অনুসরণকারী

মঙ্গলবার, ২১ জুলাই, ২০২০

অসমাপ্ত (সপ্তম পর্ব)




অসমাপ্ত

সপ্তম পর্ব

সাথী দাস


গতকাল সারারাত ঘুম হয়নি সৌরর।সকালে ও চোখ টেনে খুলতেই পারছিলো না।স্কুলে যাওয়ার আগে বাথরুমে স্নান করতে ঢুকলো।শাওয়ার খুলতেই চোখে জল লেগে,জ্বালা করে উঠলো নির্ঘুম একজোড়া চোখ।নিজেরই অজান্তে জল বেরিয়ে এলো চোখ থেকে।তাকে ছাড়া যে,কিছুতেই আর জল স্পর্শ করা যায় না।সে ছাড়া জল যেন কি ভীষণ হিমশীতল!!জলের কাছে আর যেতেই ইচ্ছে করে না সৌরর।শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে,ও দুচোখ বন্ধ করে ফেললো।ওপর থেকে নিঃসৃত জলের সঙ্গে-সঙ্গে নিজের চোখের জলে ভেসে,যখন স্নান করে বাইরে বেরোলো সৌর,তখন ওর দুটো চোখ রক্তবর্ণ...

ভয় না উত্তেজনা,কিসের জন্য যে হৃদস্পন্দন আজ এত তীব্র,বুঝতেই পারছে না সমুদ্র।বাড়ি থেকে বেরোনোর পরই মাথাটা ঘুরে গিয়েছিলো একবার।এখন তো পা দুটো আর যেন চলছেই না,রীতিমতো টলছে।রানী ম্যামের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে সব গুলিয়ে যাবে না তো!!আবার বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়ে থেকে চলে আসবে না তো!!না!!কিছুতেই না।আজ ও "গুড মর্নিং ম্যাম"-এর পরেও,আরও অনেককিছু বলবে।অনেক অব্যক্ত কথারা বহুদিন থেকে জমা হয়ে রয়েছে হৃদয়ে।সব উজাড় করে দেবে আজ।ওরা তিনজন কেউ এখনও স্কুলে আসেনি।অথচ এগারোটা থেকে তো এডমিট কার্ড দেওয়ার সময় ছিলো।নিজের এডমিটটা নিয়ে পিঠের ব্যাগে ভরে রাখলো সমুদ্র।লাইব্রেরি-রুমে সমুদ্রর ক্লাস-টিচার সকলের নাম ধরে ডেকে এডমিট কার্ড দিচ্ছিলেন।ওই ঘরের তিন-চারটে ঘরের পরেই টিচার্স-রুম!নিজের এডমিট কার্ড নেওয়ার পর,গুটিগুটি পায়ে ওইদিকে এগোলো সমুদ্র....কিন্তু সুবৃহৎ টিচার্স-রুমের দরজার সামনে থেকেই দেখলো,তার বসার জায়গাটা শুন্য।প্রচন্ডভাবে দমে গেলো সমুদ্র।সরে আসতে গেলো ওখান থেকে।বুকের ভিতরে একটা চাপা কষ্ট!আর তো এই স্কুলে সেভাবে আসা হবে না।আর তো তার মুখোমুখি দাঁড়ানো হবে না।আর তো সুযোগ পাওয়া যাবে না,নিজের হৃদপিণ্ডের রক্তে রাঙা,নিজেরই বাড়ি থেকে চুরি করে আনা,পকেটে রাখা ওই সতেজ-বৃষ্টিস্নাত গোলাপটা তার হাতে তুলে দেওয়ার!মাথা নীচু করে,ঘুরে চলে আসার সময়,একজন সল্পপরিচিত মধ্যবয়স্কা ম্যামকে সামনে দেখে সমুদ্র বললো,
-গুড মর্নিং ম্যাম!
-গুড মর্নিং!!
-মিস বিশ্বাস,মানে রেণুকা ম্যাম আজ এখনও আসেননি দেখছি।উনি কি আজ আসবেন না?মানে আমি ক্লাস টুয়েলভ তো,তাই স্কুলে আসা হয়না অনেকদিন।ওনার সঙ্গে একটু বিশেষ দরকার ছিলো....
-রানীও তো বেশ কয়েকদিন ছুটিতে ছিলো।আজই আসার কথা।দেখো,একটু অপেক্ষা করে,আসে কিনা!!
-ওকে ম্যাম!থ্যাঙ্কু সো মাচ!
-ওয়েলকাম এন্ড অল দা বেস্ট ফর ইয়োর এক্সাম!
-থ্যাঙ্কু ম্যাম!!

তরতরিয়ে ম্যাম চলে গেলেন টিচার্স-রুমের ভিতর....

এমনিতেও সমুদ্রকে অপেক্ষা করতেই হবে।কারণ,ত্রিমূর্তির পাত্তা নেই এখনও।যদিও দুপুর একটা পর্যন্ত সময় আছে।আসবে সব ধীরে-সুস্থে....একতলায় নেমে এসে,হলঘরের সামনের বেঞ্চে বসে সমুদ্র অপেক্ষা করতে লাগলো....বাকি তিন বন্ধুর জন্য?নাকি তার জন্য?!জানা নেই ওর...শুধু ঠোঁটের কোণে একটু মৃদু হাসি খেলে গেলো....

সাইকেল রেখে দরজা দিয়ে ঢুকছে সৌর,তার আগে-আগেই ঢুকছেন রানী ম্যাম!দুজন গেট দিয়ে ঢুকে দুদিকে চলে গেলো।কিন্তু পিছন ঘুরে বসে থাকায় সমুদ্র দেখতে পেলো না ওদের কাউকেই।ওরা ঢাকা পড়েছে সুবৃহৎ একটা পাতাবাহার গাছের আড়ালে।মাথা নীচু করে সমুদ্র বসেছিলো বেঞ্চে।হঠাৎ করেই রানী ম্যামের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ প্রবেশ করলো ওর কর্ণকুহরে।রানী ম্যাম আর একজন ম্যামের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন।
পিঠের দিকটা দেখা যাচ্ছে ওনার।সেই চিরপরিচিত দেহসৌষ্ঠব!!সেই কোমর পর্যন্ত লম্বা বেণী।বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠলো সমুদ্রর।রানী ম্যামও আজ টুকটুকে লাল শাড়ি পরেছেন!!আজও সেই চিরাচরিত রংমিলান্তি।হেসে ফেললো ও....তারপর উঠে দাঁড়ালো।ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে,ব্যাপারটা কিভাবে নেবেন ম্যাম!যেভাবেই নিক,আজ না বললে সমুদ্র আর বাঁচতে পারবে না।সেভাবে ও মুখে কিছু বলবে না,শুধু লেখাটা আর লাল গোলাপটা ওনার হাতে দিয়ে দেবে....আর বলবে,স্কুল ছেড়ে যাওয়ার আগে,এক পৃথিবী ভালোবাসা শুধুমাত্র আপনারই জন্য ম্যাম...তারপর মারুক-পিটুক-শাস্তি দিক,যা খুশি করুক।সব শুনে নেবে সমুদ্র....তবু আজ ও বলবেই...বুক পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিলো,চিঠিটা ঠিক আছে কিনা!আর প্যান্টের পকেটে রক্তগোলাপটা....তাড়াহুড়ো করে প্যান্টের পকেটে হাত দিতেই আঙুলে ফুটে গেলো কাঁটা!তাড়াতাড়ি করে হাত বের করে নিয়ে সমুদ্র দেখলো,আঙুল থেকে একবিন্দু রক্ত বেরোচ্ছে,কাঁটা ঢুকে রক্ত বেরিয়ে এসেছে।মুখের মধ্যে আঙুলটাকে ঢুকিয়ে দিলো ও।রক্ত অদৃশ্য হলো।হেসেই ফেললো সমুদ্র!রক্তেরাঙা গোলাপই তো ও দিতে চেয়েছিলো তাকে,ওর সামান্যতম অসাবধানতায় সেই ইচ্ছেই পূর্ণ হতে চলেছে তবে....একবার সমুদ্র উঁকি মেরে দেখলো ওইদিকে।এদিক দিয়ে আবার ছুটতে-ছুটতে সৌর আসছে.....মুখটা রানী ম্যামের দিক থেকে ঘুরিয়ে সৌরর দিকে ফেরালো সমুদ্র....

-ভাই চল!
-আমার হয়ে গেছে!আমি নিয়ে এসেছি।তুই যা!
-ওরা?
-আসেনি এখনও...
-আসবি না ওপরে?
-উঁহু!তুই যা!আমি এখানেই আছি!
-ওকে!!

সিঁড়ি দিয়ে লাফাতে-লাফাতে ওপরে উঠে গেলো সৌর...

বুকের ভিতরটা ভীষণরকম ঢিপঢিপ করছে সমুদ্রর।আর কথার শব্দ ভেসে আসছে না ওদিক থেকে।তবে নিশ্চয়ই রানী ম্যাম এইদিকেই আসছেন,সমুদ্রর সামনে দিয়েই তো সিঁড়িতে উঠবেন।আর মাথা নামিয়ে রাখতে পারলো না সমুদ্র,মাথা তুলে চাইলো সামনের দিকে।দম আটকে শরীর অস্থির হয়ে গেলো ওর....

আজ অপূর্ব সুন্দর লাগছে রানী ম্যামকে।লাল শাড়ির সঙ্গে লাল ব্লাউজ,সর্বাঙ্গেই যেন লালচে আগুনের ছোঁয়া।সেই সঙ্গে সিঁথিতে চওড়া করে আঁকা লাল সিঁদুর,আর হাতের সাদা রঙয়ের শাঁখার পাশেও,লালচে পলার ছোঁয়া...থরথর করে কেঁপে উঠলো সমুদ্র।চশমার কাঁচের ওপর কি জল পড়েছে?!এমন ঝাপসা হয়ে আসছে কেন চারদিক?পকেটে হাতটা ঢুকিয়ে রাখাই ছিলো,ফুলের ওপরে।আর সহ্য করতে পারলো না সমুদ্র,ওই ফুলটাকেই চেপে ধরে পিষে ফেললো।হাতে জায়গায়-জায়গায় বিঁধে গেলো কাঁটা,হৃদয়ের সঙ্গে-সঙ্গে রক্তাক্ত হয়ে গেলো সমুদ্রর ডান হাতটাও....ও একভাবে চেয়ে রইলো রানী ম্যামের দিকেই।লম্বা বারান্দায় আর কেউ নেই।প্রতিদিন সমুদ্র নিজেই দৌড়ে এসে রানী ম্যামের সামনে দাঁড়াতো,রকমারি ফুলের রংমিলান্তির খেলায় মেতে,প্রভাতী শুভেচ্ছা জানানোর জন্য।কিন্তু আজ ম্যামের থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়েও,আর এগোতেই পারলো না ও।আজ রানী ম্যাম নিজেই এগিয়ে এলেন ওর দিকে....

-গুড মর্নিং সমুদ্র!
কোনো সাড়া নেই।মাথা নামিয়ে রেখেছে সমুদ্র....
-সমুদ্র?
-হুম!সরি ম্যাম!
-হুম!গুড মর্নিং!
-মর্নিং!!এডমিট পেয়ে গেছো?
-হুম!
-বাঃ!এবার পরীক্ষার জন্য একেবারে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিটুকুই নেওয়া বাকি....উঠে-পড়ে লাগো!
-হুম!
-তুমি,মানে তোমার শরীর ঠিক আছে তো?
-ঠিক আছে...

সমুদ্রর গলা পর্যন্ত কান্নাটা উঠে এসেছে,রক্তাক্ত হাত যন্ত্রণায় অসাড়,অবশ....
-ওকে!সিট তো অন্য স্কুলে পড়বে।আবার হয়তো আমাদের দেখা হবে রেজাল্টের দিন,বা নাও হতে পারে।তোমরা মনে রেখো আমাদের,আর তো কিছুই চাই না...ভালোভাবে পরীক্ষা দিও কেমন!?উইশ ইউ অল দা বেস্ট!

রানী ম্যামের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা আজ আর ধরতে পারলো না সমুদ্র।পকেটের ভিতরে রক্তে ভেসে রয়েছে ডান হাত,আর বাঁ-হাত তার দিকে এগিয়ে দেওয়া সম্ভব না...সমুদ্র মাথা তুলে চাইলো ম্যামের দিকে...মুখে বললো,
-থ্যাঙ্কু ম্যাম!!

হাতটা সরিয়ে নিয়ে অবাক হয়ে রানী ম্যাম চেয়ে রইলেন সমুদ্রের দিকে....

-সমুদ্র!!কি হয়েছে তোমার?তুমি কি অসুস্থ?

তার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে,কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো ক্ষমতা,সমুদ্রর আর নেই।সমুদ্রর মস্তিষ্ক আর চোখ তখন দুটো ভিন্ন স্থানে আবদ্ধ।মস্তিষ্কের অনুরণন বলছে স্বরচিত গানের কয়েকটা বিশেষ পংক্তি,

"অঙ্গ তোমার হরিদ্রা-পেলব/কালো তোমার কেশ,
তোমার সনে পাড়ি দেবো/অজানা এক দেশ...
লাল গোলাপের শিশিরভেজা পাপড়ি/তোমার গলার ভাঁজে,
আমার উষ্ণ স্পর্শে তুমি/রাঙা হলে লাজে..."

মস্তিষ্কের জালে বোনা গানের সঙ্গে,আজ আর রানী ম্যামের কোনো সাদৃশ্য পেলো না সমুদ্র।আগের মতো হলদেটে গৌর অবয়বটুকু রয়েছে ঠিকই,সেই সঙ্গে কুচকুচে কালো একঢাল চুলের সঙ্গে ছিপছিপে গড়ন,কিন্তু চোখ মেলেই,ওই হরিণী-কণ্ঠের ভাঁজে এসেই,চোখ আটকে গেলো সমুদ্রর।অত্যধিক গৌরবর্ণ হওয়ার কারণে বুঝি অত্যন্ত সংবেদনশীল ম্যামের ত্বক।আদরের সামান্যতম আঘাতেই রক্তবর্ণ হয়ে যায়।সমুদ্র দেখলো,রানী ম্যামের গলায় হালকা লালচে আভা....

চোখটা জ্বালা করে উঠলো সমুদ্রর।কেমন যেন গা গুলিয়ে উঠলো হঠাৎ করে,বমি পেয়ে গেলো।এবার সত্যিই ওর শরীরটা খারাপ লাগতে শুরু করেছে।
-সমুদ্র,তোমার কি হয়েছে?তোমার গার্জেনকে কি একটা ফোন....
-ম্যাম!কোনো কিছুর কোনো প্রয়োজন নেই ম্যাম।আমি একদম ঠিক আছি।থ্যাঙ্কু ফর ইয়োর ওয়ার্ম উইসেশ।আমার ছাত্রজীবনের সবচেয়ে পছন্দের টিচার আপনিই।কিন্তু শেখার তো কোনো শেষ নেই,তাই আগামী দিনে জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই নতুন-নতুন শিক্ষক-শিক্ষিকার দেখা পাবো।তবু আজ আপনাকে একটা কথা বলি,আমি গান নিয়ে এগোতে চাই ম্যাম।গান নিয়ে সফল হতে চাই।ভবিষ্যতে আমার দ্বারা কতদূর পড়াশোনা হবে,এখনই আমার জানা নেই।কিন্তু এখন,এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে,শুধু এটুকুই বলতে পারি,আমরণ আপনার কথা আমার মনে থাকবে।আর কিছু বলার নেই।আসছি আমি....আমার বন্ধুরাও চলে আসবে এক্ষুণি....সরি ম্যাম!আই হ্যাভ টু গো!
-হুম!ওকে....

সমুদ্রর পক্ষে ডান হাতটা পকেট থেকে বের করা সম্ভব হলো না,ও বাঁ-হাত দিয়েই বেঞ্চের ওপর রাখা ব্যাগটা কাঁধে ফেলে নিয়ে এগোতে গেলো।তখনই আবার ডাক পড়লো পিছন থেকে,
-সমুদ্র?শোনো....
-ইয়েস ম্যাম!!

রানী ম্যাম এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন সমুদ্রর কাছে,হাত রাখলেন ওর মাথায়।সমুদ্রর দু-চোখের পাতা ভারী হয়ে গেলো বিষাদে।ও আরও একটু নামিয়ে দিল নিজের মাথাটা।এগিয়ে এলো ম্যামের একেবারে কাছে....প্রথমবার তার হাতে বই দিতে গিয়ে তাকে একবার স্পর্শ করা সম্ভব হয়েছিলো,সমুদ্রই করেছিলো।সেটা ছিলো সমুদ্রর দিক থেকে প্রথম স্পর্শ।শালীনতার চাদরে আবৃত নিষ্পাপ স্পর্শ....আর আজ ওনার দিক থেকে প্রথম এবং সম্ভবত অন্তিম স্পর্শ....

-ভালো করে পরীক্ষাটা দিও।গানটা ছেড়ো না।জীবনে যা চাও,তাই নিয়েই সুপ্রতিষ্ঠিত হও...

আর সহ্য হলো না সমুদ্রর।নিজের মাথার ওপর রাখা ম্যামের হাতের ওপর নিজের বাঁ হাতটা রাখলো ও।তারপর নিজের মাথায় ওনার হাতটা আরও একটু চেপে ধরে বললো,
-শুধু সেই আশীর্বাদটুকুই করুন ম্যাম!আসছি আমি....

আর দাঁড়ালো না সমুদ্র।গলা কেঁপে গেছে শেষ কথাটুকু বলতে গিয়ে।শরীরটাও কাঁপছে।লম্বা বারান্দা ধরে মাঠের দিকে এগোতে গেলো ও।কয়েক মুহূর্ত ওখানে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে,সিঁড়ি ভেঙে ওপরে চলে গেলেন রানী ম্যাম....

ব্যাগে এডমিট কার্ড ভরে নিয়ে,সিঁড়ি দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে নামছিলো সৌর।সিঁড়ি দিয়ে উঠেছিলেন রানী ম্যাম।ওনাকে থেকেই সৌরর আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।নিয়ম এবং সৌজন্য রক্ষার্থে কোনোরকমে সৌর বললো,
-গুড মর্নিং ম্যাম!
-গুড মর্নিং!!

ম্যামও উঠে গেলেন,পাগলের মতো লাফাতে-লাফাতে নীচে নামলো সৌরও।সমু কোথায়?লম্বা বারান্দা প্রায় জনমানবহীন।ক্লাস শুরু হয়ে গেছে সবার।প্রথম পিরিয়ডের ঘন্টা পড়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই।তাই কেউ আর ক্লাসের বাইরে নেই।অস্থির হয়ে এদিক-ওদিক দেখতে গিয়ে সৌর দেখলো,সমু মাঠের দিকে ছুটছে....ও সেই মুহূর্তেই বারান্দা থেকে নামতে গেলো।কিন্তু তার আগেই দেখা রূপ আর ঋষির সঙ্গে,
-কিরে?কোথায় চললি?এত ব্যস্ত কেন?
-আসছি ভাই!এডমিট কার্ড নিয়ে তাড়াতাড়ি মাঠে আয়।একটা ঝামেলা হয়ে গেছে!
-কি ব্যাপারে ঝামেলা?চল,আমরা তোর সঙ্গে এখনই যাচ্ছি।কার মাথা ফাটাতে হবে,সেটা শুধু বল?!
-ওই ঝামেলা আর ঠিক করা যাবে না রে!শুধু সমুর কপালটা বাঁচাতে হবে।নইলে ও নিজেই ওটা দেওয়ালে ঠুকে ফাটিয়ে ফেলবে।
-মানে?
-এডমিট নিয়ে আয়।আর পারলে রানী ম্যামের সঙ্গে দেখা করে আসিস,বুঝে যাবি!আমি মাঠে আছি...পাগলটা আবার মুহূর্তের মধ্যে কোনো পাগলামি না করে বসে...

সৌর লম্বা বারান্দা পেরিয়ে প্রচন্ড রোদের মধ্যে দিয়েই ছুটলো,স্কুল-মাঠের দিকে।ঋষি আর রূপ ব্যাপারটা তখনও ঠিক বুঝতে পারলো না।একে-অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।তারপর বারান্দা পেরিয়ে চলে গেলো ওপরে....

মাঠের এককোণে পিছন ঘুরে বসে পড়লো সমুদ্র,পিঠ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে রাখলো সবুজ ঘাসের ওপরে।ডান হাতটা পকেট থেকে বের করলো।দু-তিন জায়গা রক্তাক্ত।বুড়ো আঙুলের মাথাটায় একটা হালকা সবুজ রঙয়ের ছোট্ট কাঁটা বিঁধে রয়েছে,দেখাই যাচ্ছে চামড়ার ওপর থেকে।রক্তগোলাপটা প্যান্টের পকেট থেকে বের করলো ও,চটকে-পিষে গেছে একদম।সতেজ-লালচে পাপড়িগুলো একেবারে নেতিয়ে পড়েছে...রক্তাক্ত হাতে ওটাকে বের করতেই,মাঠের সবুজ ঘাসের ওপরে ঝরে পড়লো কয়েকটা লাল পাপড়ি।বাবা অনেক পরিশ্রম করে ফুটিয়েছিলো এই ফুলটা।আজ সকালে সমুদ্র চুপিচুপি গিয়ে ওটাকে ছিঁড়ে নিয়ে এসেছে।হয়তো বিকেলে ওকেই এটার জন্য কৈফিয়ৎ দিতে হবে।কিন্তু সমুদ্র ভেবেছিলো,ততক্ষণে হয়তো ম্যামের কালো একঢাল চুলে সারাদিন ধরে শোভা-বর্ধন করে,আধ-শুকনো হয়ে ওই লাল গোলাপটা সার্থক করবে নিজের অস্তিত্ব।কিন্তু এর পরিণতি যে এমনটা হবে,সমুদ্র যে নিজের হাতেই ওকে চটকে-পিষে ফেলবে,এ তো ওর ধারণারও অতীত ছিলো...কি প্রচন্ড কান্না আসছে দুচোখ ভেঙে,কিন্তু কাঁদতেও পারছে না ও।বুকের ভিতরে ভীষণরকম একটা কষ্ট হচ্ছে!!ঝাপসা হয়ে আসছে সামনের দৃশ্যপট।যাও বা কিঞ্চিৎ ঝাপসা হয়েছিলো আঙুলের ওই কাঁটাটা,তবু একটু হলেও দেখা যাচ্ছিলো।কিন্তু এবার চোখ থেকে এক ফোঁটা জল চশমার কাঁচের ওপরে পড়ে,সেটুকুও কেড়ে নিলো।সমুদ্র আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।ঘাড় গুঁজে বসে,ও বাঁ হাত দিয়ে চোখ থেকে চশমাটা খুলে ফেললো...তারপর হাতড়ে-হাতড়ে কাঁটাটা তোলার চেষ্টা করলো....হঠাৎ চমকে উঠলো সৌরর কণ্ঠস্বরে,

-কি হয়েছে তোর হাতে?

তাড়াতাড়ি করে হাতটা আড়াল করার চেষ্টা করলো সমুদ্র।ব্যাগের নীচে ঢোকাতে গেলো হাতটা....

-কই কি?

সৌর ব্যাগটা ধপাস করে মাঠে ফেলে সমুদ্রর পাশে এসে বসলো।তারপর ব্যাগের নীচ থেকে ওর হাতটা টেনে বের করলো....
-ইসস!!কি অবস্থা হাতের!!

সৌর সমুদ্রর মাথার পিছনদিকে এমন জোরে একটা চাঁটি মারলো,ওর মাথাটা ঝনঝন করে উঠলো।

-সমু!!তুই পাগল রে...
-কিচ্ছু হয়নি!দেখ,কাঁটাটা বের করতে পারিস কিনা!ওসব কমে যাবে!

মাথা নীচু করে কাঁটাটা উঠিয়ে আনলো সৌর।তারপর নিজের রুমাল দিয়ে বেঁধে দিলো সমুর হাতটা।হাতটা কোলের কাছে টেনে নিয়ে,দুটো হাঁটুর সঙ্গে আটকে রেখে,চুপ করে বসে রইলো সমুদ্র।চোখের দৃষ্টি শুন্য...সৌরও সমুদ্রর পাশে বেশ কিছুক্ষণ চুপটি করে বসে রইলো।ও নিজেও ভাষা হাতড়ে বেড়াচ্ছে!সমুও মুখ খুলছে না।ওর দিকে ফিরেও চাইছে না!অসহায় সৌর একপ্রকার বাধ্য হয়ে মুখ খুললো,

-এটা তো হওয়ারই ছিলো সমু...যা সম্ভব নয়।তার পিছনে ছুটে...
-অন্য কিছু বল!ভালো লাগছে না!
-ওঠ!
-তুই যা!আমি পরে আসছি!
-তোকে না নিয়ে আমি যাবো না।
-তবে বসে থাক!মুখটা বন্ধ কর!ম্যামকে নিয়ে মুখ খুললে,আমি তোকে খুন করে ফেলবো!
-পাগলামি করিস না সমু!এসব....
-সৌর!

চিৎকার করে উঠলো সমুদ্র....

-কাল যখন তুই আপসেট ছিলি,সবাই তোর মন ভালো করার চেষ্টা করেছে।তোর খারাপ লাগে এমন কোনো কাজ,ওই সময় করা হয়নি।ঠিক তেমনভাবে আজ আমি চাইছি না,ওই প্রসঙ্গে কোনো কথা বলতে।তুই একটু মুখটা বন্ধ রাখবি?রানী ম্যামের কথা মনে পড়লেই,আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি!ওই নামটা একটু ভুলতে দে না রে আমায়....

মাঠ থেকে মৃতপ্রায় গোলাপটা তুলে,ব্যাগের মধ্যে রাখা গানের ডায়েরীর ভাঁজে রেখে দিলো সমুদ্র....তারপর ব্যাগটা তুলে নিয়ে উঠে যেতে গেলো ওইখান থেকে....সৌর ওকে টেনে,জড়িয়ে ধরলো বুকে...প্রথমে দাপাতে শুরু করলেও,সৌর কিছুতেই ছাড়লো না ওকে।একটা সময় পর একেবারে শান্ত হয়ে গিয়ে হু-হু করে কেঁদে ফেললো সমুদ্র....এই সময়টার জন্যই অপেক্ষা করছিলো সৌর।এইবার ও দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-হয় না সমু!প্রথম দিনই তোকে বলেছিলাম!বন্ধ কর এসব পাগলামি!!

কান্নাভেজা কণ্ঠে সমু বললো,
-কেন হয় না রে সৌর?আমি বয়সে অনেকটা ছোটো বলে?সে আমার শিক্ষিকা বলে?আমার সম্মানীয় বলে?তাকে তো আমি শ্রদ্ধা-সম্মান কিছু কম করি না রে!!কিন্তু শ্রদ্ধার সঙ্গে-সঙ্গে ভালোও তো বেসে ফেলেছি সৌর!একটু অপেক্ষা কি করা যায় না?একবারের জন্যও কি গতানুগতিকতার বেড়াজাল ভাঙা যায় না?!উনি আমাকে যা ভালোবাসি,তাই নিয়ে জীবনে এগোনোর জন্য,সফল হওয়ার জন্য আশীর্বাদ করলেন!আমি গান নিয়ে জীবনে এগোতে চাই!শিল্পের মান-শিল্পীর মান তো কোনোদিনও বয়স দিয়ে,যোগ্যতা দিয়ে বিচার করা যায় না রে!!তাহলে শিল্পীর ভালোবাসার মূল্য,কেন বয়স দিয়ে,যোগ্যতা দিয়ে বিচার করা হবে?!আমার সব শেষ হয়ে গেছে।ওই মানুষটা আমার জীবন থেকে গানটাই কেড়ে নিয়েছে।আমি আর পারবো না....ওনাকে আমার শুধু ভালোই লাগে না সৌর,নিজের সমস্ত সৃষ্টি দিয়ে,এমনকি নিজেকেও উৎসর্গ করে,আমি ওনাকে ভালোবেসেছি....
-বুঝেছি!সব বুঝেছি!একটু চুপ কর!!
-কষ্ট হচ্ছে সৌর!আমার বাবা-মা পড়াশোনা ছাড়া আর কিচ্ছু বোঝে না রে।এই একজনই ছিলো,যে ছিলো আমার সমস্ত সৃষ্টির উৎস!আমার অনুপ্রেরণার উৎসস্থলটাই তো আজ হারিয়ে গেলো...
-সমু!তাকা আমার দিকে।ওঠে!ওদিকে ছায়ায় চল!রোদে মাথা ধরে যাচ্ছে....
-তুই যা!আমি পরে যাবো!
-তুই আসবি কিনা!!চল....

টানতে-টানতে সমুদ্রকে মাঠের কিনারায় একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে নিয়ে গেলো সৌর।দূর থেকে ও দেখলো, ঋষি আর রূপ এইদিকেই আসছে।
-এবার শোন!চুপ করে এখানে বস।ভালো করে আমার কথাগুলো শোন,কিচ্ছু শেষ হয়না সমু!সব শেষের একটা নতুন শুরু থাকে।আমি গানের ব্যাপারে আকাঠ গণ্ডমূর্খ,বাল বুঝি!শুধু এইটুকুই জানি,তুই গান করলে,প্রাণের একেবারে ভিতরে গিয়ে লাগে।আমার মতো গোমুখ্যু মানুষেরও চোখে জল এসে যায়।এতদিন যে নারী তোর অনুপ্রেরণা ছিলো,দুর্বলতা ছিলো,এবার তাকেই তোর অস্ত্র তৈরী কর।প্রেমের গানেই কাঁদিয়ে ছাড়লে,বিরহে তো ভাই আগুন জ্বালিয়ে দিবি রে!!নিজে না পুড়লে,শ্রোতার মনে আগুন লাগাবি কি করে?!এবার তো তুই খাঁটি প্রেমিক!!কারণ,তোর প্রেম পরিণতি পায়নি।পাবেও না,সেই আশাও নেই।তাই তুই জ্বলতে থাকবি।আর সেই জ্বলন তোর কলম দিয়ে কথা,আর কণ্ঠ দিয়ে আগুন হয়ে ঝরে পড়বে।ভালোবাসিস তো তাকে?!তাই গানটা ছেড়ে দিয়ে,তাকে হারিয়ে যেতে দিস না!গান তুই ছাড়বি না কিছুতেই।তাকে ওই গানের মধ্যেই বেঁধে রাখবি আজীবন!আর তাকে তোর গানের মধ্যে থেকে,টেনে-ছিনিয়ে বের করে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা,তার পুরুষেরও নেই।ওইখানে সে সম্পূর্ণ তোর।তোর গানের প্রতিটা সুরে,প্রতিটা তালে,প্রতিটা শব্দে সে লুকিয়ে থাকবে ওতপ্রোতভাবে।তাই তাকে নিজের করে পেতে হলে,গানের মধ্যে দিয়ে বেঁধে রাখ!সে আজীবন বন্দী থাকবে,তোরই কাছে....তাকে ভালোবাসিস,সেটা তো শুধু মুখেই বললি!পারবি তো তাকে বাঁধতে?
-পারবো!আমি তাকে কিছুতেই ছাড়বো না!আমি গান কোনোদিনও ছাড়বো না।আমার গিটারে বেঁধে রাখবো তাকে....
-গুড!ভেরি গুড!!

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সৌর।প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলো ও।সমুদ্র ওনাকে নিয়ে যেরকম পাগলামি করতো,ওনাকে বিবাহিত অবস্থায় মেনে নেওয়া,ওর পক্ষে যে কিছুতেই সম্ভব হবে না,সেটা রানী ম্যামকে এক নজর দেখেই বুঝে গিয়েছিলো সৌর।সমুর বাড়ির লোকও খুব একটা বুঝদার নয়।একবার বাড়িতে বেরিয়ে গেলে,সমু যে কি করবে,সেটা ভেবে ভয়ের চোটে নিজেই দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলো সৌর...এখন অনেকটা ধাতস্থ লাগছে.....সৌর সমুকে কিছুটা সামলে নিতে-নিতেই ওখানে এসে দাঁড়ালো রূপ আর ঋষি।দুজনেই গম্ভীর!সৌর ওদের ইশারায় একেবারে মুখ বন্ধ রাখতে বললো...তারপর সমুদ্রর কাছে এসে বললো,

-চল!ওঠ!ব্যান্ড-এইড লাগাবি হাতে...চল...

সৌর নিজের ব্যাগের সঙ্গে-সঙ্গে সমুদ্রের ব্যাগটাও তুলে নিলো...

উঠে পড়লো সমুদ্র।ঋষি আর রূপ ওর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করতেই,ও কয়েক পা এগিয়েও আবার ফিরে চাইলো স্কুলের দিকে।দূরে মৃতদেহের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে কংক্রিটের সুবিশাল স্কুল।আবারও ওর বুক থেকে একটা অব্যক্ত হাহাকার বেরিয়ে এলো....সৌর বুঝতে পেরে এগিয়ে এলো ওর কাছে।ওর কাঁধে হাত রেখে বললো,
-চল ভাই!সে তোর গানের ডায়েরীর পাতায় আছে,থাকবেও....কায়াহীনভাবে।বাইরের অবয়বটুকু বরং তার পুরুষের জন্যই থাক!বাকি সবটুকু তো তোরই!!শিল্পীর কোনোদিন মৃত্যু হয় না,শিল্পেরও না,আর তার অনুপ্রেরণারও না....চল.....
-হুম!

হঠাৎ থমকে যাওয়া আবেগ-অনুভূতির স্রোত,আবারও ফল্গুধারার মতো চুপিসাড়ে প্রবাহিত হতে শুরু করলো।চারবন্ধু শেষবারের মতো চিরপরিচিত স্কুলমাঠ পেরিয়ে,চেনা গলির বাঁক পেরিয়ে,ক্যান্টিনের মায়া ত্যাগ করে,সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো বড় রাস্তায়।মৃদুমন্দ উষ্ণ বাতাসে,শুষ্ক কৃষ্ণচূড়া গাছের কয়েকটা পাতা একাকী কাঁপতে লাগলো কেবল....

-বিকেলে টিউশন আসবি কিন্তু সমু।নইলে তোকে তোর বাড়ি থেকে উঠিয়ে আনবো...

সমুদ্রর দিকে চেয়ে সৌর বললো।

-এ ভাই!!ও কি মেয়ে নাকি,যে উঠিয়ে এনে বিয়ে করবি!?

চেঁচিয়ে উঠলো রূপ।একমাত্র সমু বাদে,বাকি সকলেই হেসে উঠলো।সৌর-রূপ-ঋষি সেদিন শত চেষ্টাতেও ওর মুখে একটুও হাসি ফোটাতে পারলো না।চলে গেলো যে যার রাস্তায়।বাড়িতে ঢুকে সোজা ওপরে নিজের ঘরে উঠে এলো সমুদ্র...ঘরের দরজা বন্ধ করে ব্যাগ থেকে টেনে বের করলো গানের ডায়েরীটা।পকেট থেকে চিঠিটা বের করে,চিঠি আর গোলাপটা ও রেখে দিলো ডায়েরীর ভাঁজে।বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো ওই ডায়েরীটা।ঠিকই তো বলেছে সৌর..... তাকে গানেই বাঁধতে হবে!তাকে ছাড়া যাবে না কিছুতেই!

ডায়েরীটা বুকে জড়িয়েই একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলো সমুদ্র।কিন্তু দুটো চোখ একটু বন্ধ করার উপায় আছে?!চিন্তিত বন্ধুরা একাধিকবার ফোন করতে লাগলো সারাদিন ধরে।বন্ধুদের ফোনের জ্বালায় একরকম অতিষ্ট হয়ে,বিকেলে টিউশনে বেরিয়েই পড়লো সমুদ্র....

-কিরে?ঠিক আছিস তো ভাই?মনটা ভালো লাগছে তো?

টিউশন থেকে বেরিয়ে সৌর হাত রাখলো সমুদ্রর কাঁধে...

-হুম!ঠিক আছি।
-এই জন্যই তো তোকে ফোন করে-করে বাড়ি থেকে বের করলাম।সবার মধ্যে থাকলে ভালো থাকবি।বাড়িতে একা-একা বসে থেকে কি করবি?!
-হুম!!
-আর দুটো কই গেলো?এখনও বেরোয় না কেন?

সৌরর কথা শেষ হতে না হতেই,ঋষি আর রূপ বেরিয়ে এলো বাইরে।ঋষির মুখটা গম্ভীর।রূপ ওকে কিছু একটা বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে।সৌরর মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো।এদিকে সমু,ওইদিকে আবার ঋষি,রঞ্জাও ভিতরেই আছে,সমর্পণও....টিউশনের শেষদিনে আবার কি ঝামেলা বাধলো রে বাবা!!সৌর এগিয়ে গেলো ঋষির দিকে....

-কি হয়েছে রে?
-চল,বেরো তাড়াতাড়ি!
-রূপ!কি হয়েছে বলবি?
-ও কি বলবে!আমি বলছি,সাইকেলে ওঠ।আর চল!

সৌর মৃদু চেঁচিয়ে উঠলো,
-আরে বল রে....কি হয়েছে?!উফফ!আর ভালো লাগছে না!
-সমর্পণ ঋষিকে বাইরে দাঁড়াতে বলেছে সৌর।ইনফ্যাক্ট আমাদের সবাইকেই।ওর কি কথা আছে আমাদের সঙ্গে!
-আমাদের সঙ্গে?!সবার সঙ্গে?

বেশ অবাকই হলো সৌর...

-হুম!
-আচ্ছা!দাঁড়া!দেখি কি বলে...
-তোর দাঁড়াতে হয়,তুই দাঁড়া।আমি বেরিয়ে যাবো।

লাফাতে লাগলো ঋষি।সৌর দাঁত খিঁচিয়ে উঠলো,
-এই এটার মাথার ঠিক মাঝখানে কেউ একটা দুম করে ঘুষি মার তো।অজ্ঞান হয়ে যাক!তারপর টেনে নিয়ে গিয়ে পানাপুকুরে চুবিয়ে আন।মাথা ঠান্ডা হবে....
-তুই জানিস না ওর আমার সঙ্গে....
-না!আমি জানি না!সেদিন তোকে বাঁচাতে প্রদীপের দৈত্য টপকেছিলো তো।শালা ঘষেছিলি,আর অমনি সুড়সুড় করে বেরিয়ে এসেছিলো!!তাই না?

ধ্যাতানি খেয়ে একদম চুপ করে গেলো ঋষি....আর একটাও কথা বললো না!দূর থেকে সমর্পণ ব্যাগ পিঠে নিয়ে এগিয়ে আসছে ওদের দিকেই....

-কিরে ভাই?বল,কি খবর?

ঋষিকে পিছনে রেখে সৌর এগিয়ে গেলো সামনে....ঋষির তড়পানি তখনও অব্যাহত...

-না!তেমন কিছু না।ভাবলাম,আজ শেষদিন সব বন্ধুদের সঙ্গে একবার করে একটু কথা বলে যাই!

চুপ করে গেলো ঋষি।সৌর একবার ঘাড় ঘুরিয়ে ঋষিকে দেখে মৃদু হাসলো....তারপর সমর্পণের দিকে ফিরে বললো,
-স্কুল শেষ হয়ে যাবে,টিউশনে দেখা হবে না,তো কি হয়েছে?কলেজ তো আছে।আমরাও সবাই একই শহরে আছি।জাস্ট একটা ফোন,ব্যাস.....রিউইনিয়ন!

হেসে ফেললো সমর্পণ।ওর হাসিতে আজ বিষাদের সুর...
-নাঃ!সেটা তোদের ক্ষেত্রে হতে পারে।আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
-কেন?
-বাবা ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছে।আমিও পরীক্ষার পর চলে যাবো!!তবে তোদের কথা আমার মনে থাকবে....তোকে আমি কোনোদিনও ভুলবো না সৌর!

চোখে জল এসে গেছে সৌররও।তাকে বলা একটা কথা হঠাৎ করে মনে পড়ে গেলো,সেই কথাটাই সৌর বললো,
-হুম!আমাকে ভোলা যায় না।আই এম লিমিটেড এডিশন!জাস্ট লাইক ইউ!তোকেও মনে থাকবে সমর্পণ....

দুজনেই হেসে ফেললো।ওদের পাশ দিয়েই সায়নের সঙ্গে বেরিয়ে গেলো রঞ্জা....সৌর বা ঋষির দিকে ফিরেও চাইলো না আর।ঋষি ওকে সমস্ত জায়গা থেকে ব্লক করেছে অনেকদিন আগেই,সৌরই দাঁড়িয়ে থেকে করিয়েছে।কিন্তু সমর্পণের ব্যাপারটা সৌরর জানা ছিলো না।ও একটু অবাকই হলো....ওকে দেখে সমর্পণ বললো,
-কি ভাবছিস?

স্বাভাবিক কৌতূহলবশত ঋষি,সমুদ্র আর রূপও এগিয়ে এলো সৌরর পাশে...

-রঞ্জা তোর সঙ্গে....
-নেই!আমি সরে এসেছি।নিজেকে বিশাল স্টাড ভাবতাম,লাইক মাস্টার-কি!যেকোনো বন্ধ তালা আমি মুহূর্তেই খুলে দিতে পারি!কিন্তু নিজের জীবন দিয়ে দেখলাম,তাতে কোনো বাহাদুরি নেই।নিজেকে না বদলালে,আমিও আমার মতই কাউকে পাবো।যার কাছে আমারও কোনো মূল্য থাকবে না,ঠিক যেমন রঞ্জার কাছে ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই।ঋষি নইলে আমি,আমি নইলে সায়ন,সায়ন নয়তো অন্য কেউ....প্রতিদিন সকালে স্নান করে গতরাতের বাসি স্বপ্ন ধুয়ে ফেলার মতো,বয়ফ্রেন্ড বদলায় ও।ভাই ঋষি,সরি!!ও কারোর জন্যই ঠিক না!তোর মত শান্ত ছেলের জন্য তো নয়ই....আমরা মিথ্যেই মারপিট করেছিলাম।তবু তুই করেছিলি রঞ্জার জন্য,ওকে ভালোবেসে।আর আমি তো,নিজের ইগোর জন্য!!হয়তো আমিও ঠিক না।রঞ্জা কি করবে আমি জানি না,কিন্তু আমি নিজেকে শুধরাবার আপ্রাণ চেষ্টা করবো!সরি ঋষি....
-না!সরি না....থ্যাঙ্কু সমর্পণ!
-থ্যাঙ্কু?
-হুম!তুই না থাকলে রঞ্জা এতদিনে আমার গলাতেই ঝুলতো,আর তারপর যেমনটা সৌর বলে,কুত্তার হাল করে ছেড়ে দিতো।সৌর তো আমার ভাই।ওকে আর নতুন করে কি বলবো?!কিন্তু তোকে,থ্যাঙ্কু....
-হুম!ভাই বল,প্রেমিক বল,বন্ধু বল!কোনোকিছু হওয়ার কোনো যোগ্যতাই আমি এখনও অর্জন করতে পারিনি রে।কোনো সম্পর্কেই তো আমি লয়ালই না!ওকে....চল টাটা!

সৌরর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো সমর্পণ....

সৌর ওই হাত টেনে,সমর্পণকে বুকে জড়িয়ে ধরলো...
-ভাইদের মনে রাখিস ভাই!ফোন করিস!আর কারোর মাথা ফাটাতে হলে বলিস,তোর এই চার ভাই পৌঁছে যাবে।নিজেকে কোনোদিনও একা ভাববি না!আর এই ভাইরা,তোকে শত্রুপক্ষের হাতে ছেড়ে,কোনোদিন পালাবে না....

হেসে ফেললো সমর্পণ,
-তোদের আগে পাইনি কেন?
-পেতে চাসনি তাই!তাতে কি হয়েছে?এখন তো পাশে আছি!!মনখারাপ হলেই ফোন করবি!নতুন গার্লফ্রেন্ড হলেও...ফাইনাল-ওয়ালা...টাইমপাস-ওয়ালা নয় কিন্তু...

সৌরর কথা শুনে পাঁচজনই হেসে উঠলো সশব্দে....সারাদিন পর সমুকে একটু হাসতে দেখে,সৌরর বুকের ভিতরের চাপা কষ্টটা বেশ অনেকটাই হালকা হয়ে গেলো....

সাইকেল নিয়ে তার প্রাসাদের সামনে এসে ক্ষণিক দাঁড়িয়েছিলো সৌর।খেলা বন্ধ,সাঁতার বন্ধ,মাঠে দৌড়াদৌড়ি বন্ধ,টিউশন বন্ধ,স্কুলও বন্ধ,আর সেই সঙ্গে তার সঙ্গে দেখা হওয়ার সমস্ত আশাও শেষ।অন্ধকার নেমে এসেছে।তার বাড়ির বারান্দায় একে-একে আলো জ্বলে উঠছে।দূর থেকে কিছুক্ষণ দেখেই সাইকেলে চেপে ওই জায়গাটা পেরিয়ে চলে এসেছে সৌর।পাগল-পাগল লাগে ওইদিকে দেখলেই।মনে হয়,সৌর তার সঙ্গেই আকণ্ঠ জলে ডুবে আছে।আর সে তার শরীরী-উষ্ণতায়,জলেও অগ্নিসংযোগ করছে।ভিতরে-ভিতরে পুড়তে শুরু করেছে সৌর।সেই কারণেই সমুর পাগলামি আজকাল বুঝতে পারে ও।আগে হলে দুটো থাপ্পড় মেরে ওকে সোজা করে দিতো।রানী ম্যামের ভূত ছেড়ে যেত মাথা থেকে।কিন্তু এখন আর পারে না সৌর।জ্বলতে-জ্বলতে শেষ হয়ে যাচ্ছে ও....সাইকেল চালাতে-চালাতেই সৌরর সমস্ত শরীর কিছুক্ষণের জন্য কেঁপে একদম স্থির হয়ে গেলো।রাস্তার আবছা আলোয় ও দেখলো,দূরে একটা রোগা-পাতলা মেয়ের অবয়ব,পাশেই দৈত্যাকার একটা কুকুর হেলতে-দুলতে আসছে.....সৌর জানে বটে,মিছরি রোজ টাইগারকে নিয়ে হাঁটতে বেরোয়।টাইগারেরও প্রাকৃতিক কাজ কিছুটা সারা হয়ে যায়,ওদেরও একটু বেড়ানো হয়।তবে আজ যে এইভাবে ওরা মুখোমুখি হবে,এক মুহূর্ত আগেও ভাবতে পারেনি সৌর....পাশেই জোড়া-শিবমন্দির।মন্দিরের প্রাচীন ভাঙাচোরা দেওয়ালের গায়ে একাধিক জংলী গাছ গজিয়েছে।দূরে একটা বটগাছ থেকে নেমে আসা অসংখ্য ঝুরি,এই জায়গাটাকে দিনের বেলাতেই প্রায় অন্ধকার করে রাখে।অত্যন্ত নির্জন অন্ধকারে ঢাকা এই জায়গাটার পরেই প্রশস্ত আমবাগান।রাস্তাটা সন্ধ্যের পর প্রায় ফাঁকাই থাকে।সাইকেলে ব্রেক মারলো সৌর।রাস্তার অন্ধকার একটা কোণে সাইকেলটা সরিয়ে লক করে রাখলো।পিঠ থেকে টিউশনের ব্যাগটা নামিয়ে সাইকেলে রেখে দিলো।ল্যাম্পপোস্টের আবছা-ধোঁয়াটে আলোয় দেখলো,সামনেই মিছরি আসছে টাইগারের সঙ্গে বকতে-বকতে....ওর পাশে-পাশে টাইগার বেশ আনমনে দুলকি-চালেই আসছিলো।কিন্তু হঠাৎ করে ওর থেকে কিছুটা দূরে এসেই টাইগার থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো।তারপর মিছরি কিছু বোঝার আগেই ঘেউ-ঘেউ করতে-করতে রাস্তা পেরিয়ে ছুটে এলো সৌরর কাছে....

-টাইগার!!

কে-কার ডাক শোনে!!টাইগার তখন লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে সৌরর গায়ে উঠে,ওর গা চেটে দিতে ব্যস্ত!নিজেকে আর লুকিয়ে রাখলো না সৌর।রাস্তায় বসে পড়ে,দুহাতে আদর করে জড়িয়ে ধরলো টাইগারকে।ওর সারা গায়ে মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো...রাস্তার ওপারে চুপ করে তিলোত্তমা দাঁড়িয়ে রয়েছে।পরনে একটা হাঁটু পর্যন্ত হালকা ঢোলা প্যান্ট আর টপ....মাথার চুলটা সম্পূর্ণ খোলা....টাইগারকে আদর করতে-করতেই তিলোত্তমার দিকে চাইলো সৌর....ও আর টাইগারকে ডাকছেও না।সৌর সরু রাস্তা পার হয়ে এগিয়ে গেলো ওর কাছে....সঙ্গে-সঙ্গে লেজ নাড়িয়ে টাইগারও দাঁড়ালো দুজনের মধ্যমণি হয়ে....মনের আনন্দে জিভ বের করে হাঁপাতে লাগলো...

-টাইগার?
ডাকলো সৌর...ঘ্যাক করে সাড়া দিলো টাইগার....
-একটু বলনা তোর গার্লফ্রেন্ডকে,আমার সঙ্গে একবার কথা বলতে...
তিলোত্তমার দিকে চেয়েই বললো সৌর।মুখটা নামিয়েই রেখেছে তিলোত্তমা....
-তুই বললে,তোর কথা ঠিক শুনবে।আমার কথা তো শুনছেই না।বল না রে,একবার একটু বুঝিয়ে বলবি?
-টাইগার চল!!

কুঁই-কুঁই করতে-করতে টাইগার তিলোত্তমার সঙ্গই নিয়েছিলো।কিন্তু সৌরর হাত থেকে আজ আর বাঁচতে পারলো না তিলোত্তমা....সৌর এগিয়ে গিয়ে সোজা ওর হাত টেনে ধরলো...

-প্লিজ মিছরি!আচ্ছা যা হয়েছে ভুলে যাও।সরি!!বললাম তো সরি!!আমার সঙ্গে কথা না বলার কারণটুকু অন্তত বলো।ফোনটাও তো ধরছো না তুমি....আমি মরে যাচ্ছি মিছরি...

সৌরর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টায়,ওর সঙ্গে একরকম জোরই করতে শুরু করলো তিলোত্তমা।কিন্তু সৌর কিছুতেই ওর হাতটা ছাড়লো না।বরং ওকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো নিজের সাইকেলের কাছের আধো-অন্ধকার জায়গাটায়....দুজনকে কয়েক মুহূর্ত দেখে গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠলো টাইগার।সৌর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো,এবার কিন্তু টাইগার ওকে উদ্দেশ্য করেই চিৎকার করছে।ওর দুটো চোখ ভাঁটার মতো জ্বলছে,অগ্নিদৃষ্টি ঝরে পড়ছে দুচোখ দিয়ে....একটু অবাকই হলো সৌর।টাইগারের হঠাৎ এমন ব্যবহারের কারণ ও বুঝতে পারলো না।কিন্তু ওর এই পরিবর্তনের কারণটা বুঝিয়ে দিলো তিলোত্তমাই....

-আমার হাতটা ছেড়ে দাও সৌর!তুমি টাইগারকে চেনো না।মা একবার আমাকে জোরে করে বকেছিলো বলে,ও মাকেও কামড়ে দিয়েছিলো।তুমি কিন্তু জোর করছো আমার সঙ্গে,ও বুঝতে পারছে।ওর সঙ্গে তোমার যতই খাতির থাক,আমার সঙ্গে কিছু করলে,টাইগার কিন্তু তোমাকে ছিঁড়ে ফেলবে।আমিও ওর হাত থেকে তোমাকে বাঁচাতে পারবো না....যেতে দাও আমাকে...ছাড়ো সৌর!

মৃদু ধমকে উঠলো মিছরি....

-ছাড়বোই না!
-কি পাগলামি করছো সৌর?

তিলোত্তমার দাপাদাপিতে ওইদিকে টাইগারের চিৎকার আক্রোশে পরিণত হয়েছে।ও গরগর করতে শুরু করেছে।ওকে দেখেই ভয় পেয়ে গেলো তিলোত্তমা।লাফানো বন্ধ করলো,সৌরর হাতের মধ্যে ধরে থাকা,নিজের হাতটাও আর টানাটানি করলো না!টাইগার সৌরর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য একদম প্রস্তুত!কিন্তু সৌরর কোনো হেলদোল নেই।ভয়ের চোটে কেঁদেই ফেললো তিলোত্তমা....
-সৌর!ওকে তুমি জানো না।ও আমাকে ছাড়া কাউকে মানে না!প্লিজ ওর সামনে এইরকম পাগলামো কোরো না!!ও তোমাকে ছিঁড়ে শেষ করে ফেলবে।সামনেই তোমার পরীক্ষা....প্লিজ!!
-এত ভাবো আমার জন্য?তাহলে বলছো না কেন,ভালোবাসি?!কেন পালাচ্ছ আমার কাছ থেকে?ফোন ধরছো না কেন?কথা বলছো না কেন?আমাকে পাগল করে দিচ্ছ কেন?

তিলোত্তমার কান্না দেখে টাইগার ঘেউ-ঘেউ করে গগনবিদারী চিৎকার শুরু করে দিলো।দৌড়ে এলো সৌরর দিকে....
-টাইগার....না!দাঁড়া...

তিলোত্তমার ডাকে থমকে গেলো টাইগার।কিন্তু দমলো না।সৌরর সামনে দাঁড়িয়েই সমানে চিৎকার করতে লাগলো....
-টাইগারের কিচ্ছু বোঝার ক্ষমতা নেই।ও শুধুমাত্র তোমার বডি-ল্যাঙ্গুয়েজ বুঝছে মিছরি,ও তোমাকে ফলো করছে।তুমি এমনটা করছো বলে,তুমি পালাতে চাইছো বলে,আমাকে জোর করতে হচ্ছে।ও আমাকে ছিঁড়ে ফেললেও,আজ আমি তোমাকে ছাড়বো না!!আমাকে ভালোবাসো যখন,এডমিট করছো না কেন?সমস্যাটা কোথায়?আমাকে খুলে বলো....

-আমাকে নিজের সঙ্গে জড়িও না সৌর।তুমি আমাকে সামলাতে পারবে না!আই এম টু টাফ টু হ্যান্ডেল!
-ইফ ইউ আর পজিটিভ মিছরি,আই এম সুপারলেটিভ!দা টাফেস্ট ওয়ান!আমি পারবো.....

ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো তিলোত্তমা....

-না!তুমি পারবে না।কেউ পারে না!!সৌর,প্লিজ আমাকে আর কাঁদিও না।টাইগারের হাত থেকে কিন্তু আমিও তোমাকে বাঁচাতে পারবো না।ছেড়ে দাও আমাকে...
-ছেড়ে দেবো?তোমায়?কিছুতেই না!টাইগারের হাত থেকে আমাকে তুমিই বাঁচাবে!!জানিনা কিভাবে বাঁচাবে?!আমি জানি না!দেখি তোমার টাইগার আজ আমার কি করে...

মুহুর্তমাত্র বোঝার অবকাশ না দিয়ে,তিলোত্তমাকে শিবমন্দিরের পিছনের ভাঙা জঙ্গল গজিয়ে ওঠা দেওয়ালটায় ঠেসে ধরলো সৌর।তিলোত্তমার নরম ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দিলো....

টাইগার ঘ্যাক করে লাফিয়ে উঠতেই,তিলোত্তমা নিজে সরে গিয়ে,সৌরকে টেনে ঘুরিয়ে দিলো দেওয়ালের দিকে।তারপর নিজেকে দিয়ে সম্পূর্ণভাবে সৌরকে আড়াল করে,দুহাতে সৌরর গলা জড়িয়ে ধরে আবেশে দুচোখ বন্ধ করে ফেললো....সৌর তিলোত্তমার কমনীয় শরীরটা ধীরে-ধীরে নিজের শরীরের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে লাগলো....টাইগার ঘ্যাক করে চেঁচিয়ে উঠেও,বোকা বনে গিয়ে চুপ করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো ওদের দিকে।তারপর কুঁই-কুঁই করে বসে পড়লো মাটিতেই...ধীরে-ধীরে খুশিমনে ল্যাজ নাড়তে-নাড়তে হাই তুলে শুয়ে পড়লো....

সৌরর ঠোঁটের গভীরে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলো তিলোত্তমা।সৌর ওকে না ছাড়া পর্যন্ত ওর নিজের আর কোনো হুঁশ ছিলো না।সৌরর হাতও তখন তিলোত্তমার কোমরে-পিঠে চেপে বসে রয়েছে।সৌর ধীরে-ধীরে ছেড়ে দিলো ওকে।তিলোত্তমাকে মুক্ত করলো নিজের ঠোঁটের বন্ধন থেকে....তিলোত্তমা সরে আসতে গেলো সৌরর কাছ থেকে।কিন্তু সৌর আর ওকে ছাড়লো না।ওকে আরও কাছে টেনে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে গালে গাল ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
-এখনও বলবে না মিছরি?এখনও স্বীকার করবে না,যে তুমিও আমায় ভালোবাসো?কি হলো,বলো.....

(চলবে.....)

ছবি: সংগৃহীত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন