো। কোনোভাবেই যেন ওর বর্তমান মানসিক অবস্থা প্রকাশ্যে বেরিয়ে না পড়ে, সেই চেষ্টায় উজ্জয়িনী মগ্ন হলো। এত বছর ধরে উপন্যাসের পাতায় একাধিক চরিত্রের হয়ে অভিনয় করতে করতে, এখন এই অভিনয় ব্যাপারটা উজ্জয়িনী খুব ভালোভাবে রপ্ত করে ফেলেছে। যন্ত্রণায় বুক ফেটে গেলেও, নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে চোখ থেকে এক ফোঁটা জল বেরোয় না। এমনকি মুখের একটা রেখাও কাঁপে না! তবে আজ উজ্জয়িনী একটু কাঁদতেই চেয়েছিলো। তাই এখনও চোখের কোল সিক্ত! ওই ভিজে অক্ষিপল্লব মেলেই উজ্জয়িনী দেখলো, রংবেরঙের জামাকাপড়ের হাট বসেছে গোটা শপিং মল জুড়ে। একটা প্রাণহীন মূর্তিকে কি সুন্দর হাতকাটা জামা আর স্কার্ট পরিয়ে, চোখে চশমা দিয়ে এরা দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ও প্রাণহীন বলেই মানুষের এত অত্যাচার সহ্য করছে। আর যদি ওর প্রাণ থাকতো, পছন্দ-অপছন্দ থাকতো, তবে কি সারাদিন ধরে ওই জামাটা পরে ওইখানে দাঁড়িয়ে থাকতো?! মূর্তির জামাটায় একটু হাত রাখলো উজ্জয়িনী। ফ্লোর প্রায় ফাঁকা। আটটা বাজতে যায়। একটু পরেই হয়তো বন্ধও হয়ে যাবে এই শপিং মল। সুন্দর-সুন্দর জামাকাপড় কিনলে নাকি মন ভালো হয়!! মা আর মাসিমণি সবসময় বলে মেয়েদের এই করতে নেই, ওই করতে নেই! আর মা হয়ে যাওয়ার পর তো, কোনো নারীকে নিজের জন্য বাঁচতেই নেই। তখন সবটাই স্বামী-সংসার আর সন্তানের জন্য! তাই বুঝি? তেমনটা আবার হয় নাকি! আচ্ছা কয়েকটা মুহূর্ত যদি উজ্জয়িনী চুরি করে একটু নিজের জন্য বেঁচে নেয়, কেউ কি জানতে পারবে!! কেউ কি দুয়ো দেবে? ওর এই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, লোকচক্ষুর কাছে নিখুঁত হয়ে থাকার প্রবল প্রয়াস, ঝকঝকে এই ইমেজটা কি চিরকালের জন্য নষ্ট হয়ে যাবে?! ও চুরিই তো করবে। একটু মুহূর্ত চুরি করবে, শুধু নিজের জন্য। ওই মুহূর্তে ওর বৃত্তে আর কেউ থাকবে না। নিজের সঙ্গে ও একাই থাকবে। ওকে কেউ চিনবে না। কেউ জানবে না। নিজের মতো করে নিজের জন্য একটু বাঁচলে কি খুব বড় অন্যায় হয়ে যাবে!! নিজেকে একটু অন্যরকমভাবে দেখতে ইচ্ছে করলো উজ্জয়িনীর। গোটা শপিং মল ঘুরে, ও এমন কিছু পোশাক তুলে নিয়ে ট্রায়াল রুমে ঢুকলো, যা ও মাম্মামের জন্মের পর বিগত দশ বছরে দেহে তোলেনি!
ট্রায়াল রুমে ঢুকেই উজ্জয়িনী পরনের শাড়িটা খুলে, মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। নিজের এই একঘেয়ে শরীরটা প্রতিদিনই ও দেখে। এখনও ঋতুমতী হওয়ার সুখ প্রতিমাসে সহ্য করতে হয় ওকে। কৈশোর ও প্রথম যৌবনে ওই রক্তপাত অত্যন্ত যন্ত্রণার হলেও, যখন একজন নারী জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে উপলব্ধি করতে পারে, যতদিন ওই যন্ত্রণা, ততদিনই যৌবন! তখন ওই যন্ত্রণাও পরিণত হয় সুখে। মনে হয়, ওই যন্ত্রণা যেন আর এই নারীদেহ ছেড়ে না যায়। যতদিন তাকে ধরে রাখা যায়, ততদিনই জীবনের সুখ। উজ্জয়িনী এখনও মুক্তি পায়নি ওই রক্তাক্ত আবহ থেকে। মুক্তি চায়ও না। প্রতিমাসে যেন ওইটুকু রক্তস্রোত এসে ওকে জানান দিয়ে যায়, এখনও ওর যৌবন অটুট! জীবন থেকে বসন্ত এখনও ফুরিয়ে যায়নি। ওইটুকু রক্তধারার কারণেই হয়তো দৈহিক ইচ্ছে-অনিচ্ছে, সর্বোপরি যৌবন ওকে এখনও বিদায় জানায়নি। তার ওপর নিজেকে নিখুঁত সুন্দর রাখার ওর অদম্য প্রয়াস একেবারে বিফলে যায়নি। ট্রায়াল রুমের বড় আয়নাটার একেবারে সামনে এগিয়ে গেলো উজ্জয়িনী। নাভির নিচে শাড়িটা পরা ছিলো। শাড়ি সরে যেতেই আত্মপ্রকাশ করেছে মাম্মামের অসংখ্য আদরের চিহ্ন। গর্ভাবস্থায় পেটের চামড়া প্রসারিত হয়ে আবারও সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। কুঁকড়ে যাওয়া অসমান পেটের ওপর পরম মমতায় হাত রাখলো উজ্জয়িনী। এত কষ্ট করে মেয়েটাকে জন্ম দিয়ে, আজ ওর মা নিজেই ওকে কতদূরে সরিয়ে রেখেছে। চিৎকার করে কাঁদতে গিয়ে আয়নার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো ও। মুখের পেলব চামড়ায় ঘেঁটে যাওয়া কাজলের আলগা দাগ। অবিন্যস্ত একরাশ চুল, আর উন্মাদের মতো দৃষ্টি দেখে ওর মনে হলো, সদ্য মানসিক হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আসা একজন মানসিক রোগী ও। ওকে দেখতে আর একটুও স্বাভাবিক লাগছে না। ব্যাগ থেকে টিস্যু পেপার বের করে নির্মমভাবে নিজের মুখে-চোখে-গালে ঘষতে ঘষতে, উজ্জয়িনী মুখের ছাল-চামড়া প্রায় ছিঁড়ে ফেললো। আবার আয়নার দিকে চেয়ে দেখলো, সেই একইরকম উন্মাদিনীর মতো প্রতিবিম্ব। আর নিজেকে সামলাতে পারলো না উজ্জয়িনী। অতিকষ্টে বললো, এক-দুই-তিন! ও বরাবরই এভাবে সংখ্যা গুনে গুনে নিজের অতিরিক্ত আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু আজ পারলো না। নিজের হাতদুটো মুঠো করে, দেহটাকে শক্ত রেখেও কান্নাটাকে আটকাতেই পারলো না ও। সামনের আয়নাটা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লো ট্রায়াল রুমের মেঝেতে। দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললো। দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দে চমকে উঠে তাড়াতাড়িই উঠে পড়লো ও। বোধহয় অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। এখনও একটাও জামা পরে দেখা হয়নি। একটানে নিজের ব্লাউজটা শরীর থেকে টেনে নামিয়ে নামিয়ে দরজাটা একটুখানি খুললো উজ্জয়িনী। শপিং মলের কর্মরতা একটি মেয়ে এসে প্রথমে ওকে সামান্য দেখেই থমকে গেলো। কোনোমতে বললো,
-সো সরি ম্যাম! অনেকটা দেরি করছিলেন আপনি। আর আমাদের কাউন্টারও বন্ধ হওয়ার সময় হয়ে গেছে, তাই....
-আমাকে মিনিট পাঁচেক সময় দিন প্লিজ।
একদম স্বাভাবিক কণ্ঠে উজ্জয়িনী বললো।
-শিওর ম্যাম।
প্রথম পোশাকটা গায়ে চাপিয়ে আয়নার দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো উজ্জয়িনী। পূর্ণযৌবনা না হলেও, একেবারে বিগতযৌবনা নয়। তাকে এখনও তন্বী বলাই যায়। শরীরের প্রতিটা ভাঁজের সঙ্গে বেশ ভালোভাবেই জামাটা বসে গেছে। একেবারে বেমানান লাগছে না। প্রতিটা জামাতে নিজেকে নতুন-নতুনভাবে আবিষ্কার করলো উজ্জয়িনী। আয়নার দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। বহুকাল আগের হারিয়ে যাওয়া রূপটা, আয়নার প্রতিবিম্বের মধ্যে দেখে ওর বেশ ভালোই লাগলো। সবকটা জামা গুছিয়ে নিয়ে, আবার শাড়িটা পরে নিলো উজ্জয়িনী। কাউন্টারে পৌঁছে কার্ড পেমেন্ট করে বেরোনোর সময়, ও বেশ কিছু হার-চুড়ি এমনকি পছন্দ করে একটা সানগ্লাসও কিনে ফেললো। সমস্ত পণ্যের মূল্য পরিশোধ করে শপিং মল থেকে বেরোনোর সময় উজ্জয়িনীর মনে হলো, ও এবার যাবে কোথায়? কার কাছে যাবে এত রাতে! মুহূর্তেই মনস্থির করে ফেললো উজ্জয়িনী। ওই শপিং মল থেকেই ছোট একটা ট্রলি কিনে, নতুন কেনা যাবতীয় জামাকাপড় ওতে ভরে একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়লো....
-দিদিভাই কোথায় যাবেন?
-কাছাকাছি কোনো হোটেল। যেখানে রাতে থাকা যাবে। আর একটু ভদ্রস্থ কোনো জায়গায় নিয়ে যাবেন। রাতে পুলিশ রেড করবে, এমন কোনো সস্তার হোটেল না। বুঝেছেন?
-হুম!
ট্যাক্সি চলতে শুরু করলে ফোন অন করে নিজের মাকে একটা ফোন করলো উজ্জয়িনী। ফোনের ওপার থেকে মায়ের চিৎকার ভেসে এলো,
-আমাকে কি মরার আগে তুই একটুও শান্তি দিবিনা পেখম? কোথায় যাচ্ছিস তুই এই রাতদুপুরে?
-মুহূর্ত চুরি করতে।
-কি?
-বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি মা। রাতে থাকবো। কোন বন্ধুর বাড়ি জানতে চেয়ো না। আমি বলবো না। বাচ্চা মেয়ে নই। তাই হারিয়েও যাবো না। আমাকে আর ফোন করবে না। করলেও পাবে না। আমার জন্য চিন্তা করবে না। আমি একটু ভালো থাকতে যাচ্ছি। আর থাকবোও। রাখছি।
মায়ের চিৎকারের মধ্যেই লাইন কেটে ফোনটা আবার বন্ধ করে দিলো উজ্জয়িনী। ট্যাক্সি ততক্ষণে থেমে গেছে। ট্যাক্সির ভিতর থেকেই উজ্জয়িনী দেখলো আলোয়মালায় জ্বলজ্বল করছে ইংরেজি হরফে লেখা তিনটে শব্দ। OYO....
কাঁধের ব্যাগ, হাতের ছোট ট্রলি আর আলুথালু আঁচল সামলে উজ্জয়িনী এগিয়ে গেলো রিসেপশনের দিকে। প্রয়োজনীয় কিছু কথা বলে নিলো। ওর খিদের অনুভূতিটাই যেন মরে গেছে চিরতরে। অভুক্ত অবস্থায় চাবি হাতে নির্দিষ্ট ঘরে যখন উজ্জয়িনী পৌঁছলো, তখন বেশ খানিকটা রাত হয়ে গেছে। ঘরে ঢুকেই ট্রলিটা একপাশে সরিয়ে রেখে, ধবধবে সাদা বিছানার ওপর ক্লান্ত দেহটাকে এলিয়ে দিলো। ব্যাগটা পড়ে রইলো বেশ খানিকটা দূরে। ওটাতে হাত দিতে গিয়েও মানসিক যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেলো উজ্জয়িনী। চুপ করে শুয়ে থাকতে থাকতে, একসময় ঘুমিয়েই পড়লো। ঘুম ভাঙলো প্রায় শেষরাতে। চোখদুটো খুলেই বিছানার ওপর বেশ কিছুক্ষণ চুপটি করে শুয়েছিলো ও। তারপর আবার উঠে গিয়ে নিজের ঘরের জানলার পর্দা সরিয়ে অন্ধকার শহরের দিকে চেয়ে রইলো অনেকক্ষণ। থমথমে নিস্তব্ধ গোটা শহর। হাতেগোনা দু-একটা গাড়ি যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। শহর ঘুমোচ্ছে। অন্ধকার আর একাকীত্বে বড় ভয় উজ্জয়িনীর। তাই ও আর বেশিক্ষণ ওখানে দাঁড়াতে পারলো না। আবার এসে শুয়ে পড়লো বিছানায়। বন্ধ করে ফেললো চোখ। নরম বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করতেই, ওকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরলো শৌনক। গলায় আলতো করে আদুরে কামড় বসিয়ে দিলো। নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে, হেরে যাওয়ার ভয়ে, প্রতিনিয়ত নিজের কাছ থেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছে উজ্জয়িনী। ভয়ের কারণে ও তাড়াতাড়ি চোখ খুলে ফেললো। হাতঘড়ির দিকে চেয়ে একলাফে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। শাড়িটা বিছানার ওপর ফেলে রেখে ছুটলো বাথরুমে....
হাঁটু পর্যন্ত আঁটোসাঁটো নতুন পোশাকের সঙ্গে হালকা গয়না, আর সঙ্গে সামান্য প্রসাধনের আড়ালে নিজেকে আবারও লুকিয়ে ফেললো উজ্জয়িনী সেনগুপ্ত। দিনের আলো ফুটে ওঠার পর নিজের সমস্ত জামাকাপড় ট্রলিতে গুছিয়ে নিয়ে, ব্রেকফাস্ট সেরে যখন ও প্রাইভেট গাড়িতে চড়ে বসলো, তখন আটটা বেজে গেছে। উজ্জয়িনীকে নিয়ে গাড়ি ছুটে চললো। খোশমেজাজে গাড়ির চালকের সঙ্গে সামান্য কিছু কথা বলতে-বলতে রোদ-চশমার আড়ালে নিজের চোখদুটোকে ঢেকে, রাস্তার দুপাশের প্রকৃতির অকৃত্রিম সবুজ সৌন্দর্য উজ্জয়িনী উপভোগ করছিলো। কলকাতা থেকে মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরত্বে যে এমন সবুজ একটা পৃথিবী নাগালের মধ্যেই রয়েছে, এটা ওর তেমনভাবে জানা ছিলো না। গতকাল রাতে হঠাৎ করেই ইচ্ছে হলো নিজেকে নিয়ে নিজের সঙ্গে হারিয়ে যেতে। জীবন থেকে কিছু মুহূর্ত চুরি করে নিজের নামে লিখে রাখতে। সেইমতো সব আয়োজন করে, উজ্জয়িনী আজই বেরিয়ে পড়েছে সবুজের হাতছানিতে সাড়া দেওয়ার জন্য। কটেজ আগে থেকে বুকিং করাই ছিল। তাই বিন্দুমাত্র অসুবিধে হলো না। গাড়ি থেকে নেমে রিসোর্টে ঢুকে বেশ ভালো লাগলো উজ্জয়িনীর। ছিমছাম, শান্ত-নিরিবিলি একটা রিসোর্ট। বাড়তি পাওনা হিসেবে একটা ছোট সুইমিং পুলও রয়েছে। গাড়ির চালক ট্রলিটা রিসেপশন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে টাকা ও বকশিশ নিয়ে হাসিমুখে বিদায় নিলেন। রোদ চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে যা ফর্মালিটি ছিল, সবটুকু পূরণ করে নিজের কটেজের দিকে এগোলো উজ্জয়িনী। গাড়িতে বসে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার সময়ই উজ্জয়িনী বুঝেছে, ফলতা নামক জায়গাটি শীতকালে চড়ুইভাতির জন্য যথেষ্ট সুনাম অর্জন করলেও, মরশুমের সকল সময়েই মন পরিবর্তনের জন্য এটি একটি আদর্শ জায়গা। শহুরে কোলাহলের বাইরে সপ্তাহান্তে ঝটিতি সফরে পাড়ি দেওয়ার মতো জায়গা খুঁজলে, প্রকৃতির সবুজের মাঝে পৌঁছে নিজের সঙ্গে একাকী একটু কথা বলতে চাইলে, হুগলী নদীর বুকে প্রবাহিত পাক খেয়ে ওঠা বাতাসে সমস্ত মনখারাপ উজাড় করে দিতে চাইলে, এভাবেই পালিয়ে আসতে হয় প্রকৃতির আহ্বানে। এখানে দর্শনীয় স্থানের অতিরিক্ত প্রাচুর্য না থাকলেও শান্তি আছে। বুকভরে শ্বাস নেওয়া যায়, আবার ছেড়েও দেওয়া যায় নিশ্চিন্তে। ব্যাগপত্র, ট্রলি সব নিজের ঘরে রেখে পোশাক পরিবর্তন করে ফুরফুরে মনে সুইমিং পুলে নামলো উজ্জয়িনী। হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র রয়েছেন গুটিকয় কটেজে। দু-চারজন শিশু দৌড়াদৌড়ি করে খেলা করছে অদূরে। সুইমিং পুলের জল স্থির। উজ্জয়িনী ডুব দিতেই জলের উপরিভাগে তরঙ্গের সৃষ্টি হলো। বার দুয়েক সাঁতরে বাঁধানো পাড়ের ওপর দুটো হাত তুলে, হাতের উপর মাথা রেখে চুপ করে খানিকক্ষণ পড়ে রইলো উজ্জয়িনী। চোখ বন্ধ করতেই ওই পুরুষ চিৎকার করে উঠলো, "মানুষ এই মন্দার বাজারে চাকরী পায় না। তুমি চাকরী ছাড়বে মানে!! তুমি কিছুতেই চাকরী ছাড়বে না! আমি ছাড়তে দেবোই না।" ওই চিৎকারের ভয়ে কেঁপে উঠে চোখ খুলে ফেললো উজ্জয়িনী। নোনতা জল ভিড় করেছে চোখের কোণে। জলের ওপর শৌনকের আদুরে আবছা প্রতিবিম্ব। চোখের জল ধুয়ে ফেলতে আবার পুলের জলে ডুব দিলো উজ্জয়িনী। সূর্যের আলোয় পুলের নীচের অংশ সম্পূর্ণ দৃশ্যমান। উজ্জয়িনী দেখলো, দূর থেকে শৌনক তরতর করে সাঁতার কেটে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। তক্ষুণি ও জল থেকে মাথা উঁচু করে একবুক বাতাস ফুসফুসে ভরে নিলো। জল থেকে মাথা তুলতেই উজ্জয়িনী দেখলো, এই রিসোর্টেই কর্মরত দুজন পুরুষ রিসেপশনের দিক থেকে দৌড়ে দরজার দিকে যাচ্ছে। হয়তো কোনো বিশেষ অতিথিকে আপ্যায়নের জন্য হঠাৎ এত ব্যস্ততা। পুল থেকে উঠে পড়লো উজ্জয়িনী। ধীর পায়ে ওয়াশরুমের দিকে যাওয়ার সময় দেখলো, ওই দুজন কর্মী একটা ঢাউস ট্রলি নিয়ে আসছে, অদূরেই একজন পুরুষ। রোদ চশমায় ঢাকা তার দুচোখ। নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো উজ্জয়িনী। চোখ থেকে রোদ চশমা নামিয়ে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে উজ্জয়িনীর হেঁটে পার হয়ে যাওয়া শূন্য পথের দিকে চেয়ে রইলো সে....
-স্যার! কি হলো? দাঁড়িয়ে পড়লেন যে?! আসুন আসুন!
-হ্যাঁ....চলুন।
রোদ চশমাটা আবার চোখে পরে নিলো সে। রিসেপশনে নিজের নামটুকু সই করার সময় তার কানে ভেসে এলো ব্যক্তিত্বময়ী সেই বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর....
-আমার চাবিটা প্লিজ?
হৃদস্পন্দন প্রায় বন্ধ হয়ে এলো তার। হাতের কলমটাও যেন একটু কেঁপে উঠলো। তবুও কিছুতেই মাথা তোলার সাহস হয় না।
-থ্যাঙ্কস! লাঞ্চ ঠিক দুটোয়, আমার কটেজে....
-শিওর ম্যাম।
উজ্জয়িনী চাবিটা নিয়ে ভিজে চুলগুলো কিঞ্চিৎ নেড়েচেড়ে নিজের ঘরের দিকে এগোলে, কলমটা খাতার ওপর ফেলে ঘাড় ঘুরিয়ে ওইদিকেই চেয়ে রইলো সৌজন্য রায়....দারুণ উত্তেজনায় ওর হৃদপিন্ড তখন তিরতির করে কাঁপছে....
(চলবে....)
ছবি : সংগৃহীত
Darun laglo didi । dhire dhire uttejona barche 🥰🥰🥰 mone hocche aber jome jbe
উত্তরমুছুনঅসাধারণ
উত্তরমুছুনDarun darun uff osadharon
উত্তরমুছুনঅসাধারন
উত্তরমুছুনবাঃ বেশ ভালো, নতুন চরিত্রের আগমন।
উত্তরমুছুনAsadharon laglo
উত্তরমুছুনখুব সুন্দর...
উত্তরমুছুনDaruun laglo
উত্তরমুছুনEtao jome jabe puro. . . Darun lag6
উত্তরমুছুনআবার একটা অসাধারণ গল্প উপহার হিসেবে পাচ্ছি এই lockdown পরিস্থিতি তে,,, অনেক ধন্যবাদ দিদি তোমায়🙏🙏🙏
উত্তরমুছুনOMG uff🥰
উত্তরমুছুন❤❤❤
উত্তরমুছুনDarruuunnn....
উত্তরমুছুনNotun kichu asa korbo ei golpo ta theke.. Suru ta besh sundor laglo ❤
উত্তরমুছুনNatun rokom golpo...
উত্তরমুছুন