অনুসরণকারী

বুধবার, ৩১ জুলাই, ২০২৪

দূরের পাখি দ্বিতীয় পর্ব


 


দূরের পাখি

সাথী দাস
দ্বিতীয় পর্ব



মুঠোফোনের দিকে চেয়ে হেমাঙ্গিনীর দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে। রিও প্রয়োজন ছাড়া মাকে ফোন করে না। হিসেব মিলিয়ে নেওয়ার জন্য সপ্তাহে বার দুয়েক দোকান থেকে ডাক আসে। এ ছাড়া হেমাঙ্গিনীর জীবনে তেমন ব্যস্ততা নেই।

ওর দিনের সিংহভাগ সময় কাটে বাতাসীর সঙ্গে গল্প করে, বারান্দার ঝুলন্ত টবে বসবাসকারী গাছগুলোতে জল দিয়ে আর ল্যাপটপে ঠুকঠাক করে।

হেমাঙ্গিনী পেশাগতভাবে শব্দশ্রমিক। এই পেশা ওর দায়বদ্ধতা নয়। এই ক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত অর্থের বিনিময়ে গ্যাসে হাঁড়ি চড়ে না। এ নেহাৎই নেশা। তবে স্কুল-কলেজে শব্দ নিয়ে নাড়াচাড়া করে ম্যাগাজিন বা পত্রিকায় দু-চারপাতা লেখার শখ যে এভাবে ওকে মুক্তির পথ দেখাবে, তা হেমাঙ্গিনী কস্মিনকালেও চিন্তা করেনি।

ফ্ল্যাটে উঠে আসার পর হেমাঙ্গিনীর সঙ্গে প্রতিবেশীদের আলাপ হয়েছিল বটে, তবে সেই আলাপ অন্তরঙ্গতার পর্যায়ে পৌঁছয়নি। তবে আলাপ হওয়ার কিছুদিন পর হেমাঙ্গিনী বুঝেছিল, মানুষের সঙ্গে মন খুলে কথা বলার চেয়ে মনের কথা মনে জমিয়ে লিখে ফেলা ভালো। মানুষের সুসময় কিংবা দুঃসময় তিথি-নক্ষত্র মেনে আসে না। সময়ের পরিবর্তন কেবল কথার কথা। আসলে সময় নয়, মানুষ বদলায়। আর বড় দ্রুত বদলায়। যন্ত্র বিকল হলে তাকে সারিয়ে তোলা যায়। কিন্তু মানুষ বদলে গেলে তাকে জীবন থেকে সরিয়ে ফেলা ছাড়া দ্বিতীয় পথ থাকে না।

ঘড়িতে দুপুর দুটো। বারান্দায় দুটো নাইটি আলগা বাতাসে দুলছে। বাতাসী বিকেলে আসবে না। হেমাঙ্গিনীর বিছানা ছেড়ে ওঠার তাড়া নেই। দুপুরের ভাতঘুম সেরে ও আড়মোড়া ভাঙার সময় বুঝল, গায়ে বেশ জ্বর। আনমনে হেসে জানালার ভারী পর্দা টেনে দিল সে। আধো অন্ধকারে ফিকে হল আলো। চোখ বন্ধ করল হেমাঙ্গিনী।

জ্বর বড় সুন্দর অনুভূতি। মানুষ মানুষকে ছেড়ে যাওয়ার আগে দু'বার ভাবে না। যাওয়ার আগে পিছুটানহীন হওয়ার আশায় সে স্মৃতিটুকুও হজম করে যায়। এ বিষয়ে জ্বরজ্বালা অনেক উদার। ছেড়ে যাওয়ার পর স্মৃতি হিসেবে খানিক দুর্বলতা রেখে যায়।

জ্বরের চেয়ে জ্বর পরবর্তী সময়ে মানুষ বড় কাতর হয়। তখন স্পর্শক্ষুধা তীব্র হয়ে ওঠে। এখন সেই দুর্বলতায় কাতর হয়েছে হেমাঙ্গিনী। মনের ভিতর কেমন যেন করে। একাকীত্বের উষ্ণতা বুক ভেদ করে ত্বক ছুঁয়েছে। অজান্তেই নিজের কপালে হাত দিয়ে হেমাঙ্গিনী দেখল, দেহ শীতল।

এ সবই মনগড়া মিথ্যে অসুখ। ওর মনের ভিতর যে মন আছে, সেই মনে ধ্রুবর বাস। তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে জুঁইফুলের মালা আনতে গিয়ে ধ্রুব জ্বর বাধিয়ে বসে আছে। ধ্রুবর জ্বর হলে সেই উষ্ণতা হেমাঙ্গিনীকে স্পর্শ করবে না? তা আবার হয় নাকি?

জ্বরের ঘোরে ধ্রুব পড়ে রয়েছে বিছানায়। জুঁইফুল তার সৌন্দর্য এবং সৌরভ হারিয়েছে। ব্যস্ত পাখি জলপট্টি দিতে ব্যস্ত। পাখির ডানার আড়ালে আত্মগোপন করতে চাইল জ্বরতপ্ত ধ্রুব। অনিদ্রার কারণে পাখির চোখের কোলে গভীর কালি পড়েছে। রুগ্ন ধ্রুবর ভগ্নস্বাস্থ্য উদ্ধারকার্য হেতু পাখি নিজে হয়েছে শীর্ণকায়া। পাখির মলিন মুখ দেখে ধ্রুবর কষ্ট হয়। পাখিকে কষে শাস্তি দেওয়া হল বটে! কিন্তু এমন শাস্তির কথা ধ্রুব ভাবেনি।

রান্নাঘর থেকে খিচুড়ির সুবাস আসছে। বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। এমন বৃষ্টিতে কাদায় মাখামাখি হয়ে কাঁচা পথ বেয়ে পাখির হাত ধরে হেঁটে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ও কি রাজি হবে? জ্বর গায়ে বাইরে যেতে দেবে? একটা ছাতার নীচে দু'জনে ভিজে জবজবে হয়ে গেলে কেমন হয়? সেই সময় যদি কাকভেজা ধ্রুব ঠোঁট রাখতে চায় পাখির তীক্ষ্ণ ঠোঁটে? ও কি বিরক্তি আর ক্ষোভমিশ্রিত দৃষ্টিতে চেয়ে ধ্রুবকে ভস্ম করে দেবে? প্রবল আপত্তিতে নিজের ঠোঁট ছিনিয়ে নেবে ধ্রুবর ঠোঁটের ভিতর থেকে? ফিরিয়ে দেবে ধ্রুবর কামনাকে?

পাখি তুমি আমাকে ফিরিয়ে দাও। তুমি বিরক্ত হও। কুকথা বলো। আমাকে শাসন করো। মনের যত ক্ষোভ আছে, যত নীরব অভিমান.... সব উগড়ে দাও নিমেষে। আমি তোমাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম। এ আমার গর্হিত অপরাধ। তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না।

পাখি তুমি পাখি হয়ে ডানা মেলে উড়ে যাও দিগন্তে। সংসার নামক খাঁচা তোমার জন্য নয়। আমি যেদিন মুক্তি পেয়ে আকাশ হবো, তুমি সেদিন পাখি হয়ে ডানা ঝটপটিয়ে ফিরে-ফিরে এসো আমার কাছে...

জ্বরের ঘোর আষ্টেপৃষ্টে চেপে ধরে ধ্রুবকে। গোঙানির শব্দ বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে পাখির কানে পৌঁছয় না। সমস্ত অন্ধকার কেন্দ্রীভূত হয়ে একটা উজ্জ্বল আলোর বিন্দু তৈরি হয়েছে। এ কি কেবলই দুর্যোগ? নাকি দৈবযোগ? প্রসন্ন হল পাখি? আমার পাখি! কেমন আছ পাখি? আমি প্রলাপ বকছি না। পৃথিবী ধ্বংসের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আমি তোমাকে চাই।

ও কি লণ্ঠনের আলো? রান্নাঘর থেকে সে এসে বসেছে শয্যাপ্রান্তে? একটানা কান্নার সুর ভেসে আসছে দূর থেকে। কে কাঁদে? এ তো পাখির কান্না নয়। তবে কি চেনা গানের সুর? বৃষ্টির জলতরঙ্গ?

চেতনার অতলে ঝাঁপ দিচ্ছে স্মৃতি। সুরেলা কণ্ঠে পাখি গান ধরেছে। পাখির পা দুটো আঁকড়ে ধরতে চাইল ধ্রুব। ওর পায়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দেবে। চুমু খাবে। এ ছাড়া ক্ষমাপ্রার্থনা করার দ্বিতীয় কোনও ভাষা ধ্রুবর জানা নেই।

বৃষ্টির বেগ বেড়ে যায়। ঘনায়মান অন্ধকার রহস্যময়ীর মতো গাঢ় হয়। আমগাছের ডালে আটকে থাকা স্বপ্নঘুড়ি ছিঁড়েখুঁড়ে শেষ হয়ে যায়। ধ্রুব আকুল হয়ে ডাকে, "পাখি.... আমি কেন তোমার মতো নিষ্ঠুর হতে পারলাম না!"

আমি পা মেপে বৃষ্টিসিক্ত পথে হাঁটব না। আমি বৃষ্টির জল চেখে দেখব না। সর্বক্ষণ তোমাকে শাস্তি দিতে চাইব না। তোমার অবাধ্য হবো না...

ধ্রুবর পাঁজরভাঙা আর্তি কেউ শুনল না। লাবণ্যহীন সম্পর্কের ধ্বংসস্তূপে নির্মিত স্যাঁতসেঁতে একটা ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা চৌপায়াতে একলা শুয়ে রয়েছে সে। সঙ্গী তার শুকনো জুঁইফুলের মালা, নিকোটিন আর তিনদিনের বাসি পাঁউরুটি। যে পাঁউরুটির ভাগ নিয়ে আরশোলার সঙ্গে চলে ধ্রুবর নিত্য বচসা। জানালায় দিন-রাত্রি নিয়ম মেনে কড়া নাড়ে। দেওয়ালের ছায়াগুলো দীর্ঘতর হতে হতে প্রেতাত্মার মতো বাতাসে মিলিয়ে যায়।

ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙল হেমাঙ্গিনীর। মাথার মধ্যে ও বয়ে বেড়ায় ধ্রুবর আস্ত সংসার। তার ওজন নেহাৎ কম নয়। মাথাটা ভারী হয়ে আসে। বিনবিনে ঘাম জমে চোখের কোলে। ফোনের রিংটোন আর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের যাতায়াত জানান দেয় কল্পনা ছাড়াও বাস্তবে হেমাঙ্গিনীর অস্তিত্ব আছে। স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আছে। অর্থ, যশ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি আছে। নাড়িছেঁড়া ধন রিও আছে। আর আছে প্রাক্তন স্ত্রীর তকমা।

দেবতনু...

বৃষ্টি আসে। বৃষ্টি যায়। রাস্তায় জল জমে কাদায় মাখামাখি হয় পাড়ার কুকুরটা। কেঁউ কেঁউ শব্দে ডেকে উঠলেও বৃষ্টিতে ভিজে হয়ে কেউ ওকে কোলে তুলে নেয় না। ভিজে পাঞ্জাবি আড়াল করে বুকে লুকিয়ে প্রেমিকার কাছে এসে বলে না, "আমার জন্য নয় হেম। এই অবলা প্রাণীটার জন্য এসেছি। ওকে তোমার কাছে রাখবে?"

হেমাঙ্গিনীর ঘরের দেওয়ালে কুকুরটার ছায়া দীর্ঘতর হয়। লালা ঝরে ওর জিভ থেকে। বাঙ্ময় দৃষ্টিতে জিঘাংসা! উফ! কী বীভৎস তার অভিযোগ জানাবার ভঙ্গি। অন্ধকারে নিমজ্জিত অদৃশ্য প্রাণীটা রাগে গরগর করছে। হেমাঙ্গিনীর কপালের কাছে ঝিকমিক করে জ্বলে উঠল শ্বদন্ত।

ফোন বেজে গেল। হেমাঙ্গিনী চোখ মেলল না। ভিজে চোখ মুছল না। আজ বাতাসী আসবে না। হেমাঙ্গিনীর কোনও ব্যস্ততা নেই। সঙ্গীহীন এ জগৎসংসারে হেমাঙ্গিনীর প্রয়োজন নেই।

গোঁ গোঁ করে চিৎকার করতে চাইল হেমাঙ্গিনী। বাতাসী ঘরে থাকলে কেঁদে বলত, "দিদিকে বোবায় ধরেছে গো..."

আসমুদ্রহিমাচল থরথর করে কেঁপে উঠত বাতাসীর আর্তনাদে। বাতাসী! হেমাঙ্গিনীর একমাত্র আপনার জন। জন্ম-জন্মান্তরের সই।

হেমাঙ্গিনীর বুক ধড়ফড় করে ওঠে অব্যক্ত কান্নায়। আশ্রয়ের সন্ধানে। মানুষ তুমি মানুষকে দয়া করো! মানুষ তুমি মুক্তি দাও! ভিক্ষা চাই তোমার অনুকম্পা! মানুষ তুমি করুণা করে হলেও ভালোবাসো.... আমাকে উচ্ছিষ্ট করো...

নিস্তেজ হয়ে বিছানার সঙ্গে মিশে রইল হেমাঙ্গিনী। ল্যাপটপে ভাবনার মালা গাঁথা হল না। অজস্র শব্দ অস্থির মস্তিষ্কের ইতিউতি ছড়িয়ে গেল। শহীদ হল স্নায়ুযুদ্ধের নিত্য সৈনিক। নিহন্তা হেমাঙ্গিনী।

(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত এবং প্রতীকী

শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

দূরের পাখি প্রথম পর্ব


 


দূরের পাখি

সাথী দাস
প্রথম পর্ব



শহর জুড়ে ট্র্যাফিক জ্যাম। অপেক্ষা সিগন্যালের। সবুজ আলোর ছাড়পত্র পেতে মরিয়া গাড়ির চালক। ঘামে ভেজা জামাকাপড়ে বন্দি হয়ে বাসের ভিতর অপেক্ষা করছে নিত্যযাত্রীরা। কারও পোশাক হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টিতে ভিজে জবজব করছে। ছাতা এ সময় অপরিহার্য একটি বস্তু। মিঠেকড়া বা ঝাঁঝালো রোদ্দুর, কিংবা মুষলধারে বৃষ্টি, সব ক্ষেত্রেই তার ভারী আদর। কিন্তু বৃষ্টি শেষ হয়ে যাওয়ার পর বড় অবাঞ্ছিত সে। ভিজে ছাতার বুক নিংড়ানো কান্নায় সহযাত্রী অসন্তুষ্ট হয়। ছাতার মালিকের কাছেও সে হয়ে ওঠে বিরক্ত উদ্রেককারী জড়বস্তু। স্বার্থের পৃথিবীতে প্রয়োজন শেষে প্রিয়জনও হারায় গুরুত্ব...
ব্যস্ত শহর বৃষ্টিতে ভিজেও যেন ভিজছে না। অসহনীয় গরম ব্যারিকেড হয়ে ঘিরে রয়েছে মনুষ্যদেহ। গরমের তীব্র হাঁসফাঁসানির মাঝে কয়েক ফোঁটা শান্তি নামে মেঘের প্রাচীর ভেদ করে। বৃষ্টি ভিজে মানুষের বুকে সর্দি বসে যায়। যাক না! মধ্যরাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসাও অসম্ভব নয়। সে আসুক। রোগ-শোক-মৃত্যু অবধারিত জেনেও জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে হাসিমুখে উদযাপন করতে পারে ক'জন?
ধ্রুব পারে। বাসের ভিড় ঠেলে হাতঘড়ির দিকে চেয়ে অস্থির হয়ে পড়ল ধ্রুব। রাত বাড়ছে। বিবাহ বার্ষিকীর দিনেও অফিস থেকে ছুটি পাওয়া গেল না। তার ওপর বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। অবধারিত ভাবে মেঘ জমবে পাখির চোখের কোণে। অভিমানী বৃষ্টি নেমে আসাও অসম্ভব নয়।
বাস চলতে শুরু করতেই ধ্রুবর অপেক্ষার পালে বাতাস লাগে। তবুও সে ধৈর্য হারায় না। এ কেবল গাড়ির চাকা সচল হওয়ার অপেক্ষা নয়। এ অপেক্ষা ঘরে ফেরার। পাড়ার ফুলের দোকানটা খোলা থাকবে তো? পাপড়ি ঝরে যাওয়া অবহেলায় নুয়ে পড়া শেষ বাজারের একটা গোলাপ আর খোঁপায় দেওয়ার জন্য জুঁইফুলের মালা নিয়ে যদি ঘরে ফেরা যায়, তবে বোধহয় অর্ধাঙ্গিনীর সমস্ত রাগ গলে জল হয়ে যাবে।
ধ্রুবর ধূমপানের ইচ্ছে প্রবল হল। তারপরই ওর মুখে দেখা দিল চওড়া হাসি। সুখী দাম্পত্যের নিপাট সভ্য হাসি। পরিণয়ের আগে ফোনে যোগাযোগ ছিল ধ্রুব এবং পাখির। ধূমপানের কারণে অনেক অনুযোগ ভেসে আসত ফোনের অপরদিক থেকে। তখন ফোনের এপার থেকে গাঢ় কণ্ঠে ধ্রুব বলত, শাসন আর আদর দূর থেকে করতে নেই। কাছে এসে পাশে বসে হাতের ওপর হাত রেখে করতে হয়...
ধ্রুবর কথা রেখেছে পাখি। কাছে এসেছে সে। পাশে বসে শাসন আর আদর দুই-ই করেছে। তার আদুরে অত্যাচার থেকে ধ্রুবর পরিত্রাণ নেই। তবে আজ ইচ্ছাকৃত ধূমপানকে কেন্দ্র করে পাখির শাসন এবং দাম্পত্য কলহের মাত্রা পূর্বদিনের সমস্ত সীমা লঙ্ঘন করবে। নোনাজলে ভিজবে পাখির চোখ। রাগারাগি হবে, অভিমানের পারদ চড়বে। শীতল দাম্পত্যের শান্ত দীঘির মাঝে তুমুল জলঘূর্ণি সৃষ্টি হবে। পাখির নরম বুক অভিমানী উষ্ণতায় ফুলে-ফুলে উঠবে। তার পরের দৃশ্য কল্পনা করে বাসের ভিড়ের মধ্যে মিশে ধ্রুবর শিরদাঁড়া বেয়ে সুখী কামনার শিরশিরে কাঁপুনি চুঁইয়ে পড়ে। মধ্যবিত্তের বাসনা...
টিং!
মুঠোফোনের পর্দায় পরিচিত নম্বর থেকে ভেসে এসেছে বার্তা। "শুভ পরিণয়কে আমি সুখী পরিণতি ভেবে ভুল করেছিলাম।" মেসেজ দেখেও ধ্রুব প্রত্যুত্তর করল না। অপেক্ষার চেয়ে বড় শান্তি এবং শাস্তি আর কিছুতে নেই। ধ্রুব আজ পাখিকে খুব শাস্তি দেবে।
ধ্রুবর কল্পনায় পাখি এখন চুপটি করে বসে রয়েছে বিদ্যুতের তারের ওপর। ডানার ঝটপটানি গেছে থেমে। জলভরা মেঘ জমেছে ওর মনের আকাশে। রামধনুর অপেক্ষায়...
ডোরবেলের শব্দে ঘোর কাটে হেমাঙ্গিনীর। কাল্পনিক পৃথিবীর মোহ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে ওর বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগে। ততক্ষণে আরও বার দুয়েক ডোরবেল বেজেছে। সন্ধে থেকে রাত লিখতে লিখতে, রাত পেরিয়ে সকাল হয়ে গেছে। হেমাঙ্গিনী বুঝতে পারেনি।
ল্যাপটপ থেকে হাত সরিয়ে চশমাটা আলতোভাবে খুলল হেমাঙ্গিনী। তড়িঘড়ি দরজা খুলতেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করল দমকা বাতাস। সেই বাতাসের ঝাপটায় ফ্ল্যাটের নিরিবিলি পরিবেশ দামি পর্দার আড়ালে আলগোছে মুখ লুকোল। ঘরে ঢুকে কোমরে কাপড় গুঁজে কলকল করে বাতাসী বলল,
-কখন থেকে বেল বাজাচ্ছি। কানে কি তুলো গুঁজে রেখেছ দিদি?
-লিখছিলাম।
-অ! লিখছিলে? এত সকালে? তোমার চোখে ঘুম নেই? আবার তুমি না ঘুমিয়ে পড়ালেখা করছ?
-ঐ আর কী!
-রাত জেগে চেহারার কী অবস্থা করেছ! সে খেয়াল আছে? তোমার তো আবার ঐ যন্তরের সামনে বসলে জগতের কোথায় কী ঘটছে, সে হুঁশ থাকে না। সসপ্যানে বসানো দুধ পুড়ে ঝামা হয়। বালতি ভর্তি হয়ে জল উপচে পড়ে মেঝে ভাসে। বৃষ্টিতে শুকনো জামাকাপড় ভিজে সপসপে হয়। এমন তালকানা মানুষ জন্মে দেখিনি বাপু। শোনো, এ বেলা বলে রাখি...
অনিদ্রার কারণে হেমাঙ্গিনীর মাথা টলছিল। চোখ বেশ জ্বালা করছিল। বিছানা হাতড়ে ক্লিপ খুঁজে মাথার অবিন্যস্ত চুলগুলো বাঁধার সময় আচমকা পিছু ফিরল হেমাঙ্গিনী। চোখ পাকিয়ে সন্দেহের দৃষ্টিতে বাতাসীর দিকে চেয়ে বলল, "আবার ছুটি?"
সোফার তলা থেকে ঝাঁটা বের করে আহ্লাদে আটখানা হয়ে বাতাসী শ্রুতিমধুর কণ্ঠে আবদার করল,
-আজ বিকেলে কাজে আসব না দিদি। নাতি নিয়ে মেয়ে ঘরে আসবে। সিনেমার টিকিট কাটবে বলে রেখেছে। তিনটের শো। যেতি হবে। বোঝোই তো দিদি! মেয়ে আমার শ্বশুরবাড়ির ঘর করে। দজ্জাল শাশুড়ি মেয়েটাকে একেবারে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খেলে গো। মেয়েটা দু'দিনের জন্য বাপের ঘরে আসবে। একটু আমোদ করবে। তারপর আবার নরকে ফিরবে। এই দুটো দিন ওর কাছে না থাকলে হয়? ওকে কী পরাব? কী খাওয়াব...
-ঠিক আছে। কাল তাড়াতাড়ি আসবি।
-সে তোমায় বলতি হবে না দিদি। আমি কাল চোখদুটো মেলে আগে তোমার ফেলাডে...
-চা খাওয়াবি বাতাসী? পরে ঝাঁট দিস। আগে দু'কাপ চা কর।
ব্রাশ হাতে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হেমাঙ্গিনী বাইরের দিকে চাইল। কাচের ওপর এখনো বৃষ্টির ফোঁটা লেগে রয়েছে। আকাশের মুখ ঠিক পাখির বুকের মতোই ভার হয়েছে। সে রাতে পাড়ার মোড়ে ফুলের দোকানটা খোলা ছিল? ধ্রুব জুঁইফুলের মালা নিয়ে পাখির কাছে পৌঁছেছিল? কেমন কাটল তাদের মধুরাত? কিছুই জানা হল না। কিংবা হেমাঙ্গিনী সবই জানে। কেবল মানে না।
উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের বারান্দায় দুটো পাখি একে-অপরের গায়ে ঠোঁট ঘষে দিচ্ছে। দিনের আলোয় এমন ভালোবাসাবাসি মাখামাখি কেন? হেমাঙ্গিনী ঈর্ষাকাতর দৃষ্টিতে ওদের দিকে চেয়ে রইল। ওর বুকের ভিতর একাকীত্বের নিভৃতবাস।
গরম চায়ে চুমুক দিয়ে বাতাসী জিজ্ঞাসা করল,
-দিদি শুনেছ কিছু? ডাক্তারের বৌটার সঙ্গে একতলার ঐ ব্যায়াম শেখায় ছোকরার ঢলাঢলি চলছে। হবে না? বরটা দিনরাত রুগী দেখে বেড়ায়। একদণ্ড বাড়িতে থাকে নাকো। তা কচি বৌটার বা দোষ...
-মেয়ে বাড়িতে এলে তোর খুব মজা, বল বাতাসী?
-হ্যাঁ গো দিদি। নাতিটা বাড়ি মাথায় করে রাখে।
হেমাঙ্গিনীর মুখের মলিনতা বাতাসীর দৃষ্টি এড়ায়না। বোধহয় সকল শ্রেণির নারীর মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে সন্তানস্নেহ ঘুমিয়ে থাকে। মাতৃত্বের মাপকাঠিতে হেমাঙ্গিনী-বাতাসী মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সামাজিক দূরত্ব লঘু হয়। হেমাঙ্গিনীর নিস্পৃহ মুখ দেখে ওর মনের গভীরে ওঠা ঝড়ের আভাস বাতাসী পায় না। তবে হেমাঙ্গিনীর চোখের আয়নায় স্পষ্ট ধরা পড়ে উৎকণ্ঠামিশ্রিত হতাশা। বাতাসীর কণ্ঠে আশ্রয় নেয় সমবেদনা। "রিও কবে আসবে দিদি?"
হেমাঙ্গিনী প্রথমে উত্তর দেয় না। ধূমায়িত চায়ের দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ পর বলে, "ছুটি পেলে নিশ্চয়ই আসবে।"
হেমাঙ্গিনীর নিভে আসা কন্ঠস্বরে বাতাসী কথা হারায়। প্রতিবেশী ফ্ল্যাটের হাঁড়ির খবর অতিরিক্ত রঙয়ের প্রলেপ দিয়ে বলা হয় না। মেঝেতে বসে কার্পেটে আঙুল ঘষতে ঘষতে বাতাসীর ঠোঁটের কোণে হঠাৎ হাসি ফুটে ওঠে।
বাতাসী জানে হেমাঙ্গিনীর লেখাপড়ার সে কিছুই বোঝে না। তবুও হেমাঙ্গিনী নিজের লেখা গল্প বাতাসীকে শোনায়। সময়ে-অসময়ে গল্পের বিবিধ সম্ভবনা নিয়ে তার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করে। বাতাসীর স্বল্পবুদ্ধিতে যা মনে হয়, ও তাই অনর্গল বকবক করে যায়। বাতাসী বুঝতে পারে, তার পরামর্শ হেমাঙ্গিনীর কোনও কাজে লাগে না। তবে তার বাক্যের প্রাবল্যে মুখরিত হয়ে থাকা সময়টুকু নিঃসঙ্গ হেমাঙ্গিনীর একমাত্র সঙ্গী। বাতাসী জিজ্ঞাসা করে, "কাল রাত জেগে কী লিখলে? দু'চার পাতা শোনাও দেখি।"
বাতাসীর মনোভাব বুঝে হেমাঙ্গিনী রহস্য করে বলে,
-রাত জেগে রাত লিখেছি। রাতের পর সকাল খুঁজেছি। ভোরের নরম আলোয় পাখির গান শোনার আশায় চোখ মেলে, দিগন্তরেখায় মিলিয়ে যাওয়া দূরের পাখি দেখেছি...
-তোমার বাপু যতসব গোলমেলে কথা! কিছুই বুঝি না।
-থাক। আর বুঝে কাজ নেই। এবার নিজের কাজে হাত দে। বাড়ি ফিরে তোর আবার রান্না আছে না? যাওয়ার সময় টাকা নিয়ে যাস। নাতিকে কিছু কিনে দিবি। বলবি, দিদিমণি দিয়েছে।
আজ যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে গগনচুম্বী বহুতল, বছর দশেক আগে একাধিক বাড়ির সঙ্গে সেখানে ছিল একটি বিশেষ বহুতল এবং আভিজাত্যপূর্ণ বাড়ি। হেমেন্দ্রনারায়ণ নন্দীর নাম স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতিতে আজও স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করা রয়েছে। বাজারে তিনটি শাড়ির দোকান ছাড়াও নামে এবং বেনামে একাধিক দোকানের মালিক ছিল সে। স্বাভাবিকভাবে তার প্রতি সমিতির নীরব পক্ষপাতিত্ব ছিল। ফলস্বরূপ সে ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি পদ অলংকৃত করে বসেছিল। তবে তার কর্তৃত্ব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পর হেমাঙ্গিনী অথৈ জলে পড়ে। পরবর্তী সময়ে সমিতির সাহায্যে সহজেই ব্যবসার মালিকানা লাভ করে হেমাঙ্গিনী নন্দী।
জন্মের পর অধিক রক্তক্ষরণের ফলে জন্মদাত্রীকে হারিয়েছিল হেমাঙ্গিনী। স্ত্রীর মৃত্যুর পর হেমেন্দ্রনারায়ণ দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করেনি। একমাত্র কন্যার প্রতি অন্ধস্নেহের ফলে দ্বিতীয় কোনও নারীর অস্তিত্ব স্বীকার করতে তার মন সায় দেয়নি। একটি কন্যাসন্তানের জনক হওয়া সত্ত্বেও, শুধুমাত্র বৈষয়িক কারণে পাত্র হিসেবে হেমেন্দ্রনারায়ণের বাজারদর যে সে সময় তুঙ্গে ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাদের মাঝে দেখা গিয়েছিল তুমুল উৎসাহ। কিছু আত্মীয়-স্বজন দ্বিতীয় বিবাহের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে হেমেন্দ্রনারায়ণের চক্ষুশূল হয়েছে। মৃত্যুকালে রেখে যাওয়া দেবাঙ্গিনীর অপূর্ব সৃষ্টি হেমাঙ্গিনীকে বুকে আগলে সমগ্র জীবনকাল অতিবাহিত করে গেছে হেমেন্দ্রনারায়ণ।
সময় বদলেছে। পরিবর্তিত সময়কে সাদরে গ্রহণ করে জনমানবহীন পৈতৃক ভিটে প্রোমোটারের হাতে তুলে কয়েক বছর আগে হেমাঙ্গিনী উঠে এসেছে দু'কামরার এক টুকরো ফ্ল্যাটে। এই একই টাওয়ারে ওর আরও দুটি ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া আছে। অর্থের অভাব হেমাঙ্গিনীর অতীতে ছিল না, বর্তমানে নেই। ভবিষ্যতে হওয়ার তেমন জোরালো সম্ভবনা নেই। তা সত্ত্বেও ওর যে কী নেই, তা হেমাঙ্গিনী নিজের মনের ভিতর খুঁজে বেড়ায়...
ভালোবাসার উষ্ণতা ফুরিয়ে যাওয়ার পর যেমন স্মৃতির জেদি সর এঁটো মনে আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে থাকে, তেমন সর পড়েছে কাপের গায়ে। চক্ষুলজ্জার খাতিরে সেই সর আস্বাদন করা হয় না। যদি কেউ হা-ঘরে বলে বিদ্রুপ করে! যদি হ্যাংলামির প্রভাবে নষ্ট হয় উচ্চবিত্তের আভিজাত্য! সেই দুঃসাহস থাকলে হেমাঙ্গিনী কি কাপের সরটুকু চেটেপুটে খেয়ে ফেলত না?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারান্দা থেকে বাইরের দিকে চাইল হেমাঙ্গিনী। পাখিদুটো উড়ে গেছে। হয়তো ওরা লোকচক্ষুর আড়ালে পরস্পরকে এঁটো করতে গেছে। বাতাসী ডাকছে। রান্নার জোগাড় করবে। কী রান্না করবে, তাও হেমাঙ্গিনীকেই বলে দিতে হবে। উদর বড় বিড়ম্বনা!
হেমাঙ্গিনীর মন প্রাণপণে এঁটো হতে চায়। অজ্ঞাতবাসে যেতে চায়। কাপের সর পড়া চা হয়ে ঘুম ভাঙাতে চায় কোনও একজনের। জানালায় ফুড়ুৎ করে উড়ে বেড়ানো পাখির গান শুনতে চায়। কিন্তু সে কথা মুখ ফুটে প্রকাশ্যে বলা যায় না। বাতাসীকেও জানানো যায় না। ওকে কেবল রহস্য করে বলা যায়.... রাত জেগে রাত লিখি। বাতাসীকে যদি ভুলক্রমে বলে; হেমাঙ্গিনী এঁটো হয়ে বাঁচতে চায়, তবে ও নির্ঘাৎ এঁটো বাসন সিঙ্কে ফেলে পালাবে।
আপনমনে হেসে ওঠে হেমাঙ্গিনী। মধ্যরাতের বৃষ্টিসিক্ত বাসনা সকালের প্রখর তাপে ভস্মীভূত হয়ে যায়। জগতের যা কিছু নিষিদ্ধ, তা রাতের অন্ধকারে মান্যতা পায়। দিনের আলোয় তার বৈধতা নেই। দিনের বেলা হেমাঙ্গিনী হল হেমেন্দ্রনারায়ণের মতো একজন তুখোড় ব্যবসায়ীর উপযুক্ত কন্যা। দেবতনুর প্রাক্তন স্ত্রী, বাতাসীর দিদিমণি এবং রিওর মা। সর্বোপরি সে একজন চল্লিশোর্ধা নারী। এই তার একমাত্র পরিচয়।
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত

রবিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৪

খিল দশম পর্ব


 


খিল
সাথী দাস
দশম পর্ব



দুপুর দেড়টার সময় অঙ্কন ও উত্তরার সঙ্গে এক শহুরে রেঁস্তোরায় মধ্যাহ্নভোজন সেরে আবার গাড়িতে বসে যখন আহ্লাদী আবাসনে পৌঁছল, তখন ওর সর্বাঙ্গ ধুলোয় কিচকিচ করছে। স্নান করার জন্য আহ্লাদী মনে মনে উতলা হয়ে পড়লেও, বাইরে তা প্রকাশ করল না। গাড়িটা গতি কমিয়ে পার্কিংয়ের জন্য নির্ধারিত স্থানে ঢুকে পড়ল। একটা ব্যাগ আহ্লাদীর হাতে ধরিয়ে নিজে একটা ট্রলি টেনে উত্তরা বকবক করতে করতে এগিয়ে গেল লিফটের দিকে। উত্তরার অনর্গল কথাবার্তায় আহ্লাদী তেমন উৎসাহ না দেখালেও, নীরব শ্রোতা হিসেবে ওর মন্দ লাগছিল না। লিফটের দরজা খুলতেই উত্তরা হাসিমুখে বলল,
-সেনদা! ভালো আছেন? জ্যেঠু কেমন আছেন?
অঙ্কন পিঠে ও হাতে ব্যাগ নিয়ে পৌঁছেছিল লিফটের কাছে। নেহাৎ প্রতিবেশী না হলেও একই আবাসনের বাসিন্দা হওয়ার সূত্রে সেন পরিবারের সঙ্গে অঙ্কন ও উত্তরার বেশ ঘনিষ্ঠতা আছে। সর্বোপরি উত্তরার বাবা এবং অমিতাভ সেন একই অফিসে কর্মরত হওয়ায় দীর্ঘকালীন পরিচয়ে দুই পরিবারের মধ্যে বেশ হৃদ্যতা বর্তমান। অমিতাভ বাবু ও তার জ্যেষ্ঠ পুত্র অমিয় কয়েক মাস আগে এই আবাসনে মুখোমুখি দুটো ফ্ল্যাট কিনে ভাড়াবাড়ির মায়া কাটিয়ে উঠে এসেছেন নিজ আলয়ে।
অমিতাভ সেনের জ্যেষ্ঠ পুত্র অমিয় সেন এবং সর্বকনিষ্ঠ পুত্র আর্য সেনকে দেখে উত্তরা দাঁড়িয়ে পড়েছিল। লিফটের দরজা খোলার পর হঠাৎই উত্তরাকে দেখে খানিক চমকে উঠে অমিয় বলল,
-আরে উত্তরা যে! এই ফিরলে?
-হ্যাঁ দাদা।
-আচ্ছা আচ্ছা। বাবা ভালো আছেন। মাঝে সুগারটা হাই হওয়াতে শরীর খারাপ হয়েছিল, এখন স্টেবল। এবার তোমাদের একটু বেশি ছুটি হয়ে গেল মনে হয়। ঠিক বললাম তো অঙ্কন?
অঙ্কন এগিয়ে এসে অমিয়র সঙ্গে হাত মিলিয়ে বলল,
-হ্যাঁ দাদা। এবার বাড়িতে কিছু কাজ ছিল। বেশিদিনের জন্য আটকে পড়েছিলাম।
-বোনের দেখাশোনার জন্য যাবে বলেছিলে। তা বিয়ের কথাবার্তা কিছু এগোল? বাড়িতে বিয়ে লাগলে বাড়ির ছেলের দায়িত্বও কিছু কম নয়...
আহ্লাদী মাথা নামিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। উত্তরা ভাবলেশহীন। অঙ্কন একটু ইতস্ততঃ করে বলল,
-এখনো কিছু ফাইনাল হয়নি। ওরা দেখে গেছে। ছেলের বাড়ি থেকে জানাবে বলেছে...
অঙ্কনের ইচ্ছাকৃত মিথ্যের প্রভাবে যে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হল, তা উত্তরার কাছে ক্রমে অসহ্য হয়ে উঠল। ও নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে দিল,
-দাদা আমাদের বাড়ি থেকেও ছেলেকে তেমন পছন্দ নয়। তারা হ্যাঁ বললেও, আমরা এগোব না। আমাদের দিক থেকে ও সম্বন্ধ একরকম ভেঙে গেছে বলা যায়। আমরা ওসব ব্যাপারেই আটকে গিয়েছিলাম।
উন্মুক্ত লিফট অঙ্কনদের জন্য অপেক্ষা করলেও, প্রতিবেশীর সঙ্গে কিঞ্চিৎ সৌজন্য বিনিময়ের স্বার্থে অঙ্কন দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আহ্লাদীকে সাক্ষী রেখে তারই বিয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করাটা যেন বড় বেমানান ও অস্বস্তিকর। বিয়ের প্রসঙ্গ থেকে রেহাই পেতে আর্যর দিকে চেয়ে অঙ্কন জিজ্ঞাসা করল,
-কলেজে যাচ্ছ আর্য?
-হ্যাঁ অঙ্কনদা, এই বেরোচ্ছি। দাদা আজ অফিস যাওয়ার সময় ড্রপ করে দেবে বলল।
-তোমরা প্লিজ ওপরে যাও। ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও। ভীষণ টায়ার্ড লাগছে তোমাদের।
-হ্যাঁ সেনদা। আজ অনেক ভোরে উঠেছি, তারপর আবার এতটা পথ ড্রাইভ করে আসা.... শরীর সত্যিই আর চলছে না। আজকের দিনটা রেস্ট নিয়ে ধকল সামলে কাল থেকে আবার গলায় দড়ি ঝুলিয়ে অফিস শুরু...
-গলায় দড়ি! হা হা হা! তা বেশ বলেছ। কর্পোরেট সেক্টরগুলোর যা অবস্থা, গলায় দড়িই বটে! আচ্ছা এই মেয়েটিকে তো ঠিক...
-সেনদা ও আমার ননদ, আ... মণিকঙ্কনা।
অঙ্কনের ভ্রূ কুঁচকে গেল। আহ্লাদীর যে এমন একটি বাহারি নাম আছে, তা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছিল বহুকাল আগে। উত্তরার মুখ থেকে হঠাৎ ঐ নাম শুনে হকচকিয়ে গেল অঙ্কন। চিরাচরিত চেনা নামটা বদলে যেতেই কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকল অঙ্কনের কানে। কিন্তু ও কিছু বলল না। অমিয় কণ্ঠে একরাশ বিস্ময় এঁকে বলল,
-তোমার ননদ! মানে এই মেয়েরই বিয়ের কথা চলছিল?
-হ্যাঁ দাদা। এরই বিয়ের কথা চলছিল, এরই সম্বন্ধ ভেঙে গেছে বলতে পারেন। আমরা ঐ সম্বন্ধে রাজি নই।
সামান্য সময়ের ব্যবধানে বুকে ব্যাগ আঁকড়ে মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে বারকয়েক আড়চোখে চেয়েছিল কলেজ পড়ুয়া আর্য। এখন বিয়ে ভাঙার প্রসঙ্গ কানে যেতেই চমৎকৃত হয়ে আহ্লাদীর দিকে একবার স্পষ্টভাবে চাইল সে।
মেয়েটির পরনের আকাশনীল চুড়িদারের ওপর সাদা সুতোর অভিনব নকশা বেশ অর্থ ও আভিজাত্যের চিহ্ন বহন করে। তবে তার দৈহিক ভাষায় কেমন যেন গ্রাম্য ছাপ সুস্পষ্ট। কতই বা বয়স হবে মেয়েটির! সতেরো? বড়জোর আঠেরো! এর বেশি হবে না বোধহয়। মেয়েটিকে প্রায় আর্যরই সমবয়সী বলা চলে। আর্য বুঝতে পারল না, এত তাড়াতাড়ি একটি মেয়ের বিয়ের কথা তার পরিবার কিভাবে ভাবতে পারে! তাও আবার অঙ্কন দাদার মতো উদার স্বাধীনচেতা মুক্তমনা মানুষের পরিবার! এর মধ্যে বিয়ে ঠিক হয়ে আবার ভেঙেও গেছে! আর্যর ভাবনার মাঝে অঙ্কনের থেকে বিদায় নিয়ে অমিয় এগিয়ে গেছে পার্কিংয়ের দিকে। অগত্যা আর্যকেও দৃষ্টিসুখের মায়া কাটিয়ে এগোতে হল।
ঘরের চার দেওয়ালের বাইরে পরস্পরের প্রতি নূন্যতম সম্মান দেখিয়ে যথেষ্ট সদ্ভাব বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও, অঙ্কন জানে পারিবারিক অশান্তিকে কেন্দ্র করে দাম্পত্য জীবনের ছন্দপতন হয়েছে। যদিও চার দেওয়ালের বাইরে কেউ তা বিন্দুমাত্র জানে না। কেবল অঙ্কনই জানে লোকচক্ষু থেকে আড়াল করে রাখা উত্তরার ব্যক্তিত্ব কতখানি সত্যি, আর প্রকাশ্যে সত্যি হিসেবে সাজিয়ে রাখা গাম্ভীর্য কতখানি ঠুনকো। প্রিয় মানুষের সবটা জেনে গেলে বোঝা যায়, সে সম্পূর্ণ সত্যি নয়। তার অভিব্যক্তি খানিক মেকি, খানিক নিছকই অভিনয়। তবে সান্ত্বনা কেবল একটাই, মানুষটা তার কাছে নিজেকে লুকিয়ে রাখেনি। সর্বাঙ্গীনভাবে উন্মুক্ত করেছে। সেই কারণে অঙ্কন সহজে উত্তরার মনের তল পেতে পারে।
অস্থায়ী বিবাদের কারণে দাম্পত্য আলাপের মাঝে যে অভিমান স্থান পেয়েছে, সেই সকল দূরত্ব ঘুচিয়ে নিতে অঙ্কন মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু গ্রামের বাড়িতে সে সুযোগ তেমনভাবে না থাকায় আজকের রাতটা ওর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সমস্ত দিন কোনোক্রমে কাটানোর পর রাতে যখন উন্মুক্ত কেশবিন্যাস ও রাত্রিকালীন রূপচর্চা সেরে উত্তরা বালিশ নিয়ে পাশের ঘরে যাওয়ার উদ্যোগ নিল, একলাফে বিছানা ছেড়ে উঠে এসে অঙ্কন বলল,
-ব্যাপার কী? গুছিয়ে বালিশ চাদর সব বগলে চেপে কোথায় চললে তুমি?
-ও ঘরে শুতে যাচ্ছি। নতুন জায়গা। আহ্লাদীর ঘুম আসবে না। অভ্যাস হতে দু-একদিন সময় লাগবে। ওখানে মায়ের সঙ্গে ঘুমাত। এখানে প্রথম কয়েকটা দিন আমার সঙ্গে...
ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে অঙ্কন বলল,
-ও বাচ্চা মেয়ে নয়, যে একা শুতে ভয় পাবে। তাছাড়া তুমি কেন ও ঘরে যেতে চাইছ, আমি খুব জানি।
-জানো যখন এত রাতে সময় নষ্ট করার কোনও দরকার নেই। সরো। আমার ঘুম পাচ্ছে। কাল অফিস আছে। ঘুম কমপ্লিট না হলে প্রবলেম হবে।
উত্তরার হাত থেকে বালিশটা কেড়ে নিয়ে অঙ্কন বলল,
-আমার সঙ্গে কেন এইরকম করছ? বড়দা তোমার গায়ে হাত তুলতে গেছে, বড় বৌদি তোমাকে এত কথা শুনিয়েছে, সবকিছুর জন্য আমি তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি। আর কী করব?
-আমাকে ঘুমাতে দেবে।
-দেব না।
-ধুর.... এ তো মহাজ্বালা!
বিছানায় ঝাঁপিয়ে শুয়ে চাদরের তলায় হারিয়ে গেল উত্তরা। অঙ্কন নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে চাদর নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ টানাটানি করার পর খানিকটা চাদরের ভাগ পেল। অভিমানে শক্ত হয়ে থাকা উত্তরাকে জড়িয়ে ধরে ওর মাথায় হাত রেখে বলল,
-বাবা-মাকে জানালে তোমার শান্তি হবে? তবে তাই জানাও। তাঁদের কাছেও আমি ক্ষমা চেয়ে নেব।
-সেদিন তো খুব বলছিলে, দাদার কাছে ক্ষমা চেয়ে নাও। এখন নিজে ক্ষমা চাওয়ার জন্য মরিয়া কেন? প্রয়োজনের সময় যদি বৌয়ের পাশে দাঁড়াতেই না পারো, বদ্ধ ঘরে ঐরকম শুকনো ভালোবাসা দিয়ে উত্তরার মনের চিঁড়ে ভিজবে না।
-তুমিও আমার, বাড়ির লোকও আমার। কাকে কী বলি বলো তো? বড়দার মুখের দিকে চেয়ে আমি কোনোদিন কথা বলিনি। সবসময় মাথা নামিয়ে কথা বলি। তার মুখের ওপর কথা বলব? সেখানেও সবাই তোমাকে দোষ দেবে। বলবে, বিয়ের পর আমার এমন অধঃপতন হয়েছে। সেটা শুনতে আমার ভালো লাগবে না।
-তাই তো! সেই জন্য বাইরে ভারী পুরুষ সিংহ সেজে বৌকে ক্ষমা চাইতে ব'লে, ঘরের ভিতরে এসে নিজে ক্ষমা চেয়ে উদ্ধার করছ আমাকে। সরে যাও। ঘুমোতে দাও।
-ঠিক আছে। তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না তো? তবে বাবা-মাকে ডাকো। তাঁদের মেয়ের অপমানের জন্য আমি না হয় তাঁদের কাছেই...
-কোথায় কোন কথা বলতে হয়, আর কোন কথা হজম করতে হয়, সে আমি খুব জানি। খুব বুঝি...
-কিচ্ছু জানো না, বোঝো না। সব একা হজম করতে চেয়ে তোমার বদহজম হয়ে গেছে। সেদিন থেকে কথা বন্ধ করে দিয়েছ। মুখে যেন অমাবস্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। সংসারের সবার সঙ্গে এত খাতির, এত হেসে হেসে গল্প, কেবল আমার কাছে এলেই মুখ বেজার হয়ে আছে।
-কারণ তোমার কাছেই আশাটা সবচেয়ে বেশি করি। তাই তোমার দেওয়া সামান্য কষ্টও অনেক মনে হয়।
-আর আমার কষ্ট? আমি যে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না, তুমি বুঝতে পারো সেটা? তোমার কোন আশা আমি অপূর্ণ রেখেছি? বলো আমাকে...
-থাক, সে বলে লাভ নেই। বৌয়ের হয়ে চারটে কথা বলতে হলে ঘরের বাইরেও বলার চেষ্টা করবে। ঐ ঘরে আগল দিয়ে দুটো ভালোবাসার কথা বললেই ভালোবাসা যায় না। সেই যে, বিয়ের আগে.... বাপ রে বাপ! কী না করত আমার জন্য! কারও আর জানতে বাকি নেই উনি আমাকে ভালোবাসেন! উত্তরা উত্তরা করে যেন একেবারে পাগল হয়ে গেছেন! যত্নের ঠেলায় মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। তখন মনে হতো, এ তো মানুষের সঙ্গে প্রেম করছি না, যেন সাক্ষাৎ ভগবান!
-তখন যত্ন করতাম, এখন আমি তোমার অযত্ন করি? তুমি এই কথাটা বলতে পারলে উত্তরা?
-অঙ্কন ঘুমাতে দেবে? না মার খাবে? ছাড়ো, দম আটকে আসছে...
-তোমাকে ঘুমোতে দেওয়ার থেকে সেকেন্ড অপশনটা বেটার।
-ওহ ভগবান! জ্বালিয়ে খেলো!
-আমিই তো ভগবান! একটু আগে বললে যে সাক্ষাৎ ভগবানের সঙ্গে প্রেম করেছ। জ্বালিয়ে খেলাম মানে কী? খাওয়ার সুযোগ পেলাম কোথায়? তা ভগবানকে যখন এত মন দিয়ে ডাকাডাকি করছ, সে কি আর সাড়া না দিয়ে থাকতে পারে! তার ধ্যান ভাঙতে বাধ্য! ভগবান হাজির! তোমার ভগবানকে তুষ্ট করার জন্য তুমি প্রস্তুত তো? উম...
অঙ্কনের অস্থির হস্ত সঞ্চালনের ফলে চাপা হাসিতে ফেটে পড়ল উত্তরা। ওর পাগলামো সামলাতে না পেরে উত্তরা অঙ্কনের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
-অঙ্কন প্লিজ...
-উফ! কেন? প্রত্যেকবার এভাবে বাধা দাও কেন? সমস্যাটা কী? তুমি চাও না?
-চাই, কিন্তু এখনই না.... আমি তৈরি না অঙ্কন। প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো। এক কথা কতবার বলব?
-আর কত বছর লাগবে তোমার নিজেকে তৈরি করতে? মা হতে গেলে এত রিহার্সাল দিয়ে তৈরি হতে হয় বুঝি? তাকে একবার আসতে দাও। সে তোমার কোলে এলে তুমি সবকিছু নিজে থেকে শিখে যাবে। কোনও মেয়েকে মাতৃত্ব শেখাতে হয়?
উত্তরা চুপ করে রইল। অঙ্কন আদরমাখা কণ্ঠে বলল,
-সবসময় তোমার সঙ্গে আমি আছি, তোমার মা আছেন। কিচ্ছু অসুবিধা হবে না। প্লিজ উত্তরা.... আমি খুব ডেসপারেটলি চাই, আমাদের মধ্যে সে আসুক। প্লিজ...
উত্তরার দেহের প্রতিটি বাঁকের মতো এই স্তব্ধতার অর্থ অঙ্কন খুব ভালোভাবে বোঝে। ও আর কিছু বলল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তরার ঠোঁটে গভীরভাবে চুমু খেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে ড্রয়ার খুলল...
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত এবং প্রতীকী

খিল নবম পর্ব


 


খিল
সাথী দাস
নবম পর্ব


নাগের বাড়ির অন্দরমহলের বর্তমান উত্থান-পতন তিনজন মানুষকে একেবারেই স্পর্শ করতে পারে না। প্রথমজন হল টুয়া। সে মহানন্দে স্কুলে যায়-আসে, ছবি আঁকার ক্লাসে যায়। জীবনের যত রঙ সব ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে খাতায় আঁকা রামধনু কিংবা আকাশের গায়ে। ছাত্রজীবনের যত ব্যস্ততা সব অতিক্রম করার পর, টুয়ার অবসর সময় কাটে আহ্লাদী আর কাম্মার সঙ্গে। সোনাপিসির বিয়ে ভেঙে যাওয়াতে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে টুয়া। পিসি যে আরও কিছুদিনের জন্য নাগের বাড়ির সদস্যা হয়ে থাকতে চলেছে, এটা ভেবেই সে মহা পুলকিত চিত্তে বাড়িময় আস্ফালন করে বেড়ায়। নিভৃতে উত্তরার গলা জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করে, "সোনাপিসির বিয়ে দিতেই হবে কাম্মা?" উত্তরা এ প্রশ্নের কোনো জুতসই উত্তর দিতে পারে না। প্রতিরাতে অঙ্কনের দেহের সঙ্গে মিশে যাওয়ার সময় ও অনুভব করতে পারে বিবাহের নিদারুণ সুখ।
ভাতৃবিবাদ ও সাংসারিক ডামাডোলের থেকে বহুদূরে উত্তরার অবস্থান। সময়কালে বাক্যের অগ্নিশলাকায় মানুষকে ক্রমাগত বিদ্ধ করার পর, নিতান্তই মূক ও বধির হয়ে যাওয়ার মতো ঐশ্বরিক ক্ষমতা তার মধ্যে বিদ্যমান। শশাঙ্ক উপযাচক হয়ে উত্তরার যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও, নিতান্ত ঠান্ডা লড়াইতে অঙ্কনের সহযোদ্ধা হয়েছিল। মৃগাঙ্কর সঙ্গে দুই ভাইয়ের বাক্যালাপ ও বাদানুবাদ বন্ধ। রান্নাঘরে তৃণার বাক্য নিষ্পেশন বাসনপত্রের ঘর্ষণের চেয়েও অধিক শব্দের জন্ম দেয়। কেবল নিধির মুখে কোনও কথা নেই। মন অত্যন্ত আহ্লাদিত হলে পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রাণকে ছুঁতে পারে না। একনিষ্ঠভাবে সংসারের যাবতীয় কাজ সেরে টুয়াকে নিয়ে ঘরের দোরে খিল এঁটে সে বসে থাকে।
তবে যাকে নিয়ে সংসারে এত গোলযোগ, সেই আহ্লাদীর মতো সুখী মানুষ পৃথিবীতে দুটি নেই। চিলেকোঠার ঘরের খাটের তলায় একটা ছোট পাটের ব্যাগে দুটো চুড়িদার ভাঁজ করে রাখা আছে। সেই সঙ্গে প্রতিবার আয়না দেখার সময় কানের দুলজোড়া, গলার ভারি চেন, হিরের নাকফুল আর আঙুলের তিনটে আংটির দিকে জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে চেয়ে সে নিশ্চিন্ত হয়।
বাড়ির লোক নাকি আহ্লাদীর বিয়ে দেবে! নেহাৎ ছোট বৌদিদি এই বিয়ে ভেঙে দিল। অবশ্য বিয়ে ভেঙে না গেলেও আহ্লাদীর বিশেষ দুশ্চিন্তা ছিল না। এই পাত্রের সঙ্গে হোক, অথবা অন্য কোনও পাত্র.... সবাই মনের আনন্দে করুক না বিয়ের আয়োজন! কিন্তু কনে ছাড়া কি বিয়ে হয়! সময়কালে আহ্লাদীকে কেউ খুঁজে পেলে তো বিয়েটা হবে! বাড়ির লোক যখন সুসজ্জিত পিঁড়ি নিয়ে ওর ঘরে ঢুকবে, তখন উপহার পাবে একগাল মাছি! পরনের শাড়ি-গয়না নিয়ে আহ্লাদী ততক্ষণে বর্তমান প্রেমিকের হাত ধরে পাড়ি দিয়েছে তেপান্তরে। চিলেকোঠার অন্ধকার ঘরে একা শুয়ে বহুবার এই দৃশ্য কল্পনা করে আহ্লাদী অফুরন্ত আনন্দ পেয়ে হেসে উঠেছে নিঃশব্দে।
সময়টা সন্ধেবেলা, নিধির মন বেশ খারাপ। উত্তরার ফিরে যাওয়ার সময় হল। অফিস থেকে আর ছুটি পাওয়া যাবে না। অঙ্কনও ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিকেলবেলা উত্তরা একাই বেরিয়ে পড়েছিল রেলগেট সংলগ্ন বাজারের দিকে। ঘুরে-ঘুরে বাড়ির সকলের জন্য নিজ হাতে অল্পবিস্তর কেনাকাটা করেছে। টুয়াকে আদর করে নতুন জামা ও চকোলেট উপহার দিয়ে খুব খানিক আদর করে দিল উত্তরা। নিধি ধুনুচি হাতে নিয়ে হাসিমুখে ঘরে ঢুকে বলল,
-ও মা ছোট! তুই কখন এলি?
-এই তো মেজদিভাই! সবে এলাম।
-মা দেখো.... কাম্মা আমার জন্য কত খেলনা, নতুন জামা, ক্যাডবেরি এনেছে। এই দেখো ছবি আঁকার নতুন খাতা আর রঙ পেন্সিল.... দেখবে এসো না মা...
-দাঁড়া টুয়া, বিছানায় বসে আমাকে ছুঁয়ে দিস না। সন্ধে দিচ্ছি দেখতে পাচ্ছিস না? তুই করেছিস কী ছোট! সারা খাটের ওপর জিনিসপত্র ছড়িয়ে রেখেছিস! এত টাকা নষ্ট করলি!
-ও কিছু না দিদি। সব তোমাদের না। বাড়ির সবার জন্যই কমবেশি জিনিস আছে। তুমি তাড়াতাড়ি সন্ধে দিয়ে এসো। তোমার জন্যও একটা জিনিস আছে। দেখো দেখি, পছন্দ হয় কিনা!
ঘরময় ঘুরে বাতাসে ভাসমান ধোঁয়ার যাত্রাপথ হাত দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে করতে নিধি বলল,
-হ্যাঁ রে, ঠাকুরপো তোর সঙ্গে যায়নি? দেখলাম বাইকে চেপে ও বাড়ির অবন দাদাভাইয়ের সঙ্গে ঘুরছে। ভাবলাম তুই মাইমা'র বাড়ি গেছিস বুঝি।
-না, ও যায়নি। আমি একাই গেছি। ও কোথায় গেছে আমি জানি না।
-এ কী কথা!
-কেন একা যেতে পারি না? আমি কি বাচ্চা মেয়ে নাকি? সবসময় সঙ্গ না হলে চলতে পারব না! হাত ধরে রাস্তা পার করিয়ে দিতে হবে?
-নাঃ! বাচ্চা না, তুই একেবারে বুড়ি। তা বুড়ি হয়ে যাচ্ছিস ব'লে কি নিজের বুড়োটা কোথায় যাচ্ছে, সেই খবরটুকুও রাখবি না? সে দেখি তোকে একেবারে চোখে হারায়! তা ছোট ঠাকুরপোর দোষ দিই কী করে বল! হাজার হোক পুরুষ মানুষ তো! বৌয়ের অমন মাথা ঘুরোনো রূপ থাকলে, সে বেচারা আর কী করবে!
মুখ ফিরিয়ে ফিক করে মৃদু হাসল উত্তরা। নিধিও হাসিমুখে বলল,
-আচ্ছা তুই বোস। ঘর ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে। আমি মায়ের ঘর আর বারান্দায় ধোঁয়া দেখিয়ে শঙ্খতে একটু ফুঁ মেরে আসছি।
-মেজদিভাই চা খাওয়াবে একটু? মাথাটা ধরে আছে। সেই বিকেলে বেরিয়েছি।
-আনছি...
নতুন খাতার ওপর নতুন রঙ পেন্সিল নিয়ে উপুড় হয়ে পড়েছে টুয়া। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে উত্তরা জিজ্ঞাসা করল,
-মাকে চা দিয়েছ মেজদিভাই?
-হ্যাঁ রে, দিয়েই ঘরে এলাম। চা নিয়ে বড়দির ঘরের দোরে ধাক্কা দিলাম। খুলল না। এখন সে দরকার ছাড়া নিচে নামে না। কথাও বলে না। দাদাভাই আপিসে যাওয়ার সময় আমাদের মুখ দেখলে ভাবখানা এমন করে, যেন আমরা অযাত্রা! মুখে একটা কথা পর্যন্ত নেই।
-ছাড়ো না.... ক'দিন পর এসব ঠিক হয়ে যাবে। আহ্লাদীর জীবন তো বাঁচল। মেয়েটার জীবন নষ্ট হওয়ার থেকে, এ অনেক ভালো। তুমি চা খাও! এত বেশি ভেবো না।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নিধি বলল,
-ভেবো না বললে কি আর ভাবনা আমাকে ছাড়ে রে? এতদিন একরকম ছিল। এবার তুই চলে যাবি, তারপর আবার কোন মূর্তি ধারণ করবে কে জানে বাপু! তুই কিছু মনে করিস না ভাই!
-কী ব্যাপারে বলো তো?
-এই যে, আহ্লাদীর বিয়ে ভাঙার ব্যাপারে তোকে কত অপমানিত হতে হল! নেহাৎ মা এসে সেদিন কেঁদেকেটে পড়ল ব'লে তাই রক্ষে.... ছোট ঠাকুরপো চিৎকার করে বড়দাভাইয়ের হাত টেনে না ধরলে, বড়দাভাই তো তোর গায়ে হাত তোলার জন্য সিঁড়ি পর্যন্ত দৌড়ে গিয়েছিল। কতবড় সাহস একবার চিন্তা করে দেখ!
-তোমরা বৃথাই এত চিৎকার করলে! আমাকে একবারও ভয় পেতে দেখেছ? আমি তো সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। ঐ হাত একটিবার শুধু আমার গালে এসে পড়ত, তারপর বধূ নির্যাতনের দায়ে বাড়িতে পুলিশ ডেকে এনে কোমরে দড়ি পরিয়ে কিভাবে ঘর থেকে টেনে বের করতে হয়, সে আমিও জানি। তাঁকে দাদাভাই ডাকতাম। সেই জায়গা তিনি নিজেই নষ্ট করেছেন। এখন আমারও তাঁকে সম্মান করার কোনও দায় নেই। ভাইয়ের বৌয়ের গায়ে হাত তোলা! তাঁর সরকারি চাকরি কিভাবে খেতে হয়, সে আমিও খুব ভালো জানি। আমার বাবা যে সে মানুষ নয়! তাঁর মেয়ের গায়ে হাত তুলে কেউ পার পাবে না।
-তোর ভাই নিজের টাকার জোর আছে, বাপের ঘরের জোর আছে। তার ওপর তোরা এখানে থাকিসও না। ছোট ঠাকুরপোর পায়ের তলার মাটি শক্ত। তোরা কারও পরোয়া করিস না। তাও তোদের সঙ্গে কেমনধারা ব্যবহারখানা করল দেখলি! তবেই বুঝে দ্যাখ, আমাদের সঙ্গে কী করে! ঘরে ওঁর বৌ করে আমার সঙ্গে। বাইরে ওঁর বর আমাদের ঘরের লোকটার মাথার ওপর পা তুলে চলে! ভয়ে আমি দিনরাত সিঁটিয়ে থাকি। মেয়েটাকে তো মানুষ করতে হবে বল! সে তার মেজ ভাইকে তাড়িয়ে দিলে মেয়েকে নিয়ে কোথায় দাঁড়াব আমি?
-উঁহ.... বললেই হল নাকি! তাড়িয়ে দেবে? দেশে আইন-কানুন কিছু নেই? নাগের বাড়িতে বড়দাভাইয়ের যা অধিকার, মেজদাভাইয়ের যা অধিকার, আমার বরেরও তাই অধিকার। চূর্ণী দি আর আহ্লাদীও সেই একই অধিকার দাবি করবে। তাঁর একার কথায় কিছু হবে নাকি? তেমন কিছু বললে আমাকে একটা ফোন করবে। উকিল নিয়ে এসে সব ভাগ করে দেব উঠোনের মধ্যিখানে দেওয়াল তুলে। উচিত কথা ব'লে ছোট বৌ এমনিতেই খারাপ! এবার উচিত কাজ করে সারাজীবনের মতো খারাপ হোক!
-ও বাবা! একবার ঝগড়ার সময় বিষয় ভিন্ন করার কথা উঠতেই বড়দাভাই বলে কিনা, সম্পত্তি তার হাতে রয়েছে বলেই চোখে দেখা যাচ্ছে। ভাগ করলে নাকি বারো ভূতে লুটে খাবে! সবাই সম্পত্তি নষ্ট করে ফেলবে।
-হ্যাঁ সেই। আপন ভালো পাগলেও বোঝে। একবার ভাগ করেই দেখুক না! কে রাখে আর কে নষ্ট করে! আসলে ভাগ করে দিলে তাঁর দাপট কমে যাবে তো! কেউ তখন এত মান দেবে না! যে যারটা বুঝে নিয়ে সরে পড়বে। সবকিছুর সর্বেসর্বা হয়ে বসে থাকার ফিকির ওসব। আমাকে বোকা বানাবে! মানুষ চেনা হয়ে গেছে এই ক'দিনে। আগে খুব ভালো ভাবতাম! এখন দেখি ও বাবা! নামেই নাগের বাড়ি! নামেই বনেদি বাড়ি! ঐ ওপরেই খালি আভিজাত্যের চাকন-চিকন! ভিতরে সবই আস্তাকুঁড়ের ছুঁচোর কেত্তন!
-এই নিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলতে হয় ভাই। আমার বাপের ঘরের অবস্থা তুই সবই জানিস।
তাদেরই নুন আনতে পান্তা ফুরোয়! হঠাৎ মাথা গরম করে চারটে ছোট-বড় কথা শুনিয়ে তাড়িয়ে দিলে, আমি তিনটে বাড়তি পেট নিয়ে কোথায় ঠেলে উঠব বল দেখি! সেই ভয়ে মুখ খুলি না। জলে থেকে কি আর কুমিরের সঙ্গে লড়াই করা যায় রে বোন? তুই আজ বাদে কাল চলে যাবি। ওর কথা শুনতেও আসবি না। কিন্তু আমাকে এখানে থাকতে হবে। তোদের হয়ে আমি আর আমাদের ঘরের লোকটা সেভাবে জোর দিয়ে কিছু বলতে পারলাম না। তুই যেন রাগ করিস না ভাই।
-কী যে বলো তুমি! সেদিন রাতে আমি বলার আগেও তুমি আমার ঘরে এসে বলেছ। এই বা কম কী? উত্তরার জিভে এখনো মরচে ধরেনি। সে নিজের কথা গুছিয়ে খুব ভালোভাবে বলতে পারে। তুমি বলো দেখি, শাড়িখানা পছন্দ হল? পাঞ্জাবিটা মেজদাভাইয়ের হবে তো? আমি আন্দাজে আনলাম।
-খুব হবে। কী সুন্দর শাড়ির রঙটা। এ আমি এখন তুলে রাখব। ঠাকুর থানে মনসা পুজোর দিন এই নতুন শাড়িখানা ভেঙে পরব।
-আচ্ছা মেজদিভাই, আমি এখন উঠি। রাতে সুটকেস গোছাতে হবে। তার আগে একবার মায়ের সঙ্গে দেখা করে আসি।
-ও ছোট...
খাট থেকে উঠেও আবার বসে পড়ল উত্তরা। কারণ নিধি স্নেহপূর্ণ বাঁধনে ওর হাত টেনে রেখেছে।
-কী বলো?
-কতদিন আর দেবা-দেবী থাকবি? অনেকদিন হল বিয়ে হয়েছে। ঢের আনন্দ-ফূর্তি হয়েছে। এবার একটা কিছু ভাব। সামনের বার যখন আসবি, তখন যেন শুনি নতুন খবর আছে। আমার টুয়ার খেলার সঙ্গী আসছে। একটা বাচ্চার জন্ম দিলে তোর রূপ-যৌবন একটুও টসকাবে না। ছোট ঠাকুরপো তখনো তোর আঁচলেই বাঁধা থাকবে। তোরা এত দেরি করছিস কেন ছোট? কিছু সমস্যা আছে?
কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে মাথা নামিয়ে উত্তরা বসে রইল। নিধি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
-কিছু মনে করিস না বোন। দিদি হয়েই বললাম। নিজের বোন থাকলে তাকেও এভাবে বলতাম। তোদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নাক গলাচ্ছি না। কিন্তু দেখতেও তো ভালো লাগে বল! ঘরের মধ্যে একটা বাচ্চার কান্না, আধো আধো কথা না থাকলে কি ঘরে মন বসে? ছোট ঠাকুরপো দেখবি তখন আরও বেশি করে তোদের জড়িয়ে থাকবে। এদের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে হয়। নইলে এরা সংসারী হয় না। উড়ে উড়ে বেড়ায়। তাছাড়া ওখানে কাছাকাছি তোর মা থাকেন। তিনি এসে বাচ্চাকে দেখবেন। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই বড় হয়ে যাবে। এবার নিয়ে নে ছোট।
-হুম...
-রাগ করলি ভাই?
-রাগ করলে রাগ উগড়ে দেওয়ার জন্য দু-চার কথা শুনিয়ে দিতাম। চুপ করে ভালোমানুষ সেজে মনের ভিতর রাগ পুষে রাখতাম না। তুমি উত্তরাকে চেনো না?
নিশ্চিন্ত হয়ে নিধি বলল,
-তা চিনি। সেই জন্যই তো বললাম। কী ভাবছিস এত?
-ভাবছি আহ্লাদীর কথা। এই মেজদিভাই.... একটা কাজ করব ভাবছি।
-কী কাজ রে?
-দাঁড়াও.... মায়ের ঘর থেকে ঘুরে এসে বলছি। আগে মা কী বলেন দেখি...
মাধবীলতার উপহারখানা বগলদাবা করে উত্তরা যেন চোখের নিমেষে উধাও হয়ে মাধবীলতার ঘরের দরজায় উপস্থিত হল।
-মা আসব?
-কে?
-আমি উত্তরা।
-তা এই ভর সন্ধেবেলা চায়ের আসরের খোশগপ্পো ছেড়ে এই বুড়ির দোরে কী মনে ক'রে?
-কাল চলে যাচ্ছি কিনা! তাই আপনার সঙ্গে একটু গল্প করতে এলাম।
-আর ক'টাদিন থেকে গেলে হয় না?
-আপনার ছেলের ছুটি শেষ। আমারও দু'দিন অফিস কামাই হল। এবার না গেলে একেবারে ছুটি দিয়ে দেবে।
-হুহ! এখানে এতসব জমি-জিরেত, তারা ভিটেছাড়া হয়ে পরের আপিসে চাকরি করছে! উদ্ধার করছে আমায়। সংসার-ধম্ম আর হবে না। মরার আগে বোধহয় ছোট ব্যাটার ঘরে একটা নাতি-পুতির মুখও দেখতে পাব না! কপাল আর কী! মেয়েমানুষের চাকরি করার বাই থাকলে যা হয়! একবার বাইরে বেরিয়ে রঙচঙে দুনিয়ার সোয়াদ পেয়ে গেলে, তার কী আর ঘরে মন বসে! তা ঘরের মধ্যে অমন ঠাকুরের মতো সটান দাঁড়িয়ে রইলে কেন বাছা? বসার জন্য আলতা সিঁদুর পান সুপুরি দিয়ে তোমাকে নেমন্তন্ন করতে হবে নাকি?
-তা নয়। আপনার কথা হজম করছিলাম। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে তাড়াতাড়ি পেটে নেমে যাবে কিনা! বসে পড়লে কথা এসে বুকে আটকে গিয়ে মনে ব্যাথা দিতে পারে। আবার বিষমও লাগতে পারে। তাই দাঁড়িয়েছিলাম। সংসারের সব কথা মনে লাগতে দিতে নেই। যেসব কথা ঝটপট হজম করতে হবে, সেগুলো আমি দাঁড়িয়েই শুনি। শক্ত কথা বুকের ভাঁজে জমে গেলে মনখারাপ হতে পারে। তাই...
-উফ! কথার ঝড়ে যেন সংসার উড়ে যাবে...
উত্তরা ধপাস করে খাটে বসে মাধবীলতার গা ঘেঁষে বলল,
-এটা আপনার জন্য এনেছি মা। দেখুন তো, পছন্দ হয়?
-পানের ডিবে? ও মা! কী সুন্দর ঝকঝক করছে গো!
মাধবীলতাকে শিশুর মতো আনন্দ করতে দেখে উত্তরা বলল,
-হ্যাঁ। আগেরটা বহুদিন হয়ে গেল। চুন লেগে কেমন যেন খারাপ হয়ে গেছে। তাই আপনার জন্য নতুন কিনে আনলাম। আর এই রূপোর বেলপাতা প্যাঁচানো সাপ শিব ঠাকুরের জন্য।
-এতসব তুমি কখন কিনলে?
-এই একটু আগে বেরিয়েছিলাম। আপনার পছন্দ হয়েছে?
-এতগুলো টাকা খসিয়ে কিনেছ। পছন্দ হয়নি বললে তো মুখখানা আবার হাঁড়ি হয়ে যাবে! পছন্দ না হয়ে উপায় আছে?
-তা কেন? পছন্দ না হতেই পারে। কিন্তু পছন্দ না হলেও বলবেন, পছন্দ হয়েছে।
-না হলেও হ্যাঁ বলব?
-হ্যাঁ বলবেন। যে জিনিস আনে, সে তার নিজের পছন্দমতো আনে। যার জন্য আনে, তার পছন্দ না-ও হতে পারে। সব মানুষের পছন্দ সমান নয়। মানুষের পছন্দ খারাপ হতেই পারে, কিন্তু উপহারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ভালোবাসাটা মিথ্যে নয়। একটা জিনিস দিয়ে একটা মানুষের কি সারাজীবন চলে? কিন্তু মানুষের ব্যবহার আর কথাটা আজীবন থেকে যায়। আপনি যদি উপহারের জিনিসটা হাতে নিয়ে একবার মিষ্টি করে হেসে বলেন খুব সুন্দর হয়েছে, তবে দ্বিতীয়বার-তৃতীয়বার উপহার পাওয়ার সুযোগ আরও বেড়ে যায়। বারবার সে যখন আনন্দ করে জিনিস কিনবে, উপহার দেবে, কোনও একবার নিশ্চয়ই আপনার পছন্দ হয়ে যাবে। তখন আর মিথ্যে কথা বলতে হবে না। কিন্তু আপনি যদি তাকে একবার বলে দেন পছন্দ হয়নি, তবে দ্বিতীয়বার হাতে ধরে কিছু কেনার আগে তার মন খুঁতখুঁত করবে। হয়তো সে আর কিছু কিনবেই না। কিংবা হয়তো কিনবে, তা নেহাৎই দায়িত্ব আর কর্তব্য পালন করতে। ভালোবেসে নয়। টাকা খরচ করলে কতরকম জিনিস বাজারে কিনতে পাওয়া যায়, কিন্তু ভালোবাসা পাওয়া যায় কি?
বিস্ফারিত দৃষ্টিতে উত্তরার দিকে চেয়ে মাধবীলতা বলল,
-আমার ব্যাটা হাতে হ্যারিকেন নিয়ে একটা মেয়েমানুষ খুঁজে বের করেছিল সত্যি! ঠোঁটের আগা সবসময় কথা বলার জন্য সুড়সুড় করে! এরপর তোমার আনা জিনিসকে খারাপ বলে কার বাবার সাধ্যি আছে! খুব সুন্দর হয়েছে গো! শিবশম্ভু! শিব শিব...
কপালে হাত ঠেকিয়ে চোখ বুজে শিবালয়ের শিবের উদ্দেশে প্রণাম করে মাধবীলতা বলল,
-কালই আমি নিজের হাতে শিবকে স্নান করিয়ে এই সাপ আর বেলপাতা দিয়ে পুজো দেব। যাওয়ার আগে তোমরা একটু প্রসাদ মুখে দিয়ে যেও। খুশি তো?
চোখে একরাশ দুষ্টুমি এঁকে মিটমিট করে হেসে উত্তরা বলল,
-খুব খুশি। আরও একটা কথা আপনাকে বলার জন্য আমার মুখ সুড়সুড় করছে মা। আপনি না বলতে পারবেন না। আমি চাইব, আপনি দেবেন। কোনও কথা শুনব না।
-তোমার আবার কী চাই? আমার ব্যাটাকেই তো নিয়ে বসে আছ।
-আহ্লাদীকে আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই।
-কী বললে! আহ্লাদীকে?
-হ্যাঁ.... এ বাড়ির যা অবস্থা, ওকে এখন এখানে রাখা ঠিক হবে না। যে মেয়ের বিয়ে ভাঙে, তার ওপরেই মানুষের সবচেয়ে বেশি রাগ থাকে! এমনিতেই সংসারের নিয়ম হল, যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা! এখন ওকে আরও কথা শুনতে হবে। তার চেয়ে আমার সঙ্গে যাক। কিছুদিন দাদার বাড়ি থেকে ঘুরে আসুক। আহ্লাদী সেই যে আমাদের বিয়ের সময় গিয়েছিল, তারপর আর ফ্ল্যাটে যায়নি। আমি আহ্লাদীকে নিয়ে যাই মা? দিনকতক পর আপনার ছেলে এসে ওকে দিয়ে যাবে। আহ্লাদীর যতদিন ইচ্ছে, ততদিন থাকতে পারে। আপনি ভয় পাবেন না। আমার ঘরে আপনার মেয়ের কোনও অযত্ন হবে না। ও খুব আদরেই থাকবে। আমার ওপরে ভরসা রাখুন।
মাথা নামিয়ে চুপ করে বসেছিল মাধবীলতা। উত্তরা মাধবীলতার হাতের ওপর হাত রেখে ডাকল,
-মা?
-ভরসার কথা বলছ তুমি? এ কথা কোন মুখে বলি বলো, পরের মেয়ের ওপর যে ভরসা আছে, নিজের পেটের মেয়ের ওপর তা নেই! আমি জানি তুমি ওর অনাদর করবে না। কিন্তু গৃহপ্রবেশের দিন নারায়ণ পুজোর সময় তোমার ফ্ল্যাট দেখে এসেছিলাম মা। কত বড় জায়গা! আশেপাশে কত বড় বড় ফ্ল্যাট! কত নামী-দামি মানুষের বাস সেখানে! তুমি আমার ঘরের মানুষ। তোমার কাছে আর কী লুকোব? আমার মেয়েটার স্বভাব তোমার অজানা নয়। ওখানে গিয়ে যদি আবার কারও সঙ্গে কিছু করে বসে, লজ্জায় তোমাদের নাক কাটা যাবে! লোকে ছি ছি করবে। আমি আহ্লাদীকে একদম ভরসা করতে পারি না ছোট বৌ...
পাড়া বেরিয়ে টুয়ার খাতায় খোলা আকাশ এঁকে ঘরের বাইরে তখনই পৌঁছেছিল আহ্লাদী। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে চুড়িদারের ওড়নাটা হাতের আঙুলের মধ্যে জড়িয়ে দাঁত দিয়ে সুতো কাটতে কাটতে একমনে শুনছিল ঘরের ভিতরের নিভৃত আলাপচারিতা। উত্তরা হেসে বলল,
-কিছুক্ষণ আগে মেজদিভাই আমাকে দায়িত্বের পাঠ পড়াল। সে বলল, দায়িত্ব চাপিয়ে না দিলে ঘরের পুরুষ মানুষরা নাকি উড়ে বেড়ায়। কিন্তু মিথ্যে বলব না মা, আপনার ছোট ছেলের লুকোনো ডানা আমি কোনোকালেও চোখে দেখিনি। তবে মেজদি আমার চেয়ে বেশিদিন সংসার করেছে। তার অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে খানিক বেশি। হয়তো সে ঠিকই বলে থাকবে। তার কথার জের টেনেই বলি, বড় মুখ করে ভরসা না করলে, কেউ ভরসার মর্যাদা দেবে কেন? ভরসার মর্যাদা চাইলে আগে ভরসা করতে হবে। আপনার ইচ্ছে না হলে ভরসা করবেন না। কিন্তু আমি আহ্লাদীর ওপর একবার ভরসা করবই। দেখিই না, সে কেমন তার ছোট বৌদিদির মুখে চুনকালি মাখায়! আবার এমনটাও তো হতে পারে, আমার ওখান থেকে ফেরার পর আপনি আহ্লাদীর মধ্যে একজন নতুন মানুষকে খুঁজে পেলেন, যাকে আগে কোনোদিন দেখেননি.... চেষ্টা করতে ক্ষতি কিছু নেই। ঠিক কিনা বলুন! আপনি আহ্লাদীকে আমার সঙ্গে যেতে দেবেন তো? বড়দাভাইকে আমি জিজ্ঞাসা করতে যাব না। আপনিই আমাদের সকলের অভিভাবক, আহ্লাদীরও মা। আপনি হ্যাঁ বললে, আমি কারও নিষেধ শুনব না।
মাধবীলতার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো কান্নায়। উত্তরার হাত চেপে ধরে সে বলল,
-এখানে দিনরাত টইটই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওখানে যাওয়া মানে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি হয়ে থাকা। তোমরা অফিসে বেরিয়ে যাবে। ওকে সারাদিন দমবন্ধ করে ঘরের মধ্যে একা থাকতে হবে। ও কি যেতে রাজি হবে ছোট বৌ?
ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে এক পায়ের আঙুল দিয়ে আর এক পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ একমনে খুঁটতে লাগল আহ্লাদী।
পরের দিন ভোরে ঘটা করে নিজ হাতে শিবালয়ের শিবলিঙ্গকে স্নান করাল মাধবীলতা। প্রসাদ খেয়ে মাধবীলতাকে প্রণাম করে ঘোমটা সামলে উত্তরা হাসিমুখে দাঁড়াল নাগের বাড়ির সামনে। নিজেদের সুটকেস ও আহ্লাদীর ব্যাগ গাড়ির ডিক্কিতে ঢুকিয়ে দিল অঙ্কন। আহ্লাদীর পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে খুন হয়ে গেল টুয়া। নিধি চোখের জল মুছে বলল,
-সারারাত মেয়ে ঘুমায়নি। একটু চোখ বুজলেও ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। যখন থেকে শুনেছে, কাম্মার সঙ্গে সোনাপিসিও চলে যাচ্ছে, একনাগাড়ে কেঁদে ভাসাচ্ছে...
টুয়ার দু'গালে অনেক আদর এঁকে দিয়ে আহ্লাদী রুদ্ধকণ্ঠে বলল,
-আমি আবার আসব তো। তুই এত কাঁদছিস কেন? আমি কি জন্মের মতো চলে যাচ্ছি?
-তোমার বিয়ে হয়ে গেল পিসি? বর কই? তুমি আমাকে ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছ?
টুয়ার কথা শুনে উপস্থিত সকলে হেসে উঠল সমস্বরে। কেবল আহ্লাদী টুয়াকে বুকের ভিতর মিশিয়ে কান্নায় ভেসে বলল,
-তোকে ছেড়ে কোথায় যাব মা আমার? আমি আবার আসব।
-ঠিক তো সোনাপিসি? তুমি আবার আসবে তো?
-ঠিক ঠিক ঠিক! একটু ভরসা রাখ আমার ওপর! আমি ঠিক আসব.... তোকে একা রেখে কোথাও পালাব না।
ঘরের জানলার পর্দা একটু ফাঁকা করে দোতলা থেকে উঁকি মারছিল তৃণা। মুখ বেঁকিয়ে বলল,
-ঢং দেখে গা জ্বলে যায়। যা না, আদর করে নিয়ে যা! রাখ কয়েকটা দিন। তারপর বুঝবি ও কী বিষ! আবার দু'দিন পর ঘাড় থেকে নামানোর জন্য এখানেই ফিরিয়ে দিয়ে যেতে হবে। কত দেখলাম অমন আলগা পিরিত! মায়েরও বলিহারি! যত বয়স বাড়ছে, বুদ্দিসুদ্দি যেন লোপ পাচ্ছে। ঐ বেহায়া মেয়েমানুষটাকে নিয়ে আদিখ্যেতার শেষ নেই! বাপ-মা দেখেশুনে বিয়ে দেবে, সেই অপেক্ষাও তো করতে পারিসনি হতভাগী! এমনই গতরের জ্বালা, আমার দেওরের গায়ে ঢলাঢলি করে একেবারে নাগের বাড়ির ভিতরে উঠে এসেছিস! তাও যদি একটা ব্যাটা পেটে ধরতিস, না হয় এত দেমাকের কারণ বুঝতাম! বিয়ে হয়েছে কম দিন তো হল না। এখনো কচি সেজে হেলে-দুলে ঘুরে বেড়ায়! একটা বাচ্চা পেটে এলো না। বাঁজা মেয়েছেলে কোথাকার! তাকে নিয়ে ঘর-গুষ্টি সবার ন্যাকামি দেখলে মনে হয় সংসারের মুখে নুড়ো জ্বেলে দিই।
ঘরের কোণে টেবিলের ওপর রাখা রূপোর সিঁদুরের কৌটোর দিকে চেয়ে মুখ বেঁকিয়ে হাতের চুড়ি ঝনঝনিয়ে তৃণা বলে উঠল,
-বুদ্ধির বলিহারি যাই! শাড়ি দিল না। দিল সিঁদুরের কৌটো! জানে এয়োস্ত্রী মানুষ, এ জিনিস প্রাণে ধরে কাজের লোককে বিলিয়ে দিতে পারবে না। আবার ব্যবহার না করে শুকনো কৌটো ফেলেও রাখবে না...
উত্তরার দেওয়া শূন্য সিঁদুরের কৌটোতে তৃণা খানিক গুঁড়ো সিঁদুর রাখল। তারপর আয়নার দিকে চেয়ে নিজের সিঁথিতে চওড়া করে সিঁদুর দিয়ে বলল,
-আমার সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় করো। ঠাকুর ঠাকুর...
হাতের নোয়ায় একফোঁটা সিঁদুরবিন্দু এঁকে কৌটোটাকে কপালে ছুঁইয়ে প্রণাম করে তৃণা মৃগাঙ্কর দীর্ঘায়ু কামনা করল।
গ্রামের পথের আলগা ধুলো উড়িয়ে অঙ্কনের গাড়ি এগিয়ে গেল শহরের পথে...
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট