দূরের পাখি
সাথী দাস
দ্বিতীয় পর্ব
মুঠোফোনের দিকে চেয়ে হেমাঙ্গিনীর দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে। রিও প্রয়োজন ছাড়া মাকে ফোন করে না। হিসেব মিলিয়ে নেওয়ার জন্য সপ্তাহে বার দুয়েক দোকান থেকে ডাক আসে। এ ছাড়া হেমাঙ্গিনীর জীবনে তেমন ব্যস্ততা নেই।
ওর দিনের সিংহভাগ সময় কাটে বাতাসীর সঙ্গে গল্প করে, বারান্দার ঝুলন্ত টবে বসবাসকারী গাছগুলোতে জল দিয়ে আর ল্যাপটপে ঠুকঠাক করে।
হেমাঙ্গিনী পেশাগতভাবে শব্দশ্রমিক। এই পেশা ওর দায়বদ্ধতা নয়। এই ক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত অর্থের বিনিময়ে গ্যাসে হাঁড়ি চড়ে না। এ নেহাৎই নেশা। তবে স্কুল-কলেজে শব্দ নিয়ে নাড়াচাড়া করে ম্যাগাজিন বা পত্রিকায় দু-চারপাতা লেখার শখ যে এভাবে ওকে মুক্তির পথ দেখাবে, তা হেমাঙ্গিনী কস্মিনকালেও চিন্তা করেনি।
ফ্ল্যাটে উঠে আসার পর হেমাঙ্গিনীর সঙ্গে প্রতিবেশীদের আলাপ হয়েছিল বটে, তবে সেই আলাপ অন্তরঙ্গতার পর্যায়ে পৌঁছয়নি। তবে আলাপ হওয়ার কিছুদিন পর হেমাঙ্গিনী বুঝেছিল, মানুষের সঙ্গে মন খুলে কথা বলার চেয়ে মনের কথা মনে জমিয়ে লিখে ফেলা ভালো। মানুষের সুসময় কিংবা দুঃসময় তিথি-নক্ষত্র মেনে আসে না। সময়ের পরিবর্তন কেবল কথার কথা। আসলে সময় নয়, মানুষ বদলায়। আর বড় দ্রুত বদলায়। যন্ত্র বিকল হলে তাকে সারিয়ে তোলা যায়। কিন্তু মানুষ বদলে গেলে তাকে জীবন থেকে সরিয়ে ফেলা ছাড়া দ্বিতীয় পথ থাকে না।
ঘড়িতে দুপুর দুটো। বারান্দায় দুটো নাইটি আলগা বাতাসে দুলছে। বাতাসী বিকেলে আসবে না। হেমাঙ্গিনীর বিছানা ছেড়ে ওঠার তাড়া নেই। দুপুরের ভাতঘুম সেরে ও আড়মোড়া ভাঙার সময় বুঝল, গায়ে বেশ জ্বর। আনমনে হেসে জানালার ভারী পর্দা টেনে দিল সে। আধো অন্ধকারে ফিকে হল আলো। চোখ বন্ধ করল হেমাঙ্গিনী।
জ্বর বড় সুন্দর অনুভূতি। মানুষ মানুষকে ছেড়ে যাওয়ার আগে দু'বার ভাবে না। যাওয়ার আগে পিছুটানহীন হওয়ার আশায় সে স্মৃতিটুকুও হজম করে যায়। এ বিষয়ে জ্বরজ্বালা অনেক উদার। ছেড়ে যাওয়ার পর স্মৃতি হিসেবে খানিক দুর্বলতা রেখে যায়।
জ্বরের চেয়ে জ্বর পরবর্তী সময়ে মানুষ বড় কাতর হয়। তখন স্পর্শক্ষুধা তীব্র হয়ে ওঠে। এখন সেই দুর্বলতায় কাতর হয়েছে হেমাঙ্গিনী। মনের ভিতর কেমন যেন করে। একাকীত্বের উষ্ণতা বুক ভেদ করে ত্বক ছুঁয়েছে। অজান্তেই নিজের কপালে হাত দিয়ে হেমাঙ্গিনী দেখল, দেহ শীতল।
এ সবই মনগড়া মিথ্যে অসুখ। ওর মনের ভিতর যে মন আছে, সেই মনে ধ্রুবর বাস। তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে জুঁইফুলের মালা আনতে গিয়ে ধ্রুব জ্বর বাধিয়ে বসে আছে। ধ্রুবর জ্বর হলে সেই উষ্ণতা হেমাঙ্গিনীকে স্পর্শ করবে না? তা আবার হয় নাকি?
জ্বরের ঘোরে ধ্রুব পড়ে রয়েছে বিছানায়। জুঁইফুল তার সৌন্দর্য এবং সৌরভ হারিয়েছে। ব্যস্ত পাখি জলপট্টি দিতে ব্যস্ত। পাখির ডানার আড়ালে আত্মগোপন করতে চাইল জ্বরতপ্ত ধ্রুব। অনিদ্রার কারণে পাখির চোখের কোলে গভীর কালি পড়েছে। রুগ্ন ধ্রুবর ভগ্নস্বাস্থ্য উদ্ধারকার্য হেতু পাখি নিজে হয়েছে শীর্ণকায়া। পাখির মলিন মুখ দেখে ধ্রুবর কষ্ট হয়। পাখিকে কষে শাস্তি দেওয়া হল বটে! কিন্তু এমন শাস্তির কথা ধ্রুব ভাবেনি।
রান্নাঘর থেকে খিচুড়ির সুবাস আসছে। বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। এমন বৃষ্টিতে কাদায় মাখামাখি হয়ে কাঁচা পথ বেয়ে পাখির হাত ধরে হেঁটে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ও কি রাজি হবে? জ্বর গায়ে বাইরে যেতে দেবে? একটা ছাতার নীচে দু'জনে ভিজে জবজবে হয়ে গেলে কেমন হয়? সেই সময় যদি কাকভেজা ধ্রুব ঠোঁট রাখতে চায় পাখির তীক্ষ্ণ ঠোঁটে? ও কি বিরক্তি আর ক্ষোভমিশ্রিত দৃষ্টিতে চেয়ে ধ্রুবকে ভস্ম করে দেবে? প্রবল আপত্তিতে নিজের ঠোঁট ছিনিয়ে নেবে ধ্রুবর ঠোঁটের ভিতর থেকে? ফিরিয়ে দেবে ধ্রুবর কামনাকে?
পাখি তুমি আমাকে ফিরিয়ে দাও। তুমি বিরক্ত হও। কুকথা বলো। আমাকে শাসন করো। মনের যত ক্ষোভ আছে, যত নীরব অভিমান.... সব উগড়ে দাও নিমেষে। আমি তোমাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম। এ আমার গর্হিত অপরাধ। তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না।
পাখি তুমি পাখি হয়ে ডানা মেলে উড়ে যাও দিগন্তে। সংসার নামক খাঁচা তোমার জন্য নয়। আমি যেদিন মুক্তি পেয়ে আকাশ হবো, তুমি সেদিন পাখি হয়ে ডানা ঝটপটিয়ে ফিরে-ফিরে এসো আমার কাছে...
জ্বরের ঘোর আষ্টেপৃষ্টে চেপে ধরে ধ্রুবকে। গোঙানির শব্দ বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে পাখির কানে পৌঁছয় না। সমস্ত অন্ধকার কেন্দ্রীভূত হয়ে একটা উজ্জ্বল আলোর বিন্দু তৈরি হয়েছে। এ কি কেবলই দুর্যোগ? নাকি দৈবযোগ? প্রসন্ন হল পাখি? আমার পাখি! কেমন আছ পাখি? আমি প্রলাপ বকছি না। পৃথিবী ধ্বংসের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আমি তোমাকে চাই।
ও কি লণ্ঠনের আলো? রান্নাঘর থেকে সে এসে বসেছে শয্যাপ্রান্তে? একটানা কান্নার সুর ভেসে আসছে দূর থেকে। কে কাঁদে? এ তো পাখির কান্না নয়। তবে কি চেনা গানের সুর? বৃষ্টির জলতরঙ্গ?
চেতনার অতলে ঝাঁপ দিচ্ছে স্মৃতি। সুরেলা কণ্ঠে পাখি গান ধরেছে। পাখির পা দুটো আঁকড়ে ধরতে চাইল ধ্রুব। ওর পায়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দেবে। চুমু খাবে। এ ছাড়া ক্ষমাপ্রার্থনা করার দ্বিতীয় কোনও ভাষা ধ্রুবর জানা নেই।
বৃষ্টির বেগ বেড়ে যায়। ঘনায়মান অন্ধকার রহস্যময়ীর মতো গাঢ় হয়। আমগাছের ডালে আটকে থাকা স্বপ্নঘুড়ি ছিঁড়েখুঁড়ে শেষ হয়ে যায়। ধ্রুব আকুল হয়ে ডাকে, "পাখি.... আমি কেন তোমার মতো নিষ্ঠুর হতে পারলাম না!"
আমি পা মেপে বৃষ্টিসিক্ত পথে হাঁটব না। আমি বৃষ্টির জল চেখে দেখব না। সর্বক্ষণ তোমাকে শাস্তি দিতে চাইব না। তোমার অবাধ্য হবো না...
ধ্রুবর পাঁজরভাঙা আর্তি কেউ শুনল না। লাবণ্যহীন সম্পর্কের ধ্বংসস্তূপে নির্মিত স্যাঁতসেঁতে একটা ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা চৌপায়াতে একলা শুয়ে রয়েছে সে। সঙ্গী তার শুকনো জুঁইফুলের মালা, নিকোটিন আর তিনদিনের বাসি পাঁউরুটি। যে পাঁউরুটির ভাগ নিয়ে আরশোলার সঙ্গে চলে ধ্রুবর নিত্য বচসা। জানালায় দিন-রাত্রি নিয়ম মেনে কড়া নাড়ে। দেওয়ালের ছায়াগুলো দীর্ঘতর হতে হতে প্রেতাত্মার মতো বাতাসে মিলিয়ে যায়।
ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙল হেমাঙ্গিনীর। মাথার মধ্যে ও বয়ে বেড়ায় ধ্রুবর আস্ত সংসার। তার ওজন নেহাৎ কম নয়। মাথাটা ভারী হয়ে আসে। বিনবিনে ঘাম জমে চোখের কোলে। ফোনের রিংটোন আর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের যাতায়াত জানান দেয় কল্পনা ছাড়াও বাস্তবে হেমাঙ্গিনীর অস্তিত্ব আছে। স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আছে। অর্থ, যশ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি আছে। নাড়িছেঁড়া ধন রিও আছে। আর আছে প্রাক্তন স্ত্রীর তকমা।
দেবতনু...
বৃষ্টি আসে। বৃষ্টি যায়। রাস্তায় জল জমে কাদায় মাখামাখি হয় পাড়ার কুকুরটা। কেঁউ কেঁউ শব্দে ডেকে উঠলেও বৃষ্টিতে ভিজে হয়ে কেউ ওকে কোলে তুলে নেয় না। ভিজে পাঞ্জাবি আড়াল করে বুকে লুকিয়ে প্রেমিকার কাছে এসে বলে না, "আমার জন্য নয় হেম। এই অবলা প্রাণীটার জন্য এসেছি। ওকে তোমার কাছে রাখবে?"
হেমাঙ্গিনীর ঘরের দেওয়ালে কুকুরটার ছায়া দীর্ঘতর হয়। লালা ঝরে ওর জিভ থেকে। বাঙ্ময় দৃষ্টিতে জিঘাংসা! উফ! কী বীভৎস তার অভিযোগ জানাবার ভঙ্গি। অন্ধকারে নিমজ্জিত অদৃশ্য প্রাণীটা রাগে গরগর করছে। হেমাঙ্গিনীর কপালের কাছে ঝিকমিক করে জ্বলে উঠল শ্বদন্ত।
ফোন বেজে গেল। হেমাঙ্গিনী চোখ মেলল না। ভিজে চোখ মুছল না। আজ বাতাসী আসবে না। হেমাঙ্গিনীর কোনও ব্যস্ততা নেই। সঙ্গীহীন এ জগৎসংসারে হেমাঙ্গিনীর প্রয়োজন নেই।
গোঁ গোঁ করে চিৎকার করতে চাইল হেমাঙ্গিনী। বাতাসী ঘরে থাকলে কেঁদে বলত, "দিদিকে বোবায় ধরেছে গো..."
আসমুদ্রহিমাচল থরথর করে কেঁপে উঠত বাতাসীর আর্তনাদে। বাতাসী! হেমাঙ্গিনীর একমাত্র আপনার জন। জন্ম-জন্মান্তরের সই।
হেমাঙ্গিনীর বুক ধড়ফড় করে ওঠে অব্যক্ত কান্নায়। আশ্রয়ের সন্ধানে। মানুষ তুমি মানুষকে দয়া করো! মানুষ তুমি মুক্তি দাও! ভিক্ষা চাই তোমার অনুকম্পা! মানুষ তুমি করুণা করে হলেও ভালোবাসো.... আমাকে উচ্ছিষ্ট করো...
নিস্তেজ হয়ে বিছানার সঙ্গে মিশে রইল হেমাঙ্গিনী। ল্যাপটপে ভাবনার মালা গাঁথা হল না। অজস্র শব্দ অস্থির মস্তিষ্কের ইতিউতি ছড়িয়ে গেল। শহীদ হল স্নায়ুযুদ্ধের নিত্য সৈনিক। নিহন্তা হেমাঙ্গিনী।
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত এবং প্রতীকী
ওর দিনের সিংহভাগ সময় কাটে বাতাসীর সঙ্গে গল্প করে, বারান্দার ঝুলন্ত টবে বসবাসকারী গাছগুলোতে জল দিয়ে আর ল্যাপটপে ঠুকঠাক করে।
হেমাঙ্গিনী পেশাগতভাবে শব্দশ্রমিক। এই পেশা ওর দায়বদ্ধতা নয়। এই ক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত অর্থের বিনিময়ে গ্যাসে হাঁড়ি চড়ে না। এ নেহাৎই নেশা। তবে স্কুল-কলেজে শব্দ নিয়ে নাড়াচাড়া করে ম্যাগাজিন বা পত্রিকায় দু-চারপাতা লেখার শখ যে এভাবে ওকে মুক্তির পথ দেখাবে, তা হেমাঙ্গিনী কস্মিনকালেও চিন্তা করেনি।
ফ্ল্যাটে উঠে আসার পর হেমাঙ্গিনীর সঙ্গে প্রতিবেশীদের আলাপ হয়েছিল বটে, তবে সেই আলাপ অন্তরঙ্গতার পর্যায়ে পৌঁছয়নি। তবে আলাপ হওয়ার কিছুদিন পর হেমাঙ্গিনী বুঝেছিল, মানুষের সঙ্গে মন খুলে কথা বলার চেয়ে মনের কথা মনে জমিয়ে লিখে ফেলা ভালো। মানুষের সুসময় কিংবা দুঃসময় তিথি-নক্ষত্র মেনে আসে না। সময়ের পরিবর্তন কেবল কথার কথা। আসলে সময় নয়, মানুষ বদলায়। আর বড় দ্রুত বদলায়। যন্ত্র বিকল হলে তাকে সারিয়ে তোলা যায়। কিন্তু মানুষ বদলে গেলে তাকে জীবন থেকে সরিয়ে ফেলা ছাড়া দ্বিতীয় পথ থাকে না।
ঘড়িতে দুপুর দুটো। বারান্দায় দুটো নাইটি আলগা বাতাসে দুলছে। বাতাসী বিকেলে আসবে না। হেমাঙ্গিনীর বিছানা ছেড়ে ওঠার তাড়া নেই। দুপুরের ভাতঘুম সেরে ও আড়মোড়া ভাঙার সময় বুঝল, গায়ে বেশ জ্বর। আনমনে হেসে জানালার ভারী পর্দা টেনে দিল সে। আধো অন্ধকারে ফিকে হল আলো। চোখ বন্ধ করল হেমাঙ্গিনী।
জ্বর বড় সুন্দর অনুভূতি। মানুষ মানুষকে ছেড়ে যাওয়ার আগে দু'বার ভাবে না। যাওয়ার আগে পিছুটানহীন হওয়ার আশায় সে স্মৃতিটুকুও হজম করে যায়। এ বিষয়ে জ্বরজ্বালা অনেক উদার। ছেড়ে যাওয়ার পর স্মৃতি হিসেবে খানিক দুর্বলতা রেখে যায়।
জ্বরের চেয়ে জ্বর পরবর্তী সময়ে মানুষ বড় কাতর হয়। তখন স্পর্শক্ষুধা তীব্র হয়ে ওঠে। এখন সেই দুর্বলতায় কাতর হয়েছে হেমাঙ্গিনী। মনের ভিতর কেমন যেন করে। একাকীত্বের উষ্ণতা বুক ভেদ করে ত্বক ছুঁয়েছে। অজান্তেই নিজের কপালে হাত দিয়ে হেমাঙ্গিনী দেখল, দেহ শীতল।
এ সবই মনগড়া মিথ্যে অসুখ। ওর মনের ভিতর যে মন আছে, সেই মনে ধ্রুবর বাস। তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে জুঁইফুলের মালা আনতে গিয়ে ধ্রুব জ্বর বাধিয়ে বসে আছে। ধ্রুবর জ্বর হলে সেই উষ্ণতা হেমাঙ্গিনীকে স্পর্শ করবে না? তা আবার হয় নাকি?
জ্বরের ঘোরে ধ্রুব পড়ে রয়েছে বিছানায়। জুঁইফুল তার সৌন্দর্য এবং সৌরভ হারিয়েছে। ব্যস্ত পাখি জলপট্টি দিতে ব্যস্ত। পাখির ডানার আড়ালে আত্মগোপন করতে চাইল জ্বরতপ্ত ধ্রুব। অনিদ্রার কারণে পাখির চোখের কোলে গভীর কালি পড়েছে। রুগ্ন ধ্রুবর ভগ্নস্বাস্থ্য উদ্ধারকার্য হেতু পাখি নিজে হয়েছে শীর্ণকায়া। পাখির মলিন মুখ দেখে ধ্রুবর কষ্ট হয়। পাখিকে কষে শাস্তি দেওয়া হল বটে! কিন্তু এমন শাস্তির কথা ধ্রুব ভাবেনি।
রান্নাঘর থেকে খিচুড়ির সুবাস আসছে। বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। এমন বৃষ্টিতে কাদায় মাখামাখি হয়ে কাঁচা পথ বেয়ে পাখির হাত ধরে হেঁটে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ও কি রাজি হবে? জ্বর গায়ে বাইরে যেতে দেবে? একটা ছাতার নীচে দু'জনে ভিজে জবজবে হয়ে গেলে কেমন হয়? সেই সময় যদি কাকভেজা ধ্রুব ঠোঁট রাখতে চায় পাখির তীক্ষ্ণ ঠোঁটে? ও কি বিরক্তি আর ক্ষোভমিশ্রিত দৃষ্টিতে চেয়ে ধ্রুবকে ভস্ম করে দেবে? প্রবল আপত্তিতে নিজের ঠোঁট ছিনিয়ে নেবে ধ্রুবর ঠোঁটের ভিতর থেকে? ফিরিয়ে দেবে ধ্রুবর কামনাকে?
পাখি তুমি আমাকে ফিরিয়ে দাও। তুমি বিরক্ত হও। কুকথা বলো। আমাকে শাসন করো। মনের যত ক্ষোভ আছে, যত নীরব অভিমান.... সব উগড়ে দাও নিমেষে। আমি তোমাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম। এ আমার গর্হিত অপরাধ। তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না।
পাখি তুমি পাখি হয়ে ডানা মেলে উড়ে যাও দিগন্তে। সংসার নামক খাঁচা তোমার জন্য নয়। আমি যেদিন মুক্তি পেয়ে আকাশ হবো, তুমি সেদিন পাখি হয়ে ডানা ঝটপটিয়ে ফিরে-ফিরে এসো আমার কাছে...
জ্বরের ঘোর আষ্টেপৃষ্টে চেপে ধরে ধ্রুবকে। গোঙানির শব্দ বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে পাখির কানে পৌঁছয় না। সমস্ত অন্ধকার কেন্দ্রীভূত হয়ে একটা উজ্জ্বল আলোর বিন্দু তৈরি হয়েছে। এ কি কেবলই দুর্যোগ? নাকি দৈবযোগ? প্রসন্ন হল পাখি? আমার পাখি! কেমন আছ পাখি? আমি প্রলাপ বকছি না। পৃথিবী ধ্বংসের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আমি তোমাকে চাই।
ও কি লণ্ঠনের আলো? রান্নাঘর থেকে সে এসে বসেছে শয্যাপ্রান্তে? একটানা কান্নার সুর ভেসে আসছে দূর থেকে। কে কাঁদে? এ তো পাখির কান্না নয়। তবে কি চেনা গানের সুর? বৃষ্টির জলতরঙ্গ?
চেতনার অতলে ঝাঁপ দিচ্ছে স্মৃতি। সুরেলা কণ্ঠে পাখি গান ধরেছে। পাখির পা দুটো আঁকড়ে ধরতে চাইল ধ্রুব। ওর পায়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দেবে। চুমু খাবে। এ ছাড়া ক্ষমাপ্রার্থনা করার দ্বিতীয় কোনও ভাষা ধ্রুবর জানা নেই।
বৃষ্টির বেগ বেড়ে যায়। ঘনায়মান অন্ধকার রহস্যময়ীর মতো গাঢ় হয়। আমগাছের ডালে আটকে থাকা স্বপ্নঘুড়ি ছিঁড়েখুঁড়ে শেষ হয়ে যায়। ধ্রুব আকুল হয়ে ডাকে, "পাখি.... আমি কেন তোমার মতো নিষ্ঠুর হতে পারলাম না!"
আমি পা মেপে বৃষ্টিসিক্ত পথে হাঁটব না। আমি বৃষ্টির জল চেখে দেখব না। সর্বক্ষণ তোমাকে শাস্তি দিতে চাইব না। তোমার অবাধ্য হবো না...
ধ্রুবর পাঁজরভাঙা আর্তি কেউ শুনল না। লাবণ্যহীন সম্পর্কের ধ্বংসস্তূপে নির্মিত স্যাঁতসেঁতে একটা ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা চৌপায়াতে একলা শুয়ে রয়েছে সে। সঙ্গী তার শুকনো জুঁইফুলের মালা, নিকোটিন আর তিনদিনের বাসি পাঁউরুটি। যে পাঁউরুটির ভাগ নিয়ে আরশোলার সঙ্গে চলে ধ্রুবর নিত্য বচসা। জানালায় দিন-রাত্রি নিয়ম মেনে কড়া নাড়ে। দেওয়ালের ছায়াগুলো দীর্ঘতর হতে হতে প্রেতাত্মার মতো বাতাসে মিলিয়ে যায়।
ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙল হেমাঙ্গিনীর। মাথার মধ্যে ও বয়ে বেড়ায় ধ্রুবর আস্ত সংসার। তার ওজন নেহাৎ কম নয়। মাথাটা ভারী হয়ে আসে। বিনবিনে ঘাম জমে চোখের কোলে। ফোনের রিংটোন আর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের যাতায়াত জানান দেয় কল্পনা ছাড়াও বাস্তবে হেমাঙ্গিনীর অস্তিত্ব আছে। স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আছে। অর্থ, যশ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি আছে। নাড়িছেঁড়া ধন রিও আছে। আর আছে প্রাক্তন স্ত্রীর তকমা।
দেবতনু...
বৃষ্টি আসে। বৃষ্টি যায়। রাস্তায় জল জমে কাদায় মাখামাখি হয় পাড়ার কুকুরটা। কেঁউ কেঁউ শব্দে ডেকে উঠলেও বৃষ্টিতে ভিজে হয়ে কেউ ওকে কোলে তুলে নেয় না। ভিজে পাঞ্জাবি আড়াল করে বুকে লুকিয়ে প্রেমিকার কাছে এসে বলে না, "আমার জন্য নয় হেম। এই অবলা প্রাণীটার জন্য এসেছি। ওকে তোমার কাছে রাখবে?"
হেমাঙ্গিনীর ঘরের দেওয়ালে কুকুরটার ছায়া দীর্ঘতর হয়। লালা ঝরে ওর জিভ থেকে। বাঙ্ময় দৃষ্টিতে জিঘাংসা! উফ! কী বীভৎস তার অভিযোগ জানাবার ভঙ্গি। অন্ধকারে নিমজ্জিত অদৃশ্য প্রাণীটা রাগে গরগর করছে। হেমাঙ্গিনীর কপালের কাছে ঝিকমিক করে জ্বলে উঠল শ্বদন্ত।
ফোন বেজে গেল। হেমাঙ্গিনী চোখ মেলল না। ভিজে চোখ মুছল না। আজ বাতাসী আসবে না। হেমাঙ্গিনীর কোনও ব্যস্ততা নেই। সঙ্গীহীন এ জগৎসংসারে হেমাঙ্গিনীর প্রয়োজন নেই।
গোঁ গোঁ করে চিৎকার করতে চাইল হেমাঙ্গিনী। বাতাসী ঘরে থাকলে কেঁদে বলত, "দিদিকে বোবায় ধরেছে গো..."
আসমুদ্রহিমাচল থরথর করে কেঁপে উঠত বাতাসীর আর্তনাদে। বাতাসী! হেমাঙ্গিনীর একমাত্র আপনার জন। জন্ম-জন্মান্তরের সই।
হেমাঙ্গিনীর বুক ধড়ফড় করে ওঠে অব্যক্ত কান্নায়। আশ্রয়ের সন্ধানে। মানুষ তুমি মানুষকে দয়া করো! মানুষ তুমি মুক্তি দাও! ভিক্ষা চাই তোমার অনুকম্পা! মানুষ তুমি করুণা করে হলেও ভালোবাসো.... আমাকে উচ্ছিষ্ট করো...
নিস্তেজ হয়ে বিছানার সঙ্গে মিশে রইল হেমাঙ্গিনী। ল্যাপটপে ভাবনার মালা গাঁথা হল না। অজস্র শব্দ অস্থির মস্তিষ্কের ইতিউতি ছড়িয়ে গেল। শহীদ হল স্নায়ুযুদ্ধের নিত্য সৈনিক। নিহন্তা হেমাঙ্গিনী।
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত এবং প্রতীকী