কুহেলিকায় রাত্রিযাপন
সাথী দাস
প্রথম পর্ব
বৃষ্টির কাছাকাছি আজও তোমাকে খুঁজি, খুঁজি,
মেঘের কানাগলিতে, ঠিকানা হারিয়েছ বুঝি! তাই বুঝি!
তিন রাস্তার মোড়ে, নিভে আসা আলোয়, তোমায় ভেবেছি আপন... আপন!
রোদের কিনারে, ফিরে চেয়ে দেখি, বৃথাই রাত্রিযাপন....
বৃথা এই... রাত্রিযাপন!
আজ শুটিংয়ের শেষ দিন ছিল। সামনের বছরের প্রথমার্ধেই হয়ত মুক্তি পাবে সিনেমাটা। মাত্র দুটো দৃশ্য আর বৃষ্টির মাঝে গানের শুটিং শেষ করে প্যাক আপের পর গাড়িতে উঠে বসেছিল কুহু। মেকআপ তুলে ফেললেও ওর চুলটা এখনও ভিজে। মনটা ভিতরে-ভিতরে অস্থির হলেও, কুহু ওপরে সেটা প্রকাশ করছিল না। নিজের গানটাই কুহু চোখ বন্ধ করে গুনগুন করছিল। সহ অভিনেতা পীযূষকান্তি সাহা মানুষটা বড় ভালো। চল্লিশ পেরিয়ে গেলেও, এখনও মনে-প্রাণে-শরীরে বেশ ঝকঝকে সুপুরুষ। পীযূষ ও কুহেলীর জুটিতে এটা তৃতীয় ছবি। টলিউডের একেবারে শীর্ষস্থানে না থাকলেও, ইতিমধ্যেই অনেকের রাতের ঘুমের ব্যাঘাতের কারণ হয়ে উঠেছে বছর ত্রিশের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা লাস্যময়ী কুহেলী বর্মন। আর এই নতুন জুটি বক্স-অফিসে বেশ সাড়া ফেলেছে। তার ফলে প্রযোজকরাও একটু নড়েচড়ে বসে তড়িঘড়ি খোঁজ করছেন নবাগতা কুহুর। তবে এই সমস্তটাই সম্ভব হয়েছে পীযূষের জন্য। বড় একটা প্রজেক্টে প্রথম সুযোগটা উনিই দিয়েছিলেন কিনা! যদিও ভালমানুষির মুখোশটা এখনও পীযূষ খোলেননি, কিন্তু উনি কবে যে কি প্রস্তাব দিয়ে বসবেন, এখন সেই অপেক্ষায় দিন গুনছে কুহু। মনের অস্থিরতা কাটাতে গান করতে করতে ভিজে কাঁচের দিকে চোখ খুলে চাইল কুহু। সল্টলেকে ওর দু-কামরার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের দিকে গাড়িটা ঢিমে গতিতে এগোচ্ছিল। এলাকাটা একটু নির্জন হলেও সারাদিন দমবন্ধ করা কর্মজগতে ব্যস্ত থেকে, রাতে নিজের একাকীত্বের সঙ্গে নির্জনে সময় কাটানো যায়। তুমুল বৃষ্টি না হলেও, বেশ ঝিরঝির করে হচ্ছে। গাড়ি থেকে বেরোলে ভিজতে হবে। পরের মোড়ে বাঁক নিয়ে গলির মধ্যে ঢুকবে গাড়িটা। হঠাৎ কুহু গাড়িতে বসেই দেখল রাস্তার ধারে পিছন ফিরে বর্ষাতিতে ঢাকা রয়েছে সে। গাড়িটা বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলেও, কুহু লাফিয়ে উঠল,
-দাদা, গাড়ি থামান।
-কি হল ম্যাডাম?
-আমি এখানেই নামব। কাল কোথাও বেরোনোর নেই। আপনি গাড়িটা গ্যারাজে নিয়ে চলে যান। কোথাও হঠাৎ করে বেরোতে হলে, আমি ক্যাব নিয়ে নেব। আপনার কাল ছুটি।
-আচ্ছা ম্যাডাম!
কুহু বেরোতেই গাড়ির চালকও একলাফে বেরিয়ে ছাতা ধরলো কুহুর মাথায়। কুহু বলল,
-ছাতাটা আমাকে দিন। আপনি বেরিয়ে যান!
-এইটুকু রাস্তা আবার হেঁটে ফিরবেন? একেবারে ফ্ল্যাটে ঢুকে যেতে পারতেন ম্যাডাম। একদম নির্জন রাস্তাটা। বৃষ্টি পড়ছে। রাতও অনেক...
-গুড নাইট দাদা। আসুন আপনি।
-ওকে ম্যাডাম!
গাড়িটা বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল কুহু। একেবারে দৃষ্টির বাইরে চলে গেলে হনহনিয়ে ও এগোল আপাদমস্তক বর্ষাতিতে আবৃত ওই মানুষটার দিকে। ছাতাটা নিজের মাথায় ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল ও। রাস্তার ভিজে ল্যাম্পপোস্টের ঝাপসা আলোয় কুহুর সুদীর্ঘ ছায়া ওই মানুষটার ছায়ার ওপর গিয়ে পড়ল। মৃদুস্বরে ডাক দিল কুহু,
-কাজ হয়ে গেছে?
কুহুর দিকে ফিরে দাঁড়াল বর্ষাতি। চাপাস্বরে বললো,
-একদম খতম। স্পটডেড!
বাঁকা হাসি হেসে উঠল কুহু। ফিসফিসিয়ে বললো,
-এখানে কথা বলা ঠিক হবে না। মরার খবরটা ছড়িয়ে পড়লে, টিকটিকি সবার আগে আমার পিছনেই পড়বে। বাকি সব কথা ফ্ল্যাটে গিয়ে...
পরদিন প্রত্যেকটি সংবাদমাধ্যমে চিৎকার করতে শুরু করলো অসংখ্য পরিচিত মুখ,
"আপনারা সরাসরি সম্প্রচার দেখতে পাচ্ছেন, আমরা এখন রয়েছি সল্টলেকের সেই ফ্ল্যাটের নীচে, যেখানে গতকাল রাতেই খুন হয়েছেন অভিনেত্রী কুহেলী বর্মন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের সাবলীল অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন তিনি। কেরিয়ারের মধ্যগগনে থাকাকালীন কেন এভাবে খুন হতে হল তাকে? প্রাথমিক তদন্তে জানা যাচ্ছে, শ্বাসরোধ করে তাকে খুন করা হয়েছে। নিজের ফ্ল্যাটের বেডরুম থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ফ্ল্যাটের দরজা খোলা ছিল। দরজা ভাঙার কোনো চিহ্ন নেই, অর্থাৎ কোনো ফোর্স এন্ট্রি নেই। তবে কি আততায়ী অভিনেত্রীর বিশেষ পরিচিত? উঠে আসছে অনেক অনেক প্রশ্ন... সেই সঙ্গে আপনাদের আগেই জানিয়েছি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর, আজ শহরের বুকে একটি নয়, ঘটে গেছে দুটি অনাকাঙ্খিত মৃত্যু। এই দুটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কিনা, জানতে হলে চোখ রাখুন আমাদের চ্যানেলে... আমি পল্লবী সাহা, সারাদিন প্রতিদিন..."
বিস্মৃত অতীতের অধ্যায়ে....
।। এক ।।
বিছানার ওপর মা শুয়ে রয়েছে। জ্বরে প্রায় বেহুঁশ। কাল রাতের সামান্য একটু ডাল আর ভাত বেঁচে গিয়েছিলো। খেতে বসে কুহু দেখলো, ডালটা একটু গন্ধ হয়ে গেছে। ভাত থেকেও কেমন যেন জল ছেড়ে গেছে। বাবা ভোরবেলা কিভাবে যে এই ভাতগুলো খেলো, কুহু ভেবেই পেলো না। দুদিন ধরেই মায়ের খুব জ্বর। গতকাল বাড়িতে ডাক্তার এসেছিলো, মাকে দেখে গেছে। বিশেষ আশার কথা শোনাতে পারেনি। কাল সারারাত মায়ের মাথার কাছে বাবা বসেছিলো। জলপট্টি দিয়েছে, মাকে ওষুধ খাইয়েছে। কুহু পরীক্ষার জন্য রাত জেগে পড়ছিল। আজ সকালে বাবাকে দোকানে বেরোতেই হবে, তাই বাবা নাকে-মুখে দুটো পচা ভাত গুঁজেই বেরিয়ে গেছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে কুহেলী। বাবা সজল বর্মন স্থানীয় বাজারে একটা জামাকাপড়ের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কর্মরত। মা গৃহবধূ, যার বছরের বেশিরভাগ সময়টাই কাটে সরকারি হাসপাতালের বিছানায়, বা ঘরের বিছানায় শয্যাশায়ী অবস্থায়। মফঃস্বলের সামান্য খানিকটা জমির ওপর মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে, ঠাকুরদার তদারকিতে ইঁটের পর ইঁট গেঁথে যাওয়া দুটো ঘর সজলের একমাত্র সম্বল। ওই বসতবাড়িখানা ছাড়া কুহুর ঠাকুরদা আর তেমন কিছুই করে রেখে যেতে পারেননি। নিজেদের পেটের ভাতের যোগাড়, কুহুর পড়াশোনা, কুহুর জন্মের পর থেকেই কঠিন স্ত্রীরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়া মায়ের ঘনঘন অসুস্থতা সামলাতে গিয়ে বাবা নাজেহাল হয়ে পড়ে। তাও মুখ বন্ধ করে ওই মানুষটা দিনরাত খেটে যায়। মুখে কোনো সাড়া পর্যন্ত নেই। একটা মানুষ বিছানার সঙ্গে মিশে থাকা নিজের অসুস্থ স্ত্রী-কে যে কিভাবে এতখানি ভালোবাসতে পারে, কুহু তার উত্তর জানে না। রুগ্ন মা তিনদিন যদি রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে একটু রান্না করে, তারপরেই আবার সাতদিন বিছানা আঁকড়ে শুয়ে থাকে। কলঘরের শ্যাওলা ধরা মেঝেতে রক্তিম বন্যার প্রকোপ বাড়তেই কুহু বুঝতে পারে, আবার মা বিছানায় আশ্রয় নেবে। মায়ের এই দীর্ঘকালীন অসুস্থতার জন্যই, বড় তাড়াতাড়ি সংসারী হয়ে উঠেছিল কুহু। শৈশব পেরোতে না পেরোতে পেটের জ্বালায় ও পা রেখেছিল রান্নাঘরে। কলমের পাশাপাশি হাতে তুলে নিয়েছিল খুন্তিটাও। তিনজনের ক্ষুদ্র সংসার নিতান্ত সচ্ছল না হলেও, কুহুর কর্মঠ বাবা কোনোদিন সামান্যতম অভাবটুকুও কুহুকে বুঝতে দেননি। আজ বাবা দোকানে বেরিয়ে যাওয়ার পর পাশের বাড়ির কাকিমাকে ডেকে আনলো কুহু। মায়ের জ্বরটা এখন একটু কম হলেও, শরীর বড় দুর্বল। কাকিমা বরাবরই ওদের খোঁজ-খবর নিয়ে থাকেন। প্রয়োজনে কুহুকে ডেকে দু'গ্রাস গরম ভাতও নিজের হাতে খাইয়ে দেন। কাকিমা মায়ের মাথার কাছে বসে-বসে বলছিলো,
-পরীক্ষাটা ভালো করে দিস কুহু। মায়ের চিন্তা করতে হবে না। আমি বৌদিকে এসে এসে দেখে যাবো। দুপুরে রান্নাও করে দিয়ে যাবো। তুই শুধু মন দিয়ে পরীক্ষাটা দিস! এদিকের চিন্তা তোকে করতে হবে না।
সাদা ব্লাউজের ওপর দিয়ে নীল শাড়ির আঁচলটা বুকের ওপর ফেলে, সেফটিপিনটা দাঁতের ফাঁকে চেপে ধরেছিলো কুহু। ওটা দিয়ে আঁচল আটকে চুলে বেণী করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ওর চোখদুটো জলে ভরে উঠলো। যৌবন ছুঁয়েছে ওকে। তবে ওর দেহে কুহুর কোনো পৃথক অস্তিত্ব নেই। সবটাই যেন ওর মা! ও মাতৃমুখী জন্ম থেকেই। এখন আয়নার সামনে দাঁড়ালে, ওর প্রায়ই মনে হয়, কুহু নয়, যেন ওর নিজের মা এসে দাঁড়িয়েছে আয়নার সামনে। নীরোগ মা! হাসিখুশি মা! চোখের জল চেপে বিছানার কাছে এসে কুহু মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-ও মা! একটু তাকাও। এই যে আমি! এইদিকে। আমি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। কাকিমা আজ রান্না করে দেবে বলেছে। তুমি বিছানা থেকে একদম উঠবে না। আমি তোমার মাথার কাছে জলের বোতল ভরে রেখে দিয়েছি। বেডপ্যান আছে। দরকার হলে ব্যবহার করবে। আমি এসে পরিষ্কার করবো। তুমি একা একা কলঘরে যাবে না মা!
বিছানা থেকে একটু উঠে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে হু-হু করে কেঁদে ফেললেন কুহুর মা। একটু আগেই কুহু নিজের মধ্যে দেখেছে মায়ের নীরোগ প্রতিবিম্ব। মাকে অসুস্থ অবস্থায় দেখতে খুব কষ্ট হয় ওর। কিন্তু পরীক্ষার আগে একদম কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো না। আজই শেষ পরীক্ষা। কোনোমতে দিয়ে বাড়িতে ঢুকে সারাদিন মায়ের কাছে বসে থাকতে পারবে। কয়েকদিন আর পড়াশোনার বড় বিশেষ চাপ নেই। মায়ের মাথার চুলগুলো উঠে একেবারে টাক পড়ে গেছে। রোগিনীর কাঁধ থেকে নেমে আসা মলিন রংচটা নাইটিটা তুলে মায়ের মাথাটা আঁচড়ে, গুটিকয় চুল পেঁচিয়ে বেঁধে দিলো কুহু। চিরুনি দিয়ে সিঁদুরের কৌটো থেকে সিঁদুর নিয়ে চওড়া করে পরিয়ে দিলো মায়ের সিঁথিতে। তারপর মায়ের কপালে চুমু খেয়ে বললো,
-এই তো! কত সুন্দর দেখতে তুমি!
গাল ভেঙে বসে যাওয়া রোগিনী ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো নিজের মেয়ের দিকে। মায়ের সামনেই হাউহাউ করে কেঁদে ফেলার ভয়ে 'মা আসছি' বলে পালানোর চেষ্টা করলো কুহু। অন্যদিনের মতো ক্ষীণ নিস্তেজ কণ্ঠে মা সেদিন আর বললো না, "কুহু ভালো করে পরীক্ষা দিস। সাবধানে যাস মা!" জানালার বাইরে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকেও কিছু শুনতে পেলো না কুহু। বাঁ হাতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ও আর অপেক্ষা করতে পারলো না। এগারোটা বাজতে মাত্র পনেরো মিনিট বাকি। চোখের জল মুছে সাইকেলটা নিয়ে কুহু দ্রুতগতিতে স্কুলের দিকে এগোলো। স্কুলে পৌঁছে মাথা নীচু করে সাইকেল লক করার সময় একটা উড়ন্ত চাঁটি এসে পড়লো কুহুর মাথায়...
-উফ!
-কি উফ? কতবার বেল বাজালাম, শুনতে পাসনি? কালা নাকি তুই? ওই! কিরে কুহু? মুখটা ওইরকম করে আছিস কেন?
একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে ছাত্র-ছাত্রী একত্রে পড়ার সুবাদে বালিকা বিদ্যালয় ছেড়ে এই স্কুলে আসার পর কুহুর সঙ্গে পরিচয় হয় সীমান্ত মহাপাত্র নামক এই সুবোধ ছাত্রের। কুহুর বেশিরভাগ বন্ধুরা আগের স্কুলেই রয়ে গেছে। তাই এই স্কুলে ওর বন্ধু সংখ্যা খুবই কম। হাতেগোনা কয়েক জনের সঙ্গে সখ্যতা থাকলেও, হৃদ্যতা বেশি একমাত্র সীমান্তর সঙ্গেই। এই স্কুল সীমান্তর কাছে নতুন হলেও, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কুহুর সঙ্গে ওর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। বারকয়েক খাতাপত্র আদানপ্রদানের জন্য সীমান্তর বাড়িতে এখন কুহুর অবাধ যাতায়াত। সীমান্তর বাবা একজন নামজাদা উকিল। রাশভারী বাবার সঙ্গে কথা বলতে সীমান্ত নিজেই বড় ভয় পায়। কুহু তো আজ পর্যন্ত কাকুর সঙ্গে একটাও কথা বলেনি। সেই তুলনায় সীমান্তর মা বড় অমায়িক-হাসিখুশি, দরাজ মনের একজন মানুষ। স্কুলে পৌঁছে সাইকেলের চাবিটা পকেটে ঢুকিয়ে কুহুর মুখের দিকে এক নজর দেখেই সীমান্ত বুঝলো, ওর মন আজ ভীষণ খারাপ। সীমান্তর প্রশ্নের উত্তর কুহু বললো,
-মায়ের শরীরটা আজ একটু বেশিই খারাপ রে সন্তু! কাকিমাকে বসিয়ে এসেছি। কয়েক ঘন্টার পরীক্ষাও যেন কয়েক যুগ মনে হচ্ছে। পরীক্ষা না থাকলে, আজ আমি বাড়ি থেকে বেরোতামই না। কী যে পরীক্ষা দেবো, সে একমাত্র ভগবানই জানে!
-ঠিক আছে! কাকিমা সুস্থ হয়ে যাবে। সারা বছরই তো কাকিমার কমবেশি শরীর খারাপ থাকে। তুই এক্সামে ফোকাস কর।
ঘন্টার শব্দে কেঁপে উঠলো দুজনেই। সীমান্ত কুহুর হাতটা চেপে ধরে বললো,
-চল-চল! সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় উঠতে হবে। ফার্স্ট বেল পড়ে গেছে।
শাড়ির কুঁচিটা কোনোরকমে সামলে, পিঠে ব্যাগ নিয়ে বেণী দুলিয়ে সীমান্তর সঙ্গে স্কুলের ভিতরদিকে ছুটলো কুহু।
।। দুই ।।
পরীক্ষার তখন প্রায় শেষের দিকে। অন্তিম ঘন্টা পড়ার বেশ কিছুক্ষণ আগেই কাকু এসে দাঁড়িয়েছে দরজার বাইরে। কুহুর সারা শরীর ভয়ে কাঁপছে। প্রধান শিক্ষক পরীক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে ভিতরে এসে কুহুর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,
-তোমার কি লেখা হয়ে গেছে?
-হ্যাঁ স্যার! হয়েই তো এসেছে। কেন?
-ঠিক আছে। খাতা জমা দিয়ে বাড়ি চলে যাও।
-কেন স্যার? সময়ের আগেই.... আর তো একটুখানি...
-সুতো ঠিক করে বেঁধেছ তো? দাও, খাতা জমা দিয়ে দাও। বাড়ি যাও!
বেরোনোর আগে একবার পিছনদিকে চাইলো কুহু। সীমান্ত লেখা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলো। অস্থির দৃষ্টিতে চেয়েছিলো ওর দিকেই। কুহু আর কিছু বললো না। মাথা নামিয়ে বেরিয়ে গেলো। কুহু বেরোতেই সীমান্ত ডেকে উঠলো,
-স্যার!
-বলো? তোমার আবার কি সমস্যা?
-হয়ে গেছে!
-পেজ চাইলে যে?
-লাগবে না। আপনি আমার খাতা জমা নিয়ে নিন।
খাতা জমা দেবার পরই ডাক পড়লো পিছন থেকে।
-এই ছেলে? এই পৃষ্ঠায় নাম, রোল নম্বর লিখিসনি?
-সরি স্যার! ভুলে গেছি।
-আগে লেখ!
বাড়তি পৃষ্ঠায় নাম, রোল নম্বর লিখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সীমান্ত। সিঁড়ি ভেঙে নীচে যখন ও পৌঁছলো, তখন প্রতিবেশী কাকুর বাইকে চেপে কুহু বেরিয়ে গেছে। পিঠে ব্যাগ নিয়ে সাইকেলটা টেনে বের করে সীমান্ত ঊর্ধ্বশ্বাসে প্যাডেল করতে শুরু করলো।
রাস্তার মধ্যেই কাঁদতে শুরু করেছিল কুহু। বাড়িতে পৌঁছে ও দেখলো, মায়ের মাথার কাছে বাবা একেবারে বোবা হয়ে বসে আছে। মায়ের শীর্ণ দেহটা বিছানার সঙ্গে মিশে রয়েছে। কাকিমা কাঁদতে-কাঁদতে দৌড়ে বেরিয়ে জড়িয়ে ধরলো কুহুকে। চিৎকার করে মড়াকান্না কেঁদে উঠলো কাকিমা,
-ও কুহু! তোর মা চলে গেলো রে! তুই স্কুলে বেরোনোর পরই সব ছেড়ে চলে গেলো রে! যাওয়ার আগে তোকে কত খুঁজলো...
কাঁদতে ভুলে গেলো কুহু। তুলসীমঞ্চের পাশেই বসে পড়লো ও। বারান্দায় একটা খাটিয়ায় মাকে শুইয়ে রেখেছে। মামারবাড়ি থেকেও জনাকয়েক মানুষ বুঝি এসে গেছে। কিচ্ছু মাথায় ঢুকলো না কুহুর। ও তুলসী গাছটার দিকে চেয়ে দেখলো, গাছটা একেবারে শুকিয়ে মরে গেছে। একটাও সবুজ পাতা নেই। মা ঠাকুর পুজো দিতে পারে না। সেটাও কুহুর দায়িত্ব ছিল। বেশ কয়েকদিন পড়াশোনার চাপে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ঠাকুরকে জল-বাতাসা দিয়েই দায় সেরেছিলো কুহু। তুলসীকে আর জল-ফুল দেওয়া হয়নি। তুলসীতলায় ধূপ-দীপটুকুও দেখানো হয়নি। আজ পরীক্ষার পর এদিকে চোখ পড়তেই কুহু দেখলো প্রাণহীন শুকনো গাছটাকে। টব থেকে শুকনো গাছটাকে একটানে তুলে, কুহু ওটাকে উঠোনের মধ্যিখানে ছুঁড়ে ফেললো। চুপ করে বসে রইলো বাইরেই। আর ঘরে ঢুকলো না। তক্ষুণি সাইকেল নিয়ে ঘেমেনেয়ে অস্থির হয়ে ওর বাড়ির সামনে পৌঁছলো সীমান্ত। পিছন ঘুরে বসেছিলো কুহু। ঘরের ভিতরে একঘেয়ে গোঙানির শব্দ। কাকিমা কেঁদেই চলেছে অনবরত। মৃত্যু পরবর্তী বাড়ির পরিবেশ থমথমে। সীমান্ত এসে হাত রাখলো কুহুর কাঁধে। ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে দেখে উঠে দাঁড়ালো কুহু। কিচ্ছু জিজ্ঞেস করলো না সীমান্ত। কুহু একটা শব্দও খরচ করলো না। ওর চোখ থেকে এক ফোঁটা জলও বেরোলো না। দুই কিশোর-কিশোরী পরস্পরের সঙ্গে নিভৃত দৃষ্টি বিনিময়ের মাধ্যমেই খুঁজে নিলো সান্ত্বনা ও আশ্রয়। কুহুর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে শক্ত করে ধরলো সীমান্ত....
।। তিন ।।
মা মারা যাওয়ার পর থেকেই কুহুর বাবার মধ্যে এক নিদারুণ পরিবর্তন এসে গেছে। খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে সজল। অভাবের সংসারে খাবার নষ্ট হলে বড় কষ্ট হয়। পচা ভাত হাঁড়ি উল্টে নর্দমায় ফেলে দিতে খুব খারাপ লাগে কুহুর। বাবা প্রায় প্রতিদিন রাতেই মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে। গত কয়েকদিন রাতে তো বাড়িতে ফেরেও নি। ঘরের প্রতি আর কোনো টান নেই সজলের। আজ মাঝরাতে কাকুর সঙ্গে গিয়ে মদের দোকানের সামনে থেকে অচৈতন্য বাবাকে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছে কুহু। কাকু নিজের বাড়িতে চলে যাওয়ার পর দরজায় খিল তুলে দিয়েছে। একটু পরে বাবার জ্ঞান ফিরতে, কুহুকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করতে-করতে কেঁদে ফেলে সজল। রান্নাঘরের এককোণে বসে কুহু নীরবে কাঁদতে শুরু করে। ও নিজেও ওই রাতে ভাত মুখে তুলতে পারলো না। মায়ের মৃত্যুর জন্য বাবা ওকেই দায়ী করছে। ওকে জন্ম দিতে গিয়ে মা এক কঠিন স্ত্রীরোগে আক্রান্ত হয়েছিলো। বাবার ধারণা ওই রোগের কারণেই মায়ের মৃত্যু হয়েছে। তাই এই মৃত্যুর সকল দায় কুহুর একার। ওকে জন্ম দেওয়াটাই সজলের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। কাঁদতে-কাঁদতে কুহু কখন যে রান্নাঘরের সিমেন্টের মেঝেতেই শুয়ে পড়েছিলো, সে ওর নিজেরও মনে নেই। ঘুম ভাঙতেই ও ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। ঘরে আলো জ্বলছে। বাবা খাটের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। খিদেয় কারণে মাথা ঘুরে উঠলো কুহুর। কিন্তু বাবাও তো রাতে না খেয়েই রয়েছে। চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়িয়ে একটা থালায় ভাত, একটু ডাল আর সবজি নিয়ে ও বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। বারকয়েক ধাক্কা দিতেই সজলের ঘুম ভেঙে গেলো। কুহু খাওয়ার কথা বলতেই মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো সজল। কুহু ধীরকণ্ঠে বললো,
-তুমি না খেলে মা ফিরবে বাবা? শরীরটা দেখো নিজের। রোজ রোজ খাবারগুলো নষ্ট হয়। আমি একা কত খাবো? বাবা...
কোনো উত্তর আসে না উপুড় হয়ে মুখ ফিরিয়ে থাকা দেহটা থেকে। ধরা কণ্ঠে কুহু বলে ওঠে,
-খেয়ে নাও না বাবা! আমিও কিছু খাইনি। আমার খুব খিদে পেয়েছে। তুমি খাওয়ার পর আমি খাবো। একটু খাও!
থালাটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে বাবাকে টেনে তুললো কুহু। ওকে দেখেই সজলের চোখে মুখে একরাশ বিরক্তির উদ্রেক হলো। কুহু ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। কোনোমতে বললো,
-আমি চাইনি বাবা, আমার জন্য মায়ের এইরকম একটা অসুখ হোক। আমি তো আসতেই চাইনি পৃথিবীতে। আমার দোষ কোথায় বলো?! মা চলে গেছে, তুমিও এইরকম করলে আমি কি করবো বলো তো? তোমার কিছু হয়ে গেলে, আমি কোথায় যাবো বাবা? সারাদিন ধরে এত পরিশ্রম করো, এদিকে খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছো। এভাবে বাঁচা যায়? একটু খেয়ে নাও না বাবা!
মদের বিকট গন্ধে বমি পেয়ে যাচ্ছিলো কুহুর। পরিশ্রান্ত বাবার গায়ে ঘামের উৎকট গন্ধ। জামাটা একেবারে ভিজে গেছে ঘামে। তাও কুহু বাবাকে ছাড়লো না। জড়িয়ে ধরে অনবরত কেঁদেই চললো। মেয়ের মাথায় একটা হাত রাখলো সজল। সামান্য একটু স্নেহের ছোঁয়ায় কুহু বাবার বুক থেকে মুখ তুলে বড়-বড় দুটো চোখ মেলে চাইলো সজলের দিকে। সজল দেখলো, কুহুর ভাসা-ভাসা দুটো চোখে জল টলটল করছে। অবিকল ইন্দুর মুখ কেটে বসানো রয়েছে। বিয়ের আগে ইন্দুকে সজল যখন প্রথমবার দেখেছিলো, তখন ঠিক এইরকমই দেখতে ছিল ওকে। ভরাট-নিষ্পাপ একটা মুখ। মাথায় একঢাল চুল আর বড় বড় দুটো চোখ। নাকের মাঝে ছোট্ট একটা ঝুটো মুক্তোর নথ ছিলো। ওই নথ নেড়ে ওর চোখদুটো পাকিয়ে শাসনটা সজল খুব উপভোগ করতো। আবার যখন ওই দুটো চোখে অভিমানের শ্রাবণ নেমে আসতো, তখন সজল যত্ন করে নিজের হাতে মুছিয়ে দিতো ইন্দুর ভরাট নরম তুলতুলে দুটো গাল। নিঃশব্দে কেঁদে কুহুর গালে হাত রাখলো সজল। রগচটা বাবার কাছে সামান্য একটু স্নেহের প্রশ্রয় পেয়ে কুহু ক্ষীণস্বরে ডাকলো,
-বাবা!
কুহুর গালে হাত রাখা অবস্থাতেই অতর্কিতে ওর ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রাখলো সজল। মদের গন্ধে কুহুর গা গুলিয়ে উঠলো। ঘটনার আকস্মিকতায় কেঁপে উঠে ও বাবাকে ছেড়ে ছিটকে সরে গেলো খাটের এককোণে। সজল কুহুর হাত ধরে টেনে ওকে শুইয়ে দিলো মলিন বিছানায়। অনুন্নত বুকের ওপর বাবার স্পর্শ অনুভব করেই লজ্জায় আর্তনাদ করে উঠলো কুহু!
-বাবা! ছেড়ে দাও। আমি আর কোনোদিনও তোমার সামনে আসবো না। বাবা...
কুহুর একঢাল চুলের মধ্যে হস্ত সঞ্চালন করে ওকে আদর করতে শুরু করলো সজল। ঘেন্নায় কুহু হামাগুড়ি দিয়ে খাট থেকে নামার চেষ্টা করলে, সজোরে একটা থাপ্পড় এসে পড়লো ওর গালে। হঠাৎ আঘাতে মাথা ঘুরে কুহুর পৃথিবী দুলে উঠলো। ও বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে গেলো। মুখের ওপর চেপে বসলো সজলের বলিষ্ঠ হাত। জন্মদাতার দীর্ঘকালীন সুপ্ত কামজ্বালা মেটানোর পর ছিন্নভিন্ন অবস্থায় বিছানায় পড়ে রইলো কুহু। বাবা তখনও ওর উলঙ্গ দেহটাকে তারিয়ে-তারিয়ে উপভোগ করে চলেছে। কুহুর অনাবৃত দেহের ফুটে ওঠা যৌবনচিহ্নগুলো নিয়ে সজল মেতে উঠেছে কামলীলায়। কুহুর দুটো চোখ একেবারে শুষ্ক। দেহ অবশ। বাবার নগ্ন দেহ ও উত্থিত পুরুষাঙ্গ চোখে পড়ামাত্র প্রবল ঘৃণায় মুখটা ফিরিয়ে নিলো কুহু। মানসিক যন্ত্রণায় অসাড় হয়ে গেছে ও। চিৎকার করে কাঁদতে গেলেও গলা থেকে কেবল গোঙানি বেরিয়ে আসছে। ওর দেহের একান্ত গোপনীয় স্থানে তখনও বাবার অবাধ বিচরণ। টেবিলের ওপর ভাত জুড়িয়ে গেলো। ওই রাতেই কুহুর পেটের জ্বালা মরে গেলো চিরতরে। সজল তখন কুহুর উরুসন্ধিতে ঈষদুষ্ণ জিভ স্পর্শ করে তীব্র লেহনক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের কাম উত্তেজনা প্রশমনে সচেষ্ট....
।। চার ।।
-কথা বলছিস না কেন? ওই কুহু!
টিউশন থেকে বেরিয়ে সাইকেল হাঁটিয়ে নিয়ে সীমান্তর সঙ্গে বাকি পথটুকু পায়ে হেঁটেই ফিরছিলো কুহু। নিজের বাড়িতেই ওর প্রতিটা রাত এখন বিভীষিকার মতো কাটে। সন্ধ্যে নেমে এসেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। কানের সামনে সীমান্ত অনর্গল বকবক করে যাচ্ছে। কিন্তু কুহু সেসব কিছুই কানে তুলছে না। ওর সারা গায়ে তখন বিষের মতো ব্যথা। বোধহয় কাঁপুনি দিয়ে জ্বরও আসছে। গত রাতে বাবাকে সঙ্গ দিতে আপত্তি করায় বাবা ওকে এত মার মেরেছে, উরু ছিঁড়ে রক্ত বেরিয়ে গেছে। চুড়িদারটা তুললেই শরীরের বিভিন্ন জায়গায় শারীরিক নির্যাতনের চিহ্ন চোখে পড়বে। ভোরবেলা বিছানায় শুয়ে-শুয়ে ব্যথায় কোঁকাচ্ছিলো কুহু। এই লজ্জার কথা ও কাউকে বলতে পারে না। ওই মানুষটাকে এখন বাবা বলে ডাকতেও লজ্জা করে। নরকের কীটেরও অধম ওই জানোয়ারটা। কিন্তু বাবার কথার অবাধ্য হলেই, বাবা দিনের পর দিন খেতে দেয় না। বেল্ট দিয়ে বেধড়ক মার মারে। অবলা জন্তুর মতো পড়ে-পড়ে মার খায় ও। পৃথিবীর যত রাগ সব সজল উগড়ে দেয় কুহুর ওপরেই। বাবার কথামতো না চললে স্কুলটাও ছাড়িয়ে দেবে বলেছে। গত কয়েকদিন ধরে সন্ধ্যের পর বাড়িতে কতগুলো লোক আসছে। ওই লোকগুলোও বাবার মতোই আকণ্ঠ মদ খেয়ে থাকে। লোকগুলোর হিংস্র লোলুপ দৃষ্টিকে ভয় পায় কুহু। বাবার অবাধ্য হতেও ভয় পায় ও। বাবা খেতে না দিলে, পড়াশোনা করতে না দিলে, বাড়ি থেকে বের করে দিলে, এতবড় পৃথিবীতে ও একা-একা কোথায় যাবে?! আজ কুহু একটা ফুলহাতা চুড়িদার পরে টিউশনে এসেছে। ওড়না দিয়ে পিঠ-বুক ভালোভাবে ঢেকে রেখেছে। কাল রাতের বেল্টের মারের দগদগে দাগটা যেন কারোর চোখে না পড়ে,তার জন্যই এত লুকোচুরি। হঠাৎই একটা হ্যাঁচকা টানে পাশের মানুষটার অস্তিত্ব সম্পর্কে হুঁশ ফিরলো কুহুর...
-কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমায়? সন্তু?
-আয় এদিকে।
রাস্তার এককোণে দুটো সাইকেল পড়ে রইলো। কুহুর হাত ধরে সীমান্ত ওকে টেনে নিয়ে গিয়ে বসলো লাল সিমেন্টে বাঁধানো ঘাটের ওপর। সামনেই সুবিশাল পুকুর। শ্যাওলা আর কচুরিপানায় গোটা পুকুরটাই সবুজ হয়ে রয়েছে। দূরে একটা গাছের ডাল একেবারে নুইয়ে জলে এসে পড়েছে। কুহুর কাঁধ থেকে ব্যাগটা সিঁড়ির ওপর নামিয়ে রেখে, সীমান্ত ওর পাশে বসে ওকে জিজ্ঞেস করলো,
-তোর কি হয়েছে? আমাকে বল কুহু! দিদি পড়া ধরলে পড়া পারছিস না। আমি ডাকলেও আমার বাড়িতে আসছিস না। প্রায় দিনই স্কুল কামাই করছিস। কাকিমা চলে গিয়ে তোর জীবনের অনেকটা জায়গা ফাঁকা হয়ে গেছে জানি, কিন্তু তাই বলে তুই নিজের জীবন, নিজের পড়াশোনা একেবারে শেষ করে দিলে তো...
নিঃশব্দে কেঁদে উঠলো কুহেলী। এ এমনই লজ্জার কথা, ও কাউকে বলতেও পারে না। গতরাতে বাবার তুমুল শারীরিক অত্যাচারের পর, আজ সকালের পর থেকে রক্তস্রোতে ভেসে যাচ্ছে ওর যোনিপথ। তীব্র যন্ত্রণায় ও ঘরের কাজকর্মও করতে পারছে না। অন্যদিন বাবা ঠিকমতো খেতে দেয় না, মারধর করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কুহুর পেটে খিদের আগুন জ্বলে। আজ সারাটা দিন কিচ্ছু খায়নি কুহু। মাকে মনে করে শুধু কেঁদেই চলেছে। প্রায় দেড় মাস যাবৎ সজল কর্তৃক এইরকম অবর্ণনীয় শারীরিক অত্যাচার সহ্য করার পর, হঠাৎই কুহু একদিন খেয়াল করে দেখলো, নির্দিষ্ট সময়ে মাসিকের দেখা নেই। ভয়ে-ভয়ে বাবাকে সে কথা জানাতেই, বাবা কিসব ওষুধ এনে ওকে খাইয়ে দিয়েছে। তারপরেও গতরাতে নৃশংস সঙ্গমরূপী ধর্ষণের পর, আজ ভোরবেলা থেকে অতিরিক্ত রক্তপাতে প্রায় আধমরা হয়ে গেছে কুহু। দুপুর পর্যন্ত ব্যথায় প্রায় অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলো ও। কিন্তু বিকেলের দিকে ও ঠিক করে, আজ পড়তে যাবেই। বাড়িতে থাকলেই ওই জানোয়ারটা সন্ধ্যের পর বাড়িতে আসবে। আবার জবরদস্তি শুরু করবে। তার চেয়ে বাড়িতে না থাকাই ভালো। যতক্ষণ এই বাড়ির বাইরে থাকা যায়, ততক্ষণই মুক্তি! যদি বাবা মদ খেয়ে এসে আজ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে, তবে আজকের মতো ছাড় পেয়ে যাবে কুহু। সীমান্তর শত প্রশ্নেও কুহু মুখ খুলতে পারলো না। মূক নারীর মতো কেবল কেঁদেই চললো। রাস্তার বড় আলোগুলো জ্বলে গেছে। ওই নরম হলদেটে আলো গাছগাছালি ভেদ করে কুহুর শুকনো মুখের ওপর এসে পড়েছে। ওর দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে সীমান্ত বললো,
-তোর কি হয়েছে? বলবি না আমায়?
তীব্র কান্না আটকাতে না পেরে কুহু সশব্দে কেঁদে বলে ফেললো,
-আমিও মায়ের কাছে চলে যেতে চাই সন্তু। আর বাঁচতে চাই না। মরে যেতে চাই।
-এইরকম বলতে নেই কুহু। তুই এত ভেঙে পড়লে হয়! কাকুকে তো তোকেই দেখতে হবে। তাই না? কাকু তোর জন্য এত পরিশ্রম করে। তোর পড়াশোনা....
-আমি মরে যেতে চাই।
-আর আমাদের বন্ধুত্বটা?
চুপ করে গেলো কুহু।
-আমাদের মধ্যে তো খুব সুন্দর একটা বন্ধুত্ব আছে। সেটাকেও ভুলে যাবি তুই? সব ভুলে গিয়ে মরার কথা বলবি? আমাকেও ভুলে যাবি?
-না!
-তবে?
-আমি আর পারছি না সন্তু।
-কি হয়েছে তোর?
-কিছু হয়নি। মায়ের জন্য কষ্ট হয় খুব।
-তোর জ্বর হয়েছে?
-ওই একটু!
-আমাদের বাড়িতে চল। তোকে দারুণ একটা জিনিস রান্না করে খাওয়াবো। এক্সপেরিমেন্ট করতে করতে সদ্য শিখেছি। মাকেও শিখিয়ে দিয়েছি।
-রান্না করতে তোর এত ভালোলাগে সন্তু?
-দুর্দান্ত লাগে। ছুটির দিনে মাকে ঠেলে সরিয়ে আমি রান্নাঘরে ঢুকে যাই। চল চল, ওঠ!
-আজ না রে। এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। এরপর বাড়ি ঢুকতে দেরি হলে বাবা খুব মারবে। বাবা হয়তো এতক্ষণে বাড়ি এসে ঘুমিয়েও পড়েছে।
-কাকু তোকে মারে নাকি? আগে কোনোদিন বলিসনি তো!
-নানা, ওই আর কি! খুব বকবে। মারে না। উঠি আমি।
-তুই ঠিক বলছিস তো কুহু, তোর কিছু হয়নি?
-সত্যিই রে, কিচ্ছু হয়নি।
-কাল স্কুলে যাবি তো?
-হ্যাঁ।
-কিছু খাবি কুহু?
-মোমো খাওয়াবি সন্তু? আমার খিদে পেয়েছে।
-চল! আগে বলবি তো, তোর খিদে পেয়েছে!
প্যাডেল করতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো কুহুর। তলপেটে বড় ব্যথা। কোমরের ব্যথায় পা দুটো একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে। অন্ধকারের মধ্যে দিয়েই সাইকেল হাঁটিয়ে ওরা এগিয়ে গেলো বড় রাস্তার দিকে...
(চলবে.....)
ছবি : সংগৃহীত