অনুসরণকারী

শনিবার, ১০ অক্টোবর, ২০২০

নির্বাক (পঞ্চম পর্ব)


 



নির্বাক


সাথী দাস


পঞ্চম পর্ব







-ডাকলে শুনতে পাও না নাকি গো!বলছি ওপরে এসো, আমার কাপড়খানা,মামনির জামাটা দেখে যাও একটু।

সৌদামিনী দেবী হাসিমুখে চৈতীর সঙ্গে তিনতলায় উঠে গেলেন....

বাড়ি থেকে বেরোতে আজ বেশ কিছুটা দেরিই হয়ে গেছে রাত্রির।রাস্তায় বেরিয়েই হুড়োহুড়ি করছিলো ও।গত এক বছর ধরে স্টুডিও-পাড়ায় রাত্রির যাতায়াত শুরু হয়েছে।রেডিও জকি হিসেবে কাজটা শুরু করার পর থেকেই,নতুন-নতুন অনেক কাজের সুযোগ আসছে রাত্রির সামনে।সকালের দিকে এই একটা শো থাকে,তারপর দুপুরের পর আরও একটা।এছাড়াও গত দুমাস ধরে টিভির পর্দায় একটা সান্ধ্য কুইজের অনুষ্ঠানে,সহ-সঞ্চালনার অনুরোধ আসছে।কিন্তু আরও কতগুলো সৃজনশীল কাজে একটু ব্যস্ত থাকায়,আপাতত ওই অনুরোধগুলো ঠেকিয়ে রেখেছে রাত্রি।তথাকথিত শিক্ষিত-আধুনিক পাত্রের বাড়ি থেকে ওর কাজ করা নিয়ে কোনো অসুবিধে নেই।বরং ওরা রাত্রির কর্মজীবনে বেশ খুশিই।কিন্তু কাজটাই কি সব?আর সুখ?বিয়ের পর হয়তো চরম একাকীত্বের জীবনে মানিয়ে নিতে হবে রাত্রিকেই।তখন কি ওর আরও বেশি করে নীলদার কথা মনে পড়বে?!কি করে মনে পড়বে?কোনোদিন তো ভুলতেই পারেনি তাকে।ও সত্যিই এই মুহূর্তে বিয়েটা করতে চায় কিনা,সেই প্রশ্নের উত্তর রাত্রি নিজেও জানে না।শুধু এটুকু জানে,আজও নীলদার কথা মনে পড়লেই চোখের জল বড় বেশিই অবাধ্য হয়ে ওঠে....বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালো ও।একটু আগেই বাসটা বেরিয়ে গেছে।আবারও পনেরো মিনিটের অপেক্ষা।চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো রাত্রি।ওর সামনে এসে দাঁড়ালো একজোড়া কপোত-কপোতী।কলেজ পড়ুয়া হয়তো।রাত্রির বেশ লাগছিলো ওদের খুনসুটি দেখতে।ছেলেটি তার মেয়েটির লম্বা বিনুনীটা টেনে ধরলে,মেয়েটা ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো ছেলেটির পিঠে...মৃদু হেসে ফেললো রাত্রিও।পিছনে বসে নিজের ব্যাগটা কোলের ওপর রেখে,ও হারিয়ে গেলো অতীতে...

-শোন রাত্রি!মা কিন্তু ঠাম্মির সঙ্গে অনেক ঝামেলা করে তোকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে।এরপর তুই যদি ফাঁকি মারিস না,তোর চুল টেনে ছিঁড়ে দেবো কিন্তু....
-মণিমা!নীল দা আবার আমার চুল টেনে ধরছে!
-এই চুপ!নালিশ করছিস কেন?শুধু নালিশ না!!তুই যখন ঘুমিয়ে থাকবি,তোকে একদম ন্যাড়া করে দেবো!
-ও মণিমা....
-এই মেয়ে!এত চিৎকার করছিস কেন রে?মা ঠাকুর পুজো করতে বসেছে না?
-সরি পিসিমনি!রাত্রি আর চেঁচাবে না।আমিই ওকে মারছিলাম।আর মারবো না!
-নীল শোন?
-বলো পিসিমনি?
-তোর স্যার তোকে আজও তোকে পড়াতে এলো না তো?সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হয়ে গেলো যে!
-আজ তো স্যার আসবে না পিসিমনি!
-কেন?
-স্যারের জ্বর হয়েছে।ওই জন্যই তো আমি রাত্রিকে পড়াচ্ছিলাম আর মারছিলাম।একদম পড়ে না!ভীষণ ফাঁকিবাজ।
-কবে থেকে জ্বর?আমাকে বলিসনি তো!
-যাঃ বাবা!স্যারের জ্বর তো তোমাকে বলবো কেন?তুমি কি স্যারের ছাত্রী নাকি!পড়ি তো আমি আর রাত্রি!স্যার পড়াতে এলো কি না এলো,সেসব জেনে তুমি কি করবে?!
-এই নীল!খুব মুখে-মুখে কথা শিখেছিস না রে!!যেটা জিজ্ঞেস করবো,শুধু সেটুকুরই উত্তর দিবি।এত একঝুড়ি কথা তোকে কে বলতে বলেছে রে!কবে থেকে জ্বর তার?এখানে তো একা-একা ওই মেসে পড়ে থাকে।কি খাচ্ছে,ডাক্তার দেখিয়েছে কিনা,সেই খোঁজ নিয়েছিস?আমার স্যার,আমার স্যার বলে তো খুব লাফাচ্ছিস!জানিস সেসব কিছু?
-নাতো...কাল আসেনি,তাই বাবা ফোন করেছিলো।ওসব আমি জানবো কি করে!আমি শুধু জানি স্যার কদিন আসবে না।এতকিছু তো জানি না!!
-জানিস না যখন বেশি কথা বলবি না!কেউ কোনো খোঁজ রাখে না!!
-যাঃ বাবা!আমি কি করলাম!তুমি আমার ওপর এত চেঁচাচ্ছ কেন পিসিমনি?
-কিছুনা....যা পারিস কর!!

নীলের ঘর পেরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দুম করে দরজা বন্ধ করলো চৈতী...তখনই সৌদামিনী দেবী এসে ছেলের ঘরে ঢুকলেন....

-মা দেখো পিসিমনি...

চোখ বড় করলেন সৌদামিনী দেবী।চুপ করে গেলো নীল।মণিমার রাগ দেখে রাত্রিও নালিশ করতে ভুলে গিয়ে,তাড়াতাড়ি বই খুলে পড়ায় মন দিলো...মা সরে যেতেই আবার একবার রাত্রির চুল টেনে দিলো নীল...

-উফফ!
-চুপ...পড়!নইলে কাঁচি দিয়ে কুচ করে তোর বিনুনী কেটে দেবো!

বাস এসে যাওয়ায় অতীতের সুন্দর স্মৃতিচারণের হাতছানি উপেক্ষা করে,বাসের দিকেই তড়িঘড়ি এগিয়ে গেলো রাত্রি....

-এই শাড়িটা ভালো না বৌদি?

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেও,চৈতীর দিকে একভাবে চেয়ে রইলেন সৌদামিনী দেবী।ওনার নিজের দুচোখের পাতাও ভারী হয়ে এসেছে।এই হালকা হলদেটে রংটা চৈতী আজও ছাড়তে পারে না।বৌদির দৃষ্টি ননদ কতখানি পড়তে পারলো,তা জানা নেই সৌদামিনী দেবীর।কিন্তু উনি এগিয়ে গিয়ে চৈতীর হাতের ওপর হাত রাখলেন...

-ও মামী,খিদে পেয়েছে তো!

তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে এসে,চৈতীর একমাত্র কন্যা মামনিকে জড়িয়ে ধরে আদর করে নীচে নামলেন সৌদামিনী দেবী।এগিয়ে গেলেন ডাইনিং টেবিলের দিকে....হলুদ শাড়িটার ওপর হাত রেখে চুপ করে বসে রইলো চৈতী।সমস্ত ভালোবাসা আজও যেন হলুদ রঙয়ের মোড়কেই বন্দী হয়ে রয়েছে।বিছানা থেকে নেমে,নিজের ঘরের কাঁচের শো-কেস খুলে চৈতী বের করে আনলো ছোট্ট একটা মাটির রাধাকৃষ্ণের মূর্তি...এটা একদিন রাসের মেলা থেকে কিনে দিয়েছিলো সে....সেদিন মা গিয়েছিলেন কাকিমাদের বাড়ির রাধাগোবিন্দর পুজোয়।দাদা সেদিন,নীল-রাত্রি আর চৈতীকে নিয়ে বেরোচ্ছিলো মেলায় যাবে বলে।সেই সময়ই মাস শেষ হওয়ার আগে,নিজের প্রাপ্য বেতন থেকে কিছু টাকা আগাম নিতে,সে এসে দাঁড়ায় ওদের বাড়িতে।তাকে হাসিমুখে সেই টাকা দেওয়ার পর,সেদিন সন্ধ্যায় দাদার অনুরোধে সেও ওদের সঙ্গী হয়েছিলো।মেলার ভিড়ে নীল আর রাত্রির দৌড়াদৌড়ি-হুড়োহুড়ি সামলাতে দাদা যখন নাজেহাল হয়ে যাচ্ছিলো,তখন ওদের দুটিকে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলো একটা খেলনার দোকানের দিকে।সেই সময় চৈতালী ব্যস্ত ছিলো কিছু বাহারি গয়না-চুড়ির দোকানগুলোতে।একের পর এক দোকানী পসরা সাজিয়ে বসেছিলো মেলাপ্রাঙ্গনে।বেশ কয়েকটা কানের দুল দেখার পর,একজোড়া কানের দুল পছন্দ করায়,দোকানী সেদিন তার দিকে এগিয়ে দিয়েছিলেন একটা ছোট আয়না...

আয়নার সামনে ওই রাধাকৃষ্ণের মূর্তিটা হাতে নিয়ে দাঁড়ালো চৈতী।ওর অতীতটা জলছবির মতো এক মুহূর্তেই ভেসে উঠলো ওই আয়নায়...যুবতী চৈতী এসে হাজির হলো ওর সম্মুখে।মুহূর্তেই মনটা পৌঁছে গেলো মেলাপ্রাঙ্গনে....

-ও দাদা!শুনুন না,এটার ঝুমকোগুলো আর একটু বড় হবে না?এটা ভালো লাগছে না!
-না দিদি!এটা একটাই আছে।
-ওঃ!!কিন্তু এটা না আর একটু বড় হলে....

কানের ওপর দুলটা ধরে আয়নায় চোখ রেখেই,অবাক হয়ে গেলো চৈতী।একটু দূরে দাঁড়িয়ে সেই লাজুক যুবক চশমার ভিতর থেকে একভাবে ওর দিকেই চেয়ে আছে,আয়না দিয়ে চৈতী স্পষ্টই দেখলো।মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে চাইতেই,সে অন্যদিকে ফিরলো ঠিকই।তবে দাঁড়িয়ে রইলো ওইদিকেই....কানের ওপর আবার ওই দুলটা ধরলো চৈতী।তারপর চাইলো তার দিকে।সে আবার চেয়ে রয়েছে।একটু যেন ঠোঁটের কোণে আলগা হাসির ছোঁয়ায় পছন্দের ইশারা....দুলটা দোকানীর হাতে তুলে দিয়ে চৈতী বললো,

-এটাই দিন!

দুলটা হাতে নিয়ে মেলার অপর প্রান্তের দিকে এগোলো চৈতী।কিন্তু দাদা,রাত্রি বা নীল,কাউকেই খুঁজে পেলো না।

-এদিকে আসুন।ওরা ওই জিলিপির দোকানের ওদিকে আছে।
-আপনি দেখেছেন?
-হ্যাঁ।আমি তো খেয়াল রাখছিলাম কে-কোথায় যাচ্ছে!হারিয়ে গেলে এই ভিড়ে খুঁজে পাওয়াটাই তো মুশকিল!
-খুব খেয়াল রাখছিলেন তো!আমি দেখলাম,আপনি তো শুধু আমাকেই দেখেছিলেন!
-কি!!নানা...তা নয়!ওরা সত্যিই ওইদিকে আছে,আপনি আসুন!

অপ্রস্তুত হয়ে গেলো রুদ্রশেখর.....

-খুব তো মুখ লুকিয়ে পালাচ্ছেন রুদ্রদা!বাদামভাজা খাবেন নাকি?
-আসুন।আমি খাওয়াচ্ছি!
-থাক!মাস শেষ না হতেই দাদার থেকে মাইনেটা আগাম চেয়ে নিলেন।সেটা কি ছাত্রের পিসিমনিকে বাদামভাজা খাওয়ানোর জন্য?
-না!তা ঠিক নয়।আসলে বড্ড দরকার।মেসের দু মাসের টাকা বাকি পড়েছে।কিছু টাকা না দিলেই নয়।দুটো ছোট-বড় কথা বলে দিলে,বড় সম্মানে লাগে চৈতালীদেবী!
-আপনি চাকরীর চেষ্টা করছেন না কেন?
-করছি তো!করলেই কি আর চাকরী পাওয়া যায়,বলুন তো?আপাতত এই কয়েকটা টিউশনিই যা ভরসা।নিজের খরচ চালিয়ে,মেসের টাকা দিয়ে,তার ওপর গতমাসে মা অসুস্থ থাকায় বাড়িতে একটু বেশি টাকা পাঠাতে হয়েছে,তাই এইদিকে টান পড়ে গেছে।ওই জন্যই দাদার থেকে কিছু টাকা চেয়ে নিলাম।জানি রজতদা আমায় না বলবেন না!তাই সেই ভরসা থেকে বাইরে ধার না করে,মুখ ফুটে চেয়েই ফেললাম।
-বেশ করেছেন।প্রয়োজন হলে আবার চাইবেন।টাকার জন্য কষ্ট করবেন না যেন।দাদা ঠিক দিয়ে দেবে।শুধু মাইনে নয়,এমনিতেও টাকার প্রয়োজন হলে,আমাদের বাড়িতে একটিবার জানাবেন রুদ্রদা...
-সাহস বাড়িয়ে দিচ্ছেন কিন্তু!এবার যে কোনো ধরনের প্রয়োজনে আপনাদের কাছেই হাত পাতবো।তখন কিন্তু আর ফেরাতে পারবেন না।
-ফেরাবো না!
-কথা দিচ্ছেন তো চৈতালীদেবী?

-স্যার!!শিগগির আসুন এদিকে।একটা বই পেয়েছি....আপনি সেদিন পড়াতে বসে বিবেকানন্দের গল্প করছিলেন না....
-না স্বপ্ননীল!!আমি তো এখনও বিবেকানন্দ পর্যন্ত পৌঁছইনি।আমি তো তোমাকে বিলে আর নরেনের গল্প করেছিলাম।বিবেকানন্দকে বুঝতে গেলে তোমাকে আরও একটু বড় হতে হবে।আরও পড়তে হবে...
-আচ্ছা আসুন না!দেখে যান না বইটা।কিনবো?বাবা বললো,আপনাকে নিয়ে যেতে।রাত্রি কতগুলো ছবির বই কিনেছে দেখবেন আসুন....

নীলের টানাটানি আর জোরাজুরিতে ওরা সেদিন হারিয়ে গিয়েছিলো মেলার ভিড়ে....

-রুদ্রদা?
-বলুন?
-আপনি ঈশ্বরপ্রেম বলতে কি বোঝেন?সেদিন আমি শুনছিলাম,আপনি নীলকে বোঝাচ্ছিলেন ঈশ্বরপ্রেমের কথা....বাইরে থেকে শুনছিলাম অবশ্য।আপনার জানার কথা নয়।বেশ লাগছিলো কিন্তু শুনতে!
-তা হলে আমার বেতন কিন্তু বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।আমি তো পড়াচ্ছি রাত্রি আর নীলকে।কিন্তু ফাঁকতালে শিক্ষা নিচ্ছে বাড়তি আরও একজন!এ তো ভালো কথা নয়!ফাঁকি দিয়ে চুরি করে পড়ে নেওয়া....
-ভারি অন্যায় হয়ে গেছে তো!
-হয়েছেই তো!
-তার শাস্তি কি কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা?এই রে!গেলো জামা নষ্ট হয়ে....এই জিলিপির সব ভালো।কিন্তু কথা নেই-বার্তা নেই,কামড় দিলেই এমনভাবে রস গড়িয়ে পড়ে হাত দিয়ে....
-চৈতালীদেবী...এই নিন!রুমাল!
-হুম।ধন্যবাদ!বললেন না তো...ঈশ্বরপ্রেম কি ও কেন?
-আপনারা তো মূর্তিপুজোয় বিশ্বাসী?তাই না?
-না মানে মা বাড়িতে পুজো করে।আমিও ওই একটু প্রণাম ঠুকে আসি।
-আমি কিন্তু মূর্তিপুজোর ঘোর বিরোধী চৈতালীদেবী।
-বলেন কি!তাহলে তো আপনার সঙ্গে আমার মায়ের একেবারেই আড়ি!
-না...তা নয়।আমি মূর্তিপূজায় একটু অবিশ্বাসী ঠিকই,কিন্তু মানুষের মাঝে অবস্থিত ভগবানে বিশ্বাসী!কেউ মূর্তিকে পুজো করলে,ভক্তি করলে,কোনো নির্দিষ্ট মূর্তির দিকে চেয়ে প্রার্থনা করে মনের শান্তি খুঁজে পেলে,তাকে যেমন সম্মান করতে আমাকে আমার বিমূর্ত ভগবান শিখিয়েছেন,ঠিক তেমনিভাবে কেউ আমার দলে নাম লেখালে,তাকে ভালোবাসতে,সম্মান করতেও আমার কোনো অসুবিধেই নেই।নীল-রাত্রিকে যখন পড়াতে যাই,তখন প্রতিদিন সন্ধ্যায় শঙ্খ-ঘন্টা বাজিয়ে পুজো দিয়ে আপনার মা বাড়ি মাথায় করেন।আমার তো বেশ ভালোই লাগে ওই ধুনোর গন্ধ।আপনার মায়ের কাছে যদি ধুনো সংসারের মঙ্গল কামনায় পবিত্র সুগন্ধী হয়,তবে আমার কাছে তা মশা তাড়ানোর অব্যর্থ ওষুধ।তাই ধুনো ভালো,ধূপ ভালো...সব ভালো!আমি যে মানুষ যেমন,তাকে ঠিক তেমনভাবেই ভালোবাসি চৈতালীদেবী।তাই বিচার করতেই ভুলে যাই।আমার কাছে মানবপ্রেমই ঈশ্বরপ্রেম!এবার বলুন....আর কি জানতে চান!
-মা যদি জানতে পারে,পড়ার বইয়ের পাশাপাশি আপনি তার একমাত্র নাতিকে এইসবও শেখাচ্ছেন,আপনার কিন্তু চাকরি গেলো!
-গেলে আর কি করা যাবে!আবার প্রয়োজনে না হয় আপনাদের কাছে গিয়েই বলবো,একটু সাহায্য চাই!চাকরি ছেড়ে দিলেও,আমাকে বিপদের দিনে ফিরিয়ে দেবেন না আশা করি।এটুকু ভরসা রজতদার ওপর আমার আছে।এই শহরে আসার পর ওনার মতো দরাজ মনের মানুষ,আমি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি।হ্যাঁ যদি ভগবানের কোনো মূর্তি থাকে,তবে তা আমার আছে আপনার দাদার মতোই দেখতে হবে!এটা আমি নিশ্চিতরূপে বলতে পারি!
-হুম....দাদাকে নিয়ে মায়েরও গর্বের শেষ নেই।মানুষটাও ভালো।শুধু ওই বিয়েটা এমনভাবে করে বসলো।এতগুলো বছর পরেও,মা আজও বৌদিকে ঠিক মানতে পারে নি....

চুপ করে রইলেন রুদ্রশেখর....

-কি হলো?কথা বলছেন না যে!
-আমি একজন বাইরের মানুষ চৈতালীদেবী।আপনাদের পারিবারিক ব্যাপারে কথা বলা নিতান্তই অনুচিত।এ ধৃষ্টতা দেখাই কোন দুঃসাহসে?তবে কানাঘুষোয় শুনেছিলাম ওনাদের প্রেমের বিয়ে!
-ঠিকই শুনেছেন!মা মানেনি কিছুতেই।নেহাৎ দায়ে না পড়লে,কেউ ওইরকম একটা বোবা মেয়েকে বাড়ির বউ করে আনে নাকি!!দাদা সেই সময় ওকে বিয়ে করবে বলে যা শুরু করেছিলো....
-প্রেমই তো!
-আরে প্রেম হোক আর যাই হোক!একটামাত্র ছেলের বউকে কেউ অমন মানতে পারে!!মা বলে,দাদার তখন মাথা খারাপ হয়ে গেছিলো...মানসিক বিকারগ্রস্ত হলে,তবেই মানুষ জেনেশুনে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেয়!
-হাসালেন চৈতালীদেবী!!
-কেন?!
-পৃথিবীর সর্বাধিক বিকৃত ও বিক্রীত বিষয় কি জানেন?
-কি?!
-দেখুন জীবনে চাহিদার কথা বলতে গেলে খিদে-তৃষ্ণা-আশ্রয় তো একেবারে প্রথম সারিতে পড়বে।কিন্তু তারপরই বিলাসিতার কথায় এলে,একেবারে প্রথমেই আসবে কিন্তু প্রেম!এই শব্দটাকে আপনি কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারবেন না।আর এই প্রেম যতটা সুন্দর,ঠিক ততটাই কিন্তু বিকৃত!আবার একইসঙ্গে বিক্রীতও বটে!অস্বীকার করতে পারবেন?
-বিকৃত?কেন?
-কারণ পৃথিবীর সমস্তরকম সম্পর্কের মধ্যে,একমাত্র প্রেমের সম্পর্কেই কিন্তু বৈধতা-অবৈধতা আছে।আর এইমাত্র আপনিই বললেন,প্রেমে পড়লে,আপনার মায়ের কথা অনুযায়ী মানুষ বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে,লোপ পায় বাহ্যজ্ঞান।তাই যে প্রেম রজতদার কাছে পবিত্র,সেই প্রেমই আপনার মায়ের দৃষ্টিতে বিকৃত।তিনি সন্তুষ্ট নন ছেলের সিদ্ধান্তে।আর বিক্রীত কেন?তা তো সকলেরই জানা!চৈতালীদেবী,এই মনের কাছেই তো আমরা বিকিয়ে যাই প্রতিটা মুহূর্তে,নিজেদেরই অজান্তে।প্রেমের চেয়ে বড় পণ্য,আপনি আর কোথায় পাবেন চৈতালীদেবী!প্রেমকে সামনে রেখেই তো কতশত ব্যবসা!আমরা শৈশবে কি জানতাম,ভালোবাসারও কোনো দিন হয়!!আমাদের কাছে প্রতিটা দিনই ছিলো ভালোবাসার দিন।কিন্তু এখনকার প্রজন্মর কাছে শিখলাম,ভালোবাসারও নাকি একটা নির্দিষ্ট দিন হয়।সেদিন প্রেমিক প্রেমিকাকে,এবং প্রেমিকা প্রেমিককে উপহার সামগ্রী দেয়।প্রেমকে সামনে রেখে ওই একটি দিনের জন্য এত আয়োজন,এত ব্যবসা!সেজে ওঠে শহর।ওটা ছাড়াও দুই প্রেমাস্পদের চারহাত পরিবারিকভাবে একত্রিত করে দেওয়ার জন্য এত আড়ম্বর,এত খরচখরচা...সবই তো প্রেমের পরিণতি প্রদানের জন্য,প্রেমের জন্যই তো...এরপরেও আপনি বলবেন,প্রেম বিক্রীত নয়!!
-বৌদিকে বুঝতে পারিনি কোনোদিন।অন্তত আপনার মত করে তো নয় রুদ্রদা।কি জানি,হয়তো বুঝতেই চাইনি...
-সৌদামিনী বৌদি আমার কাছে মায়ের সমান চৈতালীদেবী।আর আমরা এতটাও বড় হয়ে যাইনি,যে মায়েদের বুঝে উঠতে পারবো।সে আপনার মা বলুন,আমার মা,বা মায়ের সমতুল্য সৌদামিনী বৌদি।এনাদের সবাইকেই আমি একটা শ্রদ্ধার জায়গায় বসিয়েছি।তাই বেশি বুঝতেও চাই না।বিচার করতে বসলে,ভালোবাসার মূল্যবান সময়টা যে হেলায় হারিয়ে ফেলবো!
-নীলকে নিজের মতো করে তৈরি করুন রুদ্রদা!আমার মা বা আমার মতো যেন না হয়!
-না।স্বপ্ননীল মুখার্জী নিজের মতো হবে।কাউকে অনুসরণ বা অনুকরণ করবে না।আমার অনেকখানি আশা আছে ওকে নিয়ে।ও একদিন অনেক বড় হবে।অবশ্য জীবনে যত এগোবে,তত ওর শিক্ষাগুরু পরিবর্তন হতে থাকবে।আমি হয়তো আর কিছুদিন পর ওর জীবনে থাকবো না।কিন্তু আমার শিক্ষার এক শতাংশ যদি ও মনে রাখে,সেখানেই তো আমি সফল।সেদিন হয়তো নিজের কোনো কাজের মধ্যে দিয়েই ও আমাকে মনে রাখবে....আর আপনার বা আপনার মায়ের মতো নয় কেন বলছেন!আপনারা তো সবাই আমার কাছে সমান,সম্মানীয়া।আমি আপনাদের সকলকেই নিজের জন মনে করি।সম্মান করি,ভালোবাসি....
-ভালোবাসেন?!

-ও পিসিমনি!চলো না।ওই নাগরদোলাটা চড়বে।কেমন বনবন করে মাথা ঘুরবে,দেখবে চলো!!

রুদ্রশেখরের সঙ্গে কথায় বিভোর হয়ে গিয়েছিলো চৈতালী।নিজের চটচটে হাতটা রুদ্রদার রুমালে মুছে,ওই রুমালটা রুদ্রকে আবার ফিরিয়ে দিলো ও।স্বপ্ননীলের পিছনে রাত্রির হাত ধরে দাদা আসছে।চেঁচিয়ে উঠলো রজত,

-এই নীল!আর না!রাত্রি বমি করছে!আমারও পেট গুড়গুড় করছে!আমি আর চড়তে পারবো না!
-চৈতালীদেবী?যাবেন নাকি!!
-না বাবা!আমার খুব ভয় করে।সেই জন্যই তো দাঁড়িয়ে আছি।গেলে তো আগেই যেতে পারতাম।
-স্যার আমি যাবো।আরও একবার চড়বো।আপনি চলুন না আমার সঙ্গে!
-আচ্ছা চলো।রজতদা,আমি নীলকে নিয়ে উঠছি।আপনি রাত্রি আর চৈতালীদেবীকে নিয়ে এখানেই অপেক্ষা করুন।
-এ পেঁচি!চললাম।তুই বমি কর,আর দেখ!আমি আবার হুশ করে ওপরে উঠবো আর নীচে নামবো!তুই ভীতুর ডিম!

হাসিমুখে স্বপ্ননীলের হাত ধরে নাগরদোলার দিকে এগোলো রুদ্রশেখর....

-এখন আমারই মাথা ঘুরছে!
-কেন?খুব তো বীরপুরুষ হয়ে গেলেন!
-না সত্যি!অনেকদিন পর তো!বুকের ভেতর কেমন যেন ঢিপঢিপ করছে।গলা শুকিয়ে গেছে!
-আমি একটু আসছি!
-এই চৈতী,কোথায় চললি?অ...মাটির পুতুল!
-আসছি রে দাদা!দাঁড়া!
-কি জ্বালা বলো তো রুদ্র!তিনটেই ছেলেমানুষ।আমি কোনটাকে সামলাই!?চৈতীটা এতবড় হয়ে গিয়ে,এখনও পুতুল দেখে কেমন দৌড়াদৌড়ি করছে!
-আমি দেখছি।রাত্রি বোধহয় ঘুমিয়ে পড়লো।
-হ্যাঁ।বমি করে ক্লান্ত হয়ে গেছে!
-নীল যাবে?পুতুল কিনবে?তোমার পিসি তো ওইদিকেই গেলো!
-না স্যার!আমি কি পুতুল খেলবো?আমি আমার পছন্দের কয়েকটা বই কিনে নিয়েছি।আর কিছু লাগবে না।আচ্ছা চলুন,পেঁচিটার রান্না করার জন্য খেলনা হাঁড়ি-বাসন কিনে আনি।ও তো বাবার কোলে ঘুমিয়েই পড়লো।বাবা টাকা দাও তো...
-না রজতদা।লাগবে না।আমিই কিনে দেবো।চলো নীল!
-কি দরকার রুদ্র!?আমি দিয়ে দিচ্ছি!
-ঠিক আছে।এটুকু আমি পারবো।চলো নীল!কি কিনবে আমাকে দেখাও...

ছাত্রের হাত ধরে সেই দোকানের দিকে এগিয়ে গেলো রুদ্র,যেখানে রংবেরংয়ের মাটির পুতুল সাজানো রয়েছে।আর সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখছে চৈতালী....

-কি নেবেন আপনি?এই যে,নীলও কিসব কিনবে!
-তুই কি কিনবি নীল?
-পিসিমনি রান্নাবাটি কিনবো!
-কি!!
-পেঁচি খেলবে।ও রান্না করবে,আমি ও চুল ধরে টেনেই পালাবো।আর ও রান্না করতে-করতে চেঁচাবে!!

হেসে উঠে একটা প্লাস্টিকের মধ্যে ভরে রাখা কতগুলো থালা-বাসন-হাতা-খুন্তি-চামচ নীলের হাতে তুলে দিলো রুদ্রশেখর।

-আর আপনি কি নিচ্ছেন চৈতালীদেবী?
-দেখছি!এই রাধাকৃষ্ণের মূর্তিটা আমার বেশ লেগেছে!তবে কৃষ্ণের নাকটা একটু যেন ত্যাবড়া!আর নেই বলছে।আমার কপালটাই খারাপ জানেন তো রুদ্রদা!তখন কানের দুলও একটাই ছিলো,এখন এই মূর্তিও একটাই রয়েছে।এইরকম জিনিস আর দ্বিতীয়টি নেই!
-তাহলে তো আপনার নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করা উচিত!যে অন্তিম জিনিসটি অন্তিম মুহূর্তে এসেও আপনারই হলো,অন্তত হাতছাড়া তো হলো না!
-ধুর!ভাঙা মেলায় এইরকম জিনিস পাওয়া যায়।আমি প্রথমে এসে টাকা দিয়ে কেন নেবো এসব নাক ত্যাবড়া জিনিস!?
-রাসের মেলায় এসেছেন,আবার রাধাকৃষ্ণের মূর্তিই হাতে তুলে নিয়েছেন।এরপরেও এত হিসেব করবেন চৈতালীদেবী?আপনি প্রেমিকের প্রেমটুকু উপলব্ধি করুন না!!সেই উপলব্ধির মাঝে প্রেমিকের নিখুঁত চেহারা কি খুব প্রয়োজন!!যদি নিতান্তই প্রয়োজন হয়,প্রেমিকের রূপে প্রেম আটকায়,তবে না হয় চোখ বন্ধ করেই তাকে ভালোবাসবেন!তারপর যখন চোখ খুলে তাকে দেখবেন,তখন আর তার কোনো খুঁত খুঁজে পাবেন না!এত ভাববেন না।নিয়ে নিন!আমি কিনে দিচ্ছি!!
-এই নানা!
-আরে সবই তো আপনি আর রজতদাই করলেন,এমনকি জিলিপি,বাদামভাজাও আপনারাই খাওয়ালেন।এটুকু না করতে দিলে আমার বড় খারাপ লাগবে!দাদা,এই খেলনা আর এই রাধাকৃষ্ণের দাম কত?

-মা....খেয়ে যাও!মামী ডাকছে তো!
-আসছি মামনি!

মেয়ের ডাকে মেলাপ্রাঙ্গণ থেকে ফিরলো চৈতী।আজ ওর চোখ থেকে বহুদিন পরে ভালোবাসার কারণে জল বেরোলো।ভালোবাসতেই ভুলে গেছে ও।শ্বশুরবাড়িতে থাকতে দুচোখে যেটুকু জল আসে,বিদ্যুতের মানসিক অত্যাচারের কারণে আসে।বহুদিন হয়ে গেলো,ভালোবেসে কাঁদা হয় না।রাধাকৃষ্ণের মূর্তিটা আবার যথাস্থানে সযত্নে ঢুকিয়ে রাখলো চৈতী।আয়নার সামনে দাঁড়ালো ও....সেইদিনের মেলাপ্রাঙ্গন থেকে হাতে করে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি বয়ে নিয়ে আসা সেই ষোড়শী চৈতালীর সঙ্গে,আজকের মা হয়ে যাওয়া চৈতীর কোনো সাদৃশ্যই নেই।মেদ জমেছে শরীরের প্রতিটি ভাঁজে।চোখের কোলে গভীর কালি।মুখে বিন্দুমাত্র লালিত্যের আভাসটুকুও নেই।সব রং,সব আভা শুষে নিয়েছে ওই সংসার।চৈতীর পরিপূর্ণ সংসার।স্বামীসুখে আজ অতিরিক্ত সুখী সে।তবে যে সেদিন রুদ্রদা বলেছিলো,

"চোখ বন্ধ করেই তাকে ভালোবাসবেন!তারপর যখন চোখ খুলে তাকে দেখবেন,তখন আর তার কোনো খুঁত খুঁজে পাবেন না!"

ভবিতব্যকে মেনে নিয়ে চোখ বুজেই তো বিদ্যুৎকে ভালোবেসেছিলো চৈতী।বিয়ের পর তো স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষকে মনের ঘরে সামান্য প্রশ্রয়টুকুও দেয়নি।তবে আজ হঠাৎ করে এত বছর পর মেলাপ্রাঙ্গনে মনটা হারিয়ে গেলো কেন!কেন আজও হলদেটে রং দেখলে,বুকের মাঝে মৃদু কম্পন অনুভূত হয়?!কেন আজ এত বছর পর আবার তার স্মৃতি কাঁদিয়ে দিলো!?তার কোনো সংবাদই তো,চৈতী আর রাখেনি।শেষ সংবাদ অনুযায়ী কোন এক আপিসে দপ্তরীর কাজ পেয়েছিলো সে।তারপরই হঠাৎই একদিন এ টিউশনি ছেড়ে দেয়।নীল ওই স্যারের কাছে পড়বে বলে কেঁদে ভাসিয়ে দিলেও,আর ফেরেনি সে!কেন?সে উত্তর আজ আর কেউ জানে না।মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গে হারিয়ে গেছে সকল প্রশ্নের উত্তরও....চৈতীর কাছে রয়ে গেছে শুধু এই রাধাকৃষ্ণের অনন্ত প্রেম....

বুকটা ভারী হয়ে গেছে।সদাসর্বদা মুখ চালাতে থাকা চৈতালী,জীবনের একটা পর্যায়ে পৌঁছে হঠাৎ করেই আজ নির্বাক হয়ে গেলো।বুক ফেটে যেতে লাগলো এক অব্যক্ত কষ্টে।কিন্তু কথার খেই হারিয়ে যাওয়ায়,কয়েক মুহূর্তের জন্য নিজেকে আড়াল করতে মৌনতার পথই বেছে নিলো চৈতী....সিঁড়ি বেয়ে চুপচাপ নেমে গেলো দোতলায়....

-কি হে খুদে মাস্টার?ভালো আছো তো?

ছাদে উঠেই অন্তু দেখলো পাশের বাড়ির ডাক্তার জ্যেঠু ওই ছাদে পায়চারি করছে।ও বইটা রেখে পকেট থেকে হাত বের করে নিলো।হাসিমুখে এগিয়ে গেলো ছাদের কার্নিশের দিকে....

-আমি ভালো আছি ডাক্তার জ্যেঠু।তুমি কেমন আছো?আজ বেরোওনি তোমাদের লাফিং ক্লাবে?!বাবাও তো বেরোলো না।শুয়ে আছে দেখলাম।
-না মাস্টার!ঠান্ডা লেগেছে বড্ড।বুকে কফ বসে গেছে।ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে আসে।আর গায়ে ঘাম বসে ঠান্ডা হাওয়াটা লেগে আরও সর্দি বসে গেছে।তাই দুটো দিন একটু বিশ্রাম নিচ্ছি।শরীরটা একটু সুস্থ হোক,তারপর আবার বেরোবো!আমি নামলাম খুদে মাস্টার।অনেকক্ষণ উঠেছি ওপরে।
-এসো জ্যেঠু!
-এবার কদিন আছো তুমি?
-এই আর তিন দিন।তারপর আবার ফিরে যাবো।
-আচ্ছা-আচ্ছা!ভালো থেকো,শরীরের যত্ন নিও।
-হুম!
-এলাম...
-আচ্ছা!!

ছাদে উঠেই জ্যেঠুর মুখোমুখি পড়ে গিয়ে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলো আন্তরিক।সিগারেটের প্যাকেটে হাতটা রেখেও,আবার হাতটা পকেট থেকে বের করে নিতে হয়েছিলো।বড্ড কাঁদতে ইচ্ছে করছে।যতবার ওর কাঁদতে ইচ্ছে করে,ততবার ও সিগারেটের ধোঁয়ায় কষ্টগুলোকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।কিন্তু তাতে ফুসফুস আরও একটু ঝাঁঝরা হয় ঠিকই,কিন্তু বুকের চাপা কষ্টটা একটুও প্রশমিত হয় না!সিগারেটটা হাতে নিয়ে অন্যমনস্কভাবে আকাশের দিকে চেয়ে রইলো আন্তরিক।পাশে হেলানো আরামকেদারাটায় "সঞ্চয়িতা" পড়ে রয়েছে।আন্তরিকের মন দূর আকাশে ওই নাম-না-জানা উড়ন্ত কৃষ্ণবর্ণ পাখিগুলোর সঙ্গেই ঘরছাড়া হয়ে গেছে।আর কোনো কর্তৃত্ব নেই মনের ওপর।বারংবার সে ফিরতে চায় সুন্দর অতীতে।আকাশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আন্তরিক চাইলো "সঞ্চয়িতা"-র দিকে।লাল চামড়া দিয়ে বইটা বাঁধাই করা রয়েছে।ঝুমই করে দিয়েছিলো।আন্তরিক বইয়ের পোকা হলেও,বইপত্র যত্নের বেলায় অষ্টরম্ভা।সেসব জেনেই বইটা সুন্দর করে বাঁধিয়ে দিয়েছিলো ঝুমুর।লাল চামড়াটার ওপর পরম মমতায় হাত বোলালো আন্তরিক।এইরকম লাল রক্তেই সেদিন ভিজে গিয়েছিলো ঝুমুরের কপালটা...নতুন চশমা পরে ওর জন্য রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে-করতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলো আন্তরিক।প্রথমদিনে ফোন নম্বরও আদান-প্রদান হয়নি,যে ফোন করে জিজ্ঞেস করবে ও কোথায় আছে!শেষ পর্যন্ত একরাশ দুশ্চিন্তাকে সঙ্গী করে হাসপাতালের অভিমুখে রওনা দিয়েছিলো অন্তু....কিন্তু সেখানে পৌঁছেই মুখোমুখি হয়েছিলো এক মর্মান্তিক দৃশ্যের....

সারি-সারি এম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে রয়েছে হাসপাতালের সামনে।পাশেই পুলিশের গাড়ি।লোকজন গিজগিজ করছে হাসপাতাল চত্বরে।দৌড়ে গিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলো আন্তরিক,

-কি হয়েছে এখানে?এত ভিড়?
-দেখুন না দাদা,ডাক্তারদের কি গাফিলতি!!একজন বাচ্চা হতে এসেছিলো,মরেই গেছে।তার বাড়ির লোক হাসপাতাল ভাঙচুর করছে।মারুক!মেরে একেবারে ফাটিয়ে দিক সবকটাকে!

কেঁপে উঠলো আন্তরিক।সবাইকে ঠেলে সামনের দিকে এগোতে চাইলেও,প্রবলভাবে বাধা পেলো পুলিশের কাছে।কথার অবাধ্য হওয়ায় পুলিশের লাঠি এসে পিঠে পড়তে-পড়তে বেঁচে গেলো ও।পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তখন মরিয়া স্থানীয় পুলিশও....কয়েকজন ডাক্তার সামনে এসে দাঁড়ালে জনরোষ যখন আরও বেড়ে উঠলো,সেই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে সামান্য সুযোগে পাশ কাটিয়ে একদৌড়ে ভিতরে ঢুকলো আন্তরিক।দুজন ওয়ার্ড-বয় চেঁচিয়ে ওর দিকে আসতে গিয়েও ওকে লাঠিসোঁটা ছাড়া একা দেখে নিরাপদ মনে করে,আর এদিকে এলো না।আবার দৌড়োলো গেটের দিকে।ভিতরে ঢুকেই আন্তরিক ছুটলো এমার্জেন্সির দিকে।সামনেই দরজার কাঁচ ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে।কেউ কোত্থাও নেই।সাবধানে ভাঙা কাঁচ পেরিয়ে অনুসন্ধানে ঢুকে আন্তরিক দেখলো,চেয়ার উল্টে পড়ে রয়েছে।কাগজপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে,কম্পিউটার,ল্যান্ডফোন ভেঙেচুরে লন্ডভন্ড অবস্থা!কয়েকজন কর্তব্যরত পুলিশ ওখানে উপস্থিত রয়েছেন,আর রয়েছেন হাসপাতালের জনাকয়েক কর্মরতা মহিলা।কিন্তু তাকে তো কোথাও খুঁজে পেলো না আন্তরিক।একজন মহিলাকে ডেকে ও জিজ্ঞেস করলো,

-ঝুমুর প্রামাণিক কি বেরিয়ে গেছেন?ওনার তো ডিউটি আওয়ার পাঁচটার অনেক আগেই ওভার হয়ে গেছে!
-দিদি?!দিদি তো চেঞ্জ করে বেরিয়েই যাচ্ছিলো।আবার চেঁচামেচি শুনে ঘুরে এসেছে।ব্যাস!!দিদির কপালটাই তো ফেটে গেছে।ওরা বাইরে থেকে ইঁট ছুঁড়েছে,দিদি তো সামনেই ছিলো।মাথায় লেগে গেছে।কপালে ব্যান্ডেজ করে দিদি ভিতরে শুয়ে আছে!
-হোয়াট!আমাকে একটু ওনার কাছে নিয়ে যাবেন প্লিজ!কোথায় উনি?
-আপনি কে হন ওনার?
-আমি ওনার বিশেষ পরিচিত।একটু বলুন উনি কোথায় আছেন?!
-সোজা গিয়ে বাঁদিকে যান...

কাগজপত্র,অসংখ্য রোগীর একগাদা রিপোর্ট গোছাতে,আবারও ব্যস্ত হয়ে পড়েন দিশেহারা ওই ভদ্রমহিলা।সেইসঙ্গে উত্তর দিতে থাকেন পুলিশ অফিসারের প্রশ্নেরও....ওনার নির্দেশ অনুযায়ী সামনের দিকে এগোয় আন্তরিক।গিয়ে দেখে একটা বেডের ওপর উঠে বসেছে ঝুমুর।ওড়না ঠিক করে নিয়ে একমনে নিজের ব্যাগ ঘাঁটছিলো ও।

-ঝুমুর!
-এ কি!আপনি!?এখানে এলেন কিভাবে?আরে কিভাবে ছাড়ুন,আপনি এলেনই বা কেন?বাইরে কি অবস্থা!

ঝুমুরের কপালে একটা ছোট ব্যান্ডেজ করা রয়েছে।তাতে রক্তের লালচে বিন্দু হালকাভাবে ফুটে উঠেছে।কিন্তু সেদিকে কোনো হুঁশ নেই মেয়েটার।ও কাজ নিয়েই ব্যস্ত রয়েছে....

-আপনার এ কি অবস্থা!!আরে আপনি কোথায় চললেন?একটু রেস্ট নিন আগে!মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে এভাবে দৌড়োচ্ছেন কেন?

হতবাক আন্তরিক....

-নানা,আমি ঠিক আছি।ও সামান্য একটু কেটে গেছে।রক্তপাতও সামান্যই।আরও দুজন ইনজুওর্ড।ওদের কি অবস্থা একটু দেখে আসি!আপনি বরং আসুন এখন।আমি একটু ব্যস্ত আছি।সাবধানে যাবেন।বাইরে বিক্ষোভের মুখে পড়ে গেলে আর কিন্তু বাঁচতে পারবেন না।পিটিয়ে দেবে।
-আমি কোথাও যাচ্ছি না।এইখানেই আছি।আপনি কাজ সেরে আসুন।আমি অপেক্ষা করছি!

আর কোনো উত্তর দিলো না ঝুমুর।হয়তো দায়িত্বশীলা-কর্মব্যস্ত একজন সেবিকার নিজের ব্যক্তিগত জীবনের কথা ভাবার বড় বিশেষ অবকাশ থাকে না।আন্তরিকের কথায় কর্ণপাত না করে,ঝুমুর বেরিয়ে গেলো ঘর ছেড়ে।হাসপাতালের ওষুধ আর ফিনাইলের গন্ধে কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে বমি পেয়ে গেলো অনভ্যস্ত আন্তরিকের।ও একটা চেয়ারে চুপ করে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো ঝুমুরের জন্য....বাইরে কোলাহল একটু যেন স্তিমিত হলো....

-আপনি এখনও বসে আছেন?যাননি?
-আপনি কেমন আছেন?
-ভালো আছি!

ঝুমুরের কপালের দিকে চেয়ে কান্না পেয়ে গেলো আন্তরিকের।কপালে ব্যান্ডেজ নিয়েও বলছে,"ভালো আছি!" মাথা নামিয়ে নিলো ও...

-এবার আমি বেরোবো!কি হলো?
-এভাবে আহত হয়ে আবারও....

আর বলতে পারলো না আন্তরিক।শব্দরা ভিজে গেছে কান্নার স্রোতে....

-চলুন!নাকি থাকবেন এখানে?
-নাঃ!চলুন!এখানে থাকলে ধরেবেঁধে আবার আমাকে ইনজেকশন দিয়ে দেবে।বাইরে ঝামেলা থেমেছে মনে হয়।
-না!বাচ্চাটার বাবা,মানে বউটার স্বামী কাঁদছে!কান পেতে শুনুন।গোঙানি শুনতে পাবেন।এইসব ঝামেলা একটু পরই থেমে যাবে।কিন্তু শিশুটার জীবনের ঝামেলা তো আর কোনোদিনই থামবে না।
-বাচ্চাটা আছে?
-হুম!মা মারা গেছে।বাইরে আসুন বলছি।আপনি এগোন।আমি একটু ওদের সঙ্গে কথা বলে আসি।আমার মাথা একটু কেটেছে কি না কেটেছে,ওরা চিৎকার করে মাত করে দিয়েছে।একটু বলে যাই!সবদিক সামলে বেরোতে অনেকটা রাত হয়ে গেলো আজ!নিজের মাথাটার জন্য আরও সময় নষ্ট হলো!
-আমি আছি।যত রাতই হোক আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত ছেড়ে আসবো।আপনি কথা বলে আসুন।আমি বাইরে অপেক্ষা করছি!

বেরোনোর সময় আন্তরিক দেখলো,দরজার সামনে সিমেন্টের বাঁধানো চাতালটায় বসে একজন পুরুষ কপাল চাপড়াচ্ছে।তার সঙ্গে সুর করে কাঁদছে আরও কয়েকজন নারী-পুরুষের সম্মিলিত জটলা।অসহায় আন্তরিক এগিয়ে গেলো বাইরের দিকে।হাসপাতালের বাতাস শোকের কারণে কি ভীষণরকম ভারী হয়ে রয়েছে।নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো ওর।কত কষ্ট করে মা একজন সন্তানকে জন্ম দেন!একজন মা তো মরেই গেলেন আজ!ওই পুরুষটির আর্ত-গোঙানিতে মাথাটা ধরে গেলো আন্তরিকের।কার জন্য প্রার্থনা করবে ও!?সদ্য জীবন-সঙ্গিনীহারা ওই পুরুষটির জন্য,সদ্য কন্যাহারা ওই নারীর মায়ের জন্য,নাকি সদ্য-মাতৃহারা ওই একরত্তি শিশুর জন্য!?নাকি এদের হাতে আহত ঝুমুর আর ওর সহকর্মীদের জন্য?!কেঁদেই ফেললো আন্তরিক।চশমাটা খুলে সকলের অলক্ষ্যে চোখটা মুছে নিচ্ছিলো,তখনই ঝুমুর বলে উঠলো,

-কাঁদছিলেন নাকি?!
-কার জন্য কাঁদবো ঝুমুর?বুঝতেই তো পারছি না!
-ওয়াটার ব্রেক করে গেছে অনেক আগেই।বাড়িতে ডেলিভারি হবে বলে বসেছিলো,হসপিটালে আসেনি।অথচ বেবির যা পজিশন,নরম্যাল ডেলভারি হওয়া কোনোভাবেই পসিবল ছিলো না।পেশেন্ট ডাইং কন্ডিশনেই এসেছে।কিচ্ছু করা যায়নি,একজনকেই রাখা গেছে।ওরা বুঝবে না।ওরা বোঝে না।আর ওদের আপনজন মারা গেছে তো!তাই আপনি বরং ওদের জন্যই প্রার্থনা করুন।যে মারা গেছে,তার আত্মার শান্তি কামনা করুন।আর কি বলবো বলুন?
-দাঁড়ান ঝুমুর!যাদের চিকিৎসা করছেন,তাদের কাছ থেকে এভাবে আহত হয়ে,এরপরেও....
-কি এরপরেও?
-এরপরেও তাদের চিকিৎসা করবেন?মনে হয় না,আবার তো এদিক-ওদিক হলেই ওরা ঠিক এইভাবেই মেরে ফাটিয়ে দেবে!

হাঁটতে-হাঁটতেই একটু হাসলো ঝুমুর।সঙ্গে-সঙ্গে যন্ত্রণায় কারণে মাথার ব্যান্ডেজ চেপে ধরলো...

-থাক!আপনার কষ্ট হচ্ছে।কথা বলতে হবে না।চুপচাপ চলুন।এই একটা মৃত্যুতে আমিই বড্ড বেশি আবেগী হয়ে পড়েছি।
-আপনি আমাকে একটা কথা বলুন তো!আপনার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা কি বলে?প্রথম সারির ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে-সঙ্গে,আপনি শেষের বেঞ্চে বসে থাকা ছাত্রছাত্রীকেও তো একই শিক্ষা দেন।আপনি আপনার কাজটুকু করার সময় কি মেপে করেন?সেখানে নিশ্চয়ই কোনো কার্পণ্য করেন না!?তারা আপনার শিক্ষার বিনিময়ে কতটুকু আপনাকে ফিরিয়ে দেবে,দারুণ কোনো রেজাল্ট,নাকি একরাশ হতাশা,শিক্ষাদানের সময় সেটা ভাবতে বসেন কি?
-না!
-শুধু নিজের কাজটুকুই করেন তো?
-হুম!
-আমরাও তাই করি।কি করবো বলুন?আমাদের কাজ আমরা করি,তাদের কাজ তারা করে।তারা সম্পূর্ণ ঘটনা না জেনে,না বুঝে দুর্ব্যবহার করলে,আমরা কি নিজেদের জায়গা থেকে সরে আসতে পারি?সম্ভব নয়!ভুল কি আমাদের তরফ থেকেও থাকে না!?থাকে তো!কখনও তারা ঠিক,কখনও আমরা।তারা ঠিক হলে এইটুকু শাস্তি তো আমাদের প্রাপ্য,এই যেটা আজ আমার কপালে আঁকা রইলো।কারণ আমাদের ভুলের মূল্যটা অনেক বড়!আর সেই মূল্যটা রোগীর পরিবারকেই দিতে হয়।আজকের এই ব্যাপারটা না হয় হলোই বা অকারণে।হয়তো আমাদের তরফ থেকে কোনোদিনও কোনো ভুল হয়েছিলো,এটা তারই শাস্তি।কারোর না কারোর ভুলের শাস্তি আমি পেলাম।এভাবেই মনকে প্রবোধ দেবো,আবারও নতুনভাবে কাজে ফিরবো!এসব হয়েই থাকে।আপনি এত ভাববেন না!দুদিন খবরের হেডলাইনে থাকবে,তারপর বড় কোনো ক্ষতি না হলে আমরাও আর সেভাবে মনে রাখবো না।কাজে নিজেকে ডুবিয়ে দেবো।আর তারাও অসুস্থ হলে আমাদের কাছেই তো চিকিৎসার জন্য আসবে।আবারও সেই আমাদেরই ভরসা করবে।নইলে আর যাবেই বা কোথায়?তাই কি হবে,এতসব মনে রেখে!যত তাড়াতাড়ি কাজের স্বাভাবিক ছন্দে ফেরা যায় আর কি!শুধু পেশেন্টকে তার বাড়ির লোকের সঙ্গে হাসিমুখে ফিরে যেতে না দেখলে,আমার বড় কষ্ট হয়!কিন্তু এরা মাঝে-মধ্যে নিজেদের ভুলে পরিস্থিতিটা এমন জটিল করে ফেলে,কি আর বলবো?!
-মৃত্যু খুব কঠিন একটা পরিস্থিতি!ওই ভদ্রলোক করিডোরে বসে কাঁদছিলো!আমি সহ্য করতে পারছিলাম না ঝুমুর!
-হুম!!
-আমি মরে গেলেও সবাই এইভাবেই কাঁদবে!কিন্তু আমি তো তখন জানতেও পারবো না।তাই না!?
-এ আবার কেমন কথা!
-না...আমি মরে গেলে?কাঁদবে তো আপনজনরা!কাছের মানুষরা?

রাস্তার পাশে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো ঝুমুর।তারপর বললো,

-শুধু আপনি কেন আন্তরিক!আপনি-আমি সবাই মরে গেলেই,আমাদের আপনজনরা অবশ্যই কাঁদবে।অন্তত যাদের জন্য কাঁদার লোক আছে!এটা তো নতুন কিছু নয়!কিন্তু তখন তাতে আমাদের কি হবে আন্তরিক?
-মানে?আমাদের ভালোবাসার জন চোখের জল ফেলবে আমাদের জন্য....
-শুধুই কি ভালোবাসার জন?আপনার মৃত্যুর পর আপনার শত্রুও কিন্তু আপনার মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে দু-ফোঁটা চোখের জল ফেলে বলে যাবে,আহা!মানুষটা বড় ভালো ছিলো!কিন্তু সেই কথায় সেই মুহূর্তে আপনার আর কোনো লাভ-ক্ষতি,কিছুই হবে না!তাই অকারণে আবেগী হবেন না।মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে শিখুন!যতদিন বেঁচে আছেন,কর্মে বিশ্বাস রাখুন।আমার মৃত্যুর পর আমার জন্য কে কাঁদবে,আদৌ কেউ কাঁদবে কিনা,সেসব চিন্তাধারাকে মনে জায়গা দেবেন না!কিভাবে নিজে ভালোভাবে আরও দুটো দিন এই সুন্দর পৃথিবীর বুকে বাঁচবেন,ভালোবাসার মানুষদের সুখ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখবেন,সেটা ভাবুন!তারপর মৃত্যু যখন আসার,তখন তো আসবেই।তার সময় হলে আপনি তো তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না!সে ক্ষমতা আপনার-আমার কারোরই হাতে নেই।
-আচ্ছা বেশ!মৃত্যুর কথা আজ না হয় থাক।জীবদ্দশায় কেউ আপনার জন্য কাঁদলে আপনার কিছু আসে-যায় না ঝুমুর?আপনি কি সত্যিই এতটা অনুভূতিহীন?

ঝুমুর কয়েক মুহূর্ত আন্তরিকের চোখের দিকে চেয়ে রইলো,তারপর বললো,

-বাসস্ট্যান্ড প্রায় এসেই গেছে।আমি যেখানে পিজি থাকি,সেই বাড়িটা বাস থেকে নেমে খুব বেশি দূরে নয়।আমি একা চলে যেতে পারবো আন্তরিক।আপনাকে আসতে হবে না।
-প্রথমত,আমি সঙ্গে যাবোই।আপনার কোনো বারণ আজ অন্তত আমি শুনবো না।আর দ্বিতীয়ত,এটা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়।আপনি এড়িয়ে গেলেন কিন্তু....
-ইস!!চশমা পরে তো বেশ সুন্দর লাগছে আপনাকে!
-আপনার মুখে এই ইস শুনলেই আমি সব কষ্ট ভুলে যাই।কিন্তু আজ আর ভুলবো না।চশমা পরে আমাকে ভালো লাগছে,তার জন্য আপনাকেই ধন্যবাদ।তাও আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম না!
-কি জানতে চান,বলুন?
-ধরুন আপনি বেঁচে থাকতেই,কেউ আপনার জন্য কাঁদলে আপনার কিছু আসে-যায় না?
-দেখুন আমি এতকিছু বুঝি না,আমি শুধু এটুকুই বুঝি,আমি আজ মারা গেলে আমার জন্য অনেকেই কাঁদবে।আমার কাকুমণি,জ্যেঠুমণি,বড়মা,ছোটমা,দাদা-ভাই-বোনেরা,আর আর্থ্রাইটিসে ভুগতে থাকা আমার অসুস্থ মা-ও।সব্বাই কাঁদবে।আমি বাবাকে অনেক আগেই হারিয়েছি।একান্নবর্তী পরিবারে এদের মধ্যে বড় হয়ে ওঠা আমি,পরিবার ছাড়া কিছুই বুঝি না।এরা সবাই আমার আপনজন।আমাকে চোখে হারায়।সব মানি।কিন্তু আন্তরিক....

অন্তুর দিকে ঘুরে দাঁড়ালো ঝুমুর।

-বলুন....থামলেন কেন?
-তবুও আমি জীবনের সেই সঠিক মানুষটার জন্যই অপেক্ষা করছি,যে আমার চোখ থেকে একবিন্দু জল বেরোলে নিজেই মরে যাবে।আর সেই কারণেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য,সে আমার চোখে কোনোদিনও জল আসতে দেবে না!কারণ সে মনে করবে,আমার চোখে আসা একফোঁটা জলই হবে তার মৃত্যুর কারণ!

আন্তরিক ভাষা হারিয়ে নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলো ঝুমুরের দিকে...

-কি হলো?এখনও কি আপনার মনে হয়,আমি অনুভূতিহীন?যান্ত্রিক?

উত্তর হাতড়ে বেড়ালো আন্তরিক।কিন্তু কোনো জুতসই জবাব ওর মস্তিষ্কে এলো না।হেসে ঝুমুরই আবার বললো,

-আমার বাস আসছে।আপনি কোনদিকে যাবেন?
-আপনার সঙ্গেই যাবো!

কোনোক্রমে বললো আন্তরিক।তারপর ওরা দুজনেই এগিয়ে গেলো বাসের দিকে।আন্তরিকের মাথায় তখন একটাই কথা ঘুরছে,

"আমার চোখে আসা একফোঁটা জলই হবে তার মৃত্যুর কারণ!"

অর্থাৎ,ঝুমুরকে এতটাই ভালোবাসতে হবে,ওর চোখে কোনোদিনও জল আসতে দেওয়া যাবে না।আর ও যদি কোনো কারণে কষ্ট পেয়ে কেঁদেও ফেলে,জীবিত থাকাকালীন প্রতিটা মুহূর্তে শত-সহস্রবার মরতে হবে আন্তরিককেই...

সিগারেটের আগুনটা প্রায় আঙুল স্পর্শ করে ফেলেছিলো।ওটাকে নিভিয়ে ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেললো আন্তরিক।দিনের আলো সম্পূর্ণভাবে নিভে গিয়ে সন্ধ্যে নামার সঙ্গে-সঙ্গে,লাল চামড়ায় বাঁধানো বইটা বুকে জড়িয়ে ধরে,আরও একবার মরে গেলো কাঁদতে না পারা,অব্যক্ত কষ্টগুলো জাহির করতে না পারা নির্বাক আন্তরিক....

(চলবে.....)

ছবি : সংগৃহীত

ধারাবাহিকটি ভালো লাগলে ব্লগ থেকে নির্দ্বিধায় শেয়ার করুন ও সবাইকে পড়ার সুযোগ করে দিন।😊😊

সূর্যোদয়ের আগে
প্রিবুকিং চলবে পনেরো তারিখ পর্যন্ত।প্রিবুকিং এ থাকছে বিশেষ পঁচিশ শতাংশ ছাড়।তোমরা যারা প্রিয়মশ্রীকে নিজের সংগ্রহে রাখতে চাও,তারা বুকিং করতে পারো পাঠকবন্ধুর এই নম্বরে ফোন অথবা whatsaap করে।
পাঠকবন্ধুর নম্বর - 7439112665

৮টি মন্তব্য:

  1. অপূর্ব অনবদ্য ভাষাহীন 💖💖💖

    উত্তরমুছুন

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট