সপ্তপর্ণী
সাথী দাস
প্রথম খণ্ড
তৃতীয় পর্ব
-আমাদের রাজপরিবারেই এক পূর্বপুরুষ ছিলেন,যার নাম ত্রিদিবাচার্য।সেই রাজা ছিলেন নিঃসন্তান।অধিক নারীর সঙ্গদোষে দুষ্ট,একাধিক বিবাহ,প্রজার ওপর অকথ্য অত্যাচার,আপন রাজ্যের রমণীদের অসম্মান,অকারণ মৃগয়ার নামে মায়াকাননের লুপ্তপ্রায় বন্যজন্তুর প্রাণ হরণ,কর আদায়ের অজুহাতে প্রজার ওপর নির্মম অত্যাচার ও রক্তক্ষরণ,এইসব কারণ ব্যতীত,অতিরিক্ত ভোগবিলাসে রাজকোষ প্রায় শূন্য হতে বসেছিলো।অত্যাচারিত রাজার কারণে ভীত হয়ে,বিনিদ্র রজনী অতিবাহিত করতেন নগরের প্রজাবৃন্দ।মোহরকুঞ্জ যখন একাধিক বহিরাগত শত্রু কবলিত,তখন সেই মদ্যপ ভোগবিলাসী রাজা রাজ্যপাট ত্যাগ করে হঠাৎই হারিয়ে যান মায়াকাননের অভ্যন্তরে।তার এমন অকস্মাৎ অন্তর্ধানে রানিরা বিশেষ বিচলিত হননি।পূর্বে একাধিকবার তার এমন হঠকারি সিদ্ধান্তে রাজপরিবার ও সমগ্র রাজসভা অত্যন্ত বিরক্ত।কিছুকালের মধ্যে বা এক পক্ষকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই,আপন আস্তানায় ফিরে আসতেন উনি।তবে মোহরকুঞ্জের পতন শুরু হলো সেই সময় হতে,যখন প্রায় দুই পক্ষকাল সময় অপেক্ষার পরও দেখা মিললো না ত্রিদিবাচার্যের।অন্বেষণ শুরু হলো দিকে-দিকে.....
-কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন উনি?
-উনি হারিয়ে যাননি পর্ণা।উনি ফিরতে গিয়েছিলেন,জীবনের পথে।এক নারীসঙ্গ ওই নিঃসন্তান রাজাকে জীবনমুখী করেছিলো।
-ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ জানতে মন বড়ই ব্যাকুল মা!
-নিজেকে অত্যন্ত ঘৃণ্য ও রাজ সিংহাসনের অযোগ্য মনে হওয়ার কারণে,মায়াকাননের অনাবিষ্কৃত ও দুর্গমতম দিকের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছিলেন তিনি।হয়তো অস্থির মস্তিষ্কে পরিত্যাগ করতে চেয়েছিলেন রাজসংসার ও রাজ্যপাট।তার মানসিক অবস্থার সঠিক বর্ণনা এই ক্ষণে আর সম্ভব নয়।তবে লোকমুখে প্রচারিত,সন্তানহীনতার শোকে বিদ্ধ ছিলেন তিনি।সেই সময় অজানা পথ ধরে তিনি পৌঁছেছিলেন এক যাযাবর জাতির কাছে,সাহচর্য পেয়েছিলেন সেই নারীর....
তমসাবৃত মায়াকাননের পানে দৃষ্টিপাত করলেন নলিনীদেবী।সপ্তপর্ণী বুঝলেন,অভিশপ্ত অতীতের প্রতিটি শিকড় প্রোথিত রয়েছে মায়াকাননের অন্তরেই।ওই নিষিদ্ধ অরণ্যে পাড়ি দেওয়ার পর্ণার যে অদম্য ইচ্ছা,তা আরও সহস্রগুণ বৃদ্ধি পেলো।বিভোর হয়ে রাজকুমারী পর্ণা আত্মস্থ করতে লাগলেন,মায়ের মুখনিঃসৃত প্রতিটি শব্দ....
দীর্ঘপথ অশ্বারোহণের পরিশ্রমে অতিশয় ক্লান্ত মোহরকুঞ্জের রাজা ত্রিদিবাচার্য।গত কয়েক দিবসকাল রাজা অতিক্রম করেছেন গাছের সুমিষ্ট ফলাহার ও ঝর্ণা সংলগ্ন শান্ত দীঘির শীতল জলের দ্বারা।কিন্তু আজ দ্বিপহরের সূর্যতাপ স্তিমিত হয়ে,সূর্যদেব পশ্চিম আকাশে যাত্রা করলেও,একটিও জলাশয়ের দেখা মিললো না।সঙ্গের সামান্য ফলমূল দ্বারা আহারাদি সম্ভব।কিন্তু তৃষ্ণা নিবারণ হেতু জলের আশায় ইতস্ততভাবে মায়াকাননে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন তৃষ্ণার্ত ত্রিদিব।নিবিড় বনানীর যতটুকু অংশ দৃষ্টিপথে ধরা পড়ে,তার সর্বত্রই অজানা সুবিশাল বনস্পতির হেঁয়ালি!ক্ষুধাতুর অবস্থায় এই হেঁয়ালির সমাধান বর্তমানে তার পক্ষে অসম্ভব।ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় কাতর রাজা জলাশয়ের সন্ধানে প্রবেশ করলেন গভীর জঙ্গলে।কিন্তু ভাগ্য বিরূপ।একমাত্র সঙ্গী বৈশ্বানর তখন খাদ্যের অভাবে অবসন্ন।আরোহীকে পৃষ্ঠদেশে বহন করে,আর অগ্রসর হতে চাইলো না অশ্ব।ঘোড়ার পৃষ্ঠদেশ হতে অবতরণপূর্বক,লাগাম ধরে উনি অগ্রসর হতে লাগলেন অজানার উদ্দেশ্যে।সূর্যদেবের বিদায়লগ্নে
সমগ্র মহাশূন্য জুড়ে আধিপত্য বিস্তার করলেন উজ্জ্বল নিশাপতি।সময় গড়িয়ে প্রায় মধ্যরাত অতিক্রান্ত।তা সত্ত্বেও রাত্রি যাপনের উপযুক্ত আশ্রয়স্থল অন্বেষণে ব্যর্থ হলেন ত্রিদিবাচার্য।বন্য জন্তুর আক্রমণ হতে আত্মরক্ষার্থে অগ্নিকুন্ড সম্মুখে তরবারি হস্তে প্রহর গুনতে লাগলেন রাজা।নিদ্রাদেবী দুটি ক্লান্ত চক্ষুর ওপর সেই কালরাত্রে বিশেষ কৃপাদৃষ্টি প্রদান করলেন।অদূরেই জ্বলছে কয়েক জোড়া নির্দয় নেত্র।ক্ষুধার্ত শ্বাপদের আক্রমণ হতে আপন অশ্বকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর রাজা উন্মাদের মতো তরবারি চালিয়ে বৃথা আস্ফালন করে চললেন।অগ্নিকুণ্ডের অগ্নি কিঞ্চিৎ স্তিমিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রগাঢ় হতেই,সহসা আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে ধূর্ত শ্বাপদের দল।সমস্ত নিরালোক রাত্রি বলপূর্বক দুই চক্ষু সজাগ রাখার পরও,সূর্যোদয়ের কিছু পূর্বে অত্যন্তই ক্লান্ত হয়ে পড়লেন ত্রিদিব।কন্ঠ হলো শুষ্ক।ক্ষীণতর কন্ঠ থেকে নির্গত হলো অসংলগ্ন কিছু কাতর প্রলাপ বার্তা।তৃষ্ণায় অবসন্ন দেহে সামান্য জলের অভাবে,রাজার প্রায় জ্ঞান হারানোর উপক্রম হলো।শ্বাপদের ভয়ে ভীত অশ্বের তীব্র আর্তনাদ রাজার কর্ণকুহরে আর প্রবেশ করলো না।অগ্নিবলয় নিভে আসতেই অত্যুৎসাহী হিংস্র জন্তুসকল অগ্রসর হতে শুরু করলো অশ্ব ও রাজার অভিমুখে।জ্ঞান হারানোর পূর্ব মুহুর্তে দিনের প্রথম মৃদু আলোয় ত্রিদিব দেখলেন,অদ্ভুতদর্শন কয়েকজন দু-পেয়ে প্রাণী এসে হাজির হলো ওই হিংস্র শ্বাপদের সম্মুখে।এক নারীর ছায়াশরীর দুই হস্তের নির্মম ছুরিকাঘাতে,অতর্কিতে হত্যা করলো এক শ্বাপদকে।তার পৃষ্ঠদেশের শৈল্পিক উল্কির প্রতি ঘোলাটে দৃষ্টিপাত করলেন ত্রিদিব।অতঃপর অস্ত্রের ধাতব শব্দ ও ভীত জন্তুর আর্তনাদ সঠিকরূপে হৃদয়ঙ্গম করার পূর্বেই,জ্ঞান হারালেন মোহরকুঞ্জের রাজা....
দুটি চক্ষু উন্মোচনের পর ত্রিদিব নিজেকে আবিষ্কার করলেন অত্যন্ত সাধারণ এক পর্ণশয্যায়।চক্ষু মেলার পরই ক্ষুধার জ্বালা অসহ্য হয়ে উঠলো।ঘরের দক্ষিণপ্রান্তে একটি কাঠের চৌকির ওপর সামান্য ফলমূল ও পানীয় জল প্রস্তুত রয়েছে।দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য রাজা সর্বাগ্রে আপন উদরপূর্তির কার্যে মনোনিবেশ করলেন।খাদ্যদ্রব্য গ্রহণকালে জনমনিষ্যির কোলাহল তার কানে পৌঁছনো মাত্রই,সামান্য জল পান করে দুর্বল দেহে পর্ণকুটির হতে বাইরে বেরোলেন রাজা।
যারপরনাই হতবাক হলেন তিনি।সভ্যসমাজের বাইরে লোকচক্ষুর অন্তরালে এমন গহীন অরণ্যে মনুষ্যবসতি!এ তার কল্পনারও অতীত।প্রতিটি পর্ণকুটিরের চতুর্দিকে যত্নের চিহ্ন সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত।অদূরে একটি বৃক্ষের সঙ্গে সখ্যতা লাভ করে,সেই বৃক্ষছায়ায় স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে মনের উল্লাসে লেজ নেড়ে আপন আহার্য ও জল গ্রহণে ব্যস্ত বৈশ্বানর।কুটিরের বাইরে বেরিয়ে আসতেই,কয়েকজন খর্বকায় নারী অগ্রসর হলেন তার দিকে।চতুর্দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভীত হলেন ত্রিদিব।শ্বাপদের হাত থেকে উদ্ধারকারী এই খর্বকায় নারীসকল কি তবে কোনো মানুষখেকো অসভ্য জাতি!এদের দ্বারা কি রাজার ক্ষতিসাধন সম্ভব!সামান্য কয়েকজন স্ত্রীলোক তার কিই বা ক্ষতি করতে পারে!তরবারির এক-একটি আঘাতে সকলকে একসঙ্গে হত্যা করতে ত্রিদিব সক্ষম।স্থিরভাবে শীতল মস্তিষ্কে ত্রিদিব বললেন,
-আমি আপনাদের রাজা,রানি বা দলপতির সঙ্গে বার্তালাপে আগ্রহী।আমি এই মোহরকুঞ্জের রাজা ত্রিদিবাচার্য।জঙ্গলে পথ হারিয়ে পূর্ব রাতে আমাকে ওইরূপ বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়!দলপতি বা নেত্রীকে এ সংবাদ প্রেরণের আর্জি জানাই,যে আমি সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় এই গোষ্ঠী-দলপতির সাক্ষাৎপ্রার্থী।তোমরা আমার উদ্ধারকারী।সেই বিষয় অবগত হয়েই,আমার দ্বারা তোমাদের কারোর ক্ষতিসাধন সম্ভব নয়।আমার মুখনিঃসৃত এ বাক্য নিশ্চিতভাবেই বিশ্বাসযোগ্য।
বিস্ময়ের চাদরে আবৃত মুখাবয়বগুলির মধ্যে,রাজার কথাগুলি শেষ হওয়ার পরেও,কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হলো না।ত্রিদিব হতাশ হয়ে বুঝলেন,এরা বুঝি সভ্য সমাজের ভাষা বুঝতে সমর্থ নয়।কিন্তু সেই মুহূর্তেই তার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করতে,একটি সুসজ্জিত কুটির হতে বেরিয়ে এলেন এক তন্বী রমণী।তার সঙ্গে কয়েকজন পুরুষও।বিস্ফারিত নেত্রে ত্রিদিব দেখলেন,যুবক হতে বৃদ্ধ,হাতেগোনা প্রায় প্রত্যেক পুরুষদেহই বহন করছে অঙ্গহানির সুস্পষ্ট চিহ্ন।শিউরে উঠলেন ত্রিদিব।ওই কৃষ্ণকায় নারীর উপস্থিতিতে,
সমবেত জমায়েতের মধ্যে বেশ কিছুটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো।ত্রিদিব বুঝলেন,এই নারীই বুঝি অসভ্য গোষ্ঠীর নেত্রী।অদ্ভুতদর্শন ওই নারীর পরনে লজ্জা নিবারণ হেতু সামান্যই বস্ত্র।কপালে রক্ততিলক,দৃষ্টি ইষৎ ক্রুর!মাথায় সুবৃহৎ জটা।সেই নারী ত্রিদিবের সম্মুখে এসে দাঁড়ালে,ত্রিদিব অবনত মস্তকে নৃপতিসুলভ সৌজন্য জানালেন তাকে।জমায়েতের মধ্য হতে এক নারীকণ্ঠ স্পষ্ট উচ্চারণ ও দীপ্তকণ্ঠে বলে উঠলো,
-ডাকিনী মা!এই সেই পুরুষ।পূর্বরাতের আগন্তুক!এনার দাবী,ইনি মোহরকুঞ্জের রাজা!
বিস্ময়ের এক একটি পর্যায় অতিক্রম করছেন ত্রিদিব।এরা সভ্য সমাজের ভাষা বুঝতে ও বলতে সক্ষম।বুঝি দলনেত্রীর উপস্থিতি বা অনুমতি ব্যতীত,এরা কথা বলতে অনিচ্ছুক।ত্রিদিব দৃষ্টি ফেরালেন ওই ডাকিনী মায়ের দিকে।অপেক্ষা করতে লাগলেন,তার পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্য....
-তোমার কথার স্বপক্ষে প্রমাণ দিতে হবে।
অদ্ভুত স্বরে সেই ডাকিনী মা বললেন।আপন দুই ভ্রু-যুগলের মাঝে রাজটিকার দিকে নির্দেশ করে ত্রিদিব বললেন,
-এই রাজটিকাই কি যথেষ্ট নয় মা?!
-ওই রাজটিকার কারণেই তোমার শিরচ্ছেদ করা হয়নি!
-একজন নারীর এতদূর স্পর্ধা!!
-জঙ্গলের এই অংশ বর্তমানে আমাদের অধীনে রাজ্যেশ্বর।যদিও আপনার রাজকীয় মেজাজ আপনার পরিচয় বহন করে,তা সত্ত্বেও....
-আমারই রাজ্যের সীমানায়,এমন দুর্ভেদ্য অরণ্যে কোনো মনুষ্যসৃষ্ট কুটির বা মানুষের বাস চোখে পড়বে,এ আমার কল্পনারও অতীত ছিলো।আমার অজান্তে এমন বাসস্থানের আয়োজন কিভাবে সম্ভব?আপনারা কারা!আমার ভাষা বুঝতেও আপনারা সক্ষম!স্বল্প আলাপে আমি এও অবগত,আপনিই এদের দলনেত্রী।তাই আপনার কাছেই এই সকল প্রশ্নের উত্তর আশা করি।কোন রাজ্যের বাসিন্দা আপনারা...
-আমার মনের সংশয় পুরোপুরি কাটেনি।তুমি যে কোনো গুপ্তচর নও,তার প্রমাণ কি?!
-আমি!গুপ্তচর!!আমি রাজা এ রাজ্যের।রাজা ত্রিদিবাচার্য!!রত্নখচিত রাজমুকুট আমারই অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।এ রাজ্যের ভাগ্যবিধাতা আমি!
রাগান্বিত ত্রিদিবের প্রবল হুঙ্কারে স্তব্ধ হয়ে গেলো উপস্থিত জনগণ।বিদ্রুপ ঝরে পড়লো ডাকিনী মায়ের কণ্ঠে,
-ক্ষমতার এমন দম্ভ প্রকৃত রাজাকে শোভা পায় না ক্ষত্রিয়!তা ভাগ্যবিধাতা আপনার জন্য নির্মিত ভগবানের আসন পরিত্যাগ করে,এমন বনবাসে কেন?
-আত্ম-অনুসন্ধানে।রাজসংসার,রাজনীতি,রাজ্যপাট মানসিক শান্তি প্রদানের কারণ হয়ে উঠতে পারছিলো না।সাময়িক বিশ্রামপূর্বক,মনের ভিতর সকল মোহ পরিত্যাগের বাসনা প্রতিপালন করি!
-তোমার দম্ভ হতেই সে বিষয় স্পষ্ট,রাজপরিবারের মোহ ত্যাগ করা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়।আপন সংসারে ফিরে যাও।যেথায় তোমার কর্ম,সেথায় সুখের সন্ধান পাবে তুমি!সন্ন্যাসীর জীবন তোমার জন্য নয়।গৃহে ফিরে যাও!ক্ষুধার্ত-তৃষ্ণার্ত-পীড়িত ও বিপদগ্রস্তকে জীবনদান করাই আমার অনুগামীদের কর্তব্য।তারা পূর্বরাতে তাই করেছে।উদ্ধার করেছে তোমায়।এবার তুমি আপন পথে ফিরে যাও।আমার শিষ্যের পথনির্দেশ তোমাকে এই মায়াকাননের গোলকধাঁধা হতে বাইরে বেরোতে সাহায্য করবে।অতঃপর আশা করি,তুমি কয়েক প্রহরের এই সকল ঘটনা বিস্মৃত হবে।রাজধর্ম পালন করো রাজা!
-যথার্থই।তবে আমার কৌতূহল নিবৃত্ত করতে সমর্থ,এমন কোনো উত্তর এখনও আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি।আমার রাজ্যে বসবাসকারী এই উদ্বাস্তু গোষ্ঠীর সম্পর্কে সকল বিষয় জানতে আমি আগ্রহী।আপনার গুপ্তচর সম্পর্কিত ভীতি জানান দিচ্ছে,আপনারা অজ্ঞাতবাসে রয়েছেন।আমার রাজ্যে এমন অজ্ঞাতবাসের কারণ সম্পর্কে আমি জানতে ইচ্ছুক।কারণ যুক্তিযুক্ত মনে হলে,আমি আপন সামর্থ্যে সসম্মানে প্রতিপালন করবো আপনাদের।নগরে আশ্রয় দেবো।অন্যথায় এ অরণ্য থেকে আপনাদের উৎখাত করবো।পরিত্যাগ করতে হবে এই মায়াকানন।
-উপকারীর প্রতি এই তোমার কৃতজ্ঞতা?
-আমি রাজধর্ম পালনে ব্রতী।
-খানিক পূর্বেই রাজ্যপাট পরিত্যাগের কথা শুনেছিলাম!
মস্তক অবনত হলো ত্রিদিবের।
-লজ্জার বিষয় নয়।তুমি ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন করো রাজা।রাজধর্ম পালনেই তুমি মনের শান্তি পাবে!
-আমার প্রশ্নের উত্তর?এই অরণ্যে আপনাদের আগমনের কারণ...
ওই কুটির হতে এক রমণী এসে অনতিদূরে দাঁড়িয়ে ডাকিনী মাকে যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে বললো,
-আপনার পূজার উপাচার প্রস্তুত মা!আসন গ্রহণ করার সময় উপস্থিত।
ত্রিদিবের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ডাকিনী মা বললেন,
-তুমি আমার স্নেহভাজন পুত্র।স্নানাদি ও আহারাদিপূর্বক বিশ্রাম গ্রহণ করো।আমার সাধনার সময় উপস্থিত।আগামী দুই দিন আমি মহাভৈরবীর যোগসাধনায় ব্যস্ত থাকবো।এ রাজ্য তোমারই।তবে তোমার রাজ্যের এই সামান্য কিছু দুর্ভেদ্য অঞ্চলে বর্তমানে আমার রাজত্ব চলে।আমি অনুরোধ করবো,দিন দুই নিঃসংকোচে আমার আতিথ্য গ্রহণ করো।অতঃপর আমি এই গোষ্ঠীর অতীত সম্পর্কিত সকল বিষয় তোমার সম্মুখে উদঘাটন করবো,এমন কথাই রইলো।মহাভৈরবী তোমার সহায় হোন!
দ্বিরুক্তি করলেন না ত্রিদিব।অসামান্য ভাবে সম্মোহন করার ক্ষমতা রাখেন ডাকিনী মায়ের মুখনিঃসৃত শব্দ।সম্মোহিতের মতো অবনত মস্তকে মাতৃআজ্ঞা পালনে সম্মত হলেন নৃপতি।ডাকিনী মায়ের অনুমতি ব্যতীত আরও একটি বিষয় তীব্রভাবে আকর্ষণ করছে রাজাকে।তার দৃষ্টি তখন বাধা পড়েছে ওই খর্বকায় নারীর দীঘল দুটি চোখে।ডাকিনী মায়ের মতোই ওই নারীর পরনে কঞ্চুলিকা ও কটিদেশে সামান্য বস্ত্র মাত্র।লজ্জা নিবারণের সামান্য কিছু পরিধেয় ব্যতীত,দেহপল্লবের অটুট যৌবন আড়ালের কোনো প্রয়াসই ওই নারীর দেহে পরিলক্ষিত নয়।গ্রীবা,দুই বাহু ও নাভিমূলের কিঞ্চিৎ পার্শ্ববর্তী স্থানে,কটিবস্ত্রের উপর আপন অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে অজস্র উল্কি।শিল্পীর শিল্পকর্ম অপরূপ বটে!তবে তা ম্লান করতে পারেনি নারীদেহের অপরূপ বন্য সৌন্দর্য।নৃপতির পানে চকিত দৃষ্টিপাত করেই,আপন দৃষ্টি অবনত করলো সেই উদ্বাস্তু নারী।ডাকিনী মা বললেন,
-অনতিবিলম্বে আসছি ত্রিযামা!রাজা?
-আমি আপনার আমন্ত্রণ সসম্মানে গ্রহণ করলাম মা!
ত্রিদিবের মস্তক স্পর্শ করে আপন পর্ণকুটিরে প্রবেশ করলেন ডাকিনী মা।মায়ের আশীর্বাদ গ্রহণপূর্বক জমায়েত কিছুটা শিথিল হলো।সেই নারী এগোলেন অদূরেই বিশ্রামরত কয়েকটি শান্ত অশ্বতর অভিমুখে।মন্ত্রমুগ্ধের মতো ত্রিদিব অনুসরণ করলেন সেই নারীকে....
-ত্রিযামা?তোমার নাম?
-মহারাজ!
-তুমি জানো আমি কে?
-সকলেই জানেন।আমিও এই গোষ্ঠীর অন্তর্গত।আমার অজানা কিছুই নয়।
-তোমাদের গোষ্ঠীর যে উদ্ধারকারী দল পূর্বরাতে আমাকে ও বৈশ্বানরকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত হতে উদ্ধার করেছে,আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় অবসন্ন দেহের ক্ষমতা,অধিক ছিলো না।বিপদকালে আমার বাহ্যজ্ঞান বিলুপ্ত হয়েছিলো।আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম বুঝিবা।না জানি কত রক্তপাতের মধ্য দিয়ে,তারা আমার জীবন রক্ষা করেছেন!!
-অধিক নয়।এই সামান্যই!
ত্রিযামা দক্ষিণ হস্ত সম্মুখভাগে প্রসারিত করার পর ত্রিদিব হতবাক দৃষ্টিতে দেখলেন,উল্কির কারুকার্যের আড়ালে,কোমল নারীদেহের একাংশ শ্বাপদের আঁচড়ে রক্তাক্ত।কিছু বনজ লতাপাতা নিঃসৃত তরল ওই ক্ষতস্থানে দেওয়ায়,রক্তপাত বন্ধ।তবে ক্ষত যে সদ্যই তা সুস্পষ্ট।স্বল্পবসনা নারীর মধ্যে লজ্জা নামক অনুভূতির কিঞ্চিৎ অভাব রয়েছে।নিঃসংকোচে ত্রিযামা দাঁড়িয়ে রইলেন রাজার সম্মুখে।
-বড় গভীর ক্ষত!তুমি ছিলে গতকাল?
-না আমি একাকী নই।সঙ্গী ছিলো জনাকয়েক।তবে প্রথম আঘাতটা আমার ওপরেই হানে।বর্শার ফলা গেঁথেছি তার হৃদয়ে।ওই যে!
ত্রিদিব দেখলেন,মৃতদেহ হতে সদ্য পৃথক করা একটি চামড়া কুটিরের বেড়ার আড়ালে রৌদ্রে শায়িত।
-তোমার ভয় করলো না!!
রমণী অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
-ভয়!আমার?
-কেন?
অশ্বতরগুলিকে পর্যাপ্ত খাদ্যজল সরবরাহ করে ত্রিযামা চাইলেন দূরে অরণ্যের পানে।ত্রিদিব ও ত্রিযামার মধ্যে বিরাজ করছে কেবল অপার নৈঃশব্দ।দ্রুত পদচারণাপূর্বক সেই স্থান পরিত্যাগে সচেষ্ট হলেন ত্রিযামা।তবে নিস্তার পেলেন না ত্রিদিবের দৃষ্টি হতে।
-কোথায় চললে তুমি?
-মহারাজ!কেন অনুসরণ করছেন আমায়?
-তুমি ভীত ত্রিযামা!
-না!
-মিথ্যা!!
ত্রিদিব স্পষ্টতই লক্ষ্য করেছেন,শঙ্কার প্রসঙ্গ উত্থাপনের মুহূর্তেই ত্রিযামার ওই দুটি চক্ষু প্রাণভয়ে কাতর হরিণীর ন্যায় শঙ্কিত হয়ে ওঠে।হৃদয়স্থলে তীব্র ক্লেশ অনুভব করেন ত্রিদিব।ত্রিযামার স্তব্ধতার মাঝেই তার সম্মুখে গিয়ে বলেন,
-কি কারণে তোমার গোষ্ঠী বনবাসী?কি তোমাদের অতীত?তোমার অতীত কি ত্রিযামা?!এ অপেক্ষা বড় দীর্ঘ।প্রবল কৌতূহলের কারণে আমি আত্ম সংবরণ করতে অক্ষম।আমি জানতে আগ্রহী ত্রিযামা!তোমার অতীত!কিসের শঙ্কা তোমার ওই দুটি চোখে?অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে প্রতি মুহূর্তে হিংস্র প্রাণীর সঙ্গে যুদ্ধ করে কেন বেঁচে থাকা?কেন এই অজ্ঞাতবাস?
-সভ্য সমাজের হিংস্রতার তুলনায়,বনের এই পশুপাখি অধিক হিংস্র নয় রাজা।এ সংগ্রাম তুলনামূলক সম্মানের।
-ত্রিযামা!বলো আমায়!আমি তোমার সকল কষ্ট,সকল ব্যাধি দূর করবো!
অতঃপর মনুষ্যবসতির উপযুক্ত ওই গোষ্ঠীর অন্তর্গত,মায়াকাননের স্বল্প পরিসরের ভূমিতে পদচারণাপূর্বক ত্রিযামার নিকট হতে এই গোষ্ঠী এবং ওই নারীর দুর্ভাগ্যজনিত অতীতের সমস্ত বিবরণ জানতে পারলেন ত্রিদিব।ত্রিযামার আপন রাজ্যের রাজা দয়াপরবশত সামান্য ভূমি প্রদান করেন এই যাযাবর গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষকে।এই গোষ্ঠী বৃহৎ রাজ্যের রাজনীতি কূটনীতি বুঝতে অক্ষম।প্রতিপালক রাজার কৃপায় সামান্য কৃষিকাজ ও গবাদি পশুর প্রতিপালনে নিশ্চিন্তে জীবন ও জীবিকা অতিবাহিত হতো গোষ্ঠীর সদস্যদের।তবে আপন রাজ্যকে বহিরাগত শত্রুর দৃষ্টি হতে প্রতিরক্ষায় মগ্ন প্রজাবৎসল রাজাকে,তার আপন ভ্রাতা কুটিল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করেন।ওই নির্মম হত্যাকান্ডের পরই নতুন রাজা প্রজার উপর শুরু করেন নির্মম অত্যাচার।রাজধানী,নগর,এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও কোনো রমণী রাজপথে দ্বিধাহীনভাবে পদব্রজে বেরোতে অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে পড়তেন।কেবলমাত্র বারবনিতা নয়,একাধিক গৃহবধূ,অবিবাহিতা রমণী ও কুমারী বালিকাকেও আপন ইচ্ছের বিরুদ্ধে শয্যাসঙ্গিনী হতে বাধ্য করেন ওই নৃপতি।যাযাবর গোষ্ঠীর স্ত্রীদেহ হতে নিঃসৃত বন্য সুগন্ধ,রাজাকে মুগ্ধ করে বারংবার।রাজা ক্ষমতায় আসার পর,প্রতি রাতেই ওই গোষ্ঠীর একজন রমণী গৃহহারা হতে শুরু করেন।কোনো নারী আপন সম্মান খুইয়ে আত্মহত্যার পথ অবলম্বন করতেন,আবার কোনো রমণীর অর্ধমৃত বা মৃতদেহ রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে যাওয়া হতো তার নির্দিষ্ট কুটির সম্মুখে।
ত্রিদিবের পক্ষে দীর্ঘ সময় এ অতীত সহ্য করা অসহনীয় হয়ে উঠছিলো।সেই একই প্রকার চরিত্রদোষে দুষ্ট সে নিজেও।মদিরা সহযোগে প্রতিরাতে কোনো ত্রয়োদশী বা ষোড়শীর দেহ নিঃসৃত সৌরভে মগ্ন থাকতে ভালোবাসতেন নেশাতুর ত্রিদিব।তবে বর্তমানে এইসকল আসক্তি তার মনে বড় আত্মগ্লানির জন্ম দেয়।সেই হেতু সকল পিছুটান পরিত্যাগ করতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন রাজা।ত্রিযামার মুখনিঃসৃত বাক্য অনুধাবন করে ত্রিদিব জানতে পারলেন,একমাত্র ত্রিযামাই সেই নারী,যে ওই কামুক রাজাকে প্রত্যাখানের স্পর্ধা প্রদর্শন করেছিলেন।সৈন্যবাহিনী দ্বারা বলপূর্বক রাজার শয়নকক্ষে প্রবেশের পরই,তার কাছে ওই রাজার জঙ্ঘায় উপবিষ্ট হওয়ার অশালীন প্রস্তাব আসে।ত্রিযামা কর্তৃক তীব্রভাবে ঘৃণিত ওই রাজা বলপূর্বক সঙ্গম স্থাপন করেন ওর কুমারী নারীদেহের সঙ্গে।দেহযন্ত্রণায় কাতর ত্রিযামা যে মুহূর্তে মরণ চিৎকার দ্বারা সাহায্যপ্রার্থী,সেই মুহূর্তে তার কুমারীত্ব ছিন্নভিন্ন করে আপন কামজ্বালা পূরণ করতে লিপ্ত ওই রাজা।অভিশপ্ত রাত্রি প্রভাত হলে,ত্রিযামার অচৈতন্য দেহটা ঘোড়ার পৃষ্ঠদেশ হতে তারই কুটিরের সম্মুখে ছুঁড়ে ফেলে যায় রাজার সৈন্য।জনরোষ সেই সেনাকে বাধা দেওয়ায়,অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় গোষ্ঠীর কয়েকটি গৃহ।রাজ্যের চরম অরাজক অবস্থায়,সকল রাজ্যবাসী একত্রে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।তবে রাজ্যে থেকে রাজার বিরুদ্ধাচরণ করে জয়লাভ সম্ভব ছিলো না।সেনাবাহিনীর ক্রমাগত অত্যাচারে রাজ্যের এবং ঐ যাযাবর গোষ্ঠীর সহস্রাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়ে,ধনসম্পত্তি খুইয়ে ছড়িয়ে পড়ে দিকে-দিকে।তীব্র অত্যাচারে গৃহহারা বিদ্রোহী মানুষগুলো প্রতিবাদে সোচ্চার হলে জোটে চরমতম শারীরিক অত্যাচার।ত্রিযামার সঙ্গে কয়েকটি পর্ণকুটিরের সম্মুখে উপনীত হয়ে ত্রিদিবাচার্য দেখলেন,সেই সকল দুঃস্বপ্নের পরিচয় বহন করছেন অঙ্গহারা বহু মানুষ।এই যাযাবর গোষ্ঠীর মাত্র চল্লিশ জন আপন রাজ্য ছেড়ে,বনপথে পলায়নে সমর্থ হয়েছিলো।তবে যাত্রাপথেই অতিরিক্ত রক্তপাতে মৃত্যু হয় মাতৃহারা ত্রিযামার পিতৃদেবের।ক্ষুধায় তৃষ্ণায় অপমৃত্যু হয় জনাকয়েকের।হিংস্র জন্তুর আক্রমণে ক্ষতস্থান বিষিয়ে,অজানা অসুখে ও প্রকৃতির রোষে প্রাণ হারান বেশ কিছু মানুষ।বর্তমানে বাইশ জনের এই ক্ষুদ্র গোষ্ঠী প্রকৃতির সঙ্গে অসম লড়াইতে জয়লাভ করে মায়াকাননের গভীরে আপন আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়।মাত্র ছয়জন অথর্ব,বৃদ্ধ ও অঙ্গহারা পুরুষ ওদের গোষ্ঠীর মধ্যে জীবিত রয়েছেন।অবশিষ্ট সকলেই মহিলা ও শিশু।এমতাবস্থায় জীবনধারণের প্রয়োজনে পুরুষের সহযোগিতা কামনা একপ্রকার অসম্ভব।রাজ্যে থাকাকালীন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গোষ্ঠীর সকলে ডাকিনী মা-কে অত্যন্ত সমীহ করে চলতো।গোষ্ঠীর আরাধ্যা দেবী মহাভৈরবীর আরাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন ডাকিনী মা।নিদ্রাহীন দীর্ঘ রাত্রি পূজার পর তার রক্তচক্ষু অনুধাবন করে গোষ্ঠীর সকল শিশুমনে অত্যন্ত ভীতির সঞ্চার হতো।আপন চঞ্চল শিশুকে সামলে,কিঞ্চিৎ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার অভিপ্রায়ে প্রতি মা আপন শিশুকে ডাকিনীর রক্তচক্ষুর গল্পকথা শোনাত।লোকমুখে প্রচারিত ওই গল্পগাথার ন্যায় রক্তচক্ষুর সাদৃশ্যগত কারণে পরবর্তীতে পূজারিণী মা আপন পরিচয় হারিয়ে ডাকিনী মা সম্বোধনে উন্নীত হয়।গোষ্ঠীর চরম দুরবস্থায় সকলের ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে,ডাকিনী মা আপনার কাঁধে গোষ্ঠী পরিচালনার গুরুদায়িত্ব তুলে নেন।অতঃপর হিংস্র জন্তুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে টিকে থাকার লড়াই,খাদ্য অন্বেষণে যুদ্ধ,প্রকৃতির রোষের সঙ্গে অসম লড়াই...বর্তমানে এইভাবেই ত্রিযামার জীবনের প্রতিটি দিন অতিবাহিত হয়।
-তোমার মনোবেদনা সম্পূর্ণরূপে অনুধাবন করতে আমি অক্ষম ত্রিযামা।আপনজনের বিয়োগব্যথায় কাতর তুমি!
-জানেন মহারাজ!অদূরেই আমার পিতার দেহ অগভীর মাটির তলে শায়িত।অগ্নিদান সম্ভব হয়নি।পাছে অগ্নির কুণ্ডলীপাকানো ধূম্র,অনুসরণকারীদের নিকট আমাদের গুপ্ত ঠিকানা প্রেরণে সহায়তা করে!তবে এ বন্য জীবনে আমার কোনো আক্ষেপ নেই রাজা।এখানে হিংস্র জন্তু ও মানুষের একটিমাত্র সম্পর্ক।খাদ্য ও খাদক।তবে কোনো জন্তুই নারীখাদক নয়।
-ত্রিযামা!যে কারণে তুমি রক্তাক্ত,অপমানিতা,নিগৃহীতা, সম্ভবত প্রহৃতাও....সেই একই দোষে এ রাজ্যের রাজাও দুষ্ট!আমার কারণে এ রাজ্যের বহু নারীর মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত।আমার সঙ্গে এক রাত্রিকাল যাপনের জন্য,আপন সমাজে পরিত্যক্তা বহু নারী।সাময়িক সুখ অনুসন্ধানের পর,তাদের আর কোনো সংবাদ সম্পর্কে আমার কোনো কৌতূহল থাকতো না।তাদের জীবন বুঝি তোমার মতোই বিপন্ন হয়ে থাকবে....
আপন অতীতের স্মৃতিচারণে মগ্ন হয়েছিলো ত্রিযামা।রাজার এমন বাক্যে আচম্বিতে সম্বিৎ ফিরে পেলো সে।রাজার পানে হরিণীর ন্যায় ভীত দৃষ্টিপাত করলো ত্রিযামা।ত্রিদিবের মনে হলো,তীরবিদ্ধ এক ভীত হরিণী,ব্যাধের দিকে চেয়ে আপন প্রাণভিক্ষা চাইছে।অবনত মস্তকে অনুতপ্ত কণ্ঠে ত্রিদিব বললেন,
-চিরদুঃখভোগের অগ্নিতে আপনাকে সমর্পণ করে তুমি আজ স্বর্ণকন্যা ত্রিযামা!যে সকল অপরিচিতা নারী আমার কারণে অপমানিতা,তাদের সকলের মুখমন্ডল আমার অজানা।ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক সকলের কাছে ফেরাও সম্ভব নয়।সেই সকল নারীর ওপর করা অপমানের কারণে আমার হৃদয় আজ বড়ই উদ্বেলিত।মানসিক অস্থিরতার কারণে আমি আমার রাজ্য,সিংহাসন পরিত্যাগ করে,উদ্দেশ্যহীনভাবে এ মায়াকাননের পথে এগোতে শুরু করেছিলাম।সন্ধান শুরু করেছিলাম আপনার মনকে স্থির রাখার প্রভূত উপায়।তবে আমার সেই অন্বেষণ সমাপ্ত হলো তোমাকে পেয়ে....ত্রিযামা?
ভীত সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে রাজার পানে চেয়ে কোমরবন্ধনী হতে সর্বক্ষণের সঙ্গী,আপন সুতীক্ষ্ণ ছুরি মুক্ত করলো ত্রিযামা...
(চলবে)
ছবি : সংগৃহীত