মুহূর্তেরা বন্দী
সাথী দাস
প্রথম পর্ব
প্রথম প্রভাতের সূর্যদেব আত্মপ্রকাশ করেছেন বহুক্ষণ আগেই। বেলা গড়িয়ে প্রায় দশটা বাজতে যায়। বাঁকা রোদ্দুর চুপিসাড়ে প্রবেশ করেছে ফ্ল্যাটের খোলা জানলা দিয়ে। স্পর্শ করেছে বিছানা। ছোট টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা সদাহাস্যময় বুদ্ধমূর্তি। ল্যাপটপের পাশে চশমা, ফোন, ফোনের চার্জার, ল্যাপটপের চার্জার, কলম, ট্যাব, জলের বোতল, সেই সঙ্গে ঘুমের ওষুধের পাতাটাও উল্টে পড়ে রয়েছে। বেশ কয়েকটা ঘুমের ওষুধ টেবিলের ওপর ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। বিছানায় শুয়ে থাকা রমণীর আজকের প্রভাত দর্শনের বুঝি কোনো সদিচ্ছা ছিল না। সেই কারণে টেবিলে ছড়িয়ে থাকা সবকটা ঘুমের ওষুধ গলাধঃকরণ করার, তার ইচ্ছে ছিল প্রবল। কিন্তু মানসিক টানাপোড়েনের কারণে গতকাল রাতে সেই কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। নিত্যদিনের মতোই ওষুধ সেবন করে ঘুমের জগতে হারিয়ে গিয়েছিলেন উজ্জয়িনী সেনগুপ্ত। ফোনটা একনাগাড়ে বেজে গেলো। কোনো উত্তর না পেয়ে একটু পরেই থমকে গেলো গানের সুমিষ্ট কন্ঠস্বর। দ্বিতীয়বার আবার ফোনটা বেজে উঠতেই, চোখ টেনে খুললো উজ্জয়িনী। বিছানা ছেড়ে উঠতেই ও বুঝলো, মাথা ভারী হয়ে রয়েছে। কোনোক্রমে হাতড়ে টেবিল থেকে ফোনটা তুলে নিয়ে দেখলো পরিচিত নম্বর। গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল,
-মর্নিং দাদা! বলুন?
-আরে উজ্জয়িনী, তুমি তো সেভাবে কিছু জানালেই না, আজকের বিকেলের অনুষ্ঠানে তুমি থাকছো কিনা! আমাকে তো সেভাবে সব আয়োজন করতে হবে। প্লিজ চলে এসো, আমার বিনীত অনুরোধ!
-শরীরটা ভালো নেই দাদা। আমি বোধহয়....
-আরে খারাপ থাকা শরীরকে চাঙ্গা করে তুলতে হবে মন দিয়ে। চলে এসো। অনেক গুণীজনের সমাহার। চাঁদের হাট বসবে তো! আর সবটাই তোমাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। তোমার-আমার কত বছরের সম্পর্ক বলো তো! প্লিজ আর না কোরো না। চলে এসো। আমি কিন্তু ওদের বলে দিচ্ছি, তোমার হাতেই বইটার শুভ উদ্বোধন হবে। তুমি আসছো! জয়ী?
-আচ্ছা দাদা। আমি থাকবো। তবে ওই আধঘন্টাখানেকের জন্য। একটু মুখটা দেখিয়েই চলে আসব। কিছু বক্তব্য রাখতে আমাকে বলবেন না প্লিজ!
-বেশ তাই হবে। তুমি এসে একটু এখানে দাঁড়াও, তাহলেই হবে।
-হুম! সাড়ে চারটে নাগাদ যাচ্ছি।
-ওকে ওকে!
ঘুমের রেশ কাটতেই জানালার বাইরের দিকে চাইলো উজ্জয়িনী। বাইরে ঝকঝক করছে রোদ্দুর। কোথাও কোন বিষণ্ণতা নেই। শুধুমাত্র ওর মনের ভিতরে ছাড়া। মা জানে, ও প্রায় প্রতিটা রাত জেগে লেখালিখির কাজে ব্যস্ত থাকে। তাই সকালে আর ডাকেনি। কিন্তু ফোনটা এসে বড় অসময়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিলো। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো উজ্জয়িনী। ঘর লণ্ডভণ্ড হয়ে রয়েছে। বিছানা থেকে কুশনগুলো কাল রাতে আছড়ে ফেলেছিলো মেঝেতে। সারাটা ঘর নিজের হাতেই তছনছ করে ফেলেছে। উজ্জয়িনীর মনের ভিতর বয়ে যাওয়া ঝড়, অস্থিরতা, চঞ্চলতার সাক্ষী ঘরের এই জড় বস্তুগুলো। খুব কষ্ট হওয়াতে কাল রাতে ও কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েই পড়েছিলো। এক-একটা অভিশপ্ত একাকী রাত কেটে যাওয়ার পর নিজের মানসিক অবস্থার কিছুমাত্র উন্নতি না হলেও, নিজের হাতে ঘরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়ের কবলে পড়ে থাকা ওই জড় বস্তুগুলোকে, স্বহস্তে উদ্ধার করে আবার জায়গামতো সাজিয়ে রাখতে হয়। গত কয়েকদিন ধরে এটাই ওর প্রতিরাতের রুটিন হয়ে গেছে। ঘরটা নিজের হাতে গুছিয়ে, বিছানা ঠিক করে যখন উজ্জয়িনী ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরোলো, তখন মা ঠাকুরপুজো দিয়ে ডাইনিং রুমে এসে দাঁড়িয়েছে। একমাত্র মেয়েকে পূর্ব নির্ধারিত সময়ের আগেই ঘুম ভেঙে উঠতে দেখে, বৃদ্ধা মা জিজ্ঞেস করলেন,
-কিরে? আজ তাড়াতাড়ি উঠে পড়লি যে! কাল রাত জাগিসনি বুঝি!
মায়ের কথার উত্তরে উজ্জয়িনী বললো,
-না। ভোররাতেই শুয়েছিলাম। কিন্তু সকাল সকাল একটা ফোন এসে ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলো।
-কে রে? কার ফোন?
একমাত্র মেয়ের ভয়ে ওই নির্দিষ্ট নামটা মা আর উচ্চারণ পর্যন্ত করতে পারলো না। মায়ের মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো উজ্জয়িনী। তারপর মুখ ফিরিয়ে মায়ের একবুক আশায় জল ঢেলে বাথরুমে ঢুকতে-ঢুকতে বললো,
-অসীমদা ফোন করেছিলো! আমাকে বিকেলে ঘন্টাখানেকের জন্য একটু বেরোতে হবে মা। এক নতুন লেখিকার প্রথম বইপ্রকাশ অনুষ্ঠান। দাদার ইচ্ছে আমার হাতেই হোক। অন্য কেউ বললে এড়িয়ে যেতাম। কিন্তু দাদা আমার প্রথম প্রকাশক। পরে অনেক প্রকাশনীর সঙ্গে কাজ করলেও, অসীমদার সঙ্গে একটা অন্যরকম স্নেহের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। মুখের ওপর না বলা যায় না। বিকেলে একটু বেরোতে হবে।
-হ্যাঁ রে মা! ও আর একবারও ফোন করেনি?
-আমি বাথরুম থেকে বেরিয়ে চা করছি মা। তুমি ঠাকুরের বাসনগুলো মেজে নাও। তোমাকে আর কিচেনে ঢুকতে হবে না। আমি আজ যখন তাড়াতাড়ি উঠেই গেছি, আমিই রান্নাটা করবো।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেখমের মা মেয়েকে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে আত্মগোপন করে একপ্রকার বাঁচলো উজ্জয়িনী। বাথরুম থেকেই ও শুনতে পেল, মা কারোর সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। ব্রাশ করে উজ্জয়িনী শাওয়ারের নীচে দাঁড়ালো। সকালে ওঠার অভ্যেস ওর বরাবরই ছিল। মর্নিং স্কুল, পরবর্তীকালে সকালে টিউশন, তাছাড়া উজ্জয়িনী যখন বি. এড করছিল, সেই সময় খাতা-বইয়ের মাঝে মুখ গুঁজে হোস্টেলের প্রতিটা রাত পেরিয়ে কখন যে সকাল হয়ে যেত, ও বুঝতেই পারতো না। কখনও রুমমেট কেতকীদি, আবার কখনও বা শ্রাবণীদি এক মগ কফি এনে মুখের সামনে ধরতো। ওরা ঘুমিয়ে থাকলে উজ্জয়িনী নিজেই তিনমগ কফি করে আনতো। নিজের রাতজাগার ক্লান্তি দূর করার সঙ্গে সঙ্গে, কফির ছুতোয় খাতা-পেন সরিয়ে রেখে তিনমাথা একজায়গায় হয়ে মিনিট দশেকের ওই মেয়েলি আড্ডাটুকু বড় ভালো লাগতো উজ্জয়িনীর। সেসব আজ শুধুই ধূসর স্মৃতি। প্রথম সকালের সুন্দর মুহূর্তগুলো হারিয়ে গেছে অতীতের কালগর্ভে। পরিচিতা বান্ধবীরা কথা দিয়েও কথা রাখেনি। কেউ তেমনভাবে আর যোগযোগ রাখেনা। কেতকীদি বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে, এতখানি পরিশ্রমের ফলে প্রাপ্ত চাকরীর মায়া কাটিয়ে, গর্ভে দুমাসের একটি ছোট্ট প্রাণকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছে না ফেরার দেশে। বাকিরা সুখে-দুঃখে সংসারী, সরকারী বা বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকুরীরতা। সংসার, স্বামী-সন্তান-সন্ততি, চাকরী, পরিবারের প্রতি সকল দায়-দায়িত্বগুলো সামলে, রাতজাগা বান্ধবীদের দেওয়া কথাগুলো আর রাখা হয়না। কারোর সঙ্গেই তেমনভাবে যোগাযোগ নেই আর। এখন উজ্জয়িনী একপ্রকার বন্ধুহীন জীবন কাটায়। জলের প্রতিটা ফোঁটা ওর দেহ স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গেই নগ্ন শৌনক সিক্তদেহে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরলো উজ্জয়িনীকে। শৌনকের সঙ্গে কাটানো বেশ কিছু সুন্দর মুহূর্ত ওর মানসপটে ভেসে উঠলো। সারারাত অক্লান্ত শরীরী খেলায় মেতে থাকার পর, পরদিন ভোরবেলা স্নানের সময়ও পেখমকে কাছছাড়া করতো না শৌনক। কতদিন স্কুলে বেরোতে দেরি হয়ে যেত। তাও শৌনকের পাগলপারা আদরের উন্মাদনা থেকে অব্যাহতি পেতো না উজ্জয়িনী। ও স্কুলে গিয়ে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো। ক্লাসগুলো নিয়ে কোনোমতে টিচার্স রুমে গিয়েই এলিয়ে পড়তো চেয়ারে। ওকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে, মহিলা সহকর্মীদের কিছু অম্লমধুর বাণী ভেসে আসতো। লজ্জায় মরে গিয়েও সেসব কথা বেশ উপভোগ করতো উজ্জয়িনী। আজও শাওয়ারের তলায় দাঁড়ালে, শৌনক ওকে বরাবরের মতো চারপাশ থেকে এসে ঘিরে রাখে। চোখদুটো বন্ধ করলো উজ্জয়িনী। শৌনকের দেহের উষ্ণতার সঙ্গে, শাওয়ারের জলের শীতলতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো। আর কান্না আসে না এখন। সব সয়ে গেছে। মনটাও হয়তো পাথর হয়ে গেছে। স্নান সেরে জামাকাপড় পরে বাইরে বেরিয়েই ও দেখলো, মা তাড়াতাড়ি করে ফোনটা রেখে দিলো। একটু সন্ধিহান হয়েই পেখম জিজ্ঞেস করলো,
-কার ফোন মা?
-মাম্মামের হোস্টেল থেকে।
-সেকি! রেখে দিলে কেন? কি হয়েছে মাম্মামের?
-ও আজ প্রথম ড্রামা ক্লাসে যাচ্ছে। তাই তোর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলো।
-ওহ!
সদ্যস্নাতা উজ্জয়িনীর উন্মুক্ত ভিজে চুল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মাথায় তোয়ালে জড়ানোর সময়টুকুও পেলো না ও। ছুটলো নিজের ঘরে। ফোন হাতে নিয়েই দেখলো, দুটো মিসড কল হয়ে রয়েছে। মাম্মামের প্রিন্সিপালের ওই নম্বরে ফোন করেই উজ্জয়িনী জিজ্ঞেস করলো, মাম্মামের সঙ্গে এখন একটু কথা বলা যাবে কিনা! উনি জানালেন, মিনিট দশেক আগেই ও ক্লাসে চলে গেছে। ক্লাস শেষ হওয়ার পর প্রিন্সিপাল ম্যাডাম অবশ্যই ফোন করবেন। তখন মায়ের সঙ্গে মাম্মাম কথা বলবে। একটু হতাশ হয়ে ফোনটা কান থেকে নামিয়ে রাখলো উজ্জয়িনী। একরত্তি মেয়েটা আজ ওর বহু প্রতীক্ষিত ড্রামা ক্লাসে যাওয়ার আগে, একটু মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। সেটাও পারলো না। উজ্জয়িনীর বুকের ভিতরটা একেবারে খালি হয়ে গেল। সেই সঙ্গে মনে উঁকি দিলো আরও একটা সন্দেহ। চুপচাপ মাথায় একটা তোয়ালে জড়িয়ে ঘর ছেড়ে বেরোল ও। মা তখন ডাইনিং টেবিলে বসে ছুরি হাতে সবজি কাটছে। রান্নাঘরে ঢুকে চায়ের জল বসিয়ে উজ্জয়িনী জিজ্ঞেস করলো,
-ওটা কার ফোন ছিলো মা? প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমার ফোনে আগে ফোন করেছিলেন। তারপর না পেয়ে প্রায় দশ মিনিট আগে ল্যান্ডফোনে কল করেছিলেন। মাম্মাম ক্লাসে ঢুকে গেছে অনেক আগেই। তাহলে তুমি কার সঙ্গে কথা বলছিলে? আমি বাথরুম থেকে বেরোতেই ফোন রেখে দিলে!
-না মানে...
-সত্যিটাই বলো? বেশি ভাবতে হবে না।
নিজের গরম জলটুকু কাপে নামিয়ে নিয়ে, সসপ্যানে দুধ দিয়ে চিনি আর চা পাতা ঢেলে দিলো উজ্জয়িনী। নিজের কাপে একটা সবুজ চায়ের টি-ব্যাগ চুবিয়ে নিয়ে মাথা থেকে তোয়ালেটা নামিয়ে ফেলে পেখম আবার জিজ্ঞেস করলো,
-বলো মা?
-আজ তোর মাসিমণি একটু আসবে বলছিলো। আমি বলিনি। ও নিজেই আসবে বললো!
রান্নাঘর থেকে একলাফে বেরিয়ে এলো উজ্জয়িনী।
-কেন? আবার কেন?
-তোর সঙ্গে একটু কথা বলতে!
-কথা বলতে? না আমার মাথাটা চিবিয়ে খেতে?
-কিসব বলছিস পেখম? ও তোর মাসিমণি। আমার নিজের বোন। ও তোর খারাপ চাইবে?
-মা আমার এত ভালো আর চাইতে হবে না প্লিজ! মাসিমণি এসে আমাকে পাগল করে দেয়। মাসি এলে আমি এই এখানে থাকতে পারি না আর। তুমি কি চাইছ, আমি এই ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে যাই?
-পাগলের মতো কথা বলবে না পেখম। সেটা চাইলে প্রথম দিনই তোমার স্বেচ্ছাচারিতার কারণে ঘর থেকে দূর করে দিতাম।
-দূর করে যখন দাওনি, তাহলে এখন একটু শান্তিতে থাকতে দাও আমাকে। কি বোঝাবে মাসিমণি আমাকে? আমি কি বাচ্চা মেয়ে? যাহোক বুঝিয়ে দিলেই বুঝে যাবো? আমি যে পরিস্থিতির মধ্যে আছি, মাসিমণি বুঝবে সেটা? কিছু না বুঝেই ওর এত ভাষণ, এত জ্ঞানের কথা কে শুনবে মা? তোমরা প্লিজ আমাকে নিজেরটা বুঝে নিতে দাও!
-দিয়েছিলাম তো! খুব বোদ্ধা হয়েছিলে না তুমি! ফল কি হলো? এত যখন নিজেরটা নিজে বুঝে-গুছিয়ে নেওয়ার শখ, তাহলে ওই অবুঝ মেয়েটাকে কোলছাড়া করে হোস্টেলে ফেলে রেখেছিস কেন? এত বুঝিস, আর ওর কষ্টটা বুঝিস না? মা বাবা থাকতেও হোস্টেলে অনাথের মতো মেয়েটা বড় হচ্ছে!! আজ প্রথম ড্রামা ক্লাসে যাবে, মায়ের সঙ্গে একটু কথা বলবে, তাও বলতে পারলো না। কেমন মা রে তুই? নিজের পেটে ধরেই তো জন্ম দিয়েছিস ওকে। ওর কথা একটুও মনে পড়ে না? আমার হয়েছে যত জ্বালা! ব্যাস গেলো! ওদিকে চা উথলে সব পড়ে গ্যাস নিভে গেলো বোধহয়। সকালে একটু শান্তিতে এককাপ চা মুখে দেব, তারও উপায় নেই। তুই কি বুঝবি মায়ের জ্বালা! কিছু বলতে গেলেই কথার ফুলঝুরি! তুই একাই সব বুঝিস পেখম। আমার বয়সটা তো হাওয়ায় বেড়েছে! সব বুঝে বুঝেই তো আজ এখানে এসে পৌঁছেছিস!
প্রতিদিনের এই অশান্তি উজ্জয়িনীর এখন সয়ে গেছে। সত্যিই ও কাউকে সুখী করতে পারলো না। নিজের বাবাকেও ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর দোরগোড়ায়। মাকেও বেঁচে থাকতে কোনো সন্তানসুখ দিতে পারছে না। একরত্তি মেয়ে মাম্মাম, তাকেও সরিয়ে রেখেছে নিজের থেকে অনেকটা দূরে। মাতৃসুখ হতে বঞ্চিত ওই সেও। আর শৌনক? দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরে ঢুকলো উজ্জয়িনী। এদিকে মায়ের ওপর বকবক করতে এসে, সত্যিই সবটুকু চা উথলে পড়ে গেছে। মা আবার চায়ের জল চাপিয়েছে। নিজের সবুজ চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে ধীরকণ্ঠে উজ্জয়িনী বললো,
-ড্রামা ক্লাসের ড্রামা, ডায়লগ, ও আনন্দ করে শিখুক মা। স্টেজে উঠে আমার মাম্মাম পারফর্ম করবে। আমি বেশ দেখতে যাবো। কিন্তু ঘরের এই রোজকার ড্রামা যেন আমার মাম্মামের শিশুমনে আঘাত করতে না পারে! সেইজন্যই ওকে হোস্টেলে রেখে মানুষ করছি।
মা কোনো কথার আর উত্তর দিলো না। রান্নাঘরে বাসনের শব্দ অনাবশ্যক রকম বৃদ্ধি পাওয়াতে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো বর্তমান প্রজন্মের একজন প্রোথিতযশা লেখিকা উজ্জয়িনী সেনগুপ্ত। ডাকনাম পেখম। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে চাকুরীরত পেখমের বাবা, অবসর নেওয়ার পর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। পারিবারিক চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসাধীন থাকলেও, পেখমের জীবনের একটা হঠকারী সিদ্ধান্ত সহসাই সুখী গৃহকোণের পরিচিত চিত্রটা একেবারে বদলে দেয়। সেদিন বাড়িতে তুমুল অশান্তি হওয়ার পর বাবা সেই যে বাড়ি থেকে বেরোলেন, আর বাড়িতে ফিরলেন না। রাস্তায় একটা যমদূতের মতো সুবিশাল গাড়ি, বাবার মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। ওই দুর্ঘটনার পর থেকে মা একেবারে চুপ করে গিয়েছিল। আত্মীয়রা কেউ পেখমের দিকে সরাসরি আঙুল না তুললেও, বিবেক দংশনে মরে যাচ্ছিল শোকে পাথর হয়ে যাওয়া পেখম। সবার নিস্তব্ধ ইঙ্গিত যেন ওর বুকের মধ্যে তীরের ফলার মতো বিঁধেছিলো। তবে কি ওর জীবনের ওই সিদ্ধান্তটাই বাবার মৃত্যুর কারণ? বাবা কি ওর কথা ভাবতে ভাবতেই অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলো? মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও হারিয়েছিল পেখম। আজও মা-মেয়ের মধ্যে বাবাকে নিয়ে কোনো কথা উঠলে, মা একেবারে চুপ করে যায়। মা-ও কি তবে এটাই ভাবে, বাবার মৃত্যুর সকল দায় পেখমের?! সুর করে আদরমিশ্রিত কণ্ঠে বাবার ওই ডাকটা, আজ বড় শুনতে ইচ্ছে করছে, "আমার পেখমরানী কোথায় গেলি রে? ময়ূরের মতো পেখম মেলে আমার কাছে একটু আয় দেখি মা!" একাকীত্বের মুহূর্তে আপনজনের কথা বড় বেশিই মনে পড়ে। কিন্তু পেখমের জীবনে সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোর সঙ্গেই ওর সম্পর্ক এতটাই তিক্ত, যে তাদের কোলে মাথা রেখে কেঁদে একটু হালকা হওয়ারও উপায় নেই। জীবন বড় দুঃসহ! বড় জটিল! আর যখন চিরপরিচিত মানুষগুলোই চোখের সামনে একটু একটু করে বদলে যায়, তখন আত্মবিশ্বাসটুকুও কোথায় যেন হারিয়ে যায়। পরিবারের মধ্যে থেকে, পরিচিতের মধ্যে থেকেও একাকীত্বের অসহনীয় জ্বালা সহ্য করা বড় সহজ কথা নয়। পরিবারের মধ্যেও প্রতিমুহূর্তে শুধু নিজেকে প্রমাণ করেই যেতে হয়। পেখম যখন নিজের ক্ষমতায় স্কুলের চাকরীটা পেলো, তখন ওর বেতনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিবারে ও নিকট আত্মীয় মহলে হঠাৎ করেই ওর দর বেশ খানিকটা বেড়ে গেলো। বাবা-মাও কি ভীষণ খুশি হয়েছিল সেদিন। কিন্তু সকলের আদরের সেই পেখম যখন নিজের ইচ্ছেয় লেখালিখির কারণে চাকরীটা ছাড়লো, তখন ওর সিদ্ধান্তকে কেউ আর সাদরে গ্রহণ করলো না। ওই সিদ্ধান্তে বাবা-মাকেও আর পাশে পেলো না পেখম। মুহূর্তেই সকলের চোখে যোগ্য-আদর্শ সন্তান থেকে, অযোগ্য হয়ে উঠলো উজ্জয়িনী। যোগ্য সন্তান হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে-করতে জীবন থেকে চল্লিশটা বসন্ত যে কিভাবে পেরিয়ে গেলো, উজ্জয়িনী আজ আর সঠিকভাবে তার হিসেব দিতে পারবে না। প্রায় প্রতিদিন সকালে মায়ের সঙ্গে এমনই কিছু আলাপচারিতায় বারংবার প্রমাণিত হয়, উজ্জয়িনী সেনগুপ্ত জীবনের প্রতিপদে ব্যর্থ একজন নারী! সেদিন যখন মা দুপুরে খাওয়ার টেবিলে বলেই বসলো, "ওই ছাইপাঁশ কথাবার্তা যা সব বইতে লিখিস, তার সিকিভাগও যদি তুই নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে পারতিস, তাহলে তোর জীবনটা এভাবে ছারখার হয়ে যেত না। বড়-বড় কথা শুধু বইতেই মানায়। বুঝলি তো? বাস্তব অন্য কথা বলে!" সেদিন আর মাকে ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়নি, "তাহলে আমাকে ছোটবেলা থেকে এত-এত বই পড়তে শেখালে কেন? কঠিন বাস্তব থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখে, কল্পনার জগতে ভাসিয়ে অনাবশ্যক আবেগী করে তুললে কেন? সবরকম আঘাত থেকে আগলে রাখলেই বা কেন? কেন এতদিন পরিস্থিতির চাপে পড়ে শিখতে দাওনি? কোনো কিছুর সঙ্গে আপোষ না করার শিক্ষাটাই বা দিলে কেন? দিলেই যখন আজ সেইসব শিক্ষা কোথায় গেল? তোমার দেওয়া সেইসব মহান শিক্ষার প্রয়োগ যখন নিজের জীবনে করছি, তখন তোমাকে পাশে পাচ্ছি না কেন মা?" এসব আর জিজ্ঞেস করা হয়নি। আজকাল শুধু শুনেই যায় পেখম। কোনো কথার আর উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না। ধৈর্য হারিয়েছে ও। আর নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে ও তৎপর হয়ে ওঠে না। পেখম বুঝে গেছে, ও যতই যাই করুক না কেন, সংসারে ওকে নিয়ে কোনো একজনের সমস্যা থাকবেই। তাই এত ভেবে লাভ নেই। শুধু সময়ে-অসময়ে নিজের বছর দশেকের মেয়েটাকে দেখতে বড় ইচ্ছে করে। কিন্তু এসব পারিবারিক অশান্তি ওর শিশুমনে যাতে কোনো বিরূপ প্রভাব না ফেলে, সেই জন্য একপ্রকার বাধ্য হয়েই বুকে পাথর চাপা দিয়ে ওকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। কাঁচটা মুছে চোখে চশমাটা পরে নিলো উজ্জয়িনী। দৃষ্টিটাও গত বছর থেকেই বিশ্বাসঘাতকতা করছে। চোখদুটোতে টানতে হয়েছে কাঁচের আলগা পর্দা। চশমা পরেই উজ্জয়িনী দেখলো, মেঘ করে আসছে। দূরে আকাশে একটা সুবৃহৎ পাখি উড়ছে। বাবা অবসর নেওয়ার পর পেখম নিজের হাতে বাবার জন্য ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে এই ছোট্ট বাগানটা তৈরি করে দিয়েছিল। রকমারি পাতাবাহার গাছ, নাম না জানা গাছগাছালির পরিচর্যা করতে করতে, রঙবেরঙয়ের বাহারি ফুল ফোটার অপেক্ষায় বাবার জীবনের বাকি দিনগুলো কেটে যাবে এটা ভাবতেই, পেখমের মনে দারুণ উত্তেজনা কাজ করতো। তাই বাবার অবসরের দিনই, নার্সারী থেকে একগাদা সবুজ গাছের চারা উপহারস্বরূপ পেখম কিনে নিয়ে এসেছিল। তারপর বাবারও গাছের নেশা হয়ে গিয়েছিল। একরত্তি বারান্দাটাকে কিভাবে সাজাবে, কতরকমভাবে গাছ দিয়ে সাজাবে, সেইসব আলাপ-আলোচনা দিনরাত ফোনের মাধ্যমে মেয়ের সঙ্গে চলতো। বাবার উন্মাদনা দেখে পেখমও একের পর এক গাছের চারা এনে মহানন্দে ভরিয়ে ফেলতো ওই এক টুকরো বারান্দা। আজ বাবা সাধের এই ছোট্ট বাগানটা ফেলে রেখে চলে গেছে অনেক দূরে। কিন্তু পেখম এই বাগানটার মায়া কাটাতে পারেনি। নিজের হাতে প্রতিদিন বিকেলে এই গাছগুলোর পরিচর্যা করে ও। আর সন্ধ্যেবেলা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে শহরের বিষাক্ত আকাশের দিকে চেয়ে বলে, "বাবা দেখছো তো তুমি? আমি আজও তোমার বাগানের অযত্ন হতে দিইনি। এই কংক্রিটের শহরটা যতই বিষিয়ে উঠুক না কেন, এখানে অক্সিজেনের ঘাটতি হবে না কোনোদিনও। ওই দূরে তারাদের দেশে ঘুমিয়ে, শ্বাস নিতে তোমার কোনো কষ্ট হচ্ছে নাতো বাবা? আচ্ছা বাবা, বলো না! সেদিন রাস্তা পার হওয়ার সময় সত্যিই কি আমার কথাই তুমি ভাবছিলে? আমিই কি তোমায় শেষ করে দিলাম বাবা? মায়ের সিঁথির সিঁদুর মুছিয়ে দিলাম? কেউ উত্তর দেয় না। তুমি বলবে বাবা?" উজ্জয়িনীর এই সকল প্রশ্নের কোনো উত্তর আসে না। হঠাৎ বয়ে আসা দমকা বাতাস, বারান্দার গাছের পাতাগুলো দুলিয়ে দিয়ে যায় কেবল। কোনো একটা গাছে নতুন ফুল ফুটলেই সেই গাছটাকে জড়িয়ে ধরে সেদিন উজ্জয়িনী কাঁদে নীরব কান্না। আজ গোটা বারান্দাটা লাল-হলুদ ফুলে আগুনরঙা সাজে সেজে উঠেছে। এই গাছগুলো উজ্জয়িনীর সঙ্গে একটুও বিশ্বাসঘাতকতা করে না। ওর অক্লান্ত পরিচর্যার ফসল হিসেবে, প্রতিবারই অগুনতি ফুলেল সৌন্দর্য উপহার দিয়ে যায়। হাতের চায়ের কাপটা সরিয়ে রেখে ঝুলন্ত টবটাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো উজ্জয়িনী। তারপর ভেঙে পড়লো নিঃশব্দ কান্নায়! ঘরে ফোন বাজছে। নিশ্চয়ই মাম্মাম! ওর প্রথমদিন ড্রামা ক্লাসের গল্প শুনতে হবে। ওকে অনেকটা আদরও করতে হবে। আবেগে বাষ্পীভূত হয়ে আবছা হয়েছে পেখমের চশমার কাঁচ। চশমা নামিয়ে চোখ মুছে ও ছুটলো নিজের ঘরে। স্বচ্ছ চায়ের কাপে সবুজ চা ধীরে-ধীরে উষ্ণতা হারিয়ে পানের অযোগ্য হয়ে উঠলো...
-শোন না রে মা! এইরকম জেদ করলে হয়?
-মাসিমণি, দেখছো তো আমি রেডি হচ্ছি। বিশেষ প্রয়োজনে আমাকে একটু বেরোতেই হবে। বাড়ি ফিরে তোমার সঙ্গে কথা বলছি।
-তুই আমাকে এড়িয়ে যাস। এখনও তাই যাচ্ছিস। ফোন করলেও ফোন ধরিস না পেখম। কি শুরু করেছিস নিজের জীবনটা নিয়ে? ঝোঁকের মাথায় চাকরীটা ছাড়লি, ওটাও মানা যায় না। আর এখন তো....
-চাকরী করি না বলে আমার খাওয়া-পরার চিন্তা তোমাকে করতে হচ্ছে কি? আমি কি এক সন্ধ্যে তোমার বাড়িতে ভাত চাইতে যাচ্ছি? না থাকতে যাচ্ছি? নাকি গা ঢাকার কাপড় চাইছি? আমার নীচের ফ্ল্যাটের ভাড়ার টাকা, বাবা যা রেখে গেছে, আমার যা আছে, এখনও যা রোজগার করে চলেছি, সব মিলিয়ে আমার পুরো পরিবারের চাহিদা ভরণপোষণ বাদ দাও, প্রয়োজনে তোমার সংসারও আমি টেনে নিতে পারবো। আমি চাকরী ছেড়েছি, আমি বুঝবো। আমার জীবন, আমি বুঝবো। তোমাকে এত ভাবনা না ভাবলেও চলবে।
-দিদি তোর মেয়ের কথাবার্তা এত খারাপ হয়ে গেছে?
-তাহলেই ভাব, কি নিয়ে সারাটা দিন থাকি আমি? সারাদিন ঘরের মধ্যে বসে থাকে, আর আমার সঙ্গে এইরকম যুদ্ধ করে! মেয়ের এত মুখ চলে!
-মা!!
-কি মা? মাসিমণি কি তোর খারাপ চাইবে?
-মা! আমার এত ভালো, এত শুভচিন্তক, এতসব শুভাকাঙ্খীর চাপ আর নিতে পারছি না আমি! মাসিমণি আমি বেরোলাম।
ঘড়িটা হাতে পরে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো উজ্জয়িনী। কিন্তু তার আগেই তুমূলভাবেই বাধাপ্রাপ্ত হলো মাসির কাছে,
-এই মেয়ে! শোন! নিজের বয়সটা একটু দেখ। এই বয়সে এসে এসব কি ভূত চেপেছে তোর মাথায়? হ্যাঁ রে! জীবনটা কি তোর ওই ল্যাপটপের গল্প নাকি? যার সঙ্গে যাকে ইচ্ছে, যখন ইচ্ছে জুড়ে দিবি! আবার যখন চাইবি ভেঙে দিবি। এরকম হয় না মা। কি শুরু করেছিস মা তুই এসব? তোর মায়ের তো বয়স হচ্ছে। তোর জন্য কমপ্লেক্সে মাকে কত খারাপ-খারাপ কথা শুনতে হচ্ছে মা! কতরকম জবাবদিহি করতে হচ্ছে। এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দে মা। অন্তত নিজের পেটের মেয়েটার কথা ভাব। ও যদি বড় হয়ে জানতে পারে, ওর মায়ের চরিত্র এমন, মন এত অস্থির, সামান্য একটু মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাটুকুও নেই, তাহলে তুই তোর নিজের মেয়ের চোখেই কতটা নেমে যাবি, সেটা একবারও ভেবে দেখেছিস? একটা বাচ্চাকে সুস্থভাবে মানুষ করতে বাবা-মা দুজনকেই প্রয়োজন হয়। বাবার ভালোবাসা বাবা ছাড়া অন্য কেউ দিতে পারে না পেখম। মেয়েদের সংসার জীবনে অনেককিছুই সহ্য করতে হয়। আর মায়েদের তো এত ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা ভাবলে চলেই না। তারা কি আর নিজের জন্য বাঁচে রে? তারা তো বাঁচে সন্তানের জন্য। তোর অমন সুন্দর সাজানো-গোছানো সংসার! এই বয়সে এসে এসব তোকে মানায় বল? অন্তত সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে...
-মাসিমণি!
-বল মা?
-আমার বড্ড দেরী হয়ে যাচ্ছে। আমি একটা অনুষ্ঠানে যাবো। সেখানে সময়মতো পৌঁছতে না পারলে, অনুষ্ঠানটাই শুরু হবে না। প্লিজ! সব এসে শুনছি। প্রমিস! তুমি আজ সারারাত ধরে বলবে, আমি শুনবো। এখন বেরোতে দাও। মা এলাম।
ছিটকে ফ্ল্যাটের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে একপ্রকার পালিয়েই বাঁচলো উজ্জয়িনী সেনগুপ্ত। বেরোনোর সময় মায়ের চাপা কান্নার শব্দ ওর কানে ভেসে এলো। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েই বাড়ির বাইরে পা রাখলো উজ্জয়িনী। ওলা বুক করে ফ্ল্যাটের নীচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলো বেশ কিছুক্ষণ। তারপর হ্যান্ডব্যাগটা বুকে জড়িয়ে ধরে গাড়িতে উঠে বসলো। ব্যাগের ওই নির্দিষ্ট চেনটা খুলতে গিয়েও খুলতে পারলো না আর। কাঁচের ভিতর দিয়ে জানালার বাইরের দিকে চেয়ে অস্ফুটে একটাই নাম উচ্চারণ করলো, "শৌনক!" ফেসবুকে ঢুকেই খুলে বসলো একজন পুরুষের প্রোফাইল। শৌনক চট্টোপাধ্যায়! তার একের পর এক ছবি স্ক্রোল করে, ফোনের স্ক্রিনে হাত বুলিয়ে যেতে লাগলো উজ্জয়িনী....
অনুষ্ঠানের পর সভাগৃহে উপস্থিত অগণিত পাঠকবৃন্দের জমায়েত ও সামান্য জলযোগের ব্যবস্থা নিপুণহাতে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন অসীমদা। জনসমাগমের মধ্যেই এককোণে একটা চেয়ারে বসেছিলো উজ্জয়িনী। অনিচ্ছাসত্ত্বেও অজস্র গুণীজনের মধ্যে কিছু বক্তব্য ওকেও রাখতে হয়। কন্ঠ হতে উত্তরীয় নামিয়ে রেখে অস্থির হাতে কয়েকটি বইতে স্বাক্ষর করছিলো ও। মাথা নীচু করেই স্বাক্ষরকার্যে ব্যস্ত থাকায়, কোনো পাঠকের মুখ দেখা সম্ভব ছিল না। অদূরে দাঁড়িয়ে একটি ছেলে যে ওই লাইন শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছিল, সেটা প্রথমে উজ্জয়িনীর দৃষ্টিগোচর হয়নি। সকল পাঠকের বইতে স্বাক্ষর, মুঠোফোনে ফ্রেমবন্দী ছবির আবদার মিটিয়ে তখন উজ্জয়িনী প্রায় বিধ্বস্ত। সভাগৃহ অপেক্ষাকৃত ফাঁকা হওয়ার পর উজ্জয়িনী দেখলো, একটি ছেলে ওর দিকে চেয়েই দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটির হাতে অন্য দু-তিনটি বইয়ের সঙ্গে, ওর সর্বশেষ প্রকাশিত বইয়ের একটা কপি রয়েছে। কিন্তু সে নিজে থেকে এগিয়ে আসছে না দেখে, মুখে মৃদু হাসি এঁকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে চাইলো উজ্জয়িনী। এবার ছেলেটি এগিয়ে এলো উজ্জয়িনীর দিকে। ছেলেটির বয়স বড় বেশি নয়। কলেজ পড়ুয়া হয়তো। গালে সদ্য গজিয়ে ওঠা দাড়ির আভাস। ক্লান্ত রাতজাগা দুটি চোখ। বর্তমান প্রজন্ম মুঠোফোনের দাসত্ব বরণ করেছে। তাই স্বাস্থ্যের প্রতি বড়ই অমনোযোগী। এই ছেলেটিও তার ব্যতিক্রম নয়। রাতজাগা ক্লান্তির ছাপ গোটা মুখমন্ডল জুড়ে। পরনে সুতির পাঞ্জাবী। হাতা গুটিয়ে রেখেছে। এক নজরে ছেলেটির আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে উজ্জয়িনী বললো,
-কোনো অভিযোগ?
-না তো ম্যাম।
-তাহলে দূরে দাঁড়িয়েছিলে যে! আমি ভাবলাম, আমার কোনো বই পড়ে মনে হয়েছে অপাঠ্য, তাই একান্তে অভিযোগ জানাবে বলে দূরে দাঁড়িয়ে আছো।
-কি যে বলেন ম্যাম! আপনার কোনো বই বাদ দিইনি। সব সংগ্রহে আছে। শুধু এটাই ছিলো না। এটাতে একটা সই ম্যাম?
-নিশ্চয়ই!
-ম্যাম আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?
-আমরা তো কথাই বলছি, কি নাম তোমার?
-দীপ্ত বর্মন।
-আচ্ছা। "দীপ্তকে শুভেচ্ছা ও ভালোবাসাসহ....উজ্জয়িনী সেনগুপ্ত"। হ্যাঁ দীপ্ত, আমরা তো কথাই বলছিলাম। বলো কি বলবে?
বইটা ফিরিয়ে দিলো উজ্জয়িনী। ছেলেটি কথা শুরু করার আগেই সশব্দে উজ্জয়িনীর ফোনটা বেজে উঠলো। ও ফোনের স্ক্রিনের দিকে চেয়েই বিরক্ত হয়ে গেলো। মাসিমণি ফোন করছে। যে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ওর বাড়ি ফেরার কথা ছিল, সেই সময়সীমা বহু আগেই পেরিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে বার দুয়েক মায়ের ফোন এসে গেছে। মায়ের সঙ্গে কথা বললেও, মাসির ফোনটা উজ্জয়িনী কেটে দিলো। তারপর হাসিমুখে দীপ্তর দিকে চেয়ে বললো,
-বলো দীপ্ত? কি বলবে?
-ম্যাম একটু আলাদাভাবে কথা বলা যাবে আপনার সঙ্গে?
-কেন বলো তো?
-প্লিজ ম্যাম!
-শুনছে না কেউ। সবাই অনেকটা দূরে আছে। বলো!
-ম্যাম! আমি আঁকতে খুব ভালোবাসি। ডিজিটাল, ওয়াটার কালার, যেমনটা বলবেন করবো। আপনার মনের মতো করে। একবার আপনার বইতে ইলাস্ট্রেশনের সুযোগ দেবেন ম্যাম? আপনার মনের মতো করে আমি চরিত্রদের সাজিয়ে দেব। আপনার কলমে ওরা যদি প্রাণ পায়, আমার ছবিতে পাবে অবয়ব।
-দেখো দীপ্ত....
-নতুনদের কেউ কাজ দেয় না ম্যাম। আবার কাজ করিয়ে অনেকে পয়সাও দেয় না। ছোটখাটো কয়েকটা প্রকাশনী থেকে কাজ করেছি ম্যাম। খুব খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে। পাঠক যখন একটা বই উল্টে পাতার পর পাতা পড়ে যায়, তখন তার পিছনের অক্লান্ত পরিশ্রমটা সেভাবে বোঝে না। নতুন বইয়ের গন্ধে, বলিষ্ঠ লেখনীতে হারিয়ে যায় তারা। কিন্তু ওই একটা বই বাজারে আনতে পরিশ্রমের পাশাপাশি যে কি পরিমাণ পলিটিক্স চলে, সেটা আমি এই কদিনেই বুঝে গেছি। আপনি তো অনেক সিনিয়র রাইটার ম্যাম। আপনি আমার থেকে এসব খবর আরও ভালো জানেন। আপনি আমাকে একটা সুযোগ করে দিন না, আপনার বইতে কাজ করার। আমি জানি নতুনদের নিজের জায়গা করে নিতে কতটা পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়! আগে অনেকবার চেষ্টা করেছি ম্যাম কাজ পাওয়ার। নামী প্রকাশকরা কেউ কাজ দেয় না। আমাকে দেখা করতে বলেও তারা আসে না। আসলে আমি অনামী তো! কেউ চেনেই না। একটা কাজ পেলে নিজেকে প্রমাণ করে দেখিয়ে দেব। একটা সুযোগ আপনি করে দেবেন ম্যাম? আপনার বইয়ের যা কাটতি আছে, আপনার সঙ্গে একটা কাজ করলে, আপনার নামের সঙ্গে নিজের নামটা একবার জড়িয়ে ফেলতে পারলেই....
-দীপ্ত?
-বলুন ম্যাম?
-একটা বইয়ের পিছনের রাজনীতি আমার অজানা নয়। তবে স্তাবকতা আমার অপছন্দ। আলোকবৃত্তে থাকা মানুষরা দিনরাত পরিশ্রম করে নিজের জায়গা তৈরি করেছে। তাদের সঙ্গে একবার কাজ করলে, তোমার হয়তো খানিকটা শ্রীবৃদ্ধি হবে ঠিকই! কিন্তু টিকে থাকার জন্য নিজের লড়াইটা নিজেকেই লড়তে হয়। শূন্য থেকে একদিন আমিও শুরু করেছিলাম। তোমার সঙ্গে আমার পার্থক্য হলো, আমি কোনদিন কারোর দরজায় পাণ্ডুলিপি নিয়ে ঘুরিনি। নিজের ওপর বিশ্বাস রেখে শুধু কাজ করে গেছি। এভাবে সুযোগের জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকিনি। কাজ করো। সুযোগ তোমার দরজায় নিজেই কড়া নাড়বে।
-আর না নাড়লে?
-তখন না হয় এসব দ্বিতীয় পথগুলো ভেবো। তোমার বয়সটা তো খুবই কম। এখনই এত ভেঙে পড়লে চলবে? অনেকদূর যেতে হবে তো!
-আমাকে তবে সুযোগের জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে বলছেন? আচ্ছা! তাই করবো তবে। কিন্তু আর কত অপেক্ষা করবো ম্যাম? আর কি করলে....
ছেলেটির মুখ দেখে বড় মায়া হলো উজ্জয়িনীর। ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। কিন্তু বইবাজারের লবিবাজি আর রাজনীতির চাপে পড়ে কাজের উৎসাহ হারাচ্ছে। কাজ খারাপ হলে তাকে বকে-ধমকে দুটো উপদেশ দেওয়া যায়। কিন্তু একজন মানুষ যে ঠিক কোন পরিস্থিতিতে কাজের উৎসাহটুকুই হারিয়ে ফেলে, সেটা উপলব্ধি করতে পারলো উজ্জয়িনী। হয়তো কাজের অভাবে ছেলেটি কিছুদিনের মধ্যেই জলাঞ্জলি দেবে আপন শিল্পীসত্তা। এটা তো হতে দেওয়া যায় না। অসহায় ছেলেটির অবনত চোখের দিকে চেয়ে উজ্জয়িনী বললো,
-তোমার কাজ দেখানো সম্ভব?
-আপনি দেখবেন ম্যাম!
-এই মুহূর্তে সম্ভব না। তুমি আমাকে মেইল করবে। আমার অফিসিয়াল পেজে মেইল আইডি পেয়ে যাবে।
-আমার পেজ লিঙ্ক দিয়ে দেব ম্যাম। সব কাজ ওখানেই শো-কেস করে রাখি।
-তাই দিও।
-থ্যাঙ্কু ম্যাম!
-কথা দিলাম না কিন্তু। কাজ পছন্দ হলে ভেবে দেখবো। আমারও তো পেশাদারী ক্ষেত্রে কিছু দায়বদ্ধতা আছে। আমার কথাই শেষ কথা নয়। সবদিক ঠিক থাকলে তুমি আমার দিক থেকে নয়, সরাসরি প্রকাশকের পক্ষ থেকে ডাক পাবে। তখন যেন আমার নাম ডুবিও না!
-প্রাণ দিয়ে সাজাবো ম্যাম আপনার বইয়ের প্রচ্ছদ!
-আচ্ছা। আর ডাক না পেলে মনে রাখবে....
-আমাকে আরও খাটতে হবে। আরও নিখুঁত হওয়ার জন্য। কম্পিটিশনে টিকে থাকার জন্য।
-হুম! কিন্তু উৎসাহ হারাবে না। আগামী কোনো এক বইমেলায় তোমাকে হয়তো পকেটের পয়সা খরচ করে, আমার বই কিনতে হবে না। নিজের কাজের কপি হিসেবে একটা বই বিনামূল্যেই পেয়ে যাবে।
-আমি আজই বেশ কয়েকটা কাজ করে, পেজে আপলোড দিয়ে তারপর আপনাকে লিঙ্ক পাঠাবো ম্যাম। আজ আমি সারারাত জাগবো। আপনার পরবর্তী লেখা কবে নাগাদ আসার কথা?
-দেখি। এখন তেমন কিছু লেখা হচ্ছে না!
-লিখুন ম্যাম। আমিই করবো আপনার আগামী বইয়ের প্রচ্ছদ। কালই সব ডিটেলস আপনি পেয়ে যাবেন।
উজ্জয়িনীর মনে হলো, হঠাৎ করেই যেন ছেলেটির দীপ্ত নামটা সার্থক হয়ে উঠলো। কাজ পাওয়ার আশায়, আনন্দে ঝলমল করে উঠলো ছেলেটির মুখ।
-বেশ! তাই পাঠিও। তবে রাতে ঘুমাও একটু।
-আপনার চরিত্ররা তো সবাই নিশাচর ম্যাম। তাদের শান্তিতে ঘুমোতে দেন আপনি? পাঠকরাও না হয় রাত জাগবে। প্রচ্ছদশিল্পীও। আপনি নিজে রাতে ঘুমান তো ম্যাম?!
স্বল্পপরিচিত এই ছেলেটি হঠাৎ করেই যেন একটা আয়না এনে উজ্জয়িনীর সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। কাল্পনিক সেই আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে শিউরে উঠলো উজ্জয়িনী। তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,
-তুমি চা খাবে দীপ্ত?
-না ম্যাম। টিউশনি আছে। যেতে হবে। ভিড় একটু ফাঁকা হলে আপনার সঙ্গে কথা বলবো বলে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়েছিলাম। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। আর দেরি করলে মাসের মাঝখানেই টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে স্টুডেন্টের বাবা বলবে, কাল থেকে আর আসতে হবে না! আসলে দুবছর আগে বইমেলায় আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম আমি। আমার দুটো বইতে আপনার সইও আছে। তবুও আপনি আমায় চিনবেন না। আপনি তো বইতে সই করার সময় কারোর দিকে মুখ তুলে তাকান না। ছবি তুললেও হয়তো ভুলে যান। মেলার ওই ভিড়ের মধ্যে তো এত কথা বলা যায় না। তাই গত বছর থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম, একদিন আপনার সঙ্গে একা কথা বলবোই। সমস্ত ভিড় পেরিয়ে পৌঁছব আপনার কাছে। একটা সেলফি ম্যাম?
-নাও!
-থ্যাঙ্কু! আসছি ম্যাম! আমি কালই আপনাকে মেইল করছি!
-হুম! সাবধানে এসো....
প্রকাশক অসীমদা ও অন্যান্য প্রতিভাবান লেখক-লেখিকার সান্নিধ্যে সেদিন সন্ধ্যেটা উজ্জয়িনীর বেশ ভালোই কাটলো। অসীমদার কাছ থেকে অনুমতি চাইতে গেলে বাইরে বেরিয়ে এসে উজ্জয়িনীর কাঁধে হাত রেখে অসীমদা বললেন,
-মেয়ে কেমন আছে জয়ী?
-ভালো দাদা!
-আর তুমি?
-আমিও ভালোই।
-কি করছো নিজের জীবনটা নিয়ে?
-বাড়িতে তো সারাদিন চলছেই দাদা। এসব কথা আর না বললেই কি নয়?
-সবাই তোমার ভালো চায়। তাই বলছে! জীবনটা কোনো উপন্যাস নয় জয়ী। যে তোমার ইচ্ছেমতো তুমি উপসংহার সাজাবে!
-তবে কি দাদা? ছোটগল্প? যা শেষ হয়েও হবে না শেষ? প্রতি পাতায় থাকবে নতুন আঙ্গিকে কোনো শুরুর রেশ?
-এসব কাব্য করে বইয়ের ব্যবসা চলে। প্রকাশকের- লেখিকার দুটো পয়সা আসে। কিন্তু জীবন চলে না জয়ী। আবেগতাড়িত হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিও না। নিয়ন্ত্রণ রাখো নিজের ওপর। মেয়েটার কথা একটু ভাবো। তুমি আমার বোনের মতো। দীর্ঘ কয়েক বছরের সুসম্পর্ক আমাদের। সেই জায়গা থেকে অন্তত দাদার কথাটা শোনো! আমি তোমার ভালো ভেবেই...
সশব্দে বেজে উঠলো উজ্জয়িনীর ফোনটা। স্ক্রিনের দিকে চেয়ে ও হেসে বললো,
-এই যে! আমার ভালো চাওয়ার আর একজন মানুষ! কতবার ফোন করছে! এক মিনিট দাদা?
উজ্জয়িনীর কাঁধের ওপর থেকে স্নেহের আলিঙ্গন সরিয়ে নিলেন অসীমদা। উজ্জয়িনী বলে উঠলো,
-হ্যাঁ মাসিমণি!
-আর কত রাত করবি? নাকি আমি আছি বলেই বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে করছে না? আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের কৃতকর্মের হিসেব শুনতে ভালো লাগে না? তাই না?
নিরুত্তর উজ্জয়িনী।
-মা চিন্তা করছে তোর জন্য! বাবাটাকে তো শেষ করলি, এবার মাকে অন্তত শেষ কটাদিন একটু শান্তিতে বাঁচতে দে!
-কি বললে মাসি!! আমি বাবাকে শেষ করেছি!?
-বাড়ি আয়। বাড়ি আয়। মা চিন্তা করছে।
-আসবো না আমি। তুমি যতক্ষণ ওই ফ্ল্যাটে থাকবে, আমি ঢুকবই না। কিছুতেই যাবো না আমি! আমি আজ ফিরবোই না। কি করবে তুমি?
-জয়ী!!
লাইনটা কেটে দিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো উজ্জয়িনী।
-দাদা, আজ আর কিচ্ছু শুনতে ভালো লাগছে না। আমি আসছি। আপনি আর ফোন করবেন না প্লিজ। করলেও আমি ধরবো না।
উদভ্রান্তের মতো বড় রাস্তায় নেমে একটা সাদা রঙের নো রিফিউজাল ট্যাক্সি দেখেই হাত নেড়ে ওটাকে থামালো উজ্জয়িনী।
-কোথায় যাবেন দিদি?
-যতই বিল হোক, আপনি ভাড়া পেয়ে যাবেন। আমার কাছে টাকা আছে। চিন্তা নেই। আপনার যেদিকে ইচ্ছে হয়, যেদিকে দুচোখ যায়, আপনি শুধু চলুন। আমি এই শহরের বুকে হারিয়ে যাব। আর ফিরবো না!
ট্যাক্সিতে উঠে সজোরে দরজা বন্ধ করে দিলো উজ্জয়িনী সেনগুপ্ত। ট্যাক্সিওলা পিছন ফিরে হাঁ করে ওর মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে দেখে উজ্জয়িনী ধমকে উঠলো,
-কি হলো! চলুন!
ট্যাক্সিতে বসেই উজ্জয়িনী ভেঙে পড়লো নিঃশব্দ কান্নায়। বাবার একচিলতে বাগানের গাছগুলোতে সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলগুলো হাতছানি দিয়ে ওকে যেন পিছু ডাকছে। ওর বুকফাটা যন্ত্রণায় পাতাগুলোও কাঁপছে তিরতির করে। কিন্তু উজ্জয়িনী আর কিছুতেই ফিরবেই না ওই বারান্দায়। হ্যান্ডব্যাগটা বুকের মধ্যে চেপে ধরলো উজ্জয়িনী। ব্যাগের একটা চেন নিষিদ্ধ। ওটা খুলতে নেই! ওতে সযত্নে সংরক্ষিত রয়েছে উজ্জয়িনীর প্রাণ ভোমরা। আর অপর পাশে সর্বক্ষণের সঙ্গী ট্যাব। ল্যাপটপটা বিছানার ওপরেই রয়ে গেলো। পাওয়ার ব্যাঙ্কটাও সঙ্গে নেই। না থাকুক! এবার মা ফোন করছে। ও ফোনটা বন্ধই করে দিলো। উজ্জয়িনী সেনগুপ্তর বাড়ির সম্পূৰ্ণ বিপরীতদিকে চলতে শুরু করলো ট্যাক্সি। অজানার উদ্দেশ্যে....
(চলবে....)
ছবি : সংগৃহীত
আমরা সবাই কমবেশি উজ্জয়িনী।কোথাও না কোথাও নিজের সাথে কানেক্ট করতে পারলাম।ভালো লাগল।
উত্তরমুছুনকি করে লেখো এমন🙂🙂
উত্তরমুছুনবাহ্ দারুন সূচনা।
উত্তরমুছুনসবসময়ের মতোই অসাধারণ❤️
উত্তরমুছুনতোমার লেখার জন্য অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম,আজকে অপেক্ষার অবসান হলো❤️
শুরুটা দারুণ হল,,
উত্তরমুছুনদিদি তোমার লেখা পড়তে একটা ভীষণ টান অনুভব করি... ভালো থেকো, আর উজ্জয়িনীর পাশে কেউ নেই কিন্তু তুমি থেকো, আমরাও থাকবো তবে মুহূর্তের এপাড়ে
উত্তরমুছুনখুব সুন্দর সূচনা ।।।
উত্তরমুছুনখুব সুন্দর সূচনা ।।।
উত্তরমুছুনApurba❤️❤️❤️❤️
উত্তরমুছুনখুব সুন্দর
উত্তরমুছুনWow ..... darun
উত্তরমুছুনবাঃ শুরু টা খুব ভালো হলো।
উত্তরমুছুনবেশ একটু অন্যরকম লাগল জানিনা কেন! মানে তোমার লেখার ধরনের চেয়ে একটু আলাদা। তবে ভালো লাগলো অবশ্যই।
উত্তরমুছুনValo laglo ❤️
উত্তরমুছুনKub sundor didi
উত্তরমুছুনকিছুই বলার নেই শুধু একটা কথাই অনবদ্য, অনন্য,
উত্তরমুছুনDarun bhabe suru holo natun golpota
উত্তরমুছুনদারুণ লিখেছ গো দিদি...... পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম
উত্তরমুছুনKhub sundor hoycha. Kintu jano ae galpo ta last a mil thaka apne sob golpa bichhad hoy jay akta galpo jano mil hoy
উত্তরমুছুনখুব সুন্দর। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম
উত্তরমুছুনDarunnnnn
উত্তরমুছুনবেশ ভালো লাগলো
উত্তরমুছুনঅসাধারণ শুরু,,,,
উত্তরমুছুনআবার জুড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে.... কিন্তু কষ্টটা উপভোগ করছি ❤️❤️❤️আর লেখনীর বিন্যাস ❤️❤️❤️❤️
উত্তরমুছুনঅনবদ্য।আপনার লেখা বেশি পড়িনি।কিছুদিন আগেই এখানে যোগ দিয়েছি।বেশ ভাল লাগছে পড়ে।ভবিষ্যতে আপনার গ্রুপ বা blog টিতে লেখার wish রইল।আমি নিজেও একটু লেখালেখি করি।তবে আপনার মত পরিচিত কেউ হয়ে উঠতে পারিনি এখনো।
উত্তরমুছুনশুরু করলাম।
উত্তরমুছুনঅপূর্ব ❤️
উত্তরমুছুন