অসমাপ্ত
তৃতীয় পর্ব
সাথী দাস
ছোট্ট একটা হাতব্যাগের মধ্যে ঘুঙুর,ফোন,ব্লুটুথ স্পিকার সব গুছিয়ে নিয়ে,ক্লাবের বাইরে বেরোলো তিলোত্তমা।একেবারে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে।কিন্তু বৃষ্টির জল প্রায়,গায়ে লাগে না বললেই চলে।
-আয়,আরে আয় নারে...এইটুকু বৃষ্টিতে কিছু হবে না।টাইগার,আয় বলছি!উফফ....
টাইগারকে ধরে টানাটানি করতে থাকে তিলোত্তমা।গায়েও লাগছে না এমন ঝিরঝিরে বৃষ্টি।কিন্তু তাও টাইগার কিছুতেই বেরোয় না...
ভিজে গায়েই বৃষ্টির মধ্যে ছুটতে-ছুটতে সৌর পৌঁছলো ওখানে...
-হাই!তিলোত্তমা....
ঘ্যাক করে বেরিয়ে এলো টাইগার।ঘেউ-ঘেউ করে চিৎকার করতে শুরু করলো।গলায় চেন নেই,একবারে ছাড়া রয়েছে।টাইগারের ধমকের ভয়ে সৌর আর তিলোত্তমার দিকে এগোবার সাহসই পেলো না....লাফ মেরে দু পা পিছিয়ে এলো...
-টাইগার!!দাঁড়া!এইদিকে আয়!
তাও গলা ছেড়ে চিৎকার করেই যাচ্ছে টাইগার...এবার গলা নামিয়ে তিলোত্তমা শান্ত অথচ ভারী গলায় বললো,
-টাইগার,এদিকে এসো....আমার কথা শোনো....
সুড়সুড় করে সরে গেলো টাইগার।তিলোত্তমার পায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।ওর মুখের দিকে করুণ নয়নে একবার চেয়ে বারকয়েক আদুরে লেজ নেড়ে,সৌরকে দেখে ওইখান থেকেই গজরাতে লাগলো....
-সরি....কি যেন,হ্যাঁ সৌরদীপ!আসলে ও আমাকে নিয়ে ভীষণ পসেসিভ!রাস্তাঘাটে আমার সঙ্গে কেউ একটু কথা বলতে এলেই,ও ভীষণ রেগে যায়...ইস!তুমি তো একেবারে ভিজে রয়েছ!খেলতে এসেছিলে??
-হুম!আসলে....
তিলোত্তমার দিকে এগোতে যায় সৌর....গরগর শব্দ করতে-করতে ওদিক থেকে এগিয়ে আসে টাইগারও....সৌর আবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে....
-সমস্যাটা কি?
-ওই যে,তুমি আমার সঙ্গে কথা বলছো!
-তো?
-ওটাই ওর সহ্য হয় না!আমার সঙ্গে কেউ কথা বললে,আমার দিকে অচেনা কেউ এগোলে,ও সহ্যই করতে পারে না!
-এ আবার কি?বয়ফ্রেন্ড নাকি তোমার?!
হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো তিলোত্তমা।চোয়াল ঝুলে পড়লো ওর।তারপরই হো-হো করে হেসে উঠলো।সৌরর সারাটা শরীর জলের ছোঁয়ায় সিক্ত,জল নাকি আগুন নেভায়!!কিন্তু তাও এই ভিজে অবস্থাতেই ওই হাসিতেই সৌর জ্বলতে লাগলো,এক চরম ভালোলাগায়....
-খুব খারাপ জোক ছিলো এটা....
-না,এইরকম তো বয়ফ্রেন্ডরাই করে।তাই বলছিলাম।নাম কি ওর?টাইগার বোধহয়!!
-হুম!
-দাঁড়াও,আগে ওকে ম্যানেজ করি!
-এই সৌরদীপ,সাবধান!!খেপে গেলে কিন্তু কামড়ে দেবে।কিছু হবে না যদিও,তবে একটা রক্তারক্তি ব্যাপার হয়ে যাবে.....
তিলোত্তমার কথাটা তেমন গুরুত্ব দিলো না সৌর।এগিয়ে গেলো টাইগারের দিকে।রাগে গরগর করতে-করতে টাইগারও ঘেউ-ঘেউ করে উঠলো....
-এই তাহলে ওর হালকা হতে যাওয়ার কারণ?
রূপ বলে উঠলো...
-মানে?
ঋষি আর সমুদ্র দূর থেকে একভাবে চেয়ে রয়েছে সৌর আর তিলোত্তমার দিকেই...
-আরে বল আনতে গিয়ে দেখি,সৌর চুপ করে ক্লাবের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।তাহলে এর জন্যই....
-কিন্তু মেয়েটা কে?
-আমি কি করে জানবো?আগে তো পাড়ায় দেখিনি!
-আজ আর সৌরর টিকি পাওয়া যাবে বলে তো মনে হচ্ছেনা।চল!আমরা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজবো কেন?সন্ধ্যে হয়ে গেলো তো।বাড়ি যাই.... কাদা মেখে ভূত হয়ে গেছি একদম।মা চিনতে না পেরে,বাড়ির বাইরে থেকেই আবার না খেদিয়ে দেয়....
ওরা তিনজন মাঠের পার থেকে সাইকেল নিয়ে শর্টকাট দিয়ে বেরিয়ে গেলো যার-যার রাস্তায়।ফুটবল ঢুকে গেলো ক্লাবে,জনশূন্য হয়ে পড়ে রইলো সবুজ ঘাসের গালিচায় আবৃত সুবিস্তৃত মাঠ....
-চল টাইগার,তাহলে যাওয়া যাক!!
-মানে সিরিয়াসলি সৌরদীপ,আমি তো নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারছি না!!
অবাক তিলোত্তমা...
-কেন?
টাইগারের মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দিয়ে একবার মাঠের দিকে চাইলো সৌর।টাইগার ততক্ষণে সৌরর গা শুঁকে বারকয়েক চেটেও দিয়েছে।বোধহয় খুব একটা ভালো স্বাদ নয় বলে,আবার সরে গেছে।ইতস্তত লেজ নেড়ে-নেড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সৌর আর তিলোত্তমাকে কেন্দ্র করে।সৌর এক নজরে দেখলো,বন্ধুরা কেউ নেই।শূন্য মাঠ।ল্যাম্পপোস্টের সাদা আলোগুলো জ্বলছে কেবল।আলোর নির্দিষ্ট বৃত্তটুকুতেই বোঝা যাচ্ছে,ইলিশে-গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।নইলে তো গায়েই লাগছে না।আর এমনিতেও সৌর ভিজে গায়েই রয়েছে।তাই সেদিক থেকে নতুন করে ভেজা আর না ভেজা,ওর কাছে দুইই সমান।ও তিলোত্তমাকে বললো,
-বাড়ি যাবে তো?
-হুম!
-চলো,আমিও যাবো।দাঁড়াও,সাইকেলটা নিয়ে আসি!মাঠের ওপারে আছে!চল টাইগার!যাবি?
তিলোত্তমা হাঁ করে চেয়ে দেখলো,টাইগার নাচতে-নাচতে,লেজের ব্যায়াম করতে-করতে সৌরদীপের সঙ্গে-সঙ্গে ছুটলো....
-তিলোত্তমা....চলো!আমি সাইকেল হাঁটিয়েই নিয়ে যাচ্ছি!
-হ্যাঁ,অবশ্যই।তুমি উঠতে বললেও,তোমার সাইকেলে উঠতাম নাকি!?আমি হেঁটেই যেতাম...
হেসে ফেললো সৌর....
-কি আশ্চর্য!!আমি তোমাকে উঠতে বলতামও না....
দুজনেই হেসে ফেললো একসঙ্গে....সুখী টাইগার হেলতে-দুলতে লেজ নাড়তে-নাড়তে বহাল তবিয়তে ওদের সঙ্গে চললো।কথায়-গল্পে তিলোত্তমার বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেলো ওরা....
-আই মাস্ট সে সৌরদীপ....
-তুমি আমায় সৌর বলে ডাকতে পারো।আমার সব বন্ধুরা আমাকে ওই নামেই ডাকে।
-ওকে....আমারও আরও অনেক নাম আছে,সোনামা!তুমি আমায় সোনামা বলেও ডাকতে পারো!
-সোনার সঙ্গে আবার মা....ও চলবে না!
-কেন?নামটা খারাপ কি?সোনামা নামটা তো মা-বাবাই আদর করে ডাকে।
-অন্য কোনো নাম?
-ওকে...মিছরি?আমার দিদুন ডাকে!
-হ্যাঁ....এটা খুব মিষ্টি!!
-কোনটা?
-মিছরি.....না মানে নামটা....
বলেই সৌর হেসে অন্যদিকে মুখটা ঘুরিয়ে নিলো।সৌরর দিকে একভাবে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে,হেসে ফেললো তিলোত্তমাও...মুক্তঝরা হাসির সংজ্ঞা কি,জানা নেই সৌরর।তবে ওর মনে হলো,যদি মুক্তঝরা হাসি বলে সত্যিই কিছু থাকে,তবে এটাই তার সঠিক সংজ্ঞা।মিছরির মুখের হাসিটা....একটু হেসে তিলোত্তমা সৌরর চোখে-চোখ রেখে বললো,
-ফ্লার্ট করছো?
-ফ্লার্ট?!ধুর!ওসব তো বাচ্চারা করে।আমার অত সময় কোথায় ওসবের জন্য?
-হুম!!বুঝলাম!!আমি এখন ভীষণ ব্যস্ত একজন মানুষের সঙ্গে কথা বলছি!
-সে আর বলতে!ব্যস্ত তো বটেই।তুমি কি বলছিলে মিছরি?
-কোথায় কি বলছিলাম?
-ওই যে বললে না,আই মাস্ট সে সৌরদীপ....কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলে তখন...
তিলোত্তমাদের বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো ওরা।দারোয়ান বড় গেট খুলে দিলে,টাইগার লাফাতে-লাফাতে চলে গেলো ভিতরে...
-আরে হ্যাঁ,আমি তখন যেটা বলতে যাচ্ছিলাম,সত্যিই আমি আজ পর্যন্ত খুব কম সংখ্যক মানুষকেই দেখেছি,টাইগার আমার আশেপাশে মেনে নিয়েছে।মানে একেবারেই হাতে গোনা লিমিটেড কয়েকজন,তাই তোমাকে এভাবে ওর সঙ্গে দেখে....
সাইকেলের হ্যান্ডেলটা একহাতে ধরে ভেজা চুলগুলো কপালের ওপর থেকে পিছন দিকে সরিয়ে নিলো সৌর।তারপর হেসে ফেললো...
-হাসলে যে?
চিরকালীন অভ্যাসবশত নিজের তর্জনীটা নাকের একটু ঘষে নিয়ে সৌর বললো,
-আই এম লিমিটেড এডিশন!!জাস্ট লাইক ইউ....
বলেই তিলোত্তমার দিকে চেয়ে মৃদু হাসলো সৌর।তিলোত্তমা ওপর-নীচে একবার ঘাড় নাড়লো।তারপর মৃদু হেসে বললো,
-প্রথম দিন দেখাতেই এভাবে ওপেনলি ফ্লার্ট কে করে সৌর?!
দুজনেই হেসে উঠলো সশব্দে....
সৌর একবার ভালোভাবে চেয়ে দেখলো তিলোত্তমার দিকে।মাথায় আলগা একটা খোঁপা করা রয়েছে।দুপাশ দিয়ে চুলগুলো মুখে-কাঁধে ছড়িয়ে রয়েছে,একটু ভেজা....
সৌর মাথা নামিয়ে নিলো....
ঘেউ-ঘেউ করে ওপরের ঝুলবারান্দা থেকে টাইগার ডেকে উঠলো....সেদিকে চেয়ে তিলোত্তমা বলে উঠলো,
-টাইগার ডাকছে।আমি এলাম সৌর।দেখো আমি জানি,বাড়ির সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে চলে যাওয়াটা,ভীষণই দৃষ্টিকটূ।আমি তোমাকে ভিতরে আসতে অবশ্যই বলতাম।কিন্তু আজ বলবো না।
-নানা!ওকে....পারফেক্টলি অলরাইট...
-না,শোনো কারণটা?
-আচ্ছা বলো!
যেতে তো সৌররও ইচ্ছে করছে না।
-দুটো কারণ,যেটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ,সেটা হলো,তোমার সারা গা-জামাকাপড় পুরো ভিজে।আগে বাড়িতে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হও।নইলে ঠান্ডা লেগে,জ্বর এসে বিছানায় শুয়ে পড়বে।আর দ্বিতীয় কারণটা হলো,এক্ষুণি আমার যোগা-মেডিটেশন এর ক্লাস নিতে একজন প্রাইভেট-ট্রেইনার আসবেন।আমি ওদিকে বিজি হয়ে যাবো।সুতরাং বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে,তোমাকে আর সময়ই দিতে পারবো না।তাই,সরি সৌর....
-একদম ঠিক আছে।আমি ওসব নিয়ে ভাবছিই না।কিন্তু তুমি মেডিটেশন করো?যোগব্যায়ামও?বাঃ!!
-আমি ফিট থাকতে ভালোবাসি!আমার জীবনের কতগুলো এমবিশন আছে সৌর,যেগুলোর জন্য,আমার নিজেকে সুন্দর রাখতেই হবে।প্রপার ডায়েট,এক্সসারসাইজ....
-মেডিটেশন-যোগা ইজ টু গুড,বাট সেভাবে এক্সসারসাইজ কি করো?
-কেন বলো তো?
সন্ধিহান হয়ে সৌরকে জিজ্ঞেস করলো তিলোত্তমা....
-না এমনিই!সরি!প্লিজ কিছু মনে কোরো না।আমি বোধহয় তোমার ব্যক্তিগত পরিসরে,একটু বেশিই ঢুকে গেছি।সরি মিছরি....
-না!তা নয়!আসলে এসব নিয়ে তো সেভাবে কেউ কথা বলে না।সবাই খালি কোন ক্লাস,কোন স্কুল,কোন গ্রেড, এসবই আগে জিজ্ঞেস করে।তাই একটু অবাক হলাম বৈকি!আমি নাচতে ভালোবাসি সৌর।নাচটা আমার প্রাণ,এছাড়াও আমার মনে হলো,আলাদাভাবেও একটু কিছু শরীরচর্চা করলে ভালো হয়।বাবাইকে সকালে বলতে,বাবাই একজনকে প্রাইভেটে....
-হোয়াই ডোন্ট ইউ জয়েন সুইমিং?আই মিন,সাঁতারের চেয়ে ভালো এক্সসারসাইজ আর কি আছে?!সাঁতারের পাশাপাশি ওগুলো থাক...
-কিন্তু আমি তো সাঁতার জানি না!!
-হ্যাঁ তো শিখবে....
-এখানকার তো কিছুই চিনি না আমি!কোথায় সুইমিং পুল,কোথায় কি....
-টুমরো,এট থ্রি পিএম!শার্প!!কাল স্কুলও ছুটি আছে।সকালে আমার টিউশন আছে।তাই বিকেলে....আমি তোমার বাড়ির সামনে চলে আসবো,এইখানেই।তুমি বেরিয়ে এসো।আমি নিয়ে যাবো তোমাকে।আর হ্যাঁ,তোমার দু-কপি রিসেন্ট ছবি,যেকোনো একটা ফটো আইডি প্রুফ,আর মেডিকেল সার্টিফিকেট,এগুলো রেডি রাখবে।
-মেডিকেল সার্টিফিকেট?
-আরে তেমন কিছুই না!তুমি যে সুইম করার জন্য ফিজিক্যালি ফিট,সেটা একটা রেগুলার চেক-আপ করিয়ে,ডাক্তারকে দিয়ে প্রেসক্রিপশনে লিখিয়ে আনবে।ওটা জাস্ট একটা ফর্মালিটি,ডোন্ট ওয়ারি!তুমি এগুলো রেডি রেখো।আমি দুপুরে এসে তোমাকে নিয়ে যাবো....
-কতদূর?
-আছে কিছুটা দূর.... কেন?
-আমি কিসে করে যাবো?
-আমি একা থাকলে তো সাইকেলেই চলে যাই,কাল তুমি থাকলে,অটোতেই যাবো!
চমকে উঠলো তিলোত্তমা....
-এই নানা!ওসব পাবলিক ট্রান্সপোর্টে আমি উঠতেই পারবো না।তুমি বরং আমাকে এড্রেস দিয়ে দাও,আমি গাড়ি নিয়ে যাবো।আমার বাবাই যাবে সঙ্গে....
একটু থমকে গেলো সৌর।এই মেয়ে নিজের প্রাইভেট গাড়ি ছাড়া,এক পা-ও চলতে পারে না!!আর কিছু বললো না ও।চুপ করে গেলো....
-কিভাবে দেবে ঠিকানা?আচ্ছা তোমার নম্বর বলো?
নিজের ফোনে সৌরর নম্বরটা রেখে দিলো তিলোত্তমা....সৌর আর কিছু বললো না....চুপচাপ সাইকেলে উঠলো,
-এই শোনো,তুমি কি অনেকদিন ধরে সুইমিং করো?মানে জলটল পরিষ্কার তো?ক্লোরিনে ট্যান হয়ে আমার স্কিন টেক্সচার খারাপ হয়ে যাবে নাতো?জল কি অনেকটা গভীর?মানে আমি তো একদম নন-সুইমার....আমি জলে নামলে,আমার বাবাই ভীষণ দুশ্চিন্তা করবে...
মৃদু হাসলো সৌর...তারপর বললো,
-হ্যাঁ,আমিও ওই সবে-সবেই সাঁতার শিখছি,এবার না হয় দুজনে মিলেই শিখবো।ওখানকার ট্রেইনাররা খুব ভালো,একেবারে হাতে ধরে শেখায়।তুমি এসো,তোমার খুব ভালো লাগবে।আর স্কিনটোন?ক্লোরিন আর রোদে একটা ট্যান পড়ে ঠিকই,তুমি বিকেলের দিকে জলে নামবে।রোদের তেজ একটু কমে গেলে!!জলে নামার আগে সানস্ক্রিন ইউজ করবে,আর জল থেকে উঠে শাওয়ার নেওয়ার আগে ডি-ট্যান স্ক্রাব।ও আমি সব বলে দেবো,ওসব নিয়ে ভেবো না।আগে এসে তো দেখো....তারপর অসুবিধে হলে না হয় ছেড়েই দিও....আর জলের গভীরতার কথা যদি জানতে চাও,তাহলে আমি বলবো,জলে না নামলে বুঝবে কি করে,জল কতটা গভীর!?তার জন্য তো ট্রেইনারের হাত ধরে,ট্রেইনারকে ভরসা করে,তোমাকে ডুবতে হবে মিছরি....জলে তো নামতেই হবে....
-হুম!সেটাও ঠিক!
-কাল আসছো তো তা হলে?আমি বাড়ি গিয়ে তোমায় ঠিকানা পাঠিয়ে দিচ্ছি....একটা মিসড কল করে রেখো...
-ওকে,আই উইল!!চলো বাই সৌর....
-টাটা!!
তিলোত্তমা ঢুকে গেলো বাড়ির ভিতরে।আর পিছন ফিরে চাইলো না।দারোয়ান গেট বন্ধ করে দিলো....সৌর ভেবেছিলো তিলোত্তমা হয়তো সামনের ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়ে একেবারে বাড়িতে ঢোকার আগে,একবার অন্তত পিছন ফিরে দেখবে।তাই ও সাইকেলের ওপর বসে অপেক্ষাও করছিলো।কিন্তু আর ফিরে চাইলো না মিছরি।ঢুকে গেলো ভিতরে।সৌর মাথাটা নীচু করে ঘুরিয়ে নিলো সাইকেলটা....এবার একটু-একটু শীত করছে।অনেকক্ষণ ভিজে অবস্থায় রয়েছে ও....
অন্ধকার হয়ে গেছে আজ।শর্টকাট রাস্তাটায় আর ঢুকলো না সৌর।দিনের আলো থাকলে ঠিক আছে,কিন্তু রাতের বেলা একটাও আলো জ্বলে না ওই রাস্তার।ভীষণ অন্ধকার থাকে।তাই ও ঘুরে বড় রাস্তা ধরেই যাবে ঠিক করলো...সাইকেলটা জোরে চালিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই এসে পৌঁছলো বড় রাস্তার মোড়ে।এবার রাস্তা পার হতে হবে।অটোগুলো সারি-সারি দাঁড়িয়ে রয়েছে।মাঝে বড় একটা বাস দাঁড়িয়ে।বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সৌর।প্রচন্ড শীত করছে ওর।শরীরে মৃদু কাঁপুনি।কিন্তু সমস্ত কাঁপুনির ঊর্ধ্বে এমন একটা দৃশ্য ওর চোখে পড়লো,যে ও একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলো....অটো থেকে যে ছেলেটা রঞ্জাবতীকে হাত ধরে নামালো,সে আর কেউ নয়,সমর্পণ!!অটোভাড়া দিয়ে রঞ্জার কাঁধে হাত রেখে,দুজনে হেসে-হেসে কথা বলতে-বলতে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে।ঢুকলো একটা স্ন্যাকসের দোকানে।সৌর স্পষ্টই দেখলো,সমর্পণ হাত রেখেছে রঞ্জার কাঁধে,আর রঞ্জা ওর কোমরে হাত রেখে চেপে ধরেছে সমর্পণের জামা।দুজনের পিঠেই দুটো স্কুলব্যাগ।ওরা বিভোর হয়ে রয়েছে নিজেদের বৃত্তে।দুজনে কথা বলতে-বলতে,রাস্তার ওপারের কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকে গেলো ভিতরে....মাথাটা ঘুরে গেলো সৌরর।ঋষিকে কি বলবে ও?!কিভাবে বলবে?!
সমর্পণ!স্কুল আলাদা হলেও টিউশন এক।সেই সূত্রেই ওর আলাপ রঞ্জাবতীর সঙ্গে।খুব বেশিদিনের পরিচয়ও না।টিউশনে সমু,সৌর,ঋষি আর রূপ সবসময় একজায়গায় থাকায়,ওদের আর কাউকে সেভাবে প্রয়োজন পড়ে না।আর আলাদা স্কুল হওয়ায়,সমর্পণের সঙ্গে তো তেমন কোনো বন্ডিংই নেই।কথাই হয় না প্রায়।ওর বন্ধুবৃত্ত সম্পূর্ণ পৃথক।রঞ্জাবতীকে সৌর টিউশনে দেখেছে,সমর্পণের সঙ্গে টুকটাক কথা বলতে,সে তো ওইরকম একটু-আধটু কথা,সবাই সবার সঙ্গেই বলে।কিন্তু সেটা যে ভিতরে-ভিতরে এতটা গভীর,এই খবরটা তো ওরা কেউ জানেই না।এসব প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে ন্যাকামি,অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি,সৌরর বরাবরই অপছন্দের।কিন্তু আজ রঞ্জাকে সমর্পণের সঙ্গে ওভাবে দেখে,চোখে জল এসে গেলো ওর।সেদিনের ঋষির সরল-হাসিখুশি-লাজুক মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই মুহূর্তেই....একইসঙ্গে ভেসে উঠলো মিছরির মুখটাও....ভয়ে কেঁপে উঠলো সৌর।জ্বর আসছে বোধহয়....
রাস্তার যানজট একটু হালকা হলে,সাইকেল নিয়ে রাস্তা পার হয়ে বেরিয়ে গেলো সৌর....
-অসম্ভব!আমি বিশ্বাস করি না!
-তাতে সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাবে না রূপ।আমি আজ নিজে দেখেছি,রঞ্জা আর সমর্পণকে একসাথে।আর যেভাবে দেখেছি,ওটা যে শুধুমাত্র বন্ধুত্ব নয়,আমি সেই গ্যারান্টি দিলাম,মিলিয়ে নিস আমার কথা।শুধু তোকেই জানালাম।ঋষিকে বলার ক্ষমতা,আমার হবে না।তুই দেখ,জানাবি কিনা!!রাখছি আমি।মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়....
-তা ভিজে গায়ে অতক্ষণ থাকতে কে বলেছিলো?
-এ রূপ,থাম তো!বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই মা একচোট চিৎকার করলো,আবার তুইও?!কিচ্ছু ভালো লাগছে না আমার।রাখছি,কাল দেখা হচ্ছে।তুই দেখ,ঋষিকে কিভাবে জানাবি....
ফোনটা রেখে দিলো সৌর।মেজাজটা একদম বিগড়ে গেছে ওর।মিছরি বললো ফোন করবে,কোথায়?করলো না তো?!এসেই ফোনের কল-লিস্টের অলিগলি আতিপাতি করে খুঁজেছে সৌর।কিন্তু কোনো অজানা নম্বর নেই।বড্ড আশা করেছিলো সৌর,কিন্তু এভাবে আশাহত হবে,স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।জ্বরটাকে ধরেবেঁধে আটকানোর জন্য,বাড়িতে ঢুকেই ওষুধ খেয়ে নিয়েছে।কাল জলে নামতেই হবে ওকে।যদি ও যায়....মিছরির কথা ভাবতে-ভাবতেই চোখটা বন্ধ করলো সৌর....
ঘর পুরো ফাঁকা।সমু-ঋষি-রূপ কেউই আসেনি তখনও।ঘরে ঢুকেই থমকে গেলো সৌর।একদম কোণের খোলা জানলার ধারে,সমর্পণের একেবারে বুকের কাছে রঞ্জা দাঁড়িয়ে রয়েছে।একে-অপরের হাতে-হাত রাখা।সৌর অতর্কিতে ঘরে ঢুকে পড়ায়,একটু সরে দাঁড়ালো রঞ্জা।সৌরকে দেখে দুজনেই একটু কাষ্ঠহাসি হাসলো....বিনিময়ে সৌর একটু হেসে ব্যাগটা নামিয়ে রেখে বেরিয়ে এলো ঘরের বাইরে....
-এসব কে বলেছে তোকে?
-সৌর!!কালই তোকে ফোন করতাম।কিন্তু সাহস হয়নি ভাই।ভাবলাম,আজ সামনাসামনিই বলি।নইলে তুই কি পাগলামি করে বসবি...
টিউশনে ঢোকার আগে,মাথা নামিয়ে ঋষির প্রশ্নের উত্তর দিলো রূপ...
-সৌরকে আমরা কদিন ধরে চিনি রূপ?ও নিজেও যেমন,
ও চায় ওর আশেপাশের সবাই ওর মতোই হবে।তুই জানিস না,এসব প্রেম-ভালোবাসার ধার ধারে না ও।রঞ্জা আমার দিকে তাকায়,আমার সঙ্গে এসে কথা বলে,ও এসব সহ্য করতে পারে না।ওর মতো সবাইকে তৈরি করতে চায়।তাই ও নিজে না বলে,তোকে দিয়ে এসব কথা বলাচ্ছে।জানে,তুই আমার ছোট্টবেলার বন্ধু,তোর কথা তো আমি বিশ্বাস করবোই।দুদিনের একটা ছেলে সৌর,ও বললো,আর তুই ওর কথা বিশ্বাস করে নিলি রূপ?রঞ্জা এইরকম করতেই পারে না...
-সত্যি-মিথ্যে আমিও জানি না ঋষি।যেটা সৌর আমাকে বলেছে,সেটাই আমি তোকে বললাম....
-কোথায় ও?চল তো দেখি!ওর মুখ আজ আমি ভেঙে দেবো!
-এ ভাই!মাথা গরম করিস না ভাই...উফফ!!
ততক্ষণে সাইকেল চালিয়ে টিউশনের দিকে বেরিয়ে গেছে ঋষি।রূপ তাড়াতাড়ি করে সাইকেলের গতি বাড়িয়ে ওর পিছনে গেলো....
টিউশন থেকে বেরিয়ে কয়েক পা হেঁটে নির্জন শিবমন্দিরটার সিঁড়ির ওপরে,সৌর এসে বসলো।সকাল থেকে যে কতবার ফোনটা চেক করেছে,তার ইয়ত্তা নেই।কিন্তু কোনো অচেনা নম্বর চোখে পড়েনি ওর।ফোনটা প্যান্টের পকেটে রেখে দিলো ও।কবজিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলো,এখনও স্যার আসতে মিনিট পাঁচেক দেরি আছে।স্যার তো এই রাস্তা দিয়েই বাইক নিয়ে যাবে।স্যার এলে তবেই ভিতরে ঢুকবে ও।সকাল সাড়ে-ছটার সময় ও বাড়ি থেকে বেরিয়েছে।ঘুরপথ হবে জেনেও,ওদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা দিয়েই এসেছে সৌর।নিস্তব্ধ গোটা বাড়ি।সব দরজা-জানালা বন্ধ।কোনটা যে ঘুমন্ত রাজকন্যার ঘর,তাও তো সৌর জানে না।দারোয়ানটা টুলের ওপর বসে-বসে ঢুলছিলো।সব দেখেশুনে ও চলে এসেছে।কিন্তু মেয়েটা ফোন কেন করলো না?!
অদূরেই কচুরীপানায় আবৃত একটা পুকুর,তার চারিদিকে সবুজ জঙ্গল।পুকুরের একটু দূরেই বাঁশবাগান শুরু হয়েছে।জায়গাটা বড় নির্জন।শুধু ক্ষণে-ক্ষণে পাখির ডাক শোনা যায়।এই জায়গাটা খুব ভালো লাগে সৌরর।পুকুরপাড়ের একটা গাছের সরু ডালে,একটা মাছরাঙা পাখি চুপ করে ধ্যানস্থ অবস্থায় বসে আছে।গাছের পাতার আড়াল থেকে কয়েকটা সাদা বক উঁকি দিচ্ছে....
-কিরে?তোকে কখন থেকে ডাকছি,শুনতে পাচ্ছিস না?
-না!সরি!বল....
চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে সমুদ্রকে দেখে,উঠে দাঁড়ালো সৌর।
-এখানে বসে আছিস কেন?ভিতরে চল।
-স্যার আসুক!যাচ্ছি!স্যার আসেননি এখনও....
-তোর কি হয়েছে রে সৌর?
-কিছুনা তো!
সমুদ্র চুপ করে চেয়ে রইলো সৌরর দিকে...
-বারো বছর ধরে চিনি তোকে।তুই কিন্তু আমাকে মিথ্যে বলে পার পাবি না।এক রাতেই তোর চোখমুখ পুরো পাল্টে গেছে।শরীর খারাপ নাকি?রাতে ঘুমোসনি তুই?
-না!ঘুমিয়েছি।আসলে রাতের দিকে একটু জ্বর এসেছিলো।সকালে একদম উঠতে ইচ্ছে করছিলো না।
-তা ওইভাবে বৃষ্টিতে ভিজে,কলে স্নান করে,ভিজে অবস্থায় অতক্ষণ থাকলে,তোর জ্বর আসবে নাতো,কার আসবে?!
সৌর চুপ করে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।মুখটা অদূরের বাঁশবাগানের দিকে ফেরানো।চোখদুটো জ্বালা করছে ঘুমে....
-কালকের ওই মেয়েটা কে ছিলো রে?কিরে??
-তিলোত্তমা!
-সেটা আবার কে?
সৌরকে প্রশ্ন করলো সমুদ্র....
-ঋষি দাঁড়া....
দুজনেই চমকে রাস্তার দিকে চাইলো।সাইকেলটা মাটিতে ফেলেই ওদের দিকে দৌড়ে আসছে ঋষি।সমুদ্র অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে রয়েছে।কিন্তু সৌর একভাবে ঋষিকেই দেখছে....হাত দুটো বুকের সামনে রাখলো ও...ঋষি এসে দাঁড়ালো সৌরর মুখোমুখি.... পিছনে রূপ দুটো সাইকেল দাঁড় করিয়ে রেখে,দৌড়ে এলো ওইদিকে...
-সৌর!!রূপকে কি বলেছিস তুই?
-যা সত্যি তাই বলেছি!!
-তোর মুখ আমি ছিঁড়ে নেবো হারামি!!
চিৎকার করে উঠলো ঋষি।সৌরর জামার কলার টেনে ধরলো ও।ঋষির চিৎকারের চোটে,পুকুরপাড় থেকে কয়েকটা সাদা বক ভয় পেয়ে ঝটপটিয়ে উড়ে গেলো....
-গায়ে হাত দিবি না ঋষি।মুখে কথা বল!
সৌর ঠান্ডা মাথায় বললো...
-কি হয়েছে বলবি?
সম্পূর্ণ ব্যাপারটা থেকে অন্ধকারে থাকা সমুদ্র চেঁচিয়ে উঠলো...
-তোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করাটাই আমার ভুল হয়েছে।ভুলেই গিয়েছিলাম,বন্ধুত্বও সবসময় সমানে-সমানে হয়।নিজের পয়সা,নিজের রূপ,নিজের গুণ,নিজের এটিটিউড,তুই তোর নিজের পকেটে ভরে রাখবি!তোর পরোয়া কেউ করে না সৌর।আমার ব্যাপারে যদি আর নাক গলাতে আসিস,খুন করে ফেলে দেবো!!মনে রাখবি কথাটা...
-ভাই!ভালোভাবে কথা বল ভাই!কি হয়েছে সেটা বল,মাথা ঠান্ডা করে ভালোভাবে কথা বল....
সমুদ্র ঋষিকে সামলানোর চেষ্টা করে।কিন্তু সৌর একটাও কথা বলে না।চুপ করে ঋষির সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে...
-থাম ভাই!কাকে কি বলছিস?!
ব্যস্ত হয়ে পড়লো রূপ।ঋষিকে টেনে সরাতে গেলো সৌরর সামনে থেকে....
-কেন?ও কোন হনু,যে ওকে অয়েলিং করে চলতে হবে?ওকে আমার চোখের সামনে থেকে দূরে থাকতে বল রূপ!নইলে,আমি কিন্তু জুতিয়ে ওকে সিধে করে দেবো!!
চিৎকার করে হাঁপাতে-হাঁপাতে নিজের সাইকেলের দিকে চলে যাচ্ছিলো ঋষি....
-করে দিস!সিধে করে দিস।মেরে-কেটে-জুতিয়ে-ফাটিয়ে দিস!আমার সঙ্গে তোর যা ইচ্ছে,তাই করিস!!কিন্তু ওই রঞ্জাকে তোকে ছাড়তেই হবে।ওই রঞ্জার ভূত আমি তোর মাথা থেকে নামাবোই।আমি কিছুতেই তোকে আর রঞ্জার দিকে এগোতে দেবো না....
উল্টে ঘুরে একদৌড়ে এসে সৌরর গায়ে হাত চালিয়ে দিলো ঋষি....
-আমি কি করবো না করবো,তুই ঠিক করে দিবি হারামি!!কি আমার অভিভাবক এলো রে...
সমুদ্র আর রূপ,দুজন মিলে টেনে ধরে রাখতে পারে না ঋষিকে।সৌরও নিজেকে বাঁচাতে হাত চালিয়ে দেয় ঋষির গায়ে....
-পাগল হয়ে গেছিস!?কি করছিস কি তোরা?
দুজনকে সিঁড়ির দু-প্রান্তে বসিয়ে চিৎকার করে ওঠে সমুদ্র....রূপ তখনও চেপে ধরে রেখেছে ঋষিকে।ছাড়লেই দৌড়ে আসবে সৌরকে মারতে...
এইবার দ্বিগুণ জোরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো সৌর নিজেই....
-পাগলা আমি না,ও হয়ে গেছে বাল!ওই একটা ফালতু মেয়ের জন্য,ও নিজের বন্ধুর গায়ে হাত তুলছে!!আমার গায়ে হাত তুলছে ও....
ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো সৌর।কাল থেকেই শরীরটা খারাপ ওর,মনটাও।আজ আর পড়তে আসতোই না।কিন্তু বাড়িতে বসে থাকলে,আরও বেশি মন খারাপ হবে বলে,বেরিয়ে এসেছে।ভেবেছিলো,বন্ধুদের মধ্যে থাকলে,একটু হয়তো ভালো থাকবে...
আবার তেড়ে উঠতে যায় ঋষি....থাবড়া মেরে ওকে মন্দিরের সিঁড়িতে ঠেসে বসিয়ে রাখে রূপ...ওইখান থেকেই চেঁচাতে থাকে ঋষি...
-রূপ ওকে বল,রঞ্জার নামে আর একটা আজেবাজে কথা বললে,আমি আজ এইখানেই ওকে মেরে ফেলবো...
এবার সৌর তেড়ে ঋষির সামনে এসে দাঁড়ালো....
-মার!!মার,মার কত মারবি মার!!আমি তোর মত প্রেমে পড়ে আবাল হয়ে যাইনি ঋষি।বোধবুদ্ধি লোপ পায়নি আমার।দু বছর ধরে তুই একটা মেয়ের পিছনে ঘুরছিস!দিনরাত ওকে নিয়ে পাগলামি করছিস,সারা স্কুলে ওকে নিজের বউ বলে বেড়াচ্ছিস,ও কিছু জানে না মনে করেছিস?!কিছুই কি ওর কানে যায়নি!না কিছু বোঝেনা ও!!সব জানার পরও,তোর দিকে ও কিভাবে তাকায়,মনে নেই তোর?!আমি তো ভাবতাম,রঞ্জা তোকেই পছন্দ করে!ঠিক আছে,ও হয়তো সময় নিচ্ছে,তুই কবে এগোবি,সেটা ভেবে।কিন্তু কাল তো আমার মাথাটাই খারাপ হয়ে গেলো।তোকে যদি রঞ্জা পছন্দই করে,তাহলে তোর জন্য অপেক্ষা না করে,ও সমর্পণের সঙ্গে যাবে কেন?!আর সমর্পণের সঙ্গে থাকার পরও,তোর পাগলামিকে এভাবে প্রশ্রয় দেবে কেন?!তোকে বাড়তে দেবে কেন?!দিনরাত তোকে মেসেজ করা,সময়ের মা নেই,বাপ নেই,রাত বারোটা-একটা-দুটো,তোর সঙ্গে হেজিয়ে যাচ্ছে।আর এদিকে সমর্পণের সঙ্গে জড়াজড়ি করে ঘুরে বেড়াচ্ছে!?ওরে ও তোকে ঝুলিয়ে দেবে রে গাধা!!পুরোপুরি মরার আগে,সময় থাকতে-থাকতে ফিরে আয়!ও সমর্পণের সঙ্গেও রয়েছে,আবার তোকেও হাতে রেখেছে।তোকে সমানে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে,সরাসরি কথা বলে সরাচ্ছে না।তুই যখন মেসেজ করছিস,সেই মূহুর্তেই রিপ্লাই দিচ্ছে,রাত জেগে ওর সঙ্গে ফোনে বকছিস,অথচ কোনো কমিটমেন্ট নেই!!আর এসব ব্যাপারগুলোকেই ওর সম্মতি ধরে নিয়ে,তুইও ওই মেয়ের কথায় ভুলে গিয়ে নাচতে-নাচতে ঝুলে যাচ্ছিস!!সামনে-পিছনে আর কিছু ভেবেই দেখছিস না।এত যখন সারাদিন তোর সঙ্গে ফোনে লেগে রয়েছে,তেমন হলে রঞ্জাও তো এগোতে পারতো!ওরে গাধা,ও দুজনকেই চড়িয়ে বেড়াচ্ছে রে!!সমর্পণ তো ফেঁসেই গেছে,তুইও ওই পথেই পা বাড়িয়ে রয়েছিস!!মরবি বলে...শালা ছিঁড়েই দিলো আমার জামার বোতামটা....
জামাটা আটকানোর বৃথা চেষ্টা করে সৌর বললো...
-আমি এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছি জানিস?!আরে বাল যা,যা ভিতরে গিয়ে দেখ,রঞ্জা-রঞ্জা-রঞ্জা....তোর রঞ্জা ওই সমর্পণের বুকের ওপর চড়ে বসে আছে।যা ভিতরে গিয়ে দেখ!!
চমকে উঠলো সমুদ্র...ঋষি মাথা নীচু করে কাঁপছে....
-আমার কথা তোকে বিশ্বাস করতেও হবে না।কিন্তু নিজের চোখে দেখলে,তখন বিশ্বাস করবি তো?!যা-যা গিয়ে দেখে আয়!গায়ে হাত তুলছে আমার!!আমাকে মারতে আসছে!!
কেঁদে ফেললো সৌর....
-তুই ছাড়!আমি নিজেই কোনোদিনও আর তোর সামনে আসবো না বাল...যাঃ!!তুই মর-বাঁচ-মুখ থুবড়ে উল্টে পড়ে থাক,যা খুশি কর!!ওই মেয়ে তোকে ল্যাং মেরে,নর্দমায় ফেলে দিলেও,তোকে টেনে তুলবো না।আর দেখতেও আসবো না শালা!!মিলিয়ে নিস তুই আমার কথা,কুত্তার হাল করে তোকে ছেড়ে দেবে ওই মেয়ে।তখন পাগলা হয়ে যাবি।কিছুই নেই,তাও এইরকম পাগলামি করিস ওকে নিয়ে,আর কিছু হওয়ার পর,কদিন পর যখন লাথ মারবে,তখন তো আর উঠে দাঁড়াতেই পারবি না তুই।তবু যাবি ওখানে,যা!!মর তুই!!এটিটিউট!!পয়সা!!রূপ!!গুণ!!আগেরবার পরীক্ষায় খাতাশুদ্ধু কোথায় চলে গেছে,আমিই জানি না।বেল পড়ে গেছে,খাতা স্টেপল করবো,শালা পেজই আর হাতে আসে না।সব শালা খুলে দিয়েছি,দেখ!দেখে টোক!!তবু পাশ করে যা!একা কেন টপার হবো,সবাই যেন একসঙ্গে বেরিয়ে যেতে পারি!এটিটিউট দেখাচ্ছে আমায়!!কোনদিন দেখিয়েছি রে তোদের এটিটিউট!?আমার এটিটিউট আমি তাদেরই দেখাই,যারা ভালোবাসা বোঝে না।বন্ধুদের কোনোদিনও না!!মর শালা!বন্ধু!!সব বন্ধু চেনা হয়ে গেছে!জামাটাই ছিঁড়ে দিলো আমার....
চুপ করে সৌরর মুখের দিকে একভাবে চেয়ে রয়েছে ঋষি।সৌর চোখ মুছতে-মুছতে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো ওখান থেকে।ঋষির চোখ থেকে আগুন না জল,ঠিক কোনটা বেরোচ্ছে,ওর জানা নেই...মারামারির চোটে দুজনেরই জামা ছিঁড়ে গেছে....সৌরর পিছন-পিছন সমুদ্রও দৌড়োলো....
মাথা নামিয়ে নিলো ঋষি....সিঁড়িতে চুপ করে বসে রইলো....রূপ ওকে বললো,
-চল!ওঠ!!ঋষি??ওঠ....স্যার এসে গেছে এতক্ষণে।ওঠ....
-আজ শুধু টিউশনটা শেষ হতে দে।সমর্পণের খবর আছে।যদি সৌরর কথা সত্যি হয়,সৌর বেঁচে যাবে।আর যদি ও মিথ্যে বলে,ওর অবস্থা আমি খারাপ করে দেবো...
-আর ঝামেলা করিস না ভাই!হ্যাঁরে?তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?!সৌরর গায়ে হাত তুললি তুই?!
সাইকেলটা নিয়ে হাঁটতে শুরু করেও,মাথা নীচু করে কেঁদে ফেললো ঋষি...
-চল-চল!সব ঠিক হয়ে যাবে,চল.....
সর্বক্ষণ একজায়গায় থাকা চারমাথা,আজ দুভাগে বিভক্ত হলো।ঘরের দুই ভিন্ন কোণে দুজন-দুজন করে পৃথকভাবে বসলো।ফাটল ধরলো বন্ধুত্বের অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে....
-বাইরে বেরিয়ে দাঁড়াবি সমর্পণ।তোর সঙ্গে কথা আছে....
রঞ্জা বেরিয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই।বাঁশবাগানটা যেখানে শেষ হয়েছে,তার থেকে একটু আগে পাঁচিলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো সমর্পণ আর ওর কয়েকজন বন্ধু....রূপ একটু ভয়ে পেয়ে গেলো।অন্যদিন তো সমর্পণের বন্ধুরা চলেই যায়,আজ যায়নি কেন?!ঋষিটাও আবার লাফাতে-লাফাতে ওইদিকেই গেলো।ভয়ে অস্থির হয়ে গেলো রূপ....নিজেদের মধ্যে ঝামেলাটা মিটিয়ে নেওয়ার জন্য ও সৌরর কাছে এসে দাঁড়ালো....
-ভাই?
-দেখ রূপ!তোর সঙ্গে আমার কিন্তু কিছু হয়নি ভাই!তুই ঋষির হয়ে ওকালতি করতে আসিস না প্লিজ!
সমুদ্র নির্বাক শ্রোতা।ও নিজেও মনেপ্রাণে চাইছে,ব্যাপারটা এখানেই মিটে যাক।কিন্তু সৌরকেও ও খুব ভালোভাবে চেনে।ওর জেদ,ওর অহংকারও কিছু কম নয়!তাই কথা না বাড়িয়ে,এই পরিস্থিতিতে নিজের মুখটা বন্ধ করে রাখাই,সমীচীন বলে মনে করলো ও....
-সমর্পণের সঙ্গে অভিলাষ,হিমাদ্রিরাও আছে।আর সায়ন কি মারকুটে জানিস তো!ঋষিকে ছিঁড়ে খাবে ভাই!!তুই চল!ও একা আছে....
-যাবো না!!তুইও যাস না!মরুক ও!ওর মাথায় রঞ্জা ঢুকেছে।রঞ্জা ল্যাং মারলে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে মরার চেয়ে,সমর্পণের হাতে মার খেয়েই মরে যাক ও।তাতে অন্তত সম্মানটা কিছুটা বাঁচবে।নিজের কোনো আত্মসম্মান নেই,কিছু নেই।এত করে বোঝালাম,এত বললাম,তাও দৌড়োলো সমর্পণের কাছে...কি অবস্থা!!তুইও যাস না রূপ!!
-হ্যাঁ রে বাল!!তুই তো বলবিই!মাত্র দু-বছর হলো আমাদের চিনিস তো!এরপর আবার কলেজে গেলেই সবাইকে ভুলে যাবি,নিত্য-নতুন বন্ধু জুটে যাবে।আমাদের আর কে মনে রাখবে!!কিন্তু ঋষি আর রূপের বন্ধুত্ব এতোটাও ঠুনকো নয় সৌর!!সেই ল্যাংটো বয়স থেকে বন্ধু আমরা,হিসি করে দেওয়ালে নাম লেখার বয়স থেকে বন্ধু আমরা,টিফিন নিয়ে মারামারি করে জামা ছিঁড়ে দিয়ে,আবার ওই ছেঁড়া জামা পরে একসঙ্গে একে-অপরকে টিফিন খাইয়ে দেওয়ার সময় থেকে বন্ধু আমরা।ও যতই পাঁঠা হোক!ও মরতে গেলেও আমি ওর সঙ্গেই যাবো...কিছুতেই ওকে একা ছাড়বো না!!
ব্যাগটা পিঠে ফেলে সাইকেলে উঠে পড়লো রূপায়ণ...বেরিয়ে গেলো....
-হ্যাঁ যা-যা!ও নিজেও তো মরতে গেছে,তুইও যা!উফফ!!সবকটা এক-একটা আস্ত গবেট!আমার কপালেই জোটে সবগুলো....তুই হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন?তোকে বলিনি!!
সমুদ্রর দিকে চেয়ে খেঁকিয়ে চিৎকার করে উঠলো সৌর....
-হ্যাঁ তো?আমি আর রঞ্জা গত এক সপ্তাহ ধরে একসঙ্গেই আছি!!উই আর কাপল!!ও আমাকে একসেপ্ট করেছে!
-শালা....স্কুল-টিউশন সব জায়গায় সবাই জানে,রঞ্জা আমার!ওকে প্রোপোজ করার সাহস,তোর হলো কি করে সমর্পণ?
-সবার কথা বাদ দে ঋষি!!রঞ্জা জানে?
চুপ করে গেলো ঋষি....বাঁকা হাসি হাসলো সমর্পণ....
-উত্তরটা আমি বলছি!হ্যাঁ জানে!তোর দিকটা ও সবই জানে।আর তোর কথা উঠলেই হেসে মরে যায়।আসলে তোকে ওর জোকার বলে মনে হয়!!তুই ওকে হাসাতে পারবি,ফাঁকা থাকলে ও তোর সঙ্গে টাইম-পাস করতে পারবে,ও কোনো কারণে আপসেট থাকলে,আমি ওকে সময় দিতে না পারলে,তুই বেশ সুন্দর ভাবে সামলে নিস ভাই!কোনো ব্যাপার না,এভাবেই চালা না।আমার কোনো অসুবিধে নেই...
-ঋষি চল এখান থেকে....
রূপ এসে টেনে ধরলো ঋষিকে....ঋষি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই কেঁদে ফেলেছে।শরীরে আর একটুও শক্তি নেই ওর....
-আসলে কি বলতো ঋষি,বুকিং করা জিনিসই আমার আবার বেশি পছন্দ।আমি এই কদিন ফ্রি ছিলাম,পরীক্ষার আগে স্ট্রেস কাটানোর জন্য কাউকে খুঁজছিলাম।ভাবলাম,ঋষির বউকেই একটু বাজিয়ে দেখি,দেখলামও....সবচেয়ে অবাক কান্ড,ওই মেয়েও এককথায় রাজি হয়ে গেলো।ঠিক আছে,আমিও থাকি,তুইও থাক!চিন্তা নেই।গত এক সপ্তাহে ওকে বুঝে গেছি।তোর ওই রঞ্জাও আমারই মতো।দুজন কেন,ও দশজনকে একসঙ্গে সামলে নিতে পারবে।স্কুল শেষ হয়ে গেলে,আমিও ওকে ছেড়ে দেবো।তখন রঞ্জা পুরোপুরি তোর...এখন নিজের ইচ্ছেতেই আমার সঙ্গে আছে যখন,থাকুক কিছুদিন!আমি আর একটু ভালোভাবে দেখে নিই....তারপর তোর জিনিস,তোরই থাকবে....প্রথমবার কলেজে পা রেখে,পুরোনো জিনিসপত্র আমি আর সঙ্গে রাখবো না!!স্কুলেরটা স্কুলেই ছেড়ে যাবো!কিন্তু ছেড়ে দেওয়ার আগে একটু দেখে নিই.... কিরে?কি বুঝলি?!
রাগে-দুঃখে অন্ধ হয়ে সোজা সমর্পণের জামার কলার টেনে ধরতে গেলো ঋষি।কিন্তু তার আগেই সায়ন ঋষির নাকে সজোরে একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো।নাকের ওপর অতর্কিত আঘাতে,মাথা ঘুরে চোখমুখ অন্ধকার হয়ে গেলো ঋষির....
মাটিতে বসে পড়লো ও....রূপ চিৎকার করতে গিয়েও আগে ঋষিকে টেনে তুললো।ওর দিকে চেয়ে দেখলো,ঋষির নাক দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়ছে।চমকে উঠে অশ্লীল একটা গালাগালি দিয়ে,নিজের পকেট থেকে রুমালটা বের করে,রূপ চেপে ধরলো ঋষির নাকে....
(চলবে.....)
ছবি: সংগৃহীত
-আয়,আরে আয় নারে...এইটুকু বৃষ্টিতে কিছু হবে না।টাইগার,আয় বলছি!উফফ....
টাইগারকে ধরে টানাটানি করতে থাকে তিলোত্তমা।গায়েও লাগছে না এমন ঝিরঝিরে বৃষ্টি।কিন্তু তাও টাইগার কিছুতেই বেরোয় না...
ভিজে গায়েই বৃষ্টির মধ্যে ছুটতে-ছুটতে সৌর পৌঁছলো ওখানে...
-হাই!তিলোত্তমা....
ঘ্যাক করে বেরিয়ে এলো টাইগার।ঘেউ-ঘেউ করে চিৎকার করতে শুরু করলো।গলায় চেন নেই,একবারে ছাড়া রয়েছে।টাইগারের ধমকের ভয়ে সৌর আর তিলোত্তমার দিকে এগোবার সাহসই পেলো না....লাফ মেরে দু পা পিছিয়ে এলো...
-টাইগার!!দাঁড়া!এইদিকে আয়!
তাও গলা ছেড়ে চিৎকার করেই যাচ্ছে টাইগার...এবার গলা নামিয়ে তিলোত্তমা শান্ত অথচ ভারী গলায় বললো,
-টাইগার,এদিকে এসো....আমার কথা শোনো....
সুড়সুড় করে সরে গেলো টাইগার।তিলোত্তমার পায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।ওর মুখের দিকে করুণ নয়নে একবার চেয়ে বারকয়েক আদুরে লেজ নেড়ে,সৌরকে দেখে ওইখান থেকেই গজরাতে লাগলো....
-সরি....কি যেন,হ্যাঁ সৌরদীপ!আসলে ও আমাকে নিয়ে ভীষণ পসেসিভ!রাস্তাঘাটে আমার সঙ্গে কেউ একটু কথা বলতে এলেই,ও ভীষণ রেগে যায়...ইস!তুমি তো একেবারে ভিজে রয়েছ!খেলতে এসেছিলে??
-হুম!আসলে....
তিলোত্তমার দিকে এগোতে যায় সৌর....গরগর শব্দ করতে-করতে ওদিক থেকে এগিয়ে আসে টাইগারও....সৌর আবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে....
-সমস্যাটা কি?
-ওই যে,তুমি আমার সঙ্গে কথা বলছো!
-তো?
-ওটাই ওর সহ্য হয় না!আমার সঙ্গে কেউ কথা বললে,আমার দিকে অচেনা কেউ এগোলে,ও সহ্যই করতে পারে না!
-এ আবার কি?বয়ফ্রেন্ড নাকি তোমার?!
হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো তিলোত্তমা।চোয়াল ঝুলে পড়লো ওর।তারপরই হো-হো করে হেসে উঠলো।সৌরর সারাটা শরীর জলের ছোঁয়ায় সিক্ত,জল নাকি আগুন নেভায়!!কিন্তু তাও এই ভিজে অবস্থাতেই ওই হাসিতেই সৌর জ্বলতে লাগলো,এক চরম ভালোলাগায়....
-খুব খারাপ জোক ছিলো এটা....
-না,এইরকম তো বয়ফ্রেন্ডরাই করে।তাই বলছিলাম।নাম কি ওর?টাইগার বোধহয়!!
-হুম!
-দাঁড়াও,আগে ওকে ম্যানেজ করি!
-এই সৌরদীপ,সাবধান!!খেপে গেলে কিন্তু কামড়ে দেবে।কিছু হবে না যদিও,তবে একটা রক্তারক্তি ব্যাপার হয়ে যাবে.....
তিলোত্তমার কথাটা তেমন গুরুত্ব দিলো না সৌর।এগিয়ে গেলো টাইগারের দিকে।রাগে গরগর করতে-করতে টাইগারও ঘেউ-ঘেউ করে উঠলো....
-এই তাহলে ওর হালকা হতে যাওয়ার কারণ?
রূপ বলে উঠলো...
-মানে?
ঋষি আর সমুদ্র দূর থেকে একভাবে চেয়ে রয়েছে সৌর আর তিলোত্তমার দিকেই...
-আরে বল আনতে গিয়ে দেখি,সৌর চুপ করে ক্লাবের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।তাহলে এর জন্যই....
-কিন্তু মেয়েটা কে?
-আমি কি করে জানবো?আগে তো পাড়ায় দেখিনি!
-আজ আর সৌরর টিকি পাওয়া যাবে বলে তো মনে হচ্ছেনা।চল!আমরা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজবো কেন?সন্ধ্যে হয়ে গেলো তো।বাড়ি যাই.... কাদা মেখে ভূত হয়ে গেছি একদম।মা চিনতে না পেরে,বাড়ির বাইরে থেকেই আবার না খেদিয়ে দেয়....
ওরা তিনজন মাঠের পার থেকে সাইকেল নিয়ে শর্টকাট দিয়ে বেরিয়ে গেলো যার-যার রাস্তায়।ফুটবল ঢুকে গেলো ক্লাবে,জনশূন্য হয়ে পড়ে রইলো সবুজ ঘাসের গালিচায় আবৃত সুবিস্তৃত মাঠ....
-চল টাইগার,তাহলে যাওয়া যাক!!
-মানে সিরিয়াসলি সৌরদীপ,আমি তো নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারছি না!!
অবাক তিলোত্তমা...
-কেন?
টাইগারের মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দিয়ে একবার মাঠের দিকে চাইলো সৌর।টাইগার ততক্ষণে সৌরর গা শুঁকে বারকয়েক চেটেও দিয়েছে।বোধহয় খুব একটা ভালো স্বাদ নয় বলে,আবার সরে গেছে।ইতস্তত লেজ নেড়ে-নেড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সৌর আর তিলোত্তমাকে কেন্দ্র করে।সৌর এক নজরে দেখলো,বন্ধুরা কেউ নেই।শূন্য মাঠ।ল্যাম্পপোস্টের সাদা আলোগুলো জ্বলছে কেবল।আলোর নির্দিষ্ট বৃত্তটুকুতেই বোঝা যাচ্ছে,ইলিশে-গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।নইলে তো গায়েই লাগছে না।আর এমনিতেও সৌর ভিজে গায়েই রয়েছে।তাই সেদিক থেকে নতুন করে ভেজা আর না ভেজা,ওর কাছে দুইই সমান।ও তিলোত্তমাকে বললো,
-বাড়ি যাবে তো?
-হুম!
-চলো,আমিও যাবো।দাঁড়াও,সাইকেলটা নিয়ে আসি!মাঠের ওপারে আছে!চল টাইগার!যাবি?
তিলোত্তমা হাঁ করে চেয়ে দেখলো,টাইগার নাচতে-নাচতে,লেজের ব্যায়াম করতে-করতে সৌরদীপের সঙ্গে-সঙ্গে ছুটলো....
-তিলোত্তমা....চলো!আমি সাইকেল হাঁটিয়েই নিয়ে যাচ্ছি!
-হ্যাঁ,অবশ্যই।তুমি উঠতে বললেও,তোমার সাইকেলে উঠতাম নাকি!?আমি হেঁটেই যেতাম...
হেসে ফেললো সৌর....
-কি আশ্চর্য!!আমি তোমাকে উঠতে বলতামও না....
দুজনেই হেসে ফেললো একসঙ্গে....সুখী টাইগার হেলতে-দুলতে লেজ নাড়তে-নাড়তে বহাল তবিয়তে ওদের সঙ্গে চললো।কথায়-গল্পে তিলোত্তমার বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেলো ওরা....
-আই মাস্ট সে সৌরদীপ....
-তুমি আমায় সৌর বলে ডাকতে পারো।আমার সব বন্ধুরা আমাকে ওই নামেই ডাকে।
-ওকে....আমারও আরও অনেক নাম আছে,সোনামা!তুমি আমায় সোনামা বলেও ডাকতে পারো!
-সোনার সঙ্গে আবার মা....ও চলবে না!
-কেন?নামটা খারাপ কি?সোনামা নামটা তো মা-বাবাই আদর করে ডাকে।
-অন্য কোনো নাম?
-ওকে...মিছরি?আমার দিদুন ডাকে!
-হ্যাঁ....এটা খুব মিষ্টি!!
-কোনটা?
-মিছরি.....না মানে নামটা....
বলেই সৌর হেসে অন্যদিকে মুখটা ঘুরিয়ে নিলো।সৌরর দিকে একভাবে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে,হেসে ফেললো তিলোত্তমাও...মুক্তঝরা হাসির সংজ্ঞা কি,জানা নেই সৌরর।তবে ওর মনে হলো,যদি মুক্তঝরা হাসি বলে সত্যিই কিছু থাকে,তবে এটাই তার সঠিক সংজ্ঞা।মিছরির মুখের হাসিটা....একটু হেসে তিলোত্তমা সৌরর চোখে-চোখ রেখে বললো,
-ফ্লার্ট করছো?
-ফ্লার্ট?!ধুর!ওসব তো বাচ্চারা করে।আমার অত সময় কোথায় ওসবের জন্য?
-হুম!!বুঝলাম!!আমি এখন ভীষণ ব্যস্ত একজন মানুষের সঙ্গে কথা বলছি!
-সে আর বলতে!ব্যস্ত তো বটেই।তুমি কি বলছিলে মিছরি?
-কোথায় কি বলছিলাম?
-ওই যে বললে না,আই মাস্ট সে সৌরদীপ....কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলে তখন...
তিলোত্তমাদের বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো ওরা।দারোয়ান বড় গেট খুলে দিলে,টাইগার লাফাতে-লাফাতে চলে গেলো ভিতরে...
-আরে হ্যাঁ,আমি তখন যেটা বলতে যাচ্ছিলাম,সত্যিই আমি আজ পর্যন্ত খুব কম সংখ্যক মানুষকেই দেখেছি,টাইগার আমার আশেপাশে মেনে নিয়েছে।মানে একেবারেই হাতে গোনা লিমিটেড কয়েকজন,তাই তোমাকে এভাবে ওর সঙ্গে দেখে....
সাইকেলের হ্যান্ডেলটা একহাতে ধরে ভেজা চুলগুলো কপালের ওপর থেকে পিছন দিকে সরিয়ে নিলো সৌর।তারপর হেসে ফেললো...
-হাসলে যে?
চিরকালীন অভ্যাসবশত নিজের তর্জনীটা নাকের একটু ঘষে নিয়ে সৌর বললো,
-আই এম লিমিটেড এডিশন!!জাস্ট লাইক ইউ....
বলেই তিলোত্তমার দিকে চেয়ে মৃদু হাসলো সৌর।তিলোত্তমা ওপর-নীচে একবার ঘাড় নাড়লো।তারপর মৃদু হেসে বললো,
-প্রথম দিন দেখাতেই এভাবে ওপেনলি ফ্লার্ট কে করে সৌর?!
দুজনেই হেসে উঠলো সশব্দে....
সৌর একবার ভালোভাবে চেয়ে দেখলো তিলোত্তমার দিকে।মাথায় আলগা একটা খোঁপা করা রয়েছে।দুপাশ দিয়ে চুলগুলো মুখে-কাঁধে ছড়িয়ে রয়েছে,একটু ভেজা....
সৌর মাথা নামিয়ে নিলো....
ঘেউ-ঘেউ করে ওপরের ঝুলবারান্দা থেকে টাইগার ডেকে উঠলো....সেদিকে চেয়ে তিলোত্তমা বলে উঠলো,
-টাইগার ডাকছে।আমি এলাম সৌর।দেখো আমি জানি,বাড়ির সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে চলে যাওয়াটা,ভীষণই দৃষ্টিকটূ।আমি তোমাকে ভিতরে আসতে অবশ্যই বলতাম।কিন্তু আজ বলবো না।
-নানা!ওকে....পারফেক্টলি অলরাইট...
-না,শোনো কারণটা?
-আচ্ছা বলো!
যেতে তো সৌররও ইচ্ছে করছে না।
-দুটো কারণ,যেটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ,সেটা হলো,তোমার সারা গা-জামাকাপড় পুরো ভিজে।আগে বাড়িতে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হও।নইলে ঠান্ডা লেগে,জ্বর এসে বিছানায় শুয়ে পড়বে।আর দ্বিতীয় কারণটা হলো,এক্ষুণি আমার যোগা-মেডিটেশন এর ক্লাস নিতে একজন প্রাইভেট-ট্রেইনার আসবেন।আমি ওদিকে বিজি হয়ে যাবো।সুতরাং বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে,তোমাকে আর সময়ই দিতে পারবো না।তাই,সরি সৌর....
-একদম ঠিক আছে।আমি ওসব নিয়ে ভাবছিই না।কিন্তু তুমি মেডিটেশন করো?যোগব্যায়ামও?বাঃ!!
-আমি ফিট থাকতে ভালোবাসি!আমার জীবনের কতগুলো এমবিশন আছে সৌর,যেগুলোর জন্য,আমার নিজেকে সুন্দর রাখতেই হবে।প্রপার ডায়েট,এক্সসারসাইজ....
-মেডিটেশন-যোগা ইজ টু গুড,বাট সেভাবে এক্সসারসাইজ কি করো?
-কেন বলো তো?
সন্ধিহান হয়ে সৌরকে জিজ্ঞেস করলো তিলোত্তমা....
-না এমনিই!সরি!প্লিজ কিছু মনে কোরো না।আমি বোধহয় তোমার ব্যক্তিগত পরিসরে,একটু বেশিই ঢুকে গেছি।সরি মিছরি....
-না!তা নয়!আসলে এসব নিয়ে তো সেভাবে কেউ কথা বলে না।সবাই খালি কোন ক্লাস,কোন স্কুল,কোন গ্রেড, এসবই আগে জিজ্ঞেস করে।তাই একটু অবাক হলাম বৈকি!আমি নাচতে ভালোবাসি সৌর।নাচটা আমার প্রাণ,এছাড়াও আমার মনে হলো,আলাদাভাবেও একটু কিছু শরীরচর্চা করলে ভালো হয়।বাবাইকে সকালে বলতে,বাবাই একজনকে প্রাইভেটে....
-হোয়াই ডোন্ট ইউ জয়েন সুইমিং?আই মিন,সাঁতারের চেয়ে ভালো এক্সসারসাইজ আর কি আছে?!সাঁতারের পাশাপাশি ওগুলো থাক...
-কিন্তু আমি তো সাঁতার জানি না!!
-হ্যাঁ তো শিখবে....
-এখানকার তো কিছুই চিনি না আমি!কোথায় সুইমিং পুল,কোথায় কি....
-টুমরো,এট থ্রি পিএম!শার্প!!কাল স্কুলও ছুটি আছে।সকালে আমার টিউশন আছে।তাই বিকেলে....আমি তোমার বাড়ির সামনে চলে আসবো,এইখানেই।তুমি বেরিয়ে এসো।আমি নিয়ে যাবো তোমাকে।আর হ্যাঁ,তোমার দু-কপি রিসেন্ট ছবি,যেকোনো একটা ফটো আইডি প্রুফ,আর মেডিকেল সার্টিফিকেট,এগুলো রেডি রাখবে।
-মেডিকেল সার্টিফিকেট?
-আরে তেমন কিছুই না!তুমি যে সুইম করার জন্য ফিজিক্যালি ফিট,সেটা একটা রেগুলার চেক-আপ করিয়ে,ডাক্তারকে দিয়ে প্রেসক্রিপশনে লিখিয়ে আনবে।ওটা জাস্ট একটা ফর্মালিটি,ডোন্ট ওয়ারি!তুমি এগুলো রেডি রেখো।আমি দুপুরে এসে তোমাকে নিয়ে যাবো....
-কতদূর?
-আছে কিছুটা দূর.... কেন?
-আমি কিসে করে যাবো?
-আমি একা থাকলে তো সাইকেলেই চলে যাই,কাল তুমি থাকলে,অটোতেই যাবো!
চমকে উঠলো তিলোত্তমা....
-এই নানা!ওসব পাবলিক ট্রান্সপোর্টে আমি উঠতেই পারবো না।তুমি বরং আমাকে এড্রেস দিয়ে দাও,আমি গাড়ি নিয়ে যাবো।আমার বাবাই যাবে সঙ্গে....
একটু থমকে গেলো সৌর।এই মেয়ে নিজের প্রাইভেট গাড়ি ছাড়া,এক পা-ও চলতে পারে না!!আর কিছু বললো না ও।চুপ করে গেলো....
-কিভাবে দেবে ঠিকানা?আচ্ছা তোমার নম্বর বলো?
নিজের ফোনে সৌরর নম্বরটা রেখে দিলো তিলোত্তমা....সৌর আর কিছু বললো না....চুপচাপ সাইকেলে উঠলো,
-এই শোনো,তুমি কি অনেকদিন ধরে সুইমিং করো?মানে জলটল পরিষ্কার তো?ক্লোরিনে ট্যান হয়ে আমার স্কিন টেক্সচার খারাপ হয়ে যাবে নাতো?জল কি অনেকটা গভীর?মানে আমি তো একদম নন-সুইমার....আমি জলে নামলে,আমার বাবাই ভীষণ দুশ্চিন্তা করবে...
মৃদু হাসলো সৌর...তারপর বললো,
-হ্যাঁ,আমিও ওই সবে-সবেই সাঁতার শিখছি,এবার না হয় দুজনে মিলেই শিখবো।ওখানকার ট্রেইনাররা খুব ভালো,একেবারে হাতে ধরে শেখায়।তুমি এসো,তোমার খুব ভালো লাগবে।আর স্কিনটোন?ক্লোরিন আর রোদে একটা ট্যান পড়ে ঠিকই,তুমি বিকেলের দিকে জলে নামবে।রোদের তেজ একটু কমে গেলে!!জলে নামার আগে সানস্ক্রিন ইউজ করবে,আর জল থেকে উঠে শাওয়ার নেওয়ার আগে ডি-ট্যান স্ক্রাব।ও আমি সব বলে দেবো,ওসব নিয়ে ভেবো না।আগে এসে তো দেখো....তারপর অসুবিধে হলে না হয় ছেড়েই দিও....আর জলের গভীরতার কথা যদি জানতে চাও,তাহলে আমি বলবো,জলে না নামলে বুঝবে কি করে,জল কতটা গভীর!?তার জন্য তো ট্রেইনারের হাত ধরে,ট্রেইনারকে ভরসা করে,তোমাকে ডুবতে হবে মিছরি....জলে তো নামতেই হবে....
-হুম!সেটাও ঠিক!
-কাল আসছো তো তা হলে?আমি বাড়ি গিয়ে তোমায় ঠিকানা পাঠিয়ে দিচ্ছি....একটা মিসড কল করে রেখো...
-ওকে,আই উইল!!চলো বাই সৌর....
-টাটা!!
তিলোত্তমা ঢুকে গেলো বাড়ির ভিতরে।আর পিছন ফিরে চাইলো না।দারোয়ান গেট বন্ধ করে দিলো....সৌর ভেবেছিলো তিলোত্তমা হয়তো সামনের ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়ে একেবারে বাড়িতে ঢোকার আগে,একবার অন্তত পিছন ফিরে দেখবে।তাই ও সাইকেলের ওপর বসে অপেক্ষাও করছিলো।কিন্তু আর ফিরে চাইলো না মিছরি।ঢুকে গেলো ভিতরে।সৌর মাথাটা নীচু করে ঘুরিয়ে নিলো সাইকেলটা....এবার একটু-একটু শীত করছে।অনেকক্ষণ ভিজে অবস্থায় রয়েছে ও....
অন্ধকার হয়ে গেছে আজ।শর্টকাট রাস্তাটায় আর ঢুকলো না সৌর।দিনের আলো থাকলে ঠিক আছে,কিন্তু রাতের বেলা একটাও আলো জ্বলে না ওই রাস্তার।ভীষণ অন্ধকার থাকে।তাই ও ঘুরে বড় রাস্তা ধরেই যাবে ঠিক করলো...সাইকেলটা জোরে চালিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই এসে পৌঁছলো বড় রাস্তার মোড়ে।এবার রাস্তা পার হতে হবে।অটোগুলো সারি-সারি দাঁড়িয়ে রয়েছে।মাঝে বড় একটা বাস দাঁড়িয়ে।বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সৌর।প্রচন্ড শীত করছে ওর।শরীরে মৃদু কাঁপুনি।কিন্তু সমস্ত কাঁপুনির ঊর্ধ্বে এমন একটা দৃশ্য ওর চোখে পড়লো,যে ও একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলো....অটো থেকে যে ছেলেটা রঞ্জাবতীকে হাত ধরে নামালো,সে আর কেউ নয়,সমর্পণ!!অটোভাড়া দিয়ে রঞ্জার কাঁধে হাত রেখে,দুজনে হেসে-হেসে কথা বলতে-বলতে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে।ঢুকলো একটা স্ন্যাকসের দোকানে।সৌর স্পষ্টই দেখলো,সমর্পণ হাত রেখেছে রঞ্জার কাঁধে,আর রঞ্জা ওর কোমরে হাত রেখে চেপে ধরেছে সমর্পণের জামা।দুজনের পিঠেই দুটো স্কুলব্যাগ।ওরা বিভোর হয়ে রয়েছে নিজেদের বৃত্তে।দুজনে কথা বলতে-বলতে,রাস্তার ওপারের কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকে গেলো ভিতরে....মাথাটা ঘুরে গেলো সৌরর।ঋষিকে কি বলবে ও?!কিভাবে বলবে?!
সমর্পণ!স্কুল আলাদা হলেও টিউশন এক।সেই সূত্রেই ওর আলাপ রঞ্জাবতীর সঙ্গে।খুব বেশিদিনের পরিচয়ও না।টিউশনে সমু,সৌর,ঋষি আর রূপ সবসময় একজায়গায় থাকায়,ওদের আর কাউকে সেভাবে প্রয়োজন পড়ে না।আর আলাদা স্কুল হওয়ায়,সমর্পণের সঙ্গে তো তেমন কোনো বন্ডিংই নেই।কথাই হয় না প্রায়।ওর বন্ধুবৃত্ত সম্পূর্ণ পৃথক।রঞ্জাবতীকে সৌর টিউশনে দেখেছে,সমর্পণের সঙ্গে টুকটাক কথা বলতে,সে তো ওইরকম একটু-আধটু কথা,সবাই সবার সঙ্গেই বলে।কিন্তু সেটা যে ভিতরে-ভিতরে এতটা গভীর,এই খবরটা তো ওরা কেউ জানেই না।এসব প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে ন্যাকামি,অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি,সৌরর বরাবরই অপছন্দের।কিন্তু আজ রঞ্জাকে সমর্পণের সঙ্গে ওভাবে দেখে,চোখে জল এসে গেলো ওর।সেদিনের ঋষির সরল-হাসিখুশি-লাজুক মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই মুহূর্তেই....একইসঙ্গে ভেসে উঠলো মিছরির মুখটাও....ভয়ে কেঁপে উঠলো সৌর।জ্বর আসছে বোধহয়....
রাস্তার যানজট একটু হালকা হলে,সাইকেল নিয়ে রাস্তা পার হয়ে বেরিয়ে গেলো সৌর....
-অসম্ভব!আমি বিশ্বাস করি না!
-তাতে সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাবে না রূপ।আমি আজ নিজে দেখেছি,রঞ্জা আর সমর্পণকে একসাথে।আর যেভাবে দেখেছি,ওটা যে শুধুমাত্র বন্ধুত্ব নয়,আমি সেই গ্যারান্টি দিলাম,মিলিয়ে নিস আমার কথা।শুধু তোকেই জানালাম।ঋষিকে বলার ক্ষমতা,আমার হবে না।তুই দেখ,জানাবি কিনা!!রাখছি আমি।মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়....
-তা ভিজে গায়ে অতক্ষণ থাকতে কে বলেছিলো?
-এ রূপ,থাম তো!বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই মা একচোট চিৎকার করলো,আবার তুইও?!কিচ্ছু ভালো লাগছে না আমার।রাখছি,কাল দেখা হচ্ছে।তুই দেখ,ঋষিকে কিভাবে জানাবি....
ফোনটা রেখে দিলো সৌর।মেজাজটা একদম বিগড়ে গেছে ওর।মিছরি বললো ফোন করবে,কোথায়?করলো না তো?!এসেই ফোনের কল-লিস্টের অলিগলি আতিপাতি করে খুঁজেছে সৌর।কিন্তু কোনো অজানা নম্বর নেই।বড্ড আশা করেছিলো সৌর,কিন্তু এভাবে আশাহত হবে,স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।জ্বরটাকে ধরেবেঁধে আটকানোর জন্য,বাড়িতে ঢুকেই ওষুধ খেয়ে নিয়েছে।কাল জলে নামতেই হবে ওকে।যদি ও যায়....মিছরির কথা ভাবতে-ভাবতেই চোখটা বন্ধ করলো সৌর....
ঘর পুরো ফাঁকা।সমু-ঋষি-রূপ কেউই আসেনি তখনও।ঘরে ঢুকেই থমকে গেলো সৌর।একদম কোণের খোলা জানলার ধারে,সমর্পণের একেবারে বুকের কাছে রঞ্জা দাঁড়িয়ে রয়েছে।একে-অপরের হাতে-হাত রাখা।সৌর অতর্কিতে ঘরে ঢুকে পড়ায়,একটু সরে দাঁড়ালো রঞ্জা।সৌরকে দেখে দুজনেই একটু কাষ্ঠহাসি হাসলো....বিনিময়ে সৌর একটু হেসে ব্যাগটা নামিয়ে রেখে বেরিয়ে এলো ঘরের বাইরে....
-এসব কে বলেছে তোকে?
-সৌর!!কালই তোকে ফোন করতাম।কিন্তু সাহস হয়নি ভাই।ভাবলাম,আজ সামনাসামনিই বলি।নইলে তুই কি পাগলামি করে বসবি...
টিউশনে ঢোকার আগে,মাথা নামিয়ে ঋষির প্রশ্নের উত্তর দিলো রূপ...
-সৌরকে আমরা কদিন ধরে চিনি রূপ?ও নিজেও যেমন,
ও চায় ওর আশেপাশের সবাই ওর মতোই হবে।তুই জানিস না,এসব প্রেম-ভালোবাসার ধার ধারে না ও।রঞ্জা আমার দিকে তাকায়,আমার সঙ্গে এসে কথা বলে,ও এসব সহ্য করতে পারে না।ওর মতো সবাইকে তৈরি করতে চায়।তাই ও নিজে না বলে,তোকে দিয়ে এসব কথা বলাচ্ছে।জানে,তুই আমার ছোট্টবেলার বন্ধু,তোর কথা তো আমি বিশ্বাস করবোই।দুদিনের একটা ছেলে সৌর,ও বললো,আর তুই ওর কথা বিশ্বাস করে নিলি রূপ?রঞ্জা এইরকম করতেই পারে না...
-সত্যি-মিথ্যে আমিও জানি না ঋষি।যেটা সৌর আমাকে বলেছে,সেটাই আমি তোকে বললাম....
-কোথায় ও?চল তো দেখি!ওর মুখ আজ আমি ভেঙে দেবো!
-এ ভাই!মাথা গরম করিস না ভাই...উফফ!!
ততক্ষণে সাইকেল চালিয়ে টিউশনের দিকে বেরিয়ে গেছে ঋষি।রূপ তাড়াতাড়ি করে সাইকেলের গতি বাড়িয়ে ওর পিছনে গেলো....
টিউশন থেকে বেরিয়ে কয়েক পা হেঁটে নির্জন শিবমন্দিরটার সিঁড়ির ওপরে,সৌর এসে বসলো।সকাল থেকে যে কতবার ফোনটা চেক করেছে,তার ইয়ত্তা নেই।কিন্তু কোনো অচেনা নম্বর চোখে পড়েনি ওর।ফোনটা প্যান্টের পকেটে রেখে দিলো ও।কবজিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলো,এখনও স্যার আসতে মিনিট পাঁচেক দেরি আছে।স্যার তো এই রাস্তা দিয়েই বাইক নিয়ে যাবে।স্যার এলে তবেই ভিতরে ঢুকবে ও।সকাল সাড়ে-ছটার সময় ও বাড়ি থেকে বেরিয়েছে।ঘুরপথ হবে জেনেও,ওদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা দিয়েই এসেছে সৌর।নিস্তব্ধ গোটা বাড়ি।সব দরজা-জানালা বন্ধ।কোনটা যে ঘুমন্ত রাজকন্যার ঘর,তাও তো সৌর জানে না।দারোয়ানটা টুলের ওপর বসে-বসে ঢুলছিলো।সব দেখেশুনে ও চলে এসেছে।কিন্তু মেয়েটা ফোন কেন করলো না?!
অদূরেই কচুরীপানায় আবৃত একটা পুকুর,তার চারিদিকে সবুজ জঙ্গল।পুকুরের একটু দূরেই বাঁশবাগান শুরু হয়েছে।জায়গাটা বড় নির্জন।শুধু ক্ষণে-ক্ষণে পাখির ডাক শোনা যায়।এই জায়গাটা খুব ভালো লাগে সৌরর।পুকুরপাড়ের একটা গাছের সরু ডালে,একটা মাছরাঙা পাখি চুপ করে ধ্যানস্থ অবস্থায় বসে আছে।গাছের পাতার আড়াল থেকে কয়েকটা সাদা বক উঁকি দিচ্ছে....
-কিরে?তোকে কখন থেকে ডাকছি,শুনতে পাচ্ছিস না?
-না!সরি!বল....
চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে সমুদ্রকে দেখে,উঠে দাঁড়ালো সৌর।
-এখানে বসে আছিস কেন?ভিতরে চল।
-স্যার আসুক!যাচ্ছি!স্যার আসেননি এখনও....
-তোর কি হয়েছে রে সৌর?
-কিছুনা তো!
সমুদ্র চুপ করে চেয়ে রইলো সৌরর দিকে...
-বারো বছর ধরে চিনি তোকে।তুই কিন্তু আমাকে মিথ্যে বলে পার পাবি না।এক রাতেই তোর চোখমুখ পুরো পাল্টে গেছে।শরীর খারাপ নাকি?রাতে ঘুমোসনি তুই?
-না!ঘুমিয়েছি।আসলে রাতের দিকে একটু জ্বর এসেছিলো।সকালে একদম উঠতে ইচ্ছে করছিলো না।
-তা ওইভাবে বৃষ্টিতে ভিজে,কলে স্নান করে,ভিজে অবস্থায় অতক্ষণ থাকলে,তোর জ্বর আসবে নাতো,কার আসবে?!
সৌর চুপ করে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।মুখটা অদূরের বাঁশবাগানের দিকে ফেরানো।চোখদুটো জ্বালা করছে ঘুমে....
-কালকের ওই মেয়েটা কে ছিলো রে?কিরে??
-তিলোত্তমা!
-সেটা আবার কে?
সৌরকে প্রশ্ন করলো সমুদ্র....
-ঋষি দাঁড়া....
দুজনেই চমকে রাস্তার দিকে চাইলো।সাইকেলটা মাটিতে ফেলেই ওদের দিকে দৌড়ে আসছে ঋষি।সমুদ্র অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে রয়েছে।কিন্তু সৌর একভাবে ঋষিকেই দেখছে....হাত দুটো বুকের সামনে রাখলো ও...ঋষি এসে দাঁড়ালো সৌরর মুখোমুখি.... পিছনে রূপ দুটো সাইকেল দাঁড় করিয়ে রেখে,দৌড়ে এলো ওইদিকে...
-সৌর!!রূপকে কি বলেছিস তুই?
-যা সত্যি তাই বলেছি!!
-তোর মুখ আমি ছিঁড়ে নেবো হারামি!!
চিৎকার করে উঠলো ঋষি।সৌরর জামার কলার টেনে ধরলো ও।ঋষির চিৎকারের চোটে,পুকুরপাড় থেকে কয়েকটা সাদা বক ভয় পেয়ে ঝটপটিয়ে উড়ে গেলো....
-গায়ে হাত দিবি না ঋষি।মুখে কথা বল!
সৌর ঠান্ডা মাথায় বললো...
-কি হয়েছে বলবি?
সম্পূর্ণ ব্যাপারটা থেকে অন্ধকারে থাকা সমুদ্র চেঁচিয়ে উঠলো...
-তোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করাটাই আমার ভুল হয়েছে।ভুলেই গিয়েছিলাম,বন্ধুত্বও সবসময় সমানে-সমানে হয়।নিজের পয়সা,নিজের রূপ,নিজের গুণ,নিজের এটিটিউড,তুই তোর নিজের পকেটে ভরে রাখবি!তোর পরোয়া কেউ করে না সৌর।আমার ব্যাপারে যদি আর নাক গলাতে আসিস,খুন করে ফেলে দেবো!!মনে রাখবি কথাটা...
-ভাই!ভালোভাবে কথা বল ভাই!কি হয়েছে সেটা বল,মাথা ঠান্ডা করে ভালোভাবে কথা বল....
সমুদ্র ঋষিকে সামলানোর চেষ্টা করে।কিন্তু সৌর একটাও কথা বলে না।চুপ করে ঋষির সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে...
-থাম ভাই!কাকে কি বলছিস?!
ব্যস্ত হয়ে পড়লো রূপ।ঋষিকে টেনে সরাতে গেলো সৌরর সামনে থেকে....
-কেন?ও কোন হনু,যে ওকে অয়েলিং করে চলতে হবে?ওকে আমার চোখের সামনে থেকে দূরে থাকতে বল রূপ!নইলে,আমি কিন্তু জুতিয়ে ওকে সিধে করে দেবো!!
চিৎকার করে হাঁপাতে-হাঁপাতে নিজের সাইকেলের দিকে চলে যাচ্ছিলো ঋষি....
-করে দিস!সিধে করে দিস।মেরে-কেটে-জুতিয়ে-ফাটিয়ে দিস!আমার সঙ্গে তোর যা ইচ্ছে,তাই করিস!!কিন্তু ওই রঞ্জাকে তোকে ছাড়তেই হবে।ওই রঞ্জার ভূত আমি তোর মাথা থেকে নামাবোই।আমি কিছুতেই তোকে আর রঞ্জার দিকে এগোতে দেবো না....
উল্টে ঘুরে একদৌড়ে এসে সৌরর গায়ে হাত চালিয়ে দিলো ঋষি....
-আমি কি করবো না করবো,তুই ঠিক করে দিবি হারামি!!কি আমার অভিভাবক এলো রে...
সমুদ্র আর রূপ,দুজন মিলে টেনে ধরে রাখতে পারে না ঋষিকে।সৌরও নিজেকে বাঁচাতে হাত চালিয়ে দেয় ঋষির গায়ে....
-পাগল হয়ে গেছিস!?কি করছিস কি তোরা?
দুজনকে সিঁড়ির দু-প্রান্তে বসিয়ে চিৎকার করে ওঠে সমুদ্র....রূপ তখনও চেপে ধরে রেখেছে ঋষিকে।ছাড়লেই দৌড়ে আসবে সৌরকে মারতে...
এইবার দ্বিগুণ জোরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো সৌর নিজেই....
-পাগলা আমি না,ও হয়ে গেছে বাল!ওই একটা ফালতু মেয়ের জন্য,ও নিজের বন্ধুর গায়ে হাত তুলছে!!আমার গায়ে হাত তুলছে ও....
ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো সৌর।কাল থেকেই শরীরটা খারাপ ওর,মনটাও।আজ আর পড়তে আসতোই না।কিন্তু বাড়িতে বসে থাকলে,আরও বেশি মন খারাপ হবে বলে,বেরিয়ে এসেছে।ভেবেছিলো,বন্ধুদের মধ্যে থাকলে,একটু হয়তো ভালো থাকবে...
আবার তেড়ে উঠতে যায় ঋষি....থাবড়া মেরে ওকে মন্দিরের সিঁড়িতে ঠেসে বসিয়ে রাখে রূপ...ওইখান থেকেই চেঁচাতে থাকে ঋষি...
-রূপ ওকে বল,রঞ্জার নামে আর একটা আজেবাজে কথা বললে,আমি আজ এইখানেই ওকে মেরে ফেলবো...
এবার সৌর তেড়ে ঋষির সামনে এসে দাঁড়ালো....
-মার!!মার,মার কত মারবি মার!!আমি তোর মত প্রেমে পড়ে আবাল হয়ে যাইনি ঋষি।বোধবুদ্ধি লোপ পায়নি আমার।দু বছর ধরে তুই একটা মেয়ের পিছনে ঘুরছিস!দিনরাত ওকে নিয়ে পাগলামি করছিস,সারা স্কুলে ওকে নিজের বউ বলে বেড়াচ্ছিস,ও কিছু জানে না মনে করেছিস?!কিছুই কি ওর কানে যায়নি!না কিছু বোঝেনা ও!!সব জানার পরও,তোর দিকে ও কিভাবে তাকায়,মনে নেই তোর?!আমি তো ভাবতাম,রঞ্জা তোকেই পছন্দ করে!ঠিক আছে,ও হয়তো সময় নিচ্ছে,তুই কবে এগোবি,সেটা ভেবে।কিন্তু কাল তো আমার মাথাটাই খারাপ হয়ে গেলো।তোকে যদি রঞ্জা পছন্দই করে,তাহলে তোর জন্য অপেক্ষা না করে,ও সমর্পণের সঙ্গে যাবে কেন?!আর সমর্পণের সঙ্গে থাকার পরও,তোর পাগলামিকে এভাবে প্রশ্রয় দেবে কেন?!তোকে বাড়তে দেবে কেন?!দিনরাত তোকে মেসেজ করা,সময়ের মা নেই,বাপ নেই,রাত বারোটা-একটা-দুটো,তোর সঙ্গে হেজিয়ে যাচ্ছে।আর এদিকে সমর্পণের সঙ্গে জড়াজড়ি করে ঘুরে বেড়াচ্ছে!?ওরে ও তোকে ঝুলিয়ে দেবে রে গাধা!!পুরোপুরি মরার আগে,সময় থাকতে-থাকতে ফিরে আয়!ও সমর্পণের সঙ্গেও রয়েছে,আবার তোকেও হাতে রেখেছে।তোকে সমানে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে,সরাসরি কথা বলে সরাচ্ছে না।তুই যখন মেসেজ করছিস,সেই মূহুর্তেই রিপ্লাই দিচ্ছে,রাত জেগে ওর সঙ্গে ফোনে বকছিস,অথচ কোনো কমিটমেন্ট নেই!!আর এসব ব্যাপারগুলোকেই ওর সম্মতি ধরে নিয়ে,তুইও ওই মেয়ের কথায় ভুলে গিয়ে নাচতে-নাচতে ঝুলে যাচ্ছিস!!সামনে-পিছনে আর কিছু ভেবেই দেখছিস না।এত যখন সারাদিন তোর সঙ্গে ফোনে লেগে রয়েছে,তেমন হলে রঞ্জাও তো এগোতে পারতো!ওরে গাধা,ও দুজনকেই চড়িয়ে বেড়াচ্ছে রে!!সমর্পণ তো ফেঁসেই গেছে,তুইও ওই পথেই পা বাড়িয়ে রয়েছিস!!মরবি বলে...শালা ছিঁড়েই দিলো আমার জামার বোতামটা....
জামাটা আটকানোর বৃথা চেষ্টা করে সৌর বললো...
-আমি এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছি জানিস?!আরে বাল যা,যা ভিতরে গিয়ে দেখ,রঞ্জা-রঞ্জা-রঞ্জা....তোর রঞ্জা ওই সমর্পণের বুকের ওপর চড়ে বসে আছে।যা ভিতরে গিয়ে দেখ!!
চমকে উঠলো সমুদ্র...ঋষি মাথা নীচু করে কাঁপছে....
-আমার কথা তোকে বিশ্বাস করতেও হবে না।কিন্তু নিজের চোখে দেখলে,তখন বিশ্বাস করবি তো?!যা-যা গিয়ে দেখে আয়!গায়ে হাত তুলছে আমার!!আমাকে মারতে আসছে!!
কেঁদে ফেললো সৌর....
-তুই ছাড়!আমি নিজেই কোনোদিনও আর তোর সামনে আসবো না বাল...যাঃ!!তুই মর-বাঁচ-মুখ থুবড়ে উল্টে পড়ে থাক,যা খুশি কর!!ওই মেয়ে তোকে ল্যাং মেরে,নর্দমায় ফেলে দিলেও,তোকে টেনে তুলবো না।আর দেখতেও আসবো না শালা!!মিলিয়ে নিস তুই আমার কথা,কুত্তার হাল করে তোকে ছেড়ে দেবে ওই মেয়ে।তখন পাগলা হয়ে যাবি।কিছুই নেই,তাও এইরকম পাগলামি করিস ওকে নিয়ে,আর কিছু হওয়ার পর,কদিন পর যখন লাথ মারবে,তখন তো আর উঠে দাঁড়াতেই পারবি না তুই।তবু যাবি ওখানে,যা!!মর তুই!!এটিটিউট!!পয়সা!!রূপ!!গুণ!!আগেরবার পরীক্ষায় খাতাশুদ্ধু কোথায় চলে গেছে,আমিই জানি না।বেল পড়ে গেছে,খাতা স্টেপল করবো,শালা পেজই আর হাতে আসে না।সব শালা খুলে দিয়েছি,দেখ!দেখে টোক!!তবু পাশ করে যা!একা কেন টপার হবো,সবাই যেন একসঙ্গে বেরিয়ে যেতে পারি!এটিটিউট দেখাচ্ছে আমায়!!কোনদিন দেখিয়েছি রে তোদের এটিটিউট!?আমার এটিটিউট আমি তাদেরই দেখাই,যারা ভালোবাসা বোঝে না।বন্ধুদের কোনোদিনও না!!মর শালা!বন্ধু!!সব বন্ধু চেনা হয়ে গেছে!জামাটাই ছিঁড়ে দিলো আমার....
চুপ করে সৌরর মুখের দিকে একভাবে চেয়ে রয়েছে ঋষি।সৌর চোখ মুছতে-মুছতে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো ওখান থেকে।ঋষির চোখ থেকে আগুন না জল,ঠিক কোনটা বেরোচ্ছে,ওর জানা নেই...মারামারির চোটে দুজনেরই জামা ছিঁড়ে গেছে....সৌরর পিছন-পিছন সমুদ্রও দৌড়োলো....
মাথা নামিয়ে নিলো ঋষি....সিঁড়িতে চুপ করে বসে রইলো....রূপ ওকে বললো,
-চল!ওঠ!!ঋষি??ওঠ....স্যার এসে গেছে এতক্ষণে।ওঠ....
-আজ শুধু টিউশনটা শেষ হতে দে।সমর্পণের খবর আছে।যদি সৌরর কথা সত্যি হয়,সৌর বেঁচে যাবে।আর যদি ও মিথ্যে বলে,ওর অবস্থা আমি খারাপ করে দেবো...
-আর ঝামেলা করিস না ভাই!হ্যাঁরে?তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?!সৌরর গায়ে হাত তুললি তুই?!
সাইকেলটা নিয়ে হাঁটতে শুরু করেও,মাথা নীচু করে কেঁদে ফেললো ঋষি...
-চল-চল!সব ঠিক হয়ে যাবে,চল.....
সর্বক্ষণ একজায়গায় থাকা চারমাথা,আজ দুভাগে বিভক্ত হলো।ঘরের দুই ভিন্ন কোণে দুজন-দুজন করে পৃথকভাবে বসলো।ফাটল ধরলো বন্ধুত্বের অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে....
-বাইরে বেরিয়ে দাঁড়াবি সমর্পণ।তোর সঙ্গে কথা আছে....
রঞ্জা বেরিয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই।বাঁশবাগানটা যেখানে শেষ হয়েছে,তার থেকে একটু আগে পাঁচিলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো সমর্পণ আর ওর কয়েকজন বন্ধু....রূপ একটু ভয়ে পেয়ে গেলো।অন্যদিন তো সমর্পণের বন্ধুরা চলেই যায়,আজ যায়নি কেন?!ঋষিটাও আবার লাফাতে-লাফাতে ওইদিকেই গেলো।ভয়ে অস্থির হয়ে গেলো রূপ....নিজেদের মধ্যে ঝামেলাটা মিটিয়ে নেওয়ার জন্য ও সৌরর কাছে এসে দাঁড়ালো....
-ভাই?
-দেখ রূপ!তোর সঙ্গে আমার কিন্তু কিছু হয়নি ভাই!তুই ঋষির হয়ে ওকালতি করতে আসিস না প্লিজ!
সমুদ্র নির্বাক শ্রোতা।ও নিজেও মনেপ্রাণে চাইছে,ব্যাপারটা এখানেই মিটে যাক।কিন্তু সৌরকেও ও খুব ভালোভাবে চেনে।ওর জেদ,ওর অহংকারও কিছু কম নয়!তাই কথা না বাড়িয়ে,এই পরিস্থিতিতে নিজের মুখটা বন্ধ করে রাখাই,সমীচীন বলে মনে করলো ও....
-সমর্পণের সঙ্গে অভিলাষ,হিমাদ্রিরাও আছে।আর সায়ন কি মারকুটে জানিস তো!ঋষিকে ছিঁড়ে খাবে ভাই!!তুই চল!ও একা আছে....
-যাবো না!!তুইও যাস না!মরুক ও!ওর মাথায় রঞ্জা ঢুকেছে।রঞ্জা ল্যাং মারলে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে মরার চেয়ে,সমর্পণের হাতে মার খেয়েই মরে যাক ও।তাতে অন্তত সম্মানটা কিছুটা বাঁচবে।নিজের কোনো আত্মসম্মান নেই,কিছু নেই।এত করে বোঝালাম,এত বললাম,তাও দৌড়োলো সমর্পণের কাছে...কি অবস্থা!!তুইও যাস না রূপ!!
-হ্যাঁ রে বাল!!তুই তো বলবিই!মাত্র দু-বছর হলো আমাদের চিনিস তো!এরপর আবার কলেজে গেলেই সবাইকে ভুলে যাবি,নিত্য-নতুন বন্ধু জুটে যাবে।আমাদের আর কে মনে রাখবে!!কিন্তু ঋষি আর রূপের বন্ধুত্ব এতোটাও ঠুনকো নয় সৌর!!সেই ল্যাংটো বয়স থেকে বন্ধু আমরা,হিসি করে দেওয়ালে নাম লেখার বয়স থেকে বন্ধু আমরা,টিফিন নিয়ে মারামারি করে জামা ছিঁড়ে দিয়ে,আবার ওই ছেঁড়া জামা পরে একসঙ্গে একে-অপরকে টিফিন খাইয়ে দেওয়ার সময় থেকে বন্ধু আমরা।ও যতই পাঁঠা হোক!ও মরতে গেলেও আমি ওর সঙ্গেই যাবো...কিছুতেই ওকে একা ছাড়বো না!!
ব্যাগটা পিঠে ফেলে সাইকেলে উঠে পড়লো রূপায়ণ...বেরিয়ে গেলো....
-হ্যাঁ যা-যা!ও নিজেও তো মরতে গেছে,তুইও যা!উফফ!!সবকটা এক-একটা আস্ত গবেট!আমার কপালেই জোটে সবগুলো....তুই হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন?তোকে বলিনি!!
সমুদ্রর দিকে চেয়ে খেঁকিয়ে চিৎকার করে উঠলো সৌর....
-হ্যাঁ তো?আমি আর রঞ্জা গত এক সপ্তাহ ধরে একসঙ্গেই আছি!!উই আর কাপল!!ও আমাকে একসেপ্ট করেছে!
-শালা....স্কুল-টিউশন সব জায়গায় সবাই জানে,রঞ্জা আমার!ওকে প্রোপোজ করার সাহস,তোর হলো কি করে সমর্পণ?
-সবার কথা বাদ দে ঋষি!!রঞ্জা জানে?
চুপ করে গেলো ঋষি....বাঁকা হাসি হাসলো সমর্পণ....
-উত্তরটা আমি বলছি!হ্যাঁ জানে!তোর দিকটা ও সবই জানে।আর তোর কথা উঠলেই হেসে মরে যায়।আসলে তোকে ওর জোকার বলে মনে হয়!!তুই ওকে হাসাতে পারবি,ফাঁকা থাকলে ও তোর সঙ্গে টাইম-পাস করতে পারবে,ও কোনো কারণে আপসেট থাকলে,আমি ওকে সময় দিতে না পারলে,তুই বেশ সুন্দর ভাবে সামলে নিস ভাই!কোনো ব্যাপার না,এভাবেই চালা না।আমার কোনো অসুবিধে নেই...
-ঋষি চল এখান থেকে....
রূপ এসে টেনে ধরলো ঋষিকে....ঋষি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই কেঁদে ফেলেছে।শরীরে আর একটুও শক্তি নেই ওর....
-আসলে কি বলতো ঋষি,বুকিং করা জিনিসই আমার আবার বেশি পছন্দ।আমি এই কদিন ফ্রি ছিলাম,পরীক্ষার আগে স্ট্রেস কাটানোর জন্য কাউকে খুঁজছিলাম।ভাবলাম,ঋষির বউকেই একটু বাজিয়ে দেখি,দেখলামও....সবচেয়ে অবাক কান্ড,ওই মেয়েও এককথায় রাজি হয়ে গেলো।ঠিক আছে,আমিও থাকি,তুইও থাক!চিন্তা নেই।গত এক সপ্তাহে ওকে বুঝে গেছি।তোর ওই রঞ্জাও আমারই মতো।দুজন কেন,ও দশজনকে একসঙ্গে সামলে নিতে পারবে।স্কুল শেষ হয়ে গেলে,আমিও ওকে ছেড়ে দেবো।তখন রঞ্জা পুরোপুরি তোর...এখন নিজের ইচ্ছেতেই আমার সঙ্গে আছে যখন,থাকুক কিছুদিন!আমি আর একটু ভালোভাবে দেখে নিই....তারপর তোর জিনিস,তোরই থাকবে....প্রথমবার কলেজে পা রেখে,পুরোনো জিনিসপত্র আমি আর সঙ্গে রাখবো না!!স্কুলেরটা স্কুলেই ছেড়ে যাবো!কিন্তু ছেড়ে দেওয়ার আগে একটু দেখে নিই.... কিরে?কি বুঝলি?!
রাগে-দুঃখে অন্ধ হয়ে সোজা সমর্পণের জামার কলার টেনে ধরতে গেলো ঋষি।কিন্তু তার আগেই সায়ন ঋষির নাকে সজোরে একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো।নাকের ওপর অতর্কিত আঘাতে,মাথা ঘুরে চোখমুখ অন্ধকার হয়ে গেলো ঋষির....
মাটিতে বসে পড়লো ও....রূপ চিৎকার করতে গিয়েও আগে ঋষিকে টেনে তুললো।ওর দিকে চেয়ে দেখলো,ঋষির নাক দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়ছে।চমকে উঠে অশ্লীল একটা গালাগালি দিয়ে,নিজের পকেট থেকে রুমালটা বের করে,রূপ চেপে ধরলো ঋষির নাকে....
(চলবে.....)
ছবি: সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন