অনুসরণকারী

মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০

নির্বাক (দ্বিতীয় পর্ব)


 

নির্বাক


সাথী দাস


দ্বিতীয় পর্ব




বাইরের আধো অন্ধকার তখনও পুরোপুরি কাটেনি।ঘরের মধ্যেও প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না।ডাইংয়ের বড় আলোটা জ্বালিয়ে রাত্রির দিকে একবার চাইলো সে।ওকে অসময়ে ওপরে দেখে একটু অবাক হলেও,সে একটাও কথা বললো না।হয়তো কথা বলার প্রয়োজন মনে করলো না।ফ্রিজ খুলে ডিপ-ফ্রিজ থেকে কিছুটা বরফ একটা কাঁচের গ্লাসে বের করে নিয়ে,ফ্রিজ বন্ধ করে সিঁড়ি বেয়ে সোজা ওপরে চলে গেলো।বরাবরই মণিমা ছাড়া এই বাড়ির প্রতিটি সদস্যের কাছেই রাত্রি একরকম অস্পৃশ্য,অবহেলিতই বলা চলে।এমনকি বাড়ির ঠিকে কাজের বউ মালতীদি পর্যন্ত,বৌমনির কাছে ওকে নিয়ে মস্করা করে।ঈশ্বর সর্বশক্তিমান ওকে তৈরী করার সময় দুহাত ভরে রূপ তো দিয়েছে,কিন্তু সেই রূপকে আড়াল করে রেখেছে বর্ষার আকাশের জল ভরা কালো মেঘের মতো রঙ দিয়ে....তার চোখে রাত্রি আজ মেঘবালিকা....এই কি সেই মেঘ,যা এই মুখার্জী বাড়ির খোলা ছাদে একদিন বয়ে আনতো মনকেমনের বৃষ্টি...এই কি সেই বৃষ্টির ধারক,যে বৃষ্টি কচুবনে-কলাবাগানে ঝরতো অঝোর-ধারায়!এই কি সেই বৃষ্টি,যে বৃষ্টিতে সারা শরীর ভিজিয়ে,শুধুমাত্র মাথাটুকু বাঁচানোর জন্য নীল দার সঙ্গে রাত্রি মাথা আড়াল করতো,সুবৃহৎ কচুপাতার আড়ালে!!নাকি এই বৃষ্টিই সেই সর্বনাশা বৃষ্টি,যা মায়ের দেহকে চিতায় দেওয়ার আগেই ভিজিয়ে দিয়েছিলো সেইদিন....

আলোটা নিভিয়ে দিলো রাত্রি।হঠাৎ করেই অসহ্য লাগছে এই আলো।বেলা বেশি হয়নি,সবে সাড়ে পাঁচটা বাজে।আবার জানলার সামনে চোখ বন্ধ করে বসে,ভোরের শীতলতায় স্নান করে,অতীতে ফিরে গেলো রাত্রি।ফিরে গেলো সেই বারান্দায়,সেই উঠোনে,যেখানে মাকে এনে রাখা হয়েছিলো।বাবাকে তো ওর মনেই পড়ে না।এই বাড়ির একতলায় ওই ঘরটায় মাকে সঙ্গে করে,একরত্তি রাত্রিকে কোলে নিয়ে বাবা সংসার পেতেছিলো।কাজ করতো কোন এক চটকলে।ভাড়া দিতো,বাজার করতো,সামান্য দুটো খেতো,আর ওকে নাকি বুকে করে আগলে মানুষ করতো!এ সবই পরে বড় হয়ে মণিমার থেকে শোনা।রোগ যে বাবার হৃদপিন্ডে চুপিসাড়ে বাসা বেঁধেছিলো,সেটা ওই এটাকটার আগে কেউ বুঝতেই পারেনি।নিত্যদিনের মতোই সেদিনও নাকি বাবা কারখানায় গিয়েছিলো ডাল-ভাত খেয়ে,কিন্তু ফিরেছিলো খাটিয়ায় শুয়ে,চোখ বন্ধ করে।সেদিন নাকি রাত্রির মা একটুও কাঁদেনি।চুপ করে একতলার ওই বারান্দায় রাত্রিকে কোলে নিয়ে বসেছিলো।তিনকূলে ওর কেউ আছে কিনা,আজ আর রাত্রি জানে না।কোনোদিনও ওর জন্য,ওকে দাবী করে এই মুখার্জী বাড়ির দরজায়,কাউকে এসে দাঁড়াতে রাত্রি দেখেনি।সেদিন বাবা যখন ফুলের শয্যায় পরম নিশ্চিন্তে শেষবারের মতো নিদ্রামগ্ন হয়েছিলেন,রাত্রি তখন মায়ের বুক আগলে ঘুমিয়েছিলো বিভোর হয়ে।এরপরই শুরু হয়েছিলো মায়ের জীবন-সংগ্রাম।বড়মা অর্থাৎ মণিমার শাশুড়ি তখন এ সংসারের কর্ত্রী ছিলেন।উনি দীর্ঘদিন ধরে শাপশাপান্ত করে রাত্রির মাকে ঘর ছেড়ে দিতে বলেছিলেন।বাড়ির সকলেই নাকি তাই চাইতো!অভিভাবকহীন অবস্থায়,পরম যত্নে ছাঁচে ফেলে কালো কষ্টিপাথরে গঠিত একজন পূর্ণযৌবনা বিধবা আর তার একমাত্র কন্যাসন্তানের দায়,সেই সময় কেউই নিতে রাজি হননি।সবাই ওদের উঠিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো।জ্যেঠুমণিকে ধরে কেঁদে পড়েছিলো মণিমা।এই মণিমার জন্যই সেদিন ওদের আর রাস্তায় নেমে দাঁড়াতে হয়নি।মণিমার একান্ত ইচ্ছেরক্ষার স্বার্থে,জ্যেঠুমণি ওদের মাথা গোঁজার শেষ সম্বলটুকু কিছুতেই কাউকে কেড়ে নিতে দেননি।আজও আবছা-আবছা মনে পড়ে রাত্রির...রাতে বড়মা ঘুমিয়ে পড়লে চুপিচুপি সকলের নজর এড়িয়ে,নিজের খাওয়ার পাত থেকে তুলে রাখা মাছের বড় টুকরোটা,ভাজাভুজি,একটু ডাল,কাপড়ের আঁচলের তলায় কাঁসার থালা-বাটিতে করে লুকিয়ে নিয়ে একতলায় আসতো মণিমা।খিদের জ্বালায় ওর কান্না থামাতে কোনোদিন মুড়ি,কোনোদিন একমুঠো চিঁড়ে ভিজিয়ে রাত্রিকে জোর করে গিলিয়ে রাখতো ওর মা।মণিমা এসেই ঘুম থেকে রাত্রিকে টেনে তুলে,হ্যারিকেনের আলোয় কোলে বসিয়ে খাইয়ে দিয়ে যেতো।রাত্রি ঘুমচোখে দেখতো,আলোর অভাবে খুব সাবধানে কাঁটা বেছে খাওয়াতো মণিমা।বড়মা বলতো,বিনে-পয়সায় থাকতে দিয়েছে,এই ঢের!অত আলো-বাতাস দিতে পারবে না।তাই সন্ধ্যে নামার পর আলো জ্বলতো না,পাখা চলতো না ওদের ঘরে।হ্যারিকেনের আলোই ছিলো একমাত্র ভরসা।কিন্তু সেই আলোটুকুও সেদিন নিভে গেলো,যেদিন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলো।হলুদ রঙের ওপর অজস্র লাল ফুটকি দেওয়া একটা ফ্রক পরে,এলোমেলো জট পাকানো চুলে বারান্দায় এসে চুপটি করে দাঁড়িয়েছিলো রাত্রি।ওর বয়স তখন চার বা পাঁচ!কিন্তু ওর আবছা মনে আছে,সারাদিন অঝোর-ধারায় বৃষ্টি হয়ে,সেই সময় টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিলো।মায়ের গায়ের সাদা চাদরটা ভিজে যাচ্ছিলো বৃষ্টিতে।বেশিক্ষণ দেখতেই দেওয়া হয়নি ওকে।বাঁশের খাটিয়ায় মাকে বেঁধে নিয়ে কোথায় যেন চলে গেলো সবাই।রাত্রি কাঁদেনি সেদিন!কারণ ও বুঝতো না,মৃত্যু কি!!শুধু ঘরে ঢুকে মায়ের সেলাইয়ের বাক্সটাকে খেলনা ভেবে,ওটা খুলে রঙিন সুতোগুলো নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করেছিলো।সেই টেবিল-ক্লথটা আজও অসম্পূর্ণ অবস্থায় বাক্সে রয়ে গেছে।মা রেশমী সুতো দিয়ে ছুঁচ ফুটিয়ে-ফুটিয়ে,গোলাপী কাপড়টার এককোণে ফুলের নকশা বুনতে শুরু করেছিলো।কাজ পুরোপুরি শেষ হলে হয়তো কিছু টাকা পেতো।কিন্তু সেই কাজ,মা আর শেষ করতে পারেনি।পড়ে রয়েছে কয়েকটা অসম্পূর্ণ কাঁথাও।টেবিল ক্লথের এককোণে ফুলের একটাই মাত্র পাপড়ি ফুটেছিলো।বাকি সব পাপড়ি রোগের প্রকোপে শুকিয়ে ঝরে গেছে।মায়ের কি কঠিন রোগ হয়েছিলো,সেদিন বুঝতে পারতো না রাত্রি।কিন্তু আজ ও বোঝে।ওই মারণ রোগকে কর্কট রোগ বলে,যা মায়ের জরায়ুদ্বারে হয়েছিলো।প্রতিমাসে অবাঞ্ছিত অত্যধিক রক্তস্রোতে ভেসে গিয়ে,প্রায় বিনা চিকিৎসায় মরণ-যন্ত্রণা সয়ে,রক্তাক্ত মা আজীবনের জন্য ওকে ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে....মা চলে যেতেই,বড়মা ওকে বাড়িছাড়া করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিলো।পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলো কোনো অনামী অনাথালয়ে।রাত্রির নাকি ওপরে উঠতে নেই।ওদের সঙ্গে বসে এক টেবিলে খেতে নেই!কিন্তু ওর বাবা বেঁচে থাকতে,বাবার ঘাম ঝরানো কষ্টার্জিত পয়সা তো বেশ নেওয়া যেতো!তখন তো কোথাও বাধতো না।দুচোখে মুক্তোদানার মতো টলটলে জল নিয়ে,জানলার গরাদ ধরে মৃদু হাসলো রাত্রি।বয়সে-অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়ে আজ ও বোঝে,তিনটে জিনিসের কোনো জাত-ধর্ম-বর্ণ হয় না।রক্ত,খিদে আর টাকা!সবাই হেরে যায় এই ত্রয়ীর কাছে।মাথা নত করতে বাধ্য হয়।কতদিন দুপুরবেলা খিদের জ্বালায় কেঁদে অস্থির হয়ে যেতো রাত্রি।বড়মার কড়া হুকুম,বাড়ির সবার খাওয়া হলে রান্নাঘর পরিষ্কার করে,তবে ওকে ওই রান্নাঘরের এককোণে মেঝেতে বসে ভাত খেতে দেওয়া হবে।মণিমা ওপর থেকে কখন খেতে ডাকবে,স্নান করে সেই আশায় বসে থেকে-থেকে এক-একদিন কৌটোর অর্ধেক বিস্কুট,বাতাসা-নকুলদানা সব খেয়ে ফেলতো রাত্রি।তারপর জল খেয়ে সিঁড়ির গোড়ায় এসে বসে থাকতে-থাকতে,ঢুলে পড়ে যেতো।কোনো-কোনোদিন হয়তো শুয়ে ঘুমিয়েই পড়তো।সবার খাওয়া হয়ে গেলে,মণিমা যখন ওকে ডাকতো,কোনো সাড়া পেতো না।তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমেই ঘুমন্ত রাত্রিকে বুকে করে তুলে,নিয়ে যেতো ওপরে।ওকে খাওয়াতে-খাওয়াতে প্রায় দিনই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলতো মণিমা।অবুঝ রাত্রি ভাবতো,ওর মতোই বুঝি মণিমারও খিদে পেয়েছে।পেট মুচড়ে ব্যথা করছে,গুড়গুড় করছে পেটের ভিতর,তাই মণিমা কাঁদছে!রাত্রি ওর ছোট্ট-ছোট্ট দুটো হাত দিয়ে,নিজের থালা থেকে একটুখানি ভাত নিয়ে তুলে দিতো মণিমার মুখে।মণিমা নিঃশব্দে কাঁদতে-কাঁদতে ওই ভাতটুকুই কোনোক্রমে গিলে রাখতো।তারপর ওকে জড়িয়ে ধরতো বুকে।চুমু খেয়ে আদর করে-করে,বাকি ভাতটুকুও মণিমা কত যত্ন করে রাত্রিকে খাইয়ে দিতো!তারপর চোরের মতো চুপিসাড়ে একতলায় এসে,ঘুম পাড়িয়ে দিতো ওকে।আজও ভাবলে অবাক লাগে রাত্রির।সেই সময় ওকে ঘিরে ওপরে মুখার্জী পরিবারে,রীতিমতো ঠান্ডা-লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছিলো।শুধুমাত্র রাত্রিকে একতলা থেকে দোতলায় ওঠানোর জন্য,অসম লড়াই শুরু করেছিলো মণিমা।বাড়ির কর্ত্রীর বিরুদ্ধে,ননদের বিরুদ্ধে এক নির্বাক নারীর যুদ্ধ!!যে বলতে পারে না,সে কি চায়!কেন চায়!তার কথা বা ইচ্ছের স্বপক্ষে,কোনো যুক্তি তার কাছে নেই।থাকলেও,তা কাউকে বোঝানোর কোনো ক্ষমতা নেই।কারণ তার ঝুলিতে,জন্ম থেকেই ঈশ্বর কোনো শব্দ দেননি।অথচ ওই একটিমাত্র অস্বাভাবিক ব্যাপারই তাকে স্বতন্ত্র করে দিয়েছে,আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের থেকে।একঘরে করে দিয়েছে।আজীবনই বড়মার সকল বাক্যবাণ একতরফা শুনেই গেছে মণিমা।উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়নি আর।কিন্তু তা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তার অদম্য জেদের কাছে হাত মেনেছিলেন ওই বৃদ্ধাও।আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে মণিমা যখন বিছানায় একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লো,তখন একদিন মাতাপুত্রে তুমুল অশান্তির পর জ্যেঠুমণির কোলে চেপে রাত্রি পা রাখলো,ওপরের অচেনা-অজানা পৃথিবীতে।দোতলার ওই স্বপ্নের জগতে রান্নাঘরের মেঝে ছাড়াও যে,আরও অনেক দ্রষ্টব্য বস্তু ও প্রাণী আছে,সেদিনই প্রথম জানলো রাত্রি।বড়মা ঠাকুরঘরের দরজা বন্ধ করে নামগান করছিলেন।গঙ্গাজল ছিটিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে,পবিত্র করছিলেন ঠাকুরঘরের চৌকাঠ।জ্যেঠুমণি রাত্রিকে সন্তপর্ণে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন,ওইদিকে কোনোদিনও যেন রাত্রি না যায়।তাহলে বড়মা খুব করে পিট্টি দেবে।ওদিকে ভুল করেও যেতো না রাত্রি।রান্নাঘরেই মণিমার পায়ে-পায়ে ঘুরে বেড়াতো খালি।আর দেখতো মণিমার পাশের ঘরের বিছানার ওপর ছড়ানো-ছিটানো কত্ত বই পড়ে আছে।একদিন ঘরে কেউ নেই দেখে,রাত্রি সাহস করে ওই ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে,ঢুকে পড়েছিলো ঘরের ভিতরে।বিছানার ওপর কত রঙচঙে বই,কত রংপেন্সিল...একটা বড় গোল আঁকা ছিলো সাদা খাতার ওপর।কচি-কচি নরম-মসৃণ হাতে রংপেন্সিলের বাক্স থেকে লাল রংটা তুলে নিয়ে,চুপিচুপি ওই লাল বৃত্তের মধ্যে একটু ঘষে দিয়েছিলো রাত্রি।তারপরই হাত কেঁপে উঠেছিলো ওর,

-ওই!তুই এখানে কি করছিস রে?!

প্রচন্ড ভয় পেয়ে খাতা-পেন্সিল সব ফেলে দিয়ে,রান্নাঘরে মণিমার কাছে দৌড় মেরেছিলো রাত্রি....পিছন থেকে চেঁচাচ্ছিলো সে,

-ওই শোন!আমি তোকে বকিনি!তুই কি করছিলি শুধু জানতে চাইলাম তো!পালাচ্ছিস কেন?ওই মেয়ে....

মণিমা সেদিন রাত্রির হাত ধরে খুন্তি হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলো।খুন্তি নেড়েছিলো তার মুখের সামনে।চেয়েছিলো জবাবদিহি....সে বলেছিলো,

-আরে মা!শোনো না!ঘরে ঢুকে দেখলাম ও আমার স্কুলের খাতায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে কি যেন করছে!তাই জানতে চাইলাম,ও এখানে কি করছে!কিছু না বলে,ও দৌড়ে পালিয়ে এলো!

তাকে আর কিছু বলেনি মণিমা।রাত্রির দিকে চেয়ে,ওর গাল টিপে আদর করে হেসে ফেলেছিলো শুধু।তারপরই রান্নাঘর থেকে পোড়া গন্ধ পেয়ে,খুন্তি হাতে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটেছিলো ওইদিকে....তখনই বড়মা ঠাকুরঘরের দরজা খুলে ডাক দিয়েছিলো,

-নীলু....এদিকে শোন বাবা আমার!
-আসছি ঠাম্মি!
-ও বাছা!সোনা বাবা আমার!স্নান করেছিস বাছা?
-হ্যাঁ ঠাম্মি!এইতো স্নান করেই বেরোলাম।
-এই নে!একটু পেসাদ মুখে দে!ভগবান আমার বাবাকে সব রোগ-বালাই থেকে দূরে.....

রান্নাঘরের দরজার সামনে রাত্রি চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো।ওর দিকে চেয়েই চেঁচিয়ে উঠেছিলো বড়মা...

-ও মা!এ কি রে!!তুই স্নান করে শুদ্ধু হয়ে,ওই অজাত-কুজাতের মুখের সামনে দাঁড়িয়ে আছিস?!
-ঠাম্মি আমি প্রসাদ খাবো না!রেখে দাও।তোমার ঠাকুরের প্রসাদ,তুমিই খাও!
-কি!কেন?আহা!অমনি গোসা হয়ে বাবুর গাল ফুলে গেলো!!যেমনি বাপ তার তেমনি ছা!আমার পেটের ছেলেটাকেও ওই মেয়ে পর করে দিলো গো!হয়েছেও ছেলে আমার মোক্তার!একটা কথা বলে পার পাওয়া যাবে না!আমাকে যেন হাইকোর্ট না দেখায়!এ সংসারে আমার কথাই শেষ কথা!সবার বিচার আমিই করবো,এটা যেন মনে থাকে!নিজে তো এক পন্ডিত,আবার বউকে লেখাপড়া শিখিয়ে আরও বিদ্বান করবে!!ছেলের ঢং দেখে বাপু বাঁচি না!বাড়ির বউ হয়েছে,ঘর-সংসার সামলাবে,ঠাকুর-গোপাল সেবা করবে,সোয়ামীকে ভগবান বলে পুজো করবে,আমাকে একটু ভক্তি-ছেদ্দা করবে,তা না....দিনরাত দরজা বন্ধ করে ছেলেকে পড়াচ্ছে,আর নিজেও ফাঁক পেলেই বইতে মুখ গুঁজে পড়ে আছে।তাও কি ভাগ্যি আমার,ভগবান ওই মেয়ের মুখে বোল ফোটায়নি,নইলে যে কি হতো সে আমার ঠাকুরই জানে!মুখ দিয়ে একটা কথা না বলেও যেভাবে ঘরের দরজা বন্ধ করে আমার ছেলেটার মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে,সে লজ্জার কথা আর কাকে বলবো!বুঝলে বাছা,আমরাই এত মুখ চালিয়েও পারলাম না,নিজের সোয়ামীকে হাতের মধ্যে রাখতে!ঠাকুরের মতো আজীবন শুধু স্বামীসেবাই করে গেলাম!আমার একমাত্র বংশ পিদিম,আমার নীলু,আমার নাতিটাকেও রেহাই দিলে না গো!এখন ওটারও মাথা খাচ্ছে!!

রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে মণিমা এসে দাঁড়িয়েছিলো ঘরের মাঝে।সে ভয় পেয়ে মায়ের দিকে চেয়েছিলো ভীতু দৃষ্টিতে।মণিমা শুধু জ্বলন্ত চোখ দেখিয়ে,ইশারায় তাকে একবার বলেছিলো নিজের ঘরে যেতে।বাধ্য ছেলের মতো আর কোনোদিকে না চেয়ে,তাই চলে যাচ্ছিলো সে।কিন্তু আবার ফিরতে হয়েছিলো তাকে,

-ওই ছেলে শোন!
-কি!
-এদিকে আয়!এই নে পেসাদ!

সেদিন তার হাতে দুখানা সন্দেশ ধরিয়ে দিয়েছিলো বড়মা।

-দুটো খাবো না আমি!একটা রাখো!একটাই দাও!
-আ মরণ!তোকে দুটো খেতে কে বলেছে!তাকে না দিলে তো আবার তার মণিমার মুখ হাঁড়ির পিছনের কালির মতো কালো হয়ে থাকবে।শোন,ওই মেয়েকেও একটা দিয়ে দিস!নইলে আবার তোর মা তোকেই বড় করে চোখ দেখাবে!তোর থেকেই ভেঙে ওকে সন্দেশ দেওয়াবে...

সেদিন বড়মার কথা শুনে চুপ করে মুখ টিপে হেসেছিলো সে।মণিমাকে,মণিমার জেদকে যে বড়মাও একরকম ভয়ই পেতো,সমীহ করে চলতো,সেটা বুঝি সেও জানতো।কিন্তু মুখে স্বীকার করবেই না।বড়মা সংসারের ওপর থেকে,কিছুতেই তার কর্তৃত্ব হারাতে চাইতেন না।তাই মাঝে-মধ্যে একটু চেষ্টাও করতেন,মণিমার মতো হয়ে চলতে।কিন্তু ওই বয়সে আজীবনের সংস্কার ভেঙে বেরিয়ে আসতে,উনি আর পেরে ওঠেননি....প্রসাদ নিয়ে সে এগিয়ে এসেছিলো রাত্রির দিকে।তাকে এগোতে দেখেই,রান্নাঘরে ছুটে গিয়ে মণিমার পা জড়িয়ে ধরে,কাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিলো রাত্রি।সে এসে হাত ধরে টেনে বের করেছিলো ওকে...তারপর টানতে-টানতে তার ঘরের ভিতরে নিয়ে গিয়েছিলো...

-ওই!তুই পালাচ্ছিস কেন রে আমাকে দেখে?!আমি বাঘ না সিংহ?যে তোকে খেয়ে ফেলবো?তোর নাম তো রাত্রি?তাই না!ওই মাথা তোল!এটা খা!ভালোলাগে না সন্দেশ খেতে?খেয়ে দেখ,খুব ভালো!কিরে?খাস না?
-হুম!
-তাহলে খা!মাথা নামিয়ে রেখেছিস কেন?ধর!আমি আমারটা খেয়ে নিলাম কিন্তু....তুইও খা!
-খেতে ভালো লাগে।কিন্তু গলায় আটকে যায় তো খেতে গেলেই!তখন বমি পায়!

থেমে-থেমে মৃদুস্বরে রাত্রি বলেছিলো।

-এই রে!দাঁড়া-দাঁড়া!এই যে!এটা আমার জলের বোতল।খেতে গিয়ে গলায় আটকালে,ঢক করে জল খেয়ে নিবি!ঠিক হয়ে যাবে।খা...দে মুখে....

সন্দেশটা সেদিন সে খাইয়েই ছেড়েছিলো।তারপর ওকে নিজের হাতে জল খাইয়ে বলেছিলো,

-সূর্য আঁকছিলি?লাল রং দিয়ে?
-না!ওসব আমি পারি না....ওইটা খুব ভালো লাগলো!তাই...
-ওটা তো লাল রং!রেড বলে ওটাকে!আয় না!বাকিটুকু রং কর!
-করবো?
-হ্যাঁ আয়...কর!বিছানায় উঠে বাবু হয়ে বোস।মা বলে পড়ার সময় সুন্দরভাবে বসতে হয়।তবেই পড়ায় মন বসে।এইরকমভাবে গুছিয়ে বোস।আমার মতো করে...

সে নিজেও সুন্দর করে বসেছিলো।তাকে দেখাদেখি রাত্রিও জোড়াসন করে বসেছিলো তার বিছানায়।সে হাত বাড়িয়ে উরুর ওপর উঠে থাকা রাত্রির জামাটা নিজের হাতে ঠিক করে দিয়ে বলেছিলো,

-এই দেখ,এটা লাল রং,রেড!সূর্যের রং লাল কর।বাইরে যেন না বেরোয়।ওই গোলের মধ্যেই কর।সাবধানে করবি।তারপর এই রেড আর একটু ইয়েলো দিয়ে,মানে হলুদ রং,এই যে....এটা দিয়ে,এই সূর্যের শুঁড় কর,চারদিক দিয়ে....ভেরি গুড!এই তো!দারুণ হচ্ছে!!এগুলো কি বলতো?রোদ!এই যে দিন হচ্ছে,রাত্রি হচ্ছে....
-আমি?
-নানা তুই না,দিন-রাত্রি,আরে আমাদের বইতে একটা চ্যাপ্টার আছে না....
-আমিই তো রাত্রি...
-আচ্ছা নে...তুই রাত্রি!উফ!পড়ানোর সময় মেয়েটা এত্ত বকে না...এই রাত্রি,তুই জানিস...পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে!আমরা ভাবি,এই সূর্য ডুবলো,চাঁদ উঠলো,রাত্রি...এই চাঁদ ডুবলো,সূর্য উঠলো,দিন।সব ভুল রে!তুই মায়ের কাছে চাঁদ উঠেছে,ফুল ফুটেছে শুনিসনি?
-না!মনে নেই!মণিমা হাত দেখিয়ে বলে,মা আর আসবে না।অনেক দূরে বেরু-বেরু গেছে!আমাকে না নিয়েই....

সেদিন কেঁদেই ফেলেছিলো রাত্রি...

-ওই তুই কাঁদিস না।আমার মা-ই তোর মা।মানে মণিমা।একদম কাঁদবি না কিন্তু।তোকে আমি চাঁদমামার গল্প শোনাবো,ঠাকুমার ঝুলি আছে আমার কাছে।ওতে লালকমল আর নীলকমল আছে।রাক্ষস-খোক্ষস আছে।বাঁটুল,বাচ্চু-বিচ্চু,হাঁদা-ভোঁদা,নন্টে-ফন্টে,কেল্টুদা,শুকতারা...কত্ত মজা আছে সব বইতে।তুই শুনবি সেইসব গল্প?
-শুনবো!
-আচ্ছা!আমি রোজ স্কুল থেকে এসে তোকে একপাতা করে গল্প পড়ে শোনাবো!তুই আর কাঁদবি না তো?
-না!
-ভেরি গুড!শোন,যেটা পড়াচ্ছিলাম।সূর্য কিন্তু ওঠেও না,অস্তও যায় না!আমাদের পৃথিবী ঘুরতে-ঘুরতে সূর্যের দিক থেকে ঘুরে যায় বলে,দিন-রাত্রি হয়!
-আমি হই!
-হ্যাঁ-হ্যাঁ তুই!ইস!তুই তো কিচ্ছু জানিস না রে রাত্রি!তুই পড়বি?আমি তোকে পড়াবো!স্কুলে যা শিখে আসবো,বাড়িতে এসে সব তোকে শেখাবো!শিখবি?
-শিখবো!রং করা শেখাবে তোমাদের স্কুলে?সূর্য আঁকা?
-তোর ছবি আঁকতে ভালোলাগে?
-এটা আঁকতে!
-এটাকেই তো ছবি বলে রে পেঁচি!পিকচার-পিকচার!আমাদের স্কুলে পিকচার-কম্পোজিশন আছে।আনসিন ছবি দেখে দশটা সেন্টেন্স লিখতে হয়।আমি তো সেই জন্যই নতুন-নতুন ছবি দেখে,মনে-মনে বাক্য সাজাই।আঁকিও...আঁকাও হলো,আবার পড়াও হলো।এটা আমাকে মা শিখিয়েছে।সবকিছুর মধ্যে থেকে নতুন কিছু শিখে নেওয়া।দাঁড়া তোকে একটা জিনিস দেখাই,আমার কত ছবির বই আছে দেখবি?!সব বাবা কোর্ট থেকে ফেরার সময়,আমাকে এনে দিয়েছে!এই দেখ,এই ছবির বইটা,আর এই গল্পের বইটা আমার গতবছরের জন্মদিনের উপহার।আমার তো এখন অনেক বড় ক্লাস।সারাদিন পড়তে-পড়তে আর এগুলো খুলে দেখার সময়ই হয় না।সব পড়েই থাকে।এই সবগুলো বই তুই নে!রং করবি!

সেদিন মহানন্দে তড়িঘড়ি একটা ছবির বই খুলে ব্যস্ত হাতে রংয়ের বাক্স থেকে,একটা রং উঠিয়ে নিয়েছিলো রাত্রি।সেটা ঘষতে শুরু করেছিলো সাদা জায়গায়....

-ওই কি করছিস?
-কি?রং করছি !তুমিই তো করতে বললে!
-এটা কি রং?
-জানিনা তো!
-এটা সবুজ!গ্রীন!
-ও...
-তুই কি রং করছিস?
-গ্রীন!
-নানা!যেটায় রং করছিস,সেটাকে কি বলে?
-কি বলে?
-আমাদের মাথার ওপর কি আছে?

মাথা তুলে সিলিংয়ের দিকে চেয়েছিলো রাত্রি...

-পাখা!কিন্তু আমার ঘরে পাখা চলে না,আলোও জ্বলে না!
-জানি রে!মা রোজ রাতে বাবার কাছে কাঁদে।
-মণিমা!কেন?
-জানিনা!তোর ঘরে আলো জ্বলে না,পাখা চলে না,ঠাম্মি দিনরাত মায়ের সঙ্গে চেঁচায়...ওই জন্য বোধহয়।নীচে আলো জ্বালাতে পারবে না বলেই তো,মা তোকে ওপরে নিয়ে এলো!চুপিচুপি তোকে বললাম।আর কাউকে বলবি না কিন্তু!তাহলে মা আমাকে খুব মারবে!বড়দের কথার মধ্যে একদম কথা বলতে নেই।বললেই,মা চোখ বড় করে!কিন্তু আমার যখন রাতে ঘুম আসে না,আমি জেগে পাশ ফিরে শুয়ে থাকি....আমি জানি,মা কাঁদে!

আবার আনমনে সবুজ রংটা ঘষতে শুরু করেছিলো রাত্রি....

-ওই পেঁচি!
-কি!
-দেখছিস না,নীচে গাছপালা-ঘরবাড়ি রয়েছে।ওপরের ফাঁকা জায়গাটায় তুই সবুজ রং করছিস কেন?কি বলে ওই ফাঁকা জায়গাটাকে?আমাদের মাথার ওপরে,এই ফ্যানের ওপরে,ছাদের ওপরে কি আছে?
-জানিনা তো!
-সে কি রে!তুই কোনোদিনও স্কাই দেখিসনি?

চুপ করে বসেছিলো রাত্রি!তার অবাক হওয়া মুখটা একভাবে দেখছিলো।তার চেয়েও বেশি হতবাক রাত্রি নিজেই।ওর জীবনে তখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন,স্কাই কে?

-চল তোকে স্কাই দেখিয়ে আনি!আয়....

রাত্রির হাত ধরে একটানে ওকে বিছানা থেকে নামিয়েছিলো সে।তখনও তিনতলায় ঘর হয়নি,এমনকি দোতলাও অসম্পূর্ণ।ছাদে নিয়ে যাওয়ার আগে সে পকেটে ভরে নিয়েছিলো কয়েকটা রংপেন্সিল।আর হাতে মুড়ে গোল করে নিয়েছিলো ওই ছবির বইটা।আর এক হাতে রাত্রির হাতটা ধরে,ওকে নিয়ে গিয়েছিলো ছাদে....

-ওই দেখ!মাথার ওপরে দেখ!কি ওটা!
-কি?
-ওটাকেই স্কাই বলে।মহাশূন্য!আকাশ!আকাশের রং কি?
-কি...
-দেখ!এই চারটে রংয়ের মধ্যে কোনটা আকাশের রং?আমি বলবো না।তাহলে তুই নিজে কিছু শিখবি না।তুই একা-একা বল দেখি!

ওপরের সীমাহীন আকাশের দিকে চোখ তুলে চেয়েছিলো রাত্রি!তারপর মাথা নামিয়ে তার হাত থেকে তুলে নিয়েছিলো একটামাত্র রং পেন্সিল!

-একদম ঠিক!কি রং এটা?
-লাল-সবুজ-হলুদ!!নাতো!!কি এটা?
-এইতো!ভেরি ব্রাইট স্টুডেন্ট!একবার বলতেই তিনটে রংয়ের নাম শিখে গেছিস!এবার এটা শিখে নে!এটাকে নীল রং বলে...ব্লু!
-নীল!
-তাহলে কি শিখলি?
-আকাশের রং নীল!
-কারেক্ট!!
-আর আমার নাম কি বলতো?
-নীলু?বড়মা তখন ডাকলো!
-ধুৎ!ও তো ঠাম্মি আদর করে ডাকে,পিসিমনিও।আবার আমাকে গোপাল বলেও ডাকে।ওসব না।এমনিতে বাবা আমাকে ভালোবেসে নীল বলে ডাকে।
-নীল তো রংয়ের নাম!
-সেতো রাত্রিও অন্ধকার রাত্রির নাম!আবার তোর নামও....দুটোই হয়।
-আর কার নাম রাত্রি?!
-উফফ!তোর মাথায় কিচ্ছু নেই রে!আর একটু বড় হ!তারপর বোঝাবো।এখন তোর ওইটুকু মাথায় এতকিছু ঢুকবে না!তুই এখন শুধু আমার নামটা মুখস্ত কর।আমি স্কুলের খাতায় যে নামটা লিখি,ওটাই কিন্তু আমার ভালো নাম।কি বল তো?
-কি?
-স্বপ্ননীল মুখার্জী!তুই আমাকে কি বলে ডাকবি?
-সব...সাপ...কি!!
-থাক!থাক!ওসব সাপ-ব্যাঙ কিছু না।ওইকটা তো দাঁত তোর!আমার নামের যুক্তাক্ষর বলতে গিয়ে,জিভ জড়িয়ে গিয়ে তোর সবকটা দাঁতই খুলে যাবে।তুই আমাকে নীল বলে ডাকবি!কি বলবি?
-নীল!
-একটা চাঁটি মারবো!আমি তোর থেকে কত্ত বড়!সেটা তুই জানিস!দেখছিস...আমার হাত-পা তোর থেকে কত লম্বা!আমি কিন্তু নাইন প্লাস!এবারের জন্মদিনে টেন হবো।তুই?
-জানিনা...
-ও!আচ্ছা মা বলতে পারবে।ও আমি জেনে নেবো।এই তুই জানিস,আমি কিন্তু আবার ক্লাসের মনিটরও!এবার স্পোর্টসে রানে,হাই জাম্পে আমি ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছি!ক্লাসের ফার্স্ট বয় আমি।আর তাকে তুই নাম ধরে ডাকছিস?!তোর সাহস তো কম না!দাদা বলবি,দাদা!কি বলবি?
-দাদা!
-হুম!নীল দা বলে ডাকবি!আমাকে ভয় করবি কিন্তু!ডাক আমাকে...
-নীল দা....
-গুড!মনে থাকবে আমার নাম?
-হুম!থাকবে...
-কোনোদিনও ভুলবি না।আচ্ছা শোন!নে এবার এখানে বোস।আকাশ দেখতে-দেখতে বইয়ের আকাশে নীল রং কর দেখি!আমি চেক করে রাইট দেবো।সুন্দর করে রং করলে ভেরি গুড পাবি।যেমন আমি সব ঠিক করলে,ম্যাম আমাকে খাতায় ভেরি গুড দেয়,আমিও তোকে দেবো!আজ থেকে আমি তোর টিচার!আর তুই আমার স্টুডেন্ট,বুঝলি!আমি পড়াবো তোকে...নে,এবার রং কর!

সেদিন একমনে মাথা নীচু করে ছোট্ট-ছোট্ট হাত দিয়ে,নিজের সল্প পরিসরের রঙিন স্বপ্নের আকাশটা, নীল রঙ দিয়ে ভরাট করতে শুরু করেছিলো রাত্রি....নীল দা আবার বলেছিলো,

-তুই জানিস রাত্রি,আকাশ নীল মানে কিন্তু সত্যি-সত্যি নীল নয়!
-মানে?আমি ভুল করছি?আমাকে ভেরি গুড দেবে না?!ভালো হচ্ছে না?!
-নানা!রং করার সময় তো নীল রংই করতে হবে।ওটাই বইতে থাকে।ওটাই আমরা দেখি।কিন্তু আমরা যেটা দেখছি,সবসময় যে সেটাই সত্যি হবে,তা কিন্তু নয়।আকাশ নীল নয়,কিন্তু আকাশকে নীল দেখায়।বুঝলি?

দুদিকে ঘাড় নেড়ে না বলেছিলো রাত্রি....ও বোঝেনি....

-এই দেখ!মন দিয়ে শুনবি।পড়াশোনায় মন না দিলে কিন্তু কিছুই শিখতে পারবি না।তাই মন দিয়ে শোন,আমি কি বলছি!কালই এটা আমি জি.কে. তে পড়েছি।কি যেন মুখস্ত করলাম....হ্যাঁ!

সেদিন দুচোখ বুজে দুলে-দুলে পড়া বলতে শুরু করেছিলো নীল দা...

-কোন কিছুর ওপর আলো পড়লে সে ওই আলোটা চারদিকে ছড়িয়ে দেয়,যাকে আলোর বিক্ষেপণ বলে।যে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত কম,সেই আলোর বিক্ষেপণ তত বেশি হয়।আকাশ রংহীন।কিন্তু এখানে সব রংয়ের মধ্যে নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম।তাই এই আলোর বিক্ষেপণ সবচেয়ে বেশি হয়,আর এই রংটাই আমাদের চোখে এসে লাগে।সেই জন্যই আকাশকে নীল দেখায়।বুঝলি?
-না....

হাঁ করে ছোট্ট রাত্রি সেদিন চেয়েছিলো নীল দার দিকে।যেন নীল দার মতো আশ্চর্য প্রাণী,গোটা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় কেউ নেই....

-আমিও কিচ্ছু বুঝিনি।শুধু মুখস্ত করে রেখেছি।আজ বিকেলে স্যার এলে বুঝে নিতে হবে।আমি বোধহয় ভুলও বললাম।আরও বায়ুমণ্ডল বলে কিসব যেন ছিলো।অর্ধেক ভুলেই গেছি।যেটুকু মনে ছিলো,তোকে বললাম।আমাকে আরও পড়তে হবে।কাল পড়তে-পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।শুধু পড়েই গেছি।কিচ্ছু মাথায় ঢোকেনি।আজ স্যারের থেকে পড়াটা বুঝে নেবো।মা শুধু পাশে বসে থেকে পড়তেই বলে,কিন্তু বুঝিয়ে দিতে পারে না!তাই স্যার বা বাবার জন্য বসে থাকতে হয়...

-নীল দা!সূর্যে রং থাকে?

-হুম!থাকে মনে হয়।তবে আগুনও থাকে!সবসময় আগুন জ্বলে!

-ওই আগুনে গরম ভাত রান্না হয়?ভাতের সুন্দর গন্ধ বেরোয়?বই পড়া যায়?মাছের কাঁটা বেছে খাওয়া যায়?আলো হয় নীল দা?আমার না অন্ধকারে একা-একা থাকতে খুব ভয় করে।সূর্য থেকে একটু আলো পাওয়া যাবে?হাওয়া লাগবে না...

-ধুস!কিসব যে বলিস না তুই!তবে স্যার বলছিলেন লাইট জ্বলে,পাখাও চলে।

-আমার ঘরে জ্বলবে?

-আচ্ছা দাঁড়া!আমি স্যারকে জিজ্ঞেস করে বলবো!

-অনেক রং থাকে সূর্যে?তোমার এই সবগুলো রং পেন্সিলের থেকেও বেশি!

-নারে!সাতটা রং...

-কি রং?

-দাঁড়া!এটাও কাল মুখস্ত করেছিলাম।এখন ভুলে গেছি।আমাকেও আরও একবার পড়তে হবে।তোকে কাল বলছি!

-তাহলে আকাশ কি গ্রীনও হতে পারে?!ভুল তো নয়!যদি কোনোদিন নীল ছাড়া,ওটা আমাদের চোখে লাগে।

-না লাগবে না!ওরম হয় না।ম্যাম বলেছে,যেটা বইতে লেখা থাকে,সেটাই হয়।বইতে সব ঠিক লেখা থাকে।নীল ছাড়া কোনোকিছু তুই কোনোদিনও দেখবি না!বুঝেছিস?

-হুম!

-খুব তো ঘাড় নাড়া হচ্ছে!কি বুঝলি?পড়া মুখস্ত বল!

-আমি তোমাকে ছাড়া আর কিছু দেখবো না!

-কি!!এই না!আমি নীল আর আকাশের নীল আলাদা তো!উফ!তোকে বোঝাতে গিয়ে আমিই সব পড়া ভুলে যাবো।তোকে পড়তে হবে।আমাদের জেনারেল নলেজ বইতে অনেক কিছু আছে।যত পড়বি,তত জানবি!ফাঁকি মারলেই ফাঁকে পড়বি!সব অজানা থেকে যাবে।এই তুই ইংরেজি পড়তে পারিস?আমাদের স্কুলের প্রায় সব বই তো ইংরেজিতেই লেখা থাকে।

-আমি পড়তেই পারি না।বই নেই তো আমার...

-ও...তোর কোনো বই নেই?!দাঁড়া!বাবাকে বলবো,তোকে আগে অ-আ বই এনে দিতে।আগে বাংলাটা শেখ।সবার আগে অক্ষর শিখতে হবে।তবে তো বই পড়তে পারবি।সন্ধ্যেবেলা আমাকে স্যার পড়াতে আসে।দেখবি আমি কত্ত মোটা-মোটা বই পড়ি।দু-তিনটে বই তুই একসঙ্গে তুলতেই পারবি না।তোর ওই ছোট্ট হাত ব্যথা করবে।আমার স্কুলের ব্যাগ কত ভারী জানিস?আমি অনেক কিছু জানি।তোকেও শিখতে হবে।মনে রাখবি,পড়াশোনা করে যে,গাড়িঘোড়া চড়ে সে!পড়াশোনা করে না,গাড়িঘোড়া চড়ে না!পড়াশোনা না করলে তোকে কেউ কিন্তু ভালোবাসবে না।সবাই পচা মেয়ে বলবে।

-পড়াশোনা করলে তুমি আমাকে ভালোবাসবে নীল দা?

-হুম!খুউব ভালোবাসবো!

-আমার মায়ের মতো করে ভালোবাসবে?

-জড়িয়ে ধরে?

-হুম!

-তোকে কেউ ভালোবসে না,নারে?!ঠাম্মি-পিসিমনি তোকে সবসময় বকে!

-মণিমা ভালোবাসে।আমাকে কোলে বসিয়ে কাঁটা বেছে মাছও খাইয়ে দেয়।

-আমিও তোকে ভালোবাসবো!তোর মণিমার চেয়েও অনেক বেশি।তুই আমাকে একদম ভয় পাবি না কিন্তু!হ্যাঁ,পড়ার সময় একটু ভয় পাবি।পড়া না পারলে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবো!

-আমি পড়বো না তোমার কাছে!

-অমনি রাগ হয়ে গেলো?এখন থেকেই ফাঁকি মারতে শুরু করলি?শোন!তোকে অনেক পড়তে হবে।একদম ফাঁকি মারবি না।রাতে স্যার আমাকে পড়িয়ে চলে গেলে,তুই আমার কাছে হোমওয়ার্ক দেখাতে আসবি।আর আমি যখন সন্ধ্যেবেলা পড়বো,সেই সময় তুই আমার পাশে বসে হাতের লেখা প্র্যাকটিস করবি।একদম সময় নষ্ট করবি না।সিলেবাস অনেক,সময় কিন্তু খুব কম।যত পারবি পড়বি!তারপর আমি স্কুলে পরীক্ষা দিয়ে এসে,বাড়িতে তোর পরীক্ষা নেবো।আমার পুরনো খাতাগুলো সব তোকে দিয়ে দেবো।পিছনে অনেক ফাঁকা পেজ আছে।তাতে লিখবি!লিখে আমাকে দেখাবি!সব ঠিক হলে রাইট দেবো।ভেরি গুড পাবি।আর ভুল হলে....

-কান ধরে দাঁড়াবো না কিন্তু...


সেদিনই প্রথম মণিমার যত্ন করে বেঁধে দেওয়া বিনুনীটা জোরে করে টেনে ধরেছিলো নীল দা...


-আঃ!!লাগছে তো!

-পড়া না পারলে,এইভাবে আমি তোর চুল টেনে ধরবো!ঝুঁটি ধরে নেড়ে দেবো।এটাই তোর শাস্তি!নে-নে!রং করে আমাকে দেখা দেখি!এই দেখ!আবারও বলছি!মনে রাখবি....এটা লাল,রেড।এটা সবুজ,গ্রীন।এটা হলুদ,ইয়েলো!এটা নীল,ব্লু....

-নীল মানে তুমি...


আবারও হেসে উঠেছিলো নীল দা....ওর গাল টিপে আদর করে দিয়ে বলেছিলো,


-পেঁচি একটা!হ্যাঁ রে!!তোর কাছে নীল মানে তো আমিই...


চোখ বন্ধ করেই অতীতের স্মৃতিচারণ করতে-করতে স্বপ্নসুখে হেসে ফেলেছিলো রাত্রি।কিন্তু ধীরে-ধীরে সেই স্বপ্ন ওদের পুড়িয়ে দিতে শুরু করলো।ওর বন্ধ দুচোখের সামনে রাত্রি দেখলো,ফ্রেমবন্দী দুটো রঙিন শিশু ধীরে-ধীরে বড় হচ্ছে,আর কেমন যেন রংহীন-ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে ওরা!!একসময় ওই রঙিন আকাশে আঁকতে থাকা,সুখী স্বপ্নের সমস্ত নীল রংটুকু কারা যেন শুষে নিলো!রাত্রি দেখলো,বিবর্ণ সাদা-কালো দুটি শিশু মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করছে...যাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে সবটুকু রং....ঘিরে ধরেছে বিবর্ণতা।ওদের ওই বিবর্ণ রূপ রাত্রি আর সহ্য করতে পারলো না।দ্রুত নিজের চোখ খুলে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরতেই ও দেখলো,জানলার বাইরের আকাশের রং আজও একইরকম নীল।প্রকৃতি আজও সবুজ।বাড়ির পাশের জানলার সামনের বেড়ে ওঠা জবাগাছটায় ফুটে রয়েছে লাল-লাল পঞ্চমুখী জবাফুল।নাঃ!কোনো রং জীবন থেকে হারায়নি।সবই আছে।ক্ষণিক নিশ্চিন্ত হলো রাত্রি...বেশ অনেকটাই বেলা হয়ে গেছে।চাদরটা ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নিলো ও....চেয়ার ছেড়ে উঠেই রাত্রি দেখলো,ওপরের সিঁড়ি দিয়ে সে নামছে....ওর সামনে এসে সে দাঁড়িয়ে পড়লো।রাত্রি জিজ্ঞেস করলো,


-তোমার কি হয়েছে?আজ এতবার উঠছো!তাও এত সকালে?

-খিদে পেয়েছে!একটু কিছু খেতে দিবি?

-তখন বললে না কেন?আমি এক্ষুণি করছি।পিসিমনি,মামনি,বৌমনির জন্যও করি?

-পিসিমনির ঘরের দরজা বন্ধ।স্বর্ণও ঘুমোচ্ছে।যা করবি,শুধু আমার জন্যই কর।

-কি খাবে নীল দা?

-তুই যা খাওয়াবি!

-আচ্ছা!একটু ডিম-টোস্ট করে দিই!চেয়ারে বসো!

-চল তোর সঙ্গে রান্নাঘরে যাই।কতদিন ভালো করে তোর একটু খবর নেওয়া হয় না!তোর সঙ্গে কথাও বলা হয় না...

-আচ্ছা,এসো তবে!


-তোর কাজকর্ম কেমন চলছে?

-ভালো!

-তাহলে ওই অসভ্য লোকটাকে তুই বিয়ে করবিই?আমার একটা ভুলের জন্য,আমার ওপর অভিমান করে নিজেকে জলে ভাসিয়ে দিবি রাত্রি?

-ওটা ভুল নয়।তুমি এত সকালে ড্রিঙ্ক করেছো কেন নীল দা?

-তোকে যেটা জিজ্ঞেস করছি,সেটা বল!

-কাল রাতে খাওনি কেন?ওপর থেকে আর নামলেই না!আমি রাতে কতবার ডেকেছিলাম।বৌমনিকেও শাড়ি দেখতে ডাকলাম।কেউ দরজাই খুললে না!

-স্বর্ণ বিশাল ঝামেলা করছিলো।আর ভালো লাগে নারে অশান্তি!আমি চাইনি,তুই ওর মুখের সামনে গিয়ে পড়িস!তাই দরজাই খুলিনি!সরি!

-আমাকে এত শাড়ি-গয়না কিনে দেওয়া নিয়ে,বিয়ের খরচ নিয়ে,তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি হচ্ছে!তাই তো?মানে আমাকে নিয়েই....


চুপ করে মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো স্বপ্ননীল....


-তুমি না বললেও,আমি জানি নীল দা!বৌমনি আমাকে একদম পছন্দ করে না!

-এ বিয়ে তুই ভেঙে দে রাত্রি!আমি ওই লোকটার বাড়ি বয়ে ওর মুখে লাথি মেরে,এ বিয়ে ভেঙে দিয়ে আসবো...শুধু তুই একবার না বল!নিজেকে এভাবে শেষ করে দিস না!এত আয়োজন,এত কিছু,সব ওই হতচ্ছাড়া-লম্পটটাকে বিয়ে করার জন্য?!উফফ....অসহ্য!

-নাও!তোমার ব্রেকফাস্ট রেডি!টেবিলে চলো!

-বিয়েটা ভেঙে দে না রাত্রি...প্লিজ!নইলে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি....আমার মনে হচ্ছে তুই আমার জন্য,এ বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি বেরোনোর জন্য ওই আপদটাকে... প্লিজ রাত্রি,ভেঙে দে...


টেবিলে এসে খাবারের প্লেটটা নামিয়ে রাখলো রাত্রি।নীল ওর কাছেই এসে দাঁড়িয়েছে।একবার মণিমার ঘরের দিকে চেয়ে দেখলো,তারপর চাইলো ওপরের সিঁড়ির দিকেও।সবশেষে স্বপ্ননীলের একেবারে কাছে এগিয়ে এসে,ওর চোখের দিকে চেয়ে বললো,


-আর কি করবো বিয়েটা ভেঙে দিয়ে?তুমি করবে আমাকে বিয়ে?


হতবাক হয়ে রাত্রির মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো স্বপ্ননীল...


সকালে ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে গিয়েছিলো আন্তরিক।কাল কাঁচের টুকরোগুলো তুলতে গিয়ে হাতটা একটুখানি কেটে,কাজ বাড়িয়ে বসে আছে ও।সামান্য ওষুধ লাগিয়ে নিয়েছিলো তখনই।তবে একটু ব্যথা এখনও আছে।ওই হাত দিয়েই কোনোরকমে চশমাটা মুছে নিলো ও।গতকালই বাড়ির বাজার হয়ে গেছে।আজ আর বাজার যাওয়ার কোনো ঝামেলা নেই।এখন অপেক্ষা আপা নীচে কখন খেতে ডাকবে!ততক্ষণ একটু বইয়ের সান্নিধ্যে ডুব দিতে চাইলো আন্তরিক....খুলে বসলো ভীষণ পছন্দের "সঞ্চয়িতা"...

পৌঁছে গেলো চিরপরিচিত পংক্তিতে....


"তোমারে পাছে সহজে বুঝি   তাই কি এত লীলার ছল-

বাহিরে যবে হাসির ছটা      ভিতরে থাকে আঁখির জল।

বুঝি গো আমি,বুঝি গো তব       ছলনা-

যে কথা তুমি বলিতে চাও    সে কথা তুমি বল না।।"


বালিশের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ছিলো আন্তরিক।কিন্তু প্রথম চার লাইনেই ওর চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো।আর এগোতেই পারলো না।চশমার কাঁচে জমা হয়েছে জল।বালিশে মুখ ঠেসে থাকায়,বাষ্পীভূত চশমার কাঁচও...একেবারে আবছা....বইয়ের একেবারে প্রথম পাতায় ফিরে গেলো আন্তরিক।মেয়েলি হাতের সুন্দর গোটা-গোটা অক্ষরে লেখা,


"ভালোবাসি তোমায় প্রিয়,

মোর হৃদয় জুড়ে তুমিই আছো সখা...

প্রতিরাতের খোলা আকাশে,লালমাটির প্রতিটা কণায়,

আমি পাই তব দেখা!

রইলো আমার ভালোবাসাসহ অনেকটা আদর,

রইলো ভালোবাসার নির্ভেজাল একখানি দিক!

ঝুমুরের জন্মদিনে,আদরের ঝুমের পক্ষ থেকেই,

এই ছোট্ট উপহার গ্রহণ করুক,নির্লজ্জ আন্তরিক....."


ওই লেখাটুকুর ওপর বারংবার চুমু খেয়ে বইয়ের পাতা প্রায় ভিজিয়েই ফেললো আন্তরিক।তাও আজ নিজেকে শান্ত করতে পারলো না।চশমাটা খুলেই ফেললো চোখ থেকে।নোনতা জল জমা হয়েছে চশমার কাঁচের প্রান্তে...

ওই চশমাটার দিকেই একভাবে চেয়ে রইলো আন্তরিক...স্মৃতি হাতড়ে আবার ফিরলো লালমাটিতে ঢাকা রুক্ষ শহরের পথে....


সাপ্তাহিক পরীক্ষার খাতাগুলোর ওপর ঝুঁকে পড়েছিলো আন্তরিক।গত কয়েকদিন ধরে চোখটা ভীষণ অসুবিধে করছে।কাছের কিছু পড়াই যাচ্ছে না,একেবারে ঝাপসা!বইয়ের পোকা ও।কিন্তু বই পড়তে গেলেই চোখ থেকে জল পড়ছে।দূর থেকে ঘাড় সোজা করে চেয়ারে সটান হয়ে বসে কাজ করতে হচ্ছে।বিরক্ত হয়ে গেলো আন্তরিক....খাতার ওপর পেনটা নামিয়ে রেখে উঠে এলো ওপরে....


-বৌদি?

-হ্যাঁ অন্তু,এসো!দরজা খোলাই আছে।

-বলছি একটু বলতে পারবেন এখানে ভালো চোখের ডাক্তার কোথায় বসে?

-এই তোমার দাদা গত মাসেই তো চোখ দেখিয়ে চশমা নিলো।ওই যে পৌর বাজারের ওখানে যে চালের আড়তটা আছে না,তার পাশ দিয়ে গিয়েই...


চুপ করে মন দিয়ে বৌদির কথা শুনে নিচ্ছিলো আন্তরিক।হঠাৎই কথার মধ্যেই ও দুম করার জিজ্ঞেস করে বসলো,


-আচ্ছা!আমি আর স্পন্দন দা এক্সিডেন্টের পর যে হসপিটালে সেদিন গেছিলাম,ওখানে চোখের ডাক্তার বসে না বৌদি?

-হ্যাঁ!নিশ্চয়ই বসে।তবে হসপিটালের ব্যাপার তো!অনেকটা সময় হাতে নিয়ে যেতে হয়।তারপরেও কাজ না হলে,বেকার একটা গোটা দিন নষ্ট!তোমরা কাজের মানুষ,স্কুল আছে।ওখানে গিয়ে সময় নষ্ট করবে কেন!বাইরেই দেখিয়ে নাও না...

-না!আমি ওই হসপিটালেই যাবো।দেখছি বৌদি!থ্যাঙ্কু...দাদা দোকান থেকে কখন ফিরবে?

-এই একটু পরেই!এই অন্তু,চা খাবে?

-না বৌদি!হাতের কাজ ফেলে এসেছি।একভাবে বেশিক্ষণ কাজ করতে পারছি না।মাথা ব্যথা করছে।চোখটা এবার দেখাতেই হবে।আর সেটা ওই হসপিটালে গিয়েই...এলাম বৌদি...


(চলবে.....)


ছবি : সংগৃহীত


ধারাবাহিকটি ভালো লাগলে ব্লগ থেকে নির্দ্বিধায় শেয়ার করুন ও সবাইকে পড়ার সুযোগ করে দিন।😊😊

১৫টি মন্তব্য:

  1. Akhoni emotional hoe jachi. Ratri r neel er valobasa te pore. Erpor ki habe!

    উত্তরমুছুন
  2. রাত্রি.....নামের সঙ্গে জীবনের মেলবন্ধন টা ভালোই এঁকেছো দিদিভাই... ভালো লাগছে পড়তে

    উত্তরমুছুন
  3. রাত্রির নাম আর ওর জগৎ মিলেমিশে এক হোয়ে যাচ্ছে। সাথে নীল যেন ঝড় সাথে নিয়া জিবনে চলেছে। অন্তু কে তো সবে চেনা শুরু করলাম । প্রেমে পড়া যে দেরি আছে। পড়তেই চাই আবার। অপেক্ষায় রইলাম।

    উত্তরমুছুন
  4. আবার আবেগে ভেসে যাচ্ছি। খুব ভালো লাগছে। ♥️♥️♥️

    উত্তরমুছুন
  5. প্রতিটি উপন‍্যাসে এইরকম হৃদয় মোচরানো ভালোবাসা জাস্ট জ্বালিয়ে দেয়।

    উত্তরমুছুন
  6. সত্যি কথা বলতে অসমাপ্ত থেকে এখনো বেরোতে পারিনি.....সারেগামাপা দেখলেও সমুদ্রের কথা মনে পড়ে......এমনকী মাঝে মাঝে কোনো কারণ ছাড়াই....

    উত্তরমুছুন
  7. যেটা চোখের সামনে দেখি.... তার পেছনেও গভীর নির্বাক অন্তর্জাল থাকে....❤️

    উত্তরমুছুন

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট