অনুসরণকারী

বুধবার, ৩ আগস্ট, ২০২২

প্রজাপতির মৃত্যু (চতুর্থ পর্ব)


 

প্রজাপতির মৃত্যু

মন প্রজাপতি

প্রথম অধ্যায়
সাথী দাস

চতুর্থ পর্ব





কয়েক বছর পর...

-ধ্যাৎ! যেদিন থেকে বাড়িতে ডিভিডি প্লেয়ারটা এসেছে, সেদিন থেকে কাল্ট ক্লাসিক বলে মা আর মানু আমার মাথাটা জাস্ট ধরিয়ে দিয়েছে। এমনিতেই পড়াশোনার চাপ। তার ওপর আর্ট ফিল্মের এত ঘ্যানঘ্যানানি আমার মাথায় ঢোকে না বুঝলে! পড়া থেকে দু'দিন ছুটি পেয়েছি, কোথায় মনে ঝড় তোলা কিছু দেখব, তা না! এই শোনো...

পাহাড়ি পথ অতিক্রম করার পর একটি খরস্রোতা নদী যখন সাগরে মিলিত হয়, মোহনায় পৌঁছে সে তার তীব্র গতি ও সুদীর্ঘ যাত্রাপথ ভুলে হয়ে যায় শান্ত ও শীতল। কিন্তু এই মোহনার মধ্যে রয়েছে পাহাড়ি ঝর্ণার উন্মাদনা। স্বমহিমায় দিবারাত্র প্রবহমান মোহনা সারাদিন কলকল করে কথা বলে চলে। রঙিন প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ায়। এই বছরই মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল সে। ওর পরীক্ষার পর বাড়িতে নতুন ডিভিডি প্লেয়ার এসেছে। এখন কয়েকদিন দাপিয়ে সিনেমা দেখা চলছে, যেন গোটা বৈঠকখানাটাই একটা প্রেক্ষাগৃহ। কিন্তু মা আর মাসির পছন্দের ছবি দেখতে দেখতে মোহনা ক্লান্ত হয়ে গেছে। আজ দোকানে এসে হুড়মুড় করে মনের ভিতরে জমে থাকা সব ক্ষোভ উগড়ে, টেবিলে একটা কষে থাপ্পড় মেরে ক্যাসেটের দোকানের ছেলেটির দিকে নিজের তর্জনী নাচিয়ে মোহনা বলল,

-এই, বুঝলে তুমি? নাকি আমি আবার বলব? বুঝতে পারছ তো আমি কী চাইছি?
-না!

ছেলেটির বয়স খুব বেশি নয়। কলেজের প্রথম বর্ষে পাঠরত ছেলেটি কলেজ, টিউশন আর পড়াশোনার ফাঁকে সময় পেলে বাবার দোকানে বসে। এর আগে যতবারই আবিষ্কার আর মোহনা এই দোকানে ক্যাসেট ভাড়া নিতে বা ফেরত দিতে এসেছে, প্রতিবারই কাকু ছিলেন দোকানে। আজ ছেলেটি রয়েছে। মোহনা টেবিলের ওপর আরও একটা থাপ্পড় মেরে বলল,

-এবার একটা ভালো ভূতের সিনেমা দেখব বুঝলে! যেটাতে রাতের বেলায় বিশাল মজা হবে! বেশ ভয় ভয়, গা শিরশির! আমি অন্ধকার ঘরে ভয় পেয়ে ও মা গো করে চিৎকার করব, ঠিক সেইরকম চাই। আছে?
-বিশাল মজা হবে? গা শিরশির! সিনেমা দেখে তুমি আবার মা গো করে চিৎকারও করবে, সব একসঙ্গে চাই তোমার? আচ্ছা দাঁড়াও! এটা নিয়ে যাও। দেখার পর তুমি ফেরত দিয়ে যেও।

পিছন থেকে আবিষ্কার তিড়িং করে সিঁড়ির এক ধাপ ওপরে উঠে এসে সিডিটা মোহনার হাত থেকে ছিনিয়ে এক নজর দেখেই ফেরত দিয়ে বলল,

-বাচ্চা মেয়ে দেখে ইয়ার্কি পেয়েছ তুমি! এই তিতলি, রাখ এসব!
-কেন তাতাই? এই তো ভূতের মুখ। জঙ্গলের মধ্যে একটা মন্দির মনে হচ্ছে, এটা দেখেই তো ভয়ঙ্কর লাগছে। আমি এটাই দেখব! আর আমি বাচ্চা তোকে কোন শালা বলল?
-এই ভাই এসব রাখো। আমি যেগুলো বলছি, সেগুলো দাও। সরাও এসব।
-না সরাবে না। এই দাও, আমি এটাই দেখব!
-তিতলি আমি তোর থেকে বড়, বড়দের কথা শুনতে হয়। আমার কথাটা একবার অন্তত শোন। জীবনে কোনদিন কারোর কথা কী তুই শুনবি না?
-এহ! মাত্র সাড়ে তিন দিনের বড়। তাতেই নাকি উনি বড়! কী আমার ঠাকুর্দা এলেন রে! আমি এটাই দেখব। এই ভয় পাব তো এটা দেখে?

ঠোঁট টিপে ছেলেটি বলল,

-বিশাল! এটা দেখার পর রাতে একা শুতে গেলেই অজানা অনুভূতিতে গা শিরশির করে উঠবে। ঠিক যেমনটা তুমি চাইছ! এটা তোমার সমস্ত ক্রাইটেরিয়া ফুলফিল করবে আই প্রমিস!
-ফাইন! আর ভয় না পেলে...
-টাকা দিতে হবে না। সিডিটা তোমার কাছেই রেখে দিও। বাবা থাকলে এটা ফেরত দিও না। আমি যখন দোকানে থাকব, তখন আমার হাতে দেবে। তাহলে আর টাকা দিতে হবে না।

মোহনার হাত থেকে ওই সিডি কেড়ে নিয়ে আবিষ্কার কিছু একটা বলতে চাইছিল। কিন্তু তার আগেই মোহনা সিডিটা নিয়ে দৌড় দিয়েছে স্কুটির দিকে। ছেলেটি মুখ টিপে হাসতে হাসতে ফেটে পড়ল অট্টহাসিতে। অসহায় আবিষ্কার সেই হাসিতে যোগ দিয়ে বলে উঠল,

-মেয়েটা যে কী করে না! আবার আমার সঙ্গে বসে দেখবে! শুধু একা আমার সঙ্গে নয়। সবার সঙ্গে!

ছেলেটি হাসি আর থামাতেই পারে না। অতিকষ্টে সে বলল,

-বিশাল মজা হবে।
-হ্যাঁ সেই তো। আজ আমার কপালে গ্রহরাজ একা নন, দেবতাদের পুরো ফ্যামিলি তা ধিন ধিন নাচছেন, বেশ বুঝতে পারছি। সলিড কেস খাব। কী আর করা যায়! পার্টনার ইন ক্রাইম যখন, ধোলাইটাও একসঙ্গেই খেয়ে নেব। টোটাল পার্টনারশিপে... আমি আর কিচ্ছু বলব না। ঝাড় খেয়েই শিখুক। একটু বুঝুক ওই মেয়ে! বড়দের কথা না শোনার ফল কী!

দোকান থেকে বেরিয়ে মোহনার স্কুটির পিছনে উঠে বসলো আবিষ্কার। চেঁচিয়ে উঠল মোহনা,

-তাতাই নাম স্কুটি থেকে।
-না। তোর কিছু হলে মা আমার পিঠের চামড়া গুটিয়ে দেবে।
-তুই নামবি কিনা! এভাবে তোর ভরসায় চালালে জীবনেও আমার কনফিডেন্স আসবে না। আর আমি ঠিকমতো চালাতে না পারলে, কলেজে যাওয়ার আগে মা স্কুটিও কিনে দেবে না। পিছনে সাপোর্ট হয়ে বসে থাকবি না, সর! এটুকু হেঁটে চলে যা।
-আমি নামব না। তোর হাত এখনো কাঁপে!
-তুই নামবি! নাকি স্কুটি কাত করে ফেলে দেব তোকে?
-যা খুশি কর তুই!

একলাফে স্কুটি থেকে নেমে পড়ল আবিষ্কার। মোহনা স্কুটি চালাতে শুরু করলে আবিষ্কার ওর পিছনে প্রায় দৌড়তে শুরু করল। নিমেষের মধ্যেই বীভৎস শব্দ! নর্দমার ঠিক পাশে স্কুটি কাত হয়ে পড়েছে। আর মোহনা সটান কাদার আলিঙ্গনে লুটোপুটি খাচ্ছে। হাসতে হাসতে মাথায় হাত দিয়ে রাস্তায় বসে পড়ল আবিষ্কার। চিৎকার করে উঠল মোহনা,

-আসবি এদিকে?
-না!
-আসবি? নইলে তোর মাকে বলে দেব কিন্তু!
-আসছি তো! সব ব্যাপারে মায়ের ভয় দেখাস কেন?
-তুই খুব সাহসী তাই...

স্কুটি আর কাদায় গড়াগড়ি খাওয়া মোহনাকে টেনে তুলে খিক খিক করে হেসেই চলল আবিষ্কার। সারাটা রাস্তা মোহনা আর একটাও কথা বলেনি। বাড়িতে এসে স্নান সেরে যখন ঘর থেকে সিডি হাতে নিয়ে মোহনা বেরোল, তখন আবিষ্কার বলল,

-বোরোলীন লাগিয়েছিস কনুইতে?
-এ যা তো! বেশি ঢং করতে হবে না। তখন তো খুব দাঁত বের করে হাসছিলি! এখন কেন? সর! একহাত দূরে বসবি তুই! ওরা কোথায়?
-যেখানে থাকে!
-খেতে আসেনি এখনো? আজ দুপুরে খেতে খেতে সিনেমা দেখবে না?
-দরকার নেই। ওরা দোকানে আছে থাক। তাড়াতাড়ি খানিকটা দেখে ফেরত দিয়ে আসি চল। একটু পরেই ওরা খেতে চলে আসবে।
-তুই এত হুড়োহুড়ি করছিস কেন তাতাই? আর একটুখানি দেখব মানে? আমি পুরো সিনেমা দেখব। তুই ভীতু মানুষ জানি! তুই বরং কানে বালিশ চাপা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়। আমি একা দেখব, তবুও পুরোটা দেখব।
-তা হলেই হয়েছে!
-মানে?

রিমোটটা হাতে নিয়ে টিভি চালিয়ে দিল মোহনা। বৈঠকখানার সব জানালা বন্ধ। দরজাটা আলগা কেবল। আবিষ্কার সোফা কাম বেডে গা এলিয়ে দিয়ে বলল,

-মানে তুই আমার সঙ্গে বসে পুরো সিনেমা দেখতে পারলে, আজ আমার তরফ থেকে ফুচকা ট্রিট কনফার্ম! আনলিমিটেড! যত ইচ্ছে খাবি।

সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে আবিষ্কারের দিকে চাইল মোহনা। যে ছেলে মোহনার ঝেড়ে খেতে পারলে নিজের জীবনটা ধন্য মনে করে, সেই ছেলে হঠাৎ এমন দরাজ কণ্ঠে ঘোষণা করছে খাওয়ানোর কথা! এত উদারতা কেন? ততক্ষণে টিভির পর্দায় শুরু হয়েছে শিহরণ জাগানো এক ভয়ের সিনেমা।

পাশবালিশটা কোলের ওপর টেনে গুছিয়ে বসে উৎসুক দৃষ্টিতে মোহনা টিভির পর্দার দিকে চাইল। মিনিট কুড়ি সময় বেশ নির্বিঘ্নেই কাটল। অস্বস্তি শুরু হল তখন থেকে যখন সিনেমার নায়ক এবং নায়িকা প্রয়োজনের থেকে একটু বেশিই ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করল। আড়চোখে আবিষ্কারের দিকে চাইল মোহনা। একদম সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো স্থির ও শান্ত ওর দৃষ্টি। শিরদাঁড়া টানটান করে বুক চিতিয়ে সোজা হয়ে ধ্যানে বসে আছে। মোহনা সিলিংয়ের দিকে চাইল। ড্রইংরুমের পাখাটা ঘোরার সময় যে এইরকম ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হয়, আগে তো কখনো খেয়াল করে দেখা হয়নি। পাখাটা ঠিক করার জন্য লোক ডাকতে হবে। দেওয়ালে ঝুল পড়েছে। ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। সেবার মেলা থেকে কেনা ছোট-বড় প্রজাপতিগুলো সারি দিয়ে দেওয়ালে সেঁটে রয়েছে। মাঝে একটা প্রজাপতি কই গেল? ওই জায়গাটা ফাঁকা কেন? ঘরের যত অসঙ্গতি, সব এখনই মোহনার চোখে পড়ল। টিভির দিকে আর তাকানো যাচ্ছে না। ওদিকে টিভির পর্দায় নায়ক নায়িকার চরম ঘনিষ্ঠতার মধ্যে বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেল। মোহনা কুলকুল করে ঘামছে, নায়ক-নায়িকা ভিজছে। ঢোঁক গিলে একটু কেশে মোহনা গলাটা পরিষ্কার করে নিল। আবিষ্কার সুরেলা কণ্ঠে বলে উঠল,

-এবার বৃষ্টিভেজা অবস্থায় একটা সাদা রংয়ের ট্রান্সপারেন্ট নাইটি পরে হি হি করে হাসতে হাসতে আকাশপথ বেয়ে মাদুরে বসে একটা পেত্নী ভেসে আসবে। আমরা ভয় পাব তো! তুই আশা ছাড়িস না তিতলি, আমরা ভয় পাবই। এই তো, আর একটু অপেক্ষা। তারপর পেত্নী আসবে। আর তারপরই....

মোহনার অস্বস্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নায়ক নায়িকার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে বাড়তে এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল, যে নায়িকার ঐ তীব্র শীৎকারে চাপা পড়ে গেল দরজা খোলার মৃদু শব্দ। আবিষ্কার তখনো ক্রিকেটের মাঠের একজন সুনিপুণ ধারাভাষ্যকারের মতোই একনাগাড়ে বকবক করে চলেছে। মোহনা মনে মনে ঐ সিডির দোকানের ছেলেটির মুণ্ডপাত করছে। একদৌড়ে উঠে মোহনা টিভিটা বন্ধ করতে যাবে, এমন সময় ঘরের আলো জ্বলে উঠল। পেত্নীর বদলে দু'পায়ের দুটো চটি হাওয়ায় ভেসে উড়ে এলো মোহনা আর আবিষ্কারের দিকে। চন্দ্রাণী লাফিয়ে পড়ে সোফা কাম বেডে উঠে আবিষ্কারের চুলের মুঠি টেনে ধরে বলল,

-দুটোকেই মেরে ফেলব আজ। দুই ভাই বোনের মাথা দাম করে ঠুকে দেব। আমার ছেলেটা বেশি পাজি। কী দেখছিস তোরা? এক থাপ্পড় মেরে তোর কান গরম করে দেব তাতাই! পড়াশোনার নামগন্ধ নেই। এই বেড়ে পাকামির জন্যই তুই পরীক্ষার খাতায় লাড্ডু পাস।
-আমি কিছু জানি না মা! তিতলি আমাকে বলল ভালো ভূতের সিনেমা তাতাই। দেখবি আয়। ও এনেছে। আমি কিছু জানি না। ও আমাকে দেখতে ডাকল।

মোহনা ততক্ষণে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেছে দোতলায়। ঘরের দরজা বন্ধ করে চুপটি করে বসে আছে। একটু পরেই দরজা পেটানোর প্রবল শব্দ। চন্দ্রাণী চিৎকার করে উঠল,

-তিতলি দরজা খোল!

বারকয়েক দরজা পেটানোর পর দরজা খুলে দিল মোহনা। তাতাইয়ের কান টেনে ধরে ওর মা দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটার গাল কান সব টমেটোর মতো লাল হয়ে গেছে। ধমকে উঠল চন্দ্রাণী,

-কে এনেছে ওইসব সিনেমা? তাতাই তো? আজই এটাকে বাড়িছাড়া করব।

কানে ভালোরকম মোচড় দিতেই কঁকিয়ে উঠল আবিষ্কার। মোহনার দিকে চেয়ে চোখ টিপে ইশারা করল তাতাই। যার অর্থ, "আমার ওপর ছেড়ে দে। সামলে নেব।"

মোহনার বুকের ভিতরটা কাঁপছিল। চন্দ্রাণীর হাতটা টেনে আবিষ্কারের কান থেকে নামিয়ে ও বলল,

-তাতাইকে ছেড়ে দাও মানু। আমরা কেউ জেনেশুনে এসব সিনেমা আনিনি। আমি ভূতের সিনেমা দেখতে চেয়েছিলাম। দোকানের ছেলেটা ইচ্ছে করে আমার হাতে এটা ধরিয়ে দিয়েছে। তাতাই এটা নিতে বারণ করেছিল। আমিই বেশি সাহস দেখিয়ে এনেছি। তোমাদের সবার সঙ্গে বসেই তো টিভি দেখি বলো! তোমার কী মনে হয় মানু, জেনেশুনে এসব আমি বাড়িতে আনব? তাও আবার দিনদুপুরে দরজা খুলে চালিয়ে বসে থাকব? সরি মানু! আমি জানতাম না! তাতাইকে ছেড়ে দাও।

মোহনার মুখের দিকে চেয়ে, নিজের ছেলের মাথায় সজোরে একটা চাঁটি মেরে আর একবার ভালো করে কানটা নেড়ে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছিল চন্দ্রাণী। মোহনা ডাক দিল,

-মানু?

চন্দ্রাণী সিঁড়িতেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। মোহনার কণ্ঠে কাতর আর্তি,

-মাকে এসব বোলো না প্লিজ!

মায়ের হাতে চাঁটি খেয়ে কানে হাত বোলাতে বোলাতে মোহনার ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল তাতাই। কিন্তু তার আগেই মোহনা ঘরের দরজাটা সজোরে বন্ধ করে দিল। বাইরে থেকে চিৎকার করে উঠল তাতাই,

-ওফ! এই এক মেয়ে! একটু কিছু হলেই ঘরে খিল দিয়ে গাল ভারী করে বসে থাকতে জানে! আমার খিদে পাচ্ছে। তুই বেরোবি কিনা বোন! দরজা খোল না! ওই তিতলি?

সন্ধে নেমেছে বাড়ির ছাদে। কার্নিশে চুপ করে বসে রয়েছে মোহনা। ছাদের ওপর থেকে বাড়ির গেটটা দেখা যাচ্ছে। এই গেটটা মোহনার খুবই পরিচিত। কত ছোট বয়স থেকেই যে ওই গেট পেরিয়ে মোহনা এই বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেছে, সেটা আজ আর ওর মনে পড়ে না। মোহনার মায়েরা দুই বোন। বড় বোন চন্দ্রাণী, অর্থাৎ তাতাইয়ের মা। আর ছোট বোন ইন্দ্রাণী, তিতলির মা। বাড়িভাড়া দিয়ে ও সংসার চালিয়ে, দুই বোনের উচ্চশিক্ষার খরচ বহনের মতো আর্থিক ক্ষমতা তিতলির দাদুর ছিল না। তিনি একটি ছোট মুদি দোকানের কর্মচারী ছিলেন। তবুও মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য তিনি প্রাণপাত করেছেন। দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে অতিকষ্টে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে চন্দ্রাণী। কিন্তু ইন্দ্রাণীর পড়াশোনার দৌড় নবম শ্রেণী পর্যন্ত। তারপরই শুরু হয় বাবার শারীরিক অসুস্থতা। প্রবল শ্বাসকষ্টের কারণে প্রায় শয্যাশায়ী তিনি। চিকিৎসার জন্য পরিমিত অর্থ বাবার সঞ্চয়ে ছিল না। সেই সময়ে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে বাবার পাশে দাঁড়ানোর জন্য বদ্ধপরিকর দুই মেয়ে, সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে কাজকর্ম শুরু করতে হয় দুই বোনকে। ভাগ্য খানিক সহায় হয়, যখন দুই জামাই এই পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ায়। সুখের সাগরে ভেসে যায় ঐ পরিবার, যখন প্রায় একইসঙ্গে দুই বোনের গর্ভে নতুন অতিথির আগমন ঘটে। কিন্তু ভাগ্যে সুখ দীর্ঘস্থায়ী না হলে শত পরিশ্রম শেষে, ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই লাভ করা সম্ভব হয় না। বিয়ের কয়েক বছর পরই মারা যায় তাতাইয়ের বাবা। মেসোমশাইকে তিতলির সেভাবে মনে পড়ে না। তাঁর সঙ্গে পরিচয় কেবল ছবির মাধ্যমে। আর তিতলির বাবা? মৃদু হাসে তিতলি! চোখ থেকে গড়িয়ে আসা জলটা মুছে নেয় হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে। দাদু-দিম্মার মৃত্যু, অভাব-অনটন, আশ্রয়হীনতা, অনিশ্চয়তা.... টানাপোড়েনের সেই অভিশপ্ত দিনগুলো কাটিয়ে উঠেছে দুই বোন। আজ বাজারের ভিতর তাতাইয়ের মায়ের একটা ছোট বুটিক, আর তার সঙ্গে টেলারিং হাউজও রয়েছে। আর ওই বুটিকের সঙ্গেই লাগোয়া একটা লেডিস পার্লার করে নিয়েছে তিতলির মা। দুই বোন একত্রে সারা জীবনব্যাপী যুদ্ধ করে আজ এই পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। তাতাই আর তিতলিকে বড় করেছে, পড়াশোনা শেখাচ্ছে। তাতাইকে মানু গত বছর একটা সেকেন্ড হ্যান্ড স্কুটিও কিনে দিয়েছে। কলেজে উঠলে তিতলিকেও কিনে দেবে, এমনটাই কথা হয়েছে। এই দোতলা বাড়ির ওপর তলাতেই আগে ভাড়া থাকত তাতাইয়ের বাবা-মা আর তাতাই। এখন এই দোতলাটা ওরা পুরোটাই কিনে নিয়েছে। বাড়িওলা যেহেতু দেশের বাইরে থাকেন, তাই একতলাটাও ওরা ভাড়া নিয়েছে। তবে মা আর মানুর ইচ্ছে আছে বাড়িওলা তিন বছর পর দেশে ফিরলে একতলাটাও ওরা কিনে নেবে। এখন থেকেই বাড়ি কেনার জন্য প্রাণপণে টাকা জমাচ্ছে দুই বোন। সারাদিনই দুই বোন টাকার জন্য দোকানে পড়ে থাকে। বেশ কয়েকজন কর্মচারী কাজ করে ওদের দোকানে। খুব ছোট থেকেই খিদের তাড়নায় হাত পুড়িয়ে কাজ করতে করতে, কবে যেন সবরকম রান্নাবান্না শিখে গিয়েছিল তিতলি আর তাতাই। ভাইবোন স্কুলে বেরিয়ে গেলে গোটা বাড়ি জনমানবহীন অবস্থায় পড়ে থাকে। আর ছুটির দিনে আবিষ্কার আর মোহনা বাড়ি থাকলে, ওরাই মা আর মানুকে নিয়ে হৈ-হল্লা করে মাতিয়ে রাখে গোটা বাড়ি। দুটো মানুষ সারাজীবন অতিবাহিত করে ফেলেছে শুধুমাত্র সন্তান আর সংসারের জন্য। বিন্দুমাত্র সাধ-আহ্লাদ কিংবা আত্মসুখের কথা চিন্তা করার অবকাশ তারা পায়নি। খুব ছোট থেকেই তাতাই আর তিতলি বুঝে গিয়েছিল ওদের সংগ্রাম। সেই কারণে একটু খুশির সুযোগ পেলে, ওরা আর কোনমতেই সেটা হাতছাড়া করতে চায় না। সবসময় হেসেখেলে জীবনের কষ্টগুলোকে রঙিন প্রজাপতির মতো উড়িয়ে, মনটাকে হালকা রাখতে চায়। একটু মনখারাপ হলেই তিতলির কথা একদম বন্ধ হয়ে যায়। কেমন যেন একটা আতঙ্ক এসে চেপে বসে ওর বুকে। মনে হয় পৃথিবীর কেউ ওকে ভালোবাসে না। শৈশবের ঐ অভিশপ্ত দিনগুলো বারংবার স্মৃতিতে ফিরে আসে। গলার কাছে কেমন যেন দলা পাকিয়ে কান্না জমে থাকে। তখন ও একা ছাদে এসে চুপ করে বসে থাকে। কথা বলে নিজের সঙ্গে। সেই অভিমানী মেয়েটার সঙ্গে, যার খবর কেউ জানে না। তাতাইও না। কাব্যও না। বাবা-মাকে ছোট থেকে কাছে না পাওয়ার জন্য ওর মনের ভিতরে একটা জেদি আর অভিমানী মেয়ের জন্ম হয়েছে। যাকে ও খুব সযত্নে আজও লালন পালন করে। সময়বিশেষে ওই অভিমানী মেয়েটা আত্মপ্রকাশ করে। এমনি সময়ে মোহনা ঘুম পাড়িয়ে রাখে তাকে। তিতলির জীবনের একমাত্র বন্ধু তাতাই। তিতলির থেকে তাতাই সামান্য বড় হলেও, ও দাদাকে নাম ধরেই ডাকে। দুই ভাই-বোন যেন হরিহর আত্মা। ওদের মধ্যে দিনরাত যতটা মারপিট-চুলোচুলি-ঝগড়া, ঠিক ততটাই ভালোবাসা ও প্রগাঢ় হৃদ্যতা লক্ষ্য করা যায়। ওরা পরস্পরের জীবন যুদ্ধটা এত কাছ থেকে দেখেছে, যে দু'জন দু'জনকে ছাড়া কিছু ভাবতেই পারে না। একটা ইচ্ছাকৃত কাশির শব্দে তিতলির ভাবনার ঘোর কাটল। অদূরে তাতাই দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিতলিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে তাতাই বলল,

-কী রে? একা একা বসে আছিস যে! মন খারাপ?
-মা খেতে আসেনি দুপুরে?
-না। মা বলল পার্লারে অনেক কাস্টোমার ছিল। মানু আসতে পারবে না। মা নিজে খেয়ে মানুর খাবারটা প্যাক করে নিয়ে গেছে।
-তুই খেয়েছিস?
-তুই বাড়িতে থাকলে তোকে ছাড়া খেয়েছি কখনো?
-হতভাগা সন্ধে হয়ে গেল। এখনো খাসনি তুই?
-চেল্লাস কেন? কানের পর্দা ফেটে গেল। এমনিতেই কানমলা খেয়ে আমার পেট ভরে গেছে। খিদে নেই আর।
-একটুও জায়গা নেই পেটে? ফুচকা খেতে পারবি না?

হেসে ফেলল তাতাই। তিতলি ওকে জড়িয়ে ধরে কান্নাভেজা গলায় বলল,

-সরি দা! আমার জন্য তুই মানুর হাতে মার খেলি!
-এহ! দাদা নাকি! সম্মান শ্রদ্ধা কিছু করিস তুই আমায়? খালি কান্নার সময় দাদা বলে জড়িয়ে ধরবি, আর বাকি সময় আমার পিছনে খ্যাকশিয়ালের মতো খ্যাক খ্যাক করবি! ছাড় ছাড়! খেতে দে, খিদে পেয়েছে।
-চল!
-সাহিত্য ফোন করেছিল তিতলি।
-আবার?
-হ্যাঁ।
-কী বলছে?
-এই তুই কেমন আছিস? পরীক্ষার পর তোর আর কোন খবর নেই। একেবারে ডুমুরের ফুল হয়ে গেছিস! তোর সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে কিনা! এইসবই...
-এই মানু তখন কোথায় ছিল?
-বেরিয়ে গেছিল।
-তুই কী বললি?
-আমি বললাম, রাজকন্যা এখন গোঁসা ঘরে খিল দিয়েছেন। তুই পরে ফোন করিস ভাই! আচ্ছা তিতলি, তুই ছেলেটাকে পাত্তা দিস না কেন রে?
-সিডিটা বের করেছিস? ফেরত দিতে হবে। আমি যাব। ওই ছেলেটার মাথায় সিডি ভাঙব।
-এই না। আমি যাব। তুই গেলে ছেলেটার মাথা তো দূর, দোকানও ভাঙচুর করে ফেলতে পারিস।

হেসে ফেলল দুই ভাই বোন। তিতলির মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে ঘেঁটে তাতাই বলল,

-বড়দের কথা শুনতে হয়, বুঝলি?
-হু! আমি খুব খারাপ বোন, তাই না তাতাই?
-কোন শালা বলে? ফুলো কা তারো কা, সবকা ক্যাহনা হ্যায়... এক হাজারো মে... উঁহু! আমার বোন কোটিতে একটা!
-তাই নাকি? তোর জন্যও একটা গান আছে। করি?
-প্লিজ!
-স্রোতস্বিনী! তুমি নাহি...
-ওই!

সন্ধের আবছা অন্ধকারের মধ্যেও তিতলি বুঝতে পারল,
স্রোতস্বিনীর নামেই তাতাইয়ের হাসিতে লজ্জা স্পষ্ট! তিতলি বলে উঠল,

-থাক থাক! আর লজ্জা পেতে হবে না। স্রোত কেমন আছে?
-মামারবাড়ি থেকে কাল ফিরেছে। আজ দেখা করার কথা বলছিল। এদিকে শুভটা মাসিরবাড়ি গিয়ে বসে আছে, রাহুল সিমলা। কার নাম নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোই বল তো? বন্ধুরা শুনলে হাসে। এতবড় ছেলে হয়ে গেলাম, রেজাল্ট বেরোলে দু'দিন পর কলেজে যাব, এখনো কোথায় যাচ্ছি, কার সঙ্গে যাচ্ছি, কখন বাড়ি ঢুকব, মাকে সবকিছুর কৈফিয়ৎ দিতে হয়। আমার মা তো মনে করে আমি বাড়ি থেকে বেরোলেই পৃথিবীর সব মেয়েরা রাস্তাঘাটে বিপদে পড়বে! আমি যেন সবাইকে টিজ করে বেড়াব! তুই জানিস তো আমাকে বুনু! আমি ওইরকম করি?
-আমার কথা ভাব তো তাতাই! আজ তোর মতো দাদা আছে বলে, আমি রাস্তায় একা বেরোতে ভরসা পাই। মানু তোকে যেভাবে মানুষ করছে, তুই চাইলেও কোনদিন ভুলভাল কাজ করতেই পারবি না। তোর মন সায় দেবে না। আমার তো রাস্তায় বেরোলে মনে হয়, সব ছেলেরাই তোর মতো ভালো। তাদের সবাইকে তাদের মায়েরা ঠিক তোর মতো করেই মানুষ করেছে, তাই নিজেকে সেফ লাগে। মানু ঠিক বলে তাতাই। মেয়ে সন্তান মানুষ করার থেকে ছেলে সন্তান মানুষ করা অনেক বেশি কঠিন। অনেক বেশি দায়িত্বের। ছেলে কুসঙ্গে পড়ল কিনা, কোন বন্ধুর সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, মানুর সব হিসেব চাই। আমার তো বেশ ভালো লাগে এটা! তোকে মানু এমনভাবে তৈরি করেছে, শুধু আমি কেন তাতাই? পৃথিবীর যে কোন মেয়েই তোর সঙ্গে একটা বন্ধ ঘরেও নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে। অবশ্য স্রোতের কথা আলাদা! ওর সঙ্গে তোকে এক ঘরে রাখলে, তুই যে ওকে কী করে ফেলবি...
-মার খাবি তিতলি! দাদার সঙ্গে কথা বলছিস! ভুলে যাস নাকি! লজ্জা করে না?
-এহ! কী আমার দাদা এলেন রে! সর সর খিদে পেয়েছে।
-স্রোতের সঙ্গে একটু বেরোব বোন। মাকে ম্যানেজ করে দিবি? প্লিজ!
-আমি একটু পর কাব্যর সঙ্গে বেরোব। মানুকে বলে যাচ্ছি, তুই আমাকে আনতে যাবি। আমাকে আনতে যাওয়ার নাম করে দোকানে বলে বেরিয়ে যা, দেখা করে নে বউয়ের সঙ্গে।
-কাব্যর সঙ্গে বেরোবি, না সাহিত্য?

কোন উত্তর দিল না মোহনা। সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে এলো। ওর পিছনে নামতে নামতে আবিষ্কার বলল,

-বুঝে গেছি। যে ছেলে এক বছর ধরে ঘুরছে, তার দিকে তুই ফিরেও চাইবি না। দেখবি একদিন এমন দিন আসবে, যে ছেলে তোকে জম্পেশ ইগনোর করবে, তুই তার জন্যই মরবি!

টেবিলে খেতে বসেও তাতাইয়ের বকবকানি অব্যাহত রয়েছে। মোহনা দুপুরের খাওয়া সন্ধেবেলা সেরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে একজোড়া ঝোলানো কানের দুল পরছিল। একটা সুগন্ধীর বোতল উপুড় করে দিল নিজের দেহে। তাতাই মোহনার সমস্ত কথা জানে। সমস্ত বন্ধুদেরও চেনে। যেখানে যা হয়, ওরা ভাই বোন পরস্পরকে সবই বলে। কেবল একটা কথা কোনদিনই বলা হয়নি ওকে। হয়তো এই গোপন সত্য তাতাইকে কোনদিনই বলা হবে না। ও জানে এই কৃত্রিম সুগন্ধীটা ওকে ওর প্রিয় বান্ধবী কাব্যাঞ্জলি উপহার দিয়েছে, যে এইবার মোহনার সঙ্গেই পরীক্ষা দিল। ওরা একই স্কুলে পড়ে। পড়াশোনার সূত্রে ওরা একে অপরের বাড়িতেও যাতায়াত করে। পরীক্ষার আগে নাইট স্টাডির জন্য কাব্যর বাড়িতে মোহনা একাধিক রাতও কাটিয়ে এসেছে। কিন্তু পৃথিবীর কেউ এটা জানে না, যে এই সুগন্ধী নিজের দেহে মেখে মোহনার দৃষ্টির সম্মুখে একাধিকবার নিজেকে মেলে ধরেছিল কাব্য। আর মোহনাও হারিয়ে গিয়েছিল কাব্যর কোমল ঠোঁটের অতলে। কাব্যর দেহের ঐ পরিচিত সৌরভটুকু নিজের দেহে মেখে নিল মোহনা। প্রিয় নারীর দেহের সৌরভে আবিষ্ট হয়ে গেল ও। কাব্যর সঙ্গে নিজেকে কল্পনা করে মোহনার মনের আকাশে ডানা মেলে উড়তে লাগল শত শত রঙিন প্রজাপতি।

**********

(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত

মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই, ২০২২

প্রজাপতির মৃত্যু (তৃতীয় পর্ব)


 

প্রজাপতির মৃত্যু

মন প্রজাপতি

প্রথম অধ্যায়
সাথী দাস

তৃতীয় পর্ব



ঘরে ঢুকে পদ্ম দেখল, দুই ছেলে-মেয়ের জ্বর। পদ্মর সাময়িক অনুপস্থিতিতে বড় ছেলে টুকাই আর ওদের বাবা একেবারে দিশেহারা। দুটো মাত্র ঘর আর একটা বারান্দা সম্বল পদ্মর। কলঘর উঠোনের এককোণে। মাথার ওপর টালির চাল দিয়ে প্রতি বর্ষায় জল পড়ে। যতবার ভেবেছে চালটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে, ততবারই সর্বভূক সংসার গিলে খেয়েছে জমানো সব টাকা। দুটো ঘর একেবারে লণ্ডভণ্ড। ঘরণীর অনুপস্থিতিতে সংসার করতে গিয়ে রান্নার স্টোভ থেকে শুরু করে বালিশ বিছানা, বাসনপত্র সব ছড়িয়ে ফেলেছে দুলাল। ভাঙাচোরা ঘরের একপ্রান্তে ইঁট ঠেকিয়ে রাখা তক্তপোষের ওপর নিজের জন্য একটু জায়গা আদায় করে নিল সুরঞ্জনা। পূর্ণা একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। দেহে ভীষণ রকম তাপপ্রবাহের কারণে ছোটুর চোখে ঘুম নেই। একটুকরো কাপড় ভিজিয়ে ওর কপালে জলপট্টি দিচ্ছিল দুলাল। ও একটু পর উঠে এসে বসল পদ্মর পাশে। ট্রাঙ্ক থেকে কিছু টাকা বের করে পদ্মর হাতে গুঁজে সুরঞ্জনাকে কোলে তুলে নিয়ে ও বলল,

-এটা দিয়ে ক'দিন টেনেটুনে সংসার চালিয়ে নিও। এখন কাজের বাড়ি যেতে হবে না।
-কোথায় পেলে টাকা?
-মনসুরের থেকে সুদে ধার নিয়েছি।
-আবার দেনা? বলি শোধ করবে কে শুনি?

ভারী হয়ে এলো পদ্মর গলা। চোখের জল গড়িয়ে পড়ল গালে। মৃদুস্বরে ও বলল,

-না খেয়ে পেটে দড়ি দে থাকলেও আর দেনা করতে মন করে না। দেনার দায়ে আমার গোটা জেবনটাই শেষ হয়ে গেল। এর থেকে টাকা নিয়ে ওরে দাও, ওর থেকে নিয়ে এরে! আমি আর পারি না গো!

-মা রাতে কী রান্না হবে? চাল নেই! ডাল অল্প রয়েছে। চুপড়িতে তিনটে আলু পড়ে রয়েছে। ঠাকমা বলছে খিদা লাগে।

দরজার দিকে চেয়ে পদ্ম দেখল, বড় ছেলে টুকাই এসে হাজির হয়েছে। এই কয়েকদিনে কী বড় বেশি লম্বা হয়ে গেছে টুকাই! চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ছেলের মাথা প্রায় দরজার ওপর প্রান্তে ঠেকে গেছে। গলা ভাঙতে শুরু করেছে টুকাইয়ের। কোন এক সুনিপুণ চিত্রশিল্পী তুলির নিখুঁত টানে বালকের ঠোঁটের ওপর গোঁফের সূক্ষ্ণ রেখা টেনে ঘোষণা করছেন শৈশবের সমাপ্তি। পদ্ম ঘরে এসেছে অনেকক্ষণ আগেই। দুই ছেলে মেয়ে জ্বরে কাহিল। পিসি শাশুড়িও বিছানা হাতড়ে হাসিমুখে এগিয়ে এসে ছোট মেয়ের গায়ে মাথায় কম্পিত হাত বুলিয়ে তার দীর্ঘায়ু কামনা করেছে। দুলাল এখন মেয়েকেই কোলে নিয়ে বসে আছে। কিন্তু টুকাই একবারও বোনের ধারেকাছে এগোয়নি। উঁকি মেরে বোনের মুখটাও দেখতে আসেনি। পদ্ম বলে উঠল,

-শুধু নেই আর নেই!
-তা না থাকলে কী বলব মা? আছে!
-টুকাই এমনধারা কথা বলছিস কেন তুই? বোনকে একবারও কোলে নিয়েছিস?
-রাতে কী রান্না হবে বলো? ঘরে কিছু খাবার জুটবে নাকি খাবার লোক বেড়ে যাওয়ার জন্য আমরা না খেয়ে বা আধপেট খেয়ে নতুন মানুষকে খাওয়াব?

ছেলের কথা শুনে বাক্যহারা হল পদ্ম। দুলাল বড় নির্বিবাদী শান্ত স্বভাবের মানুষ। সাংসারিক কোন জটিলতার উত্তর সে দিতে পারে না। সে কেবল জানে এই ছেলের পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনে নিজের জীবনটাও শেষ করতে হবে। টুকাই সরকারি স্কুলে পড়ে। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব অনেকটাই। স্কুলে যাওয়ার জন্য কোথা থেকে কার একটা ভাঙা সাইকেল জুটিয়ে নিয়েছে সে। দুলাল নতুন সাইকেল কেনার জন্য ছেলেকে টাকা দিতে পারেনি। ছেলের অনেক প্রয়োজনই মেটাতে অক্ষম সে। স্কুলের প্রত্যেক শিক্ষকের মুখে মুখে ফেরে টুকাইয়ের মেধা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা। কত শিক্ষক বেতনের আশা না করেই স্বেচ্ছায় পড়ান টুকাইকে। ছেলেটা বড় কম কথা বলে। সারাদিন কেবল পড়াশোনা করে। প্রাণপণে এই ছেলেটিকে তৈরি করার চেষ্টা করছে দুলাল ও পদ্ম। পড়াশোনায় বরাবরই ভালো টুকাই। সেই কারণে দুলাল বড় ছেলেকে সমীহ ও অপার শ্রদ্ধার চোখে দেখে। প্রত্যেক বছর বার্ষিক পরীক্ষার পর ওর স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে রাস্তাঘাটে দেখা হলে, তারা দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে দুলালের সঙ্গে কত সম্মান দিয়ে কথা বলে। বাবার এই যে বিরাট সম্মান প্রাপ্তি, সকলই তো টুকাইয়ের জন্য। দুলাল প্রায় লেখাপড়া জানে না বললেই চলে। সেই কারণে ছেলের এই উন্নতি দেখে আনন্দে দুলালের দু'চোখ ভাসে। ছেলের এমন কথায় একটু কষ্ট পেলেও দুলাল অস্বীকার করতে পারল না, যে সত্যিই এতবড় পরিবারের অন্ন সংস্থানের ক্ষমতা তার নেই। ছেলের কথায় অক্ষম জন্মদাতা আঘাত পেলেও, চোখে জল নিয়ে চুপ করে রইল। পদ্ম আঁচল থেকে নার্সদিদির দেওয়া টাকা থেকে কিছু টাকা বের করে ছেলের হাতে দিয়ে বলল,

-ডিম, চাল আর আলু নে আয়। ডিমের ঝোল ভাত করে দিচ্ছি। পেটপুরে খাবি তুই। আমি বেঁচে থাকতে তোর ভাগেরটা বোন খেয়ে নেবে না। যতদিন আমার গতর আছে, আমি আমার অক্ত বিককিরি করে তোদের ভরপেট ভাত খাওয়াব।
-মা আমি...
-যা! আর কিছু শুনতে চাই না। দূর হয়ে যা!

টুকাই বেরিয়ে গেলে কাঁদতে কাঁদতে পদ্ম বলল,

-শুনলে ছেলের কথা? এই বয়সে এসে মেয়ে বিয়োলাম! তোমার জন্য নিজের পেটের ব্যাটার কাছে আমাকে এটাও শুনতে হল। এখনো গতর আছে, হাতে পা চলছে। খেটে খাচ্ছি। তাতেই ছেলের মুখের বুলি এই! এই ছেলে আমাদের বুড়ো বয়সে ভাত দেবে, তুমি সেই চিন্তা করো?
-টুকাই কত পড়ালেখা করে! ও বড়মানুষ হবে! সারাদিন খালি পেটে পড়ে। ওকে একটু ভালো কিছু খেতে দিতে পারি না আমরা। ছোটু আর পূর্ণার জন্য কত করল এই ক'দিন। তুমি তো সেটা চোখে দেখোনি! খিদের জন্য এখন ওর মাথা ঠিক নেই পদ্ম। ভুল করে বলে ফেলেছে। ব্যাটার কথা মনে নিয়ে কষ্ট পেতে নেই।
-নিজেদেরই খাওয়া জোটে না। তাও এই আকালের সংসারে রেখে তোমার পিসিরে ভাত দিচ্ছি। ঠাকুর তুমি দেখছ তো সব? একটা পেরানীরেও খালি পেটে ঘুমুতে দিই না! আমি নিজে না খেয়ে সবারে করছি। জেবনের শেষটায় যেন এই দুই বুড়ো বুড়ি খিদার জ্বালায় পথেঘাটে না মরি! দুটো ব্যাটা বিয়েছি। দুই ব্যাটার বউ যেন দু'বেলা দুটো ভাত দেয়।

একদৃষ্টে ঘুমন্ত সুরঞ্জনার দিকে চেয়ে কপাল চাপড়ে পদ্ম বলে উঠল,

-সব এই আবাগির জন্য! এর জন্যই এত কথা শুনতে হল আমারে...

ততক্ষণে বাবার কোলের উষ্ণতায় আবিষ্ট হয়ে গভীর ঘুমের দেশে হারিয়ে গেছে সুরঞ্জনা। মায়ের কুকথা তাকে স্পর্শও করতে পারল না।

সুরঞ্জনার জন্মের পর কেটে গেছে দীর্ঘ সময়। টুকাই ছোট বোনকে পছন্দ না করলেও, ছোটু সারাদিন বোনকে নিয়েই আহ্লাদে আটখানা। পড়াশোনায় একেবারে মন নেই পদ্মর ছোট ছেলের। মেয়েটা সেই তুলনায় লেখাপড়ায় ভালো। টুকাই আর পূর্ণাকে নিয়ে দুলালের অনেক আশা, তারা একদিন অনেক বড় হবে। বড় ছেলের জন্য প্রাণপাত করে সে। পদ্মর শরীরটাও ভাঙছে। এবার হাসপাতাল থেকে ফেরার পর ঐ লোহার মতো নীরোগ শরীরে একের পর এক রোগ বালাই লেগেই আছে। সুরঞ্জনার জন্মের ধকল এই বয়সে এসে পদ্ম আর নিতে পারেনি। বাবুদের বাড়ির কাজে প্রায়ই কামাই হয়ে যায়। তিনটে বাড়ির কাজ ইতিমধ্যেই চলে গেছে। তারা করিৎকর্মা নতুন লোক পেয়ে গেছে। ফলে পদ্মর সংসার প্রায় অচল বলা চলে। সংসারের ভাবগতিক দেখে বৃদ্ধা পিসি শাশুড়িরও আজকাল আর খিদে লাগে না। বেশ কয়েকদিন বাড়িতে বসে থাকার পর একদিন সকালে দুলাল হন্তদন্ত হয়ে এসে উঠোনে পা রেখে বলে উঠল,

-ও পদ্ম, পেঁয়াজ কাঁচালঙ্কা দিয়ে তাড়াতাড়ি দুটো পষ্টিভাত দাও দিকিনি! একটা কাজের খবর আছে।

এখন পদ্ম সকালে কাজে বেরোয় না। বিকেলে দুটো ফ্ল্যাটে রান্নার কাজে যায়। তারা সবাই অফিস বাবু। খুব সকালে স্বামী-স্ত্রী অফিসে বেরিয়ে যায়। তাই রান্নার যাবতীয় কাজ রাতেই করতে হয়। আর একটা ফ্ল্যাটে রাতের রুটি তরকারি করে সকালের রান্নার জোগাড়টা করে আসতে হয়। দুই ফ্ল্যাটেই সপ্তাহান্তে শনি আর রবিবার গিয়ে ঘর মোছা, সারা সপ্তাহব্যাপী ব্যবহৃত যাবতীয় জামাকাপড় কাচা-ধোয়া করে আসে পদ্ম। বৌদিরা বড় অফিসে চাকরি করে বলে নিজেরা সংসারে তেমন সময় দিতে পারে না। তাই এই ফ্ল্যাট দুটোতে পদ্ম অনেক বাড়তি কাজ পায়। ফলে ওর মাইনে ছাড়াও কিছু উপরি পাওনা আছে। বকশিশও কিছু কম নয়। কিন্তু ওর একার ওপর তো গোটা সংসার আর চলে না। টাকা-পয়সার জন্য দুশ্চিন্তা করে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছে পদ্ম। খুব ক্লান্ত লাগে আজকাল। দুলালের ডাকে বিছানা ছেড়ে উঠে ও বলল,

-কোথায় কাজ গো?
-ওই যে গো, নবীন পল্লীতে ডাক্তারবাবুর যে ইস্কুলবাড়ি আছে, ওখেনে। ইস্কুলের সামনে অনেকটা বাড়তি জমি আছে না? দিদিমণি মনসুরকে ওই জমিটা পরিষ্কার করতে ডেকেছে। বিড়ি টানতে টানতে মনসুর বলল, মন করে দিদিমণি ওই জমিতে নতুন স্কুলঘর করবে। আমি বললাম, আমারেও নে চল ভাই। হাতে একদম টাকা নাই। অত বড়লোক মানুষ। তোরে টাকা দিলে আমাকেও ক'টা টাকা দিতে পারবে। দু'জন যাব। ঝপ করে দুটো ভাত দাও তো। সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে যাই। কাজ করলে তবে তো দুটো টাকা আসবে। টুকাইয়ের টেস পেপার না কি বই যেন কিনতে হবে, কতদিন ধরে ছেলেটা বলছে! আজ টাকা পেলে আগে ওর হাতে বই কেনার টাকা দেব।

ভাতগুলো নরম হয়ে বেশ গলে গেছে। ভাতের ওপর একটু লবণ আর কয়েক ফোঁটা সর্ষের তেল ছড়িয়ে ওগুলো গোগ্রাসে গিলতে শুরু করল দুলাল। পিঁড়ির ওপর বসে পদ্ম বলে উঠল,

-হ্যাঁ গো, আমার জন্য ওই ইস্কুলে কোন কাজ পাওয়া যায়? খবর নাও না একটু! অনেক বড় ইস্কুল শুনেছি। দুটো ফেলাটের কাজের টাকা দে তো আর চলছে না।
-মঙ্গলার মাকে সেদিন কাজ দেখে দেওয়ার কথা বললে যে, তার কী হল?
-কেউ নিজে কাজ না করে আমাকে দেবে? খিদে সবার পেটেই আছে তো নাকি! আমি কাউর পেটে লাথি মেরে কাজ ভাঙিয়ে নিজে ঢুকতে চাই না। তারপর বাড়ি বয়ে কোমর বেঁধে কোঁদল করতে আসবে। টুকাই এসব পছন্দ করে না, জানোই তো!
-আমি আজ কাজে যাই। দেখছি। পিসির শরীল এখন কেমন? সকালে শরীলটা খুব খারাপ হয়েছিল তো।
-ঠিক আছে। ও বাড়ি থেকে তোমার দাদা এসেছিল একটু আগে!
-কী বলছে?
-ওই দাওয়ায় বসে মুখ লচানো আলগা পিরিত দেখালো। গলা ছেড়ে ডাক দিল, ও পিসি ভালো আছ? এক বাস্ক সন্দেশ দিয়ে গেছে। নাও আর কী! কাল থেকে পেটে ভাত নাই, খালি পেটে বসে বসে এবার দাদার আনা দামি সন্দেশই গেলো তোমরা!
-ও পিসিই খাক! ধরার দরকার নেই।
-দাদা চলে যাওয়ার পর পিসি ও সন্দেশের বাস্ক ছুঁড়ে ফেলেছে।
-কী বলছ?
-হু! আমিই কুড়িয়ে আনলাম। সন্ধেকালে দেব মুড়ি দে। ক'টাদিন আর বাঁচবে! খাক। আমরা তো আর ভালোমন্দ কিনে দিতে পারি না। তোমাকে আর দুটো ভাত দেব?
-না। টুকাই খেয়ে ইস্কুলে যাবে তো! ওর জন্য ভাত আলাদা করে তুলে রাখো। ছোটু আর পূর্ণা ইস্কুলে খেয়ে নেবে। কিন্তু তুমি আর পিসি কী খাবে?
-আমাদের চিন্তা করতে হবে না। আমরা মেয়েমানুষ, আমাদের আবার খাওয়া! এবেলা কিছু একটু ফুটিয়ে নেব। বিকেলে বৌদির ফেলাট থেকে খাবার আনব তো! ওবেলা খাব।

চোখের জল চেপে দুলাল বলল,

-আমার খিদেটা ঐ একটু মরলেই হবে। বেশি লাগবে না। টুকাইকে আমার ভাগের ভাতটা দিও।

থালাটা তুলে নিয়ে কলঘরে চলে গেল ব্রজদুলাল। সুন্দর একটি সকাল। মনসুরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে লুঙ্গিটা কোমরে বেঁধে রোদে পুড়ে ঘর্মাক্ত দেহে কাজ করছিল দুলাল। একটু বিশ্রাম নেওয়ার সময় কানে গোঁজা বিড়িটা নামিয়ে মনসুর দুটো সুখটান দিচ্ছিল, এমন সময় একজন মহিলা হন্তদন্ত হয়ে একটি ছেলের হাত ধরে স্কুলে এসে ঢুকলেন। তাঁকে দেখে প্রবেশদ্বারের দারোয়ান থেকে শুরু করে সকলেই কেমন যেন সমীহ করে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মনসুরের দিকে চাইল দুলাল। মনসুর বলল,

-ইস্কুলের সবচে বড় দিদিমণি আর তার একমাত্তর ছেলে। এ হল ডাক্তারবাবুর নাতি। সবাই একডাকে চেনে এরে। বড় ভালো ছেলে।
-এটাই বড় দিদিমণি?
-হ্যাঁ, দাঁড়াও দুলালদা, তোমার কথা দিদিমণিরে একটু বলে আসি।

জ্বলন্ত বিড়িটা দুলালের হাতে ধরিয়ে মনসুর ছুটল দীপমালার কাছে। বলল,

-দিদিমণি, ভালো আছেন?
-হ্যাঁ মনসুর। তুমি ভালো ভাই?
-হ্যাঁ দিদিমণি। অনেকটা বড় জায়গা তো। তাই একজনরে সঙ্গে নে এসেছি। আমার একটু সুবিধা হবে।
-ওহ আচ্ছা। তা ঠিক আছে, ভালোই তো! কাজ করো তোমরা। কাজ হয়ে গেলে দু'জনেই আমার অফিসে দেখা করে যেও। কেমন!
-আচ্ছা দিদিমণি।
-দিদিমণি?
-হ্যাঁ বলুন?
-আপনের সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে?

দুলাল এসে দাঁড়িয়েছে মনসুরের পিছনে। ডানহাতের কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে চেয়ে দীপমালা বলে উঠল,

-কী ব্যাপারে বলুন তো?
-এই ইস্কুলে মেয়েমানুষের জন্য কোন কাজ, মানে কতরকম তো কাজ থাকে। আমার বউয়ের জন্য...
-এখন আমার একটু তাড়া আছে দাদা। অনির ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। আপনি বরং কাজ সেরে নিন। তারপর আমার অফিসে বসে ধীরেসুস্থে কথা হবে।
-আচ্ছা দিদিমণি।

স্কুলের ঘন্টার শব্দ শুনে তাড়াতাড়ি ছেলের হাত ধরে চলে গেল দীপমালা। বিকেলে যখন দীপমালা নিজের কাজে ব্যস্ত ছিল, অনির্ণেয় অফিসের ভিতরে একটা বেঞ্চে বসে বইয়ের পাতা উল্টে রূপকথার জগতে ডুব দিয়েছে। দুলাল আর মনসুর পৌঁছল দীপমালার অফিসে। মনসুর নিজের প্রাপ্য টাকা বুঝে নিয়ে চলে গেলেও, দুলাল বাইরে বসে রইল। অফিস ঘরে তালা দিয়ে কয়েকটা ফাইল সঙ্গে নিয়ে অনির হাত ধরে বেরোল দীপমালা। দুলাল উঠে দাঁড়িয়ে জোড়হাতে বলল,

-দিদিমণি?
-হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন? আপনি তখন কী যেন বলছিলেন!
-আমার বউয়ের জন্য এই ইস্কুলবাড়িতে যদি কোন কাজ থাকে.... ছোট কাজ হলেও চলবে।
-আপনি কী কাজ করেন? কোথায় থাকেন?
-আমার বাড়ি মোছলমান পাড়ার কাছেই। মনসুরের তিনটে বাড়ি পর। আমি আগে চটকলে কাজ করতাম দিদিমণি। ওখেনে কাজের সময় হাতে চোট পেয়েছিলাম। তারপর মালিক কিছু টাকা দে বসিয়ে দিল। পরে রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ে হয়ে কাজ করেছিলাম কয়েক মাস। কিন্তু সিমেন্ট বালির বস্তা চাগাতে পারি নে। হাতটায় কেমন যেন জোর পাই না। ইঁট বইতে গেলে ইঁট পড়ে যায়। এখন মোছলমান পাড়ার মোড়ে যে বাজার আছে, ওখেনে ফল পাকুড় বেচি। আর যদি কেউ এদিক ওদিক কাজে ডাকে, ছুটে যাই। বউটা বাবুর বাড়ি কাজ করত। কিন্তু বাচ্চা হওয়ার পর কাজগুলো ছেড়ে যায়। আমার সংসার চলে না দিদিমণি। চারটে ছেলেমেয়ে। একটা বুড়ি পিসি আছে। পেটপুরে সবকটারে দুটো ভাত দিতে পারি না। আপনার ইস্কুলে যদি...
-আমি একটা বিল্ডিং করছি। ঐদিকের মাঠে। যেটা আপনারা পরিষ্কার করছেন। এখন প্রি প্রাইমারি সেকশন থেকে টেন পর্যন্ত আছে। এবার একবারে টুয়েলভ পর্যন্ত করছি। দেখুন দাদা, আপনার নামটা কী?
-দুলাল দিদিমণি! ব্রজদুলাল সর্দার।
-দেখুন দুলাল দা...
-আমাকে আপনি বলবেন না দিদিমণি। আপনি কত বড় মানুষ, আমি খুব ছোট...
-শিক্ষাগত যোগ্যতা দিয়ে বড় ছোট বিচার করা যায় না। আপনিও খেটে খাচ্ছেন। আমিও। যার যার জীবনযুদ্ধে সেই যোদ্ধা। যাইহোক, আপনি চাইছেন না যখন ঠিক আছে। দেখো দুলাল দা, আমি সারাদিন ভীষণ ব্যস্ত থাকি। এ আমার ছেলে, অনির্ণেয়। আমি ওকেও ঠিকমতো টাইম দিতে পারি না। কখন ওর স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, এখানেই আমার অফিসে ইউনিফর্ম পরে বসে আছে। আমি বেরোব, তারপর আমার সঙ্গে ও বাড়ি যাবে। আমার কাজের লোকটা প্রায়ই কামাই করে। ছেলের জন্য ওকে ভরসা করতে পারি না। তুমি মনসুরের সঙ্গে এসেছ, তাই তোমাকে বা তোমার পরিবারকে বিশ্বাস করতে পারি। এই পুরনো বিল্ডিং হওয়ার আগে থেকে আমি ওকে চিনি। মনসুরের বাবা আমার বাবার পেশেন্ট ছিলেন। তা তোমার বউ কী আমার ছেলেকে একটু দেখাশোনা করতে পারবে? এই ধরো, স্কুল থেকে ফেরার পর অনি একটু ফ্রেশ হলে ওকে কিছু খেতে দেওয়া, আমি বাড়ি ফেরার পর ভীষণ টায়ার্ড হয়ে থাকি। তাই ওর রাতের খাবারটা করে রাখা। আর যদি সকালের রান্নাটাও একটু করে দিত, আমি আর একটু তাড়াতাড়ি স্কুলে আসতে পারতাম। স্কুলের পাশে ওটাই আমার বাড়ি। তোমার বউ রাজি থাকলে আজ সন্ধেবেলা তাকে নিয়ে তুমি আমার বাড়ি এসো। সে কাজকর্ম সব দেখেশুনে বুঝে নেবে। টাকা পয়সা নিয়েও কথা বলে যাক। তারপর কাল থেকেই না হয় শুরু করুক। এই ভাঙা মাসটার জন্য আমি অর্ধেক টাকাই দেব।

দুর্বলদেহী দুলালের একটু আগেও খিদের জন্য পেটটা মোচড় দিয়ে উঠছিল। এখন ও খিদে তৃষ্ণা সব ভুলে গেল। আনন্দে ওর বুকের মধ্যে শত শত প্রজাপতি উড়তে শুরু করল। কিন্তু ও বাক্যহারা তখন হয়ে গেল, যখন দীপমালা দু'পা এগিয়ে গিয়েও আবার পিছিয়ে এসে বলল,

-দুলাল দা, নতুন বিল্ডিংয়ের ওদিকে আর একটা এক্সিট হবে। ছুটির সময় একটা গেটের ওপর এত চাপ দেওয়া যাবে না। তোমার হাতে তেমন জোর নেই বলছ, কাজকর্ম করতে পারো না! নতুন গেটে দারোয়ানের কাজটা করতে পারবে তো? ইউনিফর্ম স্কুল থেকেই দেওয়া হবে। যদিও ওটাতে একটু টাইম লাগবে। নতুন বিল্ডিং হবে, তারপর...

পদ্মকে এতগুলো সুসংবাদ দেওয়ার সময় বারংবার দু'চোখ মুছতে শুরু করল দুলাল। ছোট মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,

-আমার ছোট মা বড় লোককি পদ্ম। এবার আমাদের দিন ফিরবে। সবাই ভরপেট ভাত খাব। গরম রুটি খাব। সব আমার এই ছোট মায়ের জন্য! ওর জন্যই আমার কপাল খুলল! মন করে এবার টালির চালটা খুলে ঘরটা এলবেসটার দে ছাইতে পারব। দু'জন মিলে খুব খাটব পদ্ম। সংসারটা আবার নতুন করে শুরু করব।

সুরঞ্জনার কপালে স্নেহচুম্বন এঁকে দিল দুলাল।

বছর ঘোরে। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে তৈরি হল দীপমালার নতুন স্কুলবাড়ি। দারোয়ানের পোশাক পরিহিত দুলাল স্কুল ছুটির শেষে অনির্ণেয়কে পৌঁছে দিল তার বাড়িতে। পদ্ম এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলল,

-এসো এসো।

অনির্ণেয়র কাঁধ থেকে ভারী স্কুলব্যাগটা খুলে নিল পদ্ম। ঘরে ঢুকেই একটা বাচ্চা মেয়েকে তুরতুর করে ঘুরে বেড়াতে দেখে হতবাক অনি। ও পদ্মকে জিজ্ঞাসা করল,

-এ কে আন্টি?
-ও আমার মেয়ে অনি। রঞ্জা। কাল রাত থেকে মেয়েটার খুব জ্বর গো। আজ কাজে বেরোনোর সময় আমারে ছাড়তেই চাইছিল না। খুব কাঁদছিল, ওর ঠাকমার শরীলটাও ভালো না। আমি ঘরে না থাকলে কোথায় কোথায় কার ঘরে জ্বর গায়ে ঘুরে বেড়াবে! তাই আজ ওরে সঙ্গে নে এলাম।
-ওর জ্বর তো এভাবে খালি পায়ে মেঝেতে হাঁটছে কেন? ঠান্ডা লেগে আবার জ্বর এসে যাবে তো! জুতো ছাড়া মেঝেতে পা রাখতে মা আমাকে বারণ করে। দাঁড়াও, ঘর থেকে আমার জুতোটা নিয়ে আসি। ওটা পরে ঘুরুক।

অনির্ণেয় একজোড়া বড় বড় জুতো এনে সুরঞ্জনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, ওর পায়ের সামনে রাখল। ওটাতে ছোট দুটো পা গলিয়ে সুরঞ্জনা অনির্ণেয়র গলায় বাঁধা টাইটা একটু টেনে দেখল। অনির্ণেয় হেসে ফেলল। একটু আগেই বোধহয় কাঁদছিল রঞ্জা। দু'গালে কাজল লেপ্টে রয়েছে। কপালে বড় একটা কাজলের টিপ ঘেঁটে গেছে। হাড়গিলে চেহারা! গলায় কালো রংয়ের সুতোয় বাঁধা রয়েছে একটা তামার মাদুলি। বড় বড় দুটো চোখে এখনো জল টলটল করছে। অনি হেসে রঞ্জার চোখ মুছিয়ে দু'গাল টিপে আদর করে বলল,

-তুমি খুব সুইট! কাঁদবে না একদম। এটা... এটা টাই রঞ্জা। তুমি পরবে? চাই এটা? আচ্ছা তুমি যখন স্কুলে যাবে, তখন তোমাকেও তো টাই পরতে হবে। তখন আমি আমার মাকে বলব। মা তোমাকে আমার মতো টাই কিনে দেবে!

অনির্ণেয়র টাইটা টেনে মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে রাখল রঞ্জা। একমনে ঝুলতে থাকা ওই বস্তুটা দেখতে লাগল সে। অনি বলল,

-এটাই চাই? এক্ষুণি? আচ্ছা দাঁড়াও!

নিজের গলা থেকে টাইটা খুলে সুরঞ্জনার গলায় পরিয়ে দিল অনি। সঙ্গে সঙ্গে ওটার স্বাদ গ্রহণের জন্য মুখের ভিতর চালান করে মনের সুখে চিবোতে শুরু করল রঞ্জা। পদ্ম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে অনির খাবারটা টেবিলে রেখে চিৎকার করে উঠল,

-ওরে কাল অনিদাদার স্কুল আছে রে মেয়ে। মুখ থেকে ওটা বের কর। কেচে শুকিয়ে দিই আমি। যা পাচ্ছে, তাই নিয়ে মুখে দিচ্ছে! উফ!

টাই নিয়ে মা-মেয়েতে রীতিমতো দড়ি টানাটানির খেলা শুরু হয়ে গেল। অনিদাদার নিজের গলা থেকে খুলে দেওয়া প্রথম উপহারটা হাত থেকে কেড়ে নিতে গেলেই, পরিত্রাহি চিৎকার জুড়ে দেয় রঞ্জা। খেতে বসে এই দৃশ্য দেখে অনির্ণেয় হেসেই অস্থির। শেষ পর্যন্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে সুরঞ্জনাকে কোলে তুলে নিল অনির্ণেয়।

***********

(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট