অনুসরণকারী

বৃহস্পতিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

সপ্তপর্ণী (প্রথম খণ্ড) তৃতীয় পর্ব


 


সপ্তপর্ণী


সাথী দাস


প্রথম খণ্ড


তৃতীয় পর্ব





-আমাদের রাজপরিবারেই এক পূর্বপুরুষ ছিলেন,যার নাম ত্রিদিবাচার্য।সেই রাজা ছিলেন নিঃসন্তান।অধিক নারীর সঙ্গদোষে দুষ্ট,একাধিক বিবাহ,প্রজার ওপর অকথ্য অত্যাচার,আপন রাজ্যের রমণীদের অসম্মান,অকারণ মৃগয়ার নামে মায়াকাননের লুপ্তপ্রায় বন্যজন্তুর প্রাণ হরণ,কর আদায়ের অজুহাতে প্রজার ওপর নির্মম অত্যাচার ও রক্তক্ষরণ,এইসব কারণ ব্যতীত,অতিরিক্ত ভোগবিলাসে রাজকোষ প্রায় শূন্য হতে বসেছিলো।অত্যাচারিত রাজার কারণে ভীত হয়ে,বিনিদ্র রজনী অতিবাহিত করতেন নগরের প্রজাবৃন্দ।মোহরকুঞ্জ যখন একাধিক বহিরাগত শত্রু কবলিত,তখন সেই মদ্যপ ভোগবিলাসী রাজা রাজ্যপাট ত্যাগ করে হঠাৎই হারিয়ে যান মায়াকাননের অভ্যন্তরে।তার এমন অকস্মাৎ অন্তর্ধানে রানিরা বিশেষ বিচলিত হননি।পূর্বে একাধিকবার তার এমন হঠকারি সিদ্ধান্তে রাজপরিবার ও সমগ্র রাজসভা অত্যন্ত বিরক্ত।কিছুকালের মধ্যে বা এক পক্ষকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই,আপন আস্তানায় ফিরে আসতেন উনি।তবে মোহরকুঞ্জের পতন শুরু হলো সেই সময় হতে,যখন প্রায় দুই পক্ষকাল সময় অপেক্ষার পরও দেখা মিললো না ত্রিদিবাচার্যের।অন্বেষণ শুরু হলো দিকে-দিকে.....
-কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন উনি?
-উনি হারিয়ে যাননি পর্ণা।উনি ফিরতে গিয়েছিলেন,জীবনের পথে।এক নারীসঙ্গ ওই নিঃসন্তান রাজাকে জীবনমুখী করেছিলো।
-ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ জানতে মন বড়ই ব্যাকুল মা!
-নিজেকে অত্যন্ত ঘৃণ্য ও রাজ সিংহাসনের অযোগ্য মনে হওয়ার কারণে,মায়াকাননের অনাবিষ্কৃত ও দুর্গমতম দিকের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছিলেন তিনি।হয়তো অস্থির মস্তিষ্কে পরিত্যাগ করতে চেয়েছিলেন রাজসংসার ও রাজ্যপাট।তার মানসিক অবস্থার সঠিক বর্ণনা এই ক্ষণে আর সম্ভব নয়।তবে লোকমুখে প্রচারিত,সন্তানহীনতার শোকে বিদ্ধ ছিলেন তিনি।সেই সময় অজানা পথ ধরে তিনি পৌঁছেছিলেন এক যাযাবর জাতির কাছে,সাহচর্য পেয়েছিলেন সেই নারীর....

তমসাবৃত মায়াকাননের পানে দৃষ্টিপাত করলেন নলিনীদেবী।সপ্তপর্ণী বুঝলেন,অভিশপ্ত অতীতের প্রতিটি শিকড় প্রোথিত রয়েছে মায়াকাননের অন্তরেই।ওই নিষিদ্ধ অরণ্যে পাড়ি দেওয়ার পর্ণার যে অদম্য ইচ্ছা,তা আরও সহস্রগুণ বৃদ্ধি পেলো।বিভোর হয়ে রাজকুমারী পর্ণা আত্মস্থ করতে লাগলেন,মায়ের মুখনিঃসৃত প্রতিটি শব্দ....

দীর্ঘপথ অশ্বারোহণের পরিশ্রমে অতিশয় ক্লান্ত মোহরকুঞ্জের রাজা ত্রিদিবাচার্য।গত কয়েক দিবসকাল রাজা অতিক্রম করেছেন গাছের সুমিষ্ট ফলাহার ও ঝর্ণা সংলগ্ন শান্ত দীঘির শীতল জলের দ্বারা।কিন্তু আজ দ্বিপহরের সূর্যতাপ স্তিমিত হয়ে,সূর্যদেব পশ্চিম আকাশে যাত্রা করলেও,একটিও জলাশয়ের দেখা মিললো না।সঙ্গের সামান্য ফলমূল দ্বারা আহারাদি সম্ভব।কিন্তু তৃষ্ণা নিবারণ হেতু জলের আশায় ইতস্ততভাবে মায়াকাননে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন তৃষ্ণার্ত ত্রিদিব।নিবিড় বনানীর যতটুকু অংশ দৃষ্টিপথে ধরা পড়ে,তার সর্বত্রই অজানা সুবিশাল বনস্পতির হেঁয়ালি!ক্ষুধাতুর অবস্থায় এই হেঁয়ালির সমাধান বর্তমানে তার পক্ষে অসম্ভব।ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় কাতর রাজা জলাশয়ের সন্ধানে প্রবেশ করলেন গভীর জঙ্গলে।কিন্তু ভাগ্য বিরূপ।একমাত্র সঙ্গী বৈশ্বানর তখন খাদ্যের অভাবে অবসন্ন।আরোহীকে পৃষ্ঠদেশে বহন করে,আর অগ্রসর হতে চাইলো না অশ্ব।ঘোড়ার পৃষ্ঠদেশ হতে অবতরণপূর্বক,লাগাম ধরে উনি অগ্রসর হতে লাগলেন অজানার উদ্দেশ্যে।সূর্যদেবের বিদায়লগ্নে
সমগ্র মহাশূন্য জুড়ে আধিপত্য বিস্তার করলেন উজ্জ্বল নিশাপতি।সময় গড়িয়ে প্রায় মধ্যরাত অতিক্রান্ত।তা সত্ত্বেও রাত্রি যাপনের উপযুক্ত আশ্রয়স্থল অন্বেষণে ব্যর্থ হলেন ত্রিদিবাচার্য।বন্য জন্তুর আক্রমণ হতে আত্মরক্ষার্থে অগ্নিকুন্ড সম্মুখে তরবারি হস্তে প্রহর গুনতে লাগলেন রাজা।নিদ্রাদেবী দুটি ক্লান্ত চক্ষুর ওপর সেই কালরাত্রে বিশেষ কৃপাদৃষ্টি প্রদান করলেন।অদূরেই জ্বলছে কয়েক জোড়া নির্দয় নেত্র।ক্ষুধার্ত শ্বাপদের আক্রমণ হতে আপন অশ্বকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর রাজা উন্মাদের মতো তরবারি চালিয়ে বৃথা আস্ফালন করে চললেন।অগ্নিকুণ্ডের অগ্নি কিঞ্চিৎ স্তিমিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রগাঢ় হতেই,সহসা আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে ধূর্ত শ্বাপদের দল।সমস্ত নিরালোক রাত্রি বলপূর্বক দুই চক্ষু সজাগ রাখার পরও,সূর্যোদয়ের কিছু পূর্বে অত্যন্তই ক্লান্ত হয়ে পড়লেন ত্রিদিব।কন্ঠ হলো শুষ্ক।ক্ষীণতর কন্ঠ থেকে নির্গত হলো অসংলগ্ন কিছু কাতর প্রলাপ বার্তা।তৃষ্ণায় অবসন্ন দেহে সামান্য জলের অভাবে,রাজার প্রায় জ্ঞান হারানোর উপক্রম হলো।শ্বাপদের ভয়ে ভীত অশ্বের তীব্র আর্তনাদ রাজার কর্ণকুহরে আর প্রবেশ করলো না।অগ্নিবলয় নিভে আসতেই অত্যুৎসাহী হিংস্র জন্তুসকল অগ্রসর হতে শুরু করলো অশ্ব ও রাজার অভিমুখে।জ্ঞান হারানোর পূর্ব মুহুর্তে দিনের প্রথম মৃদু আলোয় ত্রিদিব দেখলেন,অদ্ভুতদর্শন কয়েকজন দু-পেয়ে প্রাণী এসে হাজির হলো ওই হিংস্র শ্বাপদের সম্মুখে।এক নারীর ছায়াশরীর দুই হস্তের নির্মম ছুরিকাঘাতে,অতর্কিতে হত্যা করলো এক শ্বাপদকে।তার পৃষ্ঠদেশের শৈল্পিক উল্কির প্রতি ঘোলাটে দৃষ্টিপাত করলেন ত্রিদিব।অতঃপর অস্ত্রের ধাতব শব্দ ও ভীত জন্তুর আর্তনাদ সঠিকরূপে হৃদয়ঙ্গম করার পূর্বেই,জ্ঞান হারালেন মোহরকুঞ্জের রাজা....

দুটি চক্ষু উন্মোচনের পর ত্রিদিব নিজেকে আবিষ্কার করলেন অত্যন্ত সাধারণ এক পর্ণশয্যায়।চক্ষু মেলার পরই ক্ষুধার জ্বালা অসহ্য হয়ে উঠলো।ঘরের দক্ষিণপ্রান্তে একটি কাঠের চৌকির ওপর সামান্য ফলমূল ও পানীয় জল প্রস্তুত রয়েছে।দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য রাজা সর্বাগ্রে আপন উদরপূর্তির কার্যে মনোনিবেশ করলেন।খাদ্যদ্রব্য গ্রহণকালে জনমনিষ্যির কোলাহল তার কানে পৌঁছনো মাত্রই,সামান্য জল পান করে দুর্বল দেহে পর্ণকুটির হতে বাইরে বেরোলেন রাজা।
যারপরনাই হতবাক হলেন তিনি।সভ্যসমাজের বাইরে লোকচক্ষুর অন্তরালে এমন গহীন অরণ্যে মনুষ্যবসতি!এ তার কল্পনারও অতীত।প্রতিটি পর্ণকুটিরের চতুর্দিকে যত্নের চিহ্ন সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত।অদূরে একটি বৃক্ষের সঙ্গে সখ্যতা লাভ করে,সেই বৃক্ষছায়ায় স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে মনের উল্লাসে লেজ নেড়ে আপন আহার্য ও জল গ্রহণে ব্যস্ত বৈশ্বানর।কুটিরের বাইরে বেরিয়ে আসতেই,কয়েকজন খর্বকায় নারী অগ্রসর হলেন তার দিকে।চতুর্দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভীত হলেন ত্রিদিব।শ্বাপদের হাত থেকে উদ্ধারকারী এই খর্বকায় নারীসকল কি তবে কোনো মানুষখেকো অসভ্য জাতি!এদের দ্বারা কি রাজার ক্ষতিসাধন সম্ভব!সামান্য কয়েকজন স্ত্রীলোক তার কিই বা ক্ষতি করতে পারে!তরবারির এক-একটি আঘাতে সকলকে একসঙ্গে হত্যা করতে ত্রিদিব সক্ষম।স্থিরভাবে শীতল মস্তিষ্কে ত্রিদিব বললেন,

-আমি আপনাদের রাজা,রানি বা দলপতির সঙ্গে বার্তালাপে আগ্রহী।আমি এই মোহরকুঞ্জের রাজা ত্রিদিবাচার্য।জঙ্গলে পথ হারিয়ে পূর্ব রাতে আমাকে ওইরূপ বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়!দলপতি বা নেত্রীকে এ সংবাদ প্রেরণের আর্জি জানাই,যে আমি সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় এই গোষ্ঠী-দলপতির সাক্ষাৎপ্রার্থী।তোমরা আমার উদ্ধারকারী।সেই বিষয় অবগত হয়েই,আমার দ্বারা তোমাদের কারোর ক্ষতিসাধন সম্ভব নয়।আমার মুখনিঃসৃত এ বাক্য নিশ্চিতভাবেই বিশ্বাসযোগ্য।

বিস্ময়ের চাদরে আবৃত মুখাবয়বগুলির মধ্যে,রাজার কথাগুলি শেষ হওয়ার পরেও,কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হলো না।ত্রিদিব হতাশ হয়ে বুঝলেন,এরা বুঝি সভ্য সমাজের ভাষা বুঝতে সমর্থ নয়।কিন্তু সেই মুহূর্তেই তার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করতে,একটি সুসজ্জিত কুটির হতে বেরিয়ে এলেন এক তন্বী রমণী।তার সঙ্গে কয়েকজন পুরুষও।বিস্ফারিত নেত্রে ত্রিদিব দেখলেন,যুবক হতে বৃদ্ধ,হাতেগোনা প্রায় প্রত্যেক পুরুষদেহই বহন করছে অঙ্গহানির সুস্পষ্ট চিহ্ন।শিউরে উঠলেন ত্রিদিব।ওই কৃষ্ণকায় নারীর উপস্থিতিতে,
সমবেত জমায়েতের মধ্যে বেশ কিছুটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো।ত্রিদিব বুঝলেন,এই নারীই বুঝি অসভ্য গোষ্ঠীর নেত্রী।অদ্ভুতদর্শন ওই নারীর পরনে লজ্জা নিবারণ হেতু সামান্যই বস্ত্র।কপালে রক্ততিলক,দৃষ্টি ইষৎ ক্রুর!মাথায় সুবৃহৎ জটা।সেই নারী ত্রিদিবের সম্মুখে এসে দাঁড়ালে,ত্রিদিব অবনত মস্তকে নৃপতিসুলভ সৌজন্য জানালেন তাকে।জমায়েতের মধ্য হতে এক নারীকণ্ঠ স্পষ্ট উচ্চারণ ও দীপ্তকণ্ঠে বলে উঠলো,

-ডাকিনী মা!এই সেই পুরুষ।পূর্বরাতের আগন্তুক!এনার দাবী,ইনি মোহরকুঞ্জের রাজা!

বিস্ময়ের এক একটি পর্যায় অতিক্রম করছেন ত্রিদিব।এরা সভ্য সমাজের ভাষা বুঝতে ও বলতে সক্ষম।বুঝি দলনেত্রীর উপস্থিতি বা অনুমতি ব্যতীত,এরা কথা বলতে অনিচ্ছুক।ত্রিদিব দৃষ্টি ফেরালেন ওই ডাকিনী মায়ের দিকে।অপেক্ষা করতে লাগলেন,তার পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্য....

-তোমার কথার স্বপক্ষে প্রমাণ দিতে হবে।

অদ্ভুত স্বরে সেই ডাকিনী মা বললেন।আপন দুই ভ্রু-যুগলের মাঝে রাজটিকার দিকে নির্দেশ করে ত্রিদিব বললেন,

-এই রাজটিকাই কি যথেষ্ট নয় মা?!
-ওই রাজটিকার কারণেই তোমার শিরচ্ছেদ করা হয়নি!
-একজন নারীর এতদূর স্পর্ধা!!
-জঙ্গলের এই অংশ বর্তমানে আমাদের অধীনে রাজ্যেশ্বর।যদিও আপনার রাজকীয় মেজাজ আপনার পরিচয় বহন করে,তা সত্ত্বেও....
-আমারই রাজ্যের সীমানায়,এমন দুর্ভেদ্য অরণ্যে কোনো মনুষ্যসৃষ্ট কুটির বা মানুষের বাস চোখে পড়বে,এ আমার কল্পনারও অতীত ছিলো।আমার অজান্তে এমন বাসস্থানের আয়োজন কিভাবে সম্ভব?আপনারা কারা!আমার ভাষা বুঝতেও আপনারা সক্ষম!স্বল্প আলাপে আমি এও অবগত,আপনিই এদের দলনেত্রী।তাই আপনার কাছেই এই সকল প্রশ্নের উত্তর আশা করি।কোন রাজ্যের বাসিন্দা আপনারা...
-আমার মনের সংশয় পুরোপুরি কাটেনি।তুমি যে কোনো গুপ্তচর নও,তার প্রমাণ কি?!
-আমি!গুপ্তচর!!আমি রাজা এ রাজ্যের।রাজা ত্রিদিবাচার্য!!রত্নখচিত রাজমুকুট আমারই অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।এ রাজ্যের ভাগ্যবিধাতা আমি!

রাগান্বিত ত্রিদিবের প্রবল হুঙ্কারে স্তব্ধ হয়ে গেলো উপস্থিত জনগণ।বিদ্রুপ ঝরে পড়লো ডাকিনী মায়ের কণ্ঠে,

-ক্ষমতার এমন দম্ভ প্রকৃত রাজাকে শোভা পায় না ক্ষত্রিয়!তা ভাগ্যবিধাতা আপনার জন্য নির্মিত ভগবানের আসন পরিত্যাগ করে,এমন বনবাসে কেন?
-আত্ম-অনুসন্ধানে।রাজসংসার,রাজনীতি,রাজ্যপাট মানসিক শান্তি প্রদানের কারণ হয়ে উঠতে পারছিলো না।সাময়িক বিশ্রামপূর্বক,মনের ভিতর সকল মোহ পরিত্যাগের বাসনা প্রতিপালন করি!
-তোমার দম্ভ হতেই সে বিষয় স্পষ্ট,রাজপরিবারের মোহ ত্যাগ করা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়।আপন সংসারে ফিরে যাও।যেথায় তোমার কর্ম,সেথায় সুখের সন্ধান পাবে তুমি!সন্ন্যাসীর জীবন তোমার জন্য নয়।গৃহে ফিরে যাও!ক্ষুধার্ত-তৃষ্ণার্ত-পীড়িত ও বিপদগ্রস্তকে জীবনদান করাই আমার অনুগামীদের কর্তব্য।তারা পূর্বরাতে তাই করেছে।উদ্ধার করেছে তোমায়।এবার তুমি আপন পথে ফিরে যাও।আমার শিষ্যের পথনির্দেশ তোমাকে এই মায়াকাননের গোলকধাঁধা হতে বাইরে বেরোতে সাহায্য করবে।অতঃপর আশা করি,তুমি কয়েক প্রহরের এই সকল ঘটনা বিস্মৃত হবে।রাজধর্ম পালন করো রাজা!
-যথার্থই।তবে আমার কৌতূহল নিবৃত্ত করতে সমর্থ,এমন কোনো উত্তর এখনও আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি।আমার রাজ্যে বসবাসকারী এই উদ্বাস্তু গোষ্ঠীর সম্পর্কে সকল বিষয় জানতে আমি আগ্রহী।আপনার গুপ্তচর সম্পর্কিত ভীতি জানান দিচ্ছে,আপনারা অজ্ঞাতবাসে রয়েছেন।আমার রাজ্যে এমন অজ্ঞাতবাসের কারণ সম্পর্কে আমি জানতে ইচ্ছুক।কারণ যুক্তিযুক্ত মনে হলে,আমি আপন সামর্থ্যে সসম্মানে প্রতিপালন করবো আপনাদের।নগরে আশ্রয় দেবো।অন্যথায় এ অরণ্য থেকে আপনাদের উৎখাত করবো।পরিত্যাগ করতে হবে এই মায়াকানন।
-উপকারীর প্রতি এই তোমার কৃতজ্ঞতা?
-আমি রাজধর্ম পালনে ব্রতী।
-খানিক পূর্বেই রাজ্যপাট পরিত্যাগের কথা শুনেছিলাম!

মস্তক অবনত হলো ত্রিদিবের।

-লজ্জার বিষয় নয়।তুমি ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন করো রাজা।রাজধর্ম পালনেই তুমি মনের শান্তি পাবে!
-আমার প্রশ্নের উত্তর?এই অরণ্যে আপনাদের আগমনের কারণ...

ওই কুটির হতে এক রমণী এসে অনতিদূরে দাঁড়িয়ে ডাকিনী মাকে যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে বললো,

-আপনার পূজার উপাচার প্রস্তুত মা!আসন গ্রহণ করার সময় উপস্থিত।

ত্রিদিবের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ডাকিনী মা বললেন,

-তুমি আমার স্নেহভাজন পুত্র।স্নানাদি ও আহারাদিপূর্বক বিশ্রাম গ্রহণ করো।আমার সাধনার সময় উপস্থিত।আগামী দুই দিন আমি মহাভৈরবীর যোগসাধনায় ব্যস্ত থাকবো।এ রাজ্য তোমারই।তবে তোমার রাজ্যের এই সামান্য কিছু দুর্ভেদ্য অঞ্চলে বর্তমানে আমার রাজত্ব চলে।আমি অনুরোধ করবো,দিন দুই নিঃসংকোচে আমার আতিথ্য গ্রহণ করো।অতঃপর আমি এই গোষ্ঠীর অতীত সম্পর্কিত সকল বিষয় তোমার সম্মুখে উদঘাটন করবো,এমন কথাই রইলো।মহাভৈরবী তোমার সহায় হোন!

দ্বিরুক্তি করলেন না ত্রিদিব।অসামান্য ভাবে সম্মোহন করার ক্ষমতা রাখেন ডাকিনী মায়ের মুখনিঃসৃত শব্দ।সম্মোহিতের মতো অবনত মস্তকে মাতৃআজ্ঞা পালনে সম্মত হলেন নৃপতি।ডাকিনী মায়ের অনুমতি ব্যতীত আরও একটি বিষয় তীব্রভাবে আকর্ষণ করছে রাজাকে।তার দৃষ্টি তখন বাধা পড়েছে ওই খর্বকায় নারীর দীঘল দুটি চোখে।ডাকিনী মায়ের মতোই ওই নারীর পরনে কঞ্চুলিকা ও কটিদেশে সামান্য বস্ত্র মাত্র।লজ্জা নিবারণের সামান্য কিছু পরিধেয় ব্যতীত,দেহপল্লবের অটুট যৌবন আড়ালের কোনো প্রয়াসই ওই নারীর দেহে পরিলক্ষিত নয়।গ্রীবা,দুই বাহু ও নাভিমূলের কিঞ্চিৎ পার্শ্ববর্তী স্থানে,কটিবস্ত্রের উপর আপন অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে অজস্র উল্কি।শিল্পীর শিল্পকর্ম অপরূপ বটে!তবে তা ম্লান করতে পারেনি নারীদেহের অপরূপ বন্য সৌন্দর্য।নৃপতির পানে চকিত দৃষ্টিপাত করেই,আপন দৃষ্টি অবনত করলো সেই উদ্বাস্তু নারী।ডাকিনী মা বললেন,

-অনতিবিলম্বে আসছি ত্রিযামা!রাজা?
-আমি আপনার আমন্ত্রণ সসম্মানে গ্রহণ করলাম মা!

ত্রিদিবের মস্তক স্পর্শ করে আপন পর্ণকুটিরে প্রবেশ করলেন ডাকিনী মা।মায়ের আশীর্বাদ গ্রহণপূর্বক জমায়েত কিছুটা শিথিল হলো।সেই নারী এগোলেন অদূরেই বিশ্রামরত কয়েকটি শান্ত অশ্বতর অভিমুখে।মন্ত্রমুগ্ধের মতো ত্রিদিব অনুসরণ করলেন সেই নারীকে....

-ত্রিযামা?তোমার নাম?
-মহারাজ!
-তুমি জানো আমি কে?
-সকলেই জানেন।আমিও এই গোষ্ঠীর অন্তর্গত।আমার অজানা কিছুই নয়।
-তোমাদের গোষ্ঠীর যে উদ্ধারকারী দল পূর্বরাতে আমাকে ও বৈশ্বানরকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত হতে উদ্ধার করেছে,আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় অবসন্ন দেহের ক্ষমতা,অধিক ছিলো না।বিপদকালে আমার বাহ্যজ্ঞান বিলুপ্ত হয়েছিলো।আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম বুঝিবা।না জানি কত রক্তপাতের মধ্য দিয়ে,তারা আমার জীবন রক্ষা করেছেন!!
-অধিক নয়।এই সামান্যই!

ত্রিযামা দক্ষিণ হস্ত সম্মুখভাগে প্রসারিত করার পর ত্রিদিব হতবাক দৃষ্টিতে দেখলেন,উল্কির কারুকার্যের আড়ালে,কোমল নারীদেহের একাংশ শ্বাপদের আঁচড়ে রক্তাক্ত।কিছু বনজ লতাপাতা নিঃসৃত তরল ওই ক্ষতস্থানে দেওয়ায়,রক্তপাত বন্ধ।তবে ক্ষত যে সদ্যই তা সুস্পষ্ট।স্বল্পবসনা নারীর মধ্যে লজ্জা নামক অনুভূতির কিঞ্চিৎ অভাব রয়েছে।নিঃসংকোচে ত্রিযামা দাঁড়িয়ে রইলেন রাজার সম্মুখে।

-বড় গভীর ক্ষত!তুমি ছিলে গতকাল?
-না আমি একাকী নই।সঙ্গী ছিলো জনাকয়েক।তবে প্রথম আঘাতটা আমার ওপরেই হানে।বর্শার ফলা গেঁথেছি তার হৃদয়ে।ওই যে!

ত্রিদিব দেখলেন,মৃতদেহ হতে সদ্য পৃথক করা একটি চামড়া কুটিরের বেড়ার আড়ালে রৌদ্রে শায়িত।

-তোমার ভয় করলো না!!

 রমণী অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।

-ভয়!আমার?
-কেন?

অশ্বতরগুলিকে পর্যাপ্ত খাদ্যজল সরবরাহ করে ত্রিযামা চাইলেন দূরে অরণ্যের পানে।ত্রিদিব ও ত্রিযামার মধ্যে বিরাজ করছে কেবল অপার নৈঃশব্দ।দ্রুত পদচারণাপূর্বক সেই স্থান পরিত্যাগে সচেষ্ট হলেন ত্রিযামা।তবে নিস্তার পেলেন না ত্রিদিবের দৃষ্টি হতে।

-কোথায় চললে তুমি?
-মহারাজ!কেন অনুসরণ করছেন আমায়?
-তুমি ভীত ত্রিযামা!
-না!
-মিথ্যা!!

ত্রিদিব স্পষ্টতই লক্ষ্য করেছেন,শঙ্কার প্রসঙ্গ উত্থাপনের মুহূর্তেই ত্রিযামার ওই দুটি চক্ষু প্রাণভয়ে কাতর হরিণীর ন্যায় শঙ্কিত হয়ে ওঠে।হৃদয়স্থলে তীব্র ক্লেশ অনুভব করেন ত্রিদিব।ত্রিযামার স্তব্ধতার মাঝেই তার সম্মুখে গিয়ে বলেন,

-কি কারণে তোমার গোষ্ঠী বনবাসী?কি তোমাদের অতীত?তোমার অতীত কি ত্রিযামা?!এ অপেক্ষা বড় দীর্ঘ।প্রবল কৌতূহলের কারণে আমি আত্ম সংবরণ করতে অক্ষম।আমি জানতে আগ্রহী ত্রিযামা!তোমার অতীত!কিসের শঙ্কা তোমার ওই দুটি চোখে?অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে প্রতি মুহূর্তে হিংস্র প্রাণীর সঙ্গে যুদ্ধ করে কেন বেঁচে থাকা?কেন এই অজ্ঞাতবাস?
-সভ্য সমাজের হিংস্রতার তুলনায়,বনের এই পশুপাখি অধিক হিংস্র নয় রাজা।এ সংগ্রাম তুলনামূলক সম্মানের।
-ত্রিযামা!বলো আমায়!আমি তোমার সকল কষ্ট,সকল ব্যাধি দূর করবো!

অতঃপর মনুষ্যবসতির উপযুক্ত ওই গোষ্ঠীর অন্তর্গত,মায়াকাননের স্বল্প পরিসরের ভূমিতে পদচারণাপূর্বক ত্রিযামার নিকট হতে এই গোষ্ঠী এবং ওই নারীর দুর্ভাগ্যজনিত অতীতের সমস্ত বিবরণ জানতে পারলেন ত্রিদিব।ত্রিযামার আপন রাজ্যের রাজা দয়াপরবশত সামান্য ভূমি প্রদান করেন এই যাযাবর গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষকে।এই গোষ্ঠী বৃহৎ রাজ্যের রাজনীতি কূটনীতি বুঝতে অক্ষম।প্রতিপালক রাজার কৃপায় সামান্য কৃষিকাজ ও গবাদি পশুর প্রতিপালনে নিশ্চিন্তে জীবন ও জীবিকা অতিবাহিত হতো গোষ্ঠীর সদস্যদের।তবে আপন রাজ্যকে বহিরাগত শত্রুর দৃষ্টি হতে প্রতিরক্ষায় মগ্ন প্রজাবৎসল রাজাকে,তার আপন ভ্রাতা কুটিল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করেন।ওই নির্মম হত্যাকান্ডের পরই নতুন রাজা প্রজার উপর শুরু করেন নির্মম অত্যাচার।রাজধানী,নগর,এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও কোনো রমণী রাজপথে দ্বিধাহীনভাবে পদব্রজে বেরোতে অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে পড়তেন।কেবলমাত্র বারবনিতা নয়,একাধিক গৃহবধূ,অবিবাহিতা রমণী ও কুমারী বালিকাকেও আপন ইচ্ছের বিরুদ্ধে শয্যাসঙ্গিনী হতে বাধ্য করেন ওই নৃপতি।যাযাবর গোষ্ঠীর স্ত্রীদেহ হতে নিঃসৃত বন্য সুগন্ধ,রাজাকে মুগ্ধ করে বারংবার।রাজা ক্ষমতায় আসার পর,প্রতি রাতেই ওই গোষ্ঠীর একজন রমণী গৃহহারা হতে শুরু করেন।কোনো নারী আপন সম্মান খুইয়ে আত্মহত্যার পথ অবলম্বন করতেন,আবার কোনো রমণীর অর্ধমৃত বা মৃতদেহ রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে যাওয়া হতো তার নির্দিষ্ট কুটির সম্মুখে।

ত্রিদিবের পক্ষে দীর্ঘ সময় এ অতীত সহ্য করা অসহনীয় হয়ে উঠছিলো।সেই একই প্রকার চরিত্রদোষে দুষ্ট সে নিজেও।মদিরা সহযোগে প্রতিরাতে কোনো ত্রয়োদশী বা ষোড়শীর দেহ নিঃসৃত সৌরভে মগ্ন থাকতে ভালোবাসতেন নেশাতুর ত্রিদিব।তবে বর্তমানে এইসকল আসক্তি তার মনে বড় আত্মগ্লানির জন্ম দেয়।সেই হেতু সকল পিছুটান পরিত্যাগ করতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন রাজা।ত্রিযামার মুখনিঃসৃত বাক্য অনুধাবন করে ত্রিদিব জানতে পারলেন,একমাত্র ত্রিযামাই সেই নারী,যে ওই কামুক রাজাকে প্রত্যাখানের স্পর্ধা প্রদর্শন করেছিলেন।সৈন্যবাহিনী দ্বারা বলপূর্বক রাজার শয়নকক্ষে প্রবেশের পরই,তার কাছে ওই রাজার জঙ্ঘায় উপবিষ্ট হওয়ার অশালীন প্রস্তাব আসে।ত্রিযামা কর্তৃক তীব্রভাবে ঘৃণিত ওই রাজা বলপূর্বক সঙ্গম স্থাপন করেন ওর কুমারী নারীদেহের সঙ্গে।দেহযন্ত্রণায় কাতর ত্রিযামা যে মুহূর্তে মরণ চিৎকার দ্বারা সাহায্যপ্রার্থী,সেই মুহূর্তে তার কুমারীত্ব ছিন্নভিন্ন করে আপন কামজ্বালা পূরণ করতে লিপ্ত ওই রাজা।অভিশপ্ত রাত্রি প্রভাত হলে,ত্রিযামার অচৈতন্য দেহটা ঘোড়ার পৃষ্ঠদেশ হতে তারই কুটিরের সম্মুখে ছুঁড়ে ফেলে যায় রাজার সৈন্য।জনরোষ সেই সেনাকে বাধা দেওয়ায়,অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় গোষ্ঠীর কয়েকটি গৃহ।রাজ্যের চরম অরাজক অবস্থায়,সকল রাজ্যবাসী একত্রে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।তবে রাজ্যে থেকে রাজার বিরুদ্ধাচরণ করে জয়লাভ সম্ভব ছিলো না।সেনাবাহিনীর ক্রমাগত অত্যাচারে রাজ্যের এবং ঐ যাযাবর গোষ্ঠীর সহস্রাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়ে,ধনসম্পত্তি খুইয়ে ছড়িয়ে পড়ে দিকে-দিকে।তীব্র অত্যাচারে গৃহহারা বিদ্রোহী মানুষগুলো প্রতিবাদে সোচ্চার হলে জোটে চরমতম শারীরিক অত্যাচার।ত্রিযামার সঙ্গে কয়েকটি পর্ণকুটিরের সম্মুখে উপনীত হয়ে ত্রিদিবাচার্য দেখলেন,সেই সকল দুঃস্বপ্নের পরিচয় বহন করছেন অঙ্গহারা বহু মানুষ।এই যাযাবর গোষ্ঠীর মাত্র চল্লিশ জন আপন রাজ্য ছেড়ে,বনপথে পলায়নে সমর্থ হয়েছিলো।তবে যাত্রাপথেই অতিরিক্ত রক্তপাতে মৃত্যু হয় মাতৃহারা ত্রিযামার পিতৃদেবের।ক্ষুধায় তৃষ্ণায় অপমৃত্যু হয় জনাকয়েকের।হিংস্র জন্তুর আক্রমণে ক্ষতস্থান বিষিয়ে,অজানা অসুখে ও প্রকৃতির রোষে প্রাণ হারান বেশ কিছু মানুষ।বর্তমানে বাইশ জনের এই ক্ষুদ্র গোষ্ঠী প্রকৃতির সঙ্গে অসম লড়াইতে জয়লাভ করে মায়াকাননের গভীরে আপন আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়।মাত্র ছয়জন অথর্ব,বৃদ্ধ ও অঙ্গহারা পুরুষ ওদের গোষ্ঠীর মধ্যে জীবিত রয়েছেন।অবশিষ্ট সকলেই মহিলা ও শিশু।এমতাবস্থায় জীবনধারণের প্রয়োজনে পুরুষের সহযোগিতা কামনা একপ্রকার অসম্ভব।রাজ্যে থাকাকালীন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গোষ্ঠীর সকলে ডাকিনী মা-কে অত্যন্ত সমীহ করে চলতো।গোষ্ঠীর আরাধ্যা দেবী মহাভৈরবীর আরাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন ডাকিনী মা।নিদ্রাহীন দীর্ঘ রাত্রি পূজার পর তার রক্তচক্ষু অনুধাবন করে গোষ্ঠীর সকল শিশুমনে অত্যন্ত ভীতির সঞ্চার হতো।আপন চঞ্চল শিশুকে সামলে,কিঞ্চিৎ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার অভিপ্রায়ে প্রতি মা আপন শিশুকে ডাকিনীর রক্তচক্ষুর গল্পকথা শোনাত।লোকমুখে প্রচারিত ওই গল্পগাথার ন্যায় রক্তচক্ষুর সাদৃশ্যগত কারণে পরবর্তীতে পূজারিণী মা আপন পরিচয় হারিয়ে ডাকিনী মা সম্বোধনে উন্নীত হয়।গোষ্ঠীর চরম দুরবস্থায় সকলের ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে,ডাকিনী মা আপনার কাঁধে গোষ্ঠী পরিচালনার গুরুদায়িত্ব তুলে নেন।অতঃপর হিংস্র জন্তুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে টিকে থাকার লড়াই,খাদ্য অন্বেষণে যুদ্ধ,প্রকৃতির রোষের সঙ্গে অসম লড়াই...বর্তমানে এইভাবেই ত্রিযামার জীবনের প্রতিটি দিন অতিবাহিত হয়।

-তোমার মনোবেদনা সম্পূর্ণরূপে অনুধাবন করতে আমি অক্ষম ত্রিযামা।আপনজনের বিয়োগব্যথায় কাতর তুমি!
-জানেন মহারাজ!অদূরেই আমার পিতার দেহ অগভীর মাটির তলে শায়িত।অগ্নিদান সম্ভব হয়নি।পাছে অগ্নির কুণ্ডলীপাকানো ধূম্র,অনুসরণকারীদের নিকট আমাদের গুপ্ত ঠিকানা প্রেরণে সহায়তা করে!তবে এ বন্য জীবনে আমার কোনো আক্ষেপ নেই রাজা।এখানে হিংস্র জন্তু ও মানুষের একটিমাত্র সম্পর্ক।খাদ্য ও খাদক।তবে কোনো জন্তুই নারীখাদক নয়।
-ত্রিযামা!যে কারণে তুমি রক্তাক্ত,অপমানিতা,নিগৃহীতা, সম্ভবত প্রহৃতাও....সেই একই দোষে এ রাজ্যের রাজাও দুষ্ট!আমার কারণে এ রাজ্যের বহু নারীর মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত।আমার সঙ্গে এক রাত্রিকাল যাপনের জন্য,আপন সমাজে পরিত্যক্তা বহু নারী।সাময়িক সুখ অনুসন্ধানের পর,তাদের আর কোনো সংবাদ সম্পর্কে আমার কোনো কৌতূহল থাকতো না।তাদের জীবন বুঝি তোমার মতোই বিপন্ন হয়ে থাকবে....

আপন অতীতের স্মৃতিচারণে মগ্ন হয়েছিলো ত্রিযামা।রাজার এমন বাক্যে আচম্বিতে সম্বিৎ ফিরে পেলো সে।রাজার পানে হরিণীর ন্যায় ভীত দৃষ্টিপাত করলো ত্রিযামা।ত্রিদিবের মনে হলো,তীরবিদ্ধ এক ভীত হরিণী,ব্যাধের দিকে চেয়ে আপন প্রাণভিক্ষা চাইছে।অবনত মস্তকে অনুতপ্ত কণ্ঠে ত্রিদিব বললেন,

-চিরদুঃখভোগের অগ্নিতে আপনাকে সমর্পণ করে তুমি আজ স্বর্ণকন্যা ত্রিযামা!যে সকল অপরিচিতা নারী আমার কারণে অপমানিতা,তাদের সকলের মুখমন্ডল আমার অজানা।ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক সকলের কাছে ফেরাও সম্ভব নয়।সেই সকল নারীর ওপর করা অপমানের কারণে আমার হৃদয় আজ বড়ই উদ্বেলিত।মানসিক অস্থিরতার কারণে আমি আমার রাজ্য,সিংহাসন পরিত্যাগ করে,উদ্দেশ্যহীনভাবে এ মায়াকাননের পথে এগোতে শুরু করেছিলাম।সন্ধান শুরু করেছিলাম আপনার মনকে স্থির রাখার প্রভূত উপায়।তবে আমার সেই অন্বেষণ সমাপ্ত হলো তোমাকে পেয়ে....ত্রিযামা?

ভীত সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে রাজার পানে চেয়ে কোমরবন্ধনী হতে সর্বক্ষণের সঙ্গী,আপন সুতীক্ষ্ণ ছুরি মুক্ত করলো ত্রিযামা...

(চলবে)

ছবি : সংগৃহীত


শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

সপ্তপর্ণী (প্রথম খণ্ড) দ্বিতীয় পর্ব


 


সপ্তপর্ণী


সাথী দাস


প্রথম খণ্ড


দ্বিতীয়  পর্ব



-মা?
-এসো পর্ণা!একি!তুমি এমন স্বল্প পোশাকে?
-এ পোশাক যুদ্ধশিক্ষারই একটি অধ্যায় মা।রামেশ্বর আজ আমায় আপন লজ্জাকে জয় করার শিক্ষা প্রদান করেছে।আমি জয়ী হয়েছি।
-বেশ।রামেশ্বর আমার বিশ্বস্ত।সে কোনো সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এমন কর্ম করেছে বলেই আমার বিশ্বাস।তার দ্বারা তোমার ক্ষতিসাধন অসম্ভব পর্ণা!
-তোমার এমন ধারণা ভ্রান্ত মা!
-বিস্তারিত সংবাদ ও ঘটনার বিবরণ শুনতে আগ্রহী।তার আচরণে কি তুমি অসন্তুষ্ট?তুমি কি শিক্ষা প্রদানকালে এমন কোনো বিরূপ ঘটনার সম্মুখীন হয়েছো,যা তোমার মনে এই ধারণার জন্ম দিয়েছে,যে রামেশ্বর তোমার ক্ষতি করতে পারে।মনে কোনো কুণ্ঠা রেখো না পর্ণা।বলো আমায়!
-রামেশ্বর যা করেছে,তা সৎ উদ্দেশ্যেই করেছে।আমি তার কোনোরূপ ব্যবহারে অপমানিত নই।তবে তার দ্বারা আমার ক্ষতিসাধন অসম্ভব,তোমার এ ধারণা ভ্রান্ত।আমার বক্তব্য পরিষ্কার।
-এমন বক্তব্যের কারণ?
-রামেশ্বরের শিক্ষা আমাকে সর্বদা বলে,যুদ্ধক্ষেত্রে পরম আত্মীয় ও বিশ্বস্ত জনই হয়ে উঠতে পারে বিশ্বাসহন্তা।একজন রানির সর্ববৃহৎ ভুল হলো,আপন ছায়াসঙ্গীকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা।সামান্য অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে আপন ছায়াও সঙ্গী হয় না মা।তাই রামেশ্বর দ্বারা আমার ক্ষতিসাধন অসম্ভব,এ ধারণাকে মনে আশ্রয় দেওয়া একেবারেই অনুচিত।বরং আমার মনে এ কথা কিছুটা মান্যতা পেতে পারে,রামেশ্বর দ্বারা আমার ক্ষতিসাধন একপ্রকার অসম্ভব।
-রামেশ্বর আমার অনুগামী ও মায়াকাননের বিশ্বস্ত।তার শিক্ষায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত।সে তোমায় সঠিক পথেই পরিচালনা করেছে।
-আমি তার দেওয়া শিক্ষা আয়ত্ত করার যথাসাধ্য প্রয়াস,অবিরত করে চলেছি।
-সে সংবাদ আমার অজানা নয় পর্ণা।অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনার কারণে,তোমাকে অসময়ে এত জরুরি তলব করেছি।পোশাক পরিবর্তনের পর বিশ্রাম গ্রহণ করো।রাজকার্য সমাধার পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে,আমি তোমার কক্ষে উপস্থিত হবো।মন্ত্রী তোমার সাক্ষাৎপ্রার্থী।রাজ্য ও তোমার ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত কিছু সুদীর্ঘ আলোচনার জন্য তুমি প্রস্তুত থাকবে।
-মায়াকাননের মহারানির আদেশ পালনে আমি সর্বদা...
-না পর্ণা।তুমি ভবিষ্যতে এই রাজ্যের রানি হলেও,সর্বাগ্রে আমার কন্যা।তোমার জন্য আমি মা,মহারানি নই।অকারণ কালবিলম্ব না করে,বিশ্রাম নাও।আমি মন্ত্রীকে নিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যেই তোমার সাক্ষাতে আগ্রহী।

নলিনীকে গাঢ় আলিঙ্গনপূর্বক আপন কক্ষ অভিমুখে প্রস্থান করলেন পর্ণা।একাধিক দুশ্চিন্তা রাজকন্যার মস্তিষ্কের গোপন প্রকোষ্ঠের আনাচে-কানাচে উঁকি দিয়ে যায়।মাত্র এক পক্ষকাল পূর্বেই কৈশোরের বেড়াজাল ভঙ্গ করে যৌবনের রক্তিম সীমানায় পদার্পণ করেছেন সপ্তপর্ণী।রাজ্যের দায়িত্ব কি এবার নিশ্চিতরূপে ন্যস্ত হতে চলেছে পর্ণার ওপরেই!নাকি কোনো বহিরাগত শত্রুর আক্রমণের গোপন সংবাদ গুপ্তচর কর্তৃক মায়ের কর্ণকুহরে প্রবেশ করেছে!স্নানাদি সম্পন্ন হওয়ার পর আপন কক্ষ সংলগ্ন উপরিভাগের উন্মুক্ত স্থানে ইতস্তত বিচরণ করছিলেন পর্ণা।অদূরেই তার স্বপ্নের একটুকরো মায়াকানন।আপন পরিচর্যায় নিজহস্তে নির্মিত শৌখিন একফালি বাগান।দুর্ভেদ্য নিবিড় অরণ্যানীর প্রতি,বরাবরই এক অমোঘ আকর্ষণ মনের গোপনে প্রতিপালন করেন পর্ণা।কিন্তু পিতার অপমৃত্যুর কারণে মায়ের কঠিন নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে,ওই অরণ্যের গভীরে প্রবেশ করার স্বপ্নপূরণ সম্ভব হয়নি।সেই যন্ত্রণা স্তিমিত করার অভিপ্রায়ে,মায়ের কাছে আপন হস্তনির্মিত একটি ক্ষুদ্র বাগানের আবদার রেখেছিলেন বালিকা।অনতিবিলম্বেই পেয়ে যান কাঙ্খিত সেই উপহার।রং-বেরংয়ের ক্ষুদ্র লতানো গাছগাছালি হতে সুবৃহৎ মহীরূহ,সকলেই পর্ণার ওই সবুজ সংসারে নির্বিরোধে সহাবস্থান করছে।তবে পর্ণা মনপ্রাণ উৎসর্গ করেছেন ওই দুর্ভেদ্য মায়াকাননকে।সুউচ্চ হিমশৈল পর্বতের পানে চেয়েছিলেন পর্ণা।সমুদ্রদয়িতা রুদ্রাণীর বক্ষমাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রবল আশায়,অবাধ্য মন বৃথা আস্ফালন করে।কল্লোলিনীর পার্শ্ববর্তী অরণ্যপথ ধরে ওই পর্বতের পাদদেশে পৌঁছতে বড় সাধ জাগে।ওই যাত্রাপথে অগ্রসর হতে গেলে বুঝি হিংস্র পশু,বিষাক্ত কীটপতঙ্গ ও অজানা অসুখের সঙ্গে সখ্যতা আবশ্যক।না জানি কতশত আশ্চর্য রহস্যে আবৃত ওই মায়াকানন!!ওই নিবিড় বনানীর সর্বাপেক্ষা গভীরতম অংশে হয়তো,
কোনোকালেই প্রবেশ করেনি সূর্যালোক।লোকমুখে প্রচারিত সহস্রাধিক উপমায় কলুষিত ওই অভিশপ্ত অরণ্য।পর্ণা জানেন,এ সকল গল্পকথাই মনুষ্যসৃষ্ট।রাজ্যবাসীকে ওই অঞ্চল থেকে দূরে রাখার অভিপ্রায়ে রাজপরিবারের কুটিল চক্রান্তের ফল,এইসকল মনগড়া অলীক কাহিনী।হয়তো ওই মায়াকাননের আড়ালে আপনাকে অনাবিষ্কৃত রেখেছে,কোনকালে সূর্যরশ্মির সান্নিধ্য না পাওয়া কোনো অদ্ভুতদর্শন প্রাণী,কিম্ভুতকিমাকার পতঙ্গ,প্রাণীখাদক লতানো বৃহদাকার সুদর্শন উদ্ভিদ।পৃথিবীর সেইসকল অদ্ভুত সুন্দর অথচ ভয়ঙ্কর দুর্গম অঞ্চলে পৌঁছে,তাদের অজানা কাহিনী স্বচক্ষে দর্শনের হেতু আকুল হয় পর্ণার অত্যুৎসাহী চঞ্চল মন।সাধ জাগে পাহাড়ি ঝর্ণায় অবগাহন করে সিক্ত হৃদয়ে ছুটে যেতে ওই প্রতিবেশী রাজ্যে।জানতে বড় ইচ্ছে হয় দূরে ওই পর্বতের পাদদেশে যে অজানা রাজ্য অবস্থিত,কেমন তাদের জীবনযাত্রা!কেমন তাদের বাচনভঙ্গি!তারাও কি পর্ণার মতোই রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে রাজপরিবারের কারণে,কর্তব্য নামক সোনার শৃঙ্খলে বন্দী!!রহস্যবিমুখ এই রাজ্যের ভবিষ্যৎ রানি ভ্রমণপিপাসু পর্ণা মনের গহীনে প্রতি মুহূর্তে প্রতিপালন করতে থাকেন মায়াকাননের অভ্যন্তরভাগে প্রবেশ করার,এক অদম্য লিপ্সা....

-রাজকন্যা!রানিমা আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী।আপনাকে কক্ষে আসার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।সঙ্গে মন্ত্রীবর উপস্থিত।সেনাপ্রধান রামেশ্বর মহাশয়ও।জরুরি তলব!
-এই ক্ষণে আসছি!

মায়াকানন ও হিমশৈলর প্রতি অন্তিমবার দৃষ্টিনিক্ষেপ করে,আপন কক্ষ অভিমুখে যাত্রা করলেন পর্ণা....

-পর্ণা!তোমার শিক্ষাগুরু,মন্ত্রী ও রামেশ্বরের সঙ্গে সামান্য আলোচনার মাধ্যমে আমি এ বিষয় পূর্বেই অবগত হয়েছি,তুমি এ রাজ্যের দায় ও দায়িত্ব নেওয়ার উপযুক্ত হয়েছো।তোমার শিক্ষা সম্পূর্ণ।যে সামান্য বিঘ্ন ছিলো,তাও এক পক্ষকাল পূর্বেই অতিক্রান্ত।ভগ্নস্বাস্থ্যের বিবিধ কারণে আমার দ্বারা নিয়মিতভাবে রাজকার্য চলাকালীন রাজসভায় উপস্থিত থাকা সম্ভবপর হচ্ছে না।এমতাবস্থায় আমি চাই,মায়াকাননের যাবতীয় দায়িত্ব তোমার হাতে তুলে দিয়ে দায়মুক্ত হতে।পরবর্তীতে আমি তোমার জন্য বিশিষ্ট কয়েকটি রাজ্য হতে,সমস্ত শর্ত প্রদানপূর্বক সম্মানীয় রাজপুত্রদের স্বয়ম্বরের কারণে এ মায়াকাননে আমন্ত্রণ জানাতে ইচ্ছুক।এ বিষয়ে তোমার কোনো বক্তব্য থাকলে,কালবিলম্ব না করে এই মুহূর্তেই উত্থাপন করার নির্দেশ দিলাম।
-তুমি যদি আমাকে রাজ সিংহাসনের উপযুক্ত মনে করো,শিক্ষা,রাজনীতি,কূটনীতি,নৃত্যকলা ও রণনীতি বিষয়ক সকল প্রকার পরীক্ষায় আমি যদি সসম্মানে উত্তীর্ণ হতে পারি,তবে এ গুরুদায়িত্ব আপন কাঁধে বহন করতে আমি প্রস্তুত।পরীক্ষার শুভদিন স্থিরপূর্বক,অগ্রিম সংবাদ প্রেরণের আর্জি সকলের সম্মুখে রাখছি।
-এমনটাই আশা করেছিলাম আমি।

মাথা নত করে মাকে সম্মান জানালেন পর্ণা।

-মন্ত্রী?
-আদেশ করুন রানি!
-এক পক্ষকাল পর মহাভৈরবীর পূজাকেন্দ্রিক পবিত্র উৎসবের আয়োজন করুন।রাজ্যবাসীকে এ বিষয় অবগত করুন,তারা শীঘ্রই পর্ণাকে আপন রানিরূপে রাজ সিংহাসনে পেতে চলেছেন।এ আনন্দ সংবাদ রাজ্যের সমগ্র প্রান্তে অবিলম্বে প্রেরণ করুন।রামেশ্বর,রাজকন্যার পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে যাবতীয় কার্যকলাপের দায়িত্ব তোমার।নিখুঁতভাবে আয়োজন করার নির্দেশ রইলো।

মাথা নত করে চলে গেলেন রাজমন্ত্রী ও রামেশ্বর।নলিনী এগিয়ে এসে গাঢ় আলিঙ্গন করলেন আপন আত্মজাকে।মায়ের উষ্ণ সাহচর্যে নিজেকে বিলীন করেও,দুর্গম মায়াকাননের দিকে আকুল দৃষ্টিতে চেয়ে নীরব অশ্রু বিসর্জন করলেন পর্ণা....

-সই!বিষণ্ণ কেন?
-রাজ্যভার আসছে।
-তবে আর কি তোমায় সই বলে ডাকা চলবে না!ওই আদুরে সম্বোধনে কি রানিমা নিষেধাজ্ঞা জারি করবেন?এবার তো তবে তুমি আমাদের মহারানি!

কৃত্রিম মায়াকাননের একটি সুবৃহৎ মহীরূহের ছায়াতলে পর্ণা বসেছিলেন বৃন্দার সঙ্গে।দুই সখীর আলাপচারিতার প্রারম্ভেই কলকাকলির নিখাদ প্রতিযোগিতা শুরু করেছিলো,শাখা-প্রশাখায় বসবাসকারী অসংখ্য বিহঙ্গ পরিবার।একটি অনামী পুষ্পকে পর্ণা আপন হস্তে তুলে নিলে,সেই ফুলটিকে বৃন্দা সযত্নে স্থান দিলো রাজকুমারীর অম্বুদসদৃশ একঢাল মসৃণ চুলের ভাঁজে।হতাশ পর্ণা বললেন,

-একদিন আমি পালাবো বৃন্দা।ওই মায়াকাননের অচেনা গলিপথে।তুমি যাবে আমার সঙ্গে?

অদূরেই দন্ডায়মান রাজকন্যার দুই দেহরক্ষী।আতঙ্কে শিউরে উঠলো পর্ণার আবাল্য সহচরী বৃন্দা।মাতৃপিতৃহীন এই বালিকা শিশুকাল হতেই রাজপরিবারের বিশ্বস্ত।বিনোদিনী মা নলিনীর বিশেষ পরিচারিকা হওয়ার সুবাদে,মায়ের মৃত্যুর পর এই রাজপ্রাসাদেরই সুদৃশ্য একটি কক্ষে আশ্রয় নেওয়ার সৌভাগ্য হয় বৃন্দার।পরবর্তীতে বৃন্দার পিতাও রানির কাছে আপন একমাত্র বালিকাকে গচ্ছিত রেখে,মৃত্যুর আহ্বানে সাড়া দেন।প্রায় সমবয়সী হওয়ার কারণে,পর্ণা ও বিনোদিনীর মধ্যে গড়ে ওঠে গভীর সখ্যতা।একইরকমভাবে শিক্ষাপ্রদান করা হয় বৃন্দাকেও।অভিন্নহৃদয় দুই সখী আপন সুখ-দুঃখ পরস্পরের কাছে প্রকাশ করে,কিঞ্চিৎ স্বস্তিলাভ করে।কিন্তু পর্ণার মনের এমন হেন নিষিদ্ধ ও গোপন ইচ্ছা হৃদয়ঙ্গম করে,যারপরনাই ভীত হলো বিনোদিনী।

-ধীরে বলো!তোমার দেহরক্ষীর কানে প্রবেশ করলে রানিমা কানে এ সংবাদ পৌঁছতে....
-যাবে তুমি?আমি যাবো সই!
-না পর্ণা!অনেক অভিশপ্ত ইতিহাস আছে ওই মায়াকানন ঘিরে,যা আমার মনে ভীতিসঞ্চারের জন্য যথেষ্ট।এই অসময়ে আমি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে কিছুমাত্র উৎসাহিত নই সখী।রানিমা বলেছেন,তোমার রাজ্যাভিষেক ও বিবাহের পর আমার জন্যও যোগ্য রাজপুত্তুর অন্বেষণ করবেন!এখন ওই বনে-জঙ্গলে প্রবেশ করে,দাঁতালো হাতি বা বন্য জন্তুর কবলে পড়ে,বেঘোরে মরি কি ভাবে বলো তো!এ বড়ই অনুচিত!

মৃদু হাসি ওষ্ঠের কোণে সযত্নে এঁকে পর্ণা বললেন,

-আমি যাবোই।অগ্নির পিঠে চেপে নিঃশব্দে হারিয়ে যাবো মায়াকাননে....
-এমন ইচ্ছা মন হতে একেবারে দূর করো পর্ণা।ওই জঙ্গলে নাকি এক ধূর্ত মায়াবিনীর বাস!তার কবলে পড়লে....
-তোমার মাথা!
-তুমি রাজকার্যে মনঃসংযোগ করো।অন্যথায় রানিমা রুষ্ট হবেন।
-হ্যাঁ!এমন ইচ্ছার কথা অবগত হলে মা কষ্ট পাবেন।এ বাক্য সত্য!আমি রাজকার্যেই মনোনিবেশ করবো সই।যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।এক পক্ষকাল পরেই আমার পরীক্ষা।আসন্ন এ পরীক্ষায়...
-তুমি সসম্মানে উত্তীর্ণ হবে।মহাভৈরবী তোমায় সহায় হোন।মায়াকানন থাকুক শত্রুমুক্ত!

কোনো প্রত্যুত্তর এলো না।অপরাহ্নের নিভে আসা সূর্যালোক স্পর্শ করলো পর্ণার চিবুক।দেহরক্ষীর বারংবার আহ্বানে রাজপ্রাসাদে ফিরলেন পর্ণা,সঙ্গে সর্বক্ষণের সঙ্গী বৃন্দা....

পূর্বনির্ধারিত শুভদিনে আয়োজিত সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভরা রাজসভায় নলিনীদেবীর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন সপ্তপর্ণী।অদূরবর্তী মন্দিরে খড়্গহস্তে মহাভৈরবী রক্তচক্ষু মেলে কৃপাদৃষ্টি দান করছেন সমগ্র মায়াকাননের উপর।রানির সম্মুখে পৌঁছতেই প্রজার হর্ষধ্বনিতে মুখরিত হলো রাজসভা।নলিনীদেবী সিংহাসন ত্যাগ করে দাঁড়ালেন পর্ণার অনতিদূরেই....

-রাজ্যের সকল প্রজার সম্মুখে প্রতিটি পরীক্ষায় তুমি সসম্মানে উত্তীর্ণ রাজকুমারী।এই রাজ সিংহাসনের যোগ্য তুমি।রাজ্যবাসী কি এই সিদ্ধান্তে কোনো দ্বিমত পোষণ করে?

নলিনীদেবীর প্রশ্নের প্রত্ত্যুতরে কেবল ভেসে এলো হর্ষধ্বনি ও পর্ণার স্তব-স্তুতি।মহানন্দে পর্ণার পানে চেয়ে রানি বললেন,

-তোমার প্রজা সাদরে গ্রহণ করেছে তোমায়।এ বিশেষ মুহূর্ত অতীতে আমার জীবনেও এসেছিলো।প্রজার এই সমাদর ঈশ্বরের আশীর্বাদস্বরূপ।এর অসম্মান কাম্য নয় পর্ণা।
-আমার এ জীবন রাজ্যের জন্য সমর্পিত।
-রাজ্যাভিষেকের শুভলগ্নের পূর্বে আমি তোমার উদ্দেশ্যে অন্তিম কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই।তার যথাযথ উত্তর প্রদানপূর্বক,তুমি এই সিংহাসনে আরোহণের অধিকার অর্জন করবে।
-বেশ!

রাজপুরোহিত,মন্ত্রীবর,উপদেষ্টা,সেনাপ্রধান,রামেশ্বর,
প্রজা ও বৃন্দা কিঞ্চিৎ হতবাক হলেন নলিনীদেবীর এমন সিদ্ধান্তে।তবে মহারানি নলিনীদেবীর সিদ্ধান্তের ঊর্ধ্বে কোনো বাক্য বলার অবকাশ বা ধৃষ্টতা কারোর মধ্যেই অবশিষ্ট নেই।শুভ সময় বয়ে যায়,তবুও রানির প্রশ্নের উত্তরের জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেন সকলেই....

-যুদ্ধক্ষেত্রে আপন আত্মার কাছে তোমার সর্বপ্রধান প্রতিশ্রুতি কি পর্ণা?
-আমরণ লড়াই!
-যুদ্ধক্ষেত্রে বা রাজকার্যে,কিংবা জীবনের কোন জটিল মুহূর্তে সাহায্যকারীর উদ্দেশ্যে তোমার বিচার কি?
-যুদ্ধক্ষেত্রে আমি আমার সাহায্যকারীর কাছে সেই মুহূর্ত পর্যন্ত কৃতজ্ঞ,যে মুহূর্ত পর্যন্ত আমি তার সাহায্যের উপযুক্ত মূল্য পরিশোধ করতে না পারছি।সেই মূল্য পরিশোধের পরবর্তী সময়ে,আমি তার কাছে আর ঋণী নই।ঋণশোধের পর সে আমার সাহায্যকারী নয়,পরিত্রাতাও নয়।নিতান্তই সাধারণ একজন মনুষ্যমাত্র!তার প্রতি আমার হৃদয়ে যেমন উপযুক্ত কারণ ছাড়া কোনো বিরূপ মনোভাবের জায়গা নেই,তেমনই দুর্বলতারও কোনো স্থান নেই।
-যথার্থ তোমার শিক্ষা!আমি আনন্দিত!
-আমি সম্মানিত!
-অস্ত্রাগারের অস্ত্রবল,রাজনীতি,কূটনীতি,রাষ্ট্রনীতি ও লোকবল যে স্থানে পৌঁছতে অসমর্থ,সেই ক্ষেত্রে শত্রুর বিরুদ্ধে তোমার সর্বাধিক শক্তিশালী অস্ত্র কি?
-নিরস্ত্র সপ্তপর্ণী নিজেই!
-তার কার্যকারিতা?বিস্তারিত ব্যাখ্যা আবশ্যক।
-রামেশ্বরের শিক্ষা অনুযায়ী জন্মকাল হতেই আপন অস্ত্রসহ এ পৃথিবীতে একজন নারীর আগমন ঘটে।প্রয়োজন শুধু দৈহিক লজ্জা জলাঞ্জলি দেওয়ার....দেহ আমার দুর্বলতা নয় মা,শক্তি!আর সেই....

নলিনীদেবীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে দীপ্তকণ্ঠে সমগ্র প্রশ্নের জবাবদিহি করছিলেন রাজকুমারী পর্ণা।কন্যার সামান্য অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়েই,অদূরে মেয়ের পশ্চাতে দন্ডায়মান প্রহরীর উদ্দেশ্যে ইঙ্গিত করলেন নলিনীদেবী।সেই মুহূর্তেই পর্ণার দিকে ধেয়ে এলো একটি সুতীক্ষ্ণ বর্শা।জাগ্রত হলো পর্ণার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়।স্থান পরিবর্তনপূর্বক আত্মরক্ষা করে,নলিনীদেবীর বক্ষদিকে ধেয়ে আসা ওই বর্শা ডান হাতে ধরে,নিমেষেই বাম হাতেই আবার ফিরিয়ে দিলেন প্রহরীর উদ্দেশ্যে।প্রহরী আত্মরক্ষায় সমর্থ হলে,তার কেশাগ্র স্পর্শ করে ওই বর্শা সুনিপুণভাবে প্রোথিত হলো ধরিত্রীর বুকে।যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে পশ্চাৎ হতে ধেয়ে আসা শত্রুর অনাকাঙ্খিত আক্রমণকালে কন্যার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের অকস্মাৎ জাগরণ,তাদের সুনিপুণ ব্যবহার ও পর্ণার সব্যসাচী রূপ দেখে যারপরনাই আল্লাদিত হলেন নলিনীদেবী।স্মিতহাস্যে জিজ্ঞেস করলেন তিনি,

-অন্তিম প্রশ্ন!তোমার বিচারে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি কি পর্ণা?

অতর্কিত বর্শা নিক্ষেপ হতে আত্মরক্ষা করে,সেই মুহূর্তে অতিকষ্টে ক্রোধ সংবরণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন পর্ণা।কিন্তু মহারানির অন্তিম প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হয়ে,আগ্নেয়গিরির সহসা অগ্নুৎপাত ঘটলো।প্রবল তেজে ক্ষুধার্ত বাঘিনীর ন্যায় কোমরবন্ধ হতে ছুরিকা উন্মুক্ত করে রণহুঙ্কার দিয়ে উঠলেন সপ্তপর্ণী,

-মৃত্যু!!বিশ্বাসঘাতকতার একটাই শাস্তি!সমগ্র রাজ্যবাসী,আমার পরম বিশ্বস্ত,আমার প্রাণাধিক প্রিয় সঙ্গী বৃন্দাসহ,মায়াকাননের সকলে জেনে রাখুন,মহারানি সপ্তপর্ণীর বিচারে বিশ্বাসঘাতকতার একমাত্র শাস্তি মৃত্যু!!বিশ্বাসঘাতকের কোনো ক্ষমা নেই!

রাজকন্যার এমনতর হুঙ্কারে স্তব্ধ সমগ্র রাজসভা।পর্ণা আপনার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারালে,রামেশ্বর অতিশয় আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন।বাক্যহারা নলিনীদেবীও।তারপরই সহসা সেইরূপ কঠোর বাক্য রানির মুখ হতে নির্গত হলো,যা কল্পনা করেই রামেশ্বরের মনে ভীতিসঞ্চার হয়েছিলো....
 
-পর্ণা!!মহারানি সপ্তপর্ণী কে?মহারানি কে পর্ণা?!রাজমুকুট তো এই ক্ষণেও আমার মাথার শোভাবর্ধন করছে।
-ক্ষমাপ্রার্থী মা।ক্রোধের বশে....
-অন্ধ ক্রোধ এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত অহংকার পতনের কারণ পর্ণা।স্বাধীন রাজ্যের একজন মহারানির এমনতর সূক্ষ মুহূর্তে আত্মনিয়ন্ত্রণ হারানো অনভিপ্রেত ও অত্যন্ত লজ্জাজনক।এইরূপ রূঢ়বাক্য ব্যবহারের পর ক্ষমার কোনো অবকাশই নেই।ক্রোধের বশে নেওয়া সিদ্ধান্ত কিংবা আবেগের বশে ঘটিয়ে ফেলা কোনো ঘটনার প্রভাব কেবলমাত্র তোমার ব্যক্তিজীবনের ওপর নয়,সমগ্র রাজ্যের পক্ষেই আগামী দিনে অমঙ্গলজনক হয়ে উঠতে পারে।রাজ্যের রানি স্থির মস্তিষ্কে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসমর্থ হলে,রাজ্য মুহূর্তেই হবে পরাধীন।পড়বে শত্রুর কবলে।অনতিবিলম্বেই মায়াকাননের স্বকীয়তা ধ্বংস হবে।সেই হেতু সমস্ত বিষয় বিচারপূর্বক,আমি তোমাকে এই শুভলগ্নেই রাজ সিংহাসনের অধিকার হতে বঞ্চিত করলাম।সিংহাসনের অধিকার হতে তুমি এই ক্ষণে বিচ্যুত হলে পর্ণা....
-মা!!
-মহারানি নলিনী বলে সম্ভোধন করো আমায়!আমি এ রাজ্যের রানি!!

অবনত মস্তিষ্কে নীরবতাকে আশ্রয় করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সপ্তপর্ণী।পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তৎপর হলেন রামেশ্বর....

-কন্যাকে ক্ষমা করুন মহারানি।কিন্তু এতবড় সিদ্ধান্ত সহসা গ্রহণ করবেন না।
-শাস্তি তোমারও প্রাপ্য রামেশ্বর।যুদ্ধশাস্ত্র পাঠ ও অনুশীলন একজন প্রকৃত রানি হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়।মতি স্থির হওয়া আবশ্যক।আপন আবেগ,অহংকার,
ক্রোধ,কাম,ইচ্ছা,প্রেম,এই সমস্ত বিষয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।পর্ণার শিক্ষার সেই অধ্যায় এখনও অসম্পূর্ণ।অপরিণত পর্ণার ওপর এই মুহূর্তে রাজ্যভার প্রদান করা সমীচীন নয়।এমন চরম মূর্খামি আমার দ্বারা অসম্ভব।এ বিষয়ে আমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত!
-তবে কি রাজকুমারী পর্ণা আর এই সিংহাসনের উপযুক্ত করে নিজেকে প্রমাণ করার দ্বিতীয় কোনো সুযোগ....
-অবশ্যই পাবে।আগামী দুই বৎসরকাল সময় ব্যাপী তাকে নিয়মিত যোগাভ্যাস করতে হবে।আপন মস্তিষ্কের ওপর,আপন সিদ্ধান্তের ওপর,আপন ক্রোধের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।উপযুক্ত সময়ে,রাজ্যের প্রয়োজনে,যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি,এমনকি শত্রুশিবিরে চতুর্দিক হতে শত্রুর ঘেরাটোপে বন্দিনী থেকেও,শীতল মস্তিষ্কে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার প্রভূত ক্ষমতা তাকে অর্জন করতে হবে।অস্থিরমতি,অহংকারী অবোধ বালিকার অধীনে মায়াকাননের এই রাজ সিংহাসন কলুষিত হোক,এমনটা কাম্য নয়।দুই বৎসর সময়কাল অতীত হওয়ার পর,পুনরায় পরীক্ষাপূর্বক,পর্ণা যদি নিজেকে এই সিংহাসনের উপযুক্ত প্রমাণ করতে পারেন,তবেই রাজমুকুট তার মাথায় জ্বলজ্বল করবে।অন্যথায় আমি পরবর্তী রানি নির্ধারণের জন্য প্রজার কাছে উন্মুক্ত আবেদন জানাতে আগ্রহী।পর্ণা?
-আদেশ করুন মহারানি!
-মাত্র দুটি বছর সময় আছে।প্রস্তুত করো নিজেকে।
-আপনার এই সিদ্ধান্ত আমি নতমস্তকে গ্রহণ করলাম।আপনার আদেশ শিরোধার্য!

মৃদু গুঞ্জন ও বিপুল হতাশার মধ্যে দিয়ে মনক্ষুণ্ণ হয়ে,রাজসভা পরিত্যাগ করে সকল প্রজা প্রস্থান করলো আপন গৃহে।উৎসবমুখর আমেজ হলো ম্লান।পর্ণা একরাশ অভিমানকে আপন হৃদয়ে প্রোথিত করে,মায়ের আদেশপূর্বক অগ্নির পিঠে চেপে বসলেন....বৃন্দা তার সঙ্গে অগ্রসর হতে চাইলে,বাধা দিলেন পর্ণা....একাকী হারিয়ে গেলেন ধূলিঝড়ের আঁধারে....

অন্ধকার রজনী।কক্ষের উপরিভাগের উন্মুক্ত অংশে একাকিনী দাঁড়িয়েছিলেন সপ্তপর্ণী।দিগন্তবিস্তৃত নভোমণ্ডলে অসংখ্য নক্ষত্র জ্বলছে।সেই নক্ষত্রের ঔজ্জ্বল্য পর্ণার শীতল অভিমানী দেহকে উষ্ণ রাখতে অক্ষম হলেও,বড়ই দৃষ্টিনন্দন।নিরালোক অন্তরীক্ষের প্রতি দুর্বল দৃষ্টি মেলে চেয়েছিলেন পর্ণা।আপন হস্ত প্রসারিত করে প্রতিটি নক্ষত্রকে কাল্পনিক রেখায় সংযোজিত করে,প্রাণদান করার বৃথা প্রয়াস করতে লাগলেন রাজকুমারী।কাল্পনিক রেখা কখনও জন্ম দিলো একটি নিষ্পাপ বানরশিশুর,কখনও বা বৃহদাকার মহীরূহের,কখনও এক রাজনর্তকীর।স্মিতহাস্যে সজল চক্ষে মহাশূন্যের চিত্রপটে আঁক কেটে,পর্ণা নিখুঁতভাবে অঙ্কন করলেন রাজ তরবারির সুতীক্ষ্ণ ফলা।পরক্ষণেই ইতস্তত বিক্ষিপ্ত নক্ষত্ররা জন্ম দিলো রত্নখচিত রাজমুকুটের।কল্পনার জগতে ভেসে দুই চক্ষু মুদে ওই রাজমুকুট মাথায় পরিধান করলেন রাজকন্যা।আপন ভুল সংশোধনের বৃথা প্রচেষ্টা করতে লাগলেন।অশ্রুসজল নেত্র চরম অবাধ্যতা করতে লাগলো।ক্ষীণকণ্ঠে কেঁদে উঠলেন পর্ণা।সেই চাপা ক্রন্দনধ্বনি উপলব্ধি করার জন্য,সম্মুখে একজন প্রিয়জনকেও পর্ণা পেলেন না।তিনি শূন্যদৃষ্টিতে একাকী চেয়ে রইলেন তিমির ছায়ালোকের পানে।অদূরেই মায়াকাননের সীমানায় সুবিশাল গম্বুজাকৃতি অন্তিম দুর্গসীমা দৃশ্যমান।রাত্রি জাগরণে প্রহরীদ্বয় ক্লান্ত।প্রহরী পরিবর্তনের সময় হলো বুঝি!সেনাছাউনি হতে বর্শাসম্বলিত দুটি ছায়াশরীর অগ্রসর হলো দুর্গদ্বারের পানে।দুর্গদ্বার অতিক্রম করে সুদূর দিগন্তরেখায় দৃষ্টিপাত করলেন কন্যা।নিবিড় অরণ্য যেথায় অন্তরীক্ষ স্পর্শ করেছে।গগনচুম্বী হিমশৈল পর্বতমালা ও তার পাদদেশ বেষ্টিত তমসাবৃত বনস্পতির রাত্রিকালীন সৌন্দর্য,পর্ণাকে অতিশয় মুগ্ধ করলো।মনে জাগলো একাধিক প্রশ্ন।কেন এই মায়াকাননের মায়াজালে আবদ্ধ তারা?এই রাজ্য ব্যতীত বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে কেন রাজপরিবারের ঘোরতর আপত্তি!এই সামান্য পরিসরের রাজ্যের অন্দরে,বংশপরম্পরায় কেন আপনাকে বন্দিনী রাখেন মায়াকাননের রানিরা?এ রাজ্যের শিক্ষায়,শাস্ত্রপাঠে,
অভ্যাসে,অনুশীলনে...সর্বত্রই আত্মরক্ষা এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেন?রাজ্যবিস্তার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার কোনো সুযোগ নেই কেন?রাজ্যবিস্তারের প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হয় না কেন?আজ একটিমাত্র ব্যর্থতার পর শতশত ভাবনারা মস্তিষ্কের বেড়াজাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসছিলো বাইরে।অস্থির মনে সেই সকল প্রশ্নের উত্তর হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন পর্ণা।মৃদুমন্দ বাতাস পর্ণার দেহ ও উন্মুক্ত কেশাগ্র স্পর্শ করে সুদূর মায়াকাননের দুর্ভেদ্য বনানীর উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলো....পর্ণার উদ্বেলিত হৃদয় ওই বাতাসের পিছু-পিছু ছুটলো অজানার উদ্দেশ্যে....

-পর্ণা!

মায়ের আহ্বানে তৎক্ষণাৎ অশ্রুসিক্ত চক্ষুদ্বয়ের ওপর আপন হস্ত সঞ্চালন করে,ফিরলো পর্ণা।

-মা!
-মন অস্থির?হৃদয় অবাধ্য?আমার সিদ্ধান্তে কি তুমি আহত পর্ণা?
-না!রাজ্যের মঙ্গলের কারণে যা সঠিক,তাই গ্রহণীয়।আমি তোমার সিদ্ধান্তের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সম্মত।আমার কিছুটা সময় প্রয়োজন।আত্ম নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা প্রয়োজন।
-যথার্থই।মানসিক দৃঢ়তার অভাব থাকলে,রাজকার্যে বিঘ্ন ঘটতে পারে।সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে তোমার দুর্বল মন বিচলিত হতে পারে।এই সাময়িক ব্যর্থতাকে দুর্বলতা নয় পর্ণা,আপন শক্তি হিসেবে বিবেচনা করাই বুদ্ধিমত্তার পরিচয়।নিজেকে পুনরায় প্রস্তুত করো।আপনার মন ও রাজ্য সম্পর্কিত সকল বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়াটা....
-মা!থাক না রাজ্যের কথা।রাজপরিবারের কথা!রাজ মুকুটের কথা!প্রকৃতি কেমন সুন্দররূপে সজ্জিত দেখো!আঁধার রাতের এমন মনোরম চোখজুড়ানো রূপ আমি পূর্বে দেখিনি মা!ও কি!শৃঙ্খলে আবদ্ধ ও কি প্রাণী?

দুর্গদ্বারে দৃষ্টিপাত করে রানি দেখলেন,একজন প্রহরী বলপূর্বক দুটি জীবকে সেনাছাউনির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।ব্যস্ত না হয়ে ধীরকণ্ঠে নলিনীদেবী বললেন,

-ও কোনো শম্বর দম্পতি বুঝি!ক্ষুধার্ত সেনাবাহিনীর আহারাদির উপলক্ষ্যে বন্দী!আগামীকালই ছাউনিতে নৃত্যগীতের বড় উৎসব হবে!আগুনে ঝলসানো সুস্বাদু মাংস,সৈনিকদের উদরে প্রবেশ করবে।
-মৃগ দম্পতি!!
-পথভুলে মায়াকানন ছেড়ে লোকালয়ে এসে পড়ায় এই বিপত্তি।তোমার ভাবনার কোনো কারণ নেই!অকারণে মন ও মস্তিষ্কের ওপর নির্যাতন অপ্রয়োজনীয়।

বহিরঙ্গে নির্দয়-কঠিন,অন্তরে কোমল হৃদয়ের অধিকারিণী পর্ণার ব্যথিত মন,ওই অসহায় মৃগ দম্পতির মর্মান্তিক পরিণতির কথা কল্পনা করে বড়ই অস্থির হয়ে উঠলো।সেই অনুভূতি আপন হৃদয়ে গোপন রেখে,প্রসঙ্গ পরিবর্তনে সচেষ্ট পর্ণা অতিশয় কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

-মা!গত কয়েক প্রহর যাবৎ কয়েকটা প্রশ্ন আমাকে অস্থির করে তুলছে।
-আমাকে জিজ্ঞেস করো।সম্ভব হলে আমিই তোমার কৌতূহল নিবারণের কারণে সেই প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণ করবো।
-ওই মায়াকাননের অভ্যন্তরে মনুষ্যবসতি নেই কেন?ওই অরণ্য কি সত্যিই অভিশপ্ত?নাকি এ কেবল লোকমুখে প্রচারিত!মা আমরা রাজ্যবিস্তারের কথা কখনও ভাবি না কেন?কূপমন্ডুকের মতো একটিমাত্র রাজ্যে....
-এই সমস্ত প্রশ্নের একটাই মাত্র উত্তর কন্যা!
-কি!
-সপ্তপর্ণী!
-আমি এইসকল প্রশ্নের উত্তর!অর্থাৎ?
-মাত্র দুশো বছর আগেও এ রাজ্যের রূপ সম্পূৰ্ণ ভিন্ন ছিলো।সেই সময় পর্যন্ত মায়াকাননের রাজ সিংহাসন কোনো নারীর স্পর্শ লাভ করেনি।কিন্তু আমাদের রাজপরিবারের এক পূর্বপুরুষের অনাবশ্যক জেদের কারণে ধ্বংস হয়ে যায় মোহরকুঞ্জ।
-মোহরকুঞ্জ?
-এই মায়াকাননের পূর্বনামই মোহরকুঞ্জ!
-মোহরকুঞ্জ মায়াকাননে রূপান্তরিত হলো কিরূপে?
-দীর্ঘ সে কাহিনী!
-আমি জানতে আগ্রহী মা....

কৃষ্ণকায় দুর্ভেদ্য মায়াকাননের পানে ভীত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মহারানি নলিনীদেবী শুরু করলেন,মোহরকুঞ্জের অতীত বৃত্তান্ত....

(চলবে)

ছবি : সংগৃহীত




বুধবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

সপ্তপর্ণী (প্রথম খণ্ড) প্রথম পর্ব


 


সপ্তপর্ণী


সাথী দাস


প্রথম খণ্ড

প্রথম পর্ব



দুর্ভেদ্য অরণ্য পেরিয়ে সুউচ্চ পর্বতমালাবেষ্টিত যে মায়ারাজ্য অবস্থান করছে প্রায় পাঁচ শতাধিক বৎসরেরও অধিক সময়কাল ধরে,সেই রাজ্যের বর্তমান নাম মায়াকানন।তিনদিক হতে মায়াকানন দ্বারা বেষ্টিত এই রাজ্যের সীমানায় অবস্থিত গগনচুম্বী হিমশৈল পর্বতমালা।লোকমুখে বহুল প্রচারিত,পূর্বে মায়াকানন যখন তার স্বাভাবিক সবুজায়ন হারিয়ে,প্রস্তুতি গ্রহণ করতো প্রবল শৈত্যপ্রবাহের জন্য,সেই সময়ে ওই পর্বতের চূড়া সজ্জিত হয়ে উঠতো শীতল শ্বেতশুভ্র হিমকণায়।তবে দীর্ঘ কয়েক বৎসর যাবৎ রাজ্যবাসী প্রবল শৈত্যপ্রবাহ ও তুষারপাতের আনন্দ হতে বঞ্চিত।বাণিজ্যের কারণে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সামান্যতম আলাপচারিতার হেতু,মায়াকাননের অভ্যন্তরভাগে রয়েছে একটি সুদীর্ঘ সেতু ও কয়েকটি ক্ষুদ্র-বৃহৎ গুপ্তসাঁকো।পার্শ্ববর্তী রাজ্যের সঙ্গে মায়াকানন আলাপে নিতান্তই অনাগ্রহী।গহীন অরণ্য,পর্বতমালা ও একাধিক দুর্ভেদ্য সবুজের সমারোহ ব্যতীত,মৃতদেহের ন্যায় শীতল প্রস্তরনির্মিত সুবৃহৎ দুর্গ শত্রুপক্ষের দৃষ্টি হতে প্রতিনিয়ত এই রাজ্যকে রক্ষা করে চলেছে।মনুষ্যসৃষ্ট দুর্গের অতীন্দ্রিয় প্রহরা ছাড়াও,উন্মত্ত-খরস্রোতা রুদ্রাণী নদী,পার্বত্য ঝর্ণা ও সুদৃশ্য জলপ্রপাত দ্বারা প্রকৃতি স্বয়ং এই মায়াকাননকে বহিরাগত শত্রুর অনাকাঙ্খিত আক্রমণ থেকে অনন্তকাল ধরে রক্ষা করছে।তবে স্বপ্নসম এই রাজ্যের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও খনিজ সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বহু সওদাগর,রাজা-যুবরাজ ও রথী-মহারথীরা পূর্বেই এই রাজ্যের অভ্যন্তরে পদার্পন করার বিপুল প্রচেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছেন।বংশপরম্পরায় মহারানীদের কড়া নিরাপত্তা,করজোড়ে অনুরোধ ও নির্দেশ উপেক্ষা করে কোনো পুরুষের পক্ষেই ওই রাজ্যের অন্দরমহলে,রানির অনুমতি ব্যতীত প্রবেশ করা সম্ভবপর হয়নি।হয়েছে ক্ষুদ্র-বৃহৎ মতান্তর, বাকবিতন্ডা ও যুদ্ধবিগ্রহ।কিন্তু বংশানুক্রমে আপন সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন সকল রানিই।সেই হেতু মেঘলোকের আড়ালে চিরকালই অনাবিষ্কৃত মায়ারাজ্য হয়েই রয়ে গেছে মায়াকানন।মাতৃতান্ত্রিক এই রাজ্যের বর্তমান রানি পূর্ণগর্ভা নলিনীদেবী।কিন্তু অত্যধিক ভীতি,অনিচ্ছাকৃত দুশ্চিন্তা ও উত্তেজনার কারণে,নলিনীদেবীর মাতৃত্বের সকল আনন্দ হয়েছে গৌণ।সুউচ্চ প্রাসাদের এক প্রান্তে একাকিনী দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের রক্তিম সৌন্দর্য উপভোগ করছিলেন তিনি।পরিচারিকা এসে দাঁড়ালো অনতিদূরেই....

-মহারানী!আপনি সান্ধ্য ভোজনে....

হাতের অস্থির ইশারায় সর্বক্ষণের সঙ্গিনী প্রিয় পরিচারিকাকে তখনকার মতো বিদায় দিলেন নলিনীদেবী।সমগ্র মায়াকানন সেজে উঠেছে বিদায়কালীন সূর্যের রক্তাভ আভায়।প্রাসাদের কিনারে,দুর্গের চূড়ায়,মায়াকাননকে ঘিরে প্রবাহিত হওয়া পবিত্র রুদ্রাণী নদীর চঞ্চলা ঢেউয়ের ওপরও,নিভে আসা সূর্যের ক্ষীণ ও শান্ত সৌন্দর্য বিরাজমান।অদূরবর্তী মন্দির হতে ভেসে আসছে সন্ধ্যারতির ঘণ্টাধ্বনি।মহাভৈরবীর করাল কালো হিংস্র উলঙ্গ রূপের আরাধনায় মত্ত মন্দিরের অজস্র পূজারিণী।মন্দিরে বহু ভক্তের সমাগম হয় এই সন্ধ্যারতি কালে।মৃদুমন্দ বাতাস রানিকে স্পর্শ করে পুনরায় প্রস্থান করছে অজানার উদ্দেশ্যে।উষ্ণ বাহুবন্ধনে নলিনী স্পর্শ করলেন আপন গর্ভ।অষ্টম বার গর্ভধারণের পর থেকেই বড় মায়ায় জড়িয়েছেন রানি।আপন হাতে একে-একে সাতটি পুত্রসন্তানকে হত্যা করে,অত্যন্তই ব্যথিত উনি।আপন দুই হস্ত আপনার পুত্রের রক্তেই রাঙা।প্রতিবারই প্রসূতিগৃহের অভ্যন্তরে ওনাকে শুনতে হয়েছে সদ্যোজাত পুত্রসন্তানের ক্রন্দনধ্বনি।মহারানি হওয়ার কারণে,রাজ্য ও রাজ সংবিধানকে অস্বীকার করে,রাজপরিবারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি।রাজদ্রোহ তার রক্তে নেই।তাই উনি পাষাণ হৃদয়ে আপন পুত্রদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছেন।সাতটি মৃতদেহের স্থান হয়েছে সবুজাভ পর্ণশয্যায়।প্রাসাদের অদূরবর্তী মায়াকাননের অভ্যন্তরে,পাথুরে মৃত্তিকার গভীরে চিরঘুম বরণ করেছে সাতটি সদ্যোজাত রাজপুত্র।মহারানির অষ্টম গর্ভের সূচনাকালে এক পূর্ণিমা রাতে কুমারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে রানি যখন আবিষ্ট,সেই স্পর্শকাতর মুহূর্তেও স্বামীর প্রশ্নের উত্তরে নলিনীদেবী জানিয়েছিলেন,এই সন্তানও যদি পুত্র হয়,তবে একেও ধরিত্রী পরম সমাদরে স্থান দেবে আপন বুকে।বৃহদাকার সবুজ পর্ণ-আবরণ কীটপতঙ্গের দংশন থেকে সাময়িকভাবে রক্ষা করবে সদ্যোজাতের প্রাণহীন দেহ।নলিনীর কথা শুনে কিছুকাল স্তব্ধ হয়ে ছিলেন পিতৃমাতৃহীন ওই পুরুষ!এই রাজ্যে ক্রীতদাসের মতোই পুরুষ ক্রয়-বিক্রয় চলে।কখনও গৃহকর্মের কারণে,কখনও সেনাবাহিনীতে বা রাজকার্যে লোকবলের প্রয়োজনে,আবার কখনও বা রাজপরিবারের অন্তর্ভুক্ত রানির বিশেষ পরিচারিকাবৃন্দের কামতৃষ্ণা নিবারণে।মহারানি নলিনীদেবী আপন স্বয়ম্বর সভার একেবারে অন্তিম পর্বে যে তিনজন যুবরাজকে নির্বাচন করেছিলেন,তাঁরা সকলেই বাক্য প্রদানের সময়কালে রানির প্রথম ও প্রধান শর্ত অস্বীকার করেন।রানিকে বারংবার অনুরোধ করেন বিবাহ পরবর্তী সময়ে তাঁদের রাজ্যে সশরীরে গিয়ে নিশ্চিন্ত ও বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে।মায়াকাননের প্রতি মহারানির সমস্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য সেই রাজ্যে থেকে পালন করার,সমগ্র আয়োজন তাঁরা করতে প্রস্তুত।বুঝেছিলেন নলিনীদেবী,তাঁর মাদকীয় রূপ,যৌবনের আহ্বান ও দৈহিক আবেদনের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়েই,যুবরাজ ত্রয়ীর এমন করুণ অনুনয় ও বিনয়।সেই সময় নলিনী আপন মুখাবয়বে বক্র হাসি এঁকে,সম্মানজনক ও সন্তোষজনক বাক্যের ব্যবহারে,প্রত্যাখ্যান করেন ওই তিন যুবরাজকে।এমনকি আপন রাজ্যে প্রস্থানের যাবতীয় সুব্যবস্থা করে দেন ওই তিন পাণিপ্রার্থীর।কিন্তু বিদায়ের প্রাক্কালে এক যুবরাজের ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত সর্বক্ষণের সঙ্গী,উপদেষ্টা এসে রাজকার্য চলাকালীন জনসমক্ষে নতজানু হয়ে আপন তরবারি নামিয়ে প্রেম নিবেদন করেন মহারানি নলিনীদেবীকে।এমনকি সম্মতি প্রদান করেন রানির সকল প্রকার শর্তে।ওই পুরুষ জানতেন,এই প্রেমে ব্যর্থ হলে এমন ধৃষ্টতা ও দুঃসাহসিকতার কারণে,যুবরাজ মায়াকাননের সর্বশেষ দুর্গদ্বার ত্যাগের পূর্বেই,এই রাজ্যের সীমানার মধ্যেই উন্মত্ত পশুর ন্যায় নির্মমভাবে বর্শাবিদ্ধ করে হত্যা করবেন তাকে।কিন্তু পরিণাম অবগত হওয়া সত্ত্বেও,তিনি আপনাকে বিরত রাখতে পারেননি।প্রেম নিবেদনের পর মহারানি নলিনীর পানে আকুল দৃষ্টিপাত করে,উনি অপেক্ষা করছিলেন বহিষ্কারের বা মৃত্যুদণ্ডের আদেশের জন্য।কিন্তু রানির সিদ্ধান্তে যারপরনাই চমৎকৃত হয়েছিলেন ওই পুরুষ।রানি তিন যুবরাজকে আপন রাজ্য অভিমুখে যাত্রা করিয়ে,ওনাকে এক পক্ষকাল ওই প্রাসাদের অতিথিশালায় বিশেষ আমন্ত্রণ রক্ষা করতে অনুরোধ করেছিলেন।এই এক পক্ষকাল সময়ে রাজ্যের পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে সকল বিষয় অবগত হন ওই কুমার।কিন্তু তার পরেও প্রথম যৌবনে পদার্পন করা ওই কুমারের,রানির প্রতি একনিষ্ঠ প্রেমের জোয়ারে কিছুমাত্র ভাঁটা পড়েনি।উপরন্তু উদগ্রীব হয়ে তিনি অপেক্ষা করেছিলেন, প্রেমের প্রস্তাবে রানির সম্মতির জন্য।সম্মতি প্রদানের পাশাপাশি,সেই শুভলগ্ন এসেছিলো অনতিবিলম্বেই।রাজপুরোহিতের পৌরোহিত্যে কুমার ও নলিনীদেবী বাক্য বিনিময় ও পরস্পরের নামাঙ্কিত অঙ্গুরীয় বিনিময়ের মাধ্যমে,পরস্পরকে আপন নারী-পুরুষ হিসেবে স্বঘোষিত উপমায়,বিবিধ স্বর্ণালঙ্কারে সম্মানিত করেন।রানি নলিনীর জীবনসঙ্গী রূপে নবজীবন পায় কুমার।আপন রাজ্যে রাজপরিবারের দাস হয়ে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ ব্যতীত,কুমারের কাছে ভিন্ন সদুপায় ছিলো না।মায়াকানন বড়ই আপন হয়ে উঠেছিলো কুমারের কাছে।সদ্যবিবাহিত জীবনে রানির প্রেমে ও রাজপ্রাসাদের পার্শ্ববর্তী নিবিড় যে অরণ্য,যার নামেই এই সুদৃশ্য রাজ্যের নামকরণ,সেই মায়াকানন ছিলো কুমারের প্রাণের ও প্রেমের একমাত্র স্থান।দীর্ঘ সময় ওই মায়াকাননের সবুজাভ আভায় ভ্রমণ করে,সিক্ত শিশিরভেজা ঘাসে আপন পদতল ভিজিয়ে,বা কখনও ঘোড়ার পিঠে চেপে ভ্রমণে,কুমার ব্যস্ত থাকতেন।বিবাহ পরবর্তী কয়েক পক্ষকাল অতিক্রম হওয়ার পূর্বেই,অন্দরমহলে শোনা গেলো কাঙ্খিত সুখ-সংবাদ।সন্তান সম্ভবা মহারানি নলিনী।ভগ্নস্বাস্থ্যের দরুণ রানির মাতৃবিয়োগ হয়েছে বহুকাল পূর্বেই।একাকিনী নলিনী রাজ্যের সকল দায়িত্ব ও দায়ভার সসম্মানে বহন করছেন বহুকাল যাবৎ।শারীরিক দুর্বলতা ও সাময়িক অসুস্থতার কারণে রাজকার্য হলো শিথিল।রাজবৈদ্যের পরামর্শে সামান্য বিশ্রামের অভিপ্রায়ে রানি অন্দরমহলে কিছুকাল যাপনের ফলে,সিংহাসন রইলো শুন্য।রাজ্যবাসী উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো একটি সুদর্শনা ও সুলক্ষণা রাজকন্যাকে স্বাগত জানানোর জন্য।কিন্তু রাজ্যবাসীর অপেক্ষা হলো দীর্ঘতর।রানির গর্ভ সাতটি পুত্র সন্তানের লজ্জায় লজ্জিত হওয়ার পর,অষ্টম বার গর্ভবতী হলেন নলিনী।দৃষ্টির সম্মুখে পাঁচটি সুস্থ নবজাতকের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর বাক্যহারা হয়েছিলেন কুমার।কিন্তু যে রাজ্যে রানির মুখনিঃসৃত একটি বাক্য সংবিধানের সমতুল্য,সেই রাজ্যের রানির স্বামী হয়েও,স্ত্রীর পোষ্য হয়েই দিন কাটে কুমারের।বিগত কয় বছরের মধ্যেই কুমার বুঝেছিলেন,এ রাজ্যে পুরুষের প্রয়োজন কেবলমাত্র কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার স্বার্থে।রাজনীতি,অর্থনীতি,কূটনীতি এমনকি যুদ্ধবিগ্রহেও নারীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।স্তব্ধ হয়েছিলেন কুমার।তবে আপন সন্তানদের পরিণতি দেখে,জীবন্ত অবস্থায় মৃত্যুর সমান যাতনা পেয়েছিলেন তিনি।রানির অষ্টম গর্ভাবস্থায় যখন একজন মায়ের মুখে পুনরায় শুনেছিলেন অনাগত সন্তানের ভবিতব্য,কুমার আর সইতে পারেননি।দক্ষ অশ্বারোহীর ন্যায় ঘোড়ার লাগাম ধরে রাতের অন্ধকারেই কুমার অদৃশ্য হয়ে যান দুর্গম মায়াকাননের অভ্যন্তরে।বিস্তর অন্বেষণের পর ফিরে পাওয়া যায় আরোহী বিহীন ঘোড়াটিকে।কিন্তু কুমার হয়ে যান নিরুদ্দেশ।রাজ্যের সামগ্রিক নিরাপত্তার কারণে সীমানার বাইরে অধিক অন্বেষণ সম্ভবপর না হওয়ায়,অন্বেষণ কার্য কিঞ্চিৎ শিথিল হয়েছিলো।অতঃপর কুমারের জন্য দুশ্চিন্তায় যখন রানীর স্বাস্থ্য অতিশয় ভগ্ন,সেই সময় দুর্গম জঙ্গলের ভিতরভাগ হতে আবিষ্কার করা হয় কুমারের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ।সেই ছিন্নভিন্ন পুরুষদেহ সম্পূর্ণরূপে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।বন্য জন্তুর ক্ষুধা নিবারণের কারণে,দেহের বেশিরভাগ অংশই হয়েছিলো অদৃশ্য।মৃতদেহের বাম হাতের অনামিকায় নলিনীদেবী কর্তৃক প্রদত্ত 'নলিনী' নামাঙ্কিত একটিমাত্র বহুমূল্য অঙ্গুরীয়র কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়,এই মানুষই রানির প্রাণপুরুষ।গর্ভাবস্থায় এমন হেন একটি দুঃসংবাদেও ভেঙে পড়েননি নলিনীদেবী।স্বভাবসিদ্ধ চারিত্রিক দৃঢ়তায় আগলে ধরেছিলেন আপনার গর্ভ।দুর্বল মনকে প্রস্তুত করেছিলেন।অন্তরে-অন্তরে ক্রুররূপে হয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলেন আপন অনাগত পিতৃহীন সন্তানের হন্তা।মনের গহীন চলছিলো শতাধিক রাজনীতি ও কূটনীতি।মায়াকাননের সংবিধান অনুসারে রাজরক্ত যে নারীর শরীরে প্রবাহিত হবে,একমাত্র সেই হবে রাজসিংহাসনের উত্তরসূরী।দুর্ভাগ্যবশত রানি যদি কন্যাসন্তান ধারণে অক্ষম হন,বা মৃত সন্তান প্রসব করেন,অথবা কোনো দুর্ঘটনায় রাজকন্যা নিহত বা আহত হন,সেইক্ষেত্রে সেই রাজকন্যা যদি নিজেকে সিংহাসনের উপযুক্ত প্রমাণ করতে না পারেন,তবে রাজ্যে শুরু হবে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও গৃহযুদ্ধ।সিংহাসনের অধিকারের জন্য আপনাকে প্রমাণ করার যুদ্ধ।সাধারণ প্রজার মধ্যে থেকে যে নারী নিজেকে ওই সিংহাসনের উপযুক্ত প্রমাণ করতে সমর্থ হবেন,তিনি এবং বংশপরম্পরায় তাঁর উত্তরসূরীই হবেন মায়াকাননের সিংহাসনের উত্তরাধিকারিণী।এমতাবস্থায় স্বয়ং রাজপরিবারও নতুন রানির আশ্রয়ে জীবনধারণ করবে।চিন্তিত রাজ্যবাসী সাতটি রাজপুত্র জন্মের দুঃসংবাদের সঙ্গে,রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়েও যে মৃদু গুঞ্জন শুরু করেছে,সেই সংবাদ ছদ্মবেশী সংবাদদাতা কর্তৃক নলিনীদেবীর কর্ণকুহরেও প্রবেশ করেছে।গর্ভের অন্তিম সন্তানকে আঁকড়ে ধরে ওই সন্ধ্যায় অজস্র অশ্রু বিসর্জন করলেন নলিনীদেবী।অত্যন্তই ভীত হয়ে পড়লেন শুন্য সিংহাসন ও রাজ্যের চরম অরাজক অবস্থার কথা কল্পনা করে।ইতিহাস মিথ্যে বলে না।যে পারিবারিক লোকগাথা শুনে নলিনীদেবী নিজেও শৈশব ও যৌবনকাল পেরিয়ে এসেছেন,তা অবশ্যই সত্য হবে।অষ্টম গর্ভের এ সন্তান কন্যা না হয়ে যায় না!নতুবা....আর চিন্তা করতে পারেন না রানি।অদ্ভুত এক মানসিক অস্থিরতায় দেহ শিথিল হয়ে পড়ে।ঘনঘোর সন্ধ্যা নামলো মায়াকাননে।দূরের দুর্ভেদ্য অরণ্য থেকে ভেসে আসছে অজানা হিংস্র পশুর কোলাহল ও কর্কশ কেকাধ্বনি।পরিচারিকার বারংবার আহ্বানে আপন বিলাসবহুল কক্ষে প্রবেশ করলেন রানি....

এক পক্ষকাল অতিক্রান্ত হলে,তীব্র উষ্ণতার পর রাজ্যের আকাশে ভারী মেঘের ঘনঘটা।প্রথম বর্ষার আগমনে প্রকৃতি সজ্জিত অনন্য রূপে।ঘন কালো দৈত্যের ন্যায় মেঘমালা সারি দিয়ে অগ্রসর হয় রাজপ্রাসাদের দিকে।বর্ষার প্রারম্ভে প্রথম বৃষ্টির স্পর্শে উত্তাল রুদ্রাণী নদী।ঝোড়ো বাতাসের সঙ্গে দুর্দমনীয় চোরাস্রোত আছড়ে পড়ছে জলের উপরিভাগে।নদীর দুকূল প্লাবিত।ঝড়ের প্রবল উন্মাদনায় মহাভৈরবীর মন্দিরের ঘন্টা সশব্দে দোদুল্যমান।নগরের উপকণ্ঠে গৃহস্থের লণ্ঠন প্রায় নিভে এসেছে ঝড়ের দাপটে।মৃত্যুপুরীর মতো নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে নিমজ্জিত সমগ্র মায়াকানন।সবুজ অরণ্যের সুবিশাল বৃক্ষরাজি উন্মাদ হস্তিনীর ন্যায় প্রবল আক্রোশে আছড়ে পড়ছে পরস্পরের উপর।বিকট শব্দে সমূলে উৎপাটিত অজস্র প্রাচীন বৃক্ষ।একাধিক নীড়হারা বিহঙ্গ কিঞ্চিৎ আশ্রয়ের সন্ধানে দিশেহারা।ঝড়ের প্রকোপে ও রুদ্ররূপী প্রকৃতির তান্ডবে,মহারানির তীব্র ক্রন্দনধ্বনি বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে।রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে মর্মান্তিক প্রসববেদনা সহ্য করে প্রসূতিগৃহের কঠিন শয্যা আঁকড়ে অশ্রু বিসর্জন করে চলেছেন মহারানি নলিনী।তীব্র যন্ত্রণায় উনি ধরলেন প্রৌঢ়ার শীতল হাত....আর্তস্বরে বললেন,

-মা!আর যে সইতে পারি না।আমার মৃত্যু অবধারিত!
-না মা!আমি নিশ্চিত।এ সেই!উত্তাল প্রকৃতি জানান দিচ্ছে তারই আগমনবার্তা।আপনি তাকেই জন্ম দিচ্ছেন,যে ইতিহাস সৃষ্টি করবে।একটু কষ্ট তো হবেই রানিমা!সব শুভ হবে।আর স্বল্প অপেক্ষা,সামান্যই যাতনা....

উন্মত্ত প্রকৃতির ভয়াল রূপের সঙ্গে পরিচিত হয়ে,মায়াকাননের হিংস্র প্রাণীসকল আশ্রয় নিয়েছে অরণ্যের সর্বাপেক্ষা নিরাপদ স্থানে।হিংস্র পশুর সদ্যোজাত শাবকগুলি ক্রীড়াকর্মে দিয়েছে সাময়িক বিরতি।মাতৃদেহের উষ্ণতায় আশ্রয় নিয়ে,ভয়ার্ত চক্ষু মেলে কম্পিত হৃদয়ে দেখছে প্রকৃতির এই তান্ডবলীলা....

-মা গো!
-আর কিছুক্ষণ মা!

বাতাসের দাপটে প্রসূতির কক্ষের সমস্ত আলো প্রায় নিভন্ত।পরিচারিকা একটিমাত্র আলো আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে কম্পিত কলেবরে।ছায়াঘেরা পরিবেশে গর্ভযন্ত্রণায় জ্ঞান হারানোর উপক্রম হলো ঘর্মাক্ত নলিনীর।অভিজ্ঞ প্রৌঢ়া মায়ের নাড়ি ছুঁয়েই বুঝলেন,দীর্ঘ সময়কাল যাবৎ এ যাতনা রানি সইতে পারবেন না।দ্রুত ব্যবস্থা নিলেন উনি।অন্তিমবারের মতো আর্ত-চিৎকার ভেসে এলো নলিনীদেবীর কন্ঠ চিরে।অতঃপর কেবল মায়ের গোঙানির শব্দ ও শিশুর ক্রন্দনধ্বনি বিরাজ করলো ওই কক্ষে।সন্তানকে মাতৃগর্ভ হতে পৃথক করতে,ধারালো ক্ষুর হাতে প্রস্তুত হলেন প্রৌঢ়া....

প্রবল রক্তক্ষয় স্বীকার করে,নিতান্ত ভগ্নস্বাস্থ্যেই ওই প্রৌঢ়ার সাহায্যে অষ্টম সন্তানের জন্ম দিলেন মায়াকাননের মহারানি।ইতিমধ্যেই তীব্র যন্ত্রণায় বার দুয়েক মূর্ছা গেলেন রানি।অতঃপর পরিচারিকার তৎপরতায় জ্ঞান ফিরলে ক্ষীণস্বরে জানতে চাইলেন ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত নলিনীদেবী,

-ধাই মা!কি হলো?দেখালে না?এবারও কি পর্ণশয্যা?আবারও মৃত্যু মা?বলো না!সব হারিয়েছি আমি?

রানির জ্ঞান ফিরতেই আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন সেই প্রৌঢ়া।রাজপ্রাসাদের আনাচে-কানাচে বেজে উঠলো শঙ্খধ্বনি।রক্তেস্নাতা একরত্তি কন্যাসন্তানকে রানির পাশে রাখলেন প্রৌঢ়া।

-রানি!এই সেই কন্যা,যার জীবনের মূল্য সাতটি পুরুষ নিজের জীবন দিয়ে পরিশোধ করেছে।পর্ণশয্যা আর নয় রানি!

দুর্বল দেহে শয্যা থেকে সামান্য উঠে আপন সন্তানকে বক্ষমাঝে জড়িয়ে কেঁদে ভাসালেন নলিনীদেবী।আপন কুমারকে,এমনকি সাতটি পুত্রের রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে সবেধন নীলমণি এই একটিমাত্র কন্যাসন্তান লাভ করেছেন উনি।রানি আদরে-সোহাগে ভরিয়ে দিলেন তাকে।রাজকন্যার ক্রন্দনধ্বনিতে তখন মুখরিত প্রাসাদের চতুর্দিক।কন্যার শুষ্ক কণ্ঠে মাতৃসুধা ঢেলে দিলেন রানি।কান্নার রেশ স্তিমিত হলো নবজাতিকার।ঝড়বাদলের রাতের অন্তিম প্রহরে,প্রকৃতির তাণ্ডবলীলা উপেক্ষা করে ওই সুসংবাদ রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়লো দাবানলের মতো।নবাগতার ক্রন্দনধ্বনিকে ছাপিয়ে গেলো রাজ্যবাসীর হর্ষধ্বনি।পর্ণশয্যারূপী অভিশপ্ত ভবিতব্যকে পরাজিত করে,সাতটি পুরুষের সমান তেজ সমৃদ্ধ একমাত্র রাজকন্যাকে মহাসমারোহে গ্রহণ করলেন রাজ্যবাসী।জন্মলগ্নের দুই পক্ষকাল পরে আনুষ্ঠানিকভাবে সেই শিশুকন্যার নামকরণ করা হলো,রাজকন্যা সপ্তপর্ণী।রাজসভার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে কন্যাকে বুকের উষ্ণতায় সগৌরবে জড়িয়ে বসেছিলেন নলিনীদেবী।অনতিবিলম্বেই রানি ও রাজকন্যা দাঁড়িপাল্লায় আরোহণ করলে,একই ওজনের সমান স্বর্ণালঙ্কার ও খাদ্যদ্রব্য রাজকোষ থেকে রাজ্যবাসীদের উদ্দেশ্যে বিতরণ করা হলো।রাজকন্যার আশীর্বাদীস্বরূপ রাজ্যবাসীর উপহারও উপছে পড়তে লাগলো রাজসভার বহির্বিভাগের নির্দিষ্ট স্থানে।কন্যাকে কোলে নিয়ে সিংহাসন অভিমুখে এগোলেন নলিনীদেবী।উন্নত হস্তে প্রজার উৎফুল্ল হর্ষধ্বনি থামাতে অনুরোধ করলেন।অতঃপর বললেন,

-রাজ্যবাসী আমার একমাত্র কন্যাকে সাদরে গ্রহণ করেছেন,আমি অত্যন্তই আনন্দিত।মায়াকানন তার উত্তরসূরী পেয়েছে।রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারিণী আজ আপনাদের সকলের সম্মুখেই রয়েছেন।কিন্তু দেহে,শিরা ও ধমনীতে রাজরক্ত থাকাই এই মায়াকাননের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়।তাকে এই সিংহাসনের উপযুক্ত হতে হবে।নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে হবে।তবেই সে এই গুরুদায়িত্ব পালনের অধিকার পাবে।ওই রাজমুকুটের ভার বহন করার মতো ক্ষমতা অর্জন করতে হবে।তার জন্য আজ এই শুভলগ্ন থেকেই শুরু হবে তার প্রথম প্রশিক্ষণ।তার যুদ্ধবিদ্যার জন্য সেনাপ্রধান,পুঁথিগত বিদ্যার জন্য শিক্ষাগুরু,নৃত্যকলার জন্য সুদক্ষ নর্তকী এবং রাজনীতি ও কূটনীতি শিক্ষার জন্য আমি রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ও উপদেষ্টাকে এইক্ষণ থেকে নিয়োগ করছি।অবসরে রাজকন্যার মনোরঞ্জনের জন্য বিদূষক রূপে বৃহন্নলা সম্প্রদায়কে নিযুক্ত করা হলো।রাজকার্যে আমি অতিশয় ব্যস্ত থাকার কারণে,রাজকন্যার সর্বক্ষণের সঙ্গিনী হবেন তার ধাই মা,রাঙা মা।এছাড়াও রাজকন্যার সুরক্ষার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকবেন দুজন সশস্ত্র দেহরক্ষী।ঘোড়াশালের সহিস কিছুকাল পর তার সর্বাপেক্ষা তেজী ঘোড়াকে প্রস্তুত করবে রাজকন্যার প্রশিক্ষণ প্রদান হেতু।আজকের এই শুভ মুহূর্ত হতে রাজকন্যা সপ্তপর্ণী যেদিন বালিকা থেকে নারীত্বের সম্মানে উত্তীর্ণ হবেন,সেই শুভক্ষণে এই রাজসভায় রাজ্যের সমস্ত প্রজার সম্মুখে হবে অর্জিত শিক্ষার ভিত্তিতে তার জীবনের সর্বপ্রথম পরীক্ষা।সেই পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হলে,মায়াকানন পাবে তার যোগ্য মহারানি।সেই মুহূর্ত পর্যন্ত আমি,তোমাদের বর্তমান রানি,যাকে তোমরা মা বলেই জানো,দায়িত্বে রইলাম এই সিংহাসন তথা রাজ্যের।রাজ্য অভিভাবকহীনা নয়,সিংহাসনও নয়।রাজ্যবাসীর আশঙ্কার কোনো সঙ্গত কারণ নেই।আমি আছি সকলের জন্য।সকলে নিঃসঙ্কোচে আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগ দিন।আহারকার্য সমাধাপূর্বক মহানন্দে আপন গৃহে প্রস্থান করুন।সূতীক্ষ্ণ তরবারি হাতে বিনিদ্র রাত্রি জাগরণে অতীন্দ্রিয় প্রহরায় রানি ও রাজকন্যা আপনাদের সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন।রাজ্যবাসী নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে আমোদ-প্রমোদে জীবন কাটাতে ও জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন।রাজকন্যা সপ্তপর্ণী এই শুভলগ্নে,সর্বসমক্ষে পবিত্র রাজ-তরবারি স্পর্শ করে রাজধর্ম পালনে নিজেকে উৎসর্গ করবেন।

যুব সেনানায়ক রামেশ্বর সুদৃশ্য রূপার রেকাবিতে লাল মখমলের ওপর শায়িত রাজ-তরবারি নিয়ে গেলেন রানির সম্মুখে।সেই তরবারি স্পর্শ করলো ঘুমন্ত শিশুকন্যার সুকোমল অঙ্গুলি।তরবারির শীতল স্পর্শে সুখনিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটায় সুতীব্র তেজে কেঁদে উঠলেন রাজকন্যা সপ্তপর্ণী।সেই ক্রন্দনধ্বনিকে ভবিষ্যৎ রানির আদেশস্বরূপ শিরোধার্য মনে করে,প্রবল হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়লো মায়াকাননের সুসজ্জিত রাজসভায় উপস্থিত রাজ্যবাসী....

রাজ-তরবারিকে সম্মানপূর্বক যথাস্থানে রাখতে উদ্যত হলেন যুব সেনানায়ক রামেশ্বর।অতঃপর আপন তরবারি কর্তৃক রানিকে যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে তাকে কোমরবন্ধনীতে রাখতে গেলে,তীব্রভাবে বাধা পেলেন তিনি।উজ্জ্বলতর একটি তরবারি দ্বারা তার তরবারিকে যথাস্থানে রাখা থেকে বিরত করা হচ্ছে....

দীর্ঘ বারো বৎসর সময়কালের সঙ্গে পরিবর্তিত স্থানও।রাজসভার পরিবর্তে রামেশ্বর উপস্থিত হয়েছে অস্ত্রপ্রশিক্ষণ ক্ষেত্রে...

মৃদু হাসলেন প্রৌঢ় রামেশ্বর।রণাঙ্গনে রাজকন্যার এই আহ্বান পুনরায় স্বীকার করলেন উনি।প্রৌঢ়ের চুলে ও কানের পাশের রূপোলি আভা।তবে রামেশ্বরের ক্ষুরধার দৃষ্টি হতে সশস্ত্র শত্রুবাহিনী আপনাকে আড়াল করতে আজও অসমর্থ হয়।ভরাট ও দীপ্তকণ্ঠে রামেশ্বর বললেন,

-রাজকুমারী!আপনি ক্লান্ত।এবার বুঝি আপনি হেরেই যাবেন।কয়েক মুহূর্ত বিশ্রাম নিন পর্ণা।
-আমাকে মহারানি পর্ণা সম্বোধন করো রামেশ্বর!আমি এই মায়াকাননের মহারানি,তোমাদের সকলের রানি,সপ্তপর্ণী!

তেজদীপ্ত বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন সপ্তপর্ণী।শিরস্ত্রাণে আবৃত রাজকন্যার মুখশ্রী।পরনে আঁটো পোশাক।সূর্যের রশ্মি তরবারির ফলায় পড়ে বিচ্ছুরিত হয়ে আগুনস্ফুলিঙ্গ ঝরাচ্ছে।দ্বাদশ বর্ষীয়া বালিকার কাছে,স্নেহজড়ানো তীব্র ভর্ৎসনা শুনে মুখমন্ডলে অমলিন হাসি খেলে গেলো প্রৌঢ় সেনানায়কের।সহাস্যে উনি বললেন,

-আপনি তো এখনও রানি নন রাজকন্যা!অধিক অহংকার পতনের কারণ।এ সত্য দরাজ হৃদয়ে স্বীকার করুন,আপনি এখনও রানি হয়ে ওঠেননি।
-হয়ে যাবো।দাঁড়াও না!তখন এই তুমিই আমাকে মাথা নত করে সম্মান জানাবে।তরবারি হাত থেকে পড়ে গেলেও,আর ধিক্কার জানাবে না।
-তরবারি বা তরবারি হাতে আপনার দেহ মাটি স্পর্শ করলে,আপনি তো আর রানি হতেই পারবেন না কন্যা!
-কি!!এতবড় কথা!!
-না!এ বড় সত্য কথা!রামেশ্বর কভু মিথ্যা বলে না।
-তবে হোক যুদ্ধ!দেখা যাক,কে পরাজিত হয়!
-আমি প্রস্তুত রাজকন্যা!

বালিকার তরবারির তীব্র আঘাত প্রতিরোধ করতে লাগলেন সেনানায়ক।দ্বাদশ বর্ষীয়া রাজকন্যার চতুর রণকৌশল প্রতিবারই ভিন্নরূপে মুগ্ধ করে তাকে।কন্যার অসিচালনার প্রতিটি কৌশল বুঝে নিয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগে আত্মরক্ষা করে চললেন রামেশ্বর।তারপরই তীব্রতর আঘাতে করে বসলেন প্রতিঘাত।অবলীলায় সেই আঘাত তার দিকেই ফিরিয়ে দিলেন কন্যা।হতবাক রামেশ্বর দেখলেন,কেবলমাত্র শারীরিক শক্তি নয়,তার আদেশানুসারে রাজকুমারী পর্ণা যুদ্ধ করছেন মস্তিষ্কের অপরূপ কৌশলে।প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে তার আঘাত করার কলাকৌশল।রামেশ্বর আপন পরিশ্রম,রক্তবিন্দু ও স্বেদবিন্দু দ্বারা তিলে-তিলে গড়েছেন রাজকুমারী পর্ণাকে।নাতিদীর্ঘ যুদ্ধের পরই রামেশ্বর বুঝলেন,আজ আপন শিষ্যার কাছেই পরাজিত হতে চলেছেন তিনি।যুদ্ধ চলাকালীন তার অসিচালনার যোজনা অনুধাবন করা বড়ই কঠিন।সুতীক্ষ্ণ তরবারির আঘাত কোনদিক হতে ধেয়ে আসবে,তা নির্ণয় করতে পারছিলেন না রামেশ্বর।প্রতিঘাতের সমস্ত আশা জলাঞ্জলি দিয়ে রামেশ্বর করে বসলেন পর্ণার সর্বাধিক দুর্বলতম স্থানে এক তীব্র আঘাত!নিপুণ হস্তে তরবারির শৈল্পিক চালনায় মুহূর্তেই ছিন্নভিন্ন হয়ে খসে পড়লো পর্ণার দেহের পোশাক।দেহের উপরিভাগে রইলো কেবল স্বল্পবাস।

দুজন দ্বাররক্ষী ও পর্ণার দেহরক্ষী মস্তক ও দৃষ্টি অবনত রেখে,শানিত তরবারি হাতে রাজকন্যার আদেশের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন....

পোশাকের পানে অধিক মনোযোগ প্রদানপূর্বক আপন লজ্জা নিবারণকার্যে ব্যস্ত হয়ে,চরম ভুল করে বসলেন পর্ণা।মন সরে গেলো তরবারির আঘাত হতে।রামেশ্বর সেই মুহূর্তেই আপন তরবারির সাহায্যে রাজকন্যার মস্তক হতে ধাতব শিরস্ত্রাণ উপড়ে সশব্দে ছুঁড়ে ফেললেন।মেঘের মতো কৃষ্ণবর্ণ উন্মুক্ত চুলের রাশি আবৃত করলো পর্ণার সমগ্র পৃষ্ঠদেশ।চুলের কিয়দংশ উদ্ভিন্নযৌবনা বালিকার দেহের সম্মুখভাগের সামান্যতম অংশে আছড়ে পড়ে,খানিক লজ্জা নিবারণ করলো।টিকালো নাকের মধ্যভাগের ক্ষুদ্র স্বর্ণালঙ্কার দুলে উঠলো প্রবল তেজে।রাগে স্ফীত হলো বালিকার নাসারন্ধ্র।দু-চোখের দৃষ্টিতে নিয়ন্ত্রণহীন অগ্নুৎপাত।ভ্রু-যুগলের মধ্যভাগের রাজটিকা সিক্ত হয়ে উঠলো লবণাক্ত স্বেদবিন্দুর স্পর্শে।গর্জে উঠলেন সপ্তপর্ণী....

-রামেশ্বর!!এমন দুঃসাহস!!এমন হেন অশালীন অভব্যতার জন্য আমি তোমাকে এই মুহুর্তেই ক্ষুধার্ত-উন্মত্ত-দাঁতালো বরাহের সম্মুখে নিক্ষেপ করবো!!

সেই মুহূর্তেই তরবারি ত্যাগ করে রাজকন্যার পদতলে আশ্রয় নিলো রামেশ্বর।পর্ণার অগ্নিদৃষ্টির সম্মুখে অবনত দৃষ্টিতে রামেশ্বর বললো,

-ক্ষমা করবেন রাজকুমারী পর্ণা।আমি রাজপরিবারের ভৃত্য,রানিমার এবং আপনার একান্ত অনুগত।মহাভৈরবী সকল সত্য জানেন।মনেপ্রাণে তাকে সাক্ষী মেনেই বলছি,আপনি আমার কন্যাসম এবং আপনার দেহের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র প্রলোভন বা আকর্ষণ নেই।সেইরূপ বিকৃত ও বিরূপ মানসিকতা আমার অন্তরে জন্ম নিলে,সেই মুহূর্তেই শিরচ্ছেদের জন্য আমি আপন মস্তক রানিমার পদতলে সমর্পণ করবো।তবে এই মুহূর্তে আমি আপনার শিক্ষাগুরু।আর আপনি আমার শিক্ষার সেই অধ্যায় বিস্মৃত হয়েছেন।কঠিন শাস্তি আপনার প্রাপ্য পর্ণা,আমার নয়!ধৃষ্টতা মার্জনা করবেন।
-অর্থাৎ?কি সেই শিক্ষা!
-রণনীতির বিশেষ কয়েকটি অধ্যায়ের শিক্ষা।সংঘাতের বিশেষ মুহূর্তে প্রতিঘাতের অধিক আত্মরক্ষা প্রয়োজন।আঘাত কেবলমাত্র সম্মুখভাগ থেকে নয়,পশ্চাৎভাগ হতেও একইভাবে সম্ভব।সম্মুখ সমরের তুলনায়,পৃষ্ঠদেশে আঘাতের মতো কুটিল রণকৌশল সম্পর্কে আপনাকে অধিক সচেতন হতে হবে।এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই শত্রু থাকে অদৃশ্য অথবা শত্রু আপনার অত্যন্ত প্রিয়জন।ভুলবেন না কন্যা,যুদ্ধক্ষেত্রে পরম বিশ্বস্ত জনও হতে পারে আপনার বিশ্বাসহন্তা।সর্বোপরি,যে ভুলটা আপনি এই মুহূর্তে করলেন,সেই প্রসঙ্গে কথা বলি।যুদ্ধকালে শত্রু আপনার সর্বাপেক্ষা দুর্বলতম স্থানেই আঘাত করবে পর্ণাদেবী।সেই আঘাত প্রতিহত করে,মনোযোগ সহকারে আত্মরক্ষার্থে আপনাকে যুদ্ধরীতি ও কৌশল বজায় রেখে,জীবন পণ করে লড়াই বজায় রাখতে হবে।আপনি বর্তমানে শত্রুর তরবারির প্রতি অমনোযোগী হয়েছেন,এবং আপনার দৈহিক সম্মানকে প্রাধান্য দিয়েছেন।যুদ্ধক্ষেত্রে তরবারির অধিক প্রাধান্য পেয়েছে আপনার সম্মান!আপনাকে অসম্মানের কোনো অভিপ্রায় আমার ছিলো না রাজকুমারী।কিন্তু আপনার মতো একজন বিদূষী ও দূরদর্শী নারী,যিনি ভবিষ্যতে এই রাজ্যের রানি হতে চলেছেন,তাঁর এমন গুরুতর ভুল অশোভনীয়।এই ভুল মার্জনার যোগ্য নয়।আপনার সূক্ষ একটি ভুল রাজ্যের ও রাজ্যবাসীর বিপুল ক্ষতিসাধন করতে পারে কন্যা।যুদ্ধক্ষেত্রে আপনার শত্রুর একটিই পরিচয়,সে কেবলমাত্র শত্রু!যুদ্ধ চলাকালীন সে নারী বা পুরুষ নয়।একইভাবে,আপনিও শুধুমাত্র হন্তা বা আপন রাজ্যবাসীর রক্ষাকর্ত্রী।কোনো অবলা নারী নন,যিনি আপন সম্মান রক্ষার্থে দেহ আড়ালপূর্বক যুদ্ধক্ষেত্রে নিমেষেই অস্ত্র পরিত্যাগ করবেন।ভুলবেন না কন্যা,আপনি রাজপরিবারের অংশ।আপনার জীবন এই মায়াকাননের জন্য বলিপ্রদত্ত।আপনার যৌবন,আপনার দেহ,লজ্জা-সংকোচ বা সংরক্ষণের জন্য নয়।এমনকি মৃত্যু পরবর্তী আপনার সামান্য দেহাংশও কুটিল রাজনীতির অংশ।প্রয়োজনে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় শত্রুশিবিরে আত্মরক্ষার তাগিদে পুরুষ শত্রুর বিরুদ্ধে,কলাকৌশলে আপনাকে আপন দেহকেই অস্ত্ররূপে ব্যবহার করতে হবে পর্ণা।নারীদেহ আপনার দুর্বলতা নয়।তাকে কঠিন অস্ত্র করে তুলুন!লজ্জা পরিত্যাগ করুন।যে মুহূর্ত পর্যন্ত আপনি মনে করবেন,আপনার দেহ কেবলমাত্র মাংসল পিন্ড,ওই দেহ আপনার দুর্বলতার কারণ হবে পর্ণা।কিন্তু যে ক্ষণে আপনি মানসিকভাবে আপনার দুর্বলতা দূর করবেন,সেই মুহূর্তে ওই দুর্বলতাই হয়ে উঠবে আপনার সর্বাধিক শক্তিশালী অস্ত্র।আপন দুর্বলতাকে আপনার শক্তিতে রূপান্তরিত করুন।মহাভৈরবী প্রতিটি নারীকে জন্মলগ্ন হতেই আত্মরক্ষার অস্ত্রসহ এই পৃথিবীতে প্রেরণ করেন।আত্ম-অনুসন্ধান করুন,আপন সত্তাকে জানুন।লজ্জা ত্যাগ করুন।যুদ্ধশিক্ষার এই অধ্যায় পাঠ চলাকালীন আমি বহু পূর্বেই অবগত করেছিলাম আপনাকে।কিন্তু যুদ্ধকালে আপনি আমার শিক্ষা বিস্মৃত হয়েছেন রাজকুমারী পর্ণা।আপন দেহের লজ্জা নিবারণে ব্যস্ত হয়েছেন।শত্রু এই সুযোগ দ্বিতীয়বার দেবে না।মস্তক হতে শিরস্ত্রাণ একাকী নামবে না,সেই সঙ্গে শত্রুর তরবারির এক আঘাতে আপনার মুন্ডখানি ধড় থেকে পৃথক হয়ে যাবে!আপনি ভুল করেছেন।আমার শিক্ষাদান ও আপনার শিক্ষা অসম্পূর্ণ।এ সংবাদ অবগত হওয়ার পর,রানিমা আমাকে কিছুতেই ক্ষমা করবেন না।আমি লজ্জিত!
-রামেশ্বর?
-আদেশ করুন পর্ণা!আমার জীবন মায়াকানন ও আপনার সেবায় নিয়োজিত।
-ওঠো!দৃষ্টি ফেরাও।আপন ভুলস্বীকার পূর্বক আমি পুনরায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত!
-আমার দুঃসাহস মার্জনা করুন পর্ণা।আপনি পোশাক পরিবর্তন করে আসুন।আমি এই স্থানেই অপেক্ষা করছি।অতঃপর আমরা অস্ত্রশিক্ষার অনুশীলন পুনরায়....
-তোমার দৃষ্টির সম্মুখে আমি এই স্বল্পবাসেই যুদ্ধ করবো ও জয়ী হবো।তবেই এই শিক্ষা আমার স্মৃতিতে থাকবে।
-না পর্ণা!
-রামেশ্বর!সাহায্য করো আমায়।আপন লজ্জার আবরণ ভাঙতে দাও।পুরুষের চোখে লালসা দেখেও,ক্রোধ ও লজ্জা সংবরণ করে আমাকে স্থির হতে দাও।আর তুমিই আমাকে এই শিক্ষাদানে সাহায্য করতে পারবে।আমি নিরাপদ তোমার দৃষ্টির সম্মুখে।আর আমি যদি তোমার দৃষ্টিতে নিরাপত্তার অভাব বোধ করি,এই ক্ষণেই তোমার মৃত্যু অবধারিত।ওঠো!দৃষ্টি ফেরাও আমার দিকে।আমি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত!দৈহিক বাধার প্রাচীর তুমিই আমায় ভাঙতে শেখাও রামেশ্বর!এ আমার আদেশ!

উঠে দাঁড়িয়ে আপন দৃষ্টি রাজকন্যার পানে ফিরিয়ে,তার উদ্দেশ্যে আরও একটি তরবারি ছুঁড়ে দিলেন রামেশ্বর।দুহাতে দুটি তরবারি শানিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন সপ্তপর্ণী।ধাতব সংঘাতের বারংবার সংঘর্ষের মাধ্যমে,শিষ্যা প্রবল দাপটে প্রতিটা আঘাত ফিরিয়ে দিতে লাগলেন আপন গুরুকে।মৃত্তিকা স্পর্শের পূর্ব মুহূর্তে দুজন সশস্ত্র প্রহরীর উদ্দেশ্যে,রামেশ্বর মৃদু ইঙ্গিতে অঙ্গুলিনির্দেশ করলেন।মুহূর্তেই দুপ্রান্ত হতে দুটি তীর ধেয়ে এলো সপ্তপর্ণীর দিকে।রামেশ্বরের পূর্বশিক্ষার প্রভাবে কন্যার অতিশয় সজাগ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়,বার্তা প্রেরণ করলো শ্রবনেন্দ্রিয়ের উদ্দেশ্যে।বিপদের আগাম বার্তা অনুধাবন করলেন রাজকন্যা।তৎক্ষণাৎ যুদ্ধরীতির আকস্মিক পরিবর্তনে সচেষ্ট হলেন তিনি।প্রতিঘাতের পরিবর্তে করলেন আত্মরক্ষা।দুটি তরবারি আপন দেহের দুপ্রান্তে বিদ্যুৎবেগে চালিয়ে প্রতিহত করলেন ধেয়ে আসা দুটি তীর।তীর দুটির ভগ্নাংশ সশব্দে আছড়ে পড়লো ধরিত্রীর বুকে।সম্মুখের শত্রুকে পরাস্ত করার উদ্দেশ্যে একই সময়ে পর্ণা ব্যবহার করলেন আপন পদযুগল।প্রবল বেগে বুকে পদাঘাত করে ধরাশায়ী করলেন আপন শিক্ষাগুরু রামেশ্বরকে।অতঃপর হাতের দুটি তরবারি একযোগে এনে পদতলে শায়িত রামেশ্বরের কণ্ঠনালী স্পর্শ করলেন।মাত্র একবিন্দু রক্তক্ষরণ হলো গুরুর কন্ঠ হতে....দূরে শোনা গেলো চলমান ঘোড়ার খুরের শব্দ ও হ্রেষাধ্বনি....

দৃষ্টি ফিরিয়ে সপ্তপর্ণী দেখলেন ঘোড়ার পিঠে চেপে ধূলিকণা উড়িয়ে আবাল্য সখী বিনোদিনীর আগমন ঘটেছে।রাজকন্যার হাত ধরেই উঠলেন প্রৌঢ় রামেশ্বর।উঠে দাঁড়ালেন তিনি....

-সই!!
-বলো বৃন্দা?অসময়ে তুমি এই স্থানে?
-রানীমার জরুরি তলব!তোমার অস্ত্রশিক্ষা কতদূর?

অনুমতি প্রার্থনায় রামেশ্বরের পানে দৃষ্টি ফেরালেন পর্ণা।

-আজকের মতো সমাপ্ত।মহারানীর আহ্বান!কোনো গুরুত্বপূর্ণ কার্যে অবশ্যই।আপনি আসুন রাজকন্যা।যুদ্ধরীতি ও নীতির বাকি অধ্যায়ের পাঠ ও অভ্যাস,আগামীকাল পর্যন্ত স্থগিত রইলো।আপনি পোশাক পরিবর্তন....
-প্রয়োজন দেখি না রামেশ্বর!আমি নগরের রাজপথ মাঝে এমন স্বল্প পোশাকেই অবতরণ করবো।এই বালিকা তোমার শিক্ষায় আজ লজ্জাহীনা।তুমি তার নারীসুলভ লজ্জা ভেঙে দিয়েছো।আর রাজ্যবাসী নারীকে অসম্মান করার শিক্ষা গ্রহণ করেনি বলেই,আমার দৃঢ় বিশ্বাস!মহাভৈরবী সহায় হোন!
-মহাভৈরবী সহায় হোন কন্যা!অক্ষত ও শত্রুমুক্ত রাখুন এই মায়াকাননকে।

মাথা নত করে সেনানায়কের অনুমতিক্রমে প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র ত্যাগ করে বজ্রসম কন্ঠে আহ্বান করলেন সপ্তপর্ণী....

-অগ্নিসখ!!

অদূরবর্তী ঘোড়াশালে সহিসের তত্ত্বাবধানে মনের উল্লাসে ক্ষুধা নিবারণ করছিলো অগ্নিসখ।দুর্দমনীয় তেজ ও বাতাসের ন্যায় গতির কারণে,পরম স্নেহ ও আদরে তার এইরূপ নামকরণ করেছেন স্বয়ং সপ্তপর্ণী।সহিসের নির্দেশ অমান্য করে,অগ্রভাগের পদযুগল দ্বারা খাদ্য ও জলের পাত্র উপুড় করে তীব্র হ্রেষাধ্বনিকে সঙ্গী করে বায়ুর গতিতে ধেয়ে এলো অগ্নিসখ।স্থির হলো রাজকুমারীর একেবারে সম্মুখে এসে....

-অগ্নি!!তুই শুনেছিস?

দু-পা এগিয়ে রাজকন্যার গ্রীবা আলিঙ্গনের মৃদু প্রচেষ্টা করলো অগ্নি।প্রাণাধিক প্রিয় ঘোড়াকে দুহাতে আলিঙ্গন করলেন পর্ণা...

-সই!রানির কড়া নির্দেশ,অপ্রয়োজনে বিলম্ব নয়।
-মায়ের স্বাস্থ্য?
-অনুকূল বলেই আমার ধারণা।আহ্বানের কারণ অজানা সই।
-চলো বৃন্দা!

অগ্নিসখের কানে ওষ্ঠ ও অধর স্পর্শ করে মৃদুস্বরে পর্ণা বললেন,

-অগ্নি!মায়ের আহ্বান।আমায় উড়িয়ে নিয়ে চল পক্ষীরাজ!!

স্বল্প অলংকারে সুসজ্জিত সম্মুখভাগের দুটি পা তুলে তীব্র হ্রেষাধ্বনির মাধ্যমে অগ্নিসখ জানান দিলো,সে প্রস্তুত!কোমরবন্ধনীর মধ্যে তরবারিকে নীরব আশ্রয় দিয়ে অগ্নির পৃষ্ঠদেশে চড়ে বসলেন সপ্তপর্ণী।

-সই ধীরে!আমিও একই পথের যাত্রী!

অদূরে দন্ডায়মান রামেশ্বর দেখলেন,কোনো আহ্বানে কর্ণপাত না করে,ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে দিলেন রাজকুমারী।মাতৃআজ্ঞা পালনে অজস্র ধূলিকণা উড়িয়ে বাতাসের গতির ন্যায় দ্রুতবেগে,নগরের পথে প্রস্থান করলেন লজ্জাহীনা স্বল্প পোশাক পরিহিতা রাজকুমারী সপ্তপর্ণী।পশ্চাতে অপর একটি ঘোড়ার পিঠে চেপে বিনোদিনীও ছুটলেন তাঁর সঙ্গে।সপ্তপর্ণীর সুদীর্ঘ উন্মুক্ত চুলের রাশি ক্ষণিকের মধ্যেই মিলিয়ে গেলো ধূলিঝড়ের অন্তরালে।ঘোড়ার খুরের শব্দও হলো ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর....

আপন কণ্ঠের সামান্য ক্ষত স্পর্শ করে অত্যন্তই উৎফুল্ল হলেন রামেশ্বর।ওনার শিক্ষা প্রায় সম্পূর্ণ।অনতিবিলম্বেই রাজকন্যাকে রাজ্যভার বুঝিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নেবেন রানি।আর সেই মহাযজ্ঞের আয়োজনে রানিমা সর্বাগ্রে রামেশ্বরকে আহ্বান জানাবেন বলেই,ওনার স্থির বিশ্বাস।মায়াকাননের চতুর্দিকের বিপুল সবুজ সমারোহের দিকে ক্ষণিক চেয়ে,পুলকিত চিত্তে অস্ত্রাগারের দিকে অগ্রসর হলেন রামেশ্বর....

(চলবে)

ছবি : সংগৃহীত






New Video

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট