মুহূর্তেরা বন্দী
সাথী দাস
তৃতীয় পর্ব
বহুদিন পর সারাটা দুপুর ভাতঘুম দিয়ে কাটিয়ে দিলো উজ্জয়িনী। ঘুম থেকে উঠে ও কিছুক্ষণের জন্য সকাল না বিকেল, ভোর না সন্ধ্যে, কিছুই বুঝতে পারছিলো না। শেষ পর্যন্ত ঘড়ি দেখে বুঝলো, জীবনের অমূল্য কিছু মুহূর্ত ও ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিয়েছে। দুপুরে মাম্মামের সঙ্গে একবার কথা হয়েছে। তারপর ফোন অন ছিলো। কাল সারারাত একমাত্র মেয়ে বাড়ি ফেরেনি। মা ফোন করে এত কান্নাকাটি করছিলো, যে নিজের এই হঠকারী সিদ্ধান্তের জন্য উজ্জয়িনীর একটু খারাপই লাগছিলো। মন খারাপ করে শুয়ে থাকতে থাকতে ও সেই যে ঘুমিয়ে গেছে, একেবারে সন্ধ্যে পার করে উঠলো। বিকেলে নদীর পাড়ে ঘুরতে যাওয়া, একটু প্রকৃতির মাঝে বেড়ানো, কিছুই হলো না। রিসিভারটা কানে তুলেও নামিয়ে রাখলো উজ্জয়িনী। চা-স্ন্যাকস আর কটেজে আনিয়ে কাজ নেই। তার চেয়ে বরং বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসা যাক, খেয়েও আসা যাক। ঢিলে পোশাক ছেড়ে, একটা স্কার্ট আর টপ পরলো উজ্জয়িনী। অনেকদিন পর খুব যত্ন সহকারে মনের মতো করে নিজেকে সাজালো। কাজল দিয়ে চোখ আঁকলো বহুক্ষণ ধরে। পছন্দের লিপশেডে রাঙিয়ে নিলো নিজের ঠোঁটদুটো। সবশেষে চুলগুলোতে আর চিরুনিই ছোঁয়ালো না। স্বাধীনভাবে মনের আনন্দে মাথার ওপর বিচরণ করার জন্য ওদের সম্পূর্ণ খুলে এলোমেলো করে দিলো। সবশেষে চোখে চশমা পরে, ভালোভাবে দেখলো আয়নার দিকে। এতটা সাজার পরিশ্রম বিফলে যেতে দেওয়া উচিত নয়। বরাবরের অভ্যেসমত সঙ্গে-সঙ্গে নিজের একটা ছবি তুলে, মন ভালো থাকার বিশেষ মুহূর্তটাকে ক্যামেরাবন্দী করে রাখলো উজ্জয়িনী। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো, বেশ কয়েকটা মেইল এসে জমা হয়েছে। উজ্জয়িনী ঠিক করেছে, এই কটাদিন শুধু নিজের সঙ্গে সময় কাটাবে। আর কোনো কাজ নয়। সমস্ত প্রকাশনীর মেইলগুলো স্ক্রোল করে গিয়ে, একটা মেইলে ও এসে থমকে গেলো। দীপ্ত পাঠিয়েছে। এই ছেলেটার কাজগুলো একটু দেখতে হবে। ফোনটা হাতে নিয়ে কটেজের দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেলো উজ্জয়িনী। হলঘরের টেবিলের এককোণে বসে সপ্রশংস দৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনের দিকে ও চেয়েছিল। দীপ্তর এক-একটা কাজ দেখে সত্যিই অবাক হয়ে যেতে হয়। ঠিক কতটা যত্ন আর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে একজন শিল্পী এভাবে কল্পনার বাস্তবায়ন ঘটায়, ওই ছেলেটিকে সামনে বসিয়ে একটু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলো! কফির মগটা ঠোঁটে ছুঁয়ে চশমার ওপর দিয়ে হঠাৎই উজ্জয়িনী দেখলো, রিসেপশন থেকে একজন পুরুষ ওর দিকেই চেয়ে আছে। তাড়াতাড়ি দৃষ্টি নামিয়ে নিলো উজ্জয়িনী। আবার ফোনের স্ক্রিনে মন দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু ওর মন বললো, ওই মানুষটা দু-পা এগিয়ে যাবার তিন পা পিছিয়ে গেলো। কিছু কি বলতে চায় ওকে! আশেপাশের টেবিলগুলো বেশিরভাগই ফাঁকা পড়ে রয়েছে। একেবারে কোণের দিকে দুটো টেবিলে মানুষজন বসে রয়েছে। একটা ছোট বাচ্চা কান্নাকাটিও করছে। হলের ভিতরে প্রবেশ করলো ওই পুরুষটি। স্ক্রিনের ছবিতে দীপ্তর একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট দেখছিলো উজ্জয়িনী। ও মনে-মনে গুনতে শুরু করলো,
"এক-দুই....."
-গুড এভনিং ম্যাম!
"এসেই গেলো তবে!"
কফি মগটা হাত থেকে নামিয়ে রাখলো উজ্জয়িনী। একবার চোখ তুলে দেখে নিলো তাকে। বয়স বড়জোর ছাব্বিশ-সাতাশ হবে। মানুষটা শৌখিন ও বিত্তবান। নিজের যে বিশেষ যত্ন নেয় সেটা গালের পরিপাটি করে ট্রিম করা দাড়ি থেকে শুরু করে, হাতের মূল্যবান ঘড়িটা দেখলেই বোঝা যায়। ছেলেটির পরনে একটা টি শার্ট, হাফপ্যান্ট, গলায় মস্ত বড়-বড় কানওলা একটা হেডফোন ঝুলছে। মুখে চাপা উত্তেজনামিশ্রিত একটা হাসি। দৃষ্টি চঞ্চল হলেও বেশ মার্জিত। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উজ্জয়িনী চেয়ে রইলো তার দিকে। সহাস্যবদনে সে বললো,
-আপনি যদি অনুমতি দেন, তাহলে আমি কি এই চেয়ারে একটু....
-না।
উজ্জয়িনীর শান্ত উত্তর।
-এক্সকিউজ মি?
হতভম্ব হয়ে সেই পুরুষটি বলে ফেললেন।
-না! এত চেয়ার-টেবিল আশেপাশে ফাঁকা পড়ে রয়েছে। আপনি এই চেয়ারেই কেন বসবেন? না। আমি অনুমতি দিলাম না।
আত্মপ্রত্যয়ী উজ্জয়িনীর দৃঢ় কণ্ঠস্বর। বিন্দুমাত্র না দমে সেই পুরুষ বললেন,
-আপনি জানেন আমি কে?
-জানতে আগ্রহী নই!
-ম্যাম! আমি এই গোটা রিসোর্টের ওনার সৌজন্য রায়। এই রিসোর্ট, প্রত্যেকটা কটেজ, এমনকি এই চেয়ার টেবিলগুলো সব আমার।
ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে হাসিমুখে নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো উজ্জয়িনী। সৌজন্য ওর হাতে হাত রাখতেই উজ্জয়িনী বলে উঠলো,
-হ্যালো মিস্টার রয়! আরে আমি তো আপনাকেই খুঁজছিলাম। নাইস টু মিট ইউ! বসুন-বসুন। কয়েকটা কথা আপনাকে জানিয়ে রাখি। একবার গিজার চালালে সারাদিন ধরে ফোঁটা-ফোঁটা জল পড়ছে। জল ঠিকমতো গরমও হচ্ছে না। ওয়াশরুমের আলোটা কিছুটা সিসিটিভি ক্যামেরার মতো কাজ করছে। টুয়েন্টিফোর আওয়ার সার্ভেলিয়েন্স! কিন্তু চব্বিশ ঘন্টাই নিভে রয়েছে। সুইচ টিপলেও আলো জ্বলে না। নেহাৎ আমি সোলো ট্রিপে আছি, তাই দরজা বন্ধ করার প্রয়োজন পড়ছে না। কিন্তু আপনি এই বিষয়গুলো একটু দেখে নেবেন। আপনার ব্যবসার উন্নতির স্বার্থেই বলছি!
চেয়ারে হাত রেখে সবে বসতে যাচ্ছিলো সৌজন্য। ভুরি ভুরি অভিযোগের তালিকা শুনে লাফিয়ে উঠে বললো,
-সরি!! মানে আমি এখানকার কর্মচারী! এগুলো ম্যানেজার বা স্যারকে গিয়ে বলতে হবে!
আলাপ করতে আসা পুরুষটির স্বতঃস্ফূর্ত উজ্জ্বল মুখমন্ডল দপ করে নিভে যাওয়ায়, বেজায় হাসি পেয়ে গেলো উজ্জয়িনীর। ও এবার সত্যিই হেসে ফেললো।
-আরে ভয় পেয়ে গেলেন নাকি? নিজেকে এত তাড়াতাড়ি তালগাছ থেকে মাটিতে আছড়ে ফেলতে হবে না। বসুন-বসুন!
-থ্যাঙ্কু ম্যাম। সত্যিই একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম বৈকি! প্রথম আলাপেই আমার পরিচয় পেয়ে, আপনি যেভাবে বকে-ধমকে অভিযোগ জানাতে শুরু করলেন....
চেয়ারটা টেনে নিয়ে উজ্জয়িনীর মুখোমুখি বসে পড়লো সৌজন্য।
-ম্যাম আর একটা কফি প্লিজ! আমার সঙ্গে? আমার বাড়িতে আপনি এসেছেন, সামান্য একটু আপ্যায়ন করার সুযোগ দিন!
-বেশি আপ্যায়নের জন্য আবার চড়া মূল্য দাবী করে বসবেন যে!
-আরে নানা, কি যে বলেন! আসছি একটু....
তরতর করে উঠে গিয়ে কিসব যেন অর্ডার দিয়ে আবার ফিরে এলো সৌজন্য। হাসিমুখে বললো,
-এভাবে আপনার মুখোমুখি বসে যে কোনোদিনও কথা বলবো, চা-কফি খাবো, আমি তো ভাবতেই পারিনি। কল্পনায় তো কত কি....
-আপনি আমাকে চেনেন? এমনভাবে কথা বলছেন, যেন....
-উজ্জয়িনী সেনগুপ্ত! "ফিরে চাই তোমাকে" , "হলুদ পাখিটা হারিয়ে গেছে" , "আবর্ত", "গোধূলিবেলায়"....
-হুম বুঝেছি! থামুন!
-কি হলো ম্যাম?
-কিছু না।
-বলুন না?
-আসলে আমি এইসব কাজ, লেখালেখি, বুক ক্রিটিকস, রিভিউয়ার, প্রোমোশন, পাবলিশারের প্রেশার, রিডার বেস, ফ্যানপেজ, পাইরেটেড পিডিএফ, রয়্যালটি, পার্সেন্টেজ, রাইটার্স ফোরাম, পাবলিশার্স গিল্ড, প্রোডাকশন কপিরাইট, কন্টেন্ট কপিরাইট, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি, কন্ট্রাক্ট, গাদাখানেক ক্লজ, এগ্রিমেন্ট...
-এতকিছু? একটা বইয়ের জন্য? ওরে বাপরে!
-হুম! এতকিছুই। একটা বই মানে শুধুমাত্র লেখক বা লেখিকা কতগুলো রাত জেগে পড়াশোনা করে মাথা-ঘাড় যন্ত্রণায় ছিঁড়ে গিয়ে টাইপ করে পাণ্ডুলিপি তৈরি করা নয়, প্রেসে সেটা ছেপে দেওয়াও নয়, পাতার পর পাতা উল্টানোও নয়। বরং আরও অনেক কিছু। তার অক্ষরবিন্যাস, সম্পাদনা, প্রচ্ছদ! এক একটা বই রিলিজের আগে একটা গোটা টিম দিনরাত এক করে কাজ করে। এসব ছাড়াও বইবাজারের কম্পিটিশন আর পলিটিক্স তো ছেড়েই দিলাম। এসবের স্ট্রেস আপনার হোটেলের ব্যবসার থেকে কোনো অংশে কম নয় সৌজন্য। যদিও এই স্ট্রেসটাই পার্ট অফ মাই প্রফেশন। তবুও, মানুষের তো ছুটি নিতে ইচ্ছে করে। একটু সময় বের করে নিজের জন্যও ভাবতে ইচ্ছে করে। তাই আমি এই সবকিছু থেকে নিজেকে কিছুদিনের জন্য একটু দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। সে যাক গে! তারপর বলুন, আপনি আমার কি কি লেখা পড়েছেন? আর কোন লেখা সবচেয়ে ভালো লাগলো আর কেন? খারাপ লাগলেও কেন?
-এত ফর্মালিটিজের দরকার নেই ম্যাম! আমি বুঝেছি।
-থ্যাঙ্কু সৌজন্য। আসলে খুবই ভালোলাগে কেউ এসে আমার কাজ সম্পর্কে আমার সঙ্গে কথা বললে! কিন্তু জীবনের কিছু কিছু মুহূর্ত এমন থাকে, এতটাই স্পর্শকাতর....
-যে মুহূর্তে ভালো কিছুও আর ভালো লাগে না।
-রাইট!
-আপনি অহেতুক মনের ওপর এত চাপ নেবেন না ম্যাম! আমি আপনার অফিসিয়াল পেজের ব্লাইন্ড ফলোয়ার হলেও, আপনার অন্যান্য রিডারের সঙ্গে আমার কিন্তু অনেকটাই পার্থক্য আছে। আমি আপনাকে বুঝবো।
-তাই বুঝি? তা কিরকম পার্থক্য? সবাই চোখ খুলে পড়েন। বই, পিডিএফ যেটাই হোক। আর আপনি বুঝি চোখ বন্ধ করে পড়েন?
-কি যে বলেন না ম্যাম!
-নয়? তাহলে আপনি লেখা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে লেখিকাকে নিজের সামনে কল্পনা করে, তার সঙ্গে কাল্পনিক কথোপকথন করে থাকেন নিশ্চয়ই। সে কেন এমনটা করলো? তাকে সামনে পেলে খুব করে ঝগড়া করতেন!
মাথা নামিয়ে হেসে ফেললো সৌজন্য....
-সত্যি নাকি এগুলো? এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে আপনি শুধু লেখাই নয়, সঙ্গে লেখিকাকেও অ্যাডমায়ার করেন বলতে হয়।
-এই রে!! এটা বুঝলেন কি করে? ম্যাডাম! প্লিজ আমার মাইন্ড রিড করা বন্ধ করুন।
-ইচ্ছেও নেই। বড় আবর্জনা সেখানে।
-কি করবো বলুন! আপনার মতো পরিণতমনস্কা তো আর নই। একজন পঁচিশ বছরের যুবকের মাথায় আপনার মত চিন্তাধারা কাজ করবে, এটা তো আশা করাই উচিত না।
-বয়সের খোঁটা দিচ্ছেন?
-ধুর না! আপনি নিজেকে যেভাবে মেইনটেইন করছেন, কে বলবে আপনি চল্লিশ পেরিয়েছেন!! আপনার প্রশংসাই তো করছি। আপনি এখনো সুইট সিক্সটিন!
-প্রশংসা বা সমালোচনা, দুটোই যৌক্তিক হওয়া প্রয়োজন সৌজন্য। এটা বাড়াবাড়ি রকমের অযৌক্তিক কমপ্লিমেন্ট! একদমই নেওয়া গেলো না।
-সত্যি!
-কিভাবে জানলেন আমি চল্লিশ পেরিয়েছি?
-বিগত পাঁচ বছর ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো জোঁকের মতো স্টক করছি আপনাকে। একটা পোস্টও মিস করি না! কিন্তু কোনোদিনও কোনো পোস্টে আমার রিয়্যাক্ট নেই। এমনকি আপনার জন্মদিনে একটা উইশও করিনি! হা হা হা!! তবে স্বপ্ন দেখতাম জানেন, আপনার মতো লেখিকার মুখোমুখি কোনো একদিন দাঁড়াবোই। তবে সেটা অবশ্যই কোনো বইমেলার ভিড়ে নয়, নিভৃতে... একান্তে! একেবারে ব্যক্তিগত পরিসরে। আমাদের দেখা হবে একদম অন্যরকমভাবে, যেটা সারাজীবন আমার মনে থাকবে। আমি আপনার হাজার হাজার পাঠকের ভিড়ে হারিয়ে যেতে রাজি নই।
হেসে ফেললো উজ্জয়িনী।
-ম্যাম! প্লিজ প্লিজ! আপনি আমার মাইন্ড রিড করবেন না!! নইলে কিন্তু আমাকে ভীষণ লজ্জায় পড়তে হবে।
কথাবার্তার মধ্যেই একগাদা স্ন্যাকস আর কফি এসে যাওয়াতে উজ্জয়িনী ও সৌজন্য দুজনেই বকবক করতে-করতে, ডান হাতের কাজ শুরু করলো।
-জানেন ম্যাম, আমি কিন্তু আপনার একটা বইও কিনে পড়িনি। সব বন্ধুদের থেকে ধার করে।
-তাই নাকি!
-ধার করে পড়ার মজাই আলাদা। তবে প্রতিবারই ফেরত দিয়ে দিয়েছি। বই নিয়েছি আর ফেরত দিইনি, এটা আমার শত্রুও বলতে পারবে না।
-আচ্ছা আপনি বললেন না তো, অন্যান্য রিডারের সঙ্গে আপনার পার্থক্য কি?
-বড় কিছু ভাবলে, বড় কিছু সত্যিই হয়। যখনই আপনার লেখা পড়ে বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদে ফেলতাম, তখনই কল্পনায় আপনার সঙ্গে ঝগড়া করতাম। আর ভাবতাম, আপনি বড় নিষ্ঠুর। কিছুতেই কোনো বইমেলায় আপনার সঙ্গে দেখা করতে ছুটে যাবো না। চাই না আপনার সই। কিনবো না আপনার বই! আপনার সঙ্গে অনেক হিসেব-নিকেশ তুলে রাখা আছে। সেটা একান্তে মিটিয়ে নেব। আর আজ যখন আপনাকে সকালে সুইমিং পুল থেকে....
-থামলেন কেন?
-না মানে সকালে যখন চাবি নিয়ে আপনি রুমে গেলেন, তখন থেকেই আমার হাত-পা কাঁপছিলো।
-সেকি! কেন?
-আপনার সঙ্গে কথা বলবো কি বলবো না, ভেবেই পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ করে আশাতীত কিছুর সামনে পড়ে গেলে, চট করে নিজেকে সামলানো যায় না। কথা বলার সাহস পাচ্ছিলাম না ঠিক!
-কিন্তু আমি তো জানতাম আপনি কথা বলবেন।
-আপনি জানতেন?
-অফ কোর্স! কথা বলার জন্য ছটফট করছিলেন তো আপনি। কিন্তু আমি যে আপনার পূর্বপরিচিতা, এটা জানতাম না।
-আপনি আমাকে নোটিশ করেছেন? আমি মোটেও ছটফট করিনি!
কফির কাপে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে চেয়ারে নিজেকে হেলিয়ে, সৌজন্যর দিকে স্থির দৃষ্টিপাত করে উজ্জয়িনী বললো,
-সে আপনি এখন অস্বীকার করতেই পারেন।
-সরি! হ্যাঁ। অস্থির লাগছিলো কথা বলার জন্য। আপনি জানলেন কি করে?
-অবজারভেশন পাওয়ার। হেব্বি স্ট্রং বুঝলেন তো! আপনার ভাবনারও ঊর্ধ্বে।
-মানতেই হবে!
-নিশ্চয়ই। একজন আমাকে দেখলে আমি জানবো না?
-তাহলে আমাদের ওই অপবাদটা কি ঘুচলো?
-কোনটা?
-শুধুমাত্র ছেলেরাই মেয়ে দেখে!?
-ছেলেদের থেকে অনেক বেশি মেয়েরা ছেলে দেখে। কোন যুগে পড়ে আছেন বলুন তো আপনি? আসলে ওসব ছেলে-মেয়ে কিছু না সৌজন্য। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সুন্দর কিছু দেখতে সবারই ভালোলাগে। এটাই ভীষণ স্বাভাবিক! সৌন্দর্য দেখে আপনি যদি সাময়িকভাবে মুগ্ধ না হন, তবে ধরে নিতে হবে আপনার অনুভূতির মৃত্যু হয়েছে। কি হলো? কি ভাবছেন? তাকিয়ে আছেন কেন?
-তবে আমার অনুভূতির মৃত্যু হয়নি বলছেন? আমি সুন্দর কিছু দেখে এই মুহূর্তে মুগ্ধ!
-এই কফি মগটা ঠাঁই করে ছুঁড়ে মারবো!
-সে মারুন। তবে ভাঙলে দাম দিতে হবে। কফি মগের নয়, আমার ভাঙা মাথার দাম! আমার কিছু হলে, আমার পাপা কিন্তু আপনাকে ছেড়ে কথা বলবে না!
সৌজন্য আর উজ্জয়িনীর সম্মিলিত হাসিতে গোটা হলঘর মুখরিত হলো। উজ্জয়িনী অতিকষ্টে নিজের হাসি থামিয়ে বললো,
-সাংঘাতিক বিচ্ছু তো আপনি! এক মুহূর্তের মধ্যে আমার মুখের কথাটা প্রয়োগও করে ফেললেন?
-এই মুহূর্তটুকুই তো সব ম্যাম!
-হুম! ট্রু!!
-আপনাকে দূর থেকে দেখলে খুব রাশভারী, ব্যক্তিত্বময়ী মনে হয়। কিন্তু গাম্ভীর্যের বেড়াজাল টপকে একটু কাছ থেকে দেখলে....
-কি বলছেন? আমার ইমেজের আলগা মুখোশটা আপনার সামনে খুলে গেছে বলছেন? মেন্টেইন করতে পারছি না?
-আমি অন্তত আলাপের প্রথম থেকে কোনো মুখোশ দেখিনি ম্যাম। যতটুকু মুহুর্ত আপনার সঙ্গে কাটিয়েছি, লেখিকা উজ্জয়িনী সেনগুপ্তর চেয়েও, মানুষ উজ্জয়িনী সেনগুপ্তর সান্নিধ্য বেশি উপভোগ করেছি।
কয়েক মুহূর্তের অপার নিস্তব্ধতার পর উজ্জয়িনী বলে উঠলো,
-আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
-ব্যক্তিগত?
-নানা। আপনার একেবারে ব্যক্তিগত পরিসরে আমার কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু আপনি একটা বিষয় একটু খোলাখুলি বলুন দেখি। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে এতবড় বিজনেসম্যান? বলি ইনভেস্টমেন্টের জন্য ব্যাঙ্ক ডাকাতি করেছেন নাকি?
-আপনি সৌগত রায়ের নাম শুনেছেন ম্যাম?
-বিজনেস টাইকুন সৌগত রায়? রয় গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের....
-ইয়াপ! ফার্স্ট রয় ইজ সৌগত রায়। সেকেন্ড ওয়ান ইজ...
-কি বলছেন আপনি!!
-ইয়েস! আমি সৌগত রায়ের একমাত্র উত্তরাধিকারী...
-সৌজন্য রায়?!
-হ্যাঁ! এ সবই পাপার ব্যবসা। লোক আছে। তবুও আমি একটু দেখেশুনে রাখি! পাপার জন্য বেরোতেই হয়। পাপার বয়স হচ্ছে। হার্টেও কিছু সমস্যা আছে। তাই দূরে কোনো কাজ থাকলে আমিই বেরিয়ে পড়ি। পড়াশোনা শেষ করে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছিলাম। পাপা কান ধরে বিজনেসে ঢুকিয়ে দিলো। এখনও সেভাবে মাথা ঘামাই না। ওই ওপর-ওপর একটু দেখি। সেই কারণে মিডিয়ার চোখে পড়িনি। নইলে এতদিনে পরিচিত মুখ হয়ে যেতাম। যতদিন পালিয়ে থাকা যায় আর কি!
-আরে বাপরে! বিশাল ব্যাপার তো! আমি এত গণ্যমান্য একজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলছি, আগে জানলে....
-প্লিজ ম্যাম! আপনার কাছে আমি শুধু একজন পাঠক। এর বেশি আমার নিজের কোনো পরিচয় নেই। বাবার ব্যবসা, বাবার পরিচয় ভাঙিয়েই খাই। আসলে আমার বাড়িতে ঠিক পড়ার পরিবেশ নেই। শুধু টাকা আর টাকা। লক্ষ্মী আর সরস্বতীর চিরকালীন বিবাদ আমার বাড়িতে। বইয়ের পাতা থেকে মনকে টেনে বের করে শেয়ার মার্কেটের খবরে বসাতে হয়, শুধুমাত্র পাপার জন্য। তার মধ্যেও ছোটবেলা থেকেই মাকে একটু আধটু বই পড়তে দেখতাম। সেই থেকেই কেমন যেন একটা নেশা চেপে ধরেছে। এটা মায়ের দিক থেকেই এসেছে। ট্রলিতেও বই নিয়ে ঘুরি এখন। ক্লাসিক লেখা বেশ কিছু পড়েছি। আর এখনকার লেখার মধ্যে আপনার বেস্ট সেলার লেখাগুলোই পড়েছি। সত্যি বলছি ম্যাম, আপনার লেখাও সব পড়া হয়ে ওঠেনি। তাই যেটুকু পড়েছি, সেই সিলেবাসের বাইরে পড়া ধরলে কিচ্ছু পারবো না। কারণ বিশাল কিছু পড়ুয়া নই আমি। সাহিত্যের বেশি কিছু বুঝিও না। সামান্য ভালোলাগা থেকেই পড়ি।
-বাঃ! ভালো তো। তা সৌজন্য, আপনাদের এতরকম ব্যবসা ছেড়ে, শেষ পর্যন্ত হোটেলের ব্যবসাই কেন? তাও এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায়? এটা তো সেরকম কোনো ট্যুরিস্ট স্পটও না। বেসিক রিসোর্সেস....
-দেখুন ম্যাম। পাণ্ডববর্জিত জায়গা বলবেন না। আজ যেটা মরুভূমি, কঠিন পরিশ্রম করলে কাল সেখানেই জনবসতি গড়ে তোলা যাবে। আর এটাই তো আমার প্লাস পয়েন্ট। যে এখানে তেমন কোনো জমকালো হোটেল নেই। তাই কম্পিটিশনও কম। প্রথম থেকে পুরো ব্যবসাটা আমি একাই পেয়ে যাবো।
-ব্রিলিয়ান্ট!
-ক্রেডিটটা আমার পাপার ম্যাম! কারণ কথাটা আমার পাপার। আমার কোনো কৃতিত্ব নেই। আর যদি হোটেলের ব্যবসার কথাই বলেন, আপনি বাঙালির বেড়ানো বন্ধ করতে পারবেন? মরতে মরতে হলেও বছরে একবার বাঙালির ঘুরতে বেরোনো চাই। রিফ্রেশমেন্টের জন্য!
-বা হয়তো জীবনে ফেরার জন্য!
-তাও ঠিক। আসলে মাছ-ভাত আর ভ্রমণ, এই তিনটে না থাকলে, বাঙালির জীবনটাই তেজপাতা!
-আমি ধনেপাতাটাই বেশি শুনেছি।
-আরে না! তেজপাতার ফ্লেভারটুকু পেয়ে যাওয়ার পর, তাকে জাস্ট রান্না থেকে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। চিবিয়ে তো আর খাওয়া হয় না। তাও তো ধনেপাতার আগামুড়ো সবটাই কাজে লাগে। তাই তেজপাতা!
-পয়েন্ট!
-ম্যাম আপনি এখানে কতদিনের জন্য এসেছেন?
মুখের চওড়া হাসি মিলিয়ে গেলো উজ্জয়িনীর। সামান্য হেসে ও বললো,
-জানিনা। দেখা যাক। যতদিন মন টানবে, ততদিন থেকে যাবো মুহূর্তগুলোকে আঁকড়ে!
-ম্যাম, আপনি কি আপসেট কোনো কারণে?
-উঠলাম!
-এই কেন?
-একি! আপনার সঙ্গে বসে বসে আড্ডা দেবো নাকি? এমনিতেই আজ সারা দুপুর ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। একটু আশেপাশে ঘুরে দেখি, ফলতা আপনাকে ঠিক কতটা ব্যবসা দিতে পারবে! তার সান্ধ্য সৌন্দর্য কেমন!
-ম্যাম একটা আবদার আছে। আপনি না করতে পারবেন না।
-আমি অভ্যস্ত এসবে। সেলফি তো?
-একদমই না। আপনার সঙ্গে কাটানো এত সুন্দর একটা মুহূর্ত, এটাকে ফোনে বন্দী করে রাখলে এই মুহূর্তটাকে অপমান করা হয়। এটাকে তো আমি আমার মনে বন্দী করে রাখবো। সেসব নয়।
-তবে?
-আসলে আমি ফলতা এসেছি অন্য একটা কাজে। বিজনেসের ব্যাপারেই। তবে আমার ডেস্টিনেশন আলাদা জায়গায়। এখানে একটুখানি এগিয়ে একটা বাড়িতে পাপার পরিচিত এক আঙ্কেল-আন্টি থাকেন। ওনারা এই রিসোর্টের প্রজেক্টটার সময় পাপাকে খুব হেল্প করেছিলেন। তাদের সঙ্গে একটু দেখা করার জন্য আমি আজকের দিনটা এই কটেজে স্টে করলাম। ভালোই হলো, আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। লাঞ্চের পরেই আঙ্কেলের বাড়ি থেকে আমি ঘুরে এসেছি। এখানকার কাজ শেষ। কাল সকালে আমি আমার মেইন ডেস্টিনেশনে বেরিয়ে যাবো ম্যাম।
-ওকে। হ্যাপি জার্নি সৌজন্য!
-না। আমার অনুরোধটা হলো, আপনিও আমার সঙ্গে চলুন।
-কোথায় যাবো আমি?
-প্লিজ ম্যাম! চলুন না! এই কটেজটা রিভারসাইড থেকে বেশ অনেকটা দূরে। আর আমাদের রয় গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের ড্রিম প্রজেক্ট "রয় গেস্ট হাউজ" একেবারে রিভারসাইডে ম্যাম। আপনি রুমের জানলা থেকেই নদী দেখতে পাবেন। কাল সন্ধ্যেবেলা ওই হোটেলের ওপেনিং পার্টি আছে। পাপার বিহাফে ওটা অ্যাটেন্ড করতেই আমি ফলতা এসেছি। আপনি তো বেড়াতেই এসেছেন। একাই আছেন। তাহলে এখানে কটেজে থাকুন, বা রয় গেস্ট হাউজে, ব্যাপারটা তো একই। আপনার ঘোরা-বেড়ানো নিয়ে কথা! প্লিজ আমার স্পেশাল গেস্ট হয়ে আমার সঙ্গে ওখানে আসুন। কালকের পার্টি অ্যাটেন্ড করুন।এটা আমার অনুরোধ!
-দেখুন সৌজন্য, আমি একরকম মাইন্ডসেট নিয়ে এখানে এসেছি, এভাবে হঠাৎ করে শেষ মুহূর্তে বললে তো....
-মুহূর্তরা তো হঠাৎ করে শেষ মুহূর্তেই নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যায় ম্যাম। আমরা আনন্দ করে, সুন্দর মুহূর্তগুলোতে বেঁচে, তাদের আবার ভুলেও যাই! ম্যাম আই প্রমিস ইউ, আপনি এই ট্রিপটা জীবনেও ভুলবেন না। প্লিজ কাম উইথ মি! আমার গেস্ট হয়ে আপনি থাকবেন। প্লিজ!
-লেট মি থিঙ্ক সৌজন্য। আচ্ছা এখন আমাকে উঠতে হবে। একটু বাইরে থেকে হেঁটে আসি! প্লিজ এক্সকিউজ মি!
চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো উজ্জয়িনী। ফোনটা হাতে নিয়ে নিলো...
-ম্যাম অন্ধকার হয়ে গেছে অনেক আগেই। অচেনা অজানা জায়গা। আমি আসতে পারি আপনার সঙ্গে?
-না। আমি সোলো ট্রিপে এসেছি। আপনার সঙ্গে তো দেখা হওয়ার কথা ছিলো না সৌজন্য, ওটা জাস্ট হয়ে গেছে। না হলে কি হতো? আমি একাই তো বেড়াতাম। প্লিজ আমার পার্সোনাল স্পেসে ঢোকার চেষ্টা করবেন না।
-এক্সট্রিমলি সরি ম্যাম। আমি এভাবে ব্যাপারটা ভাবিনি। আপনার সিকিউরিটির জন্যই বলছিলাম। একা-একা বেড়াবেন? তাই....সো সরি!
-হুম! বাই....
কাঁচের দরজা ঠেলে বাইরে বেরোনোর আগে চেয়ার ছেড়ে উঠে সৌজন্য বললো,
-ম্যাম আমি কাল সকালে ব্রেকফাস্টের আগেই বেরিয়ে যাবো। আপনি ভাবতে কতটা সময় নেবেন?
একটু হেসে ফিরলো উজ্জয়িনী। সৌজন্যর সামনে এসে বললো,
-ভাবলাম বুঝলেন তো! ভেবে ভেবে ভাবলাম...
-কি ভাবলেন?
-আপনার মত একজন নামী-দামী বিশিষ্ট মানুষের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করা উচিত হবে কিনা! করলে সেই রাগে যদি আপনি শহরের সবকটা প্রেস কিনে নিয়ে বলে বসেন, বয়কট উজ্জয়িনী সেনগুপ্ত!! তার কোনো পাণ্ডুলিপি আর ছাপা হবে না। তখন আমার কি হবে? রুজি-রোজগার বলে কথা! চাকরী তো আর করি না। একেবারে না খেতে পেয়ে মারা পড়বো তো! তাই ভাবলাম...
-উফ! আপনি কি যে বলেন না ম্যাম! থ্যাঙ্কু সো মাচ! আমার সত্যি ভীষণ ভালো লাগছে! আমি ভাবতেই পারছি না! উফ!
-আসছি!
-ম্যাম রুম সার্ভিসকে বলে আপনার ওয়াশরুমের আলো আর গিজারটা....
-কাল সকালে তো চেক আউট করেই যাচ্ছি। তারপরই সারিয়ে নেবেন না হয়! একটা রাত কোনোমতে কাটিয়ে দিই!
-ওকে ম্যাম। আসলে এই কটেজগুলো অনেক পুরোনো তো। তাই আর কি....
-এক রাতে ওদের বয়স খুব বেশি বেড়ে যাবে না। আসছি আমি। আচ্ছা কাল কটার সময় বেরোবেন?
-আটটা! আর ম্যাম একটা অনুরোধ আছে। আমি আপনার থেকে বয়সে অনেক ছোট। প্রায় অর্ধেকই বলা চলে। হাঁটুর বয়সী!
-মানে? আমার সঙ্গেই তো আমার হাঁটুজোড়াও পৃথিবীতে এসেছে। নাকি ওদের দশ-বিশ বছর পরে এনেছি? আমার যা বয়স, আমার হাঁটুরও তো একই বয়স। আপনি আমার হাঁটুর বয়সী মানেটা কি?
-আরে সবাই বলে না?! আমার মায়ের মুখেও তো কথাটা শুনেছি।
-কিন্তু কথাটা তো টেকনিক্যালি ভুল!
-ওকে! হাঁটু ক্যানসেল! আমি যেটা বলতে চাইছিলাম, আমি অনেক ছোট আপনার থেকে। প্লিজ আমাকে আপনি বলবেন না। তুমি বলবেন।
-দিলে তো আমাকে আমার বয়সটা মনে করিয়ে!!
-নানা। তা নয়....
-আমি আমার রুমে ক্যালেন্ডার রাখি না। আমার কোনো তারিখ মনে থাকে না। কেন জানো?
-কেন ম্যাম?
-দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর, বয়সের হিসেব, এসব আমি মনে রাখতেই চাই না। আমার বয়স যদি তোমার দ্বিগুণও হয়, সেটা ওই ক্যালেন্ডারে হবে সৌজন্য। কিন্তু মনে নয়। কবি-লেখক-লেখিকাদের, শিল্পীদের কোনোদিন বয়স হয় না। দে আর এভারগ্রিন! শোননি ওই কথাটা? ওকে বাই! কাল সকালে দেখা হবে।
-কেন আজ রাতে? ডিনার টেবিলে?
-না। আমি কটেজেই ডিনার নিয়ে নেবো।
-ওকে ম্যাম! তাহলে গুড নাইট!
-গুড নাইট সৌজন্য!
কাঁচের দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে পড়লো উজ্জয়িনী। অন্ধকারের চাদরে পৃথিবী নিজেকে ঢেকে নিয়েছে। ওর মনটা হঠাৎ করেই একদম হালকা হয়ে গেছে। ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করলো ও। লোকাল মার্কেটের খোঁজ করতে হবে। পাওয়ার ব্যাঙ্ক, চার্জার কিনতে হবে। ফোনের ব্যাটারি বক্স প্রায় ফাঁকা। বড় রাস্তা বরাবর তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করলো উজ্জয়িনী। মাথার ওপর অন্ধকার আকাশে, মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে একফালি চাঁদ....
নতুন চার্জারের সাহায্যে ফোনটা ফুল চার্জ হলো। রাতে ডিনারের পর মাম্মামের সঙ্গে ফোনে কথা বলে, মায়ের কান্নাকাটি, বকাঝকা একটু শুনে বিছানায় চুপ করে শুয়েছিলো উজ্জয়িনী। আজ কোন এক অজানা কারণে, ওর মনে কোনো উদ্বেগ নেই। একেবারে যেন নির্লিপ্ত হয়ে গেছে ও। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে, ওর আর মনেই নেই। ঘুম ভাঙলো একেবারে ভোরবেলা। উঠেই মনে পড়লো সৌজন্যর মুখটা। তড়িঘড়ি বিছানা ছাড়লো উজ্জয়িনী....
কোল্ড কফিটা হোটেলের ম্যানেজার উজ্জয়িনীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেলো। ওটাতেই মনোনিবেশ করে উজ্জয়িনী দেখলো, ড্রাইভার ওর আর সৌজন্যর ট্রলিটা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে উঠিয়ে দিলেন। নিজের হ্যান্ডব্যাগটা কিছুতেই কাছছাড়া করেনি উজ্জয়িনী। ওটা নিজের কাছেই রেখেছে। বিল পেমেন্ট করে ম্যানেজারকে আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে উজ্জয়িনী সৌজন্যর গাড়ির দিকে এগোলো। ওকে রিসোর্ট থেকে বেরোতে দেখেই গাড়ি ছেড়ে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে এলো সৌজন্য। দুজনেরই চোখ রোদ চশমার আড়ালে থাকায়, পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় সম্ভব না হলেও সৌজন্য হাসিমুখে বললো,
-গুড মর্নিং ম্যাম।
-মর্নিং সৌজন্য।
-স্যার। ম্যাডাম তো এসে গেছেন। এবার বেরোবেন তো?
-ওহ ওয়েট! আই উইল ড্রাইভ! আপনাকে আর আসতে হবে না। থ্যাঙ্কু!
ড্রাইভারের হাতে বকশিশ গুঁজে দিয়ে গাড়ির সামনের দরজাটা খুলে দিলো সৌজন্য। উজ্জয়িনী উঠে বসলে, গাড়ির দরজা সশব্দে বন্ধ করে নিজে চালকের আসনে বসে ও সিটবেল্ট বেঁধে নিলো।
-ম্যাম যদিও আমি ভালোই গাড়ি চালাই। তবুও আপনি চাইলে সিটবেল্টটা....
-থাক না!
-ওকে! লাইট মিউজিক? আমার মনে হয় প্রথম সকালে ধিকচিক ধিকচিক আপনার নিশ্চয়ই ভালো লাগবে না।
-ধিকচিক ধিকচিক বা মেলোডি, এখন কিছুই ভালো লাগবে না সৌজন্য। লেটস টক! কথা বলতে বলতে যাওয়া যাক?
-শিওর ম্যাম!
গাড়িটা কিছুটা রাস্তা চলার পরই উজ্জয়িনী দেখলো প্রকৃতি কত যত্ন করে নিজের হাতে পৃথিবীকে সাজিয়ে দিয়েছে। চারিদিকে শুধু সবুজের সমারোহ। এত সবুজ দেখে, মনটাই ভালো হয়ে গেলো উজ্জয়িনীর। হঠাৎ ফাঁকা জমিতে একটা ল্যান্ডমার্ক দেখে কৌতূহলী উজ্জয়িনী জিজ্ঞেস করলো,
-সৌজন্য?
-বলুন ম্যাম?
-ওখানে রয় গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ লেখা কেন? আমরা কি এসে গেছি?
-প্রায় এসে গেছি। এখান থেকেই আমাদের রয় গেস্ট হাউজের সীমানা শুরু ম্যাম। গেস্ট হাউজের প্রজেক্টে অনেক প্ল্যানিং আছে। আসলে পুরোনো রিসোর্টটাকে শুধুমাত্র কটেজ, ট্রি-হাউজ আর টেন্ট হিসেবে রাখা হবে। আর এদিকে এটা থ্রি স্টার হোটেল হবে। ট্যুরিস্টদের যার যেমন সামর্থ্য, যেমন বাজেট, তারা তেমন জায়গাতেই থাকবে। বা কেউ যদি ট্রি-হাউজে বা টেন্টে থাকার এক্সপিরিয়েন্স চায় তো, সবরকম ব্যবস্থাই রাখা হবে।
-মানে এখানে অন্য কাউকে আর তোমরা করে খেতেই দেবে না? ঢুকতেই দেবে না? পুরোটাই তোমাদের থাকবে। তাই তো?
-পাপার প্ল্যানিং তো সেইরকমই আছে ম্যাম। দেখা যাক! অনেকটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রজেক্ট অনুযায়ী কাজ করতে বছর দুই-তিন লেগে যাবে। পার্ক, পুল, জিম, বার কাম রেস্টুরেন্ট তো থাকছেই, তাছাড়া হোটেলের ব্যাকইয়ার্ডে নদীটাও পেয়ে যাচ্ছি আমরা! তাই হোটেল থেকেই টিকিট কেটে নৌকাবিহারের ব্যবস্থাও থাকবে। ওদিকে একটা জেটিঘাটও করার কথা আছে। রয় গেস্ট হাউজের মধ্যে পাপা একটা অন্যরকম জগৎ তৈরি করে ফেলবে বলেছে। যাতে উইকেন্ডে ফলতা বেড়াতে এসে রিল্যাক্স করার সময়, রিভারসাইডে যাওয়া ছাড়া ট্যুরিস্টকে আর হোটেলের বাইরে বেরোতেই না হয়। ছোট একটা মার্কেট, স্ট্রীট ফুডের দোকান, ম্যাসাজ পার্লার, স্পা, তাছাড়া কেউ যদি সময়ের অভাবে কলকাতা থেকে কাছাকাছি কোথাও ডেস্টিনেশন ওয়েডিং এর কথা ভাবে, তার জন্যও এখানে একটা এক্সট্রা কমিউনিটি হল করা হবে! রয় গেস্ট হাউজ! বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইন হবে...স্বপ্ন যখন হাতের নাগালের মধ্যে....ভালো না ম্যাম?
-দারুণ!
-এটা আমি বলেছি।
-বিশাল প্ল্যান তো সৌজন্য!
গাড়ির গতি একটু কমালো সৌজন্য। উজ্জয়িনীকে নিজেদের জায়গার পরিসর দেখাতে-দেখাতে বললো,
-হ্যাঁ ম্যাম। আগামী পাঁচ বছরে ফলতার চেহারাই পাল্টে দেব আমরা। এখন তো ধূ-ধূ করছে ফাঁকা জমি। আস্তে আস্তে সব হবে। তবে ঘর থেকে টাকা দিয়ে তো আর হবে না। ব্যবসার টাকা দিয়েই ব্যবসা হবে। তাই বাবা আগে হোটেলের একটা অংশ দাঁড় করিয়ে দিলো। বললো, ওটা আপাতত চলুক। তাতেও কিছুটা টাকা উঠে আসবে।
অ্যামিনিটিস পরে হবে। হোটেল রমরম করে চলতে চলতেই ওদিকের কাজগুলো হবে। কিছু ট্র্যাভেল এজেন্সিকে টাকা দেওয়া হয়েছে ম্যাম। সোশ্যাল মিডিয়া তো এখন প্রোমোশনের খুব ভালো একটা প্ল্যাটফর্ম। আমাদের অফিসিয়াল পেজ আর ওয়েবসাইট থেকে ট্র্যাভেল গ্রুপগুলোতে পেইড প্রোমোশন করানোর জন্য বলা আছে। ওপেনিং এর জন্য পাপা কিছু অফারও দেবে শুনেছিলাম। শুনেছিলাম তো বিজ্ঞাপনের ভালো রেসপন্স আসছে। আজ গিয়ে দেখবো কি অবস্থা! যারা আসবে, তারা এখান থেকে ঘুরে গিয়ে পজিটিভ রিভিউ দিলে আমাদের হোটেলেরই তো প্রোমোশন হয়ে যাবে।
-এই সব জমি তোমাদের সৌজন্য?
গাড়ি চালাতে চালাতে সৌজন্য বললো,
-হ্যাঁ ম্যাম! এসে গেছি আমরা। চলুন!
গেট থেকে দুজন ওয়াচম্যান দৌড়ে এলো সৌজন্যর গাড়ির দিকে। ওদের একজনের হাতে চাবি দিয়ে গাড়ি থেকে ট্রলিগুলো বের করে গাড়ি পার্কিং জোনে ঢুকিয়ে দিতে বললো সৌজন্য। তারপর উজ্জয়িনীর দিকে চেয়ে বললো,
-ওয়েলকাম টু রয় গেস্ট হাউজ ম্যাম! প্লিজ আসুন!
লনে পা রেখেই হতভম্ব সৌজন্য। এত ট্যুরিস্ট! এই অফ সিজনেও! বেশ খুশিই হলো ও। সকলকে পেরিয়ে উজ্জয়িনীর সঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করলো। হোটেলের সাজসজ্জা, আয়োজন দেখে উজ্জয়িনীর ভীষণই ভালো লাগলো। বাইরে কত রংবেরঙের ফুলের বাগান। কি সুন্দর পরিবেশ। ভিতরেও বেলুন দিয়ে সাজানো হচ্ছে। সন্ধ্যেবেলার পার্টির প্রস্তুতির চিহ্ন দিকে-দিকে....
-ম্যাম আপনি একটু ঘুরে দেখতে পারেন। আমি রিসেপশনে কথা বলে আসছি।
-ওকে!
সুবৃহৎ হলের মধ্যেই ঘুরতে লাগলো উজ্জয়িনী। একটু দূরে একটা সোফায় গিয়ে বসলো।
-স্যার! গুড মর্নিং! বস বলেছিলেন, আপনি আজ সকালেই আসবেন।
বয়স বড় বেশি না ম্যানেজারের। তিরিশের আশেপাশেই হবে। মুখে চওড়া হাসি টেনে সৌজন্যকে উনি স্বাগত জানালেন। রোদ চশমা খুলে রিসেপশনে উপস্থিত সকল কর্মচারীর দিকে চেয়ে সৌজন্য বললো,
-ভেরি গুড মর্নিং টু অল অফ ইউ! প্রচুর ট্যুরিস্ট এসেছেন তো!
-ইয়েস স্যার! আরে আজকের বিশেষ দিন উপলক্ষ্যে বস তো ব্রেকফাস্ট, ডিনার, লাঞ্চ, ড্রিঙ্কস সব ফ্রি করে দিয়েছেন।
-পাপা?
-হুম! এটাই তো বসের বিজনেজ স্ট্র্যাটেজি! যত বেশি গ্যাদারিং, তত হোটেলেরই প্রোমোশন স্যার। আজ সবকিছু আমি নিজের হাতে দেখেশুনে করছি। তাও বস সকাল থেকে অনেকবার ফোন করেছেন। আপনি যে পৌঁছে গেছেন, একটা ফোন করে একটু জানিয়ে দেবেন স্যার। তাহলে বস একটু নিশ্চিন্ত হবেন।
-শিওর-শিওর! বলছি শুনুন, আমার রুম রেডি তো?
-একদম স্যার। এই যে চাবি! এখানে একটা সই করে চেক ইন টাইম, মোটামুটি কতক্ষণ থাকবেন অ্যাপ্রক্সিমেট কিছু একটা বসিয়ে রাখুন। আপনি রুলস জানেনই তো স্যার...আপনারই তো হোটেল, জাস্ট ফর্মালিটিজ। আসলে বস বলেন, রুলস সবার জন্যই এক যেহেতু....
-সেসব পরে হবে। আপনি আগে আমার কথা শুনুন। ঠিক আমার রুমের পাশের রুমটাই আমার চাই। আমার সঙ্গে একজন গেস্ট এসেছেন। উনি থাকবেন। আমার পাশের রুমটাই কিন্তু....
-সরি স্যার! আজ তো টোটাল হোটেলে আর একটাও রুম ফাঁকা নেই!!
স্তম্ভিত হয়ে গেলো সৌজন্য। তারপর বললো,
-হোয়াট! এটা কিভাবে সম্ভব?
-স্যার বসের বিজ্ঞাপনটা সোশ্যাল মিডিয়ার ট্র্যাভেল গ্রুপগুলোতে রীতিমতো ভাইরাল হয়ে ট্রেন্ডিংয়ে আছে। আর 'হুজুগে বাঙালি' কথাটা আপনি জানেনই তো! ব্যাস! পুরো হোটেল ভর্তি! আপনার রুমটাও পারলে দিয়ে দিলে ভালো হয় এমন অবস্থা! কেমন ভিড় দেখছেন না! তাও আমরা কাল রাত আটটার পর থেকে আর কোনো ফোন রিসিভ করছি না। কারণ আর রুম দেওয়া সম্ভব নয় স্যার!
-শিট!
-স্যার?
-দিস ইজ সো এমব্যারাসিং! এবার আমি তাকে কি বলবো? আচ্ছা শুনুন, হোটেলে এমন কোনো রুম আছে, মানে ছোটখাটো, যেমনই হোক। ম্যাডামকে আমার রুমটা দিয়ে আমি ওখানে থেকে যাবো, এমন কোনো রুম? ছোটখাটো....যাহোক কিছু!
-সরি স্যার! ওই গোডাউনে সব মাল স্টোর করা আছে, ওটা ছাড়া তো আর....হোটেলটা তো ছোটই স্যার। রুম তো খুব বেশি না। আন্ডার কনস্ট্রাকশনে আপনি বিজনেস শুরু করলে তো...
-ওয়ার্স্ট ফিলিং এভার!
-স্যার আপনার রুমের চাবি আর...
-রাখুন তো! দাঁড়ান আমি আসছি....কি বাজে পরিস্থিতি!
উজ্জয়িনীর দিকে এগোলো সৌজন্য....
-ম্যাম! ভেরি অকোয়ার্ড সিচুয়েশন। আই অ্যাম সো সরি!
-কি হয়েছে সৌজন্য?
-কিভাবে বলি?
-মাইক্রোফোন লাগবে?
-মজা নয় ম্যাম। আমার মান-সম্মান সব শেষ। কত বড় মুখ করে আপনাকে কাল ইনভাইট করলাম। কাল আমার একবার অন্তত এখানে ফোন করে নেওয়া উচিত ছিলো!
-কি হয়েছে বলো তো?
-ম্যাম পুরো হোটেলে একটাই রুম ফাঁকা আছে। আই
অ্যাম সো সরি। আমার বলতে এতটাই বাজে লাগছে...
অসহায়ভাবে সৌজন্য চাইলো উজ্জয়িনীর দিকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সৌজন্যর দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে উজ্জয়িনী বললো,
-হুম! বুঝলাম। তাহলে এখন কি করণীয়?
-আপনি এখানে থেকে যান। আমি রিসোর্টে ফিরে যাচ্ছি। লাঞ্চ করেই চলে আসব। দুপুরের মধ্যেই ঢুকছি। পার্টি তো সন্ধ্যেবেলায়।
-বয়স কত যেন?
-কার ম্যাম?
-তোমার?
-পঁচিশ। কেন?
-তুমি আমার কি যেন, হাঁটুর বয়সী বলছিলে না! তার মানে চিন্তায়-ভাবনায় আমার থেকে তোমার তো আরও আধুনিকমনস্ক হওয়া উচিত!
-বুঝতে পারছি না। কি বলতে চাইছেন ম্যাম?
-এই পরিস্থিতিতে বেশ কিছু অপশন আছে। পরপর বলছি। প্রথম, তোমার কোনো অসুবিধে না থাকলে, নিজের ওপর কনফিডেন্স থাকলে, তুমি-আমি স্বচ্ছন্দেই একটা রুম শেয়ার করতে পারি।
হাঁ করে সৌজন্য চেয়ে রইলো উজ্জয়িনীর দিকে....
-কি? প্রবলেম আছে কোনো?
সৌজন্য নিরুত্তর।
-বুঝেছি। এই অপশনের আবার কয়েকটা দিক আছে। সেগুলোও বলছি। তুমি এখনই ফোন করো তোমার গার্লফ্রেন্ডকে। তাকে সিচুয়েশন বোঝাও। সে পারমিট করলে তবেই আমার সঙ্গে রুম শেয়ার করো। যদিও না করার চান্সটাই বেশি। আর একটা দিক হলো, গার্লফ্রেন্ডের কাছ থেকে পুরো ব্যাপারটা বেমালুম চেপে যাও। কারণ এক্ষেত্রে তার তোমাকে ভুল বোঝার সম্ভবনাই বেশি। অ্যান্ড লাস্ট অপশন, রিসোর্টের রুম সার্ভিসকে ফোন করে কটেজের গিজার আর ওয়াশরুমের আলো ঠিক করতে বলো। আমি রিসোর্টে ফিরে যাব। তুমি নও। কারণ আজ এখানে তোমাকে প্রয়োজন। তোমার হোটেল, তোমার পার্টি, ইউ আর দা হোস্ট! অনেককিছু দেখেশুনে রাখতে হবে তোমাকে। এটা তোমার কাজের জায়গা। পাপার অনুপস্থিতিতে তুমিই এদের স্যার। দায়িত্বও অনেক। তাই তুমি এখান থেকে যাবে না! বলো? কোনটা করবে?
সৌজন্য নিরুত্তর।
-বলো সৌজন্য? আমার খিদে পাচ্ছে তো! এখানে কিছু খেতে দেবে না রিসোর্টে ফিরবো আমাকে জানাও...
-ওকে ম্যাম। ডান!
-কি? কোনটা? আরে কোন অপশনটা নিলে সৌজন্য? আমাকেও বলো?
হলঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা হৃদয় আকৃতির একাধিক লাল বেলুন পেরিয়ে দৌড়ে রিসেপশনের দিকে যেতে যেতে হাসিমুখে সৌজন্য বললো,
-ওই অপশনটা কোনো কাজের না ম্যাম!
-কোনটা?
-আমি একা!
-মানে? তুমি একা থাকছো? আমি কটেজে ফিরছি?
-নানা। ওই গার্লফ্রেন্ডওলা অপশন। আমি সিঙ্গেল! সিঙ্গেল মানুষকেই তো আপনারা একা বলে থাকেন, তাই না? তাহলে আমার চেয়ে একা এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই! একাকীত্ব কি আমি খুব ভালো করে জানি ম্যাম!
সুন্দর একটা হাসি উপহার দিয়ে সৌজন্য রিসেপশনে ছুটলো। উজ্জয়িনীর মন মুহূর্তেই ওই সুন্দর হাসির আড়ালে, এক দারুণ যন্ত্রণার ছায়া দুলতে দেখলো সৌজন্যর দুচোখে। একেবারে চুপ করে গেলো ও। সৌজন্যর শেষ কথাটুকুর অনুরণন তখন ওর কানে,
"তাহলে আমার চেয়ে একা এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই! একাকীত্ব কি আমি খুব ভালো করে জানি ম্যাম!"
"হুম! এজ, স্টেটাস, লুক, ম্যানার্স....পারফেক্ট! যে বয়সে ডানহাতে বাঁ-হাতে গন্ডাখানেক গার্লফ্রেন্ড থাকার কথা, সেই বয়সে জুনিয়র রয়বাবু সিঙ্গেল! কিন্তু হ্যাপিলি কি? ভাবার বিষয় উজ্জয়িনী! মুখে এত সুন্দর হাসি, এত চঞ্চল, প্রাণোচ্ছল, কিন্তু চোখ যে অন্য কথা বলছে!"
সামান্য স্বগোতোক্তির পর মৃদু হেসে বেতের সুদৃশ্য টেবিল থেকে একটা ম্যাগাজিন উঠিয়ে নিলো উজ্জয়িনী সেনগুপ্ত....
-আচ্ছা শুনুন, এক্সট্রা রুম লাগবে না। আমি আমার গেস্টের সঙ্গেই রুম শেয়ার করবো। কোথায় সই করতে হবে, দিন! নিজেদের করা রুল নিজেই ভাঙলে, পাপা আবার ফোন করে চেঁচাবে তো!
-এই যে স্যার, এখানে সই করুন। ম্যাডামকেও একটা সই করতে হবে, আর মানে এই কলামটা....মানে একসঙ্গে থাকছেন যেহেতু....ম্যাডামের সঙ্গে আপনার রিলেশনটা স্যার...
-ওসব লাগবে না। ম্যাডাম এখানে সই করবে না। আর শুনুন, পাপার কানে যেন এই খবরটা না যায়, যে আমার সঙ্গে আমার রুমে কোনো ফিমেল গেস্ট রয়েছেন। একদম বলবেন না। ওকে? আমি একাই সই করে দিচ্ছি!
-স্যার....না মানে....এটা তো রুলস....কতক্ষণ কি....থাকবেন? কতক্ষণের জন্য বুকিং? একটু ডিটেলস....মানে এটা কি ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড? ম্যাডাম কি একটা রাতই আপনার সঙ্গে....কলাম তো ফাঁকা রাখা যাবে না স্যার....মানে কিছু একটা তো....
ঘাড় নীচু করে সই করে তারিখটা লিখছিলো সৌজন্য। "ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড" কথাটা কানে যাওয়া মাত্রই, ওর হাতের কলমটা কেঁপে উঠে একদম স্থির হয়ে গেলো। মাথা তুলে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে সৌজন্য চাইলো ম্যানেজারের দিকে....
(চলবে....)
ছবি : সংগৃহীত
"ত্রিভুজ" সহ লালমাটি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত "নির্বাক" ও "সূর্যোদয়ের আগে" পাওয়া যাচ্ছে চক্রবর্তী এন্ড সন্স থেকে 26% ছাড়ে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করতে পারো এই নম্বরে 6290381169.
এছাড়া পাঠকবন্ধু - 7439112665 থেকেও বিশেষ ছাড়ে উপলব্ধ ,
যোগাযোগ করুন ফোন অথবা Whatsapp এ।
Ashadharon 🤗
উত্তরমুছুনUff di pagol kore debe ebar😍😍😍
উত্তরমুছুনNice
উত্তরমুছুন😯😯 one night stand bah darun
উত্তরমুছুনDarun laglo
উত্তরমুছুনতোমার লেখিকা জীবনের স্ট্রেস বুঝতে পারছি.... সত্যিই এইসব আমরা পাঠকরা কিছুই বুঝতে পারি না... লেখাটা দারুন চলছে... আর 'আমার চেয়ে একা এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই' ছুঁয়ে গেলো ❤️❤️❤️❤️
উত্তরমুছুনখুব সুন্দর লাগছে পড়তে,, অপেক্ষায় থাকলাম ❤️
উত্তরমুছুনDarun interesting
উত্তরমুছুনএক প্যাকেট কুরকুরে নিয়ে বসেছিলাম, কখন শেষ হয়ে গেল টের পেলাম না, কিন্তু মুশকিল আসান কীভাবে হবে?
উত্তরমুছুনদারুণ দিদি
উত্তরমুছুনজমে উঠেছে
উত্তরমুছুনখুব ভালো
উত্তরমুছুনদারুণ লাগছে, ❤️❤️❤️❤️❤️
উত্তরমুছুনসৌজন্যের প্রেমে পড়ে যাচ্ছি যেনো ❤️❤️❤️❤️
উত্তরমুছুনশেষের কথাটা কানে লাগলো বেশ। 3টেপর্ব পড়লাম। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম । বেশ ভালোই লাগছে আমার।
উত্তরমুছুনউজ্জয়িনীর ব্যক্তিত্ব মারাত্মক টানছে। দারুন এগোচ্ছে দিভাই❤❤❤
উত্তরমুছুনBesh..besh...
উত্তরমুছুন👏👏👏👏
উত্তরমুছুনঅসাধারণ! তবে সৌজন্য স্টাফদের আলাদা গেট দিয়ে উজ্জয়নীকে আনলে ভালো করত না?
উত্তরমুছুনkhub bhalo laglo golpo ta pore. asadharon.
উত্তরমুছুনThank you