
নির্বাক
সাথী দাস
চতুর্থ পর্ব
হাসিমুখে ছবির ফ্রেমখানা কাপড়ের আঁচল দিয়ে যত্ন করে মুছলেন সৌদামিনী দেবী।তারপর টুপ ডুব দিলেন নিজের অতীতে....
-ওই সামনের গাছগুলো দেখছো রজত!?ওই গাছগুলো পর্যন্ত আমাদের জমির সীমানা!
-বাপরে!অনেকটা জমি তো বড়দা!
-হ্যাঁ ভাই!ওই আর কি!মা চন্ডীর কৃপায় লবণ আর জ্বালানীর কেরোসিনটুকু ছাড়া,আর বিশেষ কিছুই কিনতে হয় না।মাঠে ধান আছে,বাগানে ফল-ফলাদি-সবজি,আর পুকুরের মাছ!এই নিয়েই বেশ কেটে যাচ্ছে।তা তুমি আমার ভাইয়ের বন্ধু পল্লবের ভাই,মানে আমারও ভাই।পুজোয় তো ঠাকুর-দালানে থাকছোই,তিনবেলা পাত পেড়ে খাবে কিন্তু।তারপরেও আমাদের বাড়িতে একদিন তোমার নেমন্তন্ন রইলো।পুজোর কদিন তো রান্নার ঠাকুর রাঁধবে,তারপর আমার মায়ের হাতের,বৌদিদিদের হাতের রান্না খেয়ে যেও!
-আসবো দাদা!পল্লবের সঙ্গেই আসবো!
-এই ভুতো!
সজোরে হেসে ফেললো রজতশুভ্র....
-হাসলে যে!
-ভুতো?নামটা কেমন যেন!
-আরে আর বোলো না,সেবার তো বসন্ত হয়ে মরেই যাচ্ছিলো হতভাগা।ওকে বাঁচানোর জন্য শেতলাতলা ছেড়ে,বুড়ো শিবতলায় মা মানত করেছিলো।পচে মরতে গিয়েও বেঁচেও গেছে আমার ভাইটা!দেখছো না,ওর সারাটা মুখে কেমন দাগ!ওইরকম সারা গায়েও আছে।চোখদুটোও তো খোয়া যেতে বসেছিলো।ওই বুড়ো শিবতলার ঠাকুরথানে আমার মা সোনার চোখ,সোনার বেলপাতা মানত করেছিলো।ভাই বেঁচে যাওয়ার পর দিয়েছে।বাবার বড় মূর্তিতে তো পরানো যায় না,অনেক উঁচুতে।তবে সামনের ছোটো শিবলিঙ্গে ওগুলো পরানো আছে দেখবে।ওই তারপর থেকেই ঠাকুমা ওকে ভূতনাথ বলে ডাকে।সেই থেকেই ভুতো হয়ে গেছে।আর আমার কাছে ভূত....এ ভূত,এদিকে আয়!ব্যাটার আসল নামটাই ভুলে গেছি,বুঝলে রজত!এক্ষুণি বলবে,দাদা আবার তুমি সবার সামনে আমাকে ভূত বলে ডাকছো!?হে হে....
কথা বলতে-বলতেই বড়দাদার থেকেই বহু অজানা সংবাদ জানলো রজত।বড়দাদা,মেজদাদা,ভুতোদাদা...তিন দাদা,বড় বৌদিদি,দুই বোন,বাবা-মা,আর বিধবা ঠাকুমার পরিপূর্ণ সংসারে,সৌদামিনী সবার ছোটো।জন্ম হওয়ার পর তার মুখ থেকে কোনো শব্দ শোনা যায়নি।সর্বকনিষ্ঠা কন্যার মুখ হতে মা ডাক শোনার আশায়,গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার,বড় ডাক্তার এমনকি সদরের নামকরা ডাক্তারও দেখিয়ে আনা হয়েছিলো একরত্তি মিনীকে।কিন্তু ঈশ্বর ওই শিশুকন্যার শ্রবনেন্দ্রিয় সম্পূর্ণ নিখুঁতভাবে সৃষ্টি করলেও,বাকযন্ত্র প্রস্তুত করার সময় বুঝিবা কিঞ্চিৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন।তাই অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে সেই কাজ।মুখে ভুবন-ভোলানো হাসি থাকলেও,মুখগহ্বরের অভ্যন্তরে অবস্থিত সচল জিহ্বা উচ্চারণ করতে পারে না শব্দের ভান্ডার।প্রকৃতির নিয়মে নির্বাক মেয়েটির বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই,পরিবারের সকলেরই করুণার পাত্রী হয়ে ওঠে ও।সকলেই ওর আসন্ন ভবিষ্যৎ নিয়ে কমবেশি চিন্তিত,একমাত্র ভুতোদাদা ছাড়া।জগৎ-সংসারের কোনো বিষয়েই ওই ছেলেটির কোনো আগ্রহ নেই।মনে হিংসার লেশমাত্র নেই।দায়িত্ব-কর্তব্যজ্ঞানও নেই।হাতে-পায়ে বড়ো হয়ে দীর্ঘকায় যুবক হয়ে উঠলেও,ভুতোর মনের মধ্যে সর্বদাই বাঁচে এক আপনভোলা কিশোর।সংসারের যাঁতাকলে পিষে,সকলের বাক্যবাণ সয়ে,এই ভুতোদাদা আর হাসিদিদিই ছিলো,নির্বাক সৌদামিনীর একমাত্র সহচর ও সহচরী।পেয়ারা চুরি করে খাওয়া,আচার চুরি করে খাওয়া,অসময়ে পুকুরে ডুব দিয়ে বাড়ি ফেরার মতো নজিরবিহীন দুঃসহসিকতার পরিচয় বহন করার সঙ্গী ছিলো,ওই দুটি মানুষই....তাদের সঙ্গেই মিনীর যত মান-অভিমান,হাসি-খেলা....বড়দাদার কথা শুনতে-শুনতে,সিক্ত পদ্মের গভীরে বুঝি হারিয়েই যাচ্ছিলো রজত।এমন সময় ভটভট করে তুমুল শব্দ করে একটা মোটরে আঁটা ভ্যান এলো।একটু দূরেই অসংখ্য গর্তে ভরা পিচঢালা রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়লো ভ্যানটা।ভটভটির বীভৎস শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে রজত দেখলো,একটি মেয়ে ছুটতে-ছুটতে নেমে এলো সেই ভ্যান থেকে...
সৌদামিনী চুপ করে বসেছিলো ওই ভ্যানেই।সে মাথা ঘুরিয়েই অপলক দৃষ্টিতে চেয়েছিলো ওর দিকেই।তার দৃষ্টিতে লজ্জায় মরে গিয়ে,মনের সুখে আখ চিবোনোই বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো ওর।মুখের মধ্যে জমিয়ে রাখা ছিবড়েটুকু ফেলে দিয়ে,মুখ মুছে চুপ করে ভ্যানের পিছনে বসে,সেদিন পা দোলাচ্ছিলো সৌদামিনী।ওর হাসিদিদি ছুটে গিয়েছিলো বড়দাদার কাছে,
-ও দাদা!এই যে ফর্দ।আমি সারা গ্রাম তোমাকে খুঁজে-খুঁজে সাড়া হলাম গো!তুমি এইখানে দাঁড়িয়ে আছো!?বাবা এই জিনিসগুলো সব আনতে বললো।এনে ঠাকুর-দালানে রাখতে হবে...
-পুজোর বাকি বাজার তো?
-হুম!
-আচ্ছা যাচ্ছি!এই শোন হাসি,এর নাম রজত।তোর ভূতদাদার বন্ধু আছে না,পল্লব।ওই পল্লবের ভাই।এখন তোর দাদারও ভাই বলতে পারিস।অনেকদিন পর শহর থেকে এই গ্রামে মাসির বাড়িতে বেড়াতে এসেছে।আমাদের পুজোর জন্য এখানে এসেছে পল্লবের সঙ্গে।পুজোর কদিন থাকবে।রজত এবার জলপানি পেয়ে পাশ দিয়েছে।অনেক পড়ালেখা জানে কিন্তু।আমাদের মত পাড়াগেঁয়ে নয়।কলেজে যায়।আবার মোক্তার হওয়ার কলেজ!কদিন পর মোক্তারও হয়ে যাবে।কত নামডাক হবে!কত বড় মানুষ হবে!একটু দেখবি,যত্ন-আত্তির যেন কোনো খামতি না থাকে!
-পল্লবদা,মানে পলুদার ভাই।তার মানে তো ডাক্তারবাবুর আত্মীয় গো বড়দা!
-হুম।তোমাদের গ্রামের ডাক্তারবাবু আমার নিজের মেসোমশাই হন।মাসির শরীরটা ভালো ছিলো না।মায়ের কথায় তাই মাসিকে দেখতে এসেছিলাম।পুজোর আগেই বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা ছিলো।কিন্তু মাসি কিছুতেই ছাড়লো না।বলে শহরের পুজো তো সবসময়েই দেখিস রজত,এবার গ্রামের পুজো দেখে যা।জোর করে রেখে দিলো।পলুদাদাও ধরে-বেঁধে নিয়ে এলো এখানে।
-বেশ করেছে।মা ঘরে আসছে,তুমি এই সময় গ্রাম ছেড়ে যাবেই বা কেন!আমাদের ডাক্তার-জ্যাঠা তো ধন্বন্তরী।তার পরিবারের নামেই গ্রামের সবাই হাতজোড় করে গড় করে।আর আমাদের ভটচাজ বাড়ির ঠাকুর-দালানের নামেও কিন্তু,সবাই একটু ভক্তি করেই চলে,বুঝলে রজত!
-হ্যাঁ বড়দা!খুব ভালো লাগছে এখানে এসে।আমার গ্রাম খুব ভালো লাগে।সেই কোন ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে আসতাম।তারপর লেখাপড়ার চাপে আর আসা হয়ে ওঠেনি।তবে গ্রামে বেড়াতে আমার বেশ লাগে!
-হ্যাঁ,বেড়াবে তো!এই ভূত?
-আঃ!দাদা!
-এদিকে আয়,দুই বন্ধু একেবারে যেন গলাগলি মানিকজোড়।এসেই প্যান্ট গুটিয়ে ক্ষেতে নেমে পড়েছে।আঃ-উঃ পরে করবি!ওপরে ওঠ।এদিকে যায়।এই যে,শোনো পল্লব!
-বলো বড়দা!
-আমি একটু বেরোলাম বুঝলে!তোমরা ওই ভটভটি করেই গোটা গ্রামটা একটু ঘুরে এসো না!তোমারও খুব ভালো লাগবে রজত!এই মিনী?তুই আর হাসি যা!ওদের বুড়ো শিবতলার ঠাকুরথানটা ঘুরিয়ে নিয়ে আয়...
-ও দাদা!আমরা এখন যেতে পারবো নাকো।আমরা তো এখন মাধবীর বাড়ি যাচ্ছি!ওকে তো আজ ওর বর দেখতে আসবে।কাত্তিক বাদেই আসছে অগঘানে ওর বিয়ে না!!পুজোর ছুটিতে বর বাড়িতে এসেছে,তাই আজ পাশের গ্রাম থেকে মাধুকে দেখতে আসবে।সবাই কখন চলে গেছে।এখন আমি আর মিনী যাচ্ছি।তাই তোমার হাতে ফর্দ ধরিয়ে দিতে কত্ত দেরি হয়ে গেলো।আর না!ও রজতদাদা,ওই ভুতোদাদা আর পলুদাদার সঙ্গে তুমি এই বেলাটা ঘুরে নাও না গো!মাধুর বরের নাকটা খ্যাদা না ব্যাকা,বর শুঁটকো না মুটকো,তালগাছ না তুলসিগাছ,চোখ ট্যারা কিনা,দাঁত উঁচু কিনা,একটু মাধুর বরকে দেখতে যাবো না বলো!!
-বাবা!!তোমরা বর দেখার সময় এতকিছু দেখো বুঝি?!কিন্তু বিয়ে তো তোমাদের বন্ধুর।তোমরা এতকিছু দেখে কি করবে?
দরাজ কণ্ঠে প্রাণখোলা হাসি হেসে উঠলো রজত....
-বাঃ রে!বিয়ের দিন 'মাধু তোর বর এসেছে' বলে চেঁচাতে হবে না?!তখন বলতে হবে তো,ওই তোর নাকবোঁচা বর এলো।ওই তোর শুঁটকো বর এসে গেছে তোকে বিয়ে করতে,ওটাই তো মজা গো!আজ না দেখলে আর ওই বরকে আমরা ফাঁকে পাবো!?যাই গো,বেলা যে বয়ে গেলো...
-আচ্ছা ঠিক আছে।তোমরা কোথায় যাবে যাও না!আমি তো কদিন আছিই...
-এই মিনী!!আয়-আয়!!একদৌড়ে আয়!
পা দোলানো বন্ধ করে ভ্যান থেকে নেমে আখ হাতে ছুটে এসে,দিদির হাত ধরেছিলো মিনী।কতগুলো লাল-হলুদ-নীল-সবুজ রঙের কাঁচের চুড়ি ঝমঝমিয়ে উঠলো ওর হাতে।মেটে-মেটে লাল কাপড়ের সঙ্গে রং মিলিয়ে,ঘটিহাতা ফুলো-ফুলো লাল ব্লাউজ,আর সেই সঙ্গে লাল ফিতে দিয়ে দুদিকে যত্ন করে বিনুনী বাঁধা ওর মাথায় একঢাল চুল।দিদির হাত ধরেই নবযৌবনা মিনী নেমে গেলো ক্ষেতের মাঝে।ব্যস্ত পায়ে আল ধরে দৌড়োতে লাগলো।দূরের সবুজ ধানক্ষেতের একেবারে শেষপ্রান্তে ওই দুই নারী মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত চেয়ে রইলো রজতশুভ্র।একসময় দূরে অদৃশ্য হলো তার হাতে ধরে থাকা ওই লম্বা আখটা...
-চল রজত।তোকে ভূতোদের পানের বরোজ দেখিয়ে আনি!
-আর লঙ্কা ক্ষেতও তোর ভাইকে দেখাবো পলু!এই পলু!ওই পাড়ায় যাবি নাকি?
-আর বাড়িতে কি বলবি?
-আরে বলবো কেন?এট্টু সুযোগ বুঝে পালাবো তো!
ভটভটির কানফাটা শব্দে কোনো কথা শুনতে পাওয়াই বড় দায়।সেই শব্দকে ছাপিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগলো দুজন গ্রাম্য ও একজন শহুরে যুবক।চেঁচিয়ে উঠলো রজতও,
-কেন?পালাবো কেন?কোথায় যাবো?বাড়িতে বলে গেলেই তো হয়!
-এই পলু!কি বলে রে তোর ভাই!আমার বড়দা জানতে পারলে ঠ্যাং ভেঙে দেবে!
-কেন?কোথায় যাবে তোমরা?
-ও গান শুনতে যাওয়ার কথা বলছে রজত।ভালো বাড়ির ছেলেরা রাত জেগে ওসব নাচগান দেখে না।ওখানে অনেকরকম মেয়েরা থাকে।হেলেদুলে নাচগান করে।বখে যাওয়া বড়োরা যায়।আমিও এই বাউন্ডুলে ভূতের পাল্লায় পড়ে দু-একবার গেছি।এবার যাবো না।তুই সঙ্গে আছিস।বাড়ি গিয়ে হুড়মুড় করে সব বলে দিবি।
-বলবো না।আমিও যাবো তোমাদের সঙ্গে!
রজতের কথা শুনে চুপ করে গেলো পল্লব আর ভুতো।রজত আবার বললো,
-উফফ!!বাবা রে!এর চেয়ে হেঁটে যাওয়া ভালো।এই রাস্তায় ভটভটিতে চড়লে,হাড়ের খোলনলচে সব একেবারে খুলে যাবে।বললাম তো পলুদা,আমি কাউকে কিছু বলবো না।কখন যাবে তোমরা?
-দেখছি!যখন ডাকবো তখনই বেরিয়ে আসতে হবে কিন্তু...ঠাকুর-দালানে বসে থাকলে হবে না।
-আচ্ছা!
-আরে পলু,আমরা রাতে তো তিনজন এক ঘরেই শোবো।উঠেই টর্চ নিয়ে পালাবো।কেউ জানতেই পারবে না....
-কোনোদিনও আমার মাকে বলবি না কিন্তু রজত।মা বাবার কানে তুলে দিলে,বাবা আমাকে বাড়িছাড়া করবে।
-নানা!মাসি কিচ্ছু জানবে না।আমি যাবো তোমাদের সঙ্গে....
-আচ্ছা!তবে অষ্টমীর রাতে।সবাই যখন সন্ধিপুজোর কাজে ব্যস্ত থাকবে,তখনই....এই তো এসে গেছি।ও কাকা!আরে থামো-থামো!শহরের অতিথকে একটু মিষ্টি পান,সাঁচি পান খাইয়ে নিয়ে আসি দাঁড়াও।এসো রজত!
চারদিক দিয়ে সবুজ আস্তরণে ঘেরা স্যাঁতসেঁতে পানের বরোজের ভিতরে মাথা নীচু করে ঢুকলো ওরা....
-এই শোনো?
ঘর থেকে বেরিয়েই বারান্দা পেরিয়ে কোমরে কাপড় গুঁজে ছুটতে যাচ্ছিলো সৌদামিনী।রজতের ডাকে দাঁড়িয়ে পড়লো।
-সারাদিন এভাবে ছুটে বেড়াও কেন?পড়ে গেলে তো হাত-পা ভেঙে বসে থাকবে।যখনই দেখো দুম-দুম করে দৌড়োচ্ছে!তোমার পড়াশোনা নেই?
দুদিকে ঘাড় নাড়লো সৌদামিনী....
-কেন?
মাথা নীচু করেই দাঁড়িয়ে রইলো ও...
-এখন কোথায় চললে?
আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে গেলো সৌদামিনীর মুখশ্রী...ও হাত নেড়ে কত কি বললো রজতকে।কিন্তু অনভ্যাসের কারণে কোনো নির্বাক নারীর ভাষা বোঝার ক্ষমতা রজতের নেই।ওকে দেখেই সৌদামিনী বুঝতে পারলো,রজত কিছুই বুঝতে পারছে না।তখন হাল ছেড়ে দিয়ে আবার পিছন ফিরে দৌড়োতে গেলো ও...
-এই!দাঁড়াও!
কাপড়ের আঁচল ঠিক করতে-করতেই পেটের কাছে গুটিয়ে রাখা আঁচলের ভাঁজ থেকে খসে পড়লো একটা ছোট্ট কৌটো...
-কি গো ওটা?
সৌদামিনী ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারা করে রজতকে চুপ করতে বললো।তারপর ওটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে,ওকে বাড়ির পিছনদিকে ডাকলো।সবার চোখ এড়িয়ে ওর সঙ্গে রজত সেদিকে গেলে,ওই কৌটোটা বের করে রজতের হাতে দিলো মিনী...রজত ওটা খুলে দেখলো,ভিতরে লাল-সাদা কিসব রয়েছে...
-কি এটা?
নিজের জিভে হাত ঠেকিয়ে ওটা রজতকে খেতে বললো মিনী।আঙুলে একটুখানি নিয়ে মুখে ঠেকিয়েই রজত বুঝলো,ওটা ঝালনুন....
-কোথায় যাচ্ছ এটা নিয়ে?নুন আবার কেউ চুরি করে খায় নাকি!!তাও আবার নিজের বাড়ি থেকে!!
দূরে হাত দেখিয়ে গোল-গোল আকৃতির কিছু একটা দেখালো মিনী...তারপর নিজের মাথার চুল দেখিয়ে,হাত নেড়ে মারার কথাও বললো....অর্থাৎ সেই বুড়ি ওকে মারবে,যার মাথায় পাকা চুল...হেসেই ফেললো রজত।
-তোমার ঠাকুমা মারবে?তোমাকে?কেন?নুন চুরি করেছো বলে?
দুদিকে ঘাড় নেড়ে না বললো মিনী।
-তবে?
আবার গোল-গোল আকৃতি দেখিয়ে কিছু বোঝালো মিনী...
-কি?ওহ...পেয়ারা!!
এবার জোরে-জোরে মাথা নেড়ে হাসিমুখে হ্যাঁ বললো মিনী।রজত দেখলো,ওকে বোঝাতে পারার আনন্দে সৌদামিনীর দুটো চোখ হাসছে!!ঈশ্বর সর্বশক্তিমানের সৃষ্টি বড়ই অদ্ভুত!যাকে একদিকে নিঃস্ব করে রাখে,তাকে অপরদিকে ভরিয়ে দেয়।যে নারীর বাকশক্তি নেই,তাকেই সে দিয়ে রেখেছে স্বচ্ছ-সদাহাস্য একজোড়া উজ্জ্বল টানা-টানা চোখ।যে চোখের আয়নায় ফুটে ওঠে,তার নির্বাক মনের প্রতিটি কথা!মুখ দিয়ে বলতে না পারা প্রতিটা কথার প্রতিফলন হয়,ওই দুটি কাজল-কালো দীঘল চোখের গভীরেই....হেসে রজত বললো,
-তুমি পেয়ারা চুরি করে খাবে?কি আশ্চর্য!কেন?তোমাদের নিজেদের বাগানেই তো এত পেয়ারা রয়েছে!!
হাত নেড়ে চোখের ভাষায় সৌদামিনী এরপর যেটা বললো,সেটা বুঝতে আর বিন্দুমাত্র অসুবিধে হলো না রজতের।মিনী বললো,
"আরে চুপিচুপি গাছে চড়ে অন্যের বাগান থেকে পেয়ারা চুরি করে,ঠাকুমার ঘর থেকে চুরি করা ঝালনুন দিয়ে খাওয়ার মজাই আলাদা...নিজের বাগানের পেয়ারায় সেই মজা কোথায়!!"
হেসে ফেলে রজত জিজ্ঞেস করলো,
-কাল বন্ধুর বর দেখলে?পছন্দ হলো বর?!
ঘাড় নেড়ে ঠোঁট উল্টে মুখ ভেংচে মিনী না বললো।ওর মাধুর বরকে একটুও পছন্দ হয়নি...
-সেকি!!কেন?বর বেচারা আবার কি করলো?
মিনীর কথায় বর খুব মোটা।মস্ত বড় পেট!পাঞ্জাবী ঠেলে নাকি পেট বেরিয়ে আসছিলো বাইরে।নাকের জায়গায় একটা শুঁড় থাকলেই,ও অনায়াসে গণেশঠাকুর বলে দুহাত জোড় করে,বরকে একটা গড় করে আসতো!
মিনীর কথা বুঝে,হেসে গড়িয়েই পড়লো রজত।তারপরই ঝালনুনের কৌটোটা রজতের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে,ওটাকে আবার জায়গামতো রেখে,ভালো করে শাড়ির আঁচলটা কোমরে পেঁচিয়ে নিয়ে,একদৌড়ে পেয়ারার সন্ধানে চলে গেলো সৌদামিনী।হয়তো ওর বন্ধুরা গাছতলায় অপেক্ষা করছে ওর জন্য....দূরে ঠাকুর-দালানে ঢাক বেজে উঠলো....সঙ্গে কাঁসর-ঘন্টাও...
-ওই রজত!কিরে?
-হ্যাঁ পলু দা,বলো!
-তুই এখানে!এদিকে কি করছিস?আমি দালানে তোকে খুঁজেই মরছি!চল-চল!পুজো শুরু হয়ে গেলো তো!আজ মায়ের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে।আজ পুজোর পর একবার দেখবি মায়ের চোখদুটো।দেখলেই মনে হবে,মা মুখে একটাও কথা বলেন না,কিন্তু ওই দুচোখের দিকে চাইলেই সবটুকু পড়ে ফেলা যায়।দশমীর দিন ওই চোখদুটো যখন ছলছল করে,কি ভীষণ মন খারাপ হয় রে ভাই!আমরা ওই দুঃখ ঢাকতেই তো চেঁচিয়ে উঠি,"আসছে বছর আবার হবে!!" চল-চল!মাকে দেখবি চল!
-হ্যাঁ পলুদাদা!নারী মূর্ত হোক বা বিমূর্ত,যেখানে চোখই মনের আয়না,সেখানে ঠোঁটের আর কাজ কি!!সে তো নিতান্তই অকেজো....
-কি!
আলতার কাঁচের শিশিটা আজ ময়নাদি নিতে বলেছিলো।ভুলেই গেছে মিনী।আবার একদৌড়ে ঘরে ফিরছিলো ও।ঠাকুমা দেখতে পেলেই,এক্ষুণি ঘাড় ধরে ঠাকুর-দালানে নিয়ে যাবে।তাই চুপিচুপি বাড়ির পিছন দিয়ে মাচার লাউগাছটাকে পাশ কাটিয়ে,সবে উঠোনে আসছিলো মিনী।তখনই শুনতে পেলো তার কন্ঠস্বর,
-আরে আমি মা দুর্গার কথা বলছি!আচ্ছা পলুদা,এই ভুতোদার বোন মিনী কি ছোটোবেলা থেকেই বোবা?ও লেখাপড়া করে না?পড়াশোনা কি কিচ্ছু জানে না?
তার মুখে নিজের নাম শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো সৌদামিনী....
-কি জানি ভাই!না জানে বোধহয়।আগে তো সবার সঙ্গে বসে পড়তে দেখতাম।এখন আর পড়ে না মনে হয়।পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে হয়তো।আমাদের এদিকে ছেলেদেরই কেউ অত পড়াশোনা করে না।সব ব্যবসা-চাষ-আবাদ নিয়েই আছে!তার মধ্যে কেউ কয়েকটা পাশ দিলেই ব্যাস!!হীরের টুকরো ছেলে....গ্রাম ভেঙে পড়ে তাকে দেখার জন্য!
-কিসের কথা হচ্ছে পলু?
-ভুতো!আয় ভাই!ঘুম ভাঙলো?সকালে তো তোকে ডেকে,উত্তরে তোর নাসিকা গর্জন শুনে আমি স্নান করে সেজেগুজে নিলাম,পুজো দেখতে যাবো....দেখ আমার ভাইও তৈরি।তোর বাড়ি,তোর বাড়ির পুজো,তুই নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিস!!বড়দা তোকে এই কারণেই ভূত বলে ডাকে....রাতে যত রাজ্যের অকাজ-কুকাজ করে জাগবি,আর দিনে ঘুমোবি....
নিমের দাঁতনটা নিজের দাঁতে মহাসুখে ঘষছিলো ভুতো।বলে উঠলো,
-হ্যাঁ রে পলু।আজ বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেলো।এই যাই,এবার পুকুরে দুটো ডুব দিয়ে আসি!তারপর ঠাকুর-দালানে যাবো।নইলে বুড়ি খুব চেঁচাবে।বলে সুদ্দু হয়ে দালানে না গেলে,ঠাকুর বড় দোষ নেয়!ও ভাই রজত!আমি না হয় আকাট মুক্কু-সুক্কু মানুষ,তুই নাকি অনেক লেখাপড়া শিখেছিস!মোক্তার হয়ে কোটে কেস লড়বি,তা তুই বল তো,ঠাকুর কি সত্যি-সত্যিই দোষ নেয় নাকি রে?আমরাও তো তারই ছেলেপুলে!মা নাকি কোনো কিছুতেই সন্তানের দোষ নেয় না!তা ওই পুকুরে দুটো ডুব না দিলেই,দোষ নেবে কেন?
-মন শুদ্ধ হলে,সব শুদ্ধ!এটাই আমি মানি!এর বেশি আমি তো আর কিছু জানি না ভুতোদাদা।আমি শাস্ত্র পড়িনি!এখন পড়ার বড় চাপ।কলেজ পাশ দিয়ে,পরে বড় হয়ে পড়বো।তখন আবার তুমি এই প্রশ্ন আমাকে কোরো।সেদিন আমি তোমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবো!
স্তব্ধ হয়ে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো সৌদামিনী....
-আরে রাখ তোর শাস্তর!কি দুপাতা লিখে দিলো,ও মুখস্ত করে নিয়েই পন্ডিত হয়ে যায় নাকি কেউ!তুই যা জানিস,তাই ঠিক।আর এই যে আমি,ছোটো পাঁচিল পেরিয়ে,বড় পাঁচিলে ঢুকতেই পারলাম না,তার মানেই কি আমি মুক্কু!!
-ছোট পাঁচিল,বড় পাঁচিল....মানে?
-এই পলু,বোঝা তোর ভাইকে....
পল্লব হেসে বলে উঠলো,
-ভুতোর আমাদের বিদ্যের দৌড় ওই ছোট পাঁচিল পর্যন্ত।মানে ওইখানেই বারবার আটকে,ও লেখাপড়াকে সসম্মানে বিদায় জানিয়েছে।আমাদের বন্ধুত্বটা সেই স্কুলের সময় থেকে হলেও,পড়াশোনায় আমি অনেকটা এগিয়ে গেছি।কিন্তু ভূত অষ্টরম্ভা!তবে আমাদের বন্ধুত্বটা আজও অটুট।ওদের ক্ষেতের ফলানো নতুন ধানের চাল থেকে শুরু করে শীতকালে বাঁধাকপি,ফুলকপি,মূলো,এমনকি গাছের মোচা,কলার কাঁদি,সব ভটভটি করে আগে আমাদের বাড়িতে যাবে,তারপর বাজারে।ডাক্তারবাবুর বাড়ির জন্য আগেই সবকিছু আলাদা করে এই পাগলটা সরিয়ে রাখে।পাগলটার সব ভালো।কিন্তু আটকে গেলো ওই ছোটো পাঁচিলেই।রজত,ভাই আমাদের এখানে ছোটো পাঁচিল মানে প্রাইমারি স্কুল,আর বড় পাঁচিল মানে হাইস্কুল।মানে আমাদের এই ভূত ফোর ক্লাসও পাশ করতে পারেনি।ছোটো পাঁচিল পেরিয়ে বড় পাঁচিলে আর ঢুকতেই পারেনি।
-এই রে!ও ভুতোদাদা,তুমি তো দেখছি অনেক শিক্ষিত!তারপরেও কাল তুমি কত গল্প করলে,কত জানো তুমি!
-আরে বইয়ের পাতায় কি আর,সব লেখা থাকে রজত!?জীবনটা তো শুরু হয়,যখন তুই বই থেকে মাথা তুলবি!তাই আমি...
-ক্লাস ফোরেই মাথা তুলে নিলে!তাড়াহুড়ো করে...ইস!বইপত্তর শিকেয় তুলেছো ঠিক আছে ভুতোদাদা।তবে তুমি যদি আর একটু জোরে লাফ দিতে পারতে,তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস,তুমি ঠিক ওই ছোটো পাঁচিলটা টপকে বড় পাঁচিলে ঢুকে যেতে পারতে!!
রজতের সূক্ষ রসবোধে পল্লব আর ভুতো তো হেসেই গড়াগড়ি।সেই সঙ্গে সকলের অলক্ষ্যে প্রজাপতির কৃপায় দেওয়ালের সঙ্গে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এক নির্বাক নারীও,রজতের কথা শুনে নিঃশব্দে হেসে ফেললো ফিক করে....
-হে হে!!দাঁড়া-দাঁড়া!গামছাটা কোমরে পেঁচিয়ে নিই ভালো করে।ঝপাং করে পুকুরে ঝাঁপাবো আজ!যাবি আমাদের পুকুরে?ওই কলাবাগান পেরিয়ে।চল...
-ঠাকুর-দালান?পুজো যে শুরু হয়ে গেলো ভূত!আমাদের সবাইকে একসঙ্গে না দেখলে,তোর ঠাকুমা,বাবা-দাদা সবাই বকবে।
-তাও তো!আচ্ছা পলু,তোরা যা!আমি একদৌড়ে আসছি...
-আচ্ছা!!
-চল রজত!কি ভাবছিস?
-চোখ দেখবো।চোখ পড়বো!
-কার?
-মায়ের!চলো পলুদা!
-এই তোর আবার কি হলো রে?কাল থেকে দেখছি কথায়-কথায় আনমনা হয়ে যাচ্ছিস?!বাড়ির জন্য মন কেমন করছে,তাই না?মাসির কথা মনে পড়ছে?
-নানা!ও এমনিই!কিছু না পলুদা!চলো,ঠাকুর দেখে আসি!পুজো শুরু হয়ে গেলো যে....
নিজের মাসতুতো ভাইয়ের সঙ্গে ঠাকুর-দালানের দিকে এগোলো রজত...
-যা...বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো।আজ কপালে শনি নাচছে পলু!আগে দৌড় মার!
সেই অষ্টমীর রাতে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে আল ধরে সাবধানে ছুটতে লাগলো ভুতো।কিন্তু অনভ্যস্ত রজতের জন্য পল্লব তড়িঘড়ি ছুটতে পারলো না....রজত চেঁচিয়ে উঠলো,
-ভুতোদাদা!আমি কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না যে অন্ধকারে।আমাকে রেখে পালিও না,দাঁড়াও!
-এই ভূত!দাঁড়া না...দেখছিস রজত অন্ধকারে হাতড়াচ্ছে!তুই তার মধ্যে ওকে আল বেয়ে দৌড়োতে বলছিস!মহা ঝামেলা তো...
-ও পলুদাদা....হাতটা ধরো না গো আমার!আর কোনোদিনও যাবো না তোমাদের সঙ্গে!
-আমি তো যাবো না-ই বলেছিলাম।তুই তো জোর করলি!
-পাড়ার অনুষ্ঠান তো অনেক দেখেছি।কিন্তু তোমাদের গ্রামের এমন গান তো কখনও শুনিনি।কি সুন্দর গান গাইলো না ওই মেয়েগুলো!সবাইকে ঠাকুর সেজে যেন সত্যি-সত্যি ঠাকুরের মতোই লাগছিলো...
-এই চুপ!কারোর সামনে এইসব কথা বললে,আমাদের তিনজনের মুন্ডুই উড়ে যাবে।যা দেখেছিস ওখানেই দেখেছিস রজত।এখন কিন্তু একদম চুপ!এই ভূত!!ভূত...ও মরা ভুতো!কোথায় মরলি হারামজাদা!!
-ও পলুদাদা!ভুতদাদা কোথায় গেলো গো!
-এই দাঁড়া!অন্ধকারে কিছু দেখতেও পাচ্ছি না।
-তোমাদের গ্রামের এদিকটায় আলো নেই কেন পলুদাদা?
-কে বললো আলো নেই?আছে তো!সেই স্টেশন রোড থেকে ভূতদের বাড়ি পর্যন্ত বারোটা খুঁটি ভূতের বড়দা একা টেনেছে।কিন্তু এত খরচপাতি করে কারেন্ট এনে কি হলো?!এখন টিউব জ্বলে কিনা,হ্যারিকেন-কুপি জ্বালিয়ে দেখতে হয়।
-কেন?
-আরে লো-ভোল্টেজ!সেদিক থেকে আমাদের ওদিকে ভালো বাবা!কিন্তু ভূতটা গেলো কোথায়!এ হারামি ভূত!!
ধানক্ষেতের কোনো প্রান্ত থেকেই কোনো উত্তর এলো না।স্তব্ধ চতুর্দিক!
-এ রজত!তুই এখানে চুপটি করে দাঁড়া তো...আমি দেখি!
-নানা!আমিও যাবো।অন্ধকারে তুমিও আবার হারিয়ে যাবে।
-তুই দাঁড়া না...আসছি আমি।ভূত!
পলুদাদা ভুতোদাদার নাম ধরে ডাকতে-ডাকতে হেদিয়ে গেলো।কিন্তু কোনো সাড়া পেলো না।একটু দূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা রজতের হঠাৎ মনে হলো,ওর পায়ের পাতার ওপর,কেউ যেন নড়েচড়ে সাড়া দিয়ে উঠলো।প্রচন্ডরকম ভয় পেয়ে গেলো রজত।এদিকে অনেকরকম লম্বা-চওড়া বিছে থাকে,মাসির কাছে আগেই গল্প শুনেছে ও।কাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠে দৌড়ে পলুদাদার কাছে আসতে গিয়েই বৃষ্টির মধ্যে নিজেকে সামলাতে না পেরে,পা পিছলে চিৎপাত হয়ে আছাড় খেয়ে আল থেকে নেমে সোজা সেঁধিয়ে গেলো ধানক্ষেতের মধ্যে।ভাইয়ের আর্তনাদ শুনে দৌড়ে এলো পল্লব।
-এই রজত!কি হলো রে!
-ও দাদা!পড়ে গেছি আমি!
-এই কোথায় তুই!কোনদিকে?
-এই যে,কাদায় ঢুকে গেছি,এইদিকে...ছি!ছি!কি নোংরা!হড়কে যাচ্ছি যে!!উঠতেই পারছি না!
অন্ধকারে হাতড়ে-হাতড়ে ভাইকে হাত ধরে টেনে তুলতে যাচ্ছিলো পল্লব।তখনই দূর থেকে একটা টর্চের আলো এসে পড়লো ওদের মুখের ওপর....
-এ পলু!?কই তুই!
-ভুতো!এদিকে...এই তো!ভাই পড়ে গেছে।তুই কোথায় মরেছিলি হারামজাদা!
-আরে আমরা বেরোনোর সময় তো টর্চ নিয়ে বেরোতেই ভুলে গেছিলাম।এখানেই পঞ্চার বাড়ি।রজতের পথ চলতে অসুবিধে হচ্ছিলো,তাই ওর থেকে টর্চ ধার নিয়ে এলাম।কাল ফিরিয়ে দেবো।
-তা বলে যেতে কি হয়েছিলো?
-আরে দৌড়ে চলে গেলাম তো!বললাম আর কখন!রজত পড়লো কি করে?
-ওরে আমি তোকে খুঁজতে গেছি!এখানে ও মনে হয় নাচানাচি করছিলো,ধাম করে পড়ে গেছে!
-না দাদা!আমি নাচছিলাম না।খামোখা রাতদুপুরে আলের ওপর নাচতে যাবো কেন!?আমি কি পাগল!আমার পায়ের ওপর দিয়ে কি যেন একটা সুড়সুড় করে চলে গেলো।ওটাকে সরিয়ে তোমার কাছে দৌড়োতে গিয়েই,পড়ে গেছি!
কাঁদো-কাঁদো কণ্ঠে এটুকু বলেই জলকাদা মেখে উঠে দাঁড়ালো নধরকান্তি রজত।টর্চের আলোয় ওকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে চাপা হাসি হেসে উঠলো পল্লব আর ভুতো....
-হাসবে না তোমরা।আমার গা চুলকোচ্ছে!
-চল বাড়িতে।
-সবাইকে কি বলবে?!সবাই তো জেনে যাবে।
-না!আমার বোন হাসি আর মিনী আছে না?!সব্বাইকে বাঁচিয়ে দেবে।চল-চল...
-এই....আরে ওই মেয়ে।ওই মিনী?!
কলঘরের দিকে যাচ্ছিলো সৌদামিনী।ভুতোদাদার গলা পেয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ালো।ঠাকুরদালানে প্রতিমার সামনে তখন টিমটিম করে আলো জ্বলছে....
-এদিকে আয়...
লণ্ঠনটা মুখের সামনে নিয়ে এসে তিনজনের অবস্থা দেখে হেসেই ফেললো কৌতূহলী সৌদামিনী।কাদার মধ্যে জলকেলি করে আসা রজত,মাথা নীচু করে চুপটি করে দূরে দাঁড়িয়ে রইলো....
-ওই মেয়ে!খিক-খিক করে হাসবি না।আমার ঘর থেকে জামাকাপড় নিয়ে আয়।রজত পরবে।ওকে পুকুরে চুবিয়ে আনবো!
ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেই দৌড়ে গিয়ে দাদার ঘর থেকে জামাকাপড় এনে দিলো মিনী।হাতের লণ্ঠনটা ধরিয়ে দিলো পল্লবের হাতে।তারপর নিজের ঘরে ঢুকে যখন দরজা বন্ধ করলো,তখন ওর বিছানায় হাসিদিদি ঘুমিয়ে অসাড়।বিছানায় না শুয়ে আস্তে-আস্তে মাথার দিকের জানালাটা খুলে মিনী দেখলো,পলুদাদা আর ভুতোদাদার সঙ্গে ভূতের মতো কাদা মেখে,সে পুকুরের দিকে চলেছে।একটু আগে দেখা তার কাদামাখা অবয়বের কথা মনে করে,আবারও ফিক করে হেসে ফেললো সৌদামিনী....
-এই আমাকে দেখে হাসছো কেন গো তুমি?!হ্যাঁচ্চ....
কাল মাঝরাতে বৃষ্টিতে ভিজে,পুকুরে ডুব দিয়ে হালকা সর্দিজ্বর বাধিয়ে বসেছে রজত।বারান্দায় তক্তপোশের ওপর বসে পা দোলাচ্ছিলো মিনী।আর ওকে দেখে,গতরাতের কথা মনে করে ফিকফিক করে হাসছিলো।হাসিদিদির চুল ঠাকুমা বেঁধে দিচ্ছে।বাঁধা হয়ে গেলেই,ওরা দুজন ছুটবে ঠাকুরদালানে।নির্বাক মিনীর দিক থেকে নিজের প্রশ্নের কোনো উত্তর পেলো না রজত।উত্তর এলো ঠাকুমার দিক থেকে।হাসির চুল বাঁধতে-বাঁধতে উনি বলে উঠলেন,
-আর কতদিন ওই মেয়ের সঙ্গে এরম ধিঙ্গিপনা চলবে তোর?ওর তো না হয় আজীবন এই বাপের ভিটে আগলেই পড়ে থাকতে হবে,কোন পাত্তর ওকে এসে উদ্ধার করবে?নাম জিজ্ঞেস করলেই তো ব্যাস!ওইখানেই মুখ থুবড়ে পড়বে।কিন্তু তোর তো আসছে মাঘেই বে রে হাসি!তুই এখনও বনে-বাদাড়ে বোনের সঙ্গে নেচে-নেচে বেড়াবি!?সংসারে তো কুটোটি নেড়ে দেখিস না!কাজকম্ম কর একটু!নইলে তো পরের ঘরে গে শুনতে হবে,বাপের ঘর থেকে মা-ঠাকমা কিছুই শিখিয়ে পাঠায়নি!ড্যাং-ড্যাং করে শাড়ি-গয়না জড়িয়ে পাঠিয়ে দেছে!তখন খুব ভালো লাগবে তো গালমন্দ শুনতে?
-আরে ও ঠাকমা,আমার মা সয়ে নিলে,আমি পারবো না কেন?আমি মায়েরই তো মেয়ে!
-কি বললি!!
-ধুর!!তাড়াতাড়ি চুলটা বেঁধে ছাড়ো না।ওরা সবাই এসে যাবে তো।
-ওই হাবাগোবা মেয়ের সঙ্গে জোড় বেঁধে তুই উড়ে বেড়া।তারপর শউর ঘর থেকে খেদিয়ে দিলে,আর এখেনে উঠতে দেবো না কিন্তু...
-কেন?তোমার বাড়ি নাকি!
-কি!আবার মুখে-মুখে চোপা!আমার বাড়ি না তো কার বাড়ি শুনি!!তোদের সবার মাথার ওপরে আমি ছাড়া আর কে আছে!
চুল বাঁধা হয়ে যেতেই,ঘুরে বসে ঠাকুমার দুটো গাল আদর করে টিপে দিলো হাসি।বললো,
-বাড়ি তো আমার ঠাকুর্দার গো!এ বাড়ি যেমন আমার নয়,তোমারও তো নয়।আমার তাও না হয় বাপের বাড়ি!কিন্তু তুমিও তো এখানে পরের বাড়ি থেকেই এসেছো গো বুড়ি!বাপের বাড়ি,শউর বাড়ি,ছেলের বাড়ি....সবই তো কারোর না কারোর।আমাদের তো কোনো বাড়িই হয় না গো বুড়ি!তাই বাড়ি দেখাবে না!এটা যদি তোমার বাড়ি হয়,তবে আমারও।আর আমার না হলে,তোমারও নয়!তুমিও যা,আমিও তাই....আমরা তো সবাই পর!তুমি পরের ছেলেকে আপন করে রেখে,এত বচ্ছর ধরে সংসার করে,এটাকে নিজের বাড়ি বলতে পারো,আর আমি এখানে জন্মে আমার বাপের বাড়িতে এসে উঠলে,তখন আমারে নামিয়ে দেবে!ও হবু মোক্তারদাদা!কি বলে গো তোমাদের আইন-কানুন?হয় নাকি এমনটা!!
-না....হয় না!
-দেখলে!ও বুড়ি!এই জন্যই তো বলি,সারাদিন পান-সুপারি নিয়ে বসে থেকে বকবক না করে,দুপাতা বই পড়ো।বোবা বলে তো মিনীটার স্কুল যাওয়া বন্ধই করে দিলে।আমিও রাগের ঠেলায় লেখাপড়া জলাঞ্জলি দিলাম।তাও দেখো,শিক্ষে কিন্তু আমার আছে!চিন্তা নেই,ফেরত আসবো না গো বুড়ি!তুমিও পরের ছেলেকে আপন করে সংসার করে যেমন ভাবছো,এটাই তোমার বাড়ি,আমিও না হয় তাই ভাববো....তবু আসবো না আর ফিরে....এ মিনী চল!বুড়ির সামনে থাকলেই জ্ঞান দেবে!
-হ্যাঁ ওই করো!মা-টা যেমন আমায় বিয়ে ইস্তক জ্বালিয়ে খেলে,ওই মায়েরই তো মেয়ে!এখন এই মেয়ের মুখের বাক্যি শুনলে,গা জ্বালা করে,মাথায় একেবারে রক্ত উঠে যায়...তাও একটার মুখে ভগবান বুলি দেছে।দুটোয় মিলে বললে তো....দেবো যেদিন আমার বাড়ি থেকে সবকটাকে খেদিয়ে....
স্তব্ধ হয়ে গেলেন ঠাকুমা।মনে পড়লো নাতনির মুখের বাক্যি,
"বাড়ি তো আমার ঠাকুর্দার গো!এ বাড়ি যেমন আমার নয়,তোমারও তো নয়।"
বৃদ্ধা চোখের জলটুকু মুছে নিয়ে,নির্বাক সৌদামিনীকে জন্ম দেওয়ার জন্য,পুত্রবধূর গতজন্মের পাপের কারণ অনুসন্ধানে মত্ত হলেন...
-এই মিনী!ছুটছিস কেন?দাঁড়া...
পিছন থেকে ছুটে এসে ওকে টেনে ধরলো হাসি....
-কিরে?ঠাকুরদালানে যাবি না?কোথায় পালাচ্ছিস?
দুদিকে ঘাড় নেড়ে না বললো সৌদামিনী।
-আবার ওই বুড়ির কথা তুই মনে ধরছিস?জানিস তো,ও সারাদিনই বলে...আমি তো জানি,টোপর মাথায় তোর জন্যও বর আসবে।এই এত্ত বরযাত্রী নিয়ে,তোকে বিয়ে করতে।আমিও তখন আনন্দে চিৎকার করবো,আমার মিনীর বর এসেছে....
দুদিকে জোরে-জোরে মাথা নেড়ে হাসিকে জড়িয়ে ধরলো মিনী...
-আবার কাঁদে!করবিনে বিয়ে?!সে এসে তোকে বিয়ে করতে চেয়ে তোর সামনে দাঁড়ালে,তখনও করবিনে?ধুর বোকা মেয়ে!এমনটা হয় নাকি!সে আসবেই,দেখবি তুই!আমার সঙ্গে নির্জলা উপোস করে বুড়ো শিবতলার ঠাকুরথানে শিবের মাথায় জল ঢেলেছিস তো তুইও।ঠিক অমন শিবের মতোই বর পাবি!
-হাসি?
-রজতদাদা?তুমি এখানে?
-তোমার বিয়ে?
নিজের বিয়ের কথায় মাথা নামিয়ে,মৃদু হেসে সলজ্জে হ্যাঁ বললো হাসি...
-তোমার ঠাকুমা মিনীকে পড়তে দেয়নি?
-না!ঠাকুমা বলে,ও বোবামেয়ে,এত কি পড়বে ও!!তিন কেলাস পড়িয়েই স্কুল ছাড়িয়ে দিয়েছে।কিন্তু মিনী বই পড়তে পারে।লিখতেও পারে।ও পড়া ছেড়ে দিলো,আমিও আর একা-একা স্কুলে যেতাম না।খুব কান্না পেতো।তাই আমিও পরের বছর ছেড়ে দিয়েছি।বড় পাঁচিলে আর যাইনি!
-হুম!
-চল মিনী....ঠাকুরদালানে...
দুদিকে ঘাড় নাড়লো মিনী...
-চল না!আরে ওই বুড়ির কথায় রাগ করিস না।
-মিনী?
-দেখো না রজতদাদা!বুড়ির কথায়...
-মিনী,কি হয়েছে তোমার?ঠাকুমা বলেছেন বলে...
দুদিকে মাথা নেড়ে না বললো মিনী।রজত শুধালো,
-তবে?কি হয়েছে তোমার?
হাসির দিকে চেয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওর গলা জড়িয়ে ধরলো মিনী।রজত সেই মুহূর্তেই বুঝতে পারলো নির্বাক নারীর ব্যথা কোথায়!!বুকের কোন গভীরে!
-তোমার বিয়ে হয়ে যাবে তো হাসি।ও হয়তো একেবারে একা হয়ে যাবে।এটা ভেবেই ও কাঁদছে!তাই তো মিনী?
রজতের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না সৌদামিনী।শুধু আজন্মের সখী হাসিদিদিকে জড়িয়ে ধরে,ওর কান্নার বেগ আরও বেড়েই চললো।যারপরনাই অবাক হলো হাসি।মিনীকে ও আর ভুতোদাদা ছাড়াও,তৃতীয় কেউ মাত্র এই কয়েকদিনের মধ্যেই যে এত ভালোভাবে বুঝতে পারে,এ তো ওর ধারণারও অতীত।চুপ করে বোনকে জড়িয়ে ধরে পিত্রালয় ত্যাগ করার বেদনা স্মরণ করে,নিজেও কেঁদে ফেললো হাসি...
-চল!আর কাঁদিস না বোন!মায়ের কাছে বসবি চল...
-তোমার বোন কাল পেয়ারা আর ঝালনুনের কত্ত গল্প করে,আমাকে লোভ দেখিয়ে ছুটে চলে গেলো হাসি।কিন্তু চুরি করা পেয়ারার কেমন স্বাদ,আমার তো অজানাই রয়ে গেলো।এখনও দেয়নি!
-কিরে?মিনী!!কি বলছে রজতদাদা!
চোখ ভালো করে মুছে কাপড়ের আঁচল থেকে পেয়ারা বের করতে গিয়ে হুড়মুড় করে সব পেয়ারা মাটিতে পড়ে ছড়িয়ে গেলো।হাসি আর মিনীর সঙ্গে রজতও বসে পড়লো পেয়ারা কুড়োতে।সব পেয়ারা গুছিয়ে তুলে,পাতশুদ্ধু একটা পেয়ারা ভালো করে নিজের কাপড়ের আঁচলে মুছে,রজতের হাতে তুলে দিলো মিনী।রজত একটা কামড় বসালো তাতে...মিনী হাত নেড়ে ইশারা করে জানতে চাইলো,
"ভালো?"
এই নির্বাক নারীর জন্য আর একটিও শব্দ খরচ করতে ইচ্ছে করলো না রজতের।ও নিজেও শব্দের ঊর্ধ্বে পৌঁছে অন্তর দিয়ে অনুভব করতে চাইলো ভাষাহীনা ওই নারীর মন।মিনীর মতোই মাথা নেড়ে ও হ্যাঁ বললো....পেয়ারা খুব ভালো!
হেসে ফেলে বাকি পেয়ারাগুলো থেকে একটা পেয়ারা দিদিকে দিয়ে,নিজেও একটা পেয়ারায় কামড় বসিয়ে হেলতে-দুলতে চলে গেলো ঠাকুরদালানের দিকে....
সকাল থেকেই বড় মনখারাপ মিনীর।মহানবমী পেরিয়ে আজ দশমী।একটু পরেই সবাইকে কাঁদিয়ে মা আবার ফিরে যাবে শিবঠাকুরের বাড়ি।বাড়ির সবার সঙ্গে হাসিদিদিও পুজোর জোগাড় করতে ব্যস্ত।একটা ছোট্ট ছাগলছানাকে বুকে জড়িয়ে ধরে,একভাবে মায়ের পিছনদিকে রাখা শিবঠাকুরের ছবির দিকে চেয়েছিলো মিনী।সত্যিই কি শিবঠাকুরের মতো বর হয়!আর সে কি আসবে মিনীর জন্য?কিন্তু এলেও বুঝবে কি করে ওকে!!এই যে আজ পুজো শেষ বলে,ওর কত মন খারাপ করছে,মায়ের দিকে চাইলেই কি ভীষণ কান্না পাচ্ছে,বুঝবে সে?!
-ওই মেয়ে!পুজো শেষ বলে মনখারাপ!!
চমকে উঠলো মিনী।ছাগলছানাটা মিনীর কোল থেকে নেমে,বারকয়েক মিনীর হাত চেটে দিয়ে,রজতকে শুঁকে চলে গেলো দালানের বাইরে...
-রজত?
-বলো ভুতোদাদা!?
-আজ বাওড়ে ভাসান হবে।যাবি কিন্তু...
-যাবো তো!ভাসান দিয়েই যাবো।যাতে আসছে বছর আবার হয়!
-সামনের বছর তুই এখানে আসবি রজত?খুব মজা হবে!
-আসবো!এবার থেকে প্রতি বছর পুজোয় এখানেই আসবো।ঠিক আসবোই...
শেষের সবটুকু কথা যে মিনীর দিকে চোখ রেখেই রজত খরচ করলো,সেটা সকলের চোখ এড়িয়ে গেলেও,হাসির চোখ এড়ালো না।ও চুপ করে রইলো শুধু....মিনী মাথা তুলে তার দিকে চাইতেই,তার চোখে চোখ পড়ে গেলো।সেও মিনীর দিকেই চেয়েছিলো।কম্পিত বক্ষে একদৌড়ে ওখান থেকে পালিয়ে বাঁচলো মিনী।দূরে ওর চলে যাওয়ার দিকেই চেয়ে রইলো রজত।হাসি এগোতে যাচ্ছিলো মিনীর দিকেই।কিন্তু বড়দাদা আর বড়বৌদিদির ডাকে আবার ঠাকুরের পুজোর যোগান দিতে,ওদিকেই এগিয়ে গেলো....পল্লব ভুতোর সঙ্গে গল্পে মত্ত।বাইরে বেরিয়ে এলো রজত...
-এই যে শোনো!সকালে আমাকে দেখে তুমি অত হাসছিলে কেন?
আর দাঁড়ালোই না মিনী।তার গলার স্বর শুনেই,দৌড়ে পালাতে গেলো।অদূরেই পেয়ারা বাগান।পাশেই সবুজ শ্যাওলা ও কচুরীপানায় আবৃত সুবৃহৎ পুকুর।বেশ ছায়াঘেরা নিবিড়-শান্ত গ্রাম্য সবুজায়নের মাঝে,মিনীর পথ আগলে দাঁড়ালো রজত।
-কি হলো?আমার কথার উত্তর দিচ্ছ না যে!
তাও কোনো উত্তর নেই।
-আমার খিদে পেয়েছে।পেয়ারা খাওয়াবে!?তোমার কাছে তো সবসময় পেয়ারা বাগান তৈরি থাকে।
হাত তুলে ওই দূরে নিজেদের পেয়ারা-বাগান দেখিয়ে দিলো মিনী।অর্থাৎ,যত খুশি পেড়ে খাও।কেউ কিচ্ছু বলবে না।
-না!তোমার চুরি করা পেয়ারাই খাবো!কেউ আমাকে বলেছিলো,চুরি করে খাওয়ার মজাই আলাদা!
রজতের প্রখর অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে কেঁপে উঠলো মিনী।ও একটা পেয়ারা বের করে রজতের হাতে দিতে গেলে,রজত পেয়ারাশুদ্ধু মিনীর হাতটাই চেপে ধরলো।আর কিছুতেই ছাড়লো না।রঙিন কাঁচের চুরির প্রবল রিনিঝিনি সত্ত্বেও,রজতের হাত থেকে নিজের হাতটা,কিছুতেই মুক্ত করতে পারলো না সৌদামিনী....
-মিনী,শোনো....
-এ রজত!!রজত....
ঠাকুরদালানের দিক থেকে পল্লবের গলা শুনেই মিনীর হাতটা ছেড়ে দিলো রজত।একদৌড়ে মিনী মিশে গেলো পেয়ারা বাগানের ভিতর....
-বলো দাদা!এখানে আমি!
-শিগগির এদিকে আয়!
সে চলে গেলো পলুদাদার সঙ্গে।কিন্তু মিনীর বুকের কম্পন কিছুতেই স্তিমিত হলো না।পেয়ারা গাছের বাকল উঠে যাওয়া সরু গুঁড়ি জড়িয়ে ধরে,আড়াল থেকে তার চলে যাওয়ার দিকে একভাবে চেয়ে রইলো দীঘল একজোড়া চোখ....
কিছুক্ষণ পরেই মা-বৌদিদি,গ্রামের সবাই মাকে বরণ করে সিঁদুর খেলা শুরু করবে।সারাটা ঠাকুরদালান খুঁজেও তাকে আর দেখতে পায়নি মিনী।তাই বাড়ির দিকেই আসছিলো ও।কলঘরের সামনে বেশ অনেকগুলো ঠাকুরের বাসন নিয়ে তেঁতুল ঘষতে বসেছিলো হাসিদিদি।হাতে একটা শুকনো পেয়ারার ডাল নিয়ে,হেলতে-দুলতে উঠোনে প্রবেশ করে দিদির পাশে বসে পড়লো মিনী।তেঁতুল নিয়ে বাসনে হাত দিয়েই ও শুনলো ঠাকুমার কথা,
-ও বড় খোকা!মেজোখোকা সঙ্গে না গিয়ে,তুই তো যেতে পারতিস!পরের ছেলে!আমাদের এখানে এসেছিলো।আমাদের একটা দায় তো থাকে...
-ভুতো তো সঙ্গে গেলো মা।মেজো আছে।পলু আছে।আমি গেলে এদিকে মাকে বাওড়ে কে নিয়ে যাবে বলো!!
হাসির হাত ধরে একটা টান মারলো মিনী।হাত নেড়ে জিজ্ঞেস করলো,কার কি হয়েছে!!
-রজতদাদার বাবার বুকের ব্যামো হয়েছে।কাল রাতে তাদের বাড়িতে নাকি ডাক্তার এসেছিলো।আজ সকালে রজতদাদাকে নিতে শহর থেকে লোক এসেছে!তাই তো সরকার কাকুদের মোটরগাড়িটা নিয়ে,রজতদাদা একটু আগেই মাসিরবাড়ি চলে গেলো!ভুতোদাদা আর পলুদাদা সঙ্গে গেছে যদিও....ওখান থেকে শহরে নিজের বাড়ি ফিরে যাবে।তবে যাওয়ার আগে আমাকে বললো,এই গ্রামের পেয়ারা ওর খুব ভালো লেগেছে!এখন বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে ঠিকই,কিন্তু ও আবার এখানে আসবে!আসবেই....
চোখ থেকে নিঃশব্দে জল গড়িয়ে পড়ছিলো মিনীর।মাথা নীচু করে রেখেছিলো ও।ঝনাৎ করে পিতলের ঘটিটা ফেলে রেখেই,উঠে দৌড় দিলো বড় রাস্তার দিকে।বড় রাস্তায় উঠতে গিয়েও ও ধরলো পেয়ারা বাগানের রাস্তা।নির্বাক এক নারী কাঁদতে-কাঁদতে গ্রামের অলিগলি দিয়ে দ্রুত পৌঁছনোর চেষ্টা করলো বড় রাস্তায়।একেবারে বড় রাস্তায় ওঠার মুখে বেলতলা দিয়ে যাওয়ার সময়,মিনীর নগ্ন পায়ের তলায় ফুটে গেলো বেলকাঁটা।দাঁড়িয়ে পড়ে নিঃশব্দে কেঁদে ফেললো মিনী।কাঁটাটা হাত দিয়ে টেনে বের করে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে ধুলোমাখা রক্তাক্ত পায়ে পৌঁছলো বড় রাস্তার কিনারায়।তার কয়েক মুহূর্ত আগেই মোটর গাড়িটা হুশ করে বেরিয়ে গেছে,ওই বড় রাস্তার বুক চিরে।পিছনে কেবল উড়ছে কুণ্ডলী পাকানো ধুলোর ঝড়।প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে,শরীরে যৌবন ছুঁয়ে গেছে সৌদামিনীর।কিন্তু এতদিন পর্যন্ত কিশোরীর মনের দরজায় কড়া নাড়েনি কেউ।আজ মিনীর নিজেকে হঠাৎ করেই একেবারে রিক্ত মনে হলো।বুঝতে পারলো না কেন এই অসহায়তা....ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামলো মাঠের প্রান্তে,পেয়ারা-বাগানে,ধানের শিষের আগায়,মিনীর মনের আঙিনায়।নির্বাক নারীর দুচোখের কোল বেয়ে বেরিয়ে এলো অবাধ্য জল।ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বৃষ্টির মধ্যে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলো ও।রঙিন কাঁচের চুরিগুলোকে স্পর্শ করলো বৃষ্টির প্রতিটা বিন্দু....কানের কাছে এসে সে বলে উঠলো,
"মিনী,শোনো...."
শোনা হলো না তো আর!কি বলতে চেয়েছিলো সে!!বৃষ্টি ভিজিয়ে দিয়ে গেলো সৌদামিনীর ভারাক্রান্ত মন....
-ও বৌদি!তোমার এই দোর আটকে ঘাপটি মেরে ঘরের মধ্যে বসে থাকার স্বভাব,আজও গেলো না গো!?কখন থেকে ডাকছি তো...
চৈতীর ডাকে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে সৌদামিনী দেবী দেখলেন,ওনার চোখের কোণে লবণাক্ত জলের স্রোত।সেদিনের সেই ষোড়শীর চোখের জল,আজও এই বৃদ্ধার চোখের কোণে এসে জমা হয়,তার নিজেরই অজান্তে....পরিবর্তন হয়নি কিছুই।শুধু মাঝে কেটে গেছে কয়েকটা বসন্ত।আর কোনোদিনও না ফেরা রঙিন বসন্ত....
চোখের জল মুছে,হাতের ফটোফ্রেমটা টেবিলের ওপর স্বপ্ননীলের ছবির পাশে পূর্বের মতো সাজিয়ে রেখে,দরজা খুলতে গেলেন সৌদামিনী দেবী....
(চলবে.....)
ছবি : সংগৃহীত
ধারাবাহিকটি ভালো লাগলে ব্লগ থেকে নির্দ্বিধায় শেয়ার করুন ও সবাইকে পড়ার সুযোগ করে দিন।😊😊
কেমন লাগছে রজতশুভ্র আর সৌদামিনীকে?
জানার অপেক্ষায় রইলাম।☺️
সূর্যোদয়ের_আগে
প্রিবুকিং চলবে পনেরো তারিখ পর্যন্ত।প্রিবুকিং এ থাকছে বিশেষ পঁচিশ শতাংশ ছাড়।তোমরা যারা প্রিয়মশ্রীকে নিজের সংগ্রহে রাখতে চাও,তারা বুকিং করতে পারো পাঠকবন্ধুর এই নম্বরে ফোন অথবা whatsapp করে।
পাঠকবন্ধুর নম্বর - 7439112665
Mon chuye gelo apnar ei part er lekha. Kono bhasa nei. Akhon e speechless sabe golpor suru te. Just Asadharon laglo.
উত্তরমুছুনOsadharon
মুছুনঅসাধারন অসাধারণ....প্রতিটা ছোট ছোট্ট ঘটনা মন ছুঁয়ে গেল। কি অবস্থা আমার! এখনো পর্যন্ত যতগুলো পুরুষের বর্ননা করেছ সবার প্রেমেই কমবেশি পড়ে গেছি🤦♀️...যতক্ষন পড়তে থাকি একটা চরম তৃপ্তি পাই শেষ হলেই একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। তোমার সৃষ্টি গুলো ঠিক কতটা বাঁচিয়ে রাখে তা বলার মতো ভাষা নেই। ❤❤❤❤❤
উত্তরমুছুনঅসাধারণ❤️
উত্তরমুছুনঅসাধারণ মিষ্টি ❤❤❤❤❤❤
উত্তরমুছুনDarun lag6e soudamini r rajat k
উত্তরমুছুনKhub khub khub sundor
উত্তরমুছুনOsadharon...Rajat naam ta emnie pochonder chilo r akhon soudamini r Rajat er golpo pore arekbar Mon valolagay vore uthlo...Mon tripto hoyeche bolbona..karon ei part ta abar Porte hobe..barbar porleo kom Mone hobe..r je line ta Amar sobsomoy Monehoy je chokh e manusher moner ayna...setai ajker part Tai barbar fire eseche ..just awesome🥰🥰🥰love u di♥️♥️♥️♥️samudra chole jawar Mon kharap er por ei prothom atto valo laglo
উত্তরমুছুনOsadharon...Rajat naam ta emnie pochonder chilo r akhon soudamini r Rajat er golpo pore arekbar Mon valolagay vore uthlo...Mon tripto hoyeche bolbona..karon ei part ta abar Porte hobe..barbar porleo kom Mone hobe..r je line ta Amar sobsomoy Monehoy je chokh e manusher moner ayna...setai ajker part Tai barbar fire eseche ..just awesome🥰🥰🥰love u di♥️♥️♥️♥️samudra chole jawar Mon kharap er por ei prothom atto valo laglo
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগছে
উত্তরমুছুনএখনো অবধি রে কটি পুরুষ চরিত্র পেয়েছি সব্বাই এক সে এক কিন্তু রজত চরিত্র অদ্বিতীয়।কি সুন্দর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা। সৌদামিনী আর রজত এর প্রেমে পড়ে গেলাম।
উত্তরমুছুনপড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল আমিও যেন ওখানে আছি। রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র বিভূতিভূষণ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
এত সুন্দর প্রেমের মূহুর্ত। ভালো না লেগে উপায় আছে।।। দারুন সুন্দর প্রেমের মূহুর্ত।।।
উত্তরমুছুন❤❤❤
উত্তরমুছুনOshadharon
উত্তরমুছুনKhub khub sundr
উত্তরমুছুনএবার একটু একটু করে বেশ জমে উঠছে .......আজকের পর্বটা বেশ ভালো লাগলো। 💚💚💚❤
উত্তরমুছুনএবার একটু একটু করে বেশ জমে উঠছে .......আজকের পর্বটা বেশ ভালো লাগলো। 💚💚💚❤
উত্তরমুছুনমিষ্টি প্রেম জমে উঠেছে।।। দারুণ।।।
উত্তরমুছুনঅসাধারণ
উত্তরমুছুনChokh bhore porlam...
উত্তরমুছুন