অনুসরণকারী

শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০

নির্বাক (প্রথম পর্ব)


 


নির্বাক


সাথী দাস


প্রথম পর্ব




-এই রাত্রি,দেখ না!এই শাড়িটা বেশি ভালো লাগছে!
-না পিসিমনি!ওইটাই থাক!টমেটো রেডে বিয়ের সাজটা খুলবে,মেরুনে সাজটা কেমন যেন চেপে যায়!মণিমা বারবার করে বলেছে এই লালটার কথা...
-বাব্বা!মণিমা অন্ত প্রাণ যে একেবারে!মণিমা বললো,আর তুইও বুঝে গেলি?
-একদম!আমি মণিমার সব কথা বুঝি পিসিমনি।এমনকি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসও পড়তে পারি....
-বেশি বুঝিস তুই আর তোর মণিমা।ওই তো তোর গায়ের রংয়ের ছিরি।ওইরকম ক্যাটকেটে লাল পরলে,তোকে বিয়ের সাজে ওই শাড়ি আরও গিলে খেতে আসবে।যেটা বললাম,সেটাই নে।
-কেন পিসিমনি?এটা কমদামী,তাই এটাই নিতে বলছো?যাতে মণিমার বেশি টাকা খরচ না হয়!
-এই শোন!মুখে-মুখে...
-দোকানের মধ্যে এসব অসভ্যতা বন্ধ করো পিসিমনি।মণিমা লালের যে শেডটা নিতে বলেছে,আমি সেটাই নেবো।
-তা আমাকে ফোন করে ডেকে এনে কেনাকাটা করতে ঠেলে পাঠানো কেন বাপু!নিজের মেয়ের বিয়ের কেনাকাটা তো,সে নিজের হাতেই করতে পারতো!সব যখন মেয়েকে শিখিয়ে-পড়িয়ে পাঠিয়েই দিয়েছে,তবে আমি ওই ধরো লক্ষণ হয়ে থেকে,খামোখা বদনাম কিনবো কেন!যত্তসব ন্যাকামো!বলিহারি বৌদির আক্কেল!কপাল করে একটা মাথামোটা মেয়েছেলেকে বাগে পেয়েছিলি বাপু!বৌদির মাথাটা একেবারে চিবিয়ে খেলি তুই!এরপর দেখবো,তোর ছেলেমেয়েরা কোনদিন আবার সম্পত্তিরও দাবী করে বসবে...

এমন অভব্য ব্যবহারের আর কোনো উত্তর দিলো না রাত্রি।শাড়িতে মনোযোগ দিলো।মুখ বেঁকিয়ে দোকানদারের দিকে চেয়ে একটু কাষ্ঠহাসি হেসে,মুখটা ফিরিয়ে মূল্যবান ঢাকাই জামদানীর দিকে ঝুঁকে পড়লো চৈতালী।শাড়ির দিকে লোলুপ দৃষ্টিদান করতে গিয়ে,উদ্ভিন্নাযৌবনা নারীর দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতেই ভুলে গেছে ও।তাড়াতাড়ি করে চৈতালী শাড়ি ফেলে রেখে বলে উঠলো,

-ওই রাত্রি!মামনি কোথায়?
-দেখো!ওর সঙ্গে আছে হয়তো।সবাই মিলে পাঞ্জাবী দেখছে।বৌমনিকেও তো দেখছি না,শাড়ি পছন্দ করতেও এলো না।ওদিকটায় একসঙ্গেই সবাই আছে!

রাত্রির কথায় খুব একটা আশ্বস্ত হলো না চৈতালী।শাড়ি ফেলে রেখে একমাত্র মেয়ে মামনির সন্ধানে,এগিয়ে গেলো অভিজাত জামাকাপড়ের দোকানের অপর প্রান্তে....

ফোনটা বেজে উঠতেই দৌড়ে গিয়ে রিসিভারটা কানে ধরলেন সৌদামিনী দেবী।কয়েক মুহূর্ত শুনেই,হাসিমুখে রেখে দিলেন ফোনটা....ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেলেন,নিজের ঘরের দক্ষিণ দিকের খোলা জানালার দিকে...

-বৌদি,তুমিও পারো বাপু!এত ঘটা করার কোনো দরকার ছিলো কি!!কে?না মুখার্জী পরিবারের সামান্য একজন আশ্রিতা!তাকে এত বচ্ছর ধরে তো খাওয়ালে,পরালে,গুচ্ছের লেখাপড়া শিখিয়ে ব্যাগ বগলে চাকরি করতেও পাঠালে,এবার একটু আদিখ্যেতাটা কম করলে হয় না!বলি এ কি বাড়ির মেয়ের বিয়ে লেগেছে নাকি গো!এত আয়োজন!!মোচ্ছব লাগিয়ে দিলে তো তুমি!দুহাতে খরচ করছো!নিজের ভবিষ্যতের চিন্তাটাও তো করবে নাকি!আমাদের স্বর্ণালী কিন্তু এসব একদম পছন্দ করছে না।বাইরের একটা অজাত-কুজাত মেয়েছেলেকে নিয়ে এত কিসের নাচানাচি বৌদি?রেজিস্ট্রি করে কোনোরকমে পার করে আপদ বিদেয় করতে পারতে তো!আরে বাবা পাত্রপক্ষের তো আর কোনো দাবী নেই।মেয়ের ওই গতর দেখেই ছেলে গলে গেছে।চুপচাপ নিয়ে যাচ্ছে,যাক না! তুমি কেন দুহাতে এমন হরির লুটের মতো টাকা ওড়াচ্ছো?!যত্তসব ন্যাকামি!দেখলেই গা পিত্তি জ্বলে যায়।মাথার ওপর বলার কেউ নেই তো!আমার মা যদি আজ বেঁচে থাকতো,তবে এইরকমভবে বাড়ির বউকে নিজের গায়ের গয়না খুলে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে দেখলে,সংসারকে কুরুক্ষেত্র বানিয়ে ছাড়তো।মা নেই,তাই সবাই এখন স্বাধীন হয়েছেন....

বিছানার ওপর ছড়িয়ে রয়েছে নতুন শাড়িগুলো।প্রায় অর্ধেক শাড়ির দোকান উঠিয়ে আনা হয়েছে।স্বল্পভাষী রাত্রি শাড়ি দেখার জন্য তিনতলার ঘর থেকে,বৌমনিকে ডাকতে গেছিলো।কিন্তু বৌমনির ঘরের দরজা বন্ধ!বার দুয়েক ডেকেও সাড়া পায়নি রাত্রি।তাই ও ধীরপায়ে নেমে আসছিলো সিঁড়ি দিয়ে।মণিমার ঘরে ঢুকতে গিয়েই পিসিমনির কথাগুলো শুনতে পেয়ে,রাত্রি ওইখানেই দাঁড়িয়ে পড়লো।আর ঘরের ভিতরে ঢুকলো না।চোখে জল নিয়ে পা টিপে-টিপে নেমে এলো একতলায়,নিজের ঘরে।দরজা বন্ধ করে দাঁড়ালো আয়নার সামনে।পাশেই তাকের ওপর রাখা একটা ফটো ফ্রেমে বাবা-মা হাসছেন....

রাজ্যের কথা শুনিয়ে ননদ হেলতে-দুলতে তিনতলায় চললেন,সৌদামিনী দেবীর একমাত্র পুত্রবধূর ঘরে।হাসিমুখে সব শাড়িগুলো ভালোভাবে দেখেশুনে একে-একে তুলে নিজের আলমারীতে রাখলেন সৌদামিনী দেবী।হাঁটুর ব্যথাটা গত কয়েকদিন ধরে বড্ড বেড়েছে।সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করতে বড় কষ্ট হয়!তাই সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে রাত্রির ঘরে বড় বিশেষ যাওয়াই হয় না।ফোনের রিসিভারটা হাতে তুলে নিয়ে,রাত্রির নম্বরে একটা ফোন করলেন সৌদামিনী দেবী।মণিমার নম্বরটা নিজের মুঠোফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠতেই,দরজা খুলে তাড়াতাড়িই ওপরে উঠে এলো রাত্রি...তার আগেই অশ্রুসিক্ত চোখ মুছে,কান্না লুকিয়ে নিজের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে এসেছে ও...

-বলো মণিমা!তোমার কি লাগবে?

রাত্রির হাত ধরে ওকে নিজের কারুকার্য করা সুশোভিত পালঙ্কের এককোণে বসালেন সৌদামিনী দেবী।মুখে একবার হাত বুলিয়ে একটু হেসে,ওর চোখের দিকে চেয়ে রইলেন...

-আমিও হাসছি তো মণিমা...

দুদিকে ঘাড় নেড়ে ভ্রূকুটি করে উঠলেন সৌদামিনী দেবী।বকা দিলেন রাত্রিকে....রাত্রি হাসিমুখে মুখ লুকোলো মণিমার বুকে।

-বিশ্বাস করো,আমি সত্যিই খুব ভালো আছি।আমি হাসছি তো...

হাত নেড়ে নিজের ঠোঁটের কাছে হাতটা এনে,এ সংসারের সব কথা ছেড়ে,রাত্রিকে শুধু নিজের মনের মানুষটার কথাই ভাবতে বললেন সৌদামিনী দেবী।হেসে ফেললো রাত্রি।মণিমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,

-আমাকে ছোট্টবেলার মতো করে ভোলাতে চাইছো মণিমা?আমি কিন্তু সব শুনেছি।তবে আমি কিছুই মনে করিনি।পিসিমনি তো সবসময় ওইরকমই বলে।আমি তো জানি।তাই আমি একটুও কষ্ট পাইনি।তবে তুমি কিন্তু এতটা খরচ না করলেই পারতে!এ তোমার বড় বাড়াবাড়ি...

রাত্রিকে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে চুমু খেলেন সৌদামিনী।তারপর দুহাত নেড়ে ইশারা করে যা বললেন,তার মর্মার্থস্বরূপ রাত্রি যা বুঝলো,তা হলো...

"আমি তো চৈতীকেও সব দিয়েছিলাম।ও গুছিয়ে রাখতে না পারলে,সেই দোষ কি আমার!"

হাত নেড়ে কথা বলতে-বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন নির্বাক সৌদামিনী দেবী...

-মণিমা...শান্ত হও!বুঝেছি আমি।আর বলবো না।ভুল হয়ে গেছে।তোমার যা মন চায়,তুমি তাই করো!

কিন্তু শান্ত হলেন না সৌদামিনী দেবী।ওনার চোখের জল উপছে পড়ছে।নিজের দুচোখ দেখিয়ে চশমার ইঙ্গিত করলেন উনি।রাত্রি বুঝলো,মণিমা রুদ্র আঙ্কেলের কথা বলছেন।সৌদামিনী হাত নেড়ে-নেড়ে বলেই চললেন কত অব্যক্ত কথা...নিজের বুকে হাত রেখে রাত্রিকে বোঝালেন,

"কত ভালোবাসতো ওই মানুষটা চৈতীকে।তুই তো জানিস রাত্রি,চৈতী এইরকম ছিলো না।সংসারের আগুনে পুড়ে গিয়ে,ও এমনটা হয়ে গেছে!আমি বললাম,ওই রুদ্রশেখরের সঙ্গেই চৈতীর বিয়ে দাও।কেউ আমার কথা শুনলো না।আজ দেখ,মেয়েটার কি অবস্থা!আমার ওর ওপর রাগও হয়,আবার ওর জন্য খারাপও লাগে...."

-জানি মণিমা!তুমি এই মুখার্জী পরিবারের কর্ত্রী।তোমার তো সবদিকেই জ্বালা!কাউকেই তুমি ফেলতে পারো না।
এমনকি সেদিন তুমি আমাকেও ফেলতে পারোনি।বড়মার কাছে এত কথা শুনেও,এত লাঞ্চনার পরেও,আমাকে বুকে করে আগলে রেখেছিলে।সেদিন তুমি না থাকলে,আমি কোথায় ভেসে যেতাম...কে জানে!আমি তোমাকে বুঝি গো মণিমা।তুমি একটু শান্ত হয়ে চুপটি করে বসে থাকো দেখি!তোমার খাওয়ার আগের ওষুধটা নিয়ে আসি দাঁড়াও।এভাবে হুটহাট করে মাথা গরম কোরো না।প্রেশারটার কথা যেন মাথায় থাকে....আর একটাও কথা বলবে না তুমি!চুপ!

নিজের ঠোঁটে হাত দিয়ে,ধীরে-ধীরে দুদিকে ঘাড় নাড়লেন সৌদামিনী দেবী।কেঁপে উঠে মণিমাকে জড়িয়ে ধরলো রাত্রি....

-ভুল হয়ে গেছে মণিমা!তুমি এত উত্তেজিত হয়ে গেছিলে,তোমার শরীরের কথা ভেবে,আমি ভুল করে বলে ফেলেছি!ভগবানই তো তোমাকে আজন্ম-নির্বাক করে রেখেছেন!আমি তোমাকে চুপ করতে বলার কে!আমার খুব ভুল হয়ে গেছে গো...

নিজের বুক থেকে টেনে তুলে,রাত্রির হাতদুটো জড়িয়ে ধরলেন সৌদামিনী দেবী।তারপর ওর মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে,একঢাল কালো চুলের রাশি সরিয়ে ওকে ভালো করে দেখলেন,ওকে আবার জড়িয়ে ধরলেন বুকে....মণিমার বুকে মুখ লুকিয়ে পালঙ্কের পাশের ছোট টেবিলটার দিকে চেয়ে রইলো রাত্রি।ফটো ফ্রেমের মধ্যে একমুখ হাসি নিয়ে জ্বলজ্বল করছে সুপুরুষ স্বপ্ননীল...

রাত্রির কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলেন সৌদামিনী দেবী।তারপর ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন।নীলের ছবির ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে,মাথা নামিয়ে নিলো রাত্রি।চোখের জল আড়াল করতে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো ও...

-আমি আসছি মণিমা।তোমার ওষুধটা কোথায় যেন...

আবার টেনে রাত্রিকে নিজের পাশে বসালেন সৌদামিনী দেবী।বিছানায় একটা হাত রেখে,অপর হাত নেড়ে-নেড়ে ওকে কড়া করে শাসন করে,নিঃশব্দে বললেন,

"আর যে কটাদিন এই বাড়িতে আছিস,তুই আমার কাছেই শুবি!"

চোখের জলটুকু মুছে নিয়ে,হাসিমুখে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো রাত্রি....

শহরের অন্য প্রান্তে কানে ফোনটা ধরেই বিছানা আঁকড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো আন্তরিক।মধ্যরাত্রির জমাট বাঁধা অন্ধকার বিরাজমান,শহরের আনাচে-কানাচে।মাঝরাতে ঘুমটা হঠাৎ করেই ভেঙে যায় অন্তুর।মাঘ পেরিয়ে ফাল্গুনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে দেওয়ালে ঝুলতে থাকা বাংলা ক্যালেন্ডারটা।হালকা ঠান্ডায় কম্বলের উষ্ণতা ত্যাগ করে নিজের ঘরের জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো অন্তু।টেবিলের ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে,জানলাটা খুলে দিলো।উন্মুক্ত জানলা দিয়ে মাঝরাতের শীতল বাতাস ঘরে প্রবেশ করে কাঁপিয়ে দিলো ওকে।একটা সিগারেট ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়াকে,অন্তু জানালার বাইরে বের করলো।জানলার সামনে থেকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো পড়ার টেবিলটার দিকে।পোড়ামাটির সুদৃশ্য একটা ঘোড়া সাজানো রয়েছে 'সঞ্চয়িতা'-র পাশেই।সিগারেটটা ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমার মধ্যবর্তী স্থানে বন্দী রেখেই,অন্তু ওই ঘোড়াটা দুহাতে তুলে নিলো।ওটা হাতে নেওয়ামাত্রই ওর গলাটা জড়িয়ে ধরলো দুটো হাত।ওর ডান কানের লতিটা আলগা মেয়েলি কামড়ে জ্বলে উঠলো।পোড়ামাটির ঘোড়াটা হাতে নিয়েই আন্তরিক গোস্বামী স্মৃতি হাতড়ে ফিরে গেলো বছরখানেক আগে,অতীতের পাতায়...ফিরে গেলো লালমাটির দেশ,বাঁকুড়ায়...

-স্পন্দন দা,লাগেনি তো তোমার?ইস!দেখি-দেখি!রক্ত বেরোচ্ছে তো!
-না রে অন্তু!ও ঠিক আছে।তোর হাতটাও তো অনেকখানি কেটে-ছড়ে গেছে।এখন তুই স্কুলে যাবি কি করে?
-আরে আমার কথা ছাড়ো।তুমি আগে হসপিটালে চলো।বাইকটা ঠিক আছে তো?চলবে তো?দাও আমি চালাচ্ছি,তুমি পিছনে বসো।

পকেট থেকে নিজের রুমালটা বের করে স্পন্দনদার হাতে জড়িয়ে ভালো করে বেঁধে দিলো আন্তরিক।নিজের ক্ষতস্থান খোলাই রইলো।ওই রক্তাক্ত হাতেই রাস্তা থেকে স্পন্দনদার বাইকটা আন্তরিক টেনে তুললো...

আন্তরিক গোস্বামী,পেশায় একজন শিক্ষক।সুদীর্ঘ ছাত্রজীবন পেরিয়ে,অক্লান্ত পরিশ্রমের পর নিজের যোগ্যতায় সবেমাত্র স্কুলের চাকরিটা পেয়ে বাড়িছাড়া হয়েছে অন্তু।বাবা সুমন্তকুমার গোস্বামী এককালে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও,বর্তমানে অবসর গ্রহণ করেছেন।কিন্তু তিনি স্কুল ছাড়লেও,সন্তানসম ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁকে ছাড়েনি।তাই শিক্ষকতাও মুক্তি দেয়নি তাঁকে।তিনিও শুন্য হাতে ছাত্রছাত্রীদের নিরাশ করে ফেরাননি।গৃহশিক্ষকতার কাজে নিজের বার্ধক্যের একাকী অবসরটুকু মনের আনন্দেই যাপন করছেন।বিপত্নীক সুমন্তবাবু বরাবরই নিজের মতো করে সময় কাটাতে ভালোবাসেন।তবে একমাত্র পুত্রসন্তান অন্তু চাকরিসূত্রে বাড়ির বাইরে চলে যাওয়ায়,এখন বড্ড একাকীত্বের জ্বালায় ভোগেন তিনি।আজ সকালেও ছেলেটাকে উনি ফোন করেছিলেন,তবে আজ অন্তুটা ফোন ধরলো না।বেশ চিন্তিত মুখেই ওপর থেকে নীচে নামলেন সৌম্যকান্তি সুমন্তবাবু।একবার চাইলেন বড় আদরের স্থান "সুরসঙ্গম"-এর দিকে।আজ সোমবার।তাই সুবৃহৎ একখানা তালা ঝুলছে "সুরসঙ্গম"-এর দরজায়।শনি-রবিবার এখানে কচিকাঁচাদের কোলাহলের শব্দে কান পাতা দায় হয়ে যায়।সারাটা সপ্তাহ বন্ধু-বান্ধবহীন নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে-কাটাতে সপ্তাহান্তের জন্যই মুখিয়ে থাকেন সুমন্তবাবু।নীচের তিনটে ঘরই ভাড়া দেওয়া রয়েছে।কোনো ঘরে খুদে শিল্পীদের আঁকার ক্লাস হয়,কোথাও আবার কোনো দিদিমণি গানের তালিম দেন।আবার দুপুরের পর একজন নাট্যকার ভদ্রলোক আসেন অভিনয় শেখাতে।সন্ধ্যের পর একতলা থেকে ভেসে আসে ঘুঙুরের ঝমঝম শব্দ।নর্তকীর ঘুঙুরের শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে,তবলার ওপর হাত আছড়ে পড়ে বাদকের।আট থেকে আশির সমাহারে মুখরিত হয়ে ওঠে বাড়ির সম্মুখভাগ।আট বছরের নাতির হাত ধরে আসেন,আশি বছরের বৃদ্ধ ঠাকুর্দা।যেন একইসঙ্গে একই জীবনের দুটি প্রতিচ্ছবি...মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ।দুই প্রজন্ম যখন একসঙ্গে হাত ধরে সামনের ওই বড় রাস্তাটা পেরিয়ে এগিয়ে আসে "সুরসঙ্গম" এর দিকে,মনটা কানায়-কানায় ভরে যায় সুমন্তবাবুর।উনি আনোয়ারের মাকে বলে এক কাপ কড়া করে চা বাগিয়ে,দুপুর তিনটের মধ্যেই বসে পড়েন ওপরের বারান্দায়।দুপুর,বিকেল পেরিয়ে কখন যে সন্ধ্যে হয়ে যায়,সময়ের আর হিসেবও থাকে না।একেবারে রাতের খাওয়ার আগে বারান্দা ছেড়ে ওঠেন উনি।আজ সকাল থেকে অন্তুর সঙ্গে একবারও কথা হয়নি।চিন্তিত-ভারাক্রান্ত সুমন্তবাবু,বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে নেমে পড়লেন রাস্তায়।তখনই প্রতিবেশীর সঙ্গে দেখা।মনে-মনে একটু খুশিই হলেন উনি।স্থানীয় বাজার পর্যন্ত এতখানি রাস্তা, একা-একা আর যেতে হবে না।একজন সমবয়সী সঙ্গী পাওয়া গেলো।সুমন্তবাবু এগিয়ে গেলেন সুপ্রিয়বাবুর দিকে....সুপ্রিয়বাবু বলে উঠলেন,

-কি হে মাস্টার!খুদে মাস্টারের কি খবর?সে ভালো আছে তো ওখানে?হাত পুড়িয়ে একা আর কতদিন খাবে?ছেলে চাকরি পেলো,এবার একটু জমিয়ে সংসার করুক।আমরা বুড়োরা আর কদিন!মরার আগে দুচোখ ভরে ওদের একটু সংসার করতে দেখে যাই!আমি তো আমার ছেলের বিয়ে খাওয়ালাম!এবার তো তোমার পালা হে মাস্টার...
-দাঁড়াও ডাক্তার!ছেলেটা আজ ফোন ধরেনি,এমনিতেই একটু চিন্তায় আছি।আর বিয়ে!!ছেলে তো নিজে থেকে কিছুই বলে না।সবে তো চাকরি পেলো।যাক কয়েকটা বছর।নিজে কিছু না বললে,তখন তো আমাকেই বলতে হবে।আসলে ওর মা থাকলে,হয়তো মাকে বলতে পারতো!কি জানি!আমার সামনে হয়তো সেভাবে সহজ হতে পারে না!কিন্তু ফোনটা কেন যে ধরলো না....বড় চিন্তা হচ্ছে!
-আরে ধরবে-ধরবে!ছেলেমানুষ,সবে-সবে একা থাকছে।ঘুম থেকে উঠে চোখদুটো খুলে গুছিয়ে সব কাজকর্ম নিজের হাতে করছে,ওকেও একটু সময় দাও।পরে ঠিক ঘুরিয়ে ফোন করবে।এত চিন্তা কোরো না।তা আজ বাজার থেকে কি নেবে?চিংড়ি নাকি পাকা কাতলা?
-নাঃ ডাক্তার!ছেলেটা না থাকলে একা-একা খেয়ে সুখ পাই না!ওই একটু সবজি-ডাল-ভাত খেয়েই দিন কাটিয়ে দিই।রাতে তো খাই খান দুই রুটি!আর এক গ্লাস দুধ।আমার রান্নাঘরে অত ঝামেলা নেই।একবেলায় আনোয়ারের মা যা করে দিয়ে যায়,তাতেই দুবেলা চালিয়ে নিই।অন্তুর মা বেঁচে থাকতে,আমার রান্নাঘর অন্নপূর্ণার হেঁশেল ছিলো।এখন সেসব পাট চুকেছে।কোনোরকমে পেটে দুটো দিয়ে,দিন কাটিয়ে দিতে পারলেই হলো।আগে তাও রাতে রুটি দিয়ে একটু আধটু মিষ্টি খেতাম।তা আমরা সুস্থ থাকলে,তোমাদের সইবে কেন!তোমাদের চলবে কি করে ডাক্তার!ব্যাস!বাধিয়ে বসলাম ডায়বেটিস!ছেলের কড়া শাসন,মাথার দিব্যি!মিষ্টি বাড়িতে আর ঢুকবেই না।যাও বা আগে দু-চারটে কিনে এনে চুরি করে খেতাম,এখন সেটাও ছাড়তে হয়েছে।আনোয়ারের মা কাজ করতে এসে রোজ ফ্রিজ খুলে দেখে যায়,ফ্রিজে মিষ্টি আছে কিনা!থাকলেই অন্তুদাদাকে ফোন করে দেবে।আর আমিও বুঝি এখন,ছেলেটা আমাকে ছেড়ে বাইরে পড়ে থাকে,হুটহাট আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে,ওকেও তো সব ছেড়েছুড়ে আসতে হবে।ও অসুবিধেয় পড়ে যাবে।তাই যতটা বুঝেশুনে চলা যায় আর কি!তবে আগেরবার আমার ছেলেটা এসে নিজের হাতেই বাজার-হাট করে আমায় খাইয়েছে।এবার আবার স্কুলের ছুটি পড়বে,তারপর আসবে।তখন বাপ-ব্যাটা মিলে জমিয়ে কব্জি ডুবিয়ে খাবো।
-ওখানে তো খুদে-মাস্টার পিজি আছে,তাই না?
-হুম!খুব ভালো ওরা।দাদা-বৌদির গল্প তো অন্তু গালভরে করে।ওদের ওখানেই তো খায়।
-তবে তোমার অত চিন্তা কিসের মাস্টার!?
-কি জানি!বাপের মন তো!ওর মা মারা যাওয়ার পর,নিজের হাতে ধরে খাইয়ে-দাইয়ে মানুষ করেছি ছেলেটাকে!এখন ওকে ছাড়া কেমন যেন লাগে!পুরো বাড়িটাই ফাঁকা!কয়েক বছর পর যখন অভ্যাস হয়ে যাবে,তখন হয়তো এতটা খারাপ লাগবে না!এখন আর "অন্তু পড়ছিস তো?" বলে চেঁচাতেও হয় না!একা-একা আর ভালো লাগে না!বার্ধক্যের বড় জ্বালা,বুঝলে ডাক্তার!তোমার কাছে কোনো ওষুধ আছে নাকি!
-না হে মাস্টার!চুলে পাক ধরেছে,চামড়াও ঝুলে পড়ছে,এখন আবার তোমার কি ওষুধ চাই?এই বয়সে তোমার বার্ধক্য কাটিয়ে যৌবন ফেরানোর কোনো ওষুধ কিন্তু,আমার কাছে নেই!আগেই বলে দিলাম!আমি বাপু ডাক্তার!ভগবানও নই,ম্যাজিশিয়ানও নই,যে দুম করে তোমাকে তোমার কুড়ি বছর বয়স ফিরিয়ে দেবো!আবার তুমি বৌদির সঙ্গে ছাদনাতলায় গিয়ে দাঁড়াবে!বৌদির চোখে চোখ রাখবে...

সজোরে হেসে উঠলেন সুমন্তবাবু...

-আরে নানা!সেসব কিছু না!সেসব দিন তো কবে পেরিয়ে এসেছি।মনে হয় যেন গত জন্মের কথা!ওসব না ডাক্তার!শুধু একটু যদি ঘুমের ওষুধ পাওয়া যেতো,বড় ভালো হতো!সারাদিন তো তেমন কোনো কাজ নেই।ছেলেটা যতদিন না চাকরি পেয়েছে,ওকে তৈরি করার জন্য ওর পিছনে পড়ে ছিলাম।এখন হঠাৎ করেই যেন একদম বেকার-অকর্মণ্য হয়ে গেছি।ছেলেমেয়েগুলো আসে,ওদের পড়াই।ব্যাস!তারপর ছুটি।আর কোনো কাজ নেই।পেপার আর বই পড়ে কত আর সময় কাটানো যায় ডাক্তার!চোখে একটু ঘুমও নেই,যে ঘুমাবো!ঘুমও আমার সঙ্গে আড়ি করেছে বুঝলে তো...
-আরে এখন ওষুধ খেয়েও ঘুম আসবে না।আমরা যখন ঘুমের দেশে যাবো,আর ফিরবো না,বুঝলে!একেবারে চিরঘুমের দেশে।তাই যে কটাদিন বেঁচেবর্তে আছি,জেগেই কাটিয়ে দিই না হয়!তারপর কখন টুপ করে দুচোখ ঘুমে জড়িয়ে আসবে,আমরা কেউ কি আগে থেকে বলতে পারি!ওসব ওষুধ-বিষুধ ছাড়ো!বিকেলে আমাদের লাফিং ক্লাবে এসো!একটু শরীরচর্চা-যোগব্যায়ামও হবে,আর সেই সঙ্গে প্রাণখুলে হেসে যাও দেখি....ফ্রিতে খানিক আড্ডাও হবে।তোমায় আজ মোটা করে দুধ দিয়ে,চিনি ছাড়া চা খাওয়াবো।আজ বিকেলে বেরোনোর আগে তোমাকে হাঁক দেবো আমি।বেল বাজাবো,তৈরি হয়ে থেকো...
-এই তোমার চেম্বার নেই?আজকাল দেখি প্রায়ই উড়ে-উড়ে বেড়াও!
-বয়সটা তো নেহাৎ কম হলো না।প্রায় সাতের ঘর ছুঁই-ছুঁই,বুঝলে হে মাস্টার!আর এখন ছুরি-কাঁচি হাতে নিলে,হাত কাঁপে!তাই ওই সপ্তাহে দুদিন একটু চেম্বারে বসি।অপারেশন আর করি না।পেশেন্ট দেখে সব ছাত্রছাত্রীদের হাতেই তুলে দিই চিকিৎসার জন্য।কিন্তু ওরা আমাকে ছাড়ে না।বলে,পুরোনো চাল নাকি আজীবন ভাতে বাড়ে!অভিজ্ঞতার জন্য আমাকে মাথার ওপর রেখেছে...মতামত নেয়,একটু ভক্তিশ্রদ্ধা করে।এই আর কি....
-ওই দেখো ডাক্তার!তুমি বলতে মনে পড়লো,ঘরে চাল বাড়ন্ত।তিনদিন ধরে আনোয়ারের মা বলছে,আজ না নিলেই নয়!নইলে কাল থেকে দুবেলাই রুটি চিবোতে হবে।তুমি কি মাছের বাজারে ঢুকবে ডাক্তার?
-হ্যাঁ মাস্টার!
-আচ্ছা...এসো তবে!আমার আর ওদিকে যাওয়ার ব্যাপার নেই।
-এত চিন্তা কোরো না মাস্টার!খুদে মাস্টার পরে ঠিক তোমাকে ফোন করবে।
-হুম...দেখি...

দুই প্রবীণ বাজারের দুদিকে চলে গেলেন ব্যাগ হাতে।মিশে গেলেন ভিড়ের মধ্যে....

-আরে দাঁড়া না!অন্তু!

ধমকে উঠলো স্পন্দন...

-আমার ইনজেকশনে বিশাল ভয় লাগে স্পন্দন দা!বাথরুমে যাবো আমি!পালাবো...
-অন্তু!!
-স্পন্দনদা!হার্ট ফেল করবো আমি...বিশ্বাস করো!
-দাঁড়ান!অনেকটা কেটে গেছে আপনার হাত!
-হ্যাঁ দিলেন তো ব্যান্ডেজ করে!ওতেই সেরে যাবে।আবার খামোখা ইনজেকশন কেন?

ধমকে উঠলেন একজন জুনিয়র ডাক্তার...

-এটা টিটেনাস!নিতেই হবে!
-অন্তু চুপটি করে বোস!এতবড় লোক...
-আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে!এই....এই আমি লোক নই!একি অত্যাচার!!আমি বাচ্চা ছেলে....
-আচ্ছা বুড়ো তুই!থামবি!?আমিও নিলাম তো!আমি চেঁচিয়েছি?
-আমি নেবো না!এসব জানলে আমি আসতামই না!ওইখান থেকেই স্কুলে পালাতাম...দেখো,এই শীতের মধ্যেও ভয়ে কেমন ঘেমে যাচ্ছি আমি!
-কি ব্যাপার!এত ঝামেলা কেন এমার্জেন্সিতে?এভাবে কে চেঁচাচ্ছে?!

নারীকণ্ঠের আবির্ভাবে আন্তরিক সিরিঞ্জ থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে চাইলো।এই সুযোগে তড়িঘড়ি শার্ট নামিয়ে নিলো ও।

-দেখুন না ম্যাডাম!টিটেনাস।কিছুতেই ইনজেক্ট করতে দিচ্ছে না।পেশেন্ট সুস্থির হয়ে বসছেই না!খালি তিড়িং-বিড়িং করে লাফাচ্ছে....
-আমি দেখছি!আপনি নেক্সট পেশেন্টকে দেখুন প্লিজ।সময় নষ্ট করবেন না।বাইরে লম্বা লাইন।আপনি স্যারের কাছে যান।কাইন্ডলি একবার আউটডোর হয়ে যাবেন।
-থ্যাঙ্কু ম্যাডাম!

ওই নারীর হাতে সিরিঞ্জ ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন ভদ্রলোক।নারীর পরনে নার্সের পোশাক।যতই ভয় করুক,একজন মহিলার সামনে হাউহাউ করে শিশুর মতো কাঁদা যায় না!অন্তু প্রাণপনে গলা ছেড়ে কাঁদার ইচ্ছেটাকে দমন করার চেষ্টা করলো।কিন্তু ওই নারীকে সিরিঞ্জ বাগিয়ে ধরতে দেখেই,ভয়ের চোটে আবার ওর জোর বাথরুম পেয়ে গেলো।পেটের মধ্যে গুড়গুড় করে ডেকে উঠলো....

-শার্টের হাতাটা তুলুন!হাতটা একটু দেখি....
-ওরা তো ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ....
-হাতটা দেখি...

উপায়ান্তর না দেখে,অন্তু আবার নামিয়ে রাখা শার্টের হাতাটা গুটিয়ে দিলো।সেই নারী একবার অন্তুর মুখের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে এগিয়ে গেলেন।অন্তু চেপে ধরলো সেই নারীর হাত,

-সিস্টার!মরে যাবো!প্রচন্ড লাগবে....

আন্তরিকের দিকে চেয়ে উনি মৃদু হেসে বললেন,

-আমরা মানুষকে মারার জন্য ইনজেকশন দিই না,সবসময় বাঁচানোরই চেষ্টা করি।এটাই আমাদের কাজ।তা কি করা হয়?আপনি কাজকর্ম কিছু করেন?
-হুম।স্কুল টিচার!
-ছাত্রছাত্রীরা জানে,স্যার যে এত সাহসী?
-না!আমি খুব রাগী টিচার!আমাকে সবাই ভয় পায়।কথা বলতেই সাহস পায় না।
-আর আপনার এই রাগ,এত অসমসাহসিকতা,একটা ইনজেকশনের কাছেই জব্দ!?

চুপ করে রইলো আন্তরিক...

-বাইকে একসিডেন্ট?
-হুম!

অন্তুর হাতের মধ্যে থেকে উনি নিজের হাতটা ধীরে-ধীরে বের করে নিলেন।কথায়-বার্তায় আন্তরিককে ব্যস্ত রেখে,তুলোটা ওর হাতে ঘষে নিলেন সেই নারী...তারপর বললেন,

-আজ তো বাইরে ভালোই রোদ উঠেছে।ঝকঝকে-চকচকে পরিষ্কার একটা দিন!এইরকম দিনে আছাড় খেলেন কি করে?উড়ছিলেন নাকি!
-না মানে...
-আমি চালাচ্ছিলাম বাইক...

স্পন্দন পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো।এগিয়ে এলো...

-হঠাৎই স্লিপ করে একপাশে কাত হয়ে গেছে।ব্যালেন্স রাখতে পারিনি...তাই...
-ঠিক আছে!দুদিনের ওষুধ দিয়েছে হয়তো।ওষুধগুলো ঠিকমতো খাবেন।দুজনেই ঠিক হয়ে যাবেন।
-ওষুধের পরেও আবার....উফ!!আমি মরে গেছি!

কথা শোনার জন্য একটু অন্যমনস্কভাবে অন্যদিকে ফিরে স্পন্দনদার মুখের দিকে চেয়েছিলো অন্তু।এর মধ্যেই নিজের কাজ সেরে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন সেই নারী...তারপর এগিয়ে গেলেন ডাস্টবিনের দিকে।অবাক হয়ে গেলো আন্তরিক।

-এটুকুতেই আমাকে ছেড়ে দিলেন?সত্যিই দিলেন না!!
-আর কি দেবো?

ঘুরে দাঁড়ালেন সেই নারী...

-ওই যে,আপনার হাতের ছুঁচটা!ঠিকমতো ফোটালেন না?

নির্মল হাসি ঝরে পড়লো সেই নারীর সমগ্র মুখাবয়বে,

-হয়ে গেছে!
-কি!কখন!!বুঝতে পারলাম না তো!সামান্য একটুখানি লাগলো তো!
-তাতেই আপনি আগে থেকে যা প্রাণান্তকর চিৎকার জুড়েছিলেন....
-ঝুমুর দি!স্যার মেটার্নিটি ওয়ার্ডে একবার ডাকছেন।তাড়াতাড়ি এসো।পেশেন্ট রেডি হয়ে গেছে।একটু বিপিটা...
-তুমি যাও মাসি।আমি আসছি....

আবার আন্তরিকের দিকে ফিরলেন সেই নারী।

-শুনুন!এখন তেমন ব্যথা হবে না।কিন্তু টিটেনাস তো!পরে বুঝবেন।বিশেষ কিছুই না।ওই সামান্য একটু ব্যথাই হবে।দুদিনেই ঠিক হয়ে যাবে।আর হাতের ব্যান্ডেজটা দুজনেই একটু ড্রেসিং করিয়ে নেবেন।গেট ওয়েল সুন!
-ঝুমুর দি...
-এইতো,চলো....

সিঙ্কে হাত ধুয়ে বেরিয়ে গেলেন সিস্টার...

-কিরে অন্তু?লাগলো?তখন থেকে ভয়েই ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করছিলি!

আন্তরিক শার্টের হাতা নামাতে-নামাতে দরজার দিকে চেয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো।ওকে ধাক্কা দিলো স্পন্দন।

-কিরে?
-কি!
-লাগলো?
-না ঠিক লাগেনি....তবে বোধহয় বাজলো!
-কি?!কি বাজলো?
-ঝুমুর!ইয়ে স্পন্দন দা,ওষুধগুলো নিয়ে আসি দাঁড়াও...বাবাকেও একটা ফোন করতে হবে।ফোন করেই যাচ্ছে আমাকে....
-এসব আবার মেসোমশাইকে বলিস না!
-মাথা খারাপ নাকি!বাবাকে এসব বললে দিনে দুবারের জায়গায়,কুড়িবার ফোন করবে!আসছি আমি ওষুধ নিয়ে,তুমি এই চেয়ারে একটু বসো!

দুজনেরই বাঁ-হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে,ওষুধ নিয়ে,স্পন্দন দার বাইকের পিছনে বসে যখন হাসপাতাল চত্বর ছাড়লো,তখনও বারংবার বাইরে থেকে দরজার-জানালার দিকে ফিরে-ফিরে চাইলো আন্তরিক।এমনকি ওষুধ নিয়েও স্পন্দন দার চোখ এড়িয়ে,এমার্জেন্সির সামনের লম্বা বারান্দাটা থেকে টুক করে একবার দৌড় মেরে ঘুরে এসেছে ও।কিন্তু আর তার দেখা পায়নি...স্পন্দনদা ওকে স্কুলে ছেড়ে চলে গেলো নিজের কাজে।স্কুলের প্রথম দুটো পিরিয়ড মিস হয়ে গেছে।টিচার্স রুমে গিয়ে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে ঢকঢক করে খানিকটা জল খেলো আন্তরিক।বাঁ হাতের কাটা জায়গাটায় তেমন ব্যথা নেই,কিন্তু সে ইনজেকশনটা যেখানে দিয়েছে,সেখানটা প্রচন্ড ব্যথা করছে।হাত নাড়ানোই যাচ্ছে না।বাথরুমে গিয়ে কয়েকটা বোতাম খুলে শার্টটা একটু খুলে ফেললো আন্তরিক।হাতের দিকে চাইলো।বাঁ হাতের কব্জি থেকে কনুই পর্যন্ত নিখুঁতভাবে ব্যান্ডেজ করা,তারপর ওপরে রক্তের চিহ্নমাত্র নেই।কিন্তু হাতের ওপরদিকে প্রবল ব্যথা....

সে সামনে উপস্থিত নেই,তার স্পর্শটুকুও নেই,এমনকি স্পর্শের চিহ্নমাত্র নেই!ইনজেকশনের কোনো সূক্ষ ক্ষতও নেই,তাই ক্ষতের প্রলেপও নেই।কোত্থাও কিচ্ছু নেই।রয়েছে শুধু একটা চিনচিনে তীব্র ব্যথা...কিন্তু শুধু তো হাতে না,বুকটাও যেন একটু ব্যথা করে উঠলো আন্তরিকের।টিটেনাস নিলে কি বুকেও ব্যথা করে নাকি!হেসে ফেললো ও নিজেই।ঘন্টা পড়ে গেলো।তড়িঘড়ি জামার বোতাম আটকে আন্তরিক বাইরে বেরিয়ে এলো....

হাতে ধরে থাকা পোড়ামাটির ঘোড়াটা আন্তরিকের দিকে একভাবে চেয়ে রয়েছে।সিগারেট পুড়ে শেষ হয়েছে অনেক আগেই।ঘোড়াটার শক্ত পিঠে আদর করে চুমু খেয়ে টেবিলের প্রান্তে ওটাকে রাখতে গেলো আন্তরিক।হাতটা সরাতে গিয়েই সামান্য একটু জল থাকা কাঁচের গ্লাসটায়,অসাবধানে হাত লেগে গেলো।ওটাকে বাঁচাতে গিয়ে ঘোড়াটাই পড়ে যাচ্ছিলো টেবিল থেকে।সব ছেড়ে দিয়ে আগে ঘোড়াটাকে আঁকড়ে ধরলো আন্তরিক।ওটাকে বাঁচালো।কাঁচের গ্লাসটা মেঝেতে পড়ে গিয়ে ঝনঝনিয়ে ভেঙে,জল ছিটকে একেবারে চুরমার হয়ে গেলো....

অতর্কিতেই ঘুমটা ভেঙে গেলো রাত্রির।মণিমা ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে।একভাবে শুয়ে ঘুমটা বেশ এসে গিয়েছিলো ওর।কিন্তু হঠাৎ করেই ঘুমটা ভেঙে গেলো,কোনো কারণ ছাড়াই।প্রায় শেষ রাত তখন।বুকের ওপর থেকে মণিমার হাতটা সরিয়ে পাশ ফিরে শুলো ও।ঘরে সবুজ রঙয়ের হালকা আলো জ্বলছে।বিছানায় শুয়ে-শুয়েই টেবিলের দিকে চোখ রাখলো ও।মণিমার ঘরের নকশা করা গোলাকার কাঠের টেবিলটার ওপর রাখা ছবিতে নীল দা হাসছে,ওর দিকে চেয়েই....কয়েক মুহূর্ত ওই দিকেই চেয়ে রইলো রাত্রি।অদ্ভুত একটা শিহরণ খেলে গেলো ওর সারাটা শরীর জুড়ে।ভালোলাগার আবেশে দুটো চোখ বুজে ফেললো ও....

-ওই পেঁচি শোন!
-নীল দা!চুলে লাগছে,উফফ!!ছাড়ো!

স্বপ্ননীলের ঘর পেরিয়ে চুপিসাড়ে পালাতে যাচ্ছিলো রাত্রি।কিন্তু ধরা পড়ে গেলো ও।নীলদা ঠিক টের পেয়ে গেছে।আর এসেই ওর কোমর পর্যন্ত দুলতে থাকা বিনুনীটা টেনে ধরেছে....

-বছর শেষে রেজাল্টের দিন আমার কাছ থেকে খালি পালিয়ে বেড়ানো হবে!তাই না!
-এবার আর পালাবো না,সত্যি বলছি!সবার আগে তোমাকেই রেজাল্ট দেখাবো!
-খারাপ হলেই তো পালাবি!
-পালাবো না,আরে খারাপ হবে না।ছাড়ো না আমায়!
-যাতে ভালো হয়,সেই চেষ্টাটা কর।তার জন্য পড়তে বসতে হবে তো।যা,বইপত্র নিয়ে আয়!আমি তোকে পড়াবো!
-তোমাকে কে পড়ায় তার ঠিক নেই,তুমি আবার আমাকে পড়াবে!
-কি বললি!আমার মুখে-মুখে কথা....দাঁড়া...

হাতের মুঠোয় ধরে থাকা রাত্রির বিনুনীটা আরও জোরে টেনে ধরলো স্বপ্ননীল...

-ওরে বাবা!তোমার জ্বালায় আমার সব চুল ছিঁড়ে গিয়ে,আমি কোনদিন ন্যাড়াই হয়ে যাবো!আচ্ছা...আমাকে এবেলা ছেড়ে দাও নীল দা!বিকেলে ঠিক পড়তে বসবো!
-খালি ফাঁকিবাজি তাই না!?ওসব একদম চলবে না!যাও,আগে বই নিয়ে এসে পড়তে বসো!
-এই তুমি সবসময় এত পড়া-পড়া করো কেন গো!মা কালীর দিব্যি বলছি,এবেলা ছেড়ে দাও।আচার খাওয়াবো!চুরি করে আনবো!
-এই কিসের আচার রে?
-কুলের!তোমার পছন্দ তো?বেশি করে নিয়ে দুপুরে চুপিচুপি ছাদে উঠবো।এখন ছেড়ে দাও না আমায়....
-এবার যদি ফেল করিস না...
-আজ পর্যন্ত কোনোদিনও করেছি?
-আমি চেপে না ধরলেই করবি!!তোকে আমি চিনি না!তুই বিশ্ব-ফাঁকিবাজ!আমি চেপে না ধরলে তুই ঠিক...

নীলের হাত ছাড়িয়ে পালালো রাত্রি।

-তুমি পারবেই না আমাকে চেপে ধরতে...আমি ঠিক পালাবো....
-আজ যদি সন্ধ্যেবেলায় পড়তে না বসিস না,দেখবি তোর মণিমাকে বলে দেবো,তোর পড়াশোনায় একটুও মন নেই!স্কুল ছাড়িয়ে ওই ঝগরুটে বুড়ির সঙ্গে ছাদে গয়না বড়ি দিবি,আর ছড়া কেটে-কেটে বরের নাক টেনে তুলবি!

দূর থেকে মুখ ভেঙিয়ে স্বপ্ননীলের সামনে থেকে ছুটে পালালো রাত্রি।হেসে নিজের ঘরে ঢুকে আবার নিজের পড়াশোনায় মন দিলো স্বপ্ননীল....

দুটো চোখ বন্ধ করে লজ্জা আর ভালোলাগার আবেশে,নিজেকে বিছানায় মিশিয়ে দিচ্ছিলো রাত্রি।স্বপ্ননীলের ছবির পাশে রাখা টেবিল ঘড়িটা কেঁপে উঠলো।পাঁচটা বাজলো বোধহয়।রাত্রি দৌড়ে গিয়ে এলার্মটা বন্ধ করে দিলো।এত সকালে এলার্ম দিয়েছে!মণিমা পায়ে এত ব্যথা নিয়ে,এই ভোরবেলা ঠান্ডার মধ্যে উঠে করেটা কি!সৌদামিনী দেবীকে আর ডাকলো না রাত্রি....নিজের হালকা চাদরটা চুড়িদারের ওপরেই ওড়নার মতো করে চাপিয়ে নিলো।মণিমার ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিংয়ের বাথরুমে ঢুকেছিলো রাত্রি।ডাইনিংয়ে এসে টেবিলের দিকের দুটো জানলা খুলে একটা চেয়ার টেনে ওখানে চুপটি করে বসলো ও।গতরাতে আর চুল বাঁধতে ইচ্ছে করেনি।খুলেই শুয়েছিলো।জট পাকিয়ে গেছে।জানালার বাইরের কুয়াশা ঘেরা প্রভাতের দিকে চেয়ে থাকতে-থাকতে,অন্যমনস্কভাবে নিজের অগোছালো খোলা চুলে হাত চালাচ্ছিলো রাত্রি...হঠাৎই পায়ের শব্দ পেয়ে পিছন ফিরে চাইলো ও,চমকে গিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো....

(চলবে.....)

ছবি : সংগৃহীত

ধারাবাহিকটি ভালো লাগলে ব্লগ থেকে নির্দ্বিধায় শেয়ার করুন ও সবাইকে পড়ার সুযোগ করে দিন।😊😊

২১টি মন্তব্য:

  1. সিট বেল্ট টা বেঁধেই বসলাম। শুরু টা বেশ ভালই লাগলো। পরের টার জন্যে অপেক্ষা করে রইলাম।লাভ ইউ।

    উত্তরমুছুন
  2. এই উপন্যাস টা অন্ততঃ বিয়োগান্তক যেন না হয়, প্লীজ্।

    উত্তরমুছুন
  3. বেশ ভালো লাগল, নোটিফিকেশন পাইনা কেনগো,জানতামইনা আজ নতুন গল্প শুরু করছ

    উত্তরমুছুন
  4. সব উপন‍্যাসের শুরুটা যেমন হয় তেমনি সব গুলিয়ে গেল। কিছু কিছু মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। প্রথমেই অনেকগুলো চরিত্রের সঙ্গে আলাপ হয়ে বেশ খুশী।

    উত্তরমুছুন
  5. তোমার গল্পের পথ চেয়ে বসেছিলাম...আবারও শুরু হলো পথ চলা নির্বাক হয়ে... নতুন চরিত্রের সাথে সাথে নতুন ভাবনা ভাবতে....

    উত্তরমুছুন
  6. সব চরিত্রের সঙ্গে মিশতে আরেকটু সময় লাগবে।।

    উত্তরমুছুন
  7. একসাথে অনেককে পেলাম। শুরু টা তো ভালোই লাগলো। সন্দেহ নেই প্রতিবারের মতো এটাও দুলিয়ে দেবে। সঙ্গে আছি ❤️

    উত্তরমুছুন
  8. তোমার ক্ষুরধার লেখনিতে শরৎচন্দ্রের ছোঁয়া পাই, দিদি! তোমার গল্পের প্রতিটা চরিত্র হৃদয়-মন আন্দোলিত করে, এবং শিহরিত হয় নারী মনের দোটানা মত চরিত্র যখন উঠে আসে তখন। চারিদিকের এত ঘটনা অঘটনা দেখতে-শুনতে হাঁপিয়ে উঠছি আর অপেক্ষায় আছি তোমার পরবর্তী পর্বের।

    উত্তরমুছুন

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট