অনুসরণকারী

মঙ্গলবার, ২ মার্চ, ২০২১

সপ্তপর্ণী (প্রথম খণ্ড) চতুর্থ পর্ব


 



সপ্তপর্ণী


সাথী দাস


প্রথম খণ্ড


চতুর্থ পর্ব








মর্মাহত ত্রিদিব বললেন,

-আমাকে অবিশ্বাসের কোনো কারণ নেই ত্রিযামা।ছুরিকাঘাতে মনুষ্যশরীরে আঘাত সম্ভব,তবে বাহির হতে অদৃশ্য হৃদয়ে নয়।এ তোমার নিষ্ফল প্রচেষ্টা।ছুরি যথাস্থানে রাখো।
-বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের মতো কোনো বক্তব্য এখনও আপনি রাখেননি রাজা।
-এ বাক্যও সত্য!
-রাত্রি জাগরণের কারণে আপনি অত্যন্ত পরিশ্রান্ত।বিশ্রাম গ্রহণ করুন।

কোমরবন্ধনীর মধ্যে অস্ত্রকে আশ্রয় দিয়ে,আপন গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হয়েছিলো ত্রিযামা।তবে তার চরণযুগল পুনরায় স্থির হলো।উদ্বেলিত হৃদয়ে ত্রিদিবের মুখনিঃসৃত বাক্য হৃদয়ঙ্গম করলো ত্রিযামা,

-আগামী কয়েক দিবস আমি মায়ের অতিথি।রাজা আপন রাজ্যেই অতিথি!এ নিতান্তই হাস্যকর হলেও,মাকে সম্মানপূর্বক এই আতিথেয়তা আমি গ্রহণ করেছি।সেই সঙ্গে আমার মনের গোপন ইচ্ছা এটুকুই ত্রিযামা,জীবনকালে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের মতো সময় ও সুযোগ তো সকল নরাধমেরই প্রাপ্য।তবে ত্রিদিবাচার্য এ অধিকার হতে বঞ্চিত হবে কেন?সেই সুযোগটুকু অন্তত তাকে প্রদান আবশ্যক....

নিরুত্তর ত্রিযামা মুহূর্তেই পরিত্যাগ করেছিলো সেই স্থান।সমগ্র দিবস কেটেছিলো এক মানসিক অস্থিরতার মধ্যে।পরিশেষে সূর্যদেব যখন আপন ম্লান হয়ে আসা নয়নাভিরাম আলোকোজ্জ্বল রূপসহ প্রায় অদৃশ্য হয়েছেন মায়াকাননের সবুজ অরণ্যশিখরের প্রান্তরে,তখন ক্ষীণ বাতি নিয়ে ত্রিদিবের কক্ষে প্রবেশ করেছিলো ত্রিযামা।তবে দর্শন পায়নি নৃপতির।কুটির শূন্য।উদভ্রান্তের মতো কুটির হতে বাইরে বেরিয়ে সেই নির্দিষ্ট স্থানের দিকে ধেয়ে যায় ত্রিযামা।অদৃশ্য হয়নি বৈশ্বানর।অন্ধকার নিমজ্জিত বৃক্ষপদতলে দুই চক্ষু বুজে দন্ডায়মান ত্রিদিবের প্রাণের অশ্ব।তবে সেই ক্ষণে নিরুদ্দেশ অশ্বারোহী।আকুলচিত্তে দুর্ভেদ্য বনানীর ভিতর পায়ে হাঁটা পথ অনুসরণ করে মায়াকাননের গভীরে প্রবেশ করলো ত্রিযামা।কিছুদূর অগ্রসর হতেই চন্দ্রালোকে দেখা মিললো তার।পূর্ণচন্দ্রের আলোকছটায় নবরূপে সজ্জিত মায়াকাননের প্রতিটি বৃক্ষ।সম্মুখে টলটলে দীঘি।এই দীঘির জল যাযাবর গোষ্ঠীর তৃষ্ণা নিবারণের হেতু ব্যবহার করা হয়।প্রতি প্রভাতে সূর্যের প্রথম কিরণের উপস্থিতিতে সবুজ জলজ উদ্ভিদে আবৃত এই দীঘির জলে অবগাহন করে ত্রিযামা।এর প্রভাতী রূপের সঙ্গে পরিচিতা এই বন্য নারী।তবে রাতে চন্দ্রপ্রভার সৌজন্যে দীঘির মোহময়ী রূপ হতে অকস্মাৎ দৃষ্টি ফিরিয়ে নেওয়া বড়ই কঠিন।ত্রিদিব ওই দীঘির এক প্রান্তে দাঁড়িয়েছিলেন।ধীর পায়ে ত্রিদিবের পশ্চাতে গিয়ে দাঁড়ালেন ত্রিযামা....

-এসো!
-আপনি বুঝতে পেরেছেন?আমি নেহাৎই ধীরগতিতে....
-আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অতিশয় সজাগ।সে বুঝিয়ে দিয়েছে আমায় কেউ অনুসরণ করছে।তবে আমি বিপদগ্রস্ত নই।সে আমার শত্রু নয়!এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
-মাকে সংবাদ প্রেরণের প্রয়োজন বোধ করেননি।এমন দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো নিরুদ্দেশ হওয়ার অর্থ?
-প্রকৃতি বড় সুন্দর ত্রিযামা।রাজকোষের স্বর্ণচ্ছটা হতে দীঘির উপরিভাগের চন্দ্রকিরণের ওই আভা,চোখকে অধিক আরাম প্রদান করে।আমি সুখী!
-দীর্ঘকাল যাবৎ মায়াকাননের এই অংশে যাতায়াতের কারণে,জঙ্গলের সকল পথ,সকল সৌন্দর্য আমার দৃষ্টিপথে ধরা পড়েছে।তবে মায়াকাননের এমন রাত্রিকালীন সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ পূর্বে হয়নি।সত্যিই পৃথিবী বড় বিচিত্র রাজা!একই অঙ্গে সময়বিশেষে তার অজস্র রূপ!
-শুধু সময়কালে সে রূপে অবগাহনের প্রয়োজন!
-আসুন।আপনাকে অপূর্ব সুন্দর এক দৃশ্য দেখাই।জীবদ্দশায় এমন সুযোগ বুঝি দ্বিতীয়বার পাবেন না!

ত্রিযামার হাত ধরে মায়াকাননের সুদীর্ঘ ছায়াঘেরা নিবিড় অরণ্যে হারিয়ে গেলেন ত্রিদিব।দীঘির অদূরেই ঝর্ণার মৃদু শব্দ।সুদূরপ্রসারী হিমশৈলর কোনো এক অনামী চূড়া বুঝি আত্মগোপন করেছে এই দুর্ভেদ্য অরণ্যের আড়ালে।যা চিরকালই থেকে গেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে।ক্ষুদ্র গুল্ম হতে বৃহৎ মহীরূহ,সকলেই আলোআঁধারির খেলায় মত্ত।মৃদুমন্দ বাতাসে শীতল হয় মায়াকাননের অধীশ্বরের অস্থির মন।অপরূপ নৈঃশব্দের মধ্যে অকস্মাৎ বৃক্ষরাজির মর্মরধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবেশপূর্বক,মনে এক অলৌকিক অনুভূতির সৃষ্টি হয়।রাতচরা বিহঙ্গ-দম্পতি কর্কশ আলাপনে আপন অস্তিত্ব জানান দেয়।ঝর্ণার সম্মুখভাগে পৌঁছে স্তব্ধতার শুভ্র চাদরে আপনাকে আবৃত করলেন ত্রিদিব।চন্দ্রালোকের স্পর্শে সেই ঝর্ণা সদ্য যুবতীর মতই প্রাণোচ্ছল।ধীরে ধীরে অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বনপূর্বক,সেই ঝর্ণার পিচ্ছিল পাড়ে আপন পদযুগল জলে ভিজিয়ে সিক্ত পাথরের ওপর বসলো ত্রিযামা।ত্রিদিব বসলেন অদূরেই।প্রকৃতির এমন অনাবিষ্কৃত সৌন্দর্যের রসাস্বাদন হেতু,ত্রিদিব ও ত্রিযামা ব্যতিরেকে বুঝি তৃতীয় কেউ এই ত্রিভুবনে জাগ্রত নেই।সামান্য উচ্চৈঃস্বরে বুঝিবা বনদেবী রুষ্ট হবেন।অত্যন্ত ধীরকণ্ঠে ত্রিদিব বললেন,

-শুক্লপক্ষ!
-হুম!
-অপূর্ব!তবে কৃষ্ণপক্ষের অধিক সুন্দর নয়।কৃষ্ণপক্ষকালে এই স্থানে পৌঁছে,ত্রিযামার কমনীয় রূপ দেখতে মনে বড় সাধ জাগে।

নিরুত্তর ত্রিযামা।ঝর্ণার জল নাতিদীর্ঘ দীঘির অন্তরে বিলীন হয়ে গেলো।জলের উপরিভাগে ক্ষুদ্র তরঙ্গ।ক্রমশ অন্ধকার অরণ্য সজ্জিত হলো আলোকমালায়।মস্তকের ঊর্ধ্বপানে সুউচ্চ তরুদল হতে,সন্নিকটের লতানো পরজীবী বৃক্ষপল্লবে জ্বলে উঠলো অজস্র আলো।স্থির নয় সেই আলোকিত পতঙ্গ।জ্বলতে-নিভতে থাকা দীপ্তিময় সেই পতঙ্গ এসে বসলো ত্রিযামার উল্কি দ্বারা সজ্জিত উন্মুক্ত রুক্ষ বাহুতে।অদূরেই বসেছিলেন ত্রিদিব।উঠে এসে বসলেন ত্রিযামার সন্নিকটে।ত্রিযামার রুক্ষ বাহু হতে সেই আলোকোজ্জ্বল পতঙ্গকে অতি সাবধানে উঠিয়ে আপন হস্তের মধ্যে স্থান দিলেন।হতবাক খদ্যোত বুঝি আকস্মিক স্থান পরিবর্তনে বিচলিত হয়ে আপন দেহ হতে অস্থির আলোকবিন্দু বিচ্ছুরণ পূর্বক,ত্রিদিবের হস্তমধ্যে ইতস্তত বিচরণ করতে লাগলো।দুজনের মুখমণ্ডলের কিয়দংশ আলোকিত হলো সেই প্রাণীর কারণে।প্রকৃতির মায়াবিনী রূপে বিভোর হয়ে ভীত দৃষ্টিতে ত্রিদিবের পানে চাইলো ত্রিযামা।একাধিক জোনাক তখন ত্রিদিবের সর্বাঙ্গে জ্বলছে-নিভছে....

-ত্রিযামা!প্রথম দর্শনেই মনপ্রাণ সঁপেছি তোমায়।এ অরণ্য তোমার যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদানে অপারগ।তুমি আমার সঙ্গে প্রাসাদে চলো।প্রিয় রানি করে আমার অন্দরমহলে রাজকীয় বিলাসিতায় রাখবো তোমায়।তোমার কোনরূপ অসম্মান হবে না।এই গোষ্ঠীর যাবতীয় দায়িত্ব নিতে আমি প্রস্তুত।নগরে স্থান দেবো সকলকে।গৃহ প্রদান করবো।জীবিকার পথ প্রশস্ত হবে।অস্তিত্বরক্ষার তাগিদে এভাবে হিংস্র জন্তুর সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই অনাবশ্যক ত্রিযামা।আমার সঙ্গে চলো তুমি!দয়া করো আমায়।আমি মোহরকুঞ্জে ফিরতে চাই।উপযুক্ত ক্ষত্রিয়রূপে রাজধর্ম পালন করতে চাই।তবে সে দায়িত্ব কর্তব্য পালন,তোমা বিনে কদাচ নয় ত্রিযামা!

চঞ্চল জোনাক আপন ক্ষুদ্র পাখা মেলে অদৃশ্য হলো প্রকৃতি মাঝে।সহস্র পতঙ্গের মধ্য হতে ওই বিশেষ জোনাককে চেনা আর সম্ভব হলো না।শিহরিত ত্রিযামার প্রাণ।ঝর্ণার হিমশীতল জল হতে উঠে দ্রুততার সঙ্গে সেই স্থান ত্যাগ করতে উদ্যত হলো সে।প্রবলভাবে বাধাপ্রাপ্ত হলো ত্রিদিবের নিকট।

-ত্রিযামা!আমার প্রস্তাবের উত্তর চাই।এই মুহূর্তে!
-নগরের উপকণ্ঠে কোনোকালেই মা আর ফিরবে না।সভ্য নগরী হতে এ অসভ্য অরণ্য অধিক বিশ্বস্ত!আমিও এ বাক্য ধ্রুব সত্য বলেই জানি এবং এই সত্য পালনে ব্রতী রাজা।
-এভাবে প্রতি মুহূর্তে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাঁচা সম্ভব?জীবনধারণের উপযোগী কোনো সুবিধাই তো এখানে নেই ত্রিযামা।তোমার গোষ্ঠীতে ওই জনাকয়েক পুরুষ জীবিত।কেউ কাতর বৃদ্ধ,কেউ অত্যন্ত অসুস্থ,কেউ আবার অঙ্গহানির যন্ত্রণায় অসহায়।এভাবে তোমার গোষ্ঠী অবলুপ্তির পথে এগিয়ে যাবে।নগরে এসো আমার সঙ্গে।সুস্থ জীবনধারণ ব্যতীত তোমার গোষ্ঠীর রমণীরা নগরের পুরুষের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে,এই গোষ্ঠী আগামী দিনে বিলুপ্ত হবে না।বংশানুক্রমে জীবিত থাকবে তোমার গোষ্ঠীর বংশধররা।মাকে বোঝানোর সকল দায়িত্ব আমার।শুধু তুমি আমায় গ্রহণ করো।
-অধিক রাত পর্যন্ত এই দীঘির পাড়ে থাকা অনুচিত রাজা।অনেক হিংস্র তৃষ্ণার্ত জন্তু জলের সন্ধানে....

অতর্কিতে বৃক্ষপল্লবের মৃদু খসখসানি শব্দ অনুধাবন করে,কোমরবন্ধনী হতে উন্মুক্ত ছুরিকা হস্তে পশ্চাতে ফিরলো ত্রিযামা।কৌতূহলী নেত্রে ত্রিদিব দেখলেন,একজোড়া চপল মৃগ দম্পতি ওই দীঘির পাড়ে উপস্থিত হয়েছে।তবে ত্রিদিব ও ত্রিযামাকে দেখে,তারা অতিশয় ভীত।আপন সুতীক্ষ্ণ ছুরি বন্ধনীর মধ্যে রেখে ত্রিদিবের সঙ্গে অরণ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন ত্রিযামা।ওই স্থান হতেই দেখলেন,জ্যোৎস্নালোকে দুটি ভীত প্রাণীর তৃষ্ণার জলগ্রহণের মনোরম দৃশ্য।অতঃপর ওই দম্পতি আশ্রয় নিলো তমসাবৃত অরণ্যে....

-চলুন!অধিক বিলম্ব অনুচিত রাজা।রাত্রিকালে এ মায়াকানন হিংস্র প্রাণীর অবাধ বিচরণক্ষেত্র।তাদের এই পৃথিবীতে আমরাই অতিথি।অসময়ে তাদের রাজ্যে অনধিকার প্রবেশের জন্য প্রাণ সংশয়....
-আমি এই স্থান পরিত্যাগ করবো না।তুমি রাজ্যে ফিরবে তো আমার সঙ্গে?আমার প্রাসাদে তুমি তোমার যোগ্য সম্মান....
-সম্ভব নয় রাজা!এই গোষ্ঠী আমার মুখাপেক্ষী।মা আমাকে অনেকখানি ভরসা করেন!তার নির্দেশ উপেক্ষা করে,আপন স্বার্থরক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠতে পারবো না।গোষ্ঠীর সকল সিদ্ধান্ত ডাকিনী মা নিয়ে থাকেন।আর আমি সামান্য এক যাযাবর কন্যা।কোনো রাজ্যের রাজকন্যা নই।আমি আপনার উপযুক্ত নই রাজা।কি পরিচয়ে আপনি আমাকে প্রাসাদে স্থান দেবেন?সকলের উপহাসের পাত্রী হয়ে দিন যাপন করা,আমার পক্ষে একপ্রকার অসম্ভব।আমি মায়াকাননকে বড় ভালোবাসি।
প্রতি মুহূর্তের বিদ্রুপ হতে,অনিরাপদ আশ্রয় অধিক সম্মানের।

বন্ধনী হতে তরবারি মুক্ত করলেন ত্রিদিবাচার্য।তীব্র আক্রোশে বললেন,

-মায়াকাননের অধীশ্বর আমি!আমি এই অরণ্য থেকে যদি তোমাদের বিতাড়িত....

তীব্র ধাতব শব্দে আপন ছুরির ফলায় সেই তরবারির আঘাতের প্রত্যাঘাতপূর্বক শীতল কণ্ঠে উত্তর দিলো ত্রিযামা,

-করতেই পারেন।সম্মানহানির কারণে পূর্ব রাজার রাজ্য পরিত্যাগ করেছি।প্রাণ,মান,সম্পত্তি,প্রিয়জন সকলই হারিয়ে এই অরণ্যে জীবিত থাকার তাগিদে প্রতিনিয়ত লড়াই করছি।তবে হেরে যায়নি এই গোষ্ঠীর কেউই।স্বল্পসংখ্যক হলেও আমরা জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি।আপনার লোকবল প্রচুর,বুদ্ধিবল,অস্ত্রবলও।আপনি আমাদের নিমেষেই ধূলিসাৎ করতে পারেন রাজা।তবে এই অসম যুদ্ধশেষে,রণক্ষেত্রের প্রতিটা দেহই হবে নিষ্প্রাণ।মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই আমার সামান্য কয়েকজন সঙ্গীনি আপনার সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করবে।এই গোষ্ঠীর কেউই আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না বলেই আমার স্থির বিশ্বাস।ত্রিযামার কাছে বিশ্বাসঘাতকতার একটিমাত্র শাস্তি,মৃত্যু!!মৃত্যু তো অবশ্যম্ভাবী!আপনার সৈন্যের অস্ত্রের আঘাতে,নতুবা আমার ছুরিকাঘাতে।তবে তারা আমার সহযোদ্ধা হয়ে শত্রুর সঙ্গে রণক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ,অধিকতর সম্মানের মনে করবে।তরবারির কারণে ভীত আমি নই।আমার গোষ্ঠীর কেউই নয়।

তরবারি নামিয়ে নিলেন ত্রিদিব।

-তোমার সাহস ও আত্মবিশ্বাসে মুগ্ধ আমি!তরবারি ত্যাগ করলাম।প্রণয় ভিক্ষা করছি ত্রিযামা।আমি বিপথগামী।দীর্ঘকাল যাবৎ সন্তানহীনতার জ্বালা,আমার পৌরুষের চরম লজ্জা!সেই লজ্জা হতে মুক্তি পেতে,নিজেকে সকল দুঃখ হতে বিস্মৃত করতে,আমি একাধিক নারীসঙ্গে আসক্ত হয়ে পড়ি।আমি এক লজ্জিত ক্ষত্রিয়,যে রাজধর্ম বিস্মৃত হয়।এভাবেই অত্যাচারী রাজার পরিচয়ে বেঁচে,অযথা ভীতিপ্রদান করে প্রজাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলাম।কয়েক বৎসর এমন অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের ফলস্বরূপ রাজকোষ প্রায় শূন্য।গুপ্তচর সূত্রে এমন সংবাদও আমি পেয়েছি,অবিলম্বেই রাজধানীতে শত্রুর আক্রমণের সম্ভবনা রয়েছে।কিন্তু আমি মনে স্থির রাখতে পারিনি।ব্যর্থ রাজা আমি।বর্তমানে রাজ্যের আমাকে প্রয়োজন ত্রিযামা।রাজসিংহাসনের আমাকে প্রয়োজন।আর আমার প্রয়োজন তোমার মত নির্ভীক,স্পষ্টবক্তা,সহযোদ্ধা এক নারীসঙ্গ।তোমার সন্ধানেই বুঝি আমি সংসার ছেড়েছি!তুমিই আমার ভবিতব্য!আমার পূর্ব রানিদের সঙ্গে,আমি সকল সংস্রব ত্যাগ করবো।তারা আমাকে নূন্যতম মানসিক সুখ দিতেও অক্ষম ত্রিযামা।তুমি আমার সঙ্গে চলো!তুমি আমাকে পরিপূর্ণ করো....

অতর্কিতে একাধিক খুরের শব্দে অরণ্যের স্বাভাবিক নৈঃশব্দ ভঙ্গ হলো।ডানা মেলে ত্রিদিব ও ত্রিযামার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো কয়েকটি ভীত সন্ত্রস্ত বিহঙ্গ।

-অরণ্যের এতখানি গভীরে,এই রাত্রিকালে খুরের শব্দ?
-এ শব্দ,এই ছন্দ আমার অতি পরিচিত ত্রিযামা।এ আমারই সৈন্যদল!রাজ্য বিপদগ্রস্ত।তাই বুঝি আমার অন্বেষণ হেতু তাদের এই আগমন!
-আমার গোষ্ঠীও কি তবে বিপদের সম্মুখীন?আমাকে এই মুহুর্তেই....

উল্কিতে সজ্জিত ত্রিযামার বাহু আপন দেহ অভিমুখে টেনে গভীর কণ্ঠে ত্রিদিব বললেন,

-আমার জীবদ্দশায় আমি বা আমার সৈন্য দ্বারা তোমার গোষ্ঠীর কোনো ক্ষতিসাধন অসম্ভব!

অপলক দৃষ্টিতে ত্রিদিবের পানে চেয়ে রইলো ত্রিযামা।ওর হরিণীর মতো ভ্রু-যুগলের মাঝে একটি ক্ষুদ্র সর্পিল উল্কির ওপর আপন ওষ্ঠ ও অধর ছুঁইয়ে দিলো ত্রিদিব।কম্পিত ললনার উপাঙ্গ।গাত্রবর্ণ রক্তিম।ইতিপূর্বে এক কামুক পুরুষের অত্যাচারের সঙ্গে পরিচিত সে,তবে ত্রিদিবের স্পর্শে যথেষ্টই প্রেম বর্তমান।সন্ধিহান নারীমন পূর্বের নির্মম অত্যাচারের পর,পুরুষ জাতির ওপর নির্ভর করার দুঃসাহস অর্জনে অক্ষম।তদুপরি নৃপতি নিজমুখে আপন চরিত্রের অন্ধকার দিকের কথা বর্ণনা করেছেন।

-আমাকে ফিরতেই হবে ত্রিযামা।রাজধানীতে,রাজধর্ম পালনে।যুদ্ধ আসন্ন।সৈন্যদলের প্রস্তুতি ও যুদ্ধ পরিচালনা আবশ্যক।তবে আমার আত্ম অনুসন্ধান সম্পূর্ণ।আমি মতি স্থির করেছি।যুদ্ধ পরবর্তী জীবনে আমি জীবিত থাকলে,তোমার কাছেই ফিরবো।এই মায়াকাননে।সেদিন আমায় শূন্য হাতে,বিদগ্ধ হৃদয়ে ফিরতে হবে নাতো!
-আপনার কিছু হবে না রাজা!আপনি যুদ্ধে জয়লাভ করবেন।মায়াকানন হবে শত্রুমুক্ত।মহাভৈরবী আপনার সহায় হন।
-আমি কালভৈরবের উপাসক।তবে তোমার ইচ্ছেপূরণ করতে অদূর ভবিষ্যতে মহাভৈরবীর মূর্তিও প্রতিষ্ঠিত হবে মোহরকুঞ্জে।অপচয় করার মতো সময় নেই ত্রিযামা!

বৃক্ষতলে রাজঘোটক বৈশ্বানর সৈন্যদলের দৃষ্টিগোচর হওয়ামাত্রই,শিঙায় ফুৎকারপূর্বক আপন রাজাকে আহ্বানের প্রচেষ্টায় মগ্ন হলেন সেনাপতি।একাধিক ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি ও সৈন্যের কোলাহলে ভয়ে তটস্থ সমগ্র গোষ্ঠী।কয়েকজন যাযাবর রমণী তরবারি হাতে সৈন্যের সঙ্গে আলাপচারিতায় উদ্যত হলেন....

শিঙাধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবেশমাত্র আপন দুই হস্ত মুখের সম্মুখে এনে অদ্ভুত শব্দ দ্বারা সংকেত প্রেরণপূর্বক,আপন উপস্থিতি জানান দিলেন ত্রিদিবাচার্য।তারপরই ফিরলেন ত্রিযামার কাছে।

-ত্রিযামা?
-আমি আপনার রাজ্যের জন্য,আপনার জন্য মহাভৈরবীর কাছে করজোড়ে প্রার্থনা করবো।মা অবশ্য আপনার সহায় হবেন।শত্রুদের পরাস্ত করে আপন রাজ্যের ভবিষ্যৎ,স্বর্ণাক্ষরে লিখবেন আপনি।
-যুদ্ধ পরবর্তী শান্তি বা সন্ধির পরই,আমি ফিরবো তোমার কাছে।আগামী কৃষ্ণপক্ষের পূর্বেই।আগামী কৃষ্ণপক্ষে এই দীঘির জলের আরশিতে আমি ত্রিযামার রূপ অবলোকন করতে বদ্ধপরিকর।তুমি সেদিন আর ফেরাবে না আমায়!আমি আসবো।এক পক্ষকালের ভিতর।

ত্রিযামা আপন মনের ঘরের গোপন সংবাদ জানে না।আকুল হৃদয় কাতর দৃষ্টিতে খানিক প্রেমের আবেদন জানালো ত্রিদিবের উদ্দেশ্যে।দীর্ঘদেহী সেই পুরুষের দৃষ্টি ওই আবেদনে সাড়া দিয়ে তৎক্ষণাৎ সিক্ত করলো ত্রিযামার অধর।মৃদুমন্দ গতিতে শীতল সমীরণ প্রবাহিত হচ্ছে।কম্পিত ওষ্ঠে ত্রিযামা বললো,

-আপন রাজ্যের রাজার সঙ্গে এক অভিশপ্ত রাত্রি যাপনের পর,রাজ্যের সকলে আমাকে বারাঙ্গনার সম্মানে ভূষিত করেছে রাজা।ওই একটিমাত্র রাত্রির কারণে,আমি কোনো পুরুষের সহগামিনী হওয়ার সৌভাগ্য হতে বঞ্চিত।রাজার কক্ষের অন্দরে একাধিক দ্বারপ্রহরীর সম্মুখে,সর্বসমক্ষে নগ্নিকা আমি।একটিমাত্র রাতে একাধিকবার একাধিক পুরুষের স্পর্শে পাপবিদ্ধা এই অবয়ব।আপনার মত মহান ক্ষত্রিয়কে উৎসর্গ করার মতো পবিত্র আমি নই।এ দেহ কলুষিত!আমি অপারগ।

পুনর্বার শিঙাধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবেশমাত্রই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ত্রিদিব।গাঢ় কণ্ঠে ত্রিযামাকে জিজ্ঞেস করলেন,

-ত্রিযামা কি পূর্বেই কোনো পুরুষ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত?
-সে ছিল একজন।আমাদের গোষ্ঠীরই এক সুঠাম পুরুষ।আমাদের আসন্ন বিবাহ ছিল সর্বজনবিদিত।কিন্তু ওই রাতের পর সে ত্যাগ করে আমায়।আমরা প্রাণ ও মান বাঁচানোর তাগিদে রাজ্য হতে পলায়ন করি।কিন্তু সে বিশ্বাসঘাতক আপন চাটুকারিতায় হয়ে ওঠে,ওই রাজার বিশ্বস্ত।
-তোমায় প্রত্যাখ্যান করে মেরুদন্ডহীন সেই পুরুষ আপন পুরুষালি অহং চরিতার্থ করেছে মাত্র।নিজেকে মানুষ প্রমাণ করতে পারেনি।আমিও একাধিকবার বিবাহ সূত্রে একাধিক নারীর সঙ্গে সহবাস করেছি ত্রিযামা।সকল রানির মুখশ্রী আমার স্মরণেও নেই।সর্বোপরি,বিবাহ বন্ধন ব্যতীত আমি একাধিক নারীতে আসক্ত।কিন্তু আমার জন্য তোমার পূর্বরাজ্যে কোনো নির্দিষ্ট বিশেষণ পাওয়া যাবে না।সকলের দৃষ্টিতে,আমি এক মহান ক্ষত্রিয়।তবে এবার আমি মুক্তি চাই।আর তা তোমার মাধ্যমেই।সময় বড় কম।ফিরতে হবে আমায়....আমি আবার আসবো!

ডাকিনী মায়ের কাছে আতিথেয়তা রক্ষায় অক্ষম ত্রিদিব ক্ষমা চেয়ে,ত্রিযামার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে,বৈশ্বানরের পৃষ্ঠদেশে আরোহণ করেন।লাগাম হাতে উল্কার বেগে রাজধানী অভিমুখে ধেয়ে যায় ত্রিদিব....

-তারপর?তারপর কি হলো?

উত্তেজিত সপ্তপর্ণীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মায়াকাননের দিক হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে নলিনীদেবী বললেন,

-দিন কাটে,রাত যায়।কিন্তু ত্রিদিবের আর কোনো খবর আসে না।
-উনি আর ফেরেননি?তবে কি যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিলেন?

লোকমুখে শোনা রাজপরিবারের গল্পকথা,সভয়ে আউড়ে গেলেন নলিনীদেবী।

বিরহের প্রতিটি নিশিকাল একাকিনী কাটে ত্রিযামার।মায়ের অগোচরে আপন গোষ্ঠীর সীমানা পেরিয়ে রাজ্যের সংবাদ অন্বেষণের দুঃসাহসকে,মনে স্থান দিতে সাহস হয় না।কিন্তু অন্তরে ব্যাকুল হয়ে ওঠে নারীমন।ত্রিযামা উপলব্ধি করতে পারে,এই বিরহবেদনা বুঝি পূর্বরাগের লক্ষণ।এক পক্ষকালের নির্দিষ্ট সময়সীমা আসন্ন।আজ রাতই কৃষ্ণপক্ষের সেই রাত।কিন্তু সেই কান্তিময় পুরুষের সুশোভন মুখখানি দেখার সৌভাগ্য বুঝি,ত্রিযামার এ জীবনকালে আর হবে না।সমরবিজয়ী রাজাধিরাজ আপন অন্দরমহলে পূর্ব রানিদের সঙ্গে সুখশয্যায় বড়ই আনন্দিত।মায়াকাননের এই অভাগিনীর কথা বিস্মৃত হয়েছেন তিনি।দীঘির পাড়ে কৃষ্ণপক্ষের চোখজুড়ানো অপরূপ দৃশ্য অবলোকনপূর্বক,একজোড়া সারঙ্গ দম্পতির নিভৃত সঙ্গম উপভোগ করছিলো ত্রিযামা।হঠাৎই নিকষ কালো রাতের অন্ধকারময় নৈঃশব্দকে ছিন্ন করে অশ্বখুরের শব্দ ধেয়ে এলো।সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সেই মুহূর্তেই ত্রিযামা ওই শব্দের অভিমুখে চঞ্চল পদচারণা শুরু করে।অনতিদূরেই সে দেখে,ঘনঘোর অমানিশা ভেদ করে বৈশ্বানরের পৃষ্ঠদেশে আরোহণ করে রাজা আসছেন।বনানী একটু অগভীর হতেই ঘোড়ার পৃষ্ঠদেশ হতে নেমে পড়েন ত্রিদিব।তমসাবৃত রাতেও আপন প্রেমাস্পদকে চিনে নিতে এতটুকু অসুবিধে হয়না ত্রিযামার।ত্রিদিবের বুকের ওপর আপনাকে বিসর্জন দিয়ে,অশ্রুজলে ভেসে যায় ত্রিযামার দুটি চক্ষু....

-ভেবেছিলাম সবই আমার অদৃষ্ট!ক্ষণিক সুখ।আপনাকে কোনোকালেই আর দেখতে পাবো না।কিন্তু আমার ললাটলিখনে যে আপনার সঙ্গে পুনর্মিলনও খোদাই করা ছিলো,এ আশাতীত।আপনি সত্যিই ফিরেছেন?!
-মন বলছিলো যে স্থানে তোমায় রেখে গিয়েছিলাম,সেই স্থানেই ফিরে পাবো।তাই সর্বাগ্রে এখানে এসেছি।মায়ের সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয়নি।
-যুদ্ধ?
-আমি জয়লাভ করেছি।রাজ্য বিপদমুক্ত।দুপক্ষের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সন্ধির মাধ্যমে বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ে শর্তসাপেক্ষে মিলনচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।রাজধানীতে শান্তি বিরাজ করছে।এবার আমি তোমাকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাবো।গ্রহণ করো আমায়!রাজ্যে ফিরেই আমি তোমায় বিবাহ....
-মা?
-সকলেই যাবেন।আমি তোমার সম্মতির অপেক্ষা করছি।

শান্ত দীঘির পানে চাইলো নিরুত্তর ত্রিযামা।আপন হৃদয়ের প্রেমমাধুরীর সহিত গোপন অভিলাষ মিশ্রিত উষ্ণতা,চুম্বনরূপে ত্রিদিব এঁকে দিলেন ত্রিযামার ওষ্ঠে।

-ত্রিযামা?

ময়ূরের কর্কশ কেকাধ্বনি রাতের নৈঃশব্দ ভঙ্গ করলো।অপরিচিত নিশাচর প্রাণীর আপন সঙ্গীকে আহ্বানের সুমধুর শব্দে প্রকৃতি মুখরিত।ত্রিদিবের ন্যায় অন্ধকারাচ্ছন্ন মায়াকাননের প্রতিটি বৃক্ষতলের অজস্র দীপ্তিময় পতঙ্গ অপেক্ষা করছে,ত্রিযামার সম্মতির।ক্রন্দনরতা ত্রিযামা ত্রিদিবের কন্ঠলগ্না হয়ে আপন ওষ্ঠ দ্বারা স্পর্শ করলেন ত্রিদিবের অধর।দীঘির পাড়ে কৃষ্ণপক্ষের ওই অন্ধকার রাত্রিকালে,ত্রিযামার দেহপল্লবের প্রতিটি সোপান সফলভাবে উত্তরণ করলেন কর্দমাক্ত রাজাধিরাজ ত্রিদিবাচার্য।বৈশ্বানর বনানীর অন্ধকারময় স্থানের এক বৃক্ষতলে চক্ষু মুদে দাঁড়িয়ে রইলো।সঙ্গমরত শম্বর দম্পতি বহু পূর্বেই অদৃশ্য হয়েছে দুর্ভেদ্য অরণ্যের গভীরে।ত্রিযামার নগ্ন কোমল কটিদেশ ও পৃষ্ঠদেশ পাথুরে মৃত্তিকার ঘর্ষণে ছিন্নভিন্ন হতে লাগলো।সঙ্গিনীর করুণ আর্তনাদেও ত্রিদিব কর্ণপাত করলেন না।মানবীর দেহনিঃসৃত বন্য সৌরভে অবগাহন করলেন ত্রিদিব।ত্রিযামার নাতিদীর্ঘ কেশরাশির অগ্রভাগ দীঘির শীতল জলস্তর স্পর্শ করলো।সঙ্গমরত ওই নারী-পুরুষের ঈষদুষ্ণ কায়া স্পর্শপূর্বক,অরণ্য অভিমুখ হতে উন্মত্ত প্রভঞ্জন প্রবাহিত হতে লাগলো।সঙ্গমসুখে পরিশ্রান্ত প্রেমাস্পদ যখন পরস্পরকে অব্যাহতি দিলো প্রেমের উষ্ণতা হতে,ত্রিযামা আপন ঘর্মাক্ত গাত্র কিঞ্চিৎ শীতল করার অভিপ্রায়ে শান্ত দীঘির অতলে বিলীন হলো।অতঃপর সেই কৃষ্ণকায় জলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন ত্রিদিব নিজেও।দুই ক্লান্ত নরনারীর ভালোবাসা ও জলকেলির সাক্ষী রইলো মায়াকাননের সমগ্র প্রাণীজগৎ ও ঘনঘোর অমানিশা....

-তারপর ত্রিযামা মোহরকুঞ্জে এলেন?মা!?

লবণাক্ত জলে নলিনীদেবীর দুই চক্ষু ভরে উঠেছিলো।কম্পিত কণ্ঠে তিনি বললেন,

-হ্যাঁ!আর ওই মূর্খ ত্রিযামার হাত ধরেই দুঃস্বপ্নের মতো এলো মোহরকুঞ্জের সমাপ্তিকাল।
-ত্রিযামা মূর্খ!!অর্থাৎ?
-ত্রিযামার কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ত্রিদিব,ডাকিনী মা সহ গোষ্ঠীর সকলকে যথোপযুক্ত সম্মান প্রদানপূর্বক আপন রাজ্যে আশ্রয় দেন।এক অতি সামান্য যাযাবর বন্য নারীকে রানিরূপে,রাজপরিবার উদারচিত্তে গ্রহণ করতে পারে না।পূর্বের সকল রানির চক্ষুশুল হয়ে দিনের সিংহভাগ মুহূর্ত যাপন করতো নববিবাহিতা ত্রিযামা।সকল উপহাসের যথাযোগ্য উত্তর প্রদানের পূর্বেই,বিধাতাপুরুষ আপন হস্তে রচনা করে ফেললেন মোহরকুঞ্জের দুর্ভাগ্যের মানচিত্র।প্রাসাদের আনাচে-কানাচে মৃদু গুঞ্জন,অন্তঃসত্ত্বা কনিষ্ঠা রানি ত্রিযামা।পূর্বের সকল রানির সমস্ত দর্প এই একটিমাত্র সংবাদেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো।আনন্দে দিশেহারা হয়ে এতকাল পর একটি সুস্থ পুত্রসন্তান লাভের আশায় বুক বাঁধলেন ত্রিদিব।সিংহাসনের উত্তরাধিকারী,রাজ্যের ভবিষ্যৎ রাজার শুভাগমনের জন্য রাজ্যবাসী অপেক্ষা করতে লাগলো প্রতিনিয়ত।অতঃপর ত্রিযামার গর্ভযন্ত্রণাকালীন কালরাত্রি আগমনের মাধ্যমেই শুরু হলো মোহরকুঞ্জের অবশ্যম্ভাবী পতন।জন্ম হলো ভুবন আলো করা এক কন্যাসন্তানের।ত্রিদিব তার মুখদর্শন করলেন না।নাড়ি হতে সদ্য পৃথক করা সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে মূর্খ ত্রিযামা এতকাল পর বুঝলেন,ত্রিদিবের সকল ভালোবাসা ভ্রান্ত,ছলনা মাত্র!আত্ম অনুসন্ধান নয়,রাজার স্বাদবদলের নবনবীন নারীশরীরের সন্ধান সম্পূর্ণ হয়েছিলো ত্রিযামাকে পেয়ে।যাকে প্রেমরূপে ভ্রম হয়েছিলো ত্রিযামার।ত্রিদিবের উপরি পাওনা ছিলো সন্তানলাভ।কিন্তু সেই সন্তান কন্যা হতেই,মুখ ফিরিয়েছেন ত্রিদিব।রাত্রি শেষের প্রভাতে আপন প্রথম সন্তানকে আর বুকের উষ্ণতায় ফিরে পায়নি ত্রিযামা।পরম বিশ্বস্ত দাসী হতে প্রাপ্ত সংবাদে ত্রিযামা পরবর্তীতে জানতে পেরেছিলো,সেই কন্যার ললাটলিখনে অঙ্কিত হয়েছিলো পর্ণশয্যা ও মৃত্তিকার অতলে চিরনিদ্রা।ওই সংবাদ শ্রবণমাত্রই জ্ঞান হারিয়েছিলেন ত্রিযামা।ধীরে ধীরে ত্রিদিবের কঠোর,নৃশংস ও নির্মম দিকের সঙ্গে ত্রিযামা পরিচয় লাভ করেছিলো।দ্বিতীয় কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার পর প্রতিবাদী বিদ্রোহী ত্রিযামার স্থান হয়েছিলো মোহরকুঞ্জের কারাগৃহে।চরিত্রহীন কামুক রাজা পূর্বের ন্যায় একাধিক নারীসঙ্গে ব্যস্ত হলেও,বিশেষ কিছু সময় কারাগারে বন্দিনী ত্রিযামার সঙ্গে যাপন করতেন।উত্তরসূরী প্রাপ্তির আশায়,ত্রিযামাকে মুক্তি দেননি তিনি।দীর্ঘকাল যাবৎ শারীরিক অত্যাচার সয়ে
একে-একে সাতটি নিষ্পাপ কন্যাসন্তানকে জন্ম দেয় ত্রিযামা।কারাগারে ত্রিদিবের বলপূর্বক ধর্ষণের ফলে ত্রিযামা আপন গর্ভে অষ্টমবার সন্তান ধারণ করে।সপ্তম গর্ভের কন্যাসন্তানটি জন্ম দেওয়ার পর,তাকেও একই পন্থায় হত্যা করা হলে,কারাগার থেকে পলায়নের উপায় ভাবতে শুরু করে পাগলিনী ত্রিযামা।মুক্তির জন্য কাতর সে।অতঃপর অষ্টম গর্ভের সন্তান আপন উপস্থিতি জানান দিতেই,ওই ক্ষুদ্র একরত্তি প্রাণকে বাঁচাতে ত্রিযামা বদ্ধপরিকর হয়।প্রহরীর নিকট ডাকিনী মায়ের কাল্পনিক গল্পকথা,মিথ্যে স্বপ্নাদেশ ও অভিশাপের ভয় দেখিয়ে,ডাকিনী মাকে কারাগৃহে একটিবার আনতে সমর্থ হয় সে।অতঃপর দ্বিতীয়বার ত্রিযামার মঙ্গল কামনায় পুজোর ফুল ও প্রসাদের দোহাই দিয়ে পুনরায় কারাগৃহে প্রবেশ করেন ডাকিনী মা।প্রবেশকালে দুই প্রহরীকে আশীর্বাদপূর্বক প্রসাদ বিতরণ করলে,স্বল্পক্ষণের মধ্যেই বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয় ওই দুই দ্বাররক্ষীর।পূর্ণ গর্ভবতী ত্রিযামাকে সঙ্গে নিয়ে যখন ডাকিনী মা কারাগার পরিত্যাগ করেন,তখন প্রকৃতি অকালে রুদ্ররূপ ধারণ করেছে।রাজ্যের রাজার পাপের ঘড়া সেই ক্ষণে পরিপূর্ণ।এইসকল ঘটনাপ্রবাহ হতে বহুদূরে অবস্থিত ত্রিদিবাচার্য সেই মুহূর্তে আপন শয়নকক্ষে,মদিরা সহযোগে একাধিক নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত যাপনে অতিশয় ব্যস্ত...

-তারপর?কি ছিলো রানির গর্ভে?পুত্র?
-তারপর?!

অচিরেই ত্রিযামার সন্ধানে রাজার সৈন্যদল রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।নগরের উপকন্ঠে ওই যাযাবর গোষ্ঠীর ক্ষুদ্র গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।বন্দী করা হয় গোষ্ঠীর সকল সদস্যকে।কিন্তু সন্ধান পাওয়া যায় না ত্রিযামার,এমনকি নিরুদ্দেশ বৃদ্ধা ডাকিনী মাও....

আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে।ঘনঘন বিদ্যুতের ঝলকানি ও মেঘের গুরুগম্ভীর গর্জন।খরস্রোতা নদীর দুকূল প্লাবিত।সেই কালরাত্রিতে প্রকৃতির তীব্র রোষের সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে সিক্ত ত্রিযামার গর্ভযন্ত্রণাও।তুমুল ঝড়-বাদলের মধ্যে চকিতেই আঁধার কাটিয়ে আলোকিত হয়ে উঠলো চতুর্দিকের পৃথিবী।রুদ্রদেব কৃপাদৃষ্টি দান করলেন অদূরেই একটি সুউচ্চ বৃক্ষের উপর।বিদ্যুৎপিষ্ট হয়ে ভেঙে পড়লো সেই সুবিশাল বনস্পতির একটি বৃহৎ শাখা।অজস্র অসহায় খেচর প্রজাতি হলো গৃহহারা।ত্রিযামার মস্তকের একেবারে সম্মুখেই ভেঙে পড়েছে ওই শাখা।মৃত্যুভয়ে ত্রিযামা অন্তিম ক্ষণে দুটি চক্ষু বন্ধ করে ফেলেছিলো।চক্ষুদ্বয় উন্মোচনের পরই পারিপার্শ্বিক দৃশ্য দেখে,সভয়ে চিৎকার করে উঠলো ত্রিযামা।অদূরেই বৃক্ষশাখার মধ্যে ডাকিনী মায়ের নিথর রক্তাক্ত দেহ পড়ে রয়েছে।পৃষ্ঠদেশের ওপর ওই বৃহৎ শাখা ভেঙে পড়ায়,মুহূর্তেই প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন মা।শোকে কাতর হয়ে একাকিনী ত্রিযামা মায়াকাননের গভীরে শিউরে উঠলো ভয়ে।আপনার অশ্রু বিসর্জন দিয়ে নিঃশব্দে সহ্য করতে লাগলো গর্ভযন্ত্রণা।অত্যধিক কষ্টে আপনার মুখগহ্বর আপনি চেপে ধরলো।হিংস্র জন্তুর হাত থেকে রক্ষা পেতে ও গর্ভের সন্তানকে রক্ষা করতে নৈঃশব্দের পথ বেছে নিলো ত্রিযামা।অদূরেই পুনরায় বিদ্যুতের ঝলকানি।প্রকৃতির রুদ্ররূপের সঙ্গে বেশিক্ষণ যুঝতে পারলো না সে।আপনার মুখ বন্ধ করলেও,প্রায় জ্ঞান হারানোর সময় উপস্থিত হলে ক্লান্ত ত্রিযামা শুনলো এক সদ্যোজাত শিশুর ক্রন্দনধ্বনি।আপন সন্তানকে বুকে তুলে নিলো ত্রিযামা।বিদ্যুতের আলোয় প্রকৃতির রুদ্ররূপের মাঝেই আপনার অষ্টম গর্ভের কন্যাকে প্রথমবার দেখলো মা।শিশুকন্যাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ত্রিযামা বলে উঠলো,

-আমার রুদ্রাণী!মা আমার!

ক্রন্দনরতা শিশুর ক্ষুদ্র মুখগহ্বরে আপন স্তনবৃন্ত উজাড় করে দিয়ে,ডাকিনী মায়ের মৃতদেহের পানে চেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু বিসর্জন করলো ত্রিযামা।কিছুক্ষণ বিশ্রাম গ্রহণের পরই ক্লান্ত রক্তাক্ত অবস্থায়,আপন সন্তানের জীবনরক্ষার্থে আপন পদযুগল চালনা করতে শুরু করলো সদ্যোজাতিকার মা।অন্তিমবারের মতো মোহরকুঞ্জের উদ্দেশ্যে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললো,

-নারীর অসম্মানের এই মূল্য তোমাকে আপন জীবন,আপন সিংহাসন,আপন রাজ্য দিয়ে পরিশোধ করতে হবে ত্রিদিবাচার্য!!তোমার পুরুষালী অহং,তোমার এই পিতৃতান্ত্রিক শাসনকাল অচিরেই এক নারীর কারণে ধ্বংস হবে!ভবিষ্যতে ইতিহাসের পাতায় অভিশপ্ত মোহরকুঞ্জের আর কোনো অস্তিত্বই থাকবে না....ইতিহাস তোমার নামের সঙ্গে,নারী অবমাননার নির্মম অধ্যায়কেই স্মরণে রাখবে চিরকাল! 

শিশু রুদ্রাণীকে বুকে জড়িয়ে,আপন শুষ্ক স্তনবৃন্ত তার মুখে রেখে,রক্তাক্ত দেহে নগ্নপদে বনানীর দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে মোহরকুঞ্জের সীমানা অতিক্রম করেছিলো একাকিনী ত্রিযামা।ভালোবাসার ভ্রমে মুহূর্তের সামান্য দুর্বলতার মূল্য,আপন জীবন দিয়ে পরিশোধ করেছে ওই মূর্খ নারী....

রাজপরিবারের অতীত ইতিহাস সম্পূর্ণরূপে অবগত হওয়া মাত্রই,কম্পিত দেহে ডাকলো রাজকুমারী পর্ণা....

-মা?!কি বলছো তুমি?
-এ রাজ্যের অতীত বৃত্তান্ত।নারীর অসম্মান করে কোনো রথী-মহারথী,কোনো ঈশ্বরপ্রদত্ত মহাপুরুষও অব্যাহতি পায়নি পর্ণা।সেক্ষেত্রে এই ত্রিদিবাচার্য তো তুচ্ছ এক দুরাচারী ক্ষত্রিয় পুরুষ!তার পতন ছিলো অবশ্যম্ভাবী।এ ক্ষণে সমস্ত বিষয় অবগত হওয়ার পর,তুমি বুঝেছো আশা করি!এ কাহিনীর সঙ্গে তোমার যোগসূত্র ঠিক কোথায়!
-অষ্টম গর্ভের সন্তান আমি,জন্মকালে প্রকৃতির চরম রুদ্ররূপ,মা.....ত্রিযামা আর রুদ্রাণী?
-ওই রাতের পরই নিরুদ্দেশ হয় তারা।পরবর্তী কয়েক বৎসরকাল যাবৎ তাদের আর কোনরূপ সন্ধান মেলেনি।রাজরক্ত বইছে রুদ্রাণীর শিরা-উপশিরায়।দীর্ঘ অন্বেষণের পর সকল প্রচেষ্টায় অহেতুক বারিবর্ষণ উপলব্ধি করে,স্থগিতাদেশের নির্দেশ দিয়েছিলেন ত্রিদিবাচার্য।অতঃপর শীঘ্রই মোহরকুঞ্জে নেমে আসে একের পর এক বিপর্যয়।হিমশৈল পর্বতে প্রাকৃতিক কারণে ধস নেমে মোহরকুঞ্জের প্রকৃত মানচিত্রই বদলে যায়।রাজ্যের উত্তরপ্রান্ত পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে।অপরদিকে রাজধানীতে অজানা রোগের প্রকোপে শুরু হয় মৃত্যুমিছিল।মহামারীর ত্রাণকার্যে রাজার প্রায় সিংহভাগ রাজকোষ শূন্য হয়ে যায়।এই দুঃসংবাদ শত্রুরাজ্যে পৌঁছতে অধিক বিলম্ব হয় না।যুদ্ধ পরিচালনার মতো কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে, মোহরকুঞ্জের রাজা এই ক্ষণে অপারগ।এই অপারগতার সুযোগ নিয়ে বহির্বিশ্বের কিছু শত্রুরাজ্য একজোট হয়ে আক্রমণ করে মোহরকুঞ্জে।কুটিল রাজনীতি,
কূটনীতি,ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের যোগ্য জবাবদিহি করতে না পারায়,রাজসিংহাসনচ্যুত হন মোহরকুঞ্জের অধীশ্বর ত্রিদিবাচার্য।রাজ্য হয় পরাধীন।অতঃপর শোনা যায়,দীর্ঘকাল রোগভোগের পর আপন রাজ্যের কারাগারের অন্ধকারে,প্রায় অনাহারেই প্রাণত্যাগ করেছিলেন বৃদ্ধ নৃপতি।
-আর তারা?
-পরবর্তীতে রুদ্রাণী হয়ে উঠেছিলো একজন সেরা তীরন্দাজ।লক্ষ্যভেদে তাকে পরাজিত করা বড় সহজ ছিলো না।লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে,আপন কন্যাকে উপযুক্ত শিক্ষায় গড়ে তুলেছিলেন ত্রিযামা।শিক্ষায়,যুদ্ধবিদ্যায়,নৃত্যকলায় অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন রুদ্রাণী।দীর্ঘকাল যাবৎ আপন পিতৃ-পরিচয় জানতে চাওয়া কন্যাকে উপযুক্ত হওয়ার পর,মোহরকুঞ্জের পূর্ব বৃত্তান্ত বলেন ত্রিযামা।অতঃপর গল্পকথায় শোনা যায়,সুদীর্ঘ সময়কাল ব্যাপী রুদ্রাণী এক শক্তিশালী গোষ্ঠী গঠন করেন ও একাধিকবারের প্রচেষ্টায় আপন রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন।যুদ্ধজয়ের পর মোহরকুঞ্জের সিংহাসনে আধিপত্য বিস্তার করেন প্রথম মহারানি রুদ্রাণী।ধ্বংস করা হয় মোহরকুঞ্জের আরাধ্য পুরুষদেবতা কালভৈরবের প্রস্তরমূর্তি।দেবী মহাভৈরবীর করালমূর্তি স্থাপন করার মাধ্যমেই পিতৃতান্ত্রিক রাজ্যের পতন ও মাতৃতান্ত্রিক রাজ্যের শুভ সূচনা হয়।ত্রিযামা ও রুদ্রাণী সম্মিলিতভাবে এই রাজ্যের নব নামকরণ করেন মায়াকানন।ইতিহাসের পাতায় এক নব অধ্যায়,নবরূপে সংযোজিত হয়....রচিত হয় নতুন সংবিধান।
-এই খরস্রোতা নদী তবে...
-রুদ্রাণীর স্মৃতি বহন করছে।মৃত্যুকালে মহারানি রুদ্রাণী প্রলাপের ঘোরে বলেন,এই রাজ্যে দ্বিশত বৎসর ভবিষ্যতে,প্রায় অনুরূপ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে।সপ্ত পুত্রের তেজরাশি আপন দেহে বহন করবে এক শিশুকন্যা।পর্ণশয্যা পরাজিত হবে তার সম্মুখে।সেই কন্যার নামকরণ করতে হবে সপ্তপর্ণী।একইরূপে প্রকৃতির রুদ্ররূপ জানান দেবে তার আগমনবার্তা।মহারানি পর্ণার সিংহাসনে আরোহণের পরবর্তী সময়ে,তার শাসনকালে মায়াকাননের মানচিত্রে আসবে সুবিশাল পরিবর্তন।তবে সেই কন্যার সুষ্ঠুভাবে জন্মানোর পথ প্রশস্ত করতে ও সিংহাসন লাভের সমস্ত বাধা-বিপত্তি দূর করতে,এ রাজপরিবারে কোনো পুরুষ সন্তানকে জন্মের পর অধিকসময় জীবিত রাখা হবে না।সকলের ভবিতব্যে থাকবে অভিশপ্ত পর্ণশয্যা।নতুবা সেই পুরুষই হবে মায়াকাননের ধ্বংসের কারণ।এ রাজ্যের সিংহাসন ভবিষ্যতে আর কোনোদিনই কোনো পুরুষের অধীনে যাবে না।এই বিষয়ে সতর্কতার সঙ্গে সকল ক্রুরতম পথ অবলম্বন করতে হবে।

অশ্রুজলে ভেসে গেলো পর্ণার দুই চক্ষু।মায়াকাননের আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা....

-আমি!কিভাবে মা?
-তোমার সকল প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতে অপেক্ষা করছে পর্ণা,তা এই ক্ষণে আমারও অজানা।আমি শুধু এই বিষয়ে অবগত,দুই শতাব্দীরও অধিক সময়কাল ধরে মায়াকানন তোমার জন্যই অপেক্ষা করছে।তোমার সিদ্ধান্তের ওপরেই নির্ভর করবে মায়াকাননের ভবিষ্যৎ।আজ রাজমুকুট তোমার মস্তকে সমর্পণ না করার কারণ কি তুমি,কিছুমাত্র অনুধাবন করতে পারছো পর্ণা?
-আমি এখনও এ গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য উপযুক্ত নই।
-যথার্থই।তুমি শুধুমাত্র রানি নও পর্ণা,তুমি এই মায়াকাননের পরিত্রাতা।সর্বাগ্রে নিজেকে প্রস্তুত করো।তোমার একটিমাত্র ভুল সিদ্ধান্ত রাজ্যের জন্য ক্ষতিকর।প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটছে।বৃষ্টি আসবে বুঝি!উন্মুক্ত স্থানে থাকা নিরাপদ নয়।ভিতরে এসো!
-সকল প্রশ্নের উত্তর তবে আমি?
-রাজ্যবিস্তার?সপ্তপর্ণী।পরিত্রাতা?সপ্তপর্ণী।সন্তানসম সকল প্রজার মা?সপ্তপর্ণী।বিপদকালে উদ্ধারকর্ত্রী?সপ্তপর্ণী....সকল প্রশ্নের উত্তর তুমিই পর্ণা।তাই তোমাকে শুধুমাত্র আত্মরক্ষা নয়,কঠিন সিদ্ধান্ত ও যুদ্ধবিগ্রহের সম্মুখীন হতে হবে।নিজেকে বজ্রকঠিন রূপে প্রস্তুত করতে হবে।তারপর উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা।আমার আশীর্বাদ সর্বদা তোমার সঙ্গেই থাকবে পর্ণা।মহাভৈরবী তোমার সহায় হোন।মায়াকানন থাকুক শত্রুমুক্ত।

অবনত মস্তকে মাকে অভিবাদন জানালেন রাজকুমারী পর্ণা।নলিনীদেবী আপন কক্ষ অভিমুখে প্রস্থান করলে,তমসাবৃত নভোমন্ডল পানে দৃষ্টিপাত করলেন রাজকুমারী সপ্তপর্ণী।সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য উজ্জ্বল নিশাপতি।বৃষ্টি নামলো মায়াকাননের আকাশ ভেঙে।উন্মুক্ত আকাশের নীচে আপনাকে এলিয়ে দিয়ে,বৃষ্টির জলে আপন দেহপল্লব পর্ণা সিক্ত করলেন।আবছা দৃষ্টিতে অপলক চেয়ে রইলেন অন্ধকারাচ্ছন্ন নিষিদ্ধ মায়াকাননের পানে।সকল প্রকার অভিশপ্ত ঘটনাপ্রবাহের সূত্রপাত ওই মায়াকাননের অন্দরমহলেই।দুর্ভেদ্য মায়াকাননের প্রতি এক তীব্র অদৃশ্য টান অনুভব করলেন পর্ণা।রাজপরিবারের দায়িত্ব ও কর্তব্য নামক স্বর্ণ-শৃঙ্খলে আবদ্ধ পর্ণা,উদ্বেলিত হৃদয়ে উপভোগ করতে লাগলেন বারিধারার শীতল স্পর্শ....তবে নারীহৃদয় হতে নির্গত দীর্ঘশ্বাস স্পর্শ করতে পারলো না ওই অরণ্যকে....

অদূরেই মায়াকাননের নীরব হাতছানি....

(চলবে)

ছবি : সংগৃহীত

৭টি মন্তব্য:

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট