অনুসরণকারী

শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৩

স্বপ্ন হলেও সত্যি তৃতীয় পর্ব




স্বপ্ন হলেও সত্যি

সাথী দাস

তৃতীয় পর্ব





তিন সন্তানকে নিয়ে জীবনের সর্বাধিক ব্যস্ততম ও মূল্যবান মুহূর্ত জাহ্নবী অতিবাহিত করছিল। সন্দেশ ও নিমকি দিনের সিংহভাগ সময় মাতৃক্রোড় আলো করে থাকে। তার মাঝে সময়ে-অসময়ে কোলে উঠে আসে জাহ্নবীর প্রথম সন্তান ল্যাপটপ। ফ্ল্যাটে স্থানাভাবের কারণে ও ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজনে চয়নের বাবা অনেকদিন আগেই ফিরে গেছেন তাঁর নিজস্ব বাড়িতে। দুটো ক্ষুদ্র শিশুকে একা সামলাতে জাহ্নবীর প্রাণ হয়তো ওষ্ঠাগত হয়ে যেত। কিন্তু মুক্তার সাহায্য এবং দুই মায়ের সান্নিধ্যে মাতৃত্ব যেন ওর কাছে কিছুটা সহজ আর উপভোগ্য হল। তবুও আয়নার সামনে দাঁড়ালে জাহ্নবীর মনে হতাশা জন্ম নেয়। অত্যধিক ওজন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে জাহ্নবী নিজেকে এখন চিনতেই পারে না। ওয়ার্ডরোবে সযত্নে তুলে রাখা প্রিয় পোশাকগুলো পরা যায় না। মাত্র আট-দশটা নতুন জামা রয়েছে, যেগুলো গর্ভাবস্থায় অফিসে বা ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য কেনা হয়েছিল। এখন সেগুলো এত ঢোলা হয়, গায়ে তোলা যায় না। নিজের মনের মতো একটাও সুন্দর জামা জাহ্নবীর কাছে আছে কিনা ওর মনে পড়ে না। ওয়ার্ডরোব খুলে দেখতেও ইচ্ছে করে না, নতুন জামা কিনতেও ইচ্ছে করে না। এই কয়েক মাসেই হাঁপিয়ে উঠেছে জাহ্নবী। মনে হচ্ছে কত যুগ পেরিয়ে গেল বাইরে ঘুরতে বেরোনো হয় না। চয়নকে কাছে পাওয়া হয় না।
সেদিন ওর সহকর্মী শাল্মলী একগুচ্ছ উপহার সঙ্গে নিয়ে সন্দেশ আর নিমকিকে দেখতে এসেছিল। ওর সঙ্গে কথা বলতে বসলে জাহ্নবীর বেশ ভালো সময় কেটে যায়। ওরা কেবল পরস্পরের সহকর্মী নয়, শাল্মলীর গুরুত্ব জাহ্নবীর জীবনে অপরিসীম। বন্ধুবৃত্ত ক্ষুদ্র হতে হতে এখন জাহ্নবীর পরিণত বয়সের একমাত্র বন্ধু ও শুভচিন্তক এই শাল্মলী। ওর সঙ্গে অফিসের কত গল্প হল, সান্ধ্য ভোজন হল.... কিন্তু ও চলে যাওয়ার পর জাহ্নবী আবার তলিয়ে গেছে নৈরাশ্য আর একাকীত্বের অন্ধকারে। ঘরে এত মানুষ থাকা সত্ত্বেও ওর কিছুই ভালো লাগে না। জীবনটা কেবল যেন বাচ্চাদের ডায়পার পরিবর্তন, মলমূত্র পরিষ্কার, নির্ধারিত সময়ে বাচ্চাদের খাওয়ানো, মনে করে ঢেঁকুর তোলানো, পেটব্যাথা, তালমিছরির জল, কারণে-অকারণে একনাগাড়ে কান্না, ডাক্তার, ভ্যাকসিন, ওষুধ, নিজে গোগ্রাসে খাওয়া আর আধো-ঘুম আধো-জাগরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে জগৎসংসার অন্ধকার। এভাবেই বোধহয় জাহ্নবীর সমগ্র জীবন কেটে যাবে। নিজের জন্য কিছুই করা হবে না। শিথিল বক্ষ, কুঁকড়ে যাওয়া ঝুলন্ত উদর, অস্ত্রপচারের সাময়িক অসাড়তা, নিদ্রাহীনতার ফলে চোখের কোলে কালি, মাতৃদুগ্ধের কারণে সর্বক্ষণ সিক্ত পোশাক.... জাহ্নবী নিজেকে আয়নায় দেখে রাগে-দুঃখে নিজেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। চয়নের সামনে দাঁড়াতেও এখন লজ্জা করে। জাহ্নবী নিজেকে ভালোবাসতে ভুলে গেছে। ওর মধ্যে আকর্ষণীয় শব্দটার কোনও অস্তিত্ব নেই। যতটুকু সৌন্দর্য, লালিত্য আর উজ্জ্বলতা ছিল, সমস্ত শুষে নিয়ে ওকে নিংড়ে পৃথিবীর আলো দেখেছে সন্দেশ ও নিমকি।
জাহ্নবীর একমাত্র ভালোবাসা ছিল নিজের কর্মক্ষেত্র। যে টেবিলের ওপর ওর ল্যাপটপ বসানো থাকত, সেই জায়গাটা ওর কাছে মন্দিরের মতো পবিত্র ছিল। সেখানেও এখন ভালো লাগে না। টেবিলের ওপর চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকে ডায়পার, বেবি পাউডার, বেবি ক্রিম, বেবি লোশন, তেল, শ্যাম্পু, রকমারি ওষুধ। নিজের প্রিয় ঘরটাকে চিনতে পারে না জাহ্নবী। ও নিজে বদলে গেছে। কিন্তু মানুষের পাশাপাশি এত সাধ করে নিজের হাতে সাজানো বাড়িঘর, পূর্বপরিচিত সংসার, সব যেন এক অদৃশ্য মন্ত্রবলে বদলে গেছে। ঘরের মধ্যে অদ্ভুত একটা গন্ধ! নিজের পোশাকে, বাচ্চাদের পোশাকে, ঘরের মেঝেতে, সর্বত্রই সেই জীবাণুনাশক তরলের উগ্র গন্ধ! জাহ্নবীর গা গুলিয়ে বমি পেয়ে যায়। গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। মুখ বন্ধ করে প্রেতাত্মার মতো ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে ও সারাদিন ঘুরে বেড়ায় আর যন্ত্রের মতো কাজ করে।
সন্দেশ-নিমকি এখন ঘুমোচ্ছে। একটু আগে মাতৃদুগ্ধ পান করছিল। জাহ্নবী পাশ ফিরে শুয়ে বালিশে মুখ চেপে নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল। কেন এত কান্না পাচ্ছে, এ প্রশ্নের উত্তর ও নিজেও জানে না। কেবল জানে, জাহ্নবী নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে না। ডোরবেলের শব্দ পেয়ে নিজেকে তাড়াতাড়ি সামলে নিল ও। ঘরের দরজাটা ধীরে ধীরে একটু ফাঁকা হওয়ার পর চয়নের মা উঁকি মেরে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-হ্যাঁ রে! ঘুমিয়েছে?
-হু। কোথায় বেরিয়েছিলে তুমি? কিছু দরকার হলে মুক্তাকে পাঠাতে পারতে। আমি অনল কাকাকে একটা ফোন করে আনিয়ে নিতাম। তুমি আবার নামতে গেলে কেন?
-দাঁড়া, বাইরের শাড়িটা ছেড়ে হাত-পা ধুয়ে আসছি...
বাড়ির সমস্ত নিয়মকানুন বদলে দিয়েছে দুই খুদে দস্যি। যতক্ষণ এরা নিদ্রামগ্ন হয়ে থাকে, ঘরের প্রত্যেক সদস্য কন্ঠ খাদে নামিয়ে কথা বলে। রান্নাঘরের বাসনপত্রের সামান্য একটু শব্দও সেই সময়ে করা নিষেধ! ঘড়িতে রাত সাড়ে আটটা বাজল। বাচ্চাদের পাশে শুয়ে জাহ্নবী একদৃষ্টে ওদের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে রইল। ছোট-ছোট হাত-পা, হাঁ করে থাকা সিক্ত ঠোঁট.... বড় মায়াময় সেই দৃশ্য। সন্দেশ বারবার ঘুমের ঘোরে হেসে উঠছে। চোখ মেলে চাইছে, হাসছে। আবার চোখ বন্ধ করে ফেলছে। নিমকি পাশ ফিরে সাড়ে আট মিনিটের বড় দাদা সন্দেশকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। নিমকির আকস্মিক স্পর্শে চমকে আড়মোড়া ভেঙে ওঠার চেষ্টা করল সন্দেশ। দু'জনকে সাবধানে চাপড়ে দিল জাহ্নবী। আবার ওরা গভীর ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল। ওদের দেহের কাছে নাক রেখে জাহ্নবী পেল এক মিষ্টি স্বর্গীয় সৌরভ, যে সুবাস কেবল শিশুদেহেই পাওয়া সম্ভব। ভালোলাগায় জাহ্নবীর চোখ বন্ধ হয়ে এলো। লবণাক্ত জলে দু'চোখ ভরে উঠেছে। কিছুক্ষণ আগের রাগ, দুঃখ, মনখারাপ, হতাশা, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা.... সমস্ত ধুয়ে গেল চোখের জলে। স্তব্ধবাক জাহ্নবী সন্দেশের ছোট্ট হাতের মুঠোয় চুমু খেয়ে নিজেকে প্রশ্ন করল, এই মিশ্র অনুভূতির নামই কি মাতৃত্ব?
-ওভাবে ঘুমন্ত বাচ্চাকে হাঁ করে দেখতে নেই জানু!
চয়নের মায়ের কথায় ঘোর কাটল জাহ্নবীর। চোখ মুছে উঠে বসল ও। চয়নের মা একটা বৃহৎ প্লাস্টিকের ব্যাগ হাতে নিয়ে খাটে বসলেন। গলা নামিয়ে ফিসফিস করে চলল দুজনের কথাবার্তা।
-কী আছে এতে? কোথায় বেরিয়েছিলে তুমি?
-কাঁদছিলি কেন আগে বল? ওদের দেখে?
-হুম।
-ওভাবে দেখবি না। বাচ্চা বড় মায়ার জিনিস। মায়া কাটিয়ে এরপর বেরোতে পারবি না। আগামী মাস থেকে অফিসে বেরোতে হবে তো?
-হ্যাঁ।
-তবে! এখন মায়া বাড়াচ্ছিস কেন? আমার মতো কাঁদতে কাঁদতে অফিস যাবি তুই? এখন থেকে দিনের বেশিরভাগ সময় ওদের মুক্তার কাছে রাখা অভ্যাস কর। তুই একটু দূরে-দূরে থাক। তোর বাচ্চা তোরই থাকবে, তোকেই মা ডাকবে। কেউ কেড়ে নেবে না।
-পরশু তুমি সত্যি চলে যাবে মা?
-বাবাইয়ের বাবার শরীরটা একটু খারাপ হয়েছে। সুগারটা বেড়েছে বোধহয়। ডাক্তার ব্লাড টেস্ট দিয়েছে। করাতে হবে। আমি না গেলে মানুষটা আবার অনিয়ম করবে। পল্লবীর ওপর সবটা ছেড়ে দিলে হয়! তাছাড়া বাড়ির গাছগাছালিগুলো ডালপালা মেলে প্রতিবেশীর অসুবিধে করছে। কাল তোর বাবাকে ডেকে পাশের বাড়ির কাকিমা গাছ কাটাতে বলেছে। আমি যাই, তারপর একটা লোক ডেকে গাছ কাটাতে হবে। কয়েক মাস তো একভাবে রইলাম জানু। আমি আবার আসব। ওদিকটাও একটু সামলে আসি। এগুলো রাখ, তুই পরবি।
-কী আছে এতে? এতগুলো কুর্তি, টপ, স্কার্ট, জিন্স!
-সব মিলিয়ে ছ'টা আছে। তোরা আজকালকার মেয়ে, তোর পছন্দ-অপছন্দ আমি জানি না মা। তোকে এইরকম জামাকাপড় বেশি পরতে দেখেছি। তাই যেগুলো আমার ভালো লাগল, নিয়ে এলাম। অফিসে যাবি। আগের জামাকাপড় কিছুই গায়ে ধরবে না। বাচ্চা রেখে বেশিক্ষণের জন্য বেরোতেও পারিস না যে কেনাকাটা করবি! আপাতত এগুলো দিয়ে কাজ চালিয়ে নে। পরে তোর সময়মতো কিনে নিস। কাল বাবাইয়ের সঙ্গে বেরিয়েও কিনতে পারিস। কাল এটা পরে ঘুরতে যাস। এই জামাটা সুন্দর না? তোকে মানাবে খুব! দ্যাখ!
উত্তেজনার আতিশয্যে জাহ্নবীর কাঁধের ওপর একটা টপ ধরে দেখতে লাগলেন চয়নের মা। জাহ্নবী এখন দুই সন্তান নিয়ে ঘরবন্দি হয়ে রয়েছে। ওর পক্ষে চয়নের কাছে যাওয়া সম্ভব নয়। চয়ন প্রত্যেক শনিবার রাতে নিজের পরিবারের কাছে আসে, সোমবার ভোরে প্রথম ট্রেনে ফিরে যায় আপন কর্মক্ষেত্রে। কিন্তু এই শনিবার ওরা কোথায় যাবে ভেবে পেলো না জাহ্নবী। এ বিষয়ে চয়ন ওকে ফোনে কিছুই জানায়নি। হতবাক জাহ্নবী বলে ফেলল,
-কাল কোথায় যাব?
চয়নের মা হেসে বললেন,
-বাবাইয়ের বাবা কী করত জানিস? আমার ছুটির দিনে বাড়িতে থাকলে সে বলত, সারা সপ্তাহ তুমি বাড়িতে থাকো না। ছেলে তোমাকে কাছে পায় না। চলো, আজ ছেলেটাকে নিয়ে দু'জনে কাছেপিঠে কোথাও হাওয়া খেয়ে আসি।
-ছেলেকে নিয়ে? না তোমাকে নিয়ে? সারা সপ্তাহ কে-কাকে কাছে পায় না? সব বুঝি আমি!
-শোন না...
-বলো-বলো। তোমার আর বাবার গল্প শুনতে আমার কী যে ভালো লাগে.... তারপর?
-তারপর আর কী! বিকেলে বেরিয়ে পড়তাম তিনজন। বাবাই পার্কে খেলত, আমি আর বাবাইয়ের বাবা ছোলাভাজা কিংবা বাদাম ভাজা নিয়ে মাঠের ঘাসের ওপর বসে থাকতাম। আসার আগে ছেলেকে একটা কাঠি আইসক্রিম কিনে দিতাম। আমরা দুটো বেগুনী কিংবা ফুলুরি নিয়ে পায়ে হেঁটে বাড়ি চলে আসতাম। এসে বাড়িতে গরম চা, মুড়িমাখা আর তেলেভাজা!
-কী ভালো! তারপর?
-তারপর আবার কী! এতগুলো বছর পর আমার সেই পার্কে খেলা করে বেড়ানো ছেলের দৌলতে জানলাম, আমাদের ঐ দু'জনে কাছেপিঠে কোথাও হাওয়া খেয়ে আসি এখন পরিবর্তিত হয়ে ডিনার ডেট হয়ে গেছে।
-মানে!
-কাল তোর বর তোকে নিয়ে ডিনার ডেটে যাবে। বাবাই আমাকে ফোন করে বলল, মা পরশুদিন আমি তোমাকে নিয়ে বাড়ি যাব। তোমাদের সঙ্গে একদিন থেকে সোমবার সকালে বাবার টেস্ট করিয়ে এগারোটার ট্রেনে ফিরব। কাল রাতে আমি বাড়ি ফিরে জানুকে নিয়ে ডিনার ডেটে যাব ভাবছি। তুমি, ওর মা আর মুক্তা মিলে বাচ্চাদের একটু দেখে রেখো। জানু ঘুরতে-বেড়াতে, সেজেগুজে পরিপাটি থাকতে ভালোবাসে। ওর আলমারিতে নতুন জামা আছে কিনা জানি না। ওর জন্য একটা জামা কিনে রাখতে পারবে? ওকে এখন কিছু জানিও না। কাল গিয়ে সারপ্রাইজ দেব। বাবাই আমাকে এটা বলে ফোন রাখল। এদিকে তোর পেট পাতলা শাশুড়ির অবস্থা দেখ! সে একটা জামা কিনতে গিয়ে ছ'টা নিয়ে এসেছে। এবার তোর পছন্দ না হলে কাল সকালে ফেরত দিতে যেতে হবে। তাই দেখাতেই হল, সব বলতেই হল। এই তোর পছন্দ হয়েছে তো? জিন্সটা পরে দেখা দেখি। কোমরের মাপ ঠিক হল, না আবার পাল্টাতে হবে! আমি আন্দাজে এনেছি।
সন্দেশ আর নিমকি নড়তে শুরু করেছে। এক্ষুণি পরিত্রাহি চিৎকার শুরু করবে। চয়নের মা তাড়াতাড়ি ওদের আলগা চাপড় মেরে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। জাহ্নবীর তখন কথা বলার মতো অবস্থা নেই। একদলা কান্না ওর বুকের ওপর বোঝা হয়ে চেপে বসেছে। চোখের কোল বেয়ে জল বেরিয়েই গেল। মাথা নামিয়ে জামাটা মুঠোর মধ্যে চেপে ও বলল,
-খুব সুন্দর হয়েছে। আমি কাল এটাই পরব। তুমি কী করে বুঝলে বলো তো, আমি ঠিক কী চাই!
-তোর এই শাশুড়ি তো একদিনে শাশুড়ি হয়নি রে মা। অনেকগুলো বছর পেরিয়ে আজ শাশুড়ি হয়েছে। সবার আগে এক বাড়ির মেয়ে ছিল। তারপর আর এক বাড়িতে এসে বৌ হয়ে সবশেষে মা হয়েছে। তারপর তুই তার ব্যাটাকে বিয়ে করে বর পেয়েছিস। কী করে বুঝলাম, সেই গল্প বলতে গেলে ইতিহাস হয়ে যাবে! আমি জীবনে যা কষ্ট পেয়েছি, তার সিকিভাগও যেন তোকে পেতে না হয় জানু! তোকে কেউ কোনোদিন বলবে না, পেটের ব্যাটা কেঁদে গলা শুকিয়ে চিতায় উঠলেও রাক্ষসী মা ব্যাগ বগলে কোমর দুলিয়ে আপিসে যাবেই! এত তেজ এই মেয়েমানুষের.... শাশুড়িকে দিনরাত ছোট বৌ বলত, আমাকে আপনি দুই ভাসুরের সামনে বেরোতে দেন না। এদিকে আপনার মেজ বৌ রোজ সকালে পরপুরুষের গায়ে গা ঘষে ট্রেনে-বাসে চেপে অফিসে যাচ্ছে। তখন কী আপনি চোখে ঠুলি এঁটে থাকেন!
গলা কেঁপে গেল চয়নের মায়ের। চুপ করে গেলেন তিনি। জাহ্নবী চয়নের মায়ের হাতের ওপর হাত রেখে দেখল তিনি অসহনীয় কষ্টে কাঁপছেন। বুকের ভিতরটা বোধহয় কান্নায় ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু পুত্রবধূ সম্মুখে সেই যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চাইছেন না। খানিকক্ষণ পর চোখ থেকে চশমা খুলে কাপড়ের আঁচলে চোখ এবং চশমা মুছে তিনি বললেন,
-আমাদের সময় প্রত্যেকের হাতে-হাতে এত ফোন ছিল না জানু, যে ইচ্ছে হলেই ফোন করে বাবাইয়ের বাবার সঙ্গে কথা বলব। অফিসে বসে প্রতি মুহূর্তে ছেলের খবর নেব। ভোরের কাক ডাকার আগে রাজ্যের অভিশাপ কানে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোতাম, ফিরতাম সেই রাতে। সারাদিন মনের ভিতর যে কী অশান্তির ঝড় চলত, তোকে কী বলব! কানে শুনতাম, আমি নাকি বাবাইকে নিয়ে ভালোমন্দ খাওয়ার জন্য বরের কান ভাঙিয়ে ওদের সংসার দু'টুকরো করে ভিন্ন হয়েছি। ব্যাগের মধ্যে পাঁউরুটি আর একটা কলা নিয়ে যেতাম। সেটাও এক-একদিন গলা বেয়ে নামত না। খেতে বসে ছেলেটা কী ছাইভস্ম খাচ্ছে, সেইসব ভাবতে ভাবতে বুক ফেটে যেত। বাবাই তখন এক পা দু'পা হাঁটে। টলমলে পায়ে এর ঘরে ওর ঘরে যায়। ছোট মায়ের ঘরে গেলে আমার জা ওর হাত ধরে ঘর থেকে বের করে দিত। তোর বরকে যে মানুষ জীবনেও একগ্রাস ভাত মুখে তুলে দেয়নি, সেই মানুষ আজ তোর বিয়েতে সোনার নেকলেস দিয়ে গেছে। জানে সামনেই তার মেয়ের বিয়ে। এখানে দিলে লাভ আছে। বাবাই ঠিক ঐ জিনিস ফিরিয়ে দেবে। আমার চাকরি নিয়ে এত ঝামেলা হয়েছে বাড়িতে, তবুও অশান্তির ভয়ে আমি হার মানিনি। তুইও হাল ছাড়বি না। বাচ্চাদের মায়ায় জড়াবি না। রোজ কাজে যাবি।
-যাব মা!
-ওরা একটু কাঁদবে। সন্দেশ আর নিমকিকে ছেড়ে বেরোতে তোর বুক ফেটে যাবে। কিন্তু তাও জোর করে শিকল ছিঁড়ে বেরোবি। মনে রাখবি, মায়েদের অনেক বেশি ধৈর্য রাখতে হয়। তারা নিজেরাও জানে না তাদের ক্ষমতা! ঈশ্বরও মেয়েদের গর্ভেই সন্তান সৃষ্টি করেন। সেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে মেয়েদের দেহে সন্তানের খাবার পাঠিয়ে দেন। আমরাই সৃষ্টি করতে পারি, চাইলে আমরাই ধ্বংস করতে পারি। ধৈর্য ধরে সবকিছু সাজাতে হবে। এটা তোর সংসার জানু, সারাজীবন তোরই থাকবে। এখন আগে নিজের স্বপ্নগুলো পূরণ করে নে। আমাদের সময় এত টেকনোলজি, ল্যাপটপ, বাড়িতে থেকে শুয়ে-বসে কাজের সুবিধা ছিল না। বেশিরভাগই ফিল্ড ওয়ার্ক। তার মধ্যেও আমি লড়ে গেছি। যখন জয়েন করলাম ডিপার্টমেন্টে তেরো জন কাজ করেছি। যখন রিটায়ার করলাম আমার সেই ডিপার্টমেন্টে দেখলাম মোট তিনজন মানুষ আর দুটো কম্পিউটার। তবেই ভাব! যুগ কত এগিয়ে গেছে। আমাদের পিছিয়ে থাকলে চলবে? পরিবর্তন তো বলে-কয়ে দরজায় নক করে অনুমতি নিয়ে আমাদের অন্দরমহলে ঢুকবে না। সংস্কার ভেঙে, খেটে মনের মতো দরজা তৈরি করে পরিবর্তন আনতে হবে। এখন তোর হাতের মুঠোর মধ্যে ফোন আছে। ভিডিও কল করবি, যখন ইচ্ছে হবে বাচ্চাদের দেখতে পাবি। ওদের সঙ্গে কথা বলতে পারবি, আবার কী চাই! যদিও আমি তোদের মতো ফোন ল্যাপটপের এতকিছু বুঝি না। মানে টেকনোলজির ব্যবহার, টেক...
-টেক স্যাভি!
-হ্যাঁ, ঐ অতটা টেক স্যাভি নই। টুকটাক কাজ চালাতে পারি। কিন্তু প্রয়োজন হলে তোর জন্য আমি ভালো করে সবকিছু শিখে নেব। আমার ছেলেটার তো আর দেশের বাইরে তেমন কোনও প্রোগ্রেস হবে না। বাঁধা বেতনের চাকরি। কিন্তু তুই প্রাইভেট সেক্টরে আছিস। স্কিল ডেভলপমেন্টের প্রচুর সুযোগ পাবি। যদি কোনও বড় সুযোগ পাস, যদি তোকে বিদেশ পাঠায়! কত নতুন অভিজ্ঞতা তোর ঝুলিতে জমা হবে! তুই একদম বাচ্চাদের কথা ভাববি না। হ্যাঁ বলে দিবি। আমি এখানে চলে আসব। তোকে ভিডিও কল করে রোজ ওদের দেখাব। আমি আর তোর মা মিলে এদিকটা সামলে নেব। আমরা বেঁচে থাকতে থাকতে তুই নিজের কেরিয়ারটা ভালোভাবে তৈরি করে নে জানু। নিজের পেটের ছেলেকে সময় দিতে পারিনি। এখন সন্দেশ আর নিমকিকে মাথায় করে রাখব। দিদিমা-ঠাম্মা হওয়া কত ভাগ্যের ব্যাপার জানিস? ওদের কোলে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গেলেই আমার কান্না পেয়ে যায়। মনে হয়, আবার ফিরে মা হয়েছি! সেই দিনগুলো ফিরে পাচ্ছি।
দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থেকে জাহ্নবী কান্না সংবরণ করল। তারপর নাক টেনে বলল,
-রকেট সায়েন্সের পর তুমিই বোধহয় এত ডিফিকাল্ট মা! তুমি যে কী দিয়ে গড়া, আমি আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না। এমন মানুষকে তোমার শ্বশুরবাড়ির লোক চিনতে পারল না। ওদের দুর্ভাগ্য দেখে হাসি পায়, আবার করুণাও হয়।
-ছাড় না! আমি মন থেকে ঐ দিনগুলোর কথা ভুলে থাকতে চাই। কিন্তু কথায়-কথায় আবার বলেও ফেলি। একটু আগে জিজ্ঞাসা করছিলি না, কীভাবে তোকে বুঝি! এই দিন, এই সময় আমিও এককালে পেরিয়ে এসেছি। তাই সব বুঝি। সবাই বাচ্চাকে নিয়েই ব্যস্ত! নতুন মা হওয়ার পর মায়ের শরীর আর মনের ওপর যে কী ধকল যায়, কেউ সেই খোঁজ নেয় না। আমাকে কেউ বলেনি, তোর বাচ্চাকে দেখছি। তুই একটু ঘুমিয়ে আগে নিজে বাঁচ, তারপর বাচ্চাকে ধরবি। বাবার বাড়ি থেকে আসার পর কেউ ফিরেও চাইত না আমার দিকে। বাবাইয়ের বাবা রাতের পর রাত জাগত। মানুষটা না থাকলে আমি বোধহয় মরে যেতাম! তবে ঐ কষ্টের দিনগুলো না পেরিয়ে এলে হয়তো তোকে এত ভালোভাবে বুঝতাম না। কোনও মেয়ে সংসার ভাঙার জন্য বিয়ে করে না জানু, সংসার করতেই বিয়েটা করে একটা নতুন পরিবেশে আসে। দিনের পর দিন মুখ বন্ধ করে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করে। কিন্তু তার কাদার তালের মতো নরম মনটাকে সংসার পুড়িয়ে ইঁট বানিয়ে দেয়। আমি কী করেছি জানিস?
-কী?
-আগে নিজের নামে জমি কিনেছি। তারপর ব্যাঙ্ক থেকে লোন দিয়ে ঐ ইঁট জমিয়ে জমিয়ে তোর বাবা আর আমি, দু'জন মিলে ছোট বাড়িটা বানিয়েছি। অপমান পুষে রাখতে হয়। যে মেয়েমানুষ তেজ করে গড়তে জানে, সেই মেয়েমানুষের তেজ ভালো জানু, খুব ভালো! তেজের পাশাপাশি অপমানগুলোও পুষে রেখে কাজে লাগাতে হয়। মুখে উত্তর দিতে নেই। উত্তরটা সময়ই দেবে। তখন মুখ ফুটে কিছু বলতে হবে না। আমি আমার ছেলের চোখ খুলে দিয়েছি। ও নিজের মাকে ঘরে-বাইরে কাজ করতে দেখেছে। সংসার আর সন্তানের প্রয়োজনে কেরিয়ার স্যাক্রিফাইজ করার চিন্তা মাথায় এলে ও বৌয়ের মুখের দিকে চেয়ে বসে থাকবে না। বরং সবদিক কীভাবে ব্যালান্স করা যায়, সেটাই ভাববে। এই শিক্ষা ওর জন্মগত! কিন্তু তুই ছেলেরও মা, আবার মেয়েরও। তোর দায়িত্ব অনেক বেশি জানু। এমন কিছু করবি না, যেটা দেখে কাল নিমকি ভাববে, আমার মা আমার জন্য কাজ ছেড়ে ঘরে বসেছিল, আমিও তাই করলে সংসারটা বজায় থাকবে। খবরদার এই ভুল করবি না। সন্তান বাবা-মাকে যে পথে চলতে দেখবে, নিজেও সেই পথেই যাওয়ার চেষ্টা করবে। তখন তুই কিচ্ছু বলতে পারবি না।
-বুঝেছি।
-তুই নিজের জন্য জীবনে কী করেছিস, এই প্রশ্নটা যখন নিজেকে করবি তখন যেন ট্রফির মতো কেবল সন্দেশ আর নিমকি তোর চোখের সামনে না আসে! ওরা ছাড়াও তোর বাঁচার উদ্দেশ্য আছে। নিজের জন্যও কিছু করতে হবে। বাবাইয়ের সঙ্গে খুব ঘুরে নিবি! বাচ্চারা একটু বড় হলে প্রত্যেক বছর ঘুরতে যাবি। অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে এনে আমাকে দেখাবি। আমি রেলের পাস পেতাম। তাও সেভাবে ঘুরতে পারিনি। সংসার আমাকে ছাড়েনি। ছেলেটার মাথা গোঁজার জন্য বাড়িঘর করে দিতে হবে সেই চিন্তা রয়েছে। বাবাইয়ের বাবার ব্যবসায় মন্দা, বাড়ির কাজ, ব্যাঙ্কের লোন, জমির দলিলটা ব্যাঙ্ক থেকে ঘরে আনতেই হবে... সবদিক গোছাতে গিয়ে বয়স হয়ে গেল। রোগে ধরে গেল। হাঁটু-কোমর পড়ে গেল। ইচ্ছে মরে গেল। আর সময়ও ফুরিয়ে গেল। বাইরে কোথাও বেড়াতে যেতে পারলাম না। আমি নিজের যে স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারিনি, তুই বাবাইয়ের সঙ্গে সেগুলো সব সত্যি করে নিস। আমি যেখানে বাধা পেয়ে আটকে গিয়েছিলাম, তোরা সেগুলো অতিক্রম করছিস দেখলে আমি একটু মানসিক শান্তি পাব।
-দাঁড়াও মা! ওরা একটু বড় হোক, আমি তোমাকে আর বাবাকে ট্রিপে পাঠাব। একটু সময় দাও আমায়...
-সময়েরটা সময়ে হয়নি। এখন আর ইচ্ছেও করে না, ভালোও লাগে না। দু'পা হাঁটতে গেলে এদিক ব্যাথা, ওদিক ব্যাথা! ডাক্তার, রাজ্যের ওষুধ! আমি নাকি ঘুরতে যাব! দূর! এখন আমার সোনু আর নিমিই সব। ওদের একটু বড় করে দিতে পারলেই আমার শান্তি! ঐ যে, তোর মাণিকজোড় পুটপুট করে চাইছে। ট্যা করে ঠেলে উঠল ব'লে! তোর মা আর মুক্তা রুটি করছে দেখলাম। তুই যা, গরম গরম রুটি তরকারি খেয়ে আয়। ততক্ষণ আমি ওদের সামলাচ্ছি। এরপর সারারাত পালা করে জাগতে হবে। তুই খেয়ে পিঠ-কোমর একটু টান করে নে। তারপর রাজপুত্র আর রাজকন্যা ম্যারাথন দৌড়ের প্রস্তুতি নিতে সারারাত হাত-পা ছুঁড়ে ব্যায়াম করবেন! ওদের পাহারা দিয়ে বসে থাকতে হবে। গল্প করতে পারলে আমারও সময়ের হিসেব থাকে না। নিজের বয়স হচ্ছে বুঝতে পারছি। খেয়ে আয় রে মেয়ে। রাত হয়ে গেল কত...
সন্দেশ ও নিমকির জন্মের পর চয়নের সঙ্গে জীবনের অন্যতম সুন্দর রাত্রিযাপন করল জাহ্নবী। দীর্ঘদিন পর ও চোখের কোলে কাজল টেনেছে। চয়নের মায়ের দেওয়া নতুন জামা পরে মনের মতো করে সেজেছে। আজকের রাতের প্রত্যেকটা মুহূর্ত যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। মোমবাতির স্বল্প আলোয় চয়নকে স্বপ্নের রাজপুত্রের মতো লাগছিল। জাহ্নবীর হাতে হাত রেখে ওর দিকে একটা লাল রংয়ের লম্বা বাক্স এগিয়ে দিল চয়ন। জাহ্নবী ওটা খুলে দেখল ভিতরে সোনার সরু চেনের সঙ্গে 'Janu' নামাঙ্কিত একটা ছোট লকেট রয়েছে। অবাক হয়ে জাহ্নবী বলল,
-হঠাৎ গিফ্ট?
-পছন্দ?
-ভীষণ!
-বিলেটেড হ্যাপি বার্থডে মম্মি!
-থ্যাঙ্কু! কিন্তু চয়ন, আজ আমার বার্থডে নয় । কয়েকদিন আগেও পেরিয়ে যায়নি। তবে?
-কয়েকমাস আগে পেরিয়ে গেছে। যেদিন তুমি প্রথম মা হলে সেদিন মম্মি জানুর জন্ম হল। এটা অনেক আগে তৈরি করে রেখেছিলাম। যেদিন তোমাদের হসপিটাল থেকে বাড়িতে আনলাম, সেদিন দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু সোসাইটির বাইরে তোমার মাথা ঘুরে গেছে শুনে আমি এমন হুড়োহুড়ি করে সেবার বেরিয়ে এসেছি, এটা সঙ্গে নিয়ে আসা হয়নি। তারপর আমাদের চ্যাম্পিয়নদের এতই ধৈর্যের অভাব, ওরাও হুড়মুড় করে সময়ের আগে বেরিয়ে পড়ল। তুমি ফ্ল্যাটে আসার পর চারদিকে এত লোকজন, সবার মাঝে দিতে ইচ্ছে হয়নি। ভেবেছিলাম তোমাকে নিয়ে একটু আলাদাভাবে সময় কাটিয়ে একান্তে এটা উপহার দেব। আজই সেই দিন! ডিনার প্ল্যানটা সেইজন্যই করি। পরিয়ে দিই?
অন্ধকারের মধ্যে আবছা নীল আলো, মোমবাতির শিখা, সমধুর সংগীতের অন্তরা, সুস্বাদু খাবার আর পারিবারিক কোলাহলের বাইরে একান্তে চয়নের সঙ্গলাভ, সব মিলিয়ে একটি পরিপাটি সুখসন্ধ্যার স্মৃতি বুকে নিয়ে চয়নের হাত ধরে লিফটে ঢুকল জাহ্নবী। জোড় কিংবা বিজোড় মাসে পৃথকভাবে সন্দেশ ও নিমকির অন্নপ্রাশনের চিন্তা, দাম্পত্য আলোচনার মাধ্যমে অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠান স্থগিত রেখে সরাসরি প্রথম বছর সন্দেশ-নিমকির জন্মদিন উদযাপনের ভাবনা, একাধিক কোম্পানিতে জাহ্নবীর চাকরির ইন্টারভিউ.... সবকিছুকে অতিক্রম করে নিজেরই অজান্তে বারংবার নিজের গলার নতুন চেনে আঙুল জড়িয়ে ফেলছে জাহ্নবী। লিফট থেকে বেরিয়ে ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছে চয়ন বলল,
-এত পছন্দ হয়েছে? হাতের সঙ্গে ওটাকে পেঁচিয়েই চলেছ!
-খুব সুন্দর হয়েছে এটা!
-লাস্ট এক ঘন্টায় এই কথাটা অন্তত একশোবার শুনলাম।
-দুটো বাচ্চা, সামনে এত খরচ বাড়বে। এর মধ্যে হঠাৎ করে...
-যে হিসেবী বৌ আমার এতগুলো টাকা বাঁচিয়ে দিয়েছে, সেই সাশ্রয়ী বৌয়ের জন্য এটুকু করতেই হয়।
-আমি আবার কখন তোমার টাকা বাঁচালাম?
ডোরবেল বাজিয়ে গলা নামিয়ে মৃদুস্বরে চয়ন বলল,
-যা হওয়ার সব একবারে হয়ে গেছে। ঝামেলা শেষ। দু'বার ডেলিভারির খরচ নেই। অন্যান্য মায়েরা যেটা করার জন্য খুব কম করে হলেও অন্তত দু'বছর সময় নেবে, তুমি সেটা ন'মাসে করে দেখিয়েছ। আর সবচেয়ে বড় কথা হল...
-কী?
একগাল হাসি নিয়ে চোখ টিপে চয়ন বলল,
-আমার দু'বার উপোস নেই! উফ জানু! উপোসের কতদিন যে হয়ে গেল, সেই হিসেব আছে?
পিঠের ওপর দু'ঘা কিল-ঘুষি খেয়ে হাসতে হাসতে জাহ্নবীর কাঁধে হাত রেখে ওকে জড়িয়ে ধরল চয়ন। দরজা খুলে মুক্তা দৃষ্টি নামিয়ে নিল। জাহ্নবী জিজ্ঞাসা করল,
-বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে মুক্তা?
-সন্দেশ ঘুমিয়ে গেছে। নিমকি তোমার মায়ের কোলে খেলা করছে।
নিজের ব্যস্ততা ও দাম্পত্যসুখে মগ্ন হয়ে থাকা জাহ্নবী লক্ষ্য করল না, মুক্তা আগের মতো মন খুলে কর্কশ স্বরে কথা বলে না, হাসে না। কোনও এক অজানা কারণে ও একেবারে চুপ করে গেছে। ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে পিছন ফিরল মুক্তা। চয়ন ও জাহ্নবীর আলগা আলিঙ্গনের দিকে নিবদ্ধ ওর শীতল দৃষ্টি। চয়নের পুরুষালী হাত তখন বেষ্টন করে রয়েছে জাহ্নবীর কাঁধ।
***************
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত

 

শুক্রবার, ৭ এপ্রিল, ২০২৩

স্বপ্ন হলেও সত্যি (দ্বিতীয় পর্ব)



স্বপ্ন হলেও সত্যি

সাথী দাস

দ্বিতীয় পর্ব

 



নবদাম্পত্যে দূরত্ব বড় বিড়ম্বনার। কিন্তু দূরত্বের কারণে চয়ন ও জাহ্নবী কখনো নিজেদের দাম্পত্যসুখ থেকে বঞ্চিত করেনি। ফ্ল্যাটের প্রিয় জানলার কোণে অমাবস্যার অন্ধকার রাত্রি ফোন হাতে নিয়ে একাকী কাটিয়ে দেওয়ার পর, পরবর্তী পূর্ণিমা রজনী জাহ্নবী কাটিয়েছে চয়নের ছোট ভাড়াবাড়িতে। সপ্তাহান্তে কিংবা এক পক্ষকাল শেষে যখন দু'জন মুখোমুখি হয়েছে, যাতায়াতের ক্লান্তি ও পথশ্রম মুহূর্তে ঘুচে গেছে। এই দু'বছরে নিজের ছোট ফ্ল্যাটে মনের মতো করে আলাদা জগৎ সাজিয়ে নিয়েছিল জাহ্নবী। আজন্মকালব্যাপী যে বাড়ির অন্দরমহলে জাহ্নবী বড় হয়েছে, সেই বাড়িতে ওর কোনোদিন মন বসেনি। শৈশবে বাড়ির একটা নির্দিষ্ট কোণ, তুলসীমঞ্চ কিংবা পাশবালিশের আলিঙ্গন পছন্দ হলেও, পরবর্তীকালে ও বুঝতে পারে ঐ বাড়ি ওকে ভবিষ্যতে উত্তরাধিকার সূত্রে নিশ্চয়তা প্রদান করলেও, মানসিক তৃপ্তি দিতে অক্ষম। পেনশনভোগী বাবা ও মায়ের ভবিষ্যৎ কিংবা শেষ জীবনের সঞ্চয় নিয়ে সুবিশাল চিন্তার ভার ওর মাথায় ছিল না। ফলে কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর জাহ্নবীর নিজস্ব ঠিকানার অন্বেষণ শুরু হয়। পরমানন্দের সুবিশাল দ্বিতল বাড়ি থাকা সত্ত্বেও আবার ফ্ল্যাট কেনার মতো বিলাসিতার কারণে সেই সময় বেশ কয়েক মাস ভারতী ও জাহ্নবীর মুখ দেখাদেখি প্রায় বন্ধ ছিল। তবে পরমানন্দ জাহ্নবীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। জন্মদাতাকে পাশে পেয়ে কন্যার মনের জোর বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছিল।
সুখী দাম্পত্যজীবন উপভোগের মুহূর্তে চয়নের প্রত্যেকটি কথার মর্যাদা রাখার চেষ্টা জাহ্নবী করত। কারও প্রতি সাধ্যাতীত আবেগ ও কর্তব্য বিলিয়ে দিত না। বিনিময়ে কিছু আশাও রাখত না। যদিও এই আশা-প্রত্যাশা, কল্পনার বেড়াজাল ভেঙে জাহ্নবী নিজেকে কৈশোরেই মুক্তি দিয়েছিল। সমস্ত নৈতিকতা ও সাংসারিক কর্তব্যকে অতিক্রম করে ওরা গ্রন্থিবন্ধন করেছিল। অফিস ফেরত জাহ্নবী কোনোদিন পৌঁছে যেত নিজের শ্বশুরবাড়িতে। আবার কোনও একদিন খবর না দিয়ে ক্লান্ত সন্ধ্যায় হঠাৎই মায়ের বাড়ি গিয়ে নিঃসঙ্গ মায়ের সঙ্গী হয়ে উঠত। যেহেতু জাহ্নবী জানত ও নিজেও পারফেক্ট নয়; এই পৃথিবীর কোনও কিছু পারফেক্ট হতে পারে না, তাই অপর দিকের মানুষগুলোর কাছ থেকে দেওয়া ছোটখাটো আঘাত, কটুকথা কিংবা জটিল পরিস্থিতি ওকে তেমনভাবে বিব্রত করতে পারত না। জীবন ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রতি অভিযোগও ছিল নিতান্তই স্বল্প। ওর কাছে অসহনীয় শব্দ কেবল একটাই, অপেক্ষা। চয়নের কাছে যাওয়ার কিংবা চয়নের ফেরার অপেক্ষা। কিন্তু সেই অপেক্ষা যে কতখানি মধুর হতে পারে, সেটা জাহ্নবী প্রথম উপলব্ধি করল যখন বিবাহিত জীবনের দুটি অম্লমধুর বছর পেরিয়ে আসার পর ওর গর্ভে একটি নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটে। অপেক্ষার আর মাত্র কয়েকটা মাস...
আল্ট্রাসনোগ্রাফির পর চয়ন ও জাহ্নবীর আনন্দের কোনও সীমা রইল না। জাহ্নবী যমজ সন্তানের মা হতে চলেছে, এই সুসংবাদে দুই পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের মনের মধ্যেও খুশির হাওয়া বয়ে গেল। সপ্তম মাস অতিক্রম করার পর একটি ছুটির দিনে মধ্যাহ্নভোজনের শেষে চয়নের বুকে মাথা রেখে জাহ্নবী বলল,
-ভয় করছে চয়ন।
-কেন?
-যদি সবকিছু হিসেব অনুযায়ী না হয়! এত বড় দায়িত্ব!
-আমি আছি, ভয়ের কিছু নেই। সেন্টারে ফোন করে দিয়েছি। সব ব্যবস্থা হয়েছে। আজ বিকেলে ওরা লোক পাঠাবে। এখন আমি আছি। কথাবার্তা বলে দেখেশুনে নেব।
-কাজ ছাড়তে বলবে না?
-তোমার ইচ্ছে হলে, তুমি পারলে কাজ করবে, না পারলে করবে না। শরীর পারমিট করারও একটা ব্যাপার আছে। একসঙ্গে দুটো বেবি। এত ধকল তোমার শরীর নিতে পারবে?
-শরীর নিয়ে নেবে। কিন্তু মন পারবে না। এখনই অতিরিক্ত ভাবনা-চিন্তায় ডিপ্রেসড হয়ে যাই। পোস্টপার্টম ডিপ্রেশনে ভোগার চেয়ে কাজের মধ্যে থাকা অনেক ভালো। ব্যস্ততা না থাকলে জীবন আমার কাছে অর্থহীন লাগে। কয়েক মাসের জন্য ওয়ার্ক ফ্রম হোম নেব ভাবছি। বাচ্চাদের কাছাকাছি থাকতে পারব, আবার কাজের মধ্যেও থাকব। ভালো হবে না?
-তোমার কেরিয়ার নিয়ে আমি কী বলব? যেটা তোমার ভালো লাগবে, সেটাই করো। দূর থেকে আমি যেটা করতে পারি, সেটাই করছি। তোমার আর বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য লোক রেখে দিচ্ছি। চব্বিশ ঘন্টা সে তোমাদের সার্ভিস দেবে। আরও কিছু চাইলে বলো? তার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে।
-আমার অনেক স্বপ্ন আছে চয়ন। তোমাকে সব বলব। এই ফ্ল্যাটের লোনটা প্রায় শোধ হয়ে এলো। এবার আর একটা স্বপ্নপূরণের পালা। শুধু তোমাকে পাশে চাই। আর কিচ্ছু চাই না...
অলস দুপুরে নিভৃত দাম্পত্য আলাপের মধ্যে বেয়াড়ার মতো ফ্ল্যাটের ডোরবেল বেজে উঠল। দরজা খুলে চয়ন দেখল একটি পূর্ণযৌবনা মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যার বয়স কুড়ি অথবা বাইশের ঊর্ধ্বে নয়। চয়ন জিজ্ঞাসা করল,
-আপনি?
-আমি মুক্তা গো দাদা। আয়া সেন্টার থেকে আসছি। বৌদি কোথায়? বৌদি পোয়াতি আমি জানি গো! তুমি কিচ্ছুটি ভাববে না। আমি একেবারে নিজের মতো করে ঘরের সব কাজ করব। বৌদিকে কোনও কাজ করতে...
প্রথম দর্শনে মুক্তার এই প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলার স্বভাব এবং কর্কশ কণ্ঠ থেকে নির্গত সপ্তমে চড়ে থাকা সুরের মূর্ছনায় যারপরনাই বিব্রত হয়ে স্বল্পভাষী চয়ন বলল,
-আপনি প্লিজ ভিতরে আসুন। এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কথা বলবেন না।
প্রায় মাসখানেক সময় পুত্রবধূর কাছে কাটিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে গিয়েছেন চয়নের বাবা ও মা। একমাত্র কন্যার দেখাশোনার জন্য ভারতী নিজের সংসার ফেলে গোপালকে সঙ্গে নিয়ে এক সপ্তাহ আগে পৌঁছেছেন জাহ্নবীর ফ্ল্যাটে। এখন জাহ্নবীর সর্বক্ষণের সঙ্গী হল ভারতী, মুক্তা এবং গোটা ফ্ল্যাট কাঁপিয়ে দেওয়া মুক্তার ঘড়ঘড়ে কন্ঠস্বর। পাশের ঘরটা জাহ্নবীর মনের মতো করে সাজিয়ে দিচ্ছে চয়ন। সিলিংয়ে আঁকা হয়েছে সমগ্র সৌরজগৎ। দেওয়ালে ইংরেজি ও বাংলা ভাষার অজস্র বর্ণমালা ছড়িয়ে রয়েছে। জিরাফের কানের ওপর বসে রয়েছে একটা সংখ্যা, আর একটি সংখ্যা জেব্রার লেজ ধরে ঝুলছে। গাছের ডালে বাঁদরের লেজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সংখ্যার ওপর তুলি দিয়ে একমনে রং করছিল চয়ন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গালে রং মেখে তুলি নিয়ে কারসাজি করতে থাকা চয়নের দিকে চেয়ে জাহ্নবী হাসিমুখে বলল,
-দুটো ছোট মশারি কিনতে হবে।
-মা যে বললেন, বেবি হওয়ার আগে কিছু কিনতে নেই।
-আমার মা ওইরকমই, সব কিছুতে বাধা দেবে। এই ফ্ল্যাটটাও মা চায়নি। আটকাতে পেরেছে আমাকে? মা যা খুশি বলুক। আমাদেরই সব গুছিয়ে রাখতে হবে। শেষ মুহূর্তে দৌড়ঝাঁপ না করে আগে থেকে গুছিয়ে রাখা ভালো। বাচ্চা যখন আমাদের, দায়িত্বও আমাদের। কী আঁকছ তুমি?
-বাঁদরের লেজ। আঁকার শখটা এইবেলা কাজে লেগে গেল বলো? জুনিয়রদের ঘরটা নিজের হাতে প্রায় সাজিয়েই ফেললাম। তুমিও তুলি নাও না! একটা ফুল, পাতা.... তোমার যা মন চায়, তাই এঁকে ফেলো। ওদিকের দেওয়ালটা এখনো ফাঁকা আছে। পরে এগুলো দেখতে ভালো লাগবে। ওরা বড় হয়ে যাবে। কিন্তু আঁকাগুলো দেওয়ালে রয়ে যাবে।
-আমিও বাঁদরের লেজের ওপর ঝুলন্ত সংখ্যা লিখব।
-জানু এত হাইট! সিঁড়ি যদি স্লিপ করে!
-তুমি ধরবে। আমি পারব। একটু ধরো আমাকে।
-আচ্ছা এসো। সাবধানে...
সিঁড়ির ওপর উঠে একমনে বাঁদরের লেজে রং করছিল জাহ্নবী। একহাতে সিঁড়ি আর অপরহাতে জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরে একদৃষ্টে ওর দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়েছিল চয়ন। ক্লান্তির ছাপ জাহ্নবীর চোখে স্পষ্ট। দেহের ওজন বৃদ্ধি পেয়েছে অত্যধিক মাত্রায়। চোখের কোলের গাঢ় কালি দেখলে বড় মায়া হয়। কিন্তু ঈষৎ স্ফীত গালদুটোতে আদর উজাড় করে দিতে ইচ্ছে করে। জাহ্নবীর মা ওর মাথায় তেল দিয়ে যত্ন করে চুল বেঁধে দিয়েছে। তৈলাক্ত সিঁথিতে একবিন্দু সিঁদুর ঘেঁটে রয়েছে। কপালের লাল টিপটা যেন অস্তমিত সূর্যের মতো সুন্দর। ওর চুল থেকে জুঁইফুলের সুবাস ভেসে আসছে। মৃদুস্বরে ডাকল চয়ন,
-জানু?
-উম?
-তোমার ঠোঁটটা একদম শুকিয়ে গেছে।
-বুঝে গেছি, এখন হবে না। আমি লেজ আঁকছি।
ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি এঁকে আবার বাঁদরের লেজে মনঃসংযোগ করল জাহ্নবী। হঠাৎ ওর হাত কেঁপে গেল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মুক্তার পরিত্রাহি চিৎকারে।
-ও মাসিমা, তোমার মেয়ের কীর্তি দেখে যাও গো! সিঁড়ির ওপর উঠে দেয়াল রং করছে। যদি একটা অঘটন...
ভারতী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে একদৌড়ে ঘরে ঢুকে চয়নকে দেখে বিরক্ত হয়ে গেল। বেশ রাগতস্বরেই বলল,
-এত মাথায় তুলো না চয়ন। ও মেয়ের জেদ তুমি জানো না! যা বলছে তাই করছ, এরপর যখন বাড়াবাড়ি শুরু করবে আর সামলাতে পারবে না। তখন আমাকে দোষ দিও না। আর তুই কোন আক্কেলে এই অবস্থায় সিঁড়ির ওপর চড়ে বসলি রে? তুমি ওকে বারণ না করে আরও উৎসাহ দিচ্ছ চয়ন? হোক একটা অঘটন! সব ছেড়ে আমি চলে যাব। একটা কথাও যদি আমার মেয়েটা শোনে গোপাল.... সঙ্গে বরটাও জুটেছে তেমন!
প্রায় কোলে তুলে জাহ্নবীকে সিঁড়ি থেকে নামিয়ে আনল চয়ন। লজ্জায় সরে গেলেন ভারতী। রান্নাঘর থেকে তিনি একনাগাড়ে বকবক করে চলেছেন। চয়নের গলা জড়িয়ে ধরে জাহ্নবী হেসে ফেলল। স্বামী পরিত্যক্তা মুক্তা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে চয়নের দিকে। জাহ্নবীর এত সুখ অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো ওর হৃদয় পুড়িয়ে দিল।
আবাসনের প্রতিবেশীদের বাঁকা দৃষ্টি, অযথা উপদেশ, ভারতীর নিষেধ উপেক্ষা করে এতদিন অফিসে গিয়েছিল জাহ্নবী। কিন্তু এই অন্তিম মাসে ওর দৈহিক মানচিত্রে অজস্র পরিবর্তন ঘটে গেছে। বিপুলাকার দেহটাকে টেনে ও সাবলীলভাবে চলতে-ফিরতে পারে না। আজ অফিসে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসেও শরীরটা বড় খারাপ লাগছিল। নির্ধারিত সময়ের আগে অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছে ও। জ্যৈষ্ঠ মাসের গরমে গলদঘর্ম অবস্থায় ট্যাক্সি থেকে আবাসনের সামনে নামল জাহ্নবী। ছাতা খোলার আগে সূর্যদেবের কৃপাদৃষ্টিতে ওর সমস্ত পৃথিবী হঠাৎ যেন দুলে উঠল। ঝাপসা হয়ে আসা দৃষ্টিতে ও দেখল আবাসনের দারোয়ান অনল কাকা ওর দিকে দৌড়ে আসছে। কয়েকজনের টুকরো কথা ভেসে এলো জাহ্নবীর কানে। "বরটা বাইরে থেকে কী করে কে জানে? আদৌ চাকরি করে তো? কী কাজ করে যে বৌকে এই অবস্থায় বাইরের কাজে পাঠাতে হয়! নাকি ওদিকে আবার কোনও গল্প আছে? লোকটার আর একটা বিয়ে নেই তো?"
"কী জানি বাবা! বৌকে নিজের কাছে নিয়ে যায় না কেন কে জানে.... টাকা-পয়সা সংসারে দ্যায় না? এই অবস্থায় কাজে না বেরোলে কি পেটের ভাত জুটবে না!"
বিছানা ছেড়ে ওঠার ক্ষমতা হারিয়েছে জাহ্নবী। ডাক্তার বাড়িতে এসে ওকে দেখে গেছে। শরীর বড় দুর্বল। চয়নের ফোনের পর ফোন পেয়ে বিরক্ত হয়ে ঘরের মধ্যে একনাগাড়ে বকবক করছিলেন ভারতী। বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে মায়ের বাক্যবাণ হজম করছিল জাহ্নবী। ঘরে পা রেখে জাহ্নবীকে উঠে বসতে দেখে চিৎকার করে ভারতী বলল,
-তুই চাকরি ছাড়বি না? তবে বাচ্চা নিতে গেলি কেন? এরপর কী রাস্তায় পড়ে মরবি?
-মা একটু ঘুমোতে দাও না!
-তুই হওয়ার এক বছরের মধ্যে কোনও চাকরির পরীক্ষায় বসিনি। অপেক্ষা করেছি। যখন তোর পাঁচ বছর বয়স হল, তখন আবার নতুন করে নিজের জীবন শুরু করার কথা চিন্তা করেছিলাম। তার আগে এসব ভাবার সাহসই পাইনি। আর তুই? তোর কাছে কি বাচ্চার জীবনের কোনও দাম নেই?
-চয়ন আসছে?
-বেরিয়ে পড়েছে।
-জানতাম। কেন ওকে সব খবর দিতে যাও মা? মানুষটা দূরে থাকে। অযথা ব্যতিব্যস্ত...
-জানু বাড়িতে ফিরেছে? ও খেয়েছে মা? রাতে ওষুধ খেয়েছে? জানু ঘুমিয়েছে? তুই জেগে থাকলে তোর ফোনে, আর তুই ঘুমিয়ে পড়ার পর আমার ফোনে রোজ ফোন করবে। তাকে জানাব না তোর কীর্তির কথা?
-কী বলল শুনে?
-কিছু বলেনি। ফোন রেখে দিল। আধ ঘন্টা পর ফোন করে বলল, রাতের ট্রেনে আসছে।
-এখন এলে আবার ডেলিভারির সময় আসতে পারবে? জানি নাঃ! খিদে পেয়েছে। কিছু খেতে দেবে মা?
-তোর শ্বশুর-শাশুড়ি আসছে।
-ওদেরও জানিয়েছ? উফ! কী যে করো না তুমি!
-সোসাইটির লোকজন তোকে নিয়ে যেভাবে ঘরে ঢুকল, ভয়ে আমার শরীর কাঁপছিল। কী করব? সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি। কয়েক বছরের জন্য কাজকর্ম ছেড়ে দে না মা! তোর কী টাকার অভাব? তোর বাবার টাকা, আমার টাকা, জামাইয়ের টাকা, সবই তোর। এরপরেও এত জেদ কেন? বাচ্চাদুটো একটু বড় হয়ে গেলে তখন আবার কাজ শুরু করিস। আমি রাখব তোর বাচ্চাকে। রিটায়ার্ড লাইফে আমার আর কাজ কী! তোর ডিগ্রি কোথাও পালিয়ে যাবে না। এখন একটু নিজের যত্ন নে। বাচ্চাদের কথা ভাব।
-ওসব তুমি বুঝবে না মা।
-আমি আমার মেয়েকে বুঝব না? তোকে পেটে ধরেছি আমি। ঠিক বুঝব। তুই বল আমাকে। কী হয়েছে তোর? জামাইয়ের সঙ্গে টাকা নিয়ে অশান্তি হয়েছে? সেই জন্য চাকরি করতে চাইছিস?
-না, কক্ষনো না। চাওয়ার আগেই ও সব হাজির করে দেয়।
-তবে? তুই টাকার পিছনে এভাবে হন্যে হয়ে ছুটছিস কেন?
-টাকা-পয়সার ব্যাপার তো আছেই। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হল, আমি আমার বাচ্চাকে ছাড়তে পারছি না।
-তোর বাচ্চা মানে?
-একদম ছোট থেকে যে শিক্ষা অর্জন করেছি, যাকে নিজের মধ্যে প্রতিপালন করেছি, যে ডিগ্রি ভাঙিয়ে চাকরি পেয়েছি.... আমার সেই শিক্ষা, সেই কর্মজীবন আমার সন্তানের থেকে কোনও অংশে কম নয়। তুমি দেখছ একদিকে আমার দুটো বাচ্চা, আর একদিকে চাকরি। আমি দেখতে পাচ্ছি তিনটেই আমার সন্তান। আমি মা হয়ে একটা বাচ্চার জন্য আর একটা বাচ্চার হাত ছেড়ে দেব? যাকে ছোট থেকে এত কষ্ট করে বড় করেছি, তাকে ত্যাগ করব? নাকি মা হয়ে কীভাবে তিনজনকে একসঙ্গে ব্যালেন্স করে মানুষ করা যায়, সমানভাবে ভালোবাসা যায়, সেই চিন্তা করব! আমার এক-একটা মার্কশিট, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারগুলো আমার কাছে সন্তানতুল্য। অনেক রাত জেগেছি ওদের জন্য। অনেক পরিশ্রম করেছি। ওদের ওপর মায়া পড়ে গেছে। ঐ কাগজের টুকরোগুলোতে ধুলো পড়তে দেখলে আমার কষ্ট হয়। আমার জন্য তোমাকেও তো কতরাত জাগতে হয়েছে মা, সেইসব রাতের গল্প তোমার মুখে বড় হয়ে অনেকবার শুনেছি। তুমি আমাকে পড়তে দেখেছ, আমার সঙ্গে রাত জেগে আমাকে পড়িয়েছ। নিজের হাতে আমাকে তৈরি করেছ। আমার সাফল্যের তুমিও সমান অংশীদার! মায়া হয় না মার্কশিটগুলোর জন্য? তোমার শো-কেসে সাজিয়ে রাখা আমার ট্রফিগুলোর জন্য? কীভাবে বলছ, প্রথম সন্তানকে ছেড়ে কেবল পরের দুটোকে নিয়ে আনন্দ কর! এটা বলতে পারলে বলেই তোমাকে বললাম, তুমি বুঝবে না। চয়ন ঠিকই বলে। একই মায়ের গর্ভে জন্মানো ভাই-বোনের ভাবনার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থাকে। মতের অমিল হয়। আমি আজ জানলাম, মা আর সন্তানের মধ্যেও মতানৈক্য হতে পারে। তুমি ঠিক আমার মতো করে ভাবতে পারবে না। যেহেতু ভাবতে পারবে না, তাই বুঝতেও পারবে না। আমি আশাও করি না। আজ চাকরি ছেড়ে দেওয়াই যায়। কিন্তু কাল যদি তোমার মতো করে দ্বিতীয়বার শুরু করার ইচ্ছেটা আমার মধ্যে না থাকে? সংসার যদি আমাকে চেপে ধরে? যদি বেরোতে না দেয়? কিংবা যদি দুই সন্তানকে বেশি ভালোবেসে ওদের মায়ায় জড়িয়ে প্রথম সন্তানের কাছে আমি ফিরতে না চাই? তখন কী হবে?
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন ভারতী। ওঁর কাছে আর কোনও প্রশ্ন নেই। বোধহয় জাহ্নবীর প্রশ্নের উত্তরও নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃদু হেসে আবদারের সুরে ডেকে উঠল জাহ্নবী,
-ও মা.... আমায় খেতে দেবে না? ফ্রিজে সন্দেশ আছে? একটা দাও না! খিদে পাচ্ছে।
রাত প্রায় আড়াইটে। ভারতীর চোখে ঘুম নেই। চয়নের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় বারংবার ভিজে উঠছিল ওঁর দু'চোখ। ডোরবেলের শব্দ পেয়ে মুক্তা দরজা খুলে দিল। নিজের বাবা-মা ও জাহ্নবীর মায়ের চিন্তান্বিত মুখ অতিক্রম করে সরাসরি নিজের ঘরে ঢুকল চয়ন। বেশ কিছুক্ষণ পর ভারতী ঘরের দরজায় টোকা মেরে ভিতরে ঢুকলেন। সঙ্গে ঢুকলেন চয়নের বাবা-মা। জাহ্নবী ও চয়ন দু'জনের চোখ অশ্রুসিক্ত। চয়নকে ভেঙে পড়তে দেখে ভারতী বলে উঠলেন,
-অনেকবার বলেছিলাম বাড়িতে থাকতে। আমার কথা শোনেনি। এবার তুমি কিছু বলো চয়ন। যদি তোমার কথা শোনে!
-বসুন মা। আপনি দাঁড়িয়ে কেন? বাবা বসো। মাকে বসতে দাও।
-কিছু বলছ না যে?
-কী শুনতে চাইছেন আপনি?
-আমার কথা তো শুনবে না। তুমি ওকে বলো কয়েক মাসের জন্য অন্তত...
-বলেছি। ডেলিভারি না হওয়া পর্যন্ত বাড়িতে থেকে কাজ করবে বলেছে। আমি দু'দিন ছুটি নিয়ে এসেছি। কাল ওকে অফিসে নিয়ে যাব। সব কথাবার্তা বলে পুরো সেট আপ এই ঘরে...
-বাচ্চাদুটো বড় হওয়ার পর আবার জয়েন করলে...
হেসে ফেলল চয়ন। নিজের বাবার দিকে চেয়ে বলল,
-বাবা আমি জানুর খবরটা শুনে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভেঙে পড়িনি। তুমি আমাকে ভুল বুঝো না।
-জানি, তুই আমার ছেলে।
হতবাক ভারতীর মুখের দিকে চেয়ে চয়ন বলল,
-যে ভদ্রমহিলা আপনার সামনে বসে রয়েছে, জানেন সে কে?
-তোমার মা!
-তার পাশে?
-তোমার বাবা।
-ঠিক। মা এবার আপনাকে প্রায় বত্রিশ বছর আগের একটা গল্প বলি। একটু মন দিয়ে শুনুন। একটা বাচ্চা কেঁদেকেটে মেঝেতে শুয়ে গড়াগড়ি খেয়ে কঁকিয়ে যাচ্ছে। কারও কাছে সেই শিশু থাকতে চায় না। তার মাকেই চাই। কিন্তু তার মা রেলে চাকরি করেন। কখনো মাঝরাতে, কখনো শেষরাতে বেরিয়ে যান। দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে দুধের শিশুকে বিছানায় ফেলে উঠে পড়ে তার মা। আর সেই বাচ্চা মাঝরাত থেকে চিৎকার করে বাড়ির সকলের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। যতক্ষণ পর্যন্ত কাঁদতে কাঁদতে তার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ না হচ্ছে, ততক্ষণই সে কাঁদে! তাকে বাড়িতে ফেলে, তার হাতের মুঠো থেকে শাড়ির আঁচল টেনে বের করে চোখের জল চোখে চেপে রেখে কাঁদতে-কাঁদতে বুকে পাথর চাপা দিয়ে তার মা প্রতিদিন বেরিয়ে যায়। বাবার একান্নবর্তী পরিবার। পারিবারিক ব্যবসা আছে। বাজারে চালের আড়ত আছে, মাছের ভেড়ি আছে। টাকার অভাব নেই। তাও সেই মা প্রতিদিন তার প্রথম সন্তানের টানে ঘর ছাড়ে। আর বাবা চুপ করে দেখে। নিজের মায়ের কটূক্তি, বাড়ির অন্যান্য বৌদের গঞ্জনা শুনে দুধের শিশুকে বুকে নিয়ে রাতের পর রাত কাটায় সেই বাবা। এই কারণে এককালে তার কপালে স্ত্রৈণ তকমাও জুটে গিয়েছিল বৈকি! তারপর কী হল জানেন মা?
চয়নের মা প্রায় রুদ্ধকণ্ঠে বললেন,
-সেই বাচ্চাটা একদিন কাঁদল। চোখের কাজল ঘেঁটে কপালের টিপ নষ্ট করে ফেলল। দু'দিন কাঁদল। শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসে গেল। অসহায় বাবা ব্যবসা ছেড়ে, দোকান ফেলে বাচ্চাকে নিয়ে ঘরে বসে রইল। ডাক্তারখানা আর বাড়ি.... এভাবে একটা গোটা সপ্তাহ সেই অসুস্থ বাচ্চাটা কাঁদল। দ্বিতীয় সপ্তাহে কাঁদতে কাঁদতে সে বুঝে গেল তার মাকে বেরোতেই হবে। বেশ অনেকক্ষণ মাকে না দেখে থাকতেই হবে। সেটা বুঝে যাওয়ামাত্র তার কান্না গেল বন্ধ হয়ে। তারপর সে বড় হল। তৈরি হয়ে বেরোনোর সময় মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের গায়ের গন্ধটা প্রাণভরে নিয়ে সে আবদার করে বলত, আমার জন্য আজ কী আনবে মা? কাল বাড়ি এসে নতুন গল্প বলবে তো? স্টেশনের বাচ্চাটাকে তুমি যে নতুন জামাটা দিয়েছিলে, সেটা ও পরেছে? ছেঁড়া জামা পরা পাগলটা আজ চায়ে ডুবিয়ে বিস্কুট খেয়েছে? কত প্রশ্ন তার।
ভারতীর দিকে চেয়ে চয়ন বলল,
-বাচ্চাটা মায়ের চোখ দিয়ে পৃথিবীটাকে নতুন করে দেখতে শুরু করল। মানুষকে চিনতে শুরু করল। বাড়ি ফেরার পর মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে খোঁজ নিতে শুরু করল স্টেশন চত্বরে ঘুরতে থাকা কুকুরটার গায়ের ঘা শুকিয়েছে কিনা! মা খেয়েছে তো? মা হয়ে উঠল তার জীবনের একমাত্র তার গল্পের ঝুলি। সে জানত মা বাড়িতে ঢুকলে তার ব্যাগ থেকে বেরোবে স্টেশন থেকে কিনে আনা রঙিন ছবির বই, রংচঙে গল্পের বই, কমিকস, একটু বড় হওয়ার পর ম্যাগাজিন। সব থেমে গেল একদিন। কটূক্তি, উপহাস! যেটা বাড়ল সেটা হল মায়ের বেতন। আর বেতনের সঙ্গে ছেলের আবদারও বেড়ে চলল। স্টেশন থেকে কিনে আনা বইগুলো দিয়ে সেই স্ত্রৈণ বাবা তাদের নতুন বাড়ির দেওয়ালে একটা মিনি লাইব্রেরি তৈরি করেছে।
চয়নের মা চোখের জল আড়াল করতে না পেরে চোখ মুছে উঠে গেলেন জাহ্নবীর পাশে। জাহ্নবী একটু হেসে তাঁকে বসার জায়গা করে দিল। ভারতীর দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জাহ্নবীর দিকে চেয়ে চয়ন বলল,
-সেইদিনের সেই কেঁদে গড়াগড়ি খাওয়া ছেলেটা বড় হয়ে আজকের চয়ন তৈরি হল। এই উপসংহারটা এখন যতটা সহজ আর সুন্দর দেখতে লাগছে, যাত্রাপথটা ততটাও মসৃণ ছিল না। আমার দুধ গরম করার জন্য, নিজের ক্ষুন্নিবৃত্তির কারণে আমার বাবাকে সময়ে-অসময়ে আপনাদের মেয়েমহল মানে রান্নাঘরে ঢুকতে হত। বাড়ির ছোট বৌ ভাসুরের সঙ্গে এক রান্নাঘরে কাজ করতে পারত না। বাড়ির বড় বৌ অসন্তুষ্ট হত। চাপা অশান্তি, বিবাদ! সংসার ভিন্ন হল। ব্যবসা ভাগ হল। বড় ভাইয়ের ভাগে মাছের ভেড়ি, আমার বাবার ভাগে চালের আড়ত, ছোট ভাইয়ের ভাগে কেরোসিনের ডিলারশিপ আর এসটিডি বুথ যেটা পরবর্তীতেকালে গ্রসারি শপ হয়েছে। আপনি আমার বাড়ি দেখতে যাওয়ার সময় সেই সবই দেখেছেন মা। আমার বাড়ির সকলের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। কিন্তু বাড়ির ভিতরের যে গল্পগুলো আপনি জানেন না, আজ সেগুলোই বলছি। সংসার ভিন্ন করেও আমার বাবা অশান্তি থেকে অব্যাহতি পায়নি। তারপর মাঝরাতে পাম্পের স্টোভ ধরানোর জন্য বাড়ির অন্য ঘরে ঘুমিয়ে থাকা মানুষদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটত। সারাদিন ধরে আরও অনেক অশান্তি। শেষ পর্যন্ত বাড়িটাও ছাড়ল আমার স্বল্পশিক্ষিত বাবা। আমার বাবার চেয়ে মায়ের পুঁথিগত বিদ্যের জোর বেশি। কিন্তু ওদের সঙ্গে থেকে আমার কোনোদিন সেটা মনে হয়নি। বাবাকে দেখে শিখেছি কীভাবে খারাপ পরিস্থিতিতেও স্ত্রীর পাশে থাকতে হয়। মা রোদে পুড়ে ভাড়াবাড়ির সিঁড়িতে পা রাখলে বাবা ঘরের পাখা চালিয়ে দিত। কুঁজোর ঠান্ডা জল হাতের সামনে গুছিয়ে রাখত। আমি এগুলো দেখেই বড় হয়েছি।
-দিদি আমি নিজের হাতে আমার ছেলের দেখাশোনা করতে পারিনি। ওর খাওয়াদাওয়া, ময়লা জামাকাপড় কাচা, স্নানের পর চুল আঁচড়ে দেওয়া, ওর ছোট-বড় যত প্রয়োজন, সব ওর বাবা দেখেছে। আমি যখন বাড়ি ফিরতাম ওরা বাপ-ব্যাটা মিলে পোড়া রুটি করে রাখত। আমরা সবাই তাই খেতাম। ছেলেটাও এগুলো খাচ্ছে ভেবে আমার খুব কষ্ট হত, মাঝে মধ্যে কেঁদে ফেলতাম। একদিন ওর বাবা আমাকে একটা কথা বলেছিল। ছেলে কী খাচ্ছে, কী পরছে সেটা দেখার চেয়েও ও কী দেখছে, কী বুঝছে আর কী শিখছে, সেটার দিকে নজর দেওয়া বেশি প্রয়োজন। আমাদেরও দিন ফিরবে। আমরাও রান্না শিখে যাব। কিন্তু ওর মনে একবার যে শিক্ষা ঢুকে যাবে, সেটাই ও সারাজীবন মেনে চলবে। তাই ওটার দিকে আগে মন দাও। যেমন চলছে চলতে দাও। নিজের হাতে রান্না করে সাজিয়ে-গুছিয়ে সন্তানকে তিনবেলা খেতে দেওয়ার জন্য সারাজীবন সময় পাবে। কিন্তু ওর শিকড় তৈরি করার সময়টা পাবে না। ওর বাবার এই কথাটা শোনার পর আমি আর দুর্বল হয়ে পড়িনি। পিছনে ফিরে চাইনি।
-বাবার দোকানে রাখা চালের বস্তার ওপর আমি স্লিপ খেলতাম। বস্তার মাথায় চড়তাম। বাবার কাছে নামতা শিখতাম। যোগ-বিয়োগটাও বাবা হাতে ধরে শিখিয়েছিল। কিন্তু পরে জীবন আমাকে শিখিয়েছে, কোন মানুষগুলোকে জীবনে যোগ করতে হবে, আর কাদের বিয়োগ! আমি ঐ দোকানে বসে হোমওয়ার্ক করতাম, পড়া মুখস্ত করতাম। সেসব অন্যরকম দিন ছিল। তারপর বাবা-মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে জমি কিনে আমাদের নতুন বাড়িটা তৈরি হল। ওদিকে পুরনো বাড়ি থেকে এলো ভাঙনের খবর। দুই ভাইয়ের সংসার ভিন্ন হয়েছে। আমার ঠাম্মি তখন জ্যেঠু আর কাকার গলগ্রহ। ঠাম্মিকে নিয়ে ঠেলাঠেলি চলছে। বাবা সেই খবর শুনেই ও বাড়িতে গিয়ে হাজির। বলল, "আমার মাকে আমি দেখব, আমিই রাখব।" সেইদিনই ঠাম্মিকে নিয়ে বাবা আমাদের নতুন বাড়িতে চলে আসে। কয়েকদিন পর আসে মুক্তার মতো একজন কাজের মানুষ, পল্লবীদি। ঠাম্মি শেষ জীবনে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন। এই নাতিকে ছাড়া তার একবেলা চলত না। সকালে উঠে তার প্রথম কাজ ছিল, "ও বুড়ো! কোথায় গেলি বাপ আমার...." এভাবে ডেকে আমাকে পাশে বসানো। তারপর আমাকে নিজের কোলে শুইয়ে, আমার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া। ঠাম্মি চলে গেলেন। যাওয়ার আগে মাকে নিজের সবটুকু আশীর্বাদ উজাড় করে গেছেন দেখেছি। তবে পল্লবীদি রয়ে গেছে। আমি মাকে বললাম, তোমাদেরও বয়স হচ্ছে। ওকে রেখে দাও।
-এসব কথা আমার মেয়ে কোনোদিন আমাকে বলেনি। এতকিছু আমি জানতাম না।
-জানু প্রায়ই একটা কথা বলে, আমার মা বুঝবে না। মাকে কিছু বলে লাভ নেই। ও কেন এটা বলে সেটা আপনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে আমার যেটা জানতে ইচ্ছে করে, আপনি কী সত্যিই বুঝতে পারেন না? নাকি বুঝতে চান না? নাকি সবটা বুঝেও অবুঝ হয়ে অন্ধের মতো চোখ বন্ধ করে থাকতে চান! আজ মাথা ঘুরে যাওয়ার আগে জানু শুনেছে সোসাইটির কারা বলেছিল, বরটা ওখানে কী করে! টাকা-পয়সা কিছু দেয় না? তবে ওকে এই অবস্থায় কাজ করতে হচ্ছে কেন! এগুলো বলার সময় জানু খুব কাঁদছিল। ওর কথা শুনে আমার মনে হচ্ছিল, মেয়েদের কাজ করাটা কী অপশনাল? মানে বিপাকে পড়লে পেট চালানোর জন্য বাধ্য হয়ে কাজ করতে হয়? ডেলিভারির আগের দিন পর্যন্ত পেটে বাচ্চা নিয়ে মাথায় ইঁটের বোঝা বইতে হয়? নাকি শখে কাজ করে? আর বিপাকে না পড়লে সংসারের অশান্তির দোহাই দিয়ে হাজার রকম অজুহাত সৃষ্টি করে কর্মহীন অবস্থায় বেঁচে থাকতে হয়? আমার বাড়ির পরিকাঠামো আমাকে সেই শিক্ষা দেয়নি। বোধ-বুদ্ধি হওয়ার আগে থেকেই দেখছি সংসারে অন্নপূর্ণা বিরাজ করেন। এতবড় পারিবারিক ব্যবসা। তাও মা কাজ করছে। আর মায়ের সেই কাজকে ঘিরেই এত অশান্তি! সংসার ভাঙল, বাড়ি আলাদা হল.... কতকিছু। সময় ঠিকই কেটে যায়। দিনও ফেরে। কিন্তু সেই পরজীবী মানুষগুলোর কী হবে, যারা আমাদের দুঃসময়ে নিজেদের চরিত্রটা বুঝিয়ে দিয়েছেন!
-বুঝলাম না ঠিক!
-আমার বড় মা স্বল্পশিক্ষিতা। তবে ছোট মা বিয়ের আগে চাকরি করত। পরে সংসারের অশান্তির ভয়ে আর কাকার কথায় চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার প্রিয় কাজ ছিল আমার মায়ের প্রসঙ্গে বড় জা আর শাশুড়ির মনের চাপা আগুনে ইন্ধন দেওয়া আর জীবনে কিছু না পারার জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলা। আমি আপনার মেয়েকে কাজ করতে একবারও জোর করিনি মা, বারণও করব না। আমার টাকার ওপর আমার বাবা-মায়ের যেমন অধিকার আছে, জানুরও ঠিক ততটাই অধিকার আছে। অসুস্থ হয়ে পড়লে কাজ করবেই বা কীভাবে? সারাজীবন আমি ওকে ভালোবেসে সসম্মানে রাখব। কিন্তু আমার ছোট মায়ের মতো মানুষ, যারা নিজে অশান্তির ভয় পেয়ে নিজের জায়গা ছেড়ে সরে এসে সন্তান আর সংসারের জন্য স্বার্থত্যাগের গল্প তৈরি করে আজীবন জাবর কাটে, নিজেদের ব্যর্থতার জ্বালা কমাতে অন্যের সাফল্যকে ছোট করে পৈশাচিক আনন্দ পায়, সেই রকম পরজীবী প্রাণীদের আমি মানুষের পর্যায়ে ফেলি না। তারা নিজেদের সিদ্ধান্তের মর্যাদা রাখতে পারে না। নিজেরা মানসিক অবসাদের শিকার। সেই নৈরাশ্যের জগৎ থেকে বেরোনোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও এদের মধ্যে নেই। এরা নিজেদের হতাশার জন্য নিজেকে নয়, ভাগ্যকে দায়ী করে। আড়ালে অন্যের পরিশ্রমকে ছোট করে তাদের সৌভাগ্যকে হিংসে করে। আর আমার এমনই দুর্ভাগ্য, যে আমার পরিবারে এবং আমার পরিচিত বৃত্তে এইরকম মানুষের সংখ্যাই বেশি। তাই আমার মন আমাকে এর বাইরে বেরিয়ে ভাবার অনুমতি দেয় না। ব্যতিক্রমী কিছু মানুষ গতানুগতিকতার বিপরীত নিয়মকে প্রমাণ করলেও তারা সংখ্যায় এতটাই কম, যে উদাহরণ দেওয়ার সময় তাদের কথা স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে পাই না। যাদের ছোটবেলা থেকে দেখেছি, জেনেছি, বুঝেছি.... তাদের কথাই আগে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যেদিন সংখ্যাটা উল্টে যাবে, আমিও ভাবনা পাল্টে ফেলব।
-দিদি আমার এই ছোট জা শাশুড়ির শ্রাদ্ধের সময় আমার ঘরে দাঁড়িয়ে বলে গেছে, তুমি করে দেখালে দিদিভাই! তোমার দ্বারাই সম্ভব! আমি তো সংসার সামলে নিজের জন্য পাঁচ মিনিট সময়ও বের করতে পারি না! আমি ওর কথার কোনও উত্তর দিইনি। কিন্তু সব মনে রেখেছি। কেঁদে আমার ছেলেটার গলা শুকিয়ে যেত। যে যার ঘরে বাচ্চা নিয়ে দরজা বন্ধ করে থাকত। আমার শাশুড়ি একটু সেকেলে মানুষ ছিলেন! বৌরা ভাসুরের সামনে যাবে না। ভাসুর ঘরে থাকলে ও ঘরে ঢুকবে না, এসব বলতেন। এসব শুনে ওরাও আর এগিয়ে আসত না। আমার চাকরি করা নিয়ে ও বাড়িতে কম অশান্তি হয়েছে? কেউ ছেলেটাকে একটু দুধও গরম করে দিত না। তারা যা পারেনি, সেটা আমি করেছি! কোথায় একটু সহযোগিতা করবে, বলবে দিদিভাই চাকরি করছে, আমি কেন করব না.... সেটা না করে আরও বাধা দিত। কিছু জিনিস ভুলতে চাইলেও, ভোলা যায় না দিদি। ভাড়ার একটা ছোট ঘর, রেলওয়ে কোয়ার্টার, কতদূর থেকে আপনার দাদা দোকানে আসত। শেষ রাতে উঠতাম আমরা। ছেলেকে ঘুম থেকে টেনে তুলতাম। পেরিয়ে গেছে সেইসব দিন। কিন্তু মানুষ চেনা হয়ে গেছে.... আসলে সংসার আমাদের থেকে নেওয়ার জন্য হাঁ করে বসে আছে। কিন্তু দেওয়ার সময় আমাদের তো হিসেব রাখতে হবে, ঠিক কতটা আমি দেব? সংসার দেখতে গিয়ে নিজের সময়টা ফুরিয়ে যাচ্ছে না তো! পরে কেঁদেও এই সময় ফেরানো যাবে না। তখন অন্যের দিকে চেয়ে হতাশ হয়ে কী লাভ? আমি চাইনি আমার ছেলে ও বাড়ির মতো তৈরি হোক। জোর করেই বেরিয়েছিলাম। না বেরোলে আমার ছেলে কী দেখত? কী শিখত! কেবল বাবা কাজে যায়, মা বাড়িতে থাকে! কিংবা চাকরি ছাড়তে হলে অনিবার্যভাবে মাকেই ছাড়তে হয়? এটাই নিয়ম! সেদিন আমি এই নিয়ম না ভাঙলে আজ আমার বাবাইও একই জিনিস আপনার মেয়ের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত। তবে বাবাইয়ের বাবা আমার পাশে না দাঁড়ালে আমার চরিত্রটাও বোধহয় আমার ছোট জায়ের মতো হয়ে যেত। আমি সফল হতে পারতাম না।
-আজ আমার মা যখন বলে, একজন সফল নারীর পিছনে একজন দায়িত্ববান পুরুষের সবচেয়ে বড় অবদান থাকে, তখন আমার বাবা মাথা নামিয়ে চুপ করে হাসে। লজ্জা পায় বোধহয়। আমার মা সত্যি কথাটা জোর গলায় বলে। কিন্তু আমার ছোট মা সত্যিটা বলতে পারে না। সে বলতে পারে না, একজন নারীর পরাজয়ের পিছনেও সেই পুরুষেরই হাত থাকে। দায়িত্বজ্ঞানহীন পুরুষের। তবে পুরুষ সিংহ বলে আমার কাকার ও পাড়ায় বেশ সুনাম আছে, সে আমার বাবার মতো স্ত্রৈণ নয়।
ভারতী স্তব্ধবাক। চয়ন হেসে বলল,
-এই পুরো গল্পে আমার বাবার চুপ করে থেকে একনিষ্ঠভাবে মাকে সাপোর্ট করে যাওয়া ছাড়া আর কোনও ভূমিকা ছিল না। কিন্তু ঐ সাপোর্টটা পেয়ে আমার মা অসাধ্যসাধন করে ফেলেছে। শেষ পর্যন্ত সবই সুন্দর হয়ে যায়। সবাই সবটা মেনে নেয়। মেনে নিতে না পারলেও অভ্যস্ত হতে শিখে যায়। আমি ছোট শিশু ছিলাম, আমিও বুঝে গিয়েছিলাম আমার মাকে বেরোতে হবে। তেরো-চোদ্দ বছরের মধ্যে বাড়ির বেশিরভাগ কাজ শিখে গিয়েছিলাম। বাবার সঙ্গে কাজ করতে-করতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। বাবা-মাকে দেখে আমি শিখেছি কীভাবে জীবনে ব্যালেন্স করে চলতে হয়! আর মা শিখিয়েছে, কীভাবে সংসার জীবন আর কর্মজীবনে ব্যালেন্স করতে হয়! দুটোই সন্তান। একটার জন্য আর একটাকে ছেড়ে দেওয়াটা একজন মায়ের গর্ভের আর মেধার লজ্জা! দুটো নিয়ে চলতে পারলাম না বলে হেরে গিয়ে সরে যাওয়াটা সহজ, যুদ্ধে নেমে জিতে আসাটা কঠিন। আমার মা কঠিন কাজটাই পেরেছে। আমার চোখে আমার মা ওয়ান ম্যান আর্মি। ঠিক এইরকম একটা মেয়ে আমি নিজের জন্য সবসময় চাইতাম। যে নিজের পাশে দাঁড়াবার সাহস দেখাতে পারে! বিয়েতে এককথায় রাজি হয়ে নিজের সবকিছু ছেড়ে আমার সঙ্গে চলে আসবে, তারপর সারাজীবন ধরে বলবে তোমাদের জন্য করতে-করতে, সংসার সামলাতে গিয়ে আমার নিজের কিছু হল না, পাঁচ মিনিট সময় নিজের জন্য পাই না.... এসব আমি মেনে নেব না। এতে আমার সংসারে অশান্তি বাড়বে। আমার সন্তান সেগুলো দেখবে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বড় হবে! প্রথম থেকে সে জানবে বাবা-মায়ের সম্পর্ক ভালো নয়। বিয়ে আর সম্পর্কের প্রতি তার বিশ্বাস উঠে যাবে। আমি চাই না আমার বেবি দেখুক ওর জন্য মা ঘরে থাকতে বাধ্য হয়েছে। যার নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই, যে নিজের জন্য স্ট্যান্ড নিতে পারে না, এইরকম পরজীবী আমার চাই না। এদের মেনে নেওয়ার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে। ভীষণ হাসিখুশি থেকে নিজের হতাশাকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু সময়বিশেষে যখন মনের বিদ্রোহ সামলাতে পারে না, মুখোশ খুলে এদের আসল রূপ বেরিয়ে আসে। আমার এই অতিরিক্ত হাসিখুশি, অতিরিক্ত ভালোটা সহ্য হয় না। লাইফ পার্টনার রিয়্যালিস্টিক হওয়ার দরকার। এরপর জীবন থাকলে সমস্যা আসবেই। সেসব দু'জনে মিলে সামলে উঠব। জানুর মধ্যে এই মানসিকতাটা আমি পেয়েছিলাম। নিজের মায়ের ছায়া দেখেছিলাম। তাই আবেগে না ভেসে অনেক ভেবেচিন্তে ওকে নির্বাচন করেছি। মা আমাকে সময় দিতে পারেনি তো কী হয়েছে? তার খামতিটুকু সময়বিশেষে বাবা পূরণ করে দিত। এখন শুধু ভাবি, আমি যেন ঠিক বাবার মতোই জানুর সাফল্যের কারণ হতে পারি। পরাজয়ের নয়। বিয়ের পর আমরা ডিস্ট্যান্স রিলেশনে থাকব শুনে আমার মা প্রথমে একটু আপত্তি জানিয়েছিল। বোধহয় ভেবেছিল ছেলে ছোটবেলা থেকে মাকে সেভাবে পায়নি, বৌকেও যদি না পায় সংসারের মর্ম বুঝবে কী করে? তাই তো মা?
-আমি চেয়েছিলাম তুই আর জানু একসঙ্গে থেকে সংসার কর। ওর চাকরি করা নিয়ে আমার কোনও বক্তব্য ছিল না। কিন্তু তুই এত বছর ধরে চেষ্টা করেও ট্রান্সফার নিয়ে এদিকে আসতে পারছিস না! জানুরও চাকরি এদিকে। দুটো মানুষ আলাদা থাকবে ভেবে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ছোট থেকে তুই একাই বড় হয়ে গেলি। আমি তোকে সেভাবে দেখতে পারিনি। তুইও নিজের বাচ্চার সঙ্গে সময় কাটাতে পারবি না? এসব চিন্তা করতাম! কিন্তু যেদিন জানুর ফ্ল্যাটের কথা শুনলাম, স্বপ্নপূরণের জন্য ও নিজের পাশে এভাবে দাঁড়িয়েছে শুনে সেইদিনই মনের সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে ফেলেছি। আসলে আমি তোর বাবাকে ছেড়ে এভাবে আলাদা থাকিনি। তাই এগুলো ঠিক বুঝি না। আমি ভেবেছিলাম একসঙ্গে থাকলে তোদের সম্পর্কটা মজবুত...
-তোমার আর বাবার মতো মানুষকে দেখে আমি বড় হয়েছি, এরপরেও আমাকে আলাদা করে বুঝতে হবে সংসার কী! বোঝাপড়া কাকে বলে! শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তোমরা ধরে রাখতে শিখিয়েছ। সম্পর্ক, চাকরি, বিয়ে, সন্তান, নিজের স্বপ্ন.... ছাড়তে চাইলে তো সবই ছেড়ে দেওয়া যায়! ভেঙে টুকরো করে ফেলা যায়। ছেড়ে দেওয়ার জন্য একটা কারণ বা অজুহাতই যথেষ্ট। কিন্তু রেখে দেওয়ার জন্য কয়েকটা বছর জানুকে যে যুদ্ধটা করতে হবে, আমি সেই যুদ্ধে কেবল আমার বাবার ভূমিকাটা পালন করতে চাই। কারও কথা শুনে কোনোরকমভাবে প্রভাবিত না হয়ে বাবার মতো ধৈর্য রাখতে চাই। বাবাকে কোনোদিন বিরক্ত হতে দেখিনি। তোমার সঙ্গে জোরে কথা বলতে শুনিনি। ওইরকম শিক্ষা পেয়ে আমিও বড় হয়েছি। দশ মাস ধরে রক্ত-মাংসে গড়া সন্তানের জন্য সারাজীবন ধরে গড়ে তোলা আর এক সন্তানকে ছেড়ে আসার মতো ব্যাপারে যারা প্রচ্ছন্নভাবে সায় দেয়, স্ত্রীর ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, তেমন পুরুষ আমার বাবা নয়। বাবা আমাকে সামলে নিয়েছে, এখন আমার চ্যাম্পিয়নদের জন্য মুক্তা আছে। মা আপনি আছেন, আমার বাবা-মা আছে। এতজন থাকতে আমার চিন্তা কী? মায়ের সন্তান মাকে ছাড়া বড় হবে না, এই পৃথিবীতে মায়ের মতো করে বাচ্চাকে আর কেউ ভালোবাসতে পারবে না.... এটা ভাবতে পারলে সেই একই মনে আপনার অপর সন্তান, মানে কর্মজীবন আপনাকে ছাড়া চলবে, এই ভাবনাটা উদয় হয় কীভাবে? দুটোই কী আপনার নিজের হাতে গড়া নয়? একটু ব্যালেন্স করে চলাটা কী জানুর পক্ষে একেবারেই অসম্ভব? যেখানে ওর পাশে আমি আছি! আর এসব সোসাইটির মানুষের কথা কানে নেবেন না মা। এদের চরিত্র অনেকটা আমার ছোট মায়ের মতো। আমার মাকে সে একটা দিনও শান্তিতে থাকতে দেয়নি। সেটা ছেড়ে দিলেও.... জানুর এই আপনার বাড়ি, আমার বাড়ি ছেড়ে ফ্ল্যাটে একা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা এমন কিছু কথা আমার মাকে বলেছে, যেগুলো শুনতে আপনার একদম ভালো লাগবে না। কারণ বিষয়টা জানুর চরিত্র নিয়ে! ওর একা থাকতে চাওয়া নিয়ে অজস্র প্রশ্ন উঠেছে.... ওসব কদর্য মনের মানুষের কথা আপনি সহ্য করতে পারবেন না। তাই ঐ প্রসঙ্গে আমি আর যাচ্ছি না। আমার জীবনের সিদ্ধান্ত নিয়ে কৈফিয়ৎ দেওয়ার সীমানা জানু, আপনি, আমার বাবা-মা পর্যন্তই। তার বেশি নয়। আমি ওসব ভাবি না। এখন আমার মাথায় কেবল একটাই চিন্তা, ভালোভাবে ডেলিভারিটা হয়ে গেলে ওদিকে আমি একটু নিশ্চিন্ত হতে.... জানু...
ঘুমে জাহ্নবীর চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিল। চয়নের মায়ের পাশে বসে অনেকক্ষণ ধরে ও ঢুলছিল। এখন ওদিক থেকে মৃদু নাসিকা গর্জনের শব্দ ভেসে আসছে। নিজের মায়ের একরাশ দুশ্চিন্তা ওকে স্পর্শ করতে পারছিল না। ওর বড় ঘুম পেয়েছিল। চয়নের ডাকে চোখ মেলে সোজা হয়ে বসল ও। চোখদুটো জ্বালা করে উঠল।
-হুম বলো! ডাকলে?
-সাড়ে তিনটে বেজে গেছে। ঠিক করে শোও। এভাবে কুঁকড়ে পেট চেপে ঘুমাচ্ছ কেন? আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তুমি হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাও। মা আপনি শুয়ে পড়ুন। তোমরাও শুয়ে পড়ো বাবা। মা যাও।
-তুই কিছু খাবি না বাবাই?
মাকে জড়িয়ে ধরে চয়ন বলল,
-ট্রেনে ডিনার করে নিয়েছি মা। তুমি যাও, শুয়ে পড়ো। খুব টেনশনে পড়ে গিয়েছিলে?
-দিদি ফোন করে কান্নাকাটি করছিল। আমি ভয়ে পেয়ে দৌড়ে এসেছি। দেখ, ঘরের কাপড় পরে লাফিয়ে গাড়িতে উঠে পড়েছি। চুলও আঁচড়াইনি.... ভাবলাম জানুর বুঝি পেইন শুরু হল!
হেসে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল চয়ন। ওর বাবা গলা নামিয়ে জাহ্নবীকে বললেন,
-তোর মা কুঁচো নিমকি এনেছে। ঘিয়ে ভাজা। ঘরে করেছে। আমি তিন বাক্স সন্দেশ এনেছি। আমরা সামনের সপ্তাহে আসতাম। তোর মা এখানে আসবে বলে সব গুছিয়ে রাখছিল। খবর পেয়ে আজই চলে এলাম। নিমকির কৌটোটা টেবিলে আছে। ও বুড়ি, একটু নিমকি খাবি মা?
-খাব বাবা!
-ভোর চারটের সময় নিমকি?
চয়নের মা হেসে বলল,
-দে তো। একটু খাক। ওইরকম করিস কেন বাবাই? এখন সবসময় খেতে ইচ্ছে করে। ঘড়ি ধরে সময় দেখলে চলে না। আমি পাইনি বলে কী জানু পাবে না? আমারও কত কিছু খেতে ইচ্ছে করত। সবসময় খিদে পেতো। কিন্তু বড় সংসারে সবাইকে না খাইয়ে কি নিজে খাওয়া যায়? সারাদিন খাই-খাই করলে কেউ যদি দুটো কথা শুনিয়ে দেয়, ভয়ে কিছু বলতাম না! আমি জানুকে প্রথম দিনই বলে দিয়েছি, তোর যেদিন যেটা খেতে ইচ্ছে করবে, তুই আমাকে ফোন করবি। আমি নিজের হাতে বানিয়ে নিয়ে আসব। আগেরবার এসে ওকে মাঝরাতে আইসক্রিম এনে খাইয়েছি। তোর বাবা আইসক্রিম পার্লার খুঁজে বের করেছে। তাই না রে?
-হুমম...
একগাল নিমকি মুখে ভরে ঘুমচোখে চিবোতে চিবোতে জাহ্নবী ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল। ভারতী এতদিন জাহ্নবীর প্রত্যেকটা সিদ্ধান্তের ওপর হস্তক্ষেপ করেছে, বারংবার প্রশ্ন তুলে মেয়ের সঙ্গে তুমুল অশান্তি করেছে! কিন্তু আজ জাহ্নবীর নেওয়া সিদ্ধান্ত চয়ন ও তার পরিবারের দিকে আঙুল তোলার সাহস পেল না। ও নিজেও যে কর্মজীবন আর সংসার জীবন সামলাতে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে, তা মিথ্যে নয়। ভারতী সেই দীর্ঘ রাতগুলোর কথা মনে করে মৃদুস্বরে চয়নের মাকে বলল,
-প্রায় চারটে বাজে। দিদি চলুন, একটু ঘুমিয়ে নেবেন। দাদা আসুন, আপনাকে ড্রইংরুমের সোফা কাম বেডটা খুলে দিই।
ফ্রিজ থেকে জল বের করতে গিয়ে চয়ন দেখল রান্নাঘরের আলো জ্বলছে। মেঝের বিছানা ছেড়ে মুক্তা উঠে দাঁড়াল। ওর অবিন্যস্ত পোশাক থেকে দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে ফ্রিজের দিকে এগিয়ে চয়ন দায়সারাভাবে বলল,
-তুমি এখনো ঘুমাওনি? শুয়ে পড়ো। আবার ঘন্টাখানেক পর উঠতে হবে। সকাল হয়ে গেল প্রায়...
গোটা ফ্ল্যাটের প্রত্যেক সদস্য হারিয়ে গেছে ঘুমের দেশে। কেবল মুক্তার অপ্রাপ্তির জ্বালা জাগিয়ে রেখেছে ওকে। নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে জাহ্নবীর পাশে গিয়ে চয়ন দেখল পাশে নিমকির কৌটো খোলা রয়েছে। ঢাকনা গড়াচ্ছে বিছানায়। জাহ্নবী ঘুমোচ্ছে। কৌটোর ঢাকনা বন্ধ করে চয়ন অগ্রসর হল জাহ্নবীর দিকে। একটু জড়িয়ে ধরতেই চয়নের দৈহিক উষ্ণতার প্রাবল্যে জাহ্নবীর ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে ও বলল,
-খিদে পাচ্ছে।
-আমি আজ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এমন কেউ করে? দেখছ যখন শরীর খারাপ লাগছে, মাকে একটা ফোন করে নিচে ডেকে নিতে পারতে, কিংবা মুক্তাকে। অনল কাকা তোমাকে না ধরলে...
-ফ্রিজে সন্দেশ নেই? বাবা যখনই আসে, আমার জন্য সন্দেশ আনে। আজ আনেনি? জলভরা সন্দেশ, কালাকাঁদ, ইলিশ মাছের পেটি, ক্ষীরকদম, শঙ্খ, কাজু বরফি...
-গোটা প্রেগন্যান্সি পিরিয়ড সন্দেশ আর নিমকি খেয়েই কাটিয়ে দিলে জানু!
-সাংঘাতিক ক্রেভিং! কী করব? দিনরাত খালি খেতে ইচ্ছে করে!
জাহ্নবীর গালে ঠোঁট ছুঁয়ে চয়ন বলল,
-দাঁড়াও দেখছি ফ্রিজে কী আছে! আসছি...
বৈঠকখানায় নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে। চয়নের বাবা সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছেন। রান্নাঘর অন্ধকার করে মুক্তা ঘুমোচ্ছে। রান্নাঘরের আলো জ্বালানো ঠিক হবে কিনা সেই ভেবে চয়ন দাঁড়িয়ে পড়ল। হঠাৎই জাহ্নবীর আর্তকন্ঠ ভেসে এলো ওর কানে,
-চয়ন.... এদিকে এসো। তাড়াতাড়ি...
দৌড়ে ঘরে ঢুকে চয়ন দেখল বিছানায় শুয়ে অনভিজ্ঞ জাহ্নবী ভয়ে কাঁপছে। ওর শোওয়ার জায়গাটা ধীরে ধীরে ভিজে উঠছে জলে। জাহ্নবী চিৎকার করে উঠল,
-ওয়াটার ব্রেক করে গেছে বোধহয়! সবাইকে ডাকো চয়ন। আমাকে এক্ষুণি হসপিটালে নিয়ে চলো প্লিজ...
প্রথমবার সন্তান প্রসবের আতঙ্কে কেঁদে ফেলল জাহ্নবী। উৎকণ্ঠায় কেটে গেল পরবর্তী কয়েক ঘন্টা। দুপুর দুটোয় নিস্তেজ জাহ্নবী মিশে রয়েছে হাসপাতালের শয্যায়। কিন্তু ওর ক্লান্ত মুখে সুন্দর হাসি। পিতৃত্বের অহংকারে চয়নের চোখ সিক্ত। পুত্রসন্তান শুয়ে রয়েছে ছোট খাটে। কন্যাসন্তানকে কোলে তুলে নিয়ে কম্পিত কণ্ঠে চয়ন জিজ্ঞাসা করল,
-জানুসাহেবা.... বলুন? আমাদের প্রিন্স আর প্রিন্সেসের কী নাম ঠিক করলেন?
যন্ত্রণাক্লিষ্ট দেহে প্রায় নিভে আসা কণ্ঠে জাহ্নবী বলল,
-প্রাজ্ঞ আর প্রচেতা।
-উঁহু, আমি জানি ওদের নাম কী হবে?
-কী?
-সন্দেশ আর নিমকি!
চয়নের কথা শুনে হাসতে গিয়েও দৈহিক যন্ত্রণার কারণে কুঁকড়ে উঠল জাহ্নবী। তোয়ালের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা সন্দেশ ও নিমকিকে পাশাপাশি রেখে জাহ্নবীর কপালে আদরচিহ্ন এঁকে দিল চয়ন।
*****************
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত

স্বপ্ন হলেও সত্যি (প্রথম পর্ব)


 

স্বপ্ন হলেও সত্যি

সাথী দাস

প্রথম পর্ব



নিজেকে আয়নায় একবার দেখে নিল জাহ্নবী। নিয়ম মেনে প্রথাগতভাবে বিয়ে করার ইচ্ছে ওর কোনোদিনই ছিল না। ও নিজেও জানে, বাঙালি ঘরের বিয়ের কনে হিসেবে এই সাধারণ সাজ যথেষ্ট নয়। সোনালী রঙয়ের ইঞ্চি পাড় বসানো হাজার বুটির লাল সিল্কের শাড়ি, নীল ব্লাউজ, মাথায় বাহারি অর্কিড আর সামান্য প্রসাধনীর মাধ্যমে বিয়ের সাজে ইতি টেনেছে সে। মায়ের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে পরতে বাধ্য হয়েছে কয়েকটা স্বল্প ওজনের স্বর্ণালংকার, যা বড়ই অনুজ্জ্বল। কৌতূহলী মানুষের দৃষ্টিপথে প্রায় ধরা দেয় না বললেই চলে। এমন নয় যে ও সোনার গহনা পছন্দ করে না। কিন্তু বিয়ের সময় সকলের আলোচনা ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে স্বর্ণশৃঙ্খলাবদ্ধ বন্দিনি হিসেবে নিজেকে মনোরঞ্জনের সামগ্রীরূপে জনসমক্ষে পরিবেশন করার মতো নিন্দনীয় বিষয়ে ওর ভীষণ রকম আপত্তি বরাবরই ছিল, নিজের বিয়েও তার ব্যতিক্রম নয়। গহনা, শাড়ি, অর্থ, প্রাচুর্য, কিংবা যেগুলো একান্তই নিজের ভালোলাগার বস্তু, সেগুলো একটা বিশেষ দিন উপলক্ষ্যে সকলের সম্মুখে ভাগ করে নেওয়া কেন? এ কী কেবল দৃষ্টিসুখ? নাকি এর আড়ালে রয়েছে সমাজে আপনার স্থান, আর্থিক স্থিতিশীলতা ও নিজস্ব বৈভব প্রদর্শনের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত! এ প্রশ্নের সদুত্তর খুঁজতে যাওয়ার মতো সময় জাহ্নবীর হাতে নেই। আজ ওর বিয়ে। আয়নায় নিজেকে দেখে মোহিত হয়ে গেল ও। নিজের চোখে এই স্বল্প সাজেও অপরূপা লাগছে ওকে। মৃদু হাসল সলজ্জ জাহ্নবী। নববধূর দিক থেকে চয়ন কি আজ চোখ ফেরাতে পারবে!

জাহ্নবীর বাবার নাম পরমানন্দ। তিনি উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার ছিলেন, বছর তিনেক আগে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন। জাহ্নবীর মা অর্থাৎ ভারতী টেলিফোন বিভাগে চাকরি করেন। আগামী বছর অবসর গ্রহণ করবেন। বরাবরই আর্থিক স্বচ্ছলতায় প্রতিপালিত হয়েছে জাহ্নবী। পড়াশোনায় মনোযোগী। ওর মেধার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর সকলেই ওর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী ছিল। স্বভাবে ভীষণ রকম শান্ত ও স্বল্পবাক জাহ্নবীর মনের তল না পেয়ে একবার পরমানন্দ ও ভারতী ওকে শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। হাতে একটা চকোলেট নিয়ে ডাক্তার আন্টির কাছ থেকে গল্প শুনছিল জাহ্নবী। বাইরে বাবা-মা অত্যন্ত শঙ্কিত এবং চিন্তিত। ডাক্তার আন্টির মুখে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর গল্প শুনতে শুনতে টেবিলের ওপরে রাখা গ্লোবটা একমনে দেখছিল জাহ্নবী। ওটা বারকয়েক ঘুরিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করেছিল, "ঐ কথা বলা পাখি কোথায় পাওয়া যায়? এই নীলে.... মানে সমুদ্রে? না এই সবুজ জঙ্গলে? আমি দেখতে যাব! তুমি আমাকে নিয়ে যাবে আন্টি? আমাকে না দেখালে আমি কী করে বুঝব, তুমি সত্যি বলছ কিনা! মা বলেছে, মিথ্যে কথা বলতে নেই। তুমি আমায় মিথ্যে গল্প বলছ না তো? রাজপুত্র রাজকন্যার সঙ্গে কথা বলে, এমন পাখির বাড়ি কোথায়? আর রাক্ষসের দেশ? আমাকে নিয়ে যাবে সেখানে? আমি বেড়াতে যাব।"

সেদিন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে স্তব্ধ হয়েছিলেন জাহ্নবীর বাবা-মা। ওঁরা বুঝেছিলেন, জাহ্নবী কোনোভাবেই অসুস্থ নয়। কিন্তু ওর শিশুমনে বুঝি কল্পনার কোনও স্থান নেই। যে বয়সে তার কল্পনাবিলাসী মনের বিকাশ ঘটানোর জন্য রসদের প্রয়োজন, সেই বয়স থেকে সে ভয়ানক রকম বাস্তববাদী। রূপকথার চরিত্রদের স্বচক্ষে দর্শনের মাধ্যমে চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন করতে ইচ্ছুক। পরবর্তীকালে বয়স বৃদ্ধি পাওয়ার পর বোঝা যায়; জাহ্নবী কেবল বাস্তববাদী নয়, অবিশ্বাস্য রকম হিসেবীও বটে! এমন মেয়ের জন্য পরমানন্দ কোনোকালেই চিন্তিত ছিলেন না। পরমানন্দ একটা বিষয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন, বাস্তবের কাঠিন্য তাঁর কন্যাকে স্পর্শ করতে পারবে না। কারণ তার অন্তর লৌহশৃঙ্খলের ভিতরে আবদ্ধ। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়া শেষ করে একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরতা জাহ্নবী যখন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন তার জন্মদাতা। কন্যার বিবেচনার ওপর অতিরিক্ত ভরসার কারণে সুযোগ্য পাত্র নির্বাচনের গুরুভার কন্যার ওপর অর্পণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু ভারতী কন্যার বিবাহের প্রসঙ্গ একাধিকবার উত্থাপন করেন এবং পরিচিত সূত্রে কয়েকজন পাত্রকে জাহ্নবীর জন্য মনোনীত করেন। জাহ্নবী মায়ের প্রশ্নের কোনও উত্তর দেয় না। নিতান্তই বধির মানুষের মতো উদাসীনতার প্রাচীরের অন্তরালে নির্বিবাদে আত্মগোপন করে থাকে।

পরমানন্দের মৃত্যুর এক বছর পর ভারতীর নিরন্তর অনুরোধে বিরক্ত হয়ে একটি ম্যাট্রিমনি সাইটে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় জাহ্নবী। সেখান থেকে চয়নের সঙ্গে জাহ্নবীর আলাপ হয়। দীর্ঘ চার বছরব্যাপী ম্যাট্রিমনি সাইটে থেকেও চৌত্রিশ বছর বয়সী অবিবাহিত চয়নের প্রতি জাহ্নবী ঈষৎ কৌতূহলী হয়েছিল। মধ্য একত্রিশের জাহ্নবী ততদিনে পৃথিবীর সকল ভালো-মন্দের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। নিজের পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ এবং অনড় সে। চয়নের সঙ্গে প্রাথমিক আলাপ ধীরে ধীরে বন্ধুত্বের দিকে এগোতে থাকে। পূর্বে তিনবার হৃদয়ভঙ্গের যন্ত্রণা, যা জাহ্নবী নিজের মায়ের কাছেও গোপন করেছে, নিজের মনের ভিতরে পুষে রাখা সেই অব্যক্ত যন্ত্রণাগুলো ও অবলীলায় চয়নকে জানায়। নিজের স্বপ্নের কথাও গোপন করে না। জাহ্নবী আশা করেছিল, সেদিনই এই আলাপ শেষ হবে। কফি শপে বসে নিজের স্বপ্নপূরণের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখার সুখবরটাও চয়নের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিল ও। সেই সঙ্গে বলেছিল,

-জেদি, বাস্তববাদী আর নিজের স্বপ্নপূরণের জন্য লড়ে যাওয়া মেয়েদের দেখতে বেশ লাগে চয়ন। বন্ধুর মতো পাশে থেকে তাদের সাফল্য উপভোগ করা যায়। হাতে হাত রেখে অভিনন্দন জানানো যায়। কিন্তু নিজের সংসারে তাদের ঠাঁই দেওয়া যায় না। তখন একজন কমনীয় নারীকে প্রয়োজন হয়, যার মধ্যে মাতৃসুলভ ব্যাপার আছে। মায়া-মমতা আছে। যে সংসারে এফর্ট দেওয়ার সময় কোনও হিসেব রাখবে না, তেমন বেহিসেবী মেয়েই সবাই চায়। যে নারী নিজের ক্ষমতায় সংসারে পুরুষের জায়গা দখল করে নেয় বা সমকক্ষ হয়ে ওঠার চেষ্টা করে, তাকে কি কোনও পুরুষ ভালোবাসতে পারে? হয়তো ভালোবাসতে পারে, কিন্তু ঘরে তুলতে পারে না। ঘরে তোলার জন্য সবাই চায় পারফেক্ট ওয়াইফ মেটিরিয়াল!
-তাই কি?
-হ্যাঁ। আমার লাস্ট তিনটে সম্পর্ক আমাকে বারবার তাই শিখিয়েছে। হয়তো তোমাদের মেল ইগো হার্ট হয়! কী জানি! দেখো চয়ন আমরা দু'জনেই জানি আমরা কেন দেখা করছি, কথা বলছি! আমি মায়ের জন্য এই ম্যাট্রিমনি সাইটে এসেছিলাম। তবে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ, দেখা করা, এসব মা জানে না। সবটা নিজের মনের তাগিদে হয়ে যাচ্ছে। আমি কিছুতেই নিজেকে আটকাতে পারছি না। তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগে। কলেজের প্রথম প্রেমের মতো অনুভূতি, সেই পাগলামিগুলো আমার মধ্যে আবার যেন ফিরে আসছে। এটা বোধহয় এখানে থামানো উচিত।

লজ্জাহীনা জাহ্নবীর এমন অকপট স্বীকারোক্তিতে চয়নের মনের সমুদ্রে যে ঢেউ উঠেছিল, তার আভাস ওর মুখের রেখায় বিন্দুমাত্র পড়ল না। নিজের সমস্ত আবেগ গোপন করে ও বলেছিল,

-কেন? যা ভালো লাগছে, তা হতে দেওয়া উচিত। জোর করে থামাতে চাইছ কেন?
-তুমি জানলে আমার জীবনের চাহিদাগুলো। এইমাত্র বললাম তোমাকে। তারপর কি আর এগোনো উচিত?
-আমি কেন এত বছর ধরে বিয়ে করিনি জানো? নিজের মনের মতো মেয়ে পাচ্ছিলাম না। আমি সরকারী চাকুরে, নিশ্চিন্ত জীবন। বেতন ভালো। কর্মসূত্রে রুরাল এরিয়ায় আমাকে একা থাকতে হয়। পাত্র হিসেবে আমার বাজারদর যে তুঙ্গে, সেটা কন্যাদায়গ্রস্ত বাবারা আমার মাকে বারবার জানান দিয়েছে। মায়ের জোরাজুরিতে গিয়েছিলাম কয়েকটা মেয়ে দেখতে। মেয়ের সঙ্গে একান্তে কথা বলার মানসিকতা হয়নি। প্রথম দর্শনে এসে গেছে মারাত্মক অভক্তি!
-কেন?
-মেয়ের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন যেন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে। জীবন-মরণ পণ করে হলেও এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেই হবে। আমাদের দিক থেকে তারা না শুনতে নারাজ। নিঃসন্দেহে তারা ভদ্রলোক। কিন্তু এত আদর, এত দেখনদারি প্রথম আলাপে আমি নিতে পারি না জাহ্নবী। আমার তীব্র অস্বস্তি হয়। আর মেয়ে? সে নিজে একতাল প্রাণহীন মাংসপিণ্ডের মতো আমার হ্যাঁ তে হ্যাঁ বলে যাচ্ছে। নিজের কোনও ইচ্ছে-অনিচ্ছে নেই। আমার কাছে তার কোনও দাবি পর্যন্ত নেই। জাহ্নবী ঐ মেয়েগুলো আমাকে ভালোবাসতে পারবে না। তাদের ভালোবাসা এই মানুষটার প্রতি নয়। তারা সিকিউরিটি চায়। একজনকে আমি বিয়ের পর চাকরি করতে বারণ করেছিলাম। আমার সঙ্গে থাকতে বলেছিলাম। এককথায় সব ছেড়েছুড়ে আমার সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে যায়। সেদিন আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সে আমাকে চেনে না। তার কাছে আমি সম্পূর্ণ অচেনা একটা লোক। আমাকে ভালোবাসার প্রশ্নই ওঠে না। তার ওপর অজানা জায়গা। প্রথম দিন দেখা হয়েছে। সেইদিনই সে আমার কথায় নিজের অস্তিত্ব, নিজের সমস্ত স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে আমার সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে গেল। ওখানে তার কাজের কোনও সম্ভবনা আছে কিনা সেটা একবারও জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন মনে করল না। সে কি আমাকে ভালোবেসে আমার সঙ্গে থাকতে চাইছে? না! তার ভালোবাসা আমার প্রতি নয়, আমার চাকরির প্রতি। একটা নিশ্চিন্ত জীবনের প্রতি।
-নিশ্চিন্ত জীবন চাওয়াটা কি ভুল চয়ন?
-অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে নিশ্চিন্ত জীবন চাওয়াটা ভুল। নিজের ক্ষমতায় নিশ্চিন্ত জীবন গড়ে নেওয়াটা সম্মানের। তোমার অভিধানে যেটা পুরুষের সমকক্ষ হয়ে ওঠা বা সংসারে পুরুষের জায়গা নিয়ে নেওয়া, আমি তাকে বলি ওয়ান ম্যান আর্মি। আমার সেটাই চাই। না পেলে সারাজীবন একা কাটিয়ে দেব। কিন্তু আমার চাহিদা অনুযায়ী মেয়েই আমার চাই। এটা সারাজীবনের ব্যাপার। আমাদের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন কেউ আমাদের হয়ে সংসারটা করে দেবে না। ওটা আমাদেরই করতে হবে। এই একটা সিদ্ধান্ত খুব বুঝেশুনে নেওয়া দরকার। আমি ভুল মানুষকে বিয়ে করে বিয়েটা ভাঙতে চাই না। তার চেয়ে জীবনভর সঠিক মানুষের অপেক্ষা করতে রাজি আছি। যে মেয়ে আমার ওপর সম্পূর্ণ ডিপেন্ড করবে, আমাকে ছাড়া কিছু বুঝবে না, এমন পরজীবীকে নিয়ে সারাজীবন বোঝার মতো আমি বয়ে বেড়াতে পারব না। আমিও বাড়ির একমাত্র ছেলে। মা মাথা খারাপ করে দেয় বিয়ে করার জন্য, কিন্তু আমি এতদিন এমন কাউকে পাইনি যার কাছে নিজের স্বপ্ন এতটা গুরুত্বপূর্ণ। যার মধ্যে এই স্পার্কটা আছে! যে নিজেই একটা গোটা নভেল! আমি তোমাকে সারা জীবন ধরে পড়তে চাই জাহ্নবী। উইল ইউ ম্যারি মি ইজ সো বোরিং! তোমার স্বপ্ন, মানে নিজের নামে যে ফ্ল্যাটটা তুমি নিয়েছ, তার মান্থলি ইএমআইতে আমাকে পার্টিসিপেট করার পারমিশন দেবে জানু?

চয়ন স্পষ্ট দেখেছিল জাহ্নবীর হাতের কোল্ড কফির পাত্রটা কেঁপে উঠেছিল। বেশ কিছুক্ষণ ও চয়নের দিকে চাইতে পারেনি। "জানু" নামের অনুরণন ছড়িয়ে পড়েছিল ওর সর্বাঙ্গে। জড়তা কাটিয়ে একটু স্বাভাবিক হয়ে জাহ্নবী বলেছিল,

-তুমি এমন মেয়ে চাও না, যে তোমার ওপর ডিপেন্ড করবে! বুঝলাম। দেখো চয়ন, আমি আর্থিকভাবে তোমার কোনও সাহায্য চাই না। নিজের এবং মায়ের দায়িত্ব আমি খুব ভালোভাবে নিতে পারব। কিন্তু ইমোশনাল সাপোর্টটা না পেলে আমার খুব সমস্যা হয়ে যাবে। একদম চলবে না। ওটার জন্যই আমি একজন পার্টনার খুঁজছি। যেটা আমার পাস্ট রিলেশনশিপগুলোয় একটা সময় পর আর পাইনি। ওটার জন্য আমি পার্টনারের ওপর অন্ধভাবে ভরসা করব। আমি সবার সামনে নিজেকে মেলে ধরতে পারি না। নিজের ইমোশন জাহির করতেও পারি না। কথা বলতে না পেরে চুপ করে যাই। এখন এমন একজন মানুষ আমার চাই, যাকে আমি সারাদিনের হিসেব দিতে পারব। ঘুমোতে যাওয়ার আগে বকবক করতে পারব। যার সঙ্গে কথা বলে একটু মানসিক শান্তি পাব।
-তুমি একত্রিশ, আমি চৌত্রিশ। আশা করি জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে আসার পর আমরা নিজেদের সামলাতে শিখে গেছি। সময়ই আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে। আমাদের মধ্যে বাড়তি বা অকেজো আবেগের কোনও জায়গা নেই। আমারও দুটো সম্পর্ক ছিল। বেশ কিছুটা রাস্তা একসঙ্গে পেরিয়ে আসার পর দেখেছি, দু'জনের মানসিকতা মিলছে না। তার চাহিদার সঙ্গে আমার চাহিদার বিস্তর ফারাক। আমরা দু'জনেই সুস্থভাবে নিজেদের মুক্ত করে সরে এসেছি। কোনও কিছুকে অহেতুক এত টানবে না জানু। যেটা যেখানে শেষ হতে চাইছে, সেটাকে সেখানেই ছেড়ে দাও। ভুল দু'পক্ষেরই থাকে। আমাদের কাজ হল ঐ ভুল থেকে পাওয়া শিক্ষাগুলো মাথায় রেখে দেওয়া এবং ভবিষ্যতে ঐ ভুলের পুনরাবৃত্তি না করা। এই পৃথিবীতে এটা না পেলে বা ওটা না পেলে আমার চলবে না, এমনটা হয় না। জীবনে ভালোবাসা থাকা ভালো, কিন্তু তার জন্য মরে যাওয়াটা ঠিক নয়। প্রাক্তনকে জীবনভর বয়ে নিয়ে যাওয়াটাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাতে অতীত আর বর্তমানের ব্যালেন্স নষ্ট হয়। এই ব্যালেন্সটা ভীষণভাবে দরকার। অতীত থেকে বেরোতে পেরেছ বলেই তুমি আবার নতুন করে জীবন শুরু করার কথা ভাবতে পারছ। ঠিক তো?
-হ্যাঁ।
-আমি তোমাকে যতদূর বুঝেছি, তুমি হিসেবী মানুষ। তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে। দুটো মানুষকে ঘিরে যখন স্বাভাবিকভাবে একটা ভালোবাসার বৃত্ত তৈরি হয়, তাকে আমরা সংসার বলি। ভালোবাসার জন্যই আমরা সংসার করি। সংসার করার জন্য ভালোবাসতে বাধ্য হওয়াটা কোনও কাজের কথা নয়। তাই ব্যালেন্স করে সংসার করার জন্য ভালোবাসাটাও ব্যালেন্সড হওয়া দরকার। অতিরিক্ত কিছু ভালো না। অন্তত এই বয়সে পৌঁছে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না, আমার এক মুহূর্ত তুমি ছাড়া চলবে না....এগুলো আমার কাছে বড্ড বোকা-বোকা লাগে।
-আমি একরোখা। বেশি কথা বলতে পারি না। মানুষের সঙ্গে মিশতে পারি না। কারও মন রাখার জন্য নিজের কমফোর্ট জোন থেকে বেরোতে পারি না। খুব কম মানুষকে নিয়ে আমার জীবন। আমি অসামাজিক। পারফেক্ট নই।
-সেতো আমিও নই, আমাদের সম্পর্কও পারফেক্ট হবে না।
-হবে না?
-না। বিয়ের পরেও আমাদের সম্পর্কটা পারফেক্ট হবে না। একই মায়ের গর্ভে জন্মানো দুই ভাই-বোনের মতের মিল হয় না। সেখানে আমরা আলাদা পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা সম্পূর্ণ আলাদা দুটো মানুষ হয়ে কীভাবে পারফেক্ট হওয়ার দাবি করব? আমি পারফেক্ট স্বামী হতে পারব না, তুমিও পারফেক্ট স্ত্রী হতে পারবে না। আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন, দিনের শেষে এমন কিছু ভুল করে বসব, যার ফলে পারফেক্ট তকমাটা হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই পারফেক্ট হওয়ার নয়, সুখী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। পারফেক্ট রিলেশন, পারফেক্ট কাপল, বাস্তবে এগুলোর কোনও অস্তিত্ব নেই। যেটার অস্তিত্ব আছে, সেটা হল বিশ্বাস। একজন মানুষ, যার সামনে জাজড হওয়ার ভয় থাকে না, নিজেকে প্রমাণ করার দায়বদ্ধতা থাকে না, যাকে বিশ্বাস করে তার সামনে আমরা আমাদের ইমপারফেকশনগুলো তুলে ধরতে পারি, ম্যাচুওর হয়ে যাওয়ার পর তেমন একটা মানুষই আমরা জীবনে পেতে চাই। ভালোবাসায় থাকার চেয়েও ভালো থাকাটা জীবনে বেশি প্রয়োজন জানু। একটু ভালো থাকব বলেই তো আমরা বিয়ের কথা ভাবছি নাকি?
-হুম!
-আমরা দু'জন দু'জনের খামতিগুলো জানব। সেগুলো কিছুটা শুধরে, কিছুটা মানিয়ে নিয়ে, কিছুটা খামতিগুলোকে ভালোবাসার চেষ্টা করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। এটাই একটা সফল বিয়ের সিক্রেট! যারা সেটা পারে, তাদের বাইরে থেকে দেখে পারফেক্ট কাপল মনে হয়। আর কিচ্ছু না! বিয়েটা কোনও ফেয়ারি টেল নয় যে শেষে এসে সবকিছু পারফেক্ট হয়ে যাবে। বাস্তবে তারা কতটা ইমপারফেক্ট, সেটা কেবল তারাই জানবে। বাইরের কেউ ঘুণাক্ষরেও জানবে না। সেই বোঝাপড়াটা তাদের মধ্যে থাকতে হবে। আমার মনে হয় তুমিই সেই মানুষ, যার কাছে আমি আমার সমস্ত বদ অভ্যাস, সমস্ত খামতিগুলো বলতে পারব। নিজের ভুলগুলো স্বীকার করে হালকা হতে পারব। তোমাকে ভরসা করতে পারব। তোমার ভালোবাসা যদি কোনোদিন কমেও যায়, আমার বিশ্বাস তুমি আমাকে ভালো রাখতে পারবে। আমি তোমার কাছে এসে স্বস্তি পাব। আমি ঐ মানসিক স্বস্তিটাই খুঁজছি। একটা সম্পর্ককে একা ড্রাইভ করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো খুব বেশি এনার্জি আমার মধ্যে নেই। আমি নিজেও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য নিজের সবটা দিতে পারব না, তোমার থেকেও চাইব না। আমার একজন পরিণত সঙ্গী প্রয়োজন। যে আমার খারাপ দিনগুলোতে মেন্টাল সাপোর্টের জন্য আমার পাশে থাকবে। আর তোমার প্রয়োজনে আমি তোমার জন্য আছি, এটুকু বলতে পারি। এর চেয়ে খুব বেশি কিছু করে ভালোবাসা বোঝানোর বয়স অনেক আগেই আমি পেরিয়ে এসেছি। বলো, আমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে তুমি কী ভাবছ?

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার এবং নিজেরা একটু কাছাকাছি আসার জন্য জাহ্নবী ও চয়ন নিয়েছিল আরও একটি বছর। জাহ্নবীর দু'কামরার ফ্ল্যাটের একটা কোণ ওর বড় প্রিয়। সেই কোণে আজ দুটো সুসজ্জিত চেয়ার রয়েছে। বিয়ের পরও স্বামী-স্ত্রী আলাদা থাকবে, সপ্তাহান্তে কিংবা মাসে দু-একবার পরস্পরের কাছে যাতায়াত করবে, বৌ নিজের কেনা ফ্ল্যাটে একা থাকবে, এটা চয়নের মা প্রথমে মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু একমাত্র ছেলে শেষ পর্যন্ত বিয়েতে রাজি হয়েছে, সেই আনন্দে তিনি বিশেষ কথা বলার প্রয়োজন মনে করেননি। জেলার বাইরে কর্মরত একটি মানুষকে একমাত্র জামাতা হিসেবে ভারতী মন থেকে মেনে নেননি। কিন্তু জাহ্নবীর জেদের কাছে তিনিও পরাস্ত হয়েছেন।

স্বপ্ন সত্যি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষার সময়টা যেন সুখস্বপ্নের মতোই কেটে যাচ্ছিল। পাশাপাশি ছিল নতুন জীবন শুরু করার জন্য কিঞ্চিৎ সুখ এবং উৎকন্ঠা! বাইরে কোলাহল শুনে নিজের কপালের টিপটা ঠিক করে আয়নার দিকে চাইল জাহ্নবী। চয়ন এসেছে।

রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে। বিবাহের আয়োজন বড় স্বল্প। বরপক্ষ ও কনেপক্ষ মিলিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সর্বমোট চল্লিশ জনের মধ্যে বর ও নববধূকে পৃথক করা যায় না, এতটাই সাধারণ তাদের সাজ ও পোশাক। দায়িত্ব নিয়ে একা সমস্ত আয়োজন সামলে নিয়েছে জাহ্নবী। চয়ন ফিরেছে বিয়ের মাত্র একদিন আগে। কর্মব্যস্ততার কারণে সারা ফ্ল্যাটে ছুটে বেড়ানোর সময় জাহ্নবীর রক্তিম সিঁথির দিকে চয়ন অপলক দৃষ্টিতে চেয়েছিল। সেই মধুরাতে জনমানবহীন ফ্ল্যাটের পুষ্পশোভিত শয্যায় বিবসনা জাহ্নবীর সিঁদুর-রাঙা কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল চয়ন। ঘরের জানলা দিয়ে প্রবেশ করছিল মৃদুমন্দ বাতাস। কিন্তু সেই বাতাস দুটি কামাসক্ত তপ্ত দেহের উষ্ণতা প্রশমিত করতে অক্ষম। দৈহিক ক্লান্তির কারণে জাহ্নবী ঘুমিয়ে পড়ার পরও চয়নের চোখে ঘুম নেই। ও দীর্ঘক্ষণ চেয়ে রইল জাহ্নবীর ঘুমন্ত মুখের দিকে।

*****************

(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট