সেই তো এলে ভালোবাসা
সাথী দাস
দ্বিতীয় পর্ব
পরমুহূর্তেই বিস্বাদ হয়ে ওঠে মন। কামনার রাতগুলোতে একাধিকভাবে সঞ্চারিণীর প্রত্যাখ্যানে নিজেকে কেমন নারীদেহলোলুপ কামুক পুরুষ মনে হয়। মাত্রাতিরিক্ত ঘৃণা জন্মায় নিজের প্রতি। আত্মবিশ্বাস তলানিতে পৌঁছয়। সেই স্পর্শকাতর মুহূর্তে নিজেকে নষ্ট চরিত্রের পুরুষ ভাবতে দ্বিধা হয় না।
সঞ্চারিণীর রূঢ় আচরণ প্রতি মুহূর্তে অরুণাক্ষকে মনে করিয়ে দেয়, সে প্রতারক। এ জগতে যা কিছু সঞ্চারিণীর প্রাপ্য ছিল, কথা দিয়েও সেসব কিছুই অরুণাক্ষ দিতে পারেনি। তার মতো দরিদ্র মানুষ ইহলোকে থাকার অর্থ কেবল পৃথিবীর ভার বৃদ্ধি। এর বেশি কিছু না।
কোনও এক রাতের তুমুল বাকবিতণ্ডার পর অরুণাক্ষ আকুল হয়ে থাকে নতুন সকালের আশায়। সঞ্চারিণী যদি সামান্য অনুতপ্ত হয়, তবে অরুণাক্ষর মনের গোপন ক্ষত সহজেই উপশম হতে পারে। কিন্তু সঞ্চারিণীর দৃষ্টিতে অনুতাপের দেখা মেলে না। সেখানে নীরব ক্ষোভ ছাড়া কিছু অবশিষ্ট নেই।
সম্পর্ক যখন প্রতিনিয়ত বিষধর সাপের মতো দংশন করে, তখন বিষক্রিয়ায় নীল হয় মন। ব্যথাতুর হৃদয় আশ্রয় চায়। ভরসা চায়। কিন্তু সঞ্চারিণীর গগনচুম্বী আকাঙ্খার কাছে প্রত্যেকবারই পরাজিত হয়ে মুখ লুকিয়ে পালিয়ে আসে অরুণাক্ষর যাবতীয় প্রার্থনা। অকর্মণ্য নামক বিশেষণে জর্জরিত হয় অরুণাক্ষ। পুরুষের একমাত্র নীরব ঘাতক অর্থনৈতিক অক্ষমতা। সেই ঘাতক দিন-রাত কুরে কুরে খায় অরুণাক্ষকে।
পাশের ঘরে ছাত্র পড়াচ্ছিল সঞ্চারিণী। এই সময় মিলি-মেহুও বইপত্র নিয়ে মায়ের কাছে পড়তে বসে। অতীতের মেধাবী সঞ্চারিণী আজ বড় কঠিন শিক্ষিকা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত ডিগ্রি সঞ্চারিণীকে কেবল উচ্চশিক্ষা দেয়নি, সেই সঙ্গে খানিক দম্ভের প্রলেপ লেপে দিয়েছে তার শ্বেতপাথরের মতো মসৃণ গালে। কিন্তু বিয়ের আগে সেই দম্ভ প্রকাশ্যে আসেনি। তখন সঞ্চারিণীর ব্যবহারে কেবল নিখাদ প্রেমেরই প্রকাশ ছিল। নিজের চেয়ে অধিক শিক্ষিতা এবং সুন্দরী সঞ্চারিণী যখন অরুণাক্ষর বিয়ের প্রস্তাবে এককথায় রাজি হয়েছিল, তখন অরুণাক্ষ ভেবেছিল, এ গভীর প্রেম এবং মনের টান ব্যতীত ভিন্ন কিছু নয়। সেই ঘোর কেটেছে বহু পরে।
সঞ্চারিণী যখন রান্নাঘরে প্রবেশ করল, বাসনের ঝনঝনানিতে অরুণাক্ষ চমকে উঠল। বোতল ভরতে গিয়ে খানিক জল চলকে পড়ল মেঝেতে। কিন্তু অন্যদিনের মতো সঞ্চারিণী রাগতস্বরে কথা শোনাল না। অরুণাক্ষ বুঝল, গতকাল ওর দিদির কানপাশার উজ্জ্বলতার কাছে ম্লান হয়েছে সঞ্চারিণীর যাবতীয় সান্ধ্যসুখ। অমন একজোড়া কানপাশা দিয়ে কান সাজাতে না পারলে নারীজন্ম অর্থহীন। এই লজ্জায় অরুণাক্ষর দু'কান কাটা যাওয়াই কাম্য। গুণবান স্বামীর যাবতীয় ঐশ্বর্য প্রকাশ পায় স্ত্রীর সাজসজ্জায়। আর এ বিষয়ে অরুণাক্ষ এক দারুণ দৈন্যতার পরিচায়ক। মুঠোফোন বের করে সেইদিনের সোনার বাজারদরে একবার চোখ বুলিয়ে নিল অরুণাক্ষ। এতে স্বর্ণব্যবসায়ীর লাভ-লোকসান বিশেষ হল না। কেবল পুরুষ হৃদয়ের অক্ষমতা এবং দীর্ঘশ্বাস পরষ্পরকে গাঢ়ভাবে আলিঙ্গন করল।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অন্যমনস্কভাবে বাইকের দিকে চেয়েছিল অরুণাক্ষ। বাইকটা বিক্রি করে দিলে ওর অনেক অসুবিধা হবে। এই মুহূর্তে স্কুলবাসের জন্য অতিরিক্ত খরচ ওর কাছে বিলাসিতার সমান। অফিস যাওয়ার পথে এই বাইকে চাপিয়েই মেয়েদের স্কুলে পৌঁছে দেওয়া সহজ হয়। ভিড় বাসে চেপে স্কুলে যেতে ওদের ভারি কষ্ট হবে। আর কোনও পথ খুঁজে পায় না অরুণাক্ষ। অস্থির লাগে ভীষণ। দৃষ্টি ঝাপসা হয়। একটা চেনা মুখ ক্রমে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। না না! এসব স্বপ্ন। রাজু এখানে কোথা থেকে আসবে? অসহায়তার মুহূর্তে অরুণাক্ষ নিশ্চয়ই অবচেতন মনে বাড়ির ছাদে পৌঁছে গিয়েছিল! তাই রাজুর দেখা পেল।
"দাদা, কেমন আছিস?"
স্বপ্ন নয়। মনের ভুল নয়। সত্যিই একমাত্র বোন রাজন্যা দেখা করতে এসেছে অরুণাক্ষর সঙ্গে। দাঁড়িয়ে আছে ওর একেবারে সামনে। রাজন্যার সঙ্গী একজন সুদর্শন পুরুষ।
"রাজু তুই!"
"তোর সঙ্গে কথা আছে দাদা।"
"মায়ের শরীর কেমন আছে?"
"ঠিক আছে। মা আমাকে তোর কাছে পাঠাল।"
"আমার কাছে! কী ব্যাপার?"
"ওর নাম প্রত্যূষ। দু'মাস পর আমরা বিয়ে করছি। তোর হাতে আধঘন্টা সময় হবে দাদা? কিছু কথা ছিল।"
অরুণাক্ষর ফোন পেয়ে ঘরের মধ্যে আনন্দে ফেটে পড়ল সঞ্চারিণী। ফোন কানে ধরে মহা উল্লাসে সঞ্চারিণী বলল, "দিদি.... রাজু এসেছে ওর সঙ্গে দেখা করতে। আমার শাশুড়ি বলে পাঠিয়েছে, বাড়ির একমাত্র ছেলেকে ছাড়া বাড়িতে শুভকাজ হয় না। আমাদের নিয়ে বাড়ি ফিরতে বলেছে। শাশুড়ি আমার সঙ্গে আজ ফোনে কথা বলবে। ও এখন রাজু আর ওর বরকে সঙ্গে নিয়ে এ বাড়িতে আসছে। এতদিন ঐ মেয়ে একা ব্যবসার সব টাকা লুটেপুটে খাচ্ছিল। এবার আমি ঢুকব ওখানে। ওর বিয়ে হলে গেলেই সব আমার একার হবে। আমার কপাল খুলে গেল রে দিদি! আমার সুখের দিন এলো! এবারও যদি ও মানুষ বাগড়া দেয়, বাড়ি যেতে না চায়.... তুই দেখিস ওর কী অবস্থা আমি করি..."
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত