স্বপ্ন হলেও সত্যি
সাথী দাস
তৃতীয় পর্ব
তিন সন্তানকে নিয়ে জীবনের সর্বাধিক ব্যস্ততম ও মূল্যবান মুহূর্ত জাহ্নবী অতিবাহিত করছিল। সন্দেশ ও নিমকি দিনের সিংহভাগ সময় মাতৃক্রোড় আলো করে থাকে। তার মাঝে সময়ে-অসময়ে কোলে উঠে আসে জাহ্নবীর প্রথম সন্তান ল্যাপটপ। ফ্ল্যাটে স্থানাভাবের কারণে ও ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজনে চয়নের বাবা অনেকদিন আগেই ফিরে গেছেন তাঁর নিজস্ব বাড়িতে। দুটো ক্ষুদ্র শিশুকে একা সামলাতে জাহ্নবীর প্রাণ হয়তো ওষ্ঠাগত হয়ে যেত। কিন্তু মুক্তার সাহায্য এবং দুই মায়ের সান্নিধ্যে মাতৃত্ব যেন ওর কাছে কিছুটা সহজ আর উপভোগ্য হল। তবুও আয়নার সামনে দাঁড়ালে জাহ্নবীর মনে হতাশা জন্ম নেয়। অত্যধিক ওজন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে জাহ্নবী নিজেকে এখন চিনতেই পারে না। ওয়ার্ডরোবে সযত্নে তুলে রাখা প্রিয় পোশাকগুলো পরা যায় না। মাত্র আট-দশটা নতুন জামা রয়েছে, যেগুলো গর্ভাবস্থায় অফিসে বা ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য কেনা হয়েছিল। এখন সেগুলো এত ঢোলা হয়, গায়ে তোলা যায় না। নিজের মনের মতো একটাও সুন্দর জামা জাহ্নবীর কাছে আছে কিনা ওর মনে পড়ে না। ওয়ার্ডরোব খুলে দেখতেও ইচ্ছে করে না, নতুন জামা কিনতেও ইচ্ছে করে না। এই কয়েক মাসেই হাঁপিয়ে উঠেছে জাহ্নবী। মনে হচ্ছে কত যুগ পেরিয়ে গেল বাইরে ঘুরতে বেরোনো হয় না। চয়নকে কাছে পাওয়া হয় না।
সেদিন ওর সহকর্মী শাল্মলী একগুচ্ছ উপহার সঙ্গে নিয়ে সন্দেশ আর নিমকিকে দেখতে এসেছিল। ওর সঙ্গে কথা বলতে বসলে জাহ্নবীর বেশ ভালো সময় কেটে যায়। ওরা কেবল পরস্পরের সহকর্মী নয়, শাল্মলীর গুরুত্ব জাহ্নবীর জীবনে অপরিসীম। বন্ধুবৃত্ত ক্ষুদ্র হতে হতে এখন জাহ্নবীর পরিণত বয়সের একমাত্র বন্ধু ও শুভচিন্তক এই শাল্মলী। ওর সঙ্গে অফিসের কত গল্প হল, সান্ধ্য ভোজন হল.... কিন্তু ও চলে যাওয়ার পর জাহ্নবী আবার তলিয়ে গেছে নৈরাশ্য আর একাকীত্বের অন্ধকারে। ঘরে এত মানুষ থাকা সত্ত্বেও ওর কিছুই ভালো লাগে না। জীবনটা কেবল যেন বাচ্চাদের ডায়পার পরিবর্তন, মলমূত্র পরিষ্কার, নির্ধারিত সময়ে বাচ্চাদের খাওয়ানো, মনে করে ঢেঁকুর তোলানো, পেটব্যাথা, তালমিছরির জল, কারণে-অকারণে একনাগাড়ে কান্না, ডাক্তার, ভ্যাকসিন, ওষুধ, নিজে গোগ্রাসে খাওয়া আর আধো-ঘুম আধো-জাগরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে জগৎসংসার অন্ধকার। এভাবেই বোধহয় জাহ্নবীর সমগ্র জীবন কেটে যাবে। নিজের জন্য কিছুই করা হবে না। শিথিল বক্ষ, কুঁকড়ে যাওয়া ঝুলন্ত উদর, অস্ত্রপচারের সাময়িক অসাড়তা, নিদ্রাহীনতার ফলে চোখের কোলে কালি, মাতৃদুগ্ধের কারণে সর্বক্ষণ সিক্ত পোশাক.... জাহ্নবী নিজেকে আয়নায় দেখে রাগে-দুঃখে নিজেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। চয়নের সামনে দাঁড়াতেও এখন লজ্জা করে। জাহ্নবী নিজেকে ভালোবাসতে ভুলে গেছে। ওর মধ্যে আকর্ষণীয় শব্দটার কোনও অস্তিত্ব নেই। যতটুকু সৌন্দর্য, লালিত্য আর উজ্জ্বলতা ছিল, সমস্ত শুষে নিয়ে ওকে নিংড়ে পৃথিবীর আলো দেখেছে সন্দেশ ও নিমকি।
জাহ্নবীর একমাত্র ভালোবাসা ছিল নিজের কর্মক্ষেত্র। যে টেবিলের ওপর ওর ল্যাপটপ বসানো থাকত, সেই জায়গাটা ওর কাছে মন্দিরের মতো পবিত্র ছিল। সেখানেও এখন ভালো লাগে না। টেবিলের ওপর চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকে ডায়পার, বেবি পাউডার, বেবি ক্রিম, বেবি লোশন, তেল, শ্যাম্পু, রকমারি ওষুধ। নিজের প্রিয় ঘরটাকে চিনতে পারে না জাহ্নবী। ও নিজে বদলে গেছে। কিন্তু মানুষের পাশাপাশি এত সাধ করে নিজের হাতে সাজানো বাড়িঘর, পূর্বপরিচিত সংসার, সব যেন এক অদৃশ্য মন্ত্রবলে বদলে গেছে। ঘরের মধ্যে অদ্ভুত একটা গন্ধ! নিজের পোশাকে, বাচ্চাদের পোশাকে, ঘরের মেঝেতে, সর্বত্রই সেই জীবাণুনাশক তরলের উগ্র গন্ধ! জাহ্নবীর গা গুলিয়ে বমি পেয়ে যায়। গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। মুখ বন্ধ করে প্রেতাত্মার মতো ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে ও সারাদিন ঘুরে বেড়ায় আর যন্ত্রের মতো কাজ করে।
সন্দেশ-নিমকি এখন ঘুমোচ্ছে। একটু আগে মাতৃদুগ্ধ পান করছিল। জাহ্নবী পাশ ফিরে শুয়ে বালিশে মুখ চেপে নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল। কেন এত কান্না পাচ্ছে, এ প্রশ্নের উত্তর ও নিজেও জানে না। কেবল জানে, জাহ্নবী নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে না। ডোরবেলের শব্দ পেয়ে নিজেকে তাড়াতাড়ি সামলে নিল ও। ঘরের দরজাটা ধীরে ধীরে একটু ফাঁকা হওয়ার পর চয়নের মা উঁকি মেরে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-হ্যাঁ রে! ঘুমিয়েছে?
-হু। কোথায় বেরিয়েছিলে তুমি? কিছু দরকার হলে মুক্তাকে পাঠাতে পারতে। আমি অনল কাকাকে একটা ফোন করে আনিয়ে নিতাম। তুমি আবার নামতে গেলে কেন?
-দাঁড়া, বাইরের শাড়িটা ছেড়ে হাত-পা ধুয়ে আসছি...
বাড়ির সমস্ত নিয়মকানুন বদলে দিয়েছে দুই খুদে দস্যি। যতক্ষণ এরা নিদ্রামগ্ন হয়ে থাকে, ঘরের প্রত্যেক সদস্য কন্ঠ খাদে নামিয়ে কথা বলে। রান্নাঘরের বাসনপত্রের সামান্য একটু শব্দও সেই সময়ে করা নিষেধ! ঘড়িতে রাত সাড়ে আটটা বাজল। বাচ্চাদের পাশে শুয়ে জাহ্নবী একদৃষ্টে ওদের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে রইল। ছোট-ছোট হাত-পা, হাঁ করে থাকা সিক্ত ঠোঁট.... বড় মায়াময় সেই দৃশ্য। সন্দেশ বারবার ঘুমের ঘোরে হেসে উঠছে। চোখ মেলে চাইছে, হাসছে। আবার চোখ বন্ধ করে ফেলছে। নিমকি পাশ ফিরে সাড়ে আট মিনিটের বড় দাদা সন্দেশকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। নিমকির আকস্মিক স্পর্শে চমকে আড়মোড়া ভেঙে ওঠার চেষ্টা করল সন্দেশ। দু'জনকে সাবধানে চাপড়ে দিল জাহ্নবী। আবার ওরা গভীর ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল। ওদের দেহের কাছে নাক রেখে জাহ্নবী পেল এক মিষ্টি স্বর্গীয় সৌরভ, যে সুবাস কেবল শিশুদেহেই পাওয়া সম্ভব। ভালোলাগায় জাহ্নবীর চোখ বন্ধ হয়ে এলো। লবণাক্ত জলে দু'চোখ ভরে উঠেছে। কিছুক্ষণ আগের রাগ, দুঃখ, মনখারাপ, হতাশা, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা.... সমস্ত ধুয়ে গেল চোখের জলে। স্তব্ধবাক জাহ্নবী সন্দেশের ছোট্ট হাতের মুঠোয় চুমু খেয়ে নিজেকে প্রশ্ন করল, এই মিশ্র অনুভূতির নামই কি মাতৃত্ব?
-ওভাবে ঘুমন্ত বাচ্চাকে হাঁ করে দেখতে নেই জানু!
চয়নের মায়ের কথায় ঘোর কাটল জাহ্নবীর। চোখ মুছে উঠে বসল ও। চয়নের মা একটা বৃহৎ প্লাস্টিকের ব্যাগ হাতে নিয়ে খাটে বসলেন। গলা নামিয়ে ফিসফিস করে চলল দুজনের কথাবার্তা।
-কী আছে এতে? কোথায় বেরিয়েছিলে তুমি?
-কাঁদছিলি কেন আগে বল? ওদের দেখে?
-হুম।
-ওভাবে দেখবি না। বাচ্চা বড় মায়ার জিনিস। মায়া কাটিয়ে এরপর বেরোতে পারবি না। আগামী মাস থেকে অফিসে বেরোতে হবে তো?
-হ্যাঁ।
-তবে! এখন মায়া বাড়াচ্ছিস কেন? আমার মতো কাঁদতে কাঁদতে অফিস যাবি তুই? এখন থেকে দিনের বেশিরভাগ সময় ওদের মুক্তার কাছে রাখা অভ্যাস কর। তুই একটু দূরে-দূরে থাক। তোর বাচ্চা তোরই থাকবে, তোকেই মা ডাকবে। কেউ কেড়ে নেবে না।
-পরশু তুমি সত্যি চলে যাবে মা?
-বাবাইয়ের বাবার শরীরটা একটু খারাপ হয়েছে। সুগারটা বেড়েছে বোধহয়। ডাক্তার ব্লাড টেস্ট দিয়েছে। করাতে হবে। আমি না গেলে মানুষটা আবার অনিয়ম করবে। পল্লবীর ওপর সবটা ছেড়ে দিলে হয়! তাছাড়া বাড়ির গাছগাছালিগুলো ডালপালা মেলে প্রতিবেশীর অসুবিধে করছে। কাল তোর বাবাকে ডেকে পাশের বাড়ির কাকিমা গাছ কাটাতে বলেছে। আমি যাই, তারপর একটা লোক ডেকে গাছ কাটাতে হবে। কয়েক মাস তো একভাবে রইলাম জানু। আমি আবার আসব। ওদিকটাও একটু সামলে আসি। এগুলো রাখ, তুই পরবি।
-কী আছে এতে? এতগুলো কুর্তি, টপ, স্কার্ট, জিন্স!
-সব মিলিয়ে ছ'টা আছে। তোরা আজকালকার মেয়ে, তোর পছন্দ-অপছন্দ আমি জানি না মা। তোকে এইরকম জামাকাপড় বেশি পরতে দেখেছি। তাই যেগুলো আমার ভালো লাগল, নিয়ে এলাম। অফিসে যাবি। আগের জামাকাপড় কিছুই গায়ে ধরবে না। বাচ্চা রেখে বেশিক্ষণের জন্য বেরোতেও পারিস না যে কেনাকাটা করবি! আপাতত এগুলো দিয়ে কাজ চালিয়ে নে। পরে তোর সময়মতো কিনে নিস। কাল বাবাইয়ের সঙ্গে বেরিয়েও কিনতে পারিস। কাল এটা পরে ঘুরতে যাস। এই জামাটা সুন্দর না? তোকে মানাবে খুব! দ্যাখ!
উত্তেজনার আতিশয্যে জাহ্নবীর কাঁধের ওপর একটা টপ ধরে দেখতে লাগলেন চয়নের মা। জাহ্নবী এখন দুই সন্তান নিয়ে ঘরবন্দি হয়ে রয়েছে। ওর পক্ষে চয়নের কাছে যাওয়া সম্ভব নয়। চয়ন প্রত্যেক শনিবার রাতে নিজের পরিবারের কাছে আসে, সোমবার ভোরে প্রথম ট্রেনে ফিরে যায় আপন কর্মক্ষেত্রে। কিন্তু এই শনিবার ওরা কোথায় যাবে ভেবে পেলো না জাহ্নবী। এ বিষয়ে চয়ন ওকে ফোনে কিছুই জানায়নি। হতবাক জাহ্নবী বলে ফেলল,
-কাল কোথায় যাব?
চয়নের মা হেসে বললেন,
-বাবাইয়ের বাবা কী করত জানিস? আমার ছুটির দিনে বাড়িতে থাকলে সে বলত, সারা সপ্তাহ তুমি বাড়িতে থাকো না। ছেলে তোমাকে কাছে পায় না। চলো, আজ ছেলেটাকে নিয়ে দু'জনে কাছেপিঠে কোথাও হাওয়া খেয়ে আসি।
-ছেলেকে নিয়ে? না তোমাকে নিয়ে? সারা সপ্তাহ কে-কাকে কাছে পায় না? সব বুঝি আমি!
-শোন না...
-বলো-বলো। তোমার আর বাবার গল্প শুনতে আমার কী যে ভালো লাগে.... তারপর?
-তারপর আর কী! বিকেলে বেরিয়ে পড়তাম তিনজন। বাবাই পার্কে খেলত, আমি আর বাবাইয়ের বাবা ছোলাভাজা কিংবা বাদাম ভাজা নিয়ে মাঠের ঘাসের ওপর বসে থাকতাম। আসার আগে ছেলেকে একটা কাঠি আইসক্রিম কিনে দিতাম। আমরা দুটো বেগুনী কিংবা ফুলুরি নিয়ে পায়ে হেঁটে বাড়ি চলে আসতাম। এসে বাড়িতে গরম চা, মুড়িমাখা আর তেলেভাজা!
-কী ভালো! তারপর?
-তারপর আবার কী! এতগুলো বছর পর আমার সেই পার্কে খেলা করে বেড়ানো ছেলের দৌলতে জানলাম, আমাদের ঐ দু'জনে কাছেপিঠে কোথাও হাওয়া খেয়ে আসি এখন পরিবর্তিত হয়ে ডিনার ডেট হয়ে গেছে।
-মানে!
-কাল তোর বর তোকে নিয়ে ডিনার ডেটে যাবে। বাবাই আমাকে ফোন করে বলল, মা পরশুদিন আমি তোমাকে নিয়ে বাড়ি যাব। তোমাদের সঙ্গে একদিন থেকে সোমবার সকালে বাবার টেস্ট করিয়ে এগারোটার ট্রেনে ফিরব। কাল রাতে আমি বাড়ি ফিরে জানুকে নিয়ে ডিনার ডেটে যাব ভাবছি। তুমি, ওর মা আর মুক্তা মিলে বাচ্চাদের একটু দেখে রেখো। জানু ঘুরতে-বেড়াতে, সেজেগুজে পরিপাটি থাকতে ভালোবাসে। ওর আলমারিতে নতুন জামা আছে কিনা জানি না। ওর জন্য একটা জামা কিনে রাখতে পারবে? ওকে এখন কিছু জানিও না। কাল গিয়ে সারপ্রাইজ দেব। বাবাই আমাকে এটা বলে ফোন রাখল। এদিকে তোর পেট পাতলা শাশুড়ির অবস্থা দেখ! সে একটা জামা কিনতে গিয়ে ছ'টা নিয়ে এসেছে। এবার তোর পছন্দ না হলে কাল সকালে ফেরত দিতে যেতে হবে। তাই দেখাতেই হল, সব বলতেই হল। এই তোর পছন্দ হয়েছে তো? জিন্সটা পরে দেখা দেখি। কোমরের মাপ ঠিক হল, না আবার পাল্টাতে হবে! আমি আন্দাজে এনেছি।
সন্দেশ আর নিমকি নড়তে শুরু করেছে। এক্ষুণি পরিত্রাহি চিৎকার শুরু করবে। চয়নের মা তাড়াতাড়ি ওদের আলগা চাপড় মেরে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। জাহ্নবীর তখন কথা বলার মতো অবস্থা নেই। একদলা কান্না ওর বুকের ওপর বোঝা হয়ে চেপে বসেছে। চোখের কোল বেয়ে জল বেরিয়েই গেল। মাথা নামিয়ে জামাটা মুঠোর মধ্যে চেপে ও বলল,
-খুব সুন্দর হয়েছে। আমি কাল এটাই পরব। তুমি কী করে বুঝলে বলো তো, আমি ঠিক কী চাই!
-তোর এই শাশুড়ি তো একদিনে শাশুড়ি হয়নি রে মা। অনেকগুলো বছর পেরিয়ে আজ শাশুড়ি হয়েছে। সবার আগে এক বাড়ির মেয়ে ছিল। তারপর আর এক বাড়িতে এসে বৌ হয়ে সবশেষে মা হয়েছে। তারপর তুই তার ব্যাটাকে বিয়ে করে বর পেয়েছিস। কী করে বুঝলাম, সেই গল্প বলতে গেলে ইতিহাস হয়ে যাবে! আমি জীবনে যা কষ্ট পেয়েছি, তার সিকিভাগও যেন তোকে পেতে না হয় জানু! তোকে কেউ কোনোদিন বলবে না, পেটের ব্যাটা কেঁদে গলা শুকিয়ে চিতায় উঠলেও রাক্ষসী মা ব্যাগ বগলে কোমর দুলিয়ে আপিসে যাবেই! এত তেজ এই মেয়েমানুষের.... শাশুড়িকে দিনরাত ছোট বৌ বলত, আমাকে আপনি দুই ভাসুরের সামনে বেরোতে দেন না। এদিকে আপনার মেজ বৌ রোজ সকালে পরপুরুষের গায়ে গা ঘষে ট্রেনে-বাসে চেপে অফিসে যাচ্ছে। তখন কী আপনি চোখে ঠুলি এঁটে থাকেন!
গলা কেঁপে গেল চয়নের মায়ের। চুপ করে গেলেন তিনি। জাহ্নবী চয়নের মায়ের হাতের ওপর হাত রেখে দেখল তিনি অসহনীয় কষ্টে কাঁপছেন। বুকের ভিতরটা বোধহয় কান্নায় ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু পুত্রবধূ সম্মুখে সেই যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চাইছেন না। খানিকক্ষণ পর চোখ থেকে চশমা খুলে কাপড়ের আঁচলে চোখ এবং চশমা মুছে তিনি বললেন,
-আমাদের সময় প্রত্যেকের হাতে-হাতে এত ফোন ছিল না জানু, যে ইচ্ছে হলেই ফোন করে বাবাইয়ের বাবার সঙ্গে কথা বলব। অফিসে বসে প্রতি মুহূর্তে ছেলের খবর নেব। ভোরের কাক ডাকার আগে রাজ্যের অভিশাপ কানে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোতাম, ফিরতাম সেই রাতে। সারাদিন মনের ভিতর যে কী অশান্তির ঝড় চলত, তোকে কী বলব! কানে শুনতাম, আমি নাকি বাবাইকে নিয়ে ভালোমন্দ খাওয়ার জন্য বরের কান ভাঙিয়ে ওদের সংসার দু'টুকরো করে ভিন্ন হয়েছি। ব্যাগের মধ্যে পাঁউরুটি আর একটা কলা নিয়ে যেতাম। সেটাও এক-একদিন গলা বেয়ে নামত না। খেতে বসে ছেলেটা কী ছাইভস্ম খাচ্ছে, সেইসব ভাবতে ভাবতে বুক ফেটে যেত। বাবাই তখন এক পা দু'পা হাঁটে। টলমলে পায়ে এর ঘরে ওর ঘরে যায়। ছোট মায়ের ঘরে গেলে আমার জা ওর হাত ধরে ঘর থেকে বের করে দিত। তোর বরকে যে মানুষ জীবনেও একগ্রাস ভাত মুখে তুলে দেয়নি, সেই মানুষ আজ তোর বিয়েতে সোনার নেকলেস দিয়ে গেছে। জানে সামনেই তার মেয়ের বিয়ে। এখানে দিলে লাভ আছে। বাবাই ঠিক ঐ জিনিস ফিরিয়ে দেবে। আমার চাকরি নিয়ে এত ঝামেলা হয়েছে বাড়িতে, তবুও অশান্তির ভয়ে আমি হার মানিনি। তুইও হাল ছাড়বি না। বাচ্চাদের মায়ায় জড়াবি না। রোজ কাজে যাবি।
-যাব মা!
-ওরা একটু কাঁদবে। সন্দেশ আর নিমকিকে ছেড়ে বেরোতে তোর বুক ফেটে যাবে। কিন্তু তাও জোর করে শিকল ছিঁড়ে বেরোবি। মনে রাখবি, মায়েদের অনেক বেশি ধৈর্য রাখতে হয়। তারা নিজেরাও জানে না তাদের ক্ষমতা! ঈশ্বরও মেয়েদের গর্ভেই সন্তান সৃষ্টি করেন। সেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে মেয়েদের দেহে সন্তানের খাবার পাঠিয়ে দেন। আমরাই সৃষ্টি করতে পারি, চাইলে আমরাই ধ্বংস করতে পারি। ধৈর্য ধরে সবকিছু সাজাতে হবে। এটা তোর সংসার জানু, সারাজীবন তোরই থাকবে। এখন আগে নিজের স্বপ্নগুলো পূরণ করে নে। আমাদের সময় এত টেকনোলজি, ল্যাপটপ, বাড়িতে থেকে শুয়ে-বসে কাজের সুবিধা ছিল না। বেশিরভাগই ফিল্ড ওয়ার্ক। তার মধ্যেও আমি লড়ে গেছি। যখন জয়েন করলাম ডিপার্টমেন্টে তেরো জন কাজ করেছি। যখন রিটায়ার করলাম আমার সেই ডিপার্টমেন্টে দেখলাম মোট তিনজন মানুষ আর দুটো কম্পিউটার। তবেই ভাব! যুগ কত এগিয়ে গেছে। আমাদের পিছিয়ে থাকলে চলবে? পরিবর্তন তো বলে-কয়ে দরজায় নক করে অনুমতি নিয়ে আমাদের অন্দরমহলে ঢুকবে না। সংস্কার ভেঙে, খেটে মনের মতো দরজা তৈরি করে পরিবর্তন আনতে হবে। এখন তোর হাতের মুঠোর মধ্যে ফোন আছে। ভিডিও কল করবি, যখন ইচ্ছে হবে বাচ্চাদের দেখতে পাবি। ওদের সঙ্গে কথা বলতে পারবি, আবার কী চাই! যদিও আমি তোদের মতো ফোন ল্যাপটপের এতকিছু বুঝি না। মানে টেকনোলজির ব্যবহার, টেক...
-টেক স্যাভি!
-হ্যাঁ, ঐ অতটা টেক স্যাভি নই। টুকটাক কাজ চালাতে পারি। কিন্তু প্রয়োজন হলে তোর জন্য আমি ভালো করে সবকিছু শিখে নেব। আমার ছেলেটার তো আর দেশের বাইরে তেমন কোনও প্রোগ্রেস হবে না। বাঁধা বেতনের চাকরি। কিন্তু তুই প্রাইভেট সেক্টরে আছিস। স্কিল ডেভলপমেন্টের প্রচুর সুযোগ পাবি। যদি কোনও বড় সুযোগ পাস, যদি তোকে বিদেশ পাঠায়! কত নতুন অভিজ্ঞতা তোর ঝুলিতে জমা হবে! তুই একদম বাচ্চাদের কথা ভাববি না। হ্যাঁ বলে দিবি। আমি এখানে চলে আসব। তোকে ভিডিও কল করে রোজ ওদের দেখাব। আমি আর তোর মা মিলে এদিকটা সামলে নেব। আমরা বেঁচে থাকতে থাকতে তুই নিজের কেরিয়ারটা ভালোভাবে তৈরি করে নে জানু। নিজের পেটের ছেলেকে সময় দিতে পারিনি। এখন সন্দেশ আর নিমকিকে মাথায় করে রাখব। দিদিমা-ঠাম্মা হওয়া কত ভাগ্যের ব্যাপার জানিস? ওদের কোলে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গেলেই আমার কান্না পেয়ে যায়। মনে হয়, আবার ফিরে মা হয়েছি! সেই দিনগুলো ফিরে পাচ্ছি।
দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থেকে জাহ্নবী কান্না সংবরণ করল। তারপর নাক টেনে বলল,
-রকেট সায়েন্সের পর তুমিই বোধহয় এত ডিফিকাল্ট মা! তুমি যে কী দিয়ে গড়া, আমি আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না। এমন মানুষকে তোমার শ্বশুরবাড়ির লোক চিনতে পারল না। ওদের দুর্ভাগ্য দেখে হাসি পায়, আবার করুণাও হয়।
-ছাড় না! আমি মন থেকে ঐ দিনগুলোর কথা ভুলে থাকতে চাই। কিন্তু কথায়-কথায় আবার বলেও ফেলি। একটু আগে জিজ্ঞাসা করছিলি না, কীভাবে তোকে বুঝি! এই দিন, এই সময় আমিও এককালে পেরিয়ে এসেছি। তাই সব বুঝি। সবাই বাচ্চাকে নিয়েই ব্যস্ত! নতুন মা হওয়ার পর মায়ের শরীর আর মনের ওপর যে কী ধকল যায়, কেউ সেই খোঁজ নেয় না। আমাকে কেউ বলেনি, তোর বাচ্চাকে দেখছি। তুই একটু ঘুমিয়ে আগে নিজে বাঁচ, তারপর বাচ্চাকে ধরবি। বাবার বাড়ি থেকে আসার পর কেউ ফিরেও চাইত না আমার দিকে। বাবাইয়ের বাবা রাতের পর রাত জাগত। মানুষটা না থাকলে আমি বোধহয় মরে যেতাম! তবে ঐ কষ্টের দিনগুলো না পেরিয়ে এলে হয়তো তোকে এত ভালোভাবে বুঝতাম না। কোনও মেয়ে সংসার ভাঙার জন্য বিয়ে করে না জানু, সংসার করতেই বিয়েটা করে একটা নতুন পরিবেশে আসে। দিনের পর দিন মুখ বন্ধ করে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করে। কিন্তু তার কাদার তালের মতো নরম মনটাকে সংসার পুড়িয়ে ইঁট বানিয়ে দেয়। আমি কী করেছি জানিস?
-কী?
-আগে নিজের নামে জমি কিনেছি। তারপর ব্যাঙ্ক থেকে লোন দিয়ে ঐ ইঁট জমিয়ে জমিয়ে তোর বাবা আর আমি, দু'জন মিলে ছোট বাড়িটা বানিয়েছি। অপমান পুষে রাখতে হয়। যে মেয়েমানুষ তেজ করে গড়তে জানে, সেই মেয়েমানুষের তেজ ভালো জানু, খুব ভালো! তেজের পাশাপাশি অপমানগুলোও পুষে রেখে কাজে লাগাতে হয়। মুখে উত্তর দিতে নেই। উত্তরটা সময়ই দেবে। তখন মুখ ফুটে কিছু বলতে হবে না। আমি আমার ছেলের চোখ খুলে দিয়েছি। ও নিজের মাকে ঘরে-বাইরে কাজ করতে দেখেছে। সংসার আর সন্তানের প্রয়োজনে কেরিয়ার স্যাক্রিফাইজ করার চিন্তা মাথায় এলে ও বৌয়ের মুখের দিকে চেয়ে বসে থাকবে না। বরং সবদিক কীভাবে ব্যালান্স করা যায়, সেটাই ভাববে। এই শিক্ষা ওর জন্মগত! কিন্তু তুই ছেলেরও মা, আবার মেয়েরও। তোর দায়িত্ব অনেক বেশি জানু। এমন কিছু করবি না, যেটা দেখে কাল নিমকি ভাববে, আমার মা আমার জন্য কাজ ছেড়ে ঘরে বসেছিল, আমিও তাই করলে সংসারটা বজায় থাকবে। খবরদার এই ভুল করবি না। সন্তান বাবা-মাকে যে পথে চলতে দেখবে, নিজেও সেই পথেই যাওয়ার চেষ্টা করবে। তখন তুই কিচ্ছু বলতে পারবি না।
-বুঝেছি।
-তুই নিজের জন্য জীবনে কী করেছিস, এই প্রশ্নটা যখন নিজেকে করবি তখন যেন ট্রফির মতো কেবল সন্দেশ আর নিমকি তোর চোখের সামনে না আসে! ওরা ছাড়াও তোর বাঁচার উদ্দেশ্য আছে। নিজের জন্যও কিছু করতে হবে। বাবাইয়ের সঙ্গে খুব ঘুরে নিবি! বাচ্চারা একটু বড় হলে প্রত্যেক বছর ঘুরতে যাবি। অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে এনে আমাকে দেখাবি। আমি রেলের পাস পেতাম। তাও সেভাবে ঘুরতে পারিনি। সংসার আমাকে ছাড়েনি। ছেলেটার মাথা গোঁজার জন্য বাড়িঘর করে দিতে হবে সেই চিন্তা রয়েছে। বাবাইয়ের বাবার ব্যবসায় মন্দা, বাড়ির কাজ, ব্যাঙ্কের লোন, জমির দলিলটা ব্যাঙ্ক থেকে ঘরে আনতেই হবে... সবদিক গোছাতে গিয়ে বয়স হয়ে গেল। রোগে ধরে গেল। হাঁটু-কোমর পড়ে গেল। ইচ্ছে মরে গেল। আর সময়ও ফুরিয়ে গেল। বাইরে কোথাও বেড়াতে যেতে পারলাম না। আমি নিজের যে স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারিনি, তুই বাবাইয়ের সঙ্গে সেগুলো সব সত্যি করে নিস। আমি যেখানে বাধা পেয়ে আটকে গিয়েছিলাম, তোরা সেগুলো অতিক্রম করছিস দেখলে আমি একটু মানসিক শান্তি পাব।
-দাঁড়াও মা! ওরা একটু বড় হোক, আমি তোমাকে আর বাবাকে ট্রিপে পাঠাব। একটু সময় দাও আমায়...
-সময়েরটা সময়ে হয়নি। এখন আর ইচ্ছেও করে না, ভালোও লাগে না। দু'পা হাঁটতে গেলে এদিক ব্যাথা, ওদিক ব্যাথা! ডাক্তার, রাজ্যের ওষুধ! আমি নাকি ঘুরতে যাব! দূর! এখন আমার সোনু আর নিমিই সব। ওদের একটু বড় করে দিতে পারলেই আমার শান্তি! ঐ যে, তোর মাণিকজোড় পুটপুট করে চাইছে। ট্যা করে ঠেলে উঠল ব'লে! তোর মা আর মুক্তা রুটি করছে দেখলাম। তুই যা, গরম গরম রুটি তরকারি খেয়ে আয়। ততক্ষণ আমি ওদের সামলাচ্ছি। এরপর সারারাত পালা করে জাগতে হবে। তুই খেয়ে পিঠ-কোমর একটু টান করে নে। তারপর রাজপুত্র আর রাজকন্যা ম্যারাথন দৌড়ের প্রস্তুতি নিতে সারারাত হাত-পা ছুঁড়ে ব্যায়াম করবেন! ওদের পাহারা দিয়ে বসে থাকতে হবে। গল্প করতে পারলে আমারও সময়ের হিসেব থাকে না। নিজের বয়স হচ্ছে বুঝতে পারছি। খেয়ে আয় রে মেয়ে। রাত হয়ে গেল কত...
সন্দেশ ও নিমকির জন্মের পর চয়নের সঙ্গে জীবনের অন্যতম সুন্দর রাত্রিযাপন করল জাহ্নবী। দীর্ঘদিন পর ও চোখের কোলে কাজল টেনেছে। চয়নের মায়ের দেওয়া নতুন জামা পরে মনের মতো করে সেজেছে। আজকের রাতের প্রত্যেকটা মুহূর্ত যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। মোমবাতির স্বল্প আলোয় চয়নকে স্বপ্নের রাজপুত্রের মতো লাগছিল। জাহ্নবীর হাতে হাত রেখে ওর দিকে একটা লাল রংয়ের লম্বা বাক্স এগিয়ে দিল চয়ন। জাহ্নবী ওটা খুলে দেখল ভিতরে সোনার সরু চেনের সঙ্গে 'Janu' নামাঙ্কিত একটা ছোট লকেট রয়েছে। অবাক হয়ে জাহ্নবী বলল,
-হঠাৎ গিফ্ট?
-পছন্দ?
-ভীষণ!
-বিলেটেড হ্যাপি বার্থডে মম্মি!
-থ্যাঙ্কু! কিন্তু চয়ন, আজ আমার বার্থডে নয় । কয়েকদিন আগেও পেরিয়ে যায়নি। তবে?
-কয়েকমাস আগে পেরিয়ে গেছে। যেদিন তুমি প্রথম মা হলে সেদিন মম্মি জানুর জন্ম হল। এটা অনেক আগে তৈরি করে রেখেছিলাম। যেদিন তোমাদের হসপিটাল থেকে বাড়িতে আনলাম, সেদিন দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু সোসাইটির বাইরে তোমার মাথা ঘুরে গেছে শুনে আমি এমন হুড়োহুড়ি করে সেবার বেরিয়ে এসেছি, এটা সঙ্গে নিয়ে আসা হয়নি। তারপর আমাদের চ্যাম্পিয়নদের এতই ধৈর্যের অভাব, ওরাও হুড়মুড় করে সময়ের আগে বেরিয়ে পড়ল। তুমি ফ্ল্যাটে আসার পর চারদিকে এত লোকজন, সবার মাঝে দিতে ইচ্ছে হয়নি। ভেবেছিলাম তোমাকে নিয়ে একটু আলাদাভাবে সময় কাটিয়ে একান্তে এটা উপহার দেব। আজই সেই দিন! ডিনার প্ল্যানটা সেইজন্যই করি। পরিয়ে দিই?
অন্ধকারের মধ্যে আবছা নীল আলো, মোমবাতির শিখা, সমধুর সংগীতের অন্তরা, সুস্বাদু খাবার আর পারিবারিক কোলাহলের বাইরে একান্তে চয়নের সঙ্গলাভ, সব মিলিয়ে একটি পরিপাটি সুখসন্ধ্যার স্মৃতি বুকে নিয়ে চয়নের হাত ধরে লিফটে ঢুকল জাহ্নবী। জোড় কিংবা বিজোড় মাসে পৃথকভাবে সন্দেশ ও নিমকির অন্নপ্রাশনের চিন্তা, দাম্পত্য আলোচনার মাধ্যমে অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠান স্থগিত রেখে সরাসরি প্রথম বছর সন্দেশ-নিমকির জন্মদিন উদযাপনের ভাবনা, একাধিক কোম্পানিতে জাহ্নবীর চাকরির ইন্টারভিউ.... সবকিছুকে অতিক্রম করে নিজেরই অজান্তে বারংবার নিজের গলার নতুন চেনে আঙুল জড়িয়ে ফেলছে জাহ্নবী। লিফট থেকে বেরিয়ে ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছে চয়ন বলল,
-এত পছন্দ হয়েছে? হাতের সঙ্গে ওটাকে পেঁচিয়েই চলেছ!
-খুব সুন্দর হয়েছে এটা!
-লাস্ট এক ঘন্টায় এই কথাটা অন্তত একশোবার শুনলাম।
-দুটো বাচ্চা, সামনে এত খরচ বাড়বে। এর মধ্যে হঠাৎ করে...
-যে হিসেবী বৌ আমার এতগুলো টাকা বাঁচিয়ে দিয়েছে, সেই সাশ্রয়ী বৌয়ের জন্য এটুকু করতেই হয়।
-আমি আবার কখন তোমার টাকা বাঁচালাম?
ডোরবেল বাজিয়ে গলা নামিয়ে মৃদুস্বরে চয়ন বলল,
-যা হওয়ার সব একবারে হয়ে গেছে। ঝামেলা শেষ। দু'বার ডেলিভারির খরচ নেই। অন্যান্য মায়েরা যেটা করার জন্য খুব কম করে হলেও অন্তত দু'বছর সময় নেবে, তুমি সেটা ন'মাসে করে দেখিয়েছ। আর সবচেয়ে বড় কথা হল...
-কী?
একগাল হাসি নিয়ে চোখ টিপে চয়ন বলল,
-আমার দু'বার উপোস নেই! উফ জানু! উপোসের কতদিন যে হয়ে গেল, সেই হিসেব আছে?
পিঠের ওপর দু'ঘা কিল-ঘুষি খেয়ে হাসতে হাসতে জাহ্নবীর কাঁধে হাত রেখে ওকে জড়িয়ে ধরল চয়ন। দরজা খুলে মুক্তা দৃষ্টি নামিয়ে নিল। জাহ্নবী জিজ্ঞাসা করল,
-বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে মুক্তা?
-সন্দেশ ঘুমিয়ে গেছে। নিমকি তোমার মায়ের কোলে খেলা করছে।
নিজের ব্যস্ততা ও দাম্পত্যসুখে মগ্ন হয়ে থাকা জাহ্নবী লক্ষ্য করল না, মুক্তা আগের মতো মন খুলে কর্কশ স্বরে কথা বলে না, হাসে না। কোনও এক অজানা কারণে ও একেবারে চুপ করে গেছে। ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে পিছন ফিরল মুক্তা। চয়ন ও জাহ্নবীর আলগা আলিঙ্গনের দিকে নিবদ্ধ ওর শীতল দৃষ্টি। চয়নের পুরুষালী হাত তখন বেষ্টন করে রয়েছে জাহ্নবীর কাঁধ।
***************
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত