অনুসরণকারী

বুধবার, ৩১ জুলাই, ২০২৪

দূরের পাখি দ্বিতীয় পর্ব


 


দূরের পাখি

সাথী দাস
দ্বিতীয় পর্ব



মুঠোফোনের দিকে চেয়ে হেমাঙ্গিনীর দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে। রিও প্রয়োজন ছাড়া মাকে ফোন করে না। হিসেব মিলিয়ে নেওয়ার জন্য সপ্তাহে বার দুয়েক দোকান থেকে ডাক আসে। এ ছাড়া হেমাঙ্গিনীর জীবনে তেমন ব্যস্ততা নেই।

ওর দিনের সিংহভাগ সময় কাটে বাতাসীর সঙ্গে গল্প করে, বারান্দার ঝুলন্ত টবে বসবাসকারী গাছগুলোতে জল দিয়ে আর ল্যাপটপে ঠুকঠাক করে।

হেমাঙ্গিনী পেশাগতভাবে শব্দশ্রমিক। এই পেশা ওর দায়বদ্ধতা নয়। এই ক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত অর্থের বিনিময়ে গ্যাসে হাঁড়ি চড়ে না। এ নেহাৎই নেশা। তবে স্কুল-কলেজে শব্দ নিয়ে নাড়াচাড়া করে ম্যাগাজিন বা পত্রিকায় দু-চারপাতা লেখার শখ যে এভাবে ওকে মুক্তির পথ দেখাবে, তা হেমাঙ্গিনী কস্মিনকালেও চিন্তা করেনি।

ফ্ল্যাটে উঠে আসার পর হেমাঙ্গিনীর সঙ্গে প্রতিবেশীদের আলাপ হয়েছিল বটে, তবে সেই আলাপ অন্তরঙ্গতার পর্যায়ে পৌঁছয়নি। তবে আলাপ হওয়ার কিছুদিন পর হেমাঙ্গিনী বুঝেছিল, মানুষের সঙ্গে মন খুলে কথা বলার চেয়ে মনের কথা মনে জমিয়ে লিখে ফেলা ভালো। মানুষের সুসময় কিংবা দুঃসময় তিথি-নক্ষত্র মেনে আসে না। সময়ের পরিবর্তন কেবল কথার কথা। আসলে সময় নয়, মানুষ বদলায়। আর বড় দ্রুত বদলায়। যন্ত্র বিকল হলে তাকে সারিয়ে তোলা যায়। কিন্তু মানুষ বদলে গেলে তাকে জীবন থেকে সরিয়ে ফেলা ছাড়া দ্বিতীয় পথ থাকে না।

ঘড়িতে দুপুর দুটো। বারান্দায় দুটো নাইটি আলগা বাতাসে দুলছে। বাতাসী বিকেলে আসবে না। হেমাঙ্গিনীর বিছানা ছেড়ে ওঠার তাড়া নেই। দুপুরের ভাতঘুম সেরে ও আড়মোড়া ভাঙার সময় বুঝল, গায়ে বেশ জ্বর। আনমনে হেসে জানালার ভারী পর্দা টেনে দিল সে। আধো অন্ধকারে ফিকে হল আলো। চোখ বন্ধ করল হেমাঙ্গিনী।

জ্বর বড় সুন্দর অনুভূতি। মানুষ মানুষকে ছেড়ে যাওয়ার আগে দু'বার ভাবে না। যাওয়ার আগে পিছুটানহীন হওয়ার আশায় সে স্মৃতিটুকুও হজম করে যায়। এ বিষয়ে জ্বরজ্বালা অনেক উদার। ছেড়ে যাওয়ার পর স্মৃতি হিসেবে খানিক দুর্বলতা রেখে যায়।

জ্বরের চেয়ে জ্বর পরবর্তী সময়ে মানুষ বড় কাতর হয়। তখন স্পর্শক্ষুধা তীব্র হয়ে ওঠে। এখন সেই দুর্বলতায় কাতর হয়েছে হেমাঙ্গিনী। মনের ভিতর কেমন যেন করে। একাকীত্বের উষ্ণতা বুক ভেদ করে ত্বক ছুঁয়েছে। অজান্তেই নিজের কপালে হাত দিয়ে হেমাঙ্গিনী দেখল, দেহ শীতল।

এ সবই মনগড়া মিথ্যে অসুখ। ওর মনের ভিতর যে মন আছে, সেই মনে ধ্রুবর বাস। তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে জুঁইফুলের মালা আনতে গিয়ে ধ্রুব জ্বর বাধিয়ে বসে আছে। ধ্রুবর জ্বর হলে সেই উষ্ণতা হেমাঙ্গিনীকে স্পর্শ করবে না? তা আবার হয় নাকি?

জ্বরের ঘোরে ধ্রুব পড়ে রয়েছে বিছানায়। জুঁইফুল তার সৌন্দর্য এবং সৌরভ হারিয়েছে। ব্যস্ত পাখি জলপট্টি দিতে ব্যস্ত। পাখির ডানার আড়ালে আত্মগোপন করতে চাইল জ্বরতপ্ত ধ্রুব। অনিদ্রার কারণে পাখির চোখের কোলে গভীর কালি পড়েছে। রুগ্ন ধ্রুবর ভগ্নস্বাস্থ্য উদ্ধারকার্য হেতু পাখি নিজে হয়েছে শীর্ণকায়া। পাখির মলিন মুখ দেখে ধ্রুবর কষ্ট হয়। পাখিকে কষে শাস্তি দেওয়া হল বটে! কিন্তু এমন শাস্তির কথা ধ্রুব ভাবেনি।

রান্নাঘর থেকে খিচুড়ির সুবাস আসছে। বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। এমন বৃষ্টিতে কাদায় মাখামাখি হয়ে কাঁচা পথ বেয়ে পাখির হাত ধরে হেঁটে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ও কি রাজি হবে? জ্বর গায়ে বাইরে যেতে দেবে? একটা ছাতার নীচে দু'জনে ভিজে জবজবে হয়ে গেলে কেমন হয়? সেই সময় যদি কাকভেজা ধ্রুব ঠোঁট রাখতে চায় পাখির তীক্ষ্ণ ঠোঁটে? ও কি বিরক্তি আর ক্ষোভমিশ্রিত দৃষ্টিতে চেয়ে ধ্রুবকে ভস্ম করে দেবে? প্রবল আপত্তিতে নিজের ঠোঁট ছিনিয়ে নেবে ধ্রুবর ঠোঁটের ভিতর থেকে? ফিরিয়ে দেবে ধ্রুবর কামনাকে?

পাখি তুমি আমাকে ফিরিয়ে দাও। তুমি বিরক্ত হও। কুকথা বলো। আমাকে শাসন করো। মনের যত ক্ষোভ আছে, যত নীরব অভিমান.... সব উগড়ে দাও নিমেষে। আমি তোমাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম। এ আমার গর্হিত অপরাধ। তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না।

পাখি তুমি পাখি হয়ে ডানা মেলে উড়ে যাও দিগন্তে। সংসার নামক খাঁচা তোমার জন্য নয়। আমি যেদিন মুক্তি পেয়ে আকাশ হবো, তুমি সেদিন পাখি হয়ে ডানা ঝটপটিয়ে ফিরে-ফিরে এসো আমার কাছে...

জ্বরের ঘোর আষ্টেপৃষ্টে চেপে ধরে ধ্রুবকে। গোঙানির শব্দ বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে পাখির কানে পৌঁছয় না। সমস্ত অন্ধকার কেন্দ্রীভূত হয়ে একটা উজ্জ্বল আলোর বিন্দু তৈরি হয়েছে। এ কি কেবলই দুর্যোগ? নাকি দৈবযোগ? প্রসন্ন হল পাখি? আমার পাখি! কেমন আছ পাখি? আমি প্রলাপ বকছি না। পৃথিবী ধ্বংসের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আমি তোমাকে চাই।

ও কি লণ্ঠনের আলো? রান্নাঘর থেকে সে এসে বসেছে শয্যাপ্রান্তে? একটানা কান্নার সুর ভেসে আসছে দূর থেকে। কে কাঁদে? এ তো পাখির কান্না নয়। তবে কি চেনা গানের সুর? বৃষ্টির জলতরঙ্গ?

চেতনার অতলে ঝাঁপ দিচ্ছে স্মৃতি। সুরেলা কণ্ঠে পাখি গান ধরেছে। পাখির পা দুটো আঁকড়ে ধরতে চাইল ধ্রুব। ওর পায়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দেবে। চুমু খাবে। এ ছাড়া ক্ষমাপ্রার্থনা করার দ্বিতীয় কোনও ভাষা ধ্রুবর জানা নেই।

বৃষ্টির বেগ বেড়ে যায়। ঘনায়মান অন্ধকার রহস্যময়ীর মতো গাঢ় হয়। আমগাছের ডালে আটকে থাকা স্বপ্নঘুড়ি ছিঁড়েখুঁড়ে শেষ হয়ে যায়। ধ্রুব আকুল হয়ে ডাকে, "পাখি.... আমি কেন তোমার মতো নিষ্ঠুর হতে পারলাম না!"

আমি পা মেপে বৃষ্টিসিক্ত পথে হাঁটব না। আমি বৃষ্টির জল চেখে দেখব না। সর্বক্ষণ তোমাকে শাস্তি দিতে চাইব না। তোমার অবাধ্য হবো না...

ধ্রুবর পাঁজরভাঙা আর্তি কেউ শুনল না। লাবণ্যহীন সম্পর্কের ধ্বংসস্তূপে নির্মিত স্যাঁতসেঁতে একটা ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা চৌপায়াতে একলা শুয়ে রয়েছে সে। সঙ্গী তার শুকনো জুঁইফুলের মালা, নিকোটিন আর তিনদিনের বাসি পাঁউরুটি। যে পাঁউরুটির ভাগ নিয়ে আরশোলার সঙ্গে চলে ধ্রুবর নিত্য বচসা। জানালায় দিন-রাত্রি নিয়ম মেনে কড়া নাড়ে। দেওয়ালের ছায়াগুলো দীর্ঘতর হতে হতে প্রেতাত্মার মতো বাতাসে মিলিয়ে যায়।

ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙল হেমাঙ্গিনীর। মাথার মধ্যে ও বয়ে বেড়ায় ধ্রুবর আস্ত সংসার। তার ওজন নেহাৎ কম নয়। মাথাটা ভারী হয়ে আসে। বিনবিনে ঘাম জমে চোখের কোলে। ফোনের রিংটোন আর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের যাতায়াত জানান দেয় কল্পনা ছাড়াও বাস্তবে হেমাঙ্গিনীর অস্তিত্ব আছে। স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আছে। অর্থ, যশ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি আছে। নাড়িছেঁড়া ধন রিও আছে। আর আছে প্রাক্তন স্ত্রীর তকমা।

দেবতনু...

বৃষ্টি আসে। বৃষ্টি যায়। রাস্তায় জল জমে কাদায় মাখামাখি হয় পাড়ার কুকুরটা। কেঁউ কেঁউ শব্দে ডেকে উঠলেও বৃষ্টিতে ভিজে হয়ে কেউ ওকে কোলে তুলে নেয় না। ভিজে পাঞ্জাবি আড়াল করে বুকে লুকিয়ে প্রেমিকার কাছে এসে বলে না, "আমার জন্য নয় হেম। এই অবলা প্রাণীটার জন্য এসেছি। ওকে তোমার কাছে রাখবে?"

হেমাঙ্গিনীর ঘরের দেওয়ালে কুকুরটার ছায়া দীর্ঘতর হয়। লালা ঝরে ওর জিভ থেকে। বাঙ্ময় দৃষ্টিতে জিঘাংসা! উফ! কী বীভৎস তার অভিযোগ জানাবার ভঙ্গি। অন্ধকারে নিমজ্জিত অদৃশ্য প্রাণীটা রাগে গরগর করছে। হেমাঙ্গিনীর কপালের কাছে ঝিকমিক করে জ্বলে উঠল শ্বদন্ত।

ফোন বেজে গেল। হেমাঙ্গিনী চোখ মেলল না। ভিজে চোখ মুছল না। আজ বাতাসী আসবে না। হেমাঙ্গিনীর কোনও ব্যস্ততা নেই। সঙ্গীহীন এ জগৎসংসারে হেমাঙ্গিনীর প্রয়োজন নেই।

গোঁ গোঁ করে চিৎকার করতে চাইল হেমাঙ্গিনী। বাতাসী ঘরে থাকলে কেঁদে বলত, "দিদিকে বোবায় ধরেছে গো..."

আসমুদ্রহিমাচল থরথর করে কেঁপে উঠত বাতাসীর আর্তনাদে। বাতাসী! হেমাঙ্গিনীর একমাত্র আপনার জন। জন্ম-জন্মান্তরের সই।

হেমাঙ্গিনীর বুক ধড়ফড় করে ওঠে অব্যক্ত কান্নায়। আশ্রয়ের সন্ধানে। মানুষ তুমি মানুষকে দয়া করো! মানুষ তুমি মুক্তি দাও! ভিক্ষা চাই তোমার অনুকম্পা! মানুষ তুমি করুণা করে হলেও ভালোবাসো.... আমাকে উচ্ছিষ্ট করো...

নিস্তেজ হয়ে বিছানার সঙ্গে মিশে রইল হেমাঙ্গিনী। ল্যাপটপে ভাবনার মালা গাঁথা হল না। অজস্র শব্দ অস্থির মস্তিষ্কের ইতিউতি ছড়িয়ে গেল। শহীদ হল স্নায়ুযুদ্ধের নিত্য সৈনিক। নিহন্তা হেমাঙ্গিনী।

(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত এবং প্রতীকী

শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

দূরের পাখি প্রথম পর্ব


 


দূরের পাখি

সাথী দাস
প্রথম পর্ব



শহর জুড়ে ট্র্যাফিক জ্যাম। অপেক্ষা সিগন্যালের। সবুজ আলোর ছাড়পত্র পেতে মরিয়া গাড়ির চালক। ঘামে ভেজা জামাকাপড়ে বন্দি হয়ে বাসের ভিতর অপেক্ষা করছে নিত্যযাত্রীরা। কারও পোশাক হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টিতে ভিজে জবজব করছে। ছাতা এ সময় অপরিহার্য একটি বস্তু। মিঠেকড়া বা ঝাঁঝালো রোদ্দুর, কিংবা মুষলধারে বৃষ্টি, সব ক্ষেত্রেই তার ভারী আদর। কিন্তু বৃষ্টি শেষ হয়ে যাওয়ার পর বড় অবাঞ্ছিত সে। ভিজে ছাতার বুক নিংড়ানো কান্নায় সহযাত্রী অসন্তুষ্ট হয়। ছাতার মালিকের কাছেও সে হয়ে ওঠে বিরক্ত উদ্রেককারী জড়বস্তু। স্বার্থের পৃথিবীতে প্রয়োজন শেষে প্রিয়জনও হারায় গুরুত্ব...
ব্যস্ত শহর বৃষ্টিতে ভিজেও যেন ভিজছে না। অসহনীয় গরম ব্যারিকেড হয়ে ঘিরে রয়েছে মনুষ্যদেহ। গরমের তীব্র হাঁসফাঁসানির মাঝে কয়েক ফোঁটা শান্তি নামে মেঘের প্রাচীর ভেদ করে। বৃষ্টি ভিজে মানুষের বুকে সর্দি বসে যায়। যাক না! মধ্যরাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসাও অসম্ভব নয়। সে আসুক। রোগ-শোক-মৃত্যু অবধারিত জেনেও জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে হাসিমুখে উদযাপন করতে পারে ক'জন?
ধ্রুব পারে। বাসের ভিড় ঠেলে হাতঘড়ির দিকে চেয়ে অস্থির হয়ে পড়ল ধ্রুব। রাত বাড়ছে। বিবাহ বার্ষিকীর দিনেও অফিস থেকে ছুটি পাওয়া গেল না। তার ওপর বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। অবধারিত ভাবে মেঘ জমবে পাখির চোখের কোণে। অভিমানী বৃষ্টি নেমে আসাও অসম্ভব নয়।
বাস চলতে শুরু করতেই ধ্রুবর অপেক্ষার পালে বাতাস লাগে। তবুও সে ধৈর্য হারায় না। এ কেবল গাড়ির চাকা সচল হওয়ার অপেক্ষা নয়। এ অপেক্ষা ঘরে ফেরার। পাড়ার ফুলের দোকানটা খোলা থাকবে তো? পাপড়ি ঝরে যাওয়া অবহেলায় নুয়ে পড়া শেষ বাজারের একটা গোলাপ আর খোঁপায় দেওয়ার জন্য জুঁইফুলের মালা নিয়ে যদি ঘরে ফেরা যায়, তবে বোধহয় অর্ধাঙ্গিনীর সমস্ত রাগ গলে জল হয়ে যাবে।
ধ্রুবর ধূমপানের ইচ্ছে প্রবল হল। তারপরই ওর মুখে দেখা দিল চওড়া হাসি। সুখী দাম্পত্যের নিপাট সভ্য হাসি। পরিণয়ের আগে ফোনে যোগাযোগ ছিল ধ্রুব এবং পাখির। ধূমপানের কারণে অনেক অনুযোগ ভেসে আসত ফোনের অপরদিক থেকে। তখন ফোনের এপার থেকে গাঢ় কণ্ঠে ধ্রুব বলত, শাসন আর আদর দূর থেকে করতে নেই। কাছে এসে পাশে বসে হাতের ওপর হাত রেখে করতে হয়...
ধ্রুবর কথা রেখেছে পাখি। কাছে এসেছে সে। পাশে বসে শাসন আর আদর দুই-ই করেছে। তার আদুরে অত্যাচার থেকে ধ্রুবর পরিত্রাণ নেই। তবে আজ ইচ্ছাকৃত ধূমপানকে কেন্দ্র করে পাখির শাসন এবং দাম্পত্য কলহের মাত্রা পূর্বদিনের সমস্ত সীমা লঙ্ঘন করবে। নোনাজলে ভিজবে পাখির চোখ। রাগারাগি হবে, অভিমানের পারদ চড়বে। শীতল দাম্পত্যের শান্ত দীঘির মাঝে তুমুল জলঘূর্ণি সৃষ্টি হবে। পাখির নরম বুক অভিমানী উষ্ণতায় ফুলে-ফুলে উঠবে। তার পরের দৃশ্য কল্পনা করে বাসের ভিড়ের মধ্যে মিশে ধ্রুবর শিরদাঁড়া বেয়ে সুখী কামনার শিরশিরে কাঁপুনি চুঁইয়ে পড়ে। মধ্যবিত্তের বাসনা...
টিং!
মুঠোফোনের পর্দায় পরিচিত নম্বর থেকে ভেসে এসেছে বার্তা। "শুভ পরিণয়কে আমি সুখী পরিণতি ভেবে ভুল করেছিলাম।" মেসেজ দেখেও ধ্রুব প্রত্যুত্তর করল না। অপেক্ষার চেয়ে বড় শান্তি এবং শাস্তি আর কিছুতে নেই। ধ্রুব আজ পাখিকে খুব শাস্তি দেবে।
ধ্রুবর কল্পনায় পাখি এখন চুপটি করে বসে রয়েছে বিদ্যুতের তারের ওপর। ডানার ঝটপটানি গেছে থেমে। জলভরা মেঘ জমেছে ওর মনের আকাশে। রামধনুর অপেক্ষায়...
ডোরবেলের শব্দে ঘোর কাটে হেমাঙ্গিনীর। কাল্পনিক পৃথিবীর মোহ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে ওর বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগে। ততক্ষণে আরও বার দুয়েক ডোরবেল বেজেছে। সন্ধে থেকে রাত লিখতে লিখতে, রাত পেরিয়ে সকাল হয়ে গেছে। হেমাঙ্গিনী বুঝতে পারেনি।
ল্যাপটপ থেকে হাত সরিয়ে চশমাটা আলতোভাবে খুলল হেমাঙ্গিনী। তড়িঘড়ি দরজা খুলতেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করল দমকা বাতাস। সেই বাতাসের ঝাপটায় ফ্ল্যাটের নিরিবিলি পরিবেশ দামি পর্দার আড়ালে আলগোছে মুখ লুকোল। ঘরে ঢুকে কোমরে কাপড় গুঁজে কলকল করে বাতাসী বলল,
-কখন থেকে বেল বাজাচ্ছি। কানে কি তুলো গুঁজে রেখেছ দিদি?
-লিখছিলাম।
-অ! লিখছিলে? এত সকালে? তোমার চোখে ঘুম নেই? আবার তুমি না ঘুমিয়ে পড়ালেখা করছ?
-ঐ আর কী!
-রাত জেগে চেহারার কী অবস্থা করেছ! সে খেয়াল আছে? তোমার তো আবার ঐ যন্তরের সামনে বসলে জগতের কোথায় কী ঘটছে, সে হুঁশ থাকে না। সসপ্যানে বসানো দুধ পুড়ে ঝামা হয়। বালতি ভর্তি হয়ে জল উপচে পড়ে মেঝে ভাসে। বৃষ্টিতে শুকনো জামাকাপড় ভিজে সপসপে হয়। এমন তালকানা মানুষ জন্মে দেখিনি বাপু। শোনো, এ বেলা বলে রাখি...
অনিদ্রার কারণে হেমাঙ্গিনীর মাথা টলছিল। চোখ বেশ জ্বালা করছিল। বিছানা হাতড়ে ক্লিপ খুঁজে মাথার অবিন্যস্ত চুলগুলো বাঁধার সময় আচমকা পিছু ফিরল হেমাঙ্গিনী। চোখ পাকিয়ে সন্দেহের দৃষ্টিতে বাতাসীর দিকে চেয়ে বলল, "আবার ছুটি?"
সোফার তলা থেকে ঝাঁটা বের করে আহ্লাদে আটখানা হয়ে বাতাসী শ্রুতিমধুর কণ্ঠে আবদার করল,
-আজ বিকেলে কাজে আসব না দিদি। নাতি নিয়ে মেয়ে ঘরে আসবে। সিনেমার টিকিট কাটবে বলে রেখেছে। তিনটের শো। যেতি হবে। বোঝোই তো দিদি! মেয়ে আমার শ্বশুরবাড়ির ঘর করে। দজ্জাল শাশুড়ি মেয়েটাকে একেবারে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খেলে গো। মেয়েটা দু'দিনের জন্য বাপের ঘরে আসবে। একটু আমোদ করবে। তারপর আবার নরকে ফিরবে। এই দুটো দিন ওর কাছে না থাকলে হয়? ওকে কী পরাব? কী খাওয়াব...
-ঠিক আছে। কাল তাড়াতাড়ি আসবি।
-সে তোমায় বলতি হবে না দিদি। আমি কাল চোখদুটো মেলে আগে তোমার ফেলাডে...
-চা খাওয়াবি বাতাসী? পরে ঝাঁট দিস। আগে দু'কাপ চা কর।
ব্রাশ হাতে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হেমাঙ্গিনী বাইরের দিকে চাইল। কাচের ওপর এখনো বৃষ্টির ফোঁটা লেগে রয়েছে। আকাশের মুখ ঠিক পাখির বুকের মতোই ভার হয়েছে। সে রাতে পাড়ার মোড়ে ফুলের দোকানটা খোলা ছিল? ধ্রুব জুঁইফুলের মালা নিয়ে পাখির কাছে পৌঁছেছিল? কেমন কাটল তাদের মধুরাত? কিছুই জানা হল না। কিংবা হেমাঙ্গিনী সবই জানে। কেবল মানে না।
উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের বারান্দায় দুটো পাখি একে-অপরের গায়ে ঠোঁট ঘষে দিচ্ছে। দিনের আলোয় এমন ভালোবাসাবাসি মাখামাখি কেন? হেমাঙ্গিনী ঈর্ষাকাতর দৃষ্টিতে ওদের দিকে চেয়ে রইল। ওর বুকের ভিতর একাকীত্বের নিভৃতবাস।
গরম চায়ে চুমুক দিয়ে বাতাসী জিজ্ঞাসা করল,
-দিদি শুনেছ কিছু? ডাক্তারের বৌটার সঙ্গে একতলার ঐ ব্যায়াম শেখায় ছোকরার ঢলাঢলি চলছে। হবে না? বরটা দিনরাত রুগী দেখে বেড়ায়। একদণ্ড বাড়িতে থাকে নাকো। তা কচি বৌটার বা দোষ...
-মেয়ে বাড়িতে এলে তোর খুব মজা, বল বাতাসী?
-হ্যাঁ গো দিদি। নাতিটা বাড়ি মাথায় করে রাখে।
হেমাঙ্গিনীর মুখের মলিনতা বাতাসীর দৃষ্টি এড়ায়না। বোধহয় সকল শ্রেণির নারীর মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে সন্তানস্নেহ ঘুমিয়ে থাকে। মাতৃত্বের মাপকাঠিতে হেমাঙ্গিনী-বাতাসী মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সামাজিক দূরত্ব লঘু হয়। হেমাঙ্গিনীর নিস্পৃহ মুখ দেখে ওর মনের গভীরে ওঠা ঝড়ের আভাস বাতাসী পায় না। তবে হেমাঙ্গিনীর চোখের আয়নায় স্পষ্ট ধরা পড়ে উৎকণ্ঠামিশ্রিত হতাশা। বাতাসীর কণ্ঠে আশ্রয় নেয় সমবেদনা। "রিও কবে আসবে দিদি?"
হেমাঙ্গিনী প্রথমে উত্তর দেয় না। ধূমায়িত চায়ের দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ পর বলে, "ছুটি পেলে নিশ্চয়ই আসবে।"
হেমাঙ্গিনীর নিভে আসা কন্ঠস্বরে বাতাসী কথা হারায়। প্রতিবেশী ফ্ল্যাটের হাঁড়ির খবর অতিরিক্ত রঙয়ের প্রলেপ দিয়ে বলা হয় না। মেঝেতে বসে কার্পেটে আঙুল ঘষতে ঘষতে বাতাসীর ঠোঁটের কোণে হঠাৎ হাসি ফুটে ওঠে।
বাতাসী জানে হেমাঙ্গিনীর লেখাপড়ার সে কিছুই বোঝে না। তবুও হেমাঙ্গিনী নিজের লেখা গল্প বাতাসীকে শোনায়। সময়ে-অসময়ে গল্পের বিবিধ সম্ভবনা নিয়ে তার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করে। বাতাসীর স্বল্পবুদ্ধিতে যা মনে হয়, ও তাই অনর্গল বকবক করে যায়। বাতাসী বুঝতে পারে, তার পরামর্শ হেমাঙ্গিনীর কোনও কাজে লাগে না। তবে তার বাক্যের প্রাবল্যে মুখরিত হয়ে থাকা সময়টুকু নিঃসঙ্গ হেমাঙ্গিনীর একমাত্র সঙ্গী। বাতাসী জিজ্ঞাসা করে, "কাল রাত জেগে কী লিখলে? দু'চার পাতা শোনাও দেখি।"
বাতাসীর মনোভাব বুঝে হেমাঙ্গিনী রহস্য করে বলে,
-রাত জেগে রাত লিখেছি। রাতের পর সকাল খুঁজেছি। ভোরের নরম আলোয় পাখির গান শোনার আশায় চোখ মেলে, দিগন্তরেখায় মিলিয়ে যাওয়া দূরের পাখি দেখেছি...
-তোমার বাপু যতসব গোলমেলে কথা! কিছুই বুঝি না।
-থাক। আর বুঝে কাজ নেই। এবার নিজের কাজে হাত দে। বাড়ি ফিরে তোর আবার রান্না আছে না? যাওয়ার সময় টাকা নিয়ে যাস। নাতিকে কিছু কিনে দিবি। বলবি, দিদিমণি দিয়েছে।
আজ যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে গগনচুম্বী বহুতল, বছর দশেক আগে একাধিক বাড়ির সঙ্গে সেখানে ছিল একটি বিশেষ বহুতল এবং আভিজাত্যপূর্ণ বাড়ি। হেমেন্দ্রনারায়ণ নন্দীর নাম স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতিতে আজও স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করা রয়েছে। বাজারে তিনটি শাড়ির দোকান ছাড়াও নামে এবং বেনামে একাধিক দোকানের মালিক ছিল সে। স্বাভাবিকভাবে তার প্রতি সমিতির নীরব পক্ষপাতিত্ব ছিল। ফলস্বরূপ সে ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি পদ অলংকৃত করে বসেছিল। তবে তার কর্তৃত্ব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পর হেমাঙ্গিনী অথৈ জলে পড়ে। পরবর্তী সময়ে সমিতির সাহায্যে সহজেই ব্যবসার মালিকানা লাভ করে হেমাঙ্গিনী নন্দী।
জন্মের পর অধিক রক্তক্ষরণের ফলে জন্মদাত্রীকে হারিয়েছিল হেমাঙ্গিনী। স্ত্রীর মৃত্যুর পর হেমেন্দ্রনারায়ণ দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করেনি। একমাত্র কন্যার প্রতি অন্ধস্নেহের ফলে দ্বিতীয় কোনও নারীর অস্তিত্ব স্বীকার করতে তার মন সায় দেয়নি। একটি কন্যাসন্তানের জনক হওয়া সত্ত্বেও, শুধুমাত্র বৈষয়িক কারণে পাত্র হিসেবে হেমেন্দ্রনারায়ণের বাজারদর যে সে সময় তুঙ্গে ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাদের মাঝে দেখা গিয়েছিল তুমুল উৎসাহ। কিছু আত্মীয়-স্বজন দ্বিতীয় বিবাহের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে হেমেন্দ্রনারায়ণের চক্ষুশূল হয়েছে। মৃত্যুকালে রেখে যাওয়া দেবাঙ্গিনীর অপূর্ব সৃষ্টি হেমাঙ্গিনীকে বুকে আগলে সমগ্র জীবনকাল অতিবাহিত করে গেছে হেমেন্দ্রনারায়ণ।
সময় বদলেছে। পরিবর্তিত সময়কে সাদরে গ্রহণ করে জনমানবহীন পৈতৃক ভিটে প্রোমোটারের হাতে তুলে কয়েক বছর আগে হেমাঙ্গিনী উঠে এসেছে দু'কামরার এক টুকরো ফ্ল্যাটে। এই একই টাওয়ারে ওর আরও দুটি ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া আছে। অর্থের অভাব হেমাঙ্গিনীর অতীতে ছিল না, বর্তমানে নেই। ভবিষ্যতে হওয়ার তেমন জোরালো সম্ভবনা নেই। তা সত্ত্বেও ওর যে কী নেই, তা হেমাঙ্গিনী নিজের মনের ভিতর খুঁজে বেড়ায়...
ভালোবাসার উষ্ণতা ফুরিয়ে যাওয়ার পর যেমন স্মৃতির জেদি সর এঁটো মনে আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে থাকে, তেমন সর পড়েছে কাপের গায়ে। চক্ষুলজ্জার খাতিরে সেই সর আস্বাদন করা হয় না। যদি কেউ হা-ঘরে বলে বিদ্রুপ করে! যদি হ্যাংলামির প্রভাবে নষ্ট হয় উচ্চবিত্তের আভিজাত্য! সেই দুঃসাহস থাকলে হেমাঙ্গিনী কি কাপের সরটুকু চেটেপুটে খেয়ে ফেলত না?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারান্দা থেকে বাইরের দিকে চাইল হেমাঙ্গিনী। পাখিদুটো উড়ে গেছে। হয়তো ওরা লোকচক্ষুর আড়ালে পরস্পরকে এঁটো করতে গেছে। বাতাসী ডাকছে। রান্নার জোগাড় করবে। কী রান্না করবে, তাও হেমাঙ্গিনীকেই বলে দিতে হবে। উদর বড় বিড়ম্বনা!
হেমাঙ্গিনীর মন প্রাণপণে এঁটো হতে চায়। অজ্ঞাতবাসে যেতে চায়। কাপের সর পড়া চা হয়ে ঘুম ভাঙাতে চায় কোনও একজনের। জানালায় ফুড়ুৎ করে উড়ে বেড়ানো পাখির গান শুনতে চায়। কিন্তু সে কথা মুখ ফুটে প্রকাশ্যে বলা যায় না। বাতাসীকেও জানানো যায় না। ওকে কেবল রহস্য করে বলা যায়.... রাত জেগে রাত লিখি। বাতাসীকে যদি ভুলক্রমে বলে; হেমাঙ্গিনী এঁটো হয়ে বাঁচতে চায়, তবে ও নির্ঘাৎ এঁটো বাসন সিঙ্কে ফেলে পালাবে।
আপনমনে হেসে ওঠে হেমাঙ্গিনী। মধ্যরাতের বৃষ্টিসিক্ত বাসনা সকালের প্রখর তাপে ভস্মীভূত হয়ে যায়। জগতের যা কিছু নিষিদ্ধ, তা রাতের অন্ধকারে মান্যতা পায়। দিনের আলোয় তার বৈধতা নেই। দিনের বেলা হেমাঙ্গিনী হল হেমেন্দ্রনারায়ণের মতো একজন তুখোড় ব্যবসায়ীর উপযুক্ত কন্যা। দেবতনুর প্রাক্তন স্ত্রী, বাতাসীর দিদিমণি এবং রিওর মা। সর্বোপরি সে একজন চল্লিশোর্ধা নারী। এই তার একমাত্র পরিচয়।
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট