মুহূর্তেরা বন্দী
সাথী দাস
চতুর্থ পর্ব
-কি বললেন আপনি? ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড! আপনি জানেন আপনি কাকে কি বলছেন? কার সম্পর্কে কি বলছেন? আপনি চেনেন ওনাকে?
একটু আগেও একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে সোফাতে বসেছিলো উজ্জয়িনী। এখন ঘুরে-ঘুরে থোকা-থোকা করে সাজানো লাল বেলুনগুলো দেখছিল। উজ্জয়িনীকে একবার ভালো করে দেখে ম্যানেজার বললেন,
-না স্যার! আমি ওনাকে চিনি না। চেনার দরকারও নেই। উনি আমাদের একজন সম্মানীয় অতিথি, ওটাই ওনার একমাত্র পরিচয়। কিন্তু কলাম ফাঁকা রাখা যাবে না। কিছু লিখতেই হবে। ওনাকেও চেক ইন টাইম লিখে সই করতেই হবে।
-আপনার সাহস তো কম না। আপনি আমাকে শাসাচ্ছেন? আমাকে অর্ডার করছেন আপনি?
-না স্যার! রিকুয়েস্ট করছি। প্লিজ!
-দেখুন উনি অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। শি ইজ হাংরি! আমাদের দুজনের ব্রেকফাস্ট রুমে পাঠান। আর এক্ষুণি আমার রুমের চাবি দিন। আমি সই করে দিয়েছি।
-স্যার আপনি কি বলছেন, আপনি জানেন? একটা জলজ্যান্ত গোটা মানুষ এই হোটেলে থাকবেন, খাবেন, আর তার কোনো রেকর্ডই থাকবে না! কেউ জানতে চাইলে....
-কেউ জানতে চাইবে না। আমি ছাড়া আর কেউ জানবে না উনি এভাবে আমার সঙ্গে রুম শেয়ার করছেন। এসব বাইরে জানাজানি হলে ওনার ইমেজ নষ্ট হবে। আপনি না চিনলে কি হবে, মিডিয়ায় উনি একজন পরিচিত মুখ। আপনার মাথায় কি আছে বলুন তো? পাপা তো আমার কাছে মাই ডিয়ার! আমি তাকেই জানাতে বারণ করছি, আর অন্য যে কেউ জানতে জানলে আমি তাকে বলে দেবো?
-ইচ্ছাকৃতভাবে না হোক, চাপে পড়লে অনেক কিছু বলতে হয় স্যার! আপনার বয়স অনেক কম। অভিজ্ঞতাও কম। আমার ওয়ার্ক এক্সপিরিয়েন্স কিন্তু অন্য কথা বলছে। উনি এখানে এসেছেন, আমাদের পক্ষ থেকে আতিথেয়তার কোনো ত্রুটি হবে না। উনি থাকবেন, আনন্দ করবেন, ছবি তুলবেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টও করবেন। সব ঠিক আছে। কিন্তু এরপর উনি চেক আউটের পর যদি ভগবান না করুন রাস্তাঘাটে কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়, বা উনি মার্ডার হয়ে যান, তখন ওনার ছবিগুলো দেখে সবার আগে পুলিশ এসে হোটেল কর্তৃপক্ষকেই চেপে ধরবে স্যার। আমরা তখন পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দেবো ওনার চেক ইন আর চেক আউটের টাইম, সঙ্গে সিসিটিভি ফুটেজ। ব্যাস আমাদের দায় শেষ। উনি হোটেলের বাইরে পা রাখার পর ওনার সঙ্গে যা খুশি হোক, আমাদের আর জানার দরকার নেই। এই কারণেই তো রেকর্ড রাখা হয় স্যার। আমি এই ধরনের কেস আগে ডিল করেছি। কোনোরকম ঝামেলা হলে হোটেলের ম্যানেজার বলে, পুলিশ সবার আগে আমার জামার কলার টেনে ধরবে। তারপর একে-একে আপনি, বস! আমি আপনাকে অর্ডার করছি না স্যার। আমি শুধু রিকুয়েস্ট করছি, আর সেই সঙ্গে আমার ডিউটি করছি! যার জন্য আপনারা আমাকে মাস গেলে মোটা টাকা দেন। এই হোটেলের, বসের, আপনার সিকিউরিটি আমার দায়িত্ব। ওনাকে সই করতেই হবে।
-দেখুন, আজ এখানে একটা প্রোগ্রাম আছে। আমার সঙ্গে একজন গেস্ট রয়েছেন। আপনার কথাবার্তা শুনে আমার মাথায় আগুন জ্বলছে! অহেতুক ঝামেলা বাড়াবেন না। চাবি দিন!
-তাহলে আগে আপনার পাপাকে একটা ফোন করুন!
-হোয়াট! পাপাকে কি বলবো আমি?
ঝামেলা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় সৌজন্যর গলার স্বর সপ্তমে চড়ছিল। চমকে উঠে সুবিশাল হলের অন্যপ্রান্ত থেকে উজ্জয়িনী ফিরে চাইলো। রিসেপশনিস্ট মেয়েটি ম্যানেজারের দিকে চেয়ে গলা খাদে নামিয়ে বললো,
-নিলয়দা, ছেড়ে দিন না! উনি আমাদের স্যার....ওনাকে এত কথা....
-না উনি ভুল করছেন। কি বয়স ওনার? ব্যবসার তেমন কিছু বোঝেন উনি? ওনার গেস্ট, ওনার পার্সোনাল স্পেস, উনি কিভাবে সময় কাটাবেন সেটা ওনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। উনি কোনো রেকর্ড রাখবেন না সেটাও ঠিক আছে। কিন্তু ওপরতলার কাউকে তো জানিয়ে রাখুক। ওনার পাপাকে অন্তত বিষয়টা একটু বলুক। পাপাকে সব খুলে বলতে না পারলে, বন্ধুর সঙ্গে আছে বলুক। পরিচিত কারোর সঙ্গে আছে বলুক। কিছু একটু বলে রাখুক। তাতে আমার পিঠটা বাঁচে! এটা আমার ওয়ার্কপ্লেস, আমার ওয়ার্কিং আওয়ার। এর মধ্যে হোটেলের রুমের ভিতর কিছু হলে, পুরো চাপটা আমার একার ওপর এসে পড়বে। চাকরী বাঁচানো পরের কথা, এসব কেসে জীবন নিয়ে টানাটানি হয়, মান-সম্মান খুইয়ে জেলের ভাত খেয়ে আসতে হয়, তুই জানিস সেসব! আমার একটা পরিবার আছে। বাড়িতে ছোট একটা বাচ্চা আছে। আমি ফেঁসে গেলে, এসব হ্যাপা কে সামলাবে? তুই চুপ করে থাক একদম!
সাংঘাতিক ধমক খেয়ে চুপ করে গেল অল্পবয়সী মেয়েটি। সৌজন্য আর সামলাতে পারলো না নিজেকে। ধমকে উঠলো,
-ইউ আর ফায়ার্ড!
চোখ নামিয়ে নিলয় বললো,
-সরি স্যার! আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে আপনার পাপার সই ছিলো। উনি আমার কোয়ালিফিকেশন, প্রিভিয়াস ওয়ার্ক এক্সপিরিয়েন্স, ডেডিকেশন, বিশ্বাসযোগ্যতা দেখেই আমাকে অ্যাপয়েন্ট করেছেন। উনি নিজে টার্মিনেশন লেটার না দিলে তো, শুধুমাত্র আপনার কথায় কিছু হবে না। আমি বসকে ফোন করছি। উনি বললে আমি নিজেই রিজাইন...
-এই না! পাপাকে কি বলবেন আপনি?
-সৌজন্য!!
রিসেপশনের সকলে একসঙ্গে উজ্জয়িনীর দিকে ফিরলো। যাকে নিয়ে এত গন্ডগোলের সূত্রপাত, সে হঠাৎ করেই মাঝে এসে পড়ায়, ফোন থেকে হাত সরিয়ে ফেললো নিলয়। সৌজন্য একলাফে সরে এসে উজ্জয়িনীর দুটো হাত ধরে বললো,
-ম্যাম প্লিজ আপনি একটু ওদিকে যান!
-কি হয়েছে? তুমি চেঁচাচ্ছ কেন?
-কিছু না ম্যাম। আপনি প্লিজ এসব কিছু শুনবেন না। একটু ওদিকে যান প্লিজ!
-আমাকে নিয়ে কি কোনো সমস্যা? তাহলে বলো আমাকে?
-ম্যাম প্লিজ! আচ্ছা আমি চিৎকার করবো না। প্রমিস! কিন্তু আপনি প্লিজ একটু ওদিকটায় যান। প্লিজ গিভ মি সাম প্রাইভেট স্পেস!
-শিওর...বাট...
-ম্যাম সব ঠিক আছে। আমারই ফল্ট! আমি সামলে নিচ্ছি সব। আপনি প্লিজ একটু লন থেকে ঘুরে আসুন!
রিসেপশনে সবার মুখের দিকে একবার চাইলো উজ্জয়িনী। ঝামেলাটা যে ওকে নিয়েই, তাতে ওর বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইলো না আর। কিন্তু সৌজন্য এমনভাবে ওকে এখান থেকে সরাতে চাইছে, আর ওর পক্ষে ওখানে থাকা সম্ভব না। একটু বিরক্ত হলো উজ্জয়িনী। এর চেয়ে না এলেই মনে হয় ভালো হতো। নিজের মতো করে একটু সময় কাটানো যেত! হঠাৎ করে কেন যে রাজি হতে গেলো! মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ এঁকে হল থেকে বেরিয়ে লনের দিকে চলে গেলো উজ্জয়িনী। সৌজন্য আবার রিসেপশনে ফিরে শান্ত স্বরে নিলয়কে বললো,
-ওকে! তার সামনে যাচ্ছেতাই একটা ব্যাপার হয়ে গেলো। আমার আর কিছু বলার নেই। এবার আপনি বলুন, কি করলে আপনি চাবি দেবেন? সত্যিই ওনার পক্ষে এভাবে আমার সঙ্গে নিজের নাম জুড়ে কোনো রেকর্ড রাখা সম্ভব না। আমি তাকে বলতেও পারি না। আলাদা রুম হলে উনি অবশ্যই সই করতেন। কিন্তু একসঙ্গে এভাবে পারবেন না। এসব কোনোভাবে বাইরে এলে, ওনার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠবে! আমি না হয় টাকা দিয়ে সবার মুখ বন্ধ করে দেব। এক মুহূর্তে সবকিছু থেকে নিজেকে বের করে ফেলবো। কিন্তু ওনার গায়ে কাদা ছিটবে। সেটা আমি হতে দিতে পারি না। আর আমার পক্ষে পাপাকে যে এসব জানানো সম্ভব না, সেটা নিশ্চয়ই আপনাকে বলে বোঝাতে হবে না। সো প্লিজ....
নিরুত্তর নিলয়...সৌজন্য আবার বলতে শুরু করলো,
-ফাইন! আমি আপনার স্যার হিসেবে অর্ডার করছি না। আপনার ছোট ভাই হিসেবে অনুরোধ করছি নিলয়দা। প্লিজ, এটা আমার সম্মানের ব্যাপার। আমি ওনাকে ইনভাইট করেছি। আমার কপাল ভালো উনি নিজেই খোলা মনে সমস্যাটার এত সহজ একটা সমাধান বের করেছেন। নইলে আমি কি করতাম জানি না। বিকল্প কিছু? প্লিজ নিলয়দা। অন্তত আমার মুখের দিকে চেয়ে একটা সুস্থ মধ্যস্থতায় আসুন...
নিলয় চেয়ে রইলো সৌজন্যর মুখের দিকে। সৌজন্যর অসহায়তাটা যেন উপলব্ধি করতে পারলো ও। একটা রাইটিং প্যাড এগিয়ে দিয়ে বললো,
-হোটেলে একজন মধ্যবয়স্কা নারী আপনার সঙ্গে আপনার রুমেই থাকছেন। এই হোটেলে থাকাকালীন তার সব দায়িত্ব আপনার। তার কিছু হলে সব দায় আপনার একার। আপনি নিজেই তার গ্যারেন্টার! ব্ল্যাংক পেপারে এটা লিখে সই করুন। আজকের তারিখ আর চেক ইনের সময়টাও লিখে দেবেন। ওনার নাম লিখতে হবে না। ওনার পরিচয় গোপনই থাক। কোনো রেকর্ড রাখতে হবে না। আপনি একটা সই করে দিন। এটা আমার কাছেই থাকবে। আপনারা যেদিন চেক আউট করবেন, এটা আপনাকে ফেরত দিয়ে দেব, যাওয়ার আগে নিজের হাতে ছিঁড়ে ফেলবেন! বস কিছু জানবে না!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে খসখস করে লিখতে শুরু করলো সৌজন্য। নিলয়ের কথামতো সবটা লিখে সই করে দিলো। ফরফর করে কাগজটা ছিঁড়ে নিলয়ের হাতে দিয়ে বললো,
-ধরুন! পাপা বুঝেশুনেই অ্যাপয়েন্ট করেছে! নিয়মের ফাঁক দিয়ে কেউ গলে পালাতে পারবে না! এমনকি তার নিজের ছেলেও না! উফ!!
হাড় জ্বালানো মুচকি হাসি হেসে, কাগজটা ভাঁজ করে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে ফেললো নিলয়। তারপর বললো,
-এটা কিন্তু আপনি এখন রাগ করে, মনে-মনে আমাকে খুব করে গাল দিয়েই বলছেন! তবে আমি এটাকে কমপ্লিমেন্ট হিসেবেই নেবো! থ্যাঙ্কু স্যার!
নিলয় রুমের চাবিটা একজন কর্মচারীর হাতে ধরিয়ে দিলো,
-স্যার আর ম্যাডামের লাগেজ রুমে পৌঁছে দাও।
নিশ্চিন্ত হয়ে সৌজন্য বললো,
-থ্যাঙ্কু! পাঁচ মিনিট! জাস্ট পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দুজনের ব্রেকফাস্ট আমার রুমে পৌঁছনো চাই! আর কোনো কথা নয়।
-শিওর স্যার!
সৌজন্য আর দাঁড়ালো না। সোজা দৌড় মারলো লনের দিকে। নিলয় মৃদু হেসে মজা করে সৌজন্যকে নকল করে ওখানে উপস্থিত সকলকে বললো,
-শুনলে তো? পাঁচ মিনিট! জাস্ট পাঁচ মিনিটে দুজনের ব্রেকফাস্ট ওনার রুমে পৌঁছনো চাই!
-আপনি পারেন বটে নিলয়দা! আমরা ওনাকে দেখলেই ভয়ে কাঁপি! আপনি তো বসের ছেলেকেও ধুয়ে রোদে শুকিয়ে ইস্ত্রি করে একেবারে হ্যাঙারে ঝুলিয়ে দিলেন!
হেসে নিলয় বললো,
-আগে কোনোদিন ওনার সঙ্গে এভাবে কথা বলার প্রয়োজন হয়নি, বলিনি। উনি অন্যায় আবদার করছিলেন। তাই আজ দরকার ছিলো। নইলে ভালোমন্দ কিছু হলে ওনার পাপা আমার কাছেই কৈফিয়ৎ চাইবেন। তখন ওনার পাপাকে কি জবাব দিতাম! নে-নে! পাঁচ মিনিট! অলরেডি এক মিনিট দাঁত বের করে কাটিয়ে দিলি তোরা....এভরিবডি! ব্যাক টু ওয়ার্ক! যার পেটে যত গ্যাস আছে, সব আজ ফুঁ দিয়ে বেলুনে ভরে দাও! রাতে পার্টির পর গলা পর্যন্ত মদ গিলে, সব বেলুন আমি একাই ফাটাবো! তারপর সুগন্ধে অজ্ঞান হয়ে সারারাত উল্টে পড়ে থাকবো!
নিলয়ের হালকা রসিকতায় হাসির ফোয়ারা উঠলো রয় গেস্ট হাউজের সকল কর্মীদের মধ্যে....
লন পেরিয়ে হোটেলের একটু পিছন দিকে গেলেই হুগলী নদীর দেখা মেলে। দূর থেকে নদীর দিকেই চেয়েছিলো উজ্জয়িনী। ভাবছিল নিজের জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। কি ছিলো জীবনটা! আর কোথায় কিভাবে এসে পড়লো ও!! এখানে তো ওর থাকার কথাও ছিল না। নিজের অতীত ভাবলেই গাল বেয়ে নেমে আসে লবণাক্ত জলের ধারা। এই গালেই বাবা সেদিন চড়টা মেরেছিলো না?! সবার সব কথা শুনে নেওয়া যায়। কিন্তু বাবার গায়ে হাত তোলাটা আজও যেন মেনে নেওয়া যায় না। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারে না উজ্জয়িনী। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কেঁদে ফেললো....
-ম্যাম আপনি এদিকে চলে এসেছেন? আমি আপনাকে সারা লন খুঁজে মরছি!
সৌজন্যর ডাকে হুঁশ ফেরে উজ্জয়িনীর। পিছন ঘুরেই চোখ মুছে রোদ চশমাটা তাড়াতাড়ি চোখে পরে নিলো ও। তারপর সৌজন্যর দিকে ফিরে বললো,
-হ্যাঁ এই একটু ঘুরতে ঘুরতে এদিকটায় চলে এলাম। জায়গাটা কি শান্ত, নিরিবিলি! দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছিলো।
-আচ্ছা আগে ব্রেকফাস্ট করে নিন। তারপর বেড়াবেন। আপনি অনেকক্ষণ আগে বলেছিলেন খিদে পেয়েছে। প্লিজ রুমে আসুন!
-তোমাদের ঝামেলা মিটলো?
-তেমন কিছু না ম্যাম। সব মিটে গেছে!
-কি ব্যাপার? আমাকে নিয়েই ঝামেলা তো? আমাকে বলা যাবে?
-একদমই বলা যাবে না। ওসব বাদ দিন। আপনি আসুন!
সৌজন্যর সঙ্গে বকতে-বকতে লন পেরিয়ে, হল পেরিয়ে লিফটে উঠলো উজ্জয়িনী। রুমে পৌঁছেই উজ্জয়িনী দেখলো, ঘরের এককোণে কয়েক জোড়া জুতো রাখার মতো ছোট একটা শো-কেস, দেওয়ালে টিভি, ড্রিঙ্কস রাখার জন্য মিনি ফ্রিজ, আর একটা টেবিলের ওপর কফি মেকার আর দুটো কফি মগ, আর কয়েকটা কাঁচের গ্লাস রয়েছে। টেবিলের পাশে দুটো বেতের চেয়ার। একটা দেওয়াল আঁটা ওয়ার্ডরোবের সঙ্গে বড় আয়না লাগানো রয়েছে। ঘরে একটামাত্র বিছানা। ধপধপে সাদা চাদরের ওপর দুটো বালিশ সাজানো রয়েছে। গোটা ঘরে একটা সোফা পর্যন্ত নেই। বিছানার ওপর নিজের হ্যান্ডব্যাগটা রাখলো উজ্জয়িনী। ওরা রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করার অবকাশটুকুও পেলো না। তার আগেই হাজির হয়ে গেলো ব্রেকফাস্ট। খাবারের ট্রলিটা টেনে রুমের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলো সৌজন্য। তারপর বললো,
-ম্যাম! আমি বাইরে যাবো? আপনি কি আগে চেঞ্জ করবেন? নাকি আগে খেয়ে নেওয়া যাক? আমার প্রচন্ড খিদে পেয়েছে!
-আমারও!
-ওকে! আমি সার্ভ করে দিচ্ছি। আপনি হাত ধুয়ে ঝটপট চলে আসুন।
নিজে তড়িঘড়ি হাত ধুয়ে একটা বেতের চেয়ার টেনে নিয়ে, নিজের কাজে বসে পড়লো সৌজন্য। ওর এই তৎপরতায় বেশ মজা লাগলো উজ্জয়িনীর। বহুদিন হয়ে গেছে ওকে হাতে ধরে এভাবে সামনে বসিয়ে, একটু ভালোবেসে কেউ খেতে দেয়নি। মা রান্না করলেও, ও নিজে নিয়ে খায়। নিজে রান্না করলেও, নিজেই নিয়ে খায়। কি খায়, কতটা খায়, নিজে নিয়ে খেলে পেট ভরে কিনা, ও নিজেও জানে না। বাঁচতে গেলে খেতে হয়, তাই খায়। আজকাল তো খাওয়ার সময়টুকু ছাড়া নিজের ঘর থেকে বেরও হয় না উজ্জয়িনী। তাতেও কথা থেকে নিস্তার নেই। খেতে বসে মায়ের মুখ থেকে এতরকম কথা শোনে, বিষিয়ে যায় মুখের সামনের খাবারটুকু। কোনোরকমে গিলে টেবিল থেকে উঠে যায় ও। বহুদিন পর এত যত্ন করে কেউ নিজের হাতে ওকে খাবার বেড়ে খেতে দিচ্ছে। তাও ওর জন্য এটুকু করতে পেরে, সেই মানুষটা মন থেকে কত আনন্দ পাচ্ছে! সৌজন্যর চঞ্চলতা, চটপটে সারল্য বড় মুগ্ধ করলো উজ্জয়িনীকে। কিছুক্ষণ আগেই সৌজন্য দরজাটা বন্ধ করে রুমের এসিটা চালিয়ে দিয়েছে। ঘরটা বেশ ঠান্ডা হয়ে আছে। হাত ধুয়ে বিছানার এককোণে এসে বসলো উজ্জয়িনী। ব্রেড, টোস্ট, বয়েলড এগ, ফ্রুট জুস, কাঁচের গ্লাসে রাখা দুধ, আর কেটে বিটনুন আর গোলমরিচ ছড়িয়ে দেওয়া কয়েক টুকরো আপেল সুন্দরভাবে টেবিলে সাজিয়ে রেখেছে সৌজন্য। উজ্জয়িনী এসে বসতেই ওর দিকে ছোট টেবিলটা এগিয়ে দিয়ে হাসিমুখে সৌজন্য বললো,
-অ্যাট ইয়োর সার্ভিস ম্যাম!
হেসে ফেললো উজ্জয়িনী।
-বসো। তুমিও শুরু করো।
-এই তো এক্ষুণি শুরু করবো। খিদের চোটে পেটের মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ চলছে!
এক টুকরো ব্রেডে কামড় বসাতেই সৌজন্যর ফোনটা বেজে উঠলো সশব্দে। ফোন বের করেই ও বললো,
-এই রে! ফাদার ইন্ডিয়া! পৌঁছে ফোন করতে ভুলে গেছি। এবার চেঁচাবে। ম্যাম?
-হুম?
-পাপার ফোন ধরছি। প্লিজ আপনি কথা বলবেন না। মানে পাপা জানে না তো....
-ধরো-ধরো! আমার মুখ সেলাই...এই চুপ করে খেতে পারবো তো?
হাসিমুখে সম্মতি দিয়ে খেতে খেতেই ফোন ধরলো সৌজন্য,
-আরে এই তো পৌঁছলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম রিসোর্টে। বেরোতেই দেরি হয়ে গেছে। জাস্ট তোমাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম, তখনই তুমিও ফোন করলে। হ্যাঁ... হ্যাঁ... সব ঠিক আছে। তুমি যা জাঁদরেল ম্যানেজার রেখেছো, ঠিক ছাড়া বেঠিক কিছু হতে দেবে নাকি! হ্যাঁ আমি সব দেখেশুনে রাখবো। পাপা তুমি এত টেনশন কোরো না।নিজের শরীরের খেয়াল রাখো। মাকে দেখে রাখো। বাই... বাই...খাচ্ছি আমি। রাখছি! হ্যাঁ রাতে ফোন করে সব রিপোর্ট দেবো। বাই...
ফোন রেখে সৌজন্য বললো,
-ম্যাম, আমি এখন কয়েক ঘন্টা একটু ব্যস্ত থাকবো। নীচে সুপারভাইজ করতে ছুটতে হবে। ফোনে প্রতি মুহুর্তের আপডেট না দিলে, পাপা ওখানে বসে বসেই টেনশনে প্রেশার বাড়িয়ে ফেলবে। তবে ফাঁক পেলেই রুমে এসে আপনাকে টাইম দিয়ে যাবো। বা আপনি চাইলে, আমার সঙ্গেই পুরো সময়টা থাকতে পারেন। এদিক ওদিক ঘুরতে পারেন। ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি, একটু এদিক ওদিক ঘুরে আসুন না হয়। যেটা আপনার মন চাইবে, আপনি সেটাই করুন ম্যাম। এটা আপনারই বাড়ি। আচ্ছা একটা ব্যাপার! আপনাকে তো আমি হঠাৎ করেই এখানে নিয়ে এলাম। পার্টির কোনো প্ল্যান ছিলো না নিশ্চয়ই...
-আমার এই ট্রিপটারই কোনো প্ল্যান ছিলো না সৌজন্য। এটাও হঠাৎ করে হয়ে গেছে।
-ভালোই হয়েছে। বেশ হয়েছে। হঠাৎ করে ট্রিপটা হয়ে গেছে বলেই তো, আমরা এত সুন্দর একটা মুহূর্ত কাটাচ্ছি। জীবনে হঠাৎ-হঠাৎ কিছু হয়ে যাওয়া ভালো, বুঝলেন তো ম্যাম! ভালোভাবে বাঁচার জন্য খুব বেশি প্ল্যান করলে দেখবেন, ভালোভাবে তো দূরের কথা, আপনি বাঁচতেই ভুলে গেছেন। এত প্ল্যান করে কিছু হয় না। বেরিয়ে পড়বেন এইরকম হুটহাট করে। নইলে আমাদের হোটেলগুলো চলবে কি করে?
-টিপিক্যাল বিজনেসম্যান!
হেসে ফেলে ফ্রুট জুসের গ্লাসে ঠোঁট ঠেকালো উজ্জয়িনী।
-হ্যাঁ ম্যাম যেটা বলছিলাম, সন্ধ্যেবেলা পরার মতো পার্টিওয়্যার আছে তো আপনার? নাকি সব ক্যাজুয়াল ওয়্যার? আপনি চাইলে আমরা কিন্তু একফাঁকে একটু শপিংও করে আসতে পারি!
-আমার সঙ্গে এখন যা আছে, আমি তাই পরবো সৌজন্য। অতিরিক্ত পোশাক-প্রসাধনের শৃঙ্খল আজকাল আর ভালো লাগছে না।
-ওকে ম্যাম! আমার ব্রেকফাস্ট ডান। আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। নীচে রুম সার্ভিসকে বলে দিচ্ছি, ওরা এগুলো নিয়ে যাবে। আপনি চাইলে চেঞ্জ করুন, ওপরে থাকুন, নীচে আসুন, নদীর পাড়ে যান। যা খুশি করুন। আপনি নীচে না নামলে আমি আধঘন্টার মধ্যেই আবার ওপরে আসছি। আপনার সঙ্গে এখনও অনেক গল্প করা, আড্ডা দেওয়া বাকি আছে।
-হুম!
-বেরোলাম ম্যাম। ডোর লক করে রাখুন। কেউ বেল বাজালে খুলবেন।
সৌজন্য বেরিয়ে গেলে নিজের খাওয়াটা আস্তে-ধীরে শেষ করলো উজ্জয়িনী। তারপর হাত ধুয়ে ফোন হাতে নিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। জামাটাও ওর আর বদলাতে ইচ্ছে করলো না। মাকে একটা ফোন করলো। তারপর মাম্মামকে। মাম্মামের সঙ্গে কথা হলো না ঠিকই, তবে ওর প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা হলো। ওখানে ভালোই আছে মাম্মাম। অনেক নতুন নতুন বন্ধু হয়েছে। পড়াশোনাও মন দিয়ে করছে। সারাদিনই ভালো থাকে। শুধু রাতে ঘুমানোর সময় নাকি শুধু উজ্জয়িনীর কোল হাতড়ে বেড়ায়। এটুকু শুনেই কান্না পেয়ে গেলো উজ্জয়িনীর। ও আর একটা-দুটো কথা বলেই রেখে দিলো ফোনটা। বেল বাজছে। রুম সার্ভিস থেকেই হয়তো। ভালো করে চোখ মুছে উঠে দরজা খুলে দিলো উজ্জয়িনী। খাবারের ট্রলিটা নিয়ে যাবার সময় উনি জিজ্ঞেস করলেন, লন্ড্রির কোনো জামাকাপড় আছে কিনা! না বলে তাকে বিদায় জানালো উজ্জয়িনী। তারপর আবার গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ফোনটা আবার বেজে উঠতেই বেজায় বিরক্ত হলো ও। প্রকাশকের ফোন....
-হ্যালো!
-ম্যাডাম বলছিলাম কি....
-বলবেন না। আগামী দু-তিনদিন আমি একটু ব্যস্ত আছি। এর মধ্যে কিছু বলবেন না। আমি শহরের বাইরে আছি। ফিরে আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবো। কেমন? রাখছি!
ফোন রেখেই উজ্জয়িনী আগে হোয়্যাটসঅ্যাপের ব্লু-টিক অফ করলো। তারপর ফেসবুক আনইন্সটল করতে গিয়েই মনে পড়লো শৌনকের কথা। গতকাল সন্ধ্যে থেকে নানান ব্যস্ততায় ওর ছবি একবারও দেখা হয়নি। এখনও তো আর সেভাবে দেখতে ইচ্ছে করছে না। এমন নয় যে, না দেখলে থাকতেই পারছে না, এক্ষুণি চোখের সামনে ওর ছবি চাই, মন থেকে এমন কিছু অনুভব হচ্ছে না তো! শৌনকের প্রোফাইলে আর ঢুকলো না উজ্জয়িনী। সেই টানটা, সেই মায়াটা কি তবে একটু হলেও কমলো? নাকি কষ্টটা কমলো? গত দুমাস ধরে মৃত্যুর মতো মানসিক যন্ত্রণার সঙ্গে একাই যুঝছিলো উজ্জয়িনী। হঠাৎ করে সেই যন্ত্রণাটা কমে গেলো কি করে? সাতপাঁচ ভাবতে-ভাবতে ফেসবুকে ঢুকে সৌজন্যর প্রোফাইল থেকে উজ্জয়িনী একবার ঘুরে এলো। কাল রাতেও একবার দেখে এসেছে। সৌজন্যর গুটিকয় ছবি ছাড়া আর কিছুই নেই। আট বছর আগের প্রোফাইল। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকটা মাত্র ছবি রয়েছে।
রিলেশনশিপ স্টেটাস সিঙ্গেল। এত বড়মাপের একজন মানুষ, অথচ প্রোফাইলে বিশেষ কিচ্ছু নেই। হয়তো তেমনভাবে অ্যাকটিভ না। বা হয়তো ওর বাকি পোস্টগুলো পাবলিক করা নেই। তাই উজ্জয়িনীকে দেখাচ্ছে না। সৌজন্যকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাতে গিয়েও, আঙুল সরিয়ে নিলো উজ্জয়িনী। কোনোদিনও কাউকে এভাবে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠায়নি ও। এমনিতেই তো ওকে সৌজন্য অফিসিয়াল পেজে আর প্রোফাইলে ফলো করে রেখেছে। থাক! ফলোয়ার হয়েই দূরে থাক। বন্ধুবৃত্তে ঢোকালে আজীবনের জন্য চোখের সামনে থেকে যাবে। ওর নামের পাশে সবুজ আলো জ্বলবে। কি দরকার ওসবের? দুদিন পর যে যার রাস্তায় চলে যাবে। সব শেষ! ভাবতে-ভাবতে মাথাটা ভারী হয়ে গেলো উজ্জয়িনীর। এতকিছু যে ও কেন ভাবছে, সেটার উত্তরও ভেবে পাচ্ছে না। নিজের ফেসবুকের সার্চ লিস্ট দেখে হঠাৎ করেই চমকে উঠলো উজ্জয়িনী। এতদিন যাবৎ ওর সার্চ লিস্টের প্রথম নাম থাকতো, শৌনক চট্টোপাধ্যায়। আর আজ শৌনকের মাথার ওপর বসে রয়েছে সৌজন্য রায়। এসব মেসেজ, ইনবক্স, সত্যি বড্ড ঝামেলার বিষয়। তার চেয়ে এই বেড়াতে আসা, কিছুটা মুহূর্ত একসঙ্গে কাটানো, তারপর হারিয়ে যাওয়া ঢের ভালো। নেহাৎ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এখন সেল্ফ-প্রোমোশনের একটা বড় জায়গা, তাই নিজের কাজের জন্য একপ্রকার বাধ্য হয়ে উজ্জয়িনীকে এখানে থাকতেই হয়। কিন্তু কদিনের জন্য তো এই অন্তর্জাল থেকে নিজেকে মুক্তি দেওয়াই যায়। তাড়াতাড়ি করে ফেসবুক আনইন্সটল করে ফেললো উজ্জয়িনী। এই কটাদিন ও একদম একা থাকতে চায়। মুহূর্তগুলোকে নিজের মতো করে, প্রাণ দিয়ে উপভোগ করতে চায়। মন চাইলে সৌজন্য নীচে যেতে বলেছিলো। নাহলে আবার আধঘন্টা পর ছেলেটা কাজকর্ম সব ফেলে ওকে সময় দেওয়ার জন্য ওপরে চলে আসবে। তার চেয়ে নীচে যাওয়াই ভালো। ওর সঙ্গ উজ্জয়িনীর বড় ভালো লাগে। ছেলেটা কি সুন্দর তরতর করে দৌড়োয়! কলকল করে কথা বলে! মনে কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই। জীবনে কোন জটিলতা নেই। জীবনে কোন কিছুর অভাবও নেই। কোনো স্ট্রাগল নেই। ঝরঝরে বুদ্ধিদীপ্ত একজন যুবক। কিন্তু ওই ছেলের চোখদুটো অমন কেন? ওপরে যতই ছটফট করে ঘুরে বেড়াক, উজ্জয়িনীর চোখকে তো ও ফাঁকি দিতে পারবে না। অনেক অব্যক্ত যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে, ওই দুটো চোখেই। কোনোদিন কি সৌজন্য সেই যন্ত্রণার কথা বলবে উজ্জয়িনীকে? কেন বলবে? আর উজ্জয়িনী জানতে চাইবেই বা কেন? সে তো নিজের বই পড়া, কফি খাওয়া, সামান্য কিছু আবদার, আড্ডা আর আতিথেয়তার বাইরে একটাও বাড়তি কথা উজ্জয়িনীর কাছে জানতে চায়নি। নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে, উজ্জয়িনীকে উপযুক্ত সম্মান দিয়েই, একসঙ্গে কয়েক মুহূর্ত বেড়ানোর আনন্দটা, সে উপভোগ করতে চায় মাত্র। সৌজন্য শুধুমাত্র উজ্জয়িনীর সান্নিধ্য চায়। উজ্জয়িনীর মতো আলোর বৃত্তে অবস্থিত একজন ভাবুক-আবেগী মানুষের সঙ্গে, একটু ভালো সময় কাটানোটা ওর কাছে যে সারাজীবনের সুন্দর স্মৃতি হবে, সেই স্মৃতিটুকুই চায় সৌজন্য। ওই কারণেই বারবার বলে, আমি আপনার অগণিত পাঠকের ভিড়ে হারিয়ে যেতে রাজি নই ম্যাম! মৃদু হেসে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো উজ্জয়িনী। নীচে যাওয়ার আগে চোখ থেকে চশমাটা খুলে আরও একবার দাঁড়ালো আয়নার সামনে....
সারাটাদিন ধরে হুড়োহুড়ি, খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, বেলুন ফাটানো, নদীর ধারে চরে বেড়ানো, নৌকাবিহার, মন খুলে গল্পগুজব শেষে সন্ধ্যেবেলা নিজেদের রুমে তৈরি হচ্ছিলো উজ্জয়িনী। ট্রলি থেকে নিজের জামাকাপড় বের করে নিয়ে, সৌজন্য অনেকক্ষণ আগেই উজ্জয়িনীর জন্য ঘর ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ও নীচে স্টাফরুমেই তৈরি হয়ে নেবে বললো। এদিকে উজ্জয়িনী তৈরি হয়ে বসেছিলো বিছানার ওপর। একটা ফুলহাতা পোশাকে নিজেকে আপাদমস্তক ঢেকে নিয়েছে সে। এটাও পালিয়ে আসার আগে শপিং মল থেকেই কেনা। তখন হাতের সামনে যা পেয়েছে, সব উঠিয়ে নিয়েছিল উজ্জয়িনী। আজ পরে দেখলো, বেশ ভালোই লাগছে দেখতে। খুব হালকা সাজে নিজেকে সাজালো রাখলো উজ্জয়িনী। নিজেকে আজ খানিকটা এলোমেলো রাখতেই মন চাইলো ওর। বেল বাজতেই উঠে দরজা খুলে দেখলো সৌজন্য পরিপাটি হয়ে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঘন নীল ব্লেজারটা দুর্দান্ত মানিয়েছে ওকে। উজ্জয়িনী দরজা খুলেই বলে উঠলো,
-আরে তোমাকে দারুণ লাগছে সৌজন্য!
-থ্যাঙ্কু ম্যাম। থ্যাঙ্কু! আপনাকেও খুব সুন্দর লাগছে। রেডি?
-একদম! এই সৌজন্য, তোমার গা থেকে ক্রিমের গন্ধ বেরোচ্ছে কেন?
-এখনও বেরোচ্ছে? বডি স্প্রে মেরে ফাঁকা করে দিলাম যে, তাও বেরোচ্ছে?
-কি করছিলে তুমি?
-আরে কেকটা সাজাতে ওদের একটু হেল্প করছিলাম।
-হোটেলের কেক?
-নানা। ম্যাম একটু ওয়াশরুম ইউজ করছি।
-হ্যাঁ যাও!
মুখচোখ ভালো করে ধুয়ে এসে নিজের ট্রলি খুলে বসলো সৌজন্য। উজ্জয়িনী দেখলো, অগোছালো জামাকাপড়ের ওপর দুটো ইংরেজি বইয়ের সঙ্গে ওর একটা বই রয়েছে। সৌজন্য ট্রলি হাতড়ে নিজের কয়েকটা বডি স্প্রে বের করলো।
-আমি বাইরে আছি সৌজন্য।
-না ম্যাম আপনি থাকুন। কোনো অসুবিধে নেই। আমি ওয়াশরুমে চলে যাচ্ছি।
ওয়াশরুমের দরজা খোলাই রইলো। উজ্জয়িনী ওয়াশরুমের দিকে পিছন ঘুরে বসে বললো,
-সৌজন্য বললে নাতো কিসের কেক?
-হোটেলের কেকটা তো ম্যাম আগেই অর্ডার দেওয়া ছিল। আমাদের একজন ট্যুরিস্ট এর আজ আঠের বছরের জন্মদিন ম্যাম। সে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে এখানে বেড়াতে এসেছে। খবরটা কানে যখন এলোই, তার জন্মদিনটাকে আরো একটু স্পেশাল করার জন্য ছোট একটা কেক ওদের বানাতে বললাম। ফ্রিতে কেক পেয়ে কাস্টোমার খুশি হয়ে যাবে। মনে রাখবে আমাদের। ওরা ফিরে গিয়ে আবার অন্য কাউকে রেকমেন্ট করবে এখানে আসার জন্য। ব্যাস! আমরা লালে লাল!
-হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট! তাই না?
-হ্যাঁ ম্যাম। কিন্তু আপনি কি করে জানলেন?
হতবাক সৌজন্য বাথরুম থেকে মুখ বাড়ালো। উজ্জয়িনী হেসে বললো,
-পড়াশোনাটা বেশ মন দিয়েই করেছ দেখছি। কাস্টোমার পটাতে ওস্তাদ!
-ঐটুকুই তো হোটেল ব্যবসার মূলধন ম্যাম।
-হুম বুঝলাম! তা আঠের বছর যার হচ্ছে, সে কি অষ্টাদশ, নাকি অষ্টাদশী?
ব্লেজারের পর জামাটাও একটানে খুলে ফেললো সৌজন্য। ওয়াশরুম থেকে কৃত্রিম পুরুষালী সুবাস ভেসে আসতে লাগলো বেডরুমেও। জামাটা আবার ভিজে গায়ে গলিয়ে চুল ঠিক করতে করতে সজোরে হেসে সৌজন্য বললো,
-অষ্টাদশী ম্যাম! অষ্টাদশী!
-তার জন্য তোমার যা বিশেষ-বিশেষ আয়োজনের বহর দেখছি, ওই অষ্টাদশী কিন্তু আজ তোমার হাতে পটে যাবে! মিলিয়ে নিও তুমি!
হাসতে হাসতে ওয়াশরুম থেকে বেরোলো সৌজন্য।
-ম্যাম এবার আর ক্রিমের গন্ধ পাচ্ছেন? এবারও পেলে গোবর জলে চুবে আসতে হবে।
-নানা। স্মেলস গুড!
-ওকে। চলুন তবে? যাওয়া যাক।
ট্রলিতে বডি স্প্রে ফেলে রেখে ট্রলি বন্ধ করে ফেললো সৌজন্য।
-ম্যাম আপনি বেরোন। আমি ডোর লক করে আসছি!
সৌজন্যর বাড়িয়ে দেওয়া হাতে হাত গলিয়ে লিফটে উঠলো উজ্জয়িনী....
হোটেলের সুবিশাল কেকটা কাটার সময় সৌজন্যর পাশেই দাঁড়িয়েছিলো উজ্জয়িনী। তারপর ওদিকের হুড়োহুড়ি, নাচানাচি, লাফালাফি, মিউজিকের অতিরিক্ত অত্যাচারে, রকমারি উষ্ণ পানীয়র কড়া গন্ধে মাথা ধরে গেছে ওর। সৌজন্য ব্যস্ত রয়েছে দেখে, ও সৌজন্যকে না বলেই সরে এসেছে ওখান থেকে। সেই অষ্টাদশীর জন্মদিনের কেক কাটা হচ্ছে এখন। মেয়েটা সৌজন্যর পাশ থেকে আর নড়ছেই না। একটু দূরে একটা টেবিলে একা বসেছিলো উজ্জয়িনী। সামনে উষ্ণ পানীয়র গ্লাস আর কিছু স্ন্যাকস! বেশ লাগছিলো ওদিকে চেয়ে থাকতে। দুটিকে পাশাপাশি মানাচ্ছেও বেশ। একদিকে উজ্জয়িনী দেখলো, স্বামী-স্ত্রীর কোনো বিষয় নিয়ে বেশ তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। ওদিকে আবার সুটেড-বুটেড দুজন পুরুষ মদের গ্লাস হাতে নিয়ে জোরতার ঝগড়া করছে। অদূরে একটা লেডিস গ্রুপ কি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে কে জানে! দিকে-দিকে কেবল আলাপ-আলোচনা, ভ্রু কুঁচকে কথাবার্তা....এসব দৃশ্যই চোখে পড়লো উজ্জয়িনীর। এত আলোর মধ্যে, এত আনন্দের মধ্যেও সুখী নয় কেউ! সবার জীবনের সমস্যার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে তাদের মুখমন্ডলে। গলায় আবার একটু উষ্ণ পানীয় ঢেলে নিলো উজ্জয়িনী। গ্লাসের দিকে চেয়ে একটু অন্যমনস্ক হতেই সৌজন্যকে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে ফেললো ও। একটু এদিক ওদিক চেয়ে সৌজন্যকে উজ্জয়িনী আর খুঁজেই পেলো না। অস্থিরভাবে ও চাইলো ওই মেয়েটির দিকে। কিন্তু ওই অষ্টাদশীর ত্রিসীমানায়ও, উজ্জয়িনী সৌজন্যর টিকি খুঁজে পেলো না।
-ম্যাম! এইতো আমি! একা বসে কেন এখানে?
চমকে উঠলো উজ্জয়িনী। এত জোরে গান বাজছে, আর হলে এত হৈ-হল্লা, উজ্জয়িনী সৌজন্যর কথা কিছুই শুনতে পেলো না। উষ্ণ পানীয়র প্রভাবে উজ্জয়িনীর মাথাটাও ভারী হতে শুরু করেছে। ও বললো,
-কি বললে?
সৌজন্য উজ্জয়িনীর কানের কাছে মুখ এনে চিৎকার করে বললো,
-বলছি আপনি এখানে একা-একা বসে আছেন কেন? ওদিকে চলুন একটু?
-না। এখানেই ঠিক আছি আমি।
-আরে চলুন, উঠুন। আপনি এভাবে এককোণে একা বসে থাকলে, আমার ওখানে ভালো লাগবে না।
-সদ্যযৌবনা অষ্টাদশীকে ছেড়ে এই বিগতযৌবনার খোঁজে কেন সৌজন্য? যাও, পার্টি এনজয় করো।
-ধ্যের! কেক কাটা হয়ে গেছে। দু-লাইন বক্তব্য রেখে দিয়েছি, মেয়েটার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কেক কেটেছি, আমার কাজ শেষ। বাকিটা ম্যানেজমেন্ট বুঝে নেবে।
-কি বলছো? শুনতেই পাচ্ছি না।
-বলছি ম্যাম, বাকি কাজ নিলয়দা আছে, স্টাফরা আছে। ওরা যা পারে করুক। আমার কাজ শেষ। আপনি কি ওদিকে যাবেন? চলুন একবার। উঠুন, আমি ধরে-ধরে নিয়ে যাচ্ছি। ডিনার করে রুমে চলুন বরং। আর ভালো লাগছে না এখানে। আমি ধরছি আপনাকে...
চিৎকার করে মিউজিকের শব্দের ঊর্ধ্বে উঠে সৌজন্য বললো...
-আরে সৌজন্য আমি স্টেবল আছি। ধরতে হবে না।
-তাহলে চলুন।
তাও উঠতে গিয়ে একটু টাল খেলো উজ্জয়িনী। সৌজন্য তাড়াতাড়ি ওকে ধরে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিলো। লজ্জায় পড়ে উজ্জয়িনী বললো,
-থাক আমি একটু পরে যাচ্ছি।
-আমি নিয়ে যাচ্ছি, চলুন!
সৌজন্য উজ্জয়িনীর হাত ধরে ওর কোমরে হাত রাখতেই, উজ্জয়িনী চোখের সামনে দেখলো সান্দাকফু....ফালুট.....ট্রেকিং....হোটেলের বিছানায় উদ্দাম যৌনতা....শৌনক ওর কোমর জড়িয়ে ধরে হোটেলের রুম থেকে দূরে পাহাড়ের দিকে চেয়ে রয়েছে।সারারাতের সীমাহীন শরীরী মিলনের পর পরদিন সকালে ঠিক এভাবেই শৌনক ওর কোমরটা চেপে জড়িয়ে ধরেছিল না! যেভাবে এখন সৌজন্য ধরে রেখেছে! মৃদু ধাক্কা মেরে সৌজন্যকে সরিয়ে দিলো উজ্জয়িনী। আবার ধপ করে বসে পড়লো চেয়ারে।
-ম্যাম! কি হলো?
-যাবো না। প্লিজ! তুমি যাও! আমাকে একটু একা থাকতে দাও সৌজন্য!
-ম্যাম আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? রুমে যাবেন? ঘুমোবেন একটু? আমি রুমে ডিনার সার্ভ করতে বলি?
-তুমি যাও না এখান থেকে! প্লিজ!
কথা বলতে-বলতেই কান্নায় গলা কেঁপে উঠলো উজ্জয়িনীর। শৌনক আছে। কিছুতেই ভোলা যায় না ওকে। সৌজন্য ওর অবস্থা দেখে ওখান থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না দেখে, গ্লাসের অবশিষ্ট মদটুকু গলায় ঢেলে নিলো উজ্জয়িনী। তারপর টেবিল থেকে ফোনটা তুলে সৌজন্যকে পাশ কাটিয়ে টলতে-টলতে হলের বদ্ধ পরিবেশ ছেড়ে, দেওয়াল ধরে-ধরে বেরিয়ে গেলো খোলা হাওয়ায়। সাহায্য ছাড়া একা খুব বেশিদূর যেতে পারলো না উজ্জয়িনী। হলের বাইরে বেরিয়ে লনের মধ্যে কয়েক পা গিয়েই, আবার ঘাসের ওপর বসে পড়লো ও। তারপর চুপ করে বসেই রইলো। আর উঠতে পারলো না....
এত আলো,এত ভিড় অসহ্য লাগে সৌজন্যর। একটা মদের ভরা বোতল আর একটা গ্লাস টেবিল থেকে উঠিয়ে নিয়ে, উজ্জয়িনীর পিছন-পিছন হল ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো ও নিজেও....শত কাজের মধ্যে ব্যস্ত থেকেও, নিলয় দূর থেকে দেখলো, দুজনই পরপর হলের বাইরে বেরোলো।
-ম্যাম! একি আপনি বাইরে এসে মাটির মধ্যে বসে আছেন? উঠুন-উঠুন! ওদিকে পার্কে বসার জায়গা আছে। ওখানে বসবেন চলুন।
-এখানেই ভালো লাগছে সৌজন্য।
-আচ্ছা এখানেই বসবেন তবে?
-হুঁ!
চারিদিকটা একবার দেখে নিলো সৌজন্য। গেট বেশ খানিকটা দূরে থাকায় ওদিকের আলো এদিকে এসে বড় বিশেষ পৌঁছচ্ছে না। ওদিকে হালকা আলো থাকলেও, লনের পিছনদিকের এই জায়গাটা বেশ অন্ধকারই বলা চলে। তবে অন্ধকারে চোখ সয়ে যেতেই সৌজন্য দেখলো, দূরে নদীর দিক থেকে উত্তাল হাওয়া পাক খেয়ে এদিকে আসছে। উজ্জয়িনীর মাথার চুলগুলো মনের আনন্দে উড়ছে। খালি কাঁচের গ্লাস আর বোতলটা পাশে রেখে, নিজের জুতো-মোজা খুলে ফোনটা প্যান্টের পকেট থেকে বের করে ঘাসের ওপর রেখে, সৌজন্যও বসে পড়লো উজ্জয়িনীর পাশে।
-আপেলটা ঘাসের ওপর ফেলে রাখলে যে?
-কিসের আপেল? নিয়ে আসবো ভিতর থেকে? খাবেন?
-না। তোমার দামী আপেল!
-ওহ আইফোন! ও পাপা গিফ্ট করেছে। একদিন জেদ করে পাপার কাছ থেকে এসব আইফোন, আইপ্যাড, ম্যাকবুক সব আদায় করতাম। জীবনের প্রথম আইফোন আমি রাস্তায় ছুঁড়ে ভেঙে ফেলেছি। তারপর থেকে আর কোনোদিনও কিছু চাই না ম্যাম। চাইলেই সবকিছু পাওয়া যায় না, এটা যেদিন থেকে বুঝেছি, সেদিন থেকে আমার সব চাহিদা মরে গেছে। এটা অনেক পরে পাপা নিজেই গিফ্ট করেছে। কোনো কিছুর প্রতি আমার আর কোনো মোহ নেই। কেটে গেছে সব! ও পড়ে থাকলে থাক, হারিয়ে গেলে যাক। আবার কম দামী কাজ চলার মতো কিছু একটা কিনে নেবো। ফোন আমি কাজ ছাড়া খুব বেশি ব্যবহার করি না। কাজের বাইরে সারাদিনে একবার আপনার পেজ বা প্রোফাইল ভিজিট করি, অনলাইন কিছু টাকাপয়সার লেনদেন করি। ব্যাস!
-জীবনের প্রতি এত অনীহা কেন সৌজন্য?
-একাকীত্বকে যে মন থেকে ভালোবেসে ফেলেছে, তাকে আপনি আর জীবনে ফেরাতে পারবেন না ম্যাম! কি দারুণ হাওয়া দিচ্ছে না নদীর দিক থেকে!?
-হুম!
-ভিতরের দমবন্ধকর পরিবেশের থেকে বাইরেটা অনেক ভালো। হাজারটা এসির বিনিময়েও এই পরিবেশ পাওয়া যায় না। খালি পায়ের তলায় সবুজ ঘাসের সুড়সুড়ি, মাথার ওপর খোলা আকাশ, ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘের আড়ালে উঁকি দেওয়া চাঁদ, সামনে নদী, আপনি-আমি, আর আড্ডা....
-তুমি বাইরে বেরিয়ে এলে যে! তোমার অষ্টাদশীকে ছেড়ে।
-ধুর! আমার এত আলো, এত শব্দে বিরক্ত লাগে। কি করবো? কাজের জায়গা। থাকতেই হয়। পাপা বকবে নইলে!
-তুমি পাপাকে খুব ভয় পাও, তাই না?
-না ম্যাম। পাপা আমার মাই ডিয়ার। এটা ভয় নয়। ওদের ইচ্ছেকে সসম্মানে মান্যতা দেওয়া। আমি বাবা-মাকে মানি খুব।
-এককালে আমিও মানতাম।
-মানতাম কেন? এখন মানেন না?
চুপ করে গেলো উজ্জয়িনী। সৌজন্য সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলো, কথার পৃষ্ঠে ওর মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলেও, প্রশ্নটা বড় ব্যক্তিগত হয়ে গেছে। এর উত্তর পাওয়া যাবে না। আশা করাও উচিত নয়। ও প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলে উঠলো,
-ম্যাম উইথ ইয়োর পারমিশন, আমি কিন্তু এবার একটু ড্রিঙ্ক করছি। সন্ধ্যে থেকে গেস্টদের সামনে স্টেবল থাকার জন্য একটুও খাইনি। তবে আপনি আর পাবেন না।
-কেন না?
-নিজের অবস্থা দেখুন।
-দিব্যি তো তোমার সঙ্গে কথা বলছি।
-আমি একটাই গ্লাস এনেছি। হবে না।
-মদ আবার এঁটো হয় নাকি?
হেসে উঠলো সৌজন্য।
-আচ্ছা অল্প একদম। নইলে এরপর আপনাকে ওঠাতে জেসিবি লাগবে।
-আনবে!
গ্লাসটা উজ্জয়িনীর দিকে এগিয়ে দিলো সৌজন্য। তারপর সবুজ গালিচার মতো ঘাসের উপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়লো। মাথার তলায় একটা হাত রেখে নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে চেয়ে বলে উঠলো,
-ম্যাম একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
-বলো?
-যেদিন আপনার গল্পের সব প্লট ফুরিয়ে যাবে, আপনি সেদিন কি করবেন? মানে রিটায়ারমেন্টের কথা বলছি। ধরুন, যখন আপনার ভাবনায় জং ধরবে, কল্পনারা ডানা মেলে আকাশে উড়বে না, আপনি সেদিন কি করবেন ম্যাম?
-তখন কল্পনা না করে, যা চোখের সামনে দেখবো, তাই নিয়েই লিখবো।
গ্লাসটা সৌজন্যর হাতে ফিরিয়ে দিলো উজ্জয়িনী। সৌজন্য গ্লাসে উষ্ণ পানীয় ঢেলে প্রথম চুমুক দিয়ে বললো,
-তেমনটা আবার হয় নাকি? বাস্তব বলুন বা কল্পনা, একদিন তো ফুরোবেই।
-আমার তো উল্টোটা মনে হয় সৌজন্য। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, লেখার মতো আমার কাছে এতকিছু আছে, যে এক জীবনে আমি বোধহয় সব লিখে শেষ করতে পারবো না।
-বাপরে! এত প্লট? এত ভাবতে পারেন কি করে?
-ভাবতে হবে কেন? চোখ কান খোলা রাখলেই নিজের আশেপাশে কতকিছু দেখা যায়, শোনা যায়। শুধু দেখার চোখ থাকা চাই। বেশি ভাবার দরকার নেই তো!
-আপনার আশেপাশে গল্পরা ঘুরে বেড়ায়? চরিত্ররা?
-অবশ্যই। আজ তোমার পার্টিতেই তো কতগুলো গল্প দেখলাম। অসুখী স্বামী-স্ত্রীর গল্প, একটা লেডিজ গ্রুপের পি.এন.পি.সির গল্প, আবার তোমার আর তোমার অষ্টাদশীর গল্প।
-আরে কি যে বলেন ম্যাম! বাচ্চা একটা মেয়ে।
-ও বাচ্চা? আর তুমি বুড়ো হয়ে গেছ বুঝি?
হেসে গ্লাসটা গলায় উপুড় করলো সৌজন্য। আবার শূন্য গ্লাস পূর্ণ করতে করতে শুনলো উজ্জয়িনী বলছে,
-শোনো সৌজন্য, তোমাকে একটা কথা বলে রাখি। তোমার এই পার্টিতে যারা-যারা উপস্থিত আছেন, তারা সবাই ডিপ্রেসড। সবার জীবনে সমস্যা আছে। কেউ সুখী নয়। বসে বসে দেখলাম তো, ওই একটুখানি সময়টাতেও কেউ প্রাণ খুলে হাসতে পারছে না। সবাই নিজেদের ওই খারাপ থাকাগুলোর সঙ্গে ডিল করছে। আর ওই খারাপ থাকার গল্পগুলোই এক একটা আস্ত উপন্যাস। বুঝলে? যত চোখের জল, তত গল্প। এবার তুমি আমাকে একটা কথা বলো, একজন পরিণত মানুষ জীবনে ঠিক কতবার কাঁদেন?
-জানিনা ম্যাম। নিজে তো সবেমাত্র পঁচিশটা বছর পেরিয়েছি। বাকি গোটা জীবন তো পড়েই আছে। তাও এত চোখের জল খরচ করে ফেলেছি, যে সেসব হিসেবের বাইরে! এরপর সারাজীবন ধরে আর কত কাঁদতে হবে, জানিনা ম্যাম!
-তাহলে? এবার তুমি আমাকে বলো, প্রতিবার কি একই কারণে কাঁদো?
-নানা। একই কারণে বারবার কান্না আসে নাকি? তখন তো যন্ত্রণায় মানুষ পাথর হয়ে যায়। কান্নারাও মরে যায়। কান্নার কারণেরও রকমফের আছে।
-রাইট! আর ওই প্রতিবার চোখের জলের বিভিন্ন কারণগুলো হলো এক-একটা গল্প। এবার তুমি হিসেব করো, একটা মানুষ এক জীবনে যতবার চোখের জল ফেলছে, প্রতিবার সে নিজেই এক-একটা নতুন গল্প সৃষ্টি করছে। তাহলে একটা মানুষের সারা জীবনের সব গল্প কি আমি লিপিবদ্ধ করে উঠতে পারবো? সম্ভব কখনো? তাহলে বাকিদেরগুলো কি হবে? আর সবার গল্প লিখতে গেলে, আমার এই একটা জীবন কম হবে কিনা! এবার তুমিই বলো?
নিরুত্তর সৌজন্য। আকাশে হঠাৎ করেই লক্ষ-লক্ষ তারা জ্বলে উঠলো। কত বাজি ফাটছে! বাজির আলোর চকচক করে উঠলো সৌজন্য আর উজ্জয়িনীর চোখমুখ।
-নিলয়দা!
গ্লাস আবার ফাঁকা করে আকাশের দিকে চেয়ে সৌজন্য বললো। সঙ্গে সঙ্গে ঘাসের ওপর থেকে নিজের ফোনটা নিয়ে, মনের আনন্দে ছবি তুলতে গেলো উজ্জয়িনী। ঘাসের ওপর আধশোয়া অবস্থায় পড়েছিলো সৌজন্য। একলাফে উঠে এসে উজ্জয়িনীর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিলো ও।
-ওই! আমার ফোন দাও। ফটো তুলছিলাম তো!
-না তুলবেন না।
-ওমা! কেন? যাঃ! বাজির আলো শেষ হয়ে গেলো....
হঠাৎ করে যেমন আলো হয়ে গিয়েছিল, তেমনই হঠাৎ করেই অন্ধকার হয়ে গেলো সৌজন্য আর উজ্জয়িনীর চোখমুখ। আকাশের গায়ে ভাসতে থাকা শেষ আগুনের ফুলকিটাও নিভে গেলো। উজ্জয়িনীকে ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে সৌজন্য বলে উঠলো,
-কিছু কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত ফোনে নয় ম্যাম, মনে বন্দী করে রাখা উচিত। নইলে মুহূর্তগুলোকে অপমান করা হয়। সব মুহূর্তের এভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবি তুলে রাখবেন না! এতটা যান্ত্রিক হবেন না। মুহূর্তগুলো মন দিয়ে উপভোগ করুন। ওদের মনে রাখুন, ফোনে নয়! ক্যামেরায় ফোকাস করতে গিয়ে, আপনি নিজেই মুহূর্তগুলো মিস করে যাবেন। করবেন না এটা! এখন ফোন কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে, আমরা একসঙ্গে আতসবাজির আলোটা দেখতে পেলাম না। নইলে দুজন একসঙ্গে দেখতাম। দুজনের স্মৃতিতে এই মুহূর্তটা চিরকাল বেঁচে থাকতো....
ফোনটা ফিরিয়ে দিলো সৌজন্য।
-আমার গলা শুকিয়ে গেছে।
সৌজন্য নিজের গলায় গ্লাসটা সবে উপুড় করতে যাচ্ছিলো। ঠোঁটে ঠেকানো গ্লাসটা আবার ঠোঁট থেকে নামিয়ে এগিয়ে দিলো উজ্জয়িনীর দিকে।
-আচ্ছা সৌজন্য?
-বলুন?
-তুমি আমার সম্পর্কে এখন কি ভাবছো?
-কি ভাববো ম্যাম?
-এই যে তুমি একবার অ্যাপ্রোচ করতেই আমি তোমার সঙ্গে এককথায় এখানে চলে এলাম, হোটেলের রুম শেয়ার করার প্রস্তাবটাও আমিই দিলাম, আবার এখন একটা গ্লাস শেয়ার করে তোমার সঙ্গে ড্রিঙ্কও করছি। কতটা চিনি আমি তোমাকে? তাও তো এসব করছি। এগুলো দেখে তুমি কি ভাবছো আমার সম্পর্কে? আমার সম্পর্কে তোমার ধারণা কি?
-আপনি খুব তাড়াতাড়ি মানুষকে বিশ্বাস করেন। আমাকেও করেছেন। যে বিশ্বাসের মর্যাদা আমাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাখতে হবে। অনেক বড় দায়িত্ব আমার কাঁধের ওপর এসে পড়েছে। এটাই ভাবছি!
-তোমার মনে হচ্ছে না, আমার চরিত্র ভালো না!
-ছি-ছি! একদমই না। এসব ভাবার সাহস নেই আমার। ভাবতেও চাই না।
-জানো সৌজন্য, লেখক-লেখিকারা নাকি ব্যক্তিগত জীবনে কোনোদিন সুখী হতে পারে না! তাদের সংসারে সবসময় আগুন জ্বলে!
-প্রেমের আগুন?
-মজা করছো?
-না! মজা কেন করবো? আপনার লেখা পড়ে আমার চারপাশে দাউদাউ করে প্রেমের আগুন জ্বলে। তাই বলছি। চরিত্রহীন আপনাকে হতেই হবে ম্যাম। বারবার প্রেমে না পড়লে চরিত্রহীন হওয়া যায় না। আর নিজে বারবার প্রেমে না পড়লে সৃষ্টি করা যায় না। আমি নিজেই কতবার আপনার সৃষ্টি করা চরিত্রের প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খেয়েছি! তখনই কল্পনায় আপনার সঙ্গে কত কথা বলেছি, ঝগড়া করেছি। আপনি প্রেমে পড়ুন ম্যাম! বারবার পড়ুন। নাহলে আমরা প্রেমে পড়বো কি করে!
-এ প্রেম সে প্রেম নয় সৌজন্য। তুমি ঠিক বুঝবে না।
-বুঝবো নাই তো! আপনার মত করে বুঝতে পারলে, ভাবতে পারলে, আপনার-আমার কোনো পার্থক্যই থাকবে না যে! আমি শুধু পড়বো, অনুভব করবো। ভালো লাগলে ভালো বলবো, খারাপ লাগলে খারাপ বলবো। এর বেশি বুঝতে গেলে ভারী সমস্যায় পড়ে যেতে হবে যে! গ্লাসটা দিন ম্যাম। হাওয়াটা লেগে আমার তো ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখানেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আর রুমে গিয়ে কাজ নেই। ম্যাম?
-উম?
-আপনার কাছে একটা আবদার করি?
-কি?
-আপনার চারপাশে প্রতিনিয়ত গল্প ঘুরে বেড়ায় বললেন যে, সেই কথার পরিপ্রেক্ষিতে আপনাকে একটা অনুরোধ করবো, রাখতে হবে কিন্তু!
-বলো?
-এক্ষুণি আমাকে একটা গল্প বলুন না? আপনার লেখা? না মানে ভাবা! এখন লিখবেন কোথায়? যাহোক কিছু একটা ভেবেই বলুন। বলুন না ম্যাম?
-এ কি আবদার?
-প্লিজ ম্যাম? লেখিকাকে নিজের এত কাছে পেয়ে তার মুখ থেকে গল্প শোনার লোভ সংবরণ করা বড় কষ্টকর যে! কিছু একটা বলুন না!
-আরে আমি কি গায়িকা নাকি, যে গাইতে বললে দু-কলি গেয়ে শোনাবো? এভাবে হয় নাকি?
-আপনিই তো বললেন এভাবেই গল্প হয়। বলুন না প্লিজ!ম্যাম!!
অমায়িক হাসি হেসে উঠলো উজ্জয়িনী। ছেলেটার এই অবদারের সুরে "ম্যাম" বলে আদুরে ডাকটা বড় মিষ্টি লাগে শুনতে। গত দুদিন ধরে উজ্জয়িনী এই ডাকটাই শুনছে। তবুও যেন শুনে-শুনে মন ভরে না। সারাক্ষণ ধরে শুধু শুনেই যেতে ইচ্ছে করে। উজ্জয়িনীর বাঁধভাঙা হাসির দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সৌজন্য। একরাশ অবাধ্য চুল ম্যামের মুখের ওপর এসে পড়েছে। মার্জিত কণ্ঠে সৌজন্য আবারও বললো,
-বলুন না ম্যাম!
-কি গল্প শুনতে চাও বলো?
লাফিয়ে উঠে উজ্জয়িনীর একেবারে মুখোমুখি বসলো সৌজন্য।
-আপনার যা খুশি!
-সেভাবে যদি ভাবতেই হয় সৌজন্য, তবে আমি কিন্তু এখন এইখানে একটা দুর্দান্ত গল্পের প্লট পেয়ে যাচ্ছি।
-কোথায়? কোনখানে?
-এই যে, তোমার-আমার মাঝখানে! তোমাকে-আমাকে ঘিরে!
-আমাদের ঘিরে? বুঝলাম না তো ঠিক!
-দুজন মানুষ, সম্পূর্ণ দু-প্রান্ত থেকে এসে একজায়গায় হঠাৎ মিলিত হয়। তারপর তাদের আলাপ হয়, তারপর তাদের মধ্যে একটা অসমবয়সী বন্ধুত্বও হয়। তারপর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। আর তারপর....
-তারপর কি ম্যাম?
-জানিনা সৌজন্য। আপাতত তো এতটাই হয়েছে। তারপর তাদের দুজনের জীবন কোন খাতে প্রবাহিত হবে, আমি কি করে জানবো বলো? যে কয়েকটা মুহূর্ত তারা এখন একসঙ্গে কাটাচ্ছে, ভবিষ্যতে এই মুহূর্তগুলো তাদের জীবনে গভীর কতটা প্রভাব ফেলবে, তা তো এখন আমারও অজানা সৌজন্যবাবু!
-এই সব অজানার মধ্যে কি, আপনার জানা কিচ্ছু নেই ম্যাম?
-আছে তো!
-কি আছে?
-এই মুহূর্তটুকু! যেটা আমরা এখন বাঁচছি। চলো সৌজন্য, এই আনন্দে হাই-ফাইভ! দাও তালি!
নিজের ডান হাতটা সৌজন্যর দিকে হাসিমুখে এগিয়ে দিলো উজ্জয়িনী। সৌজন্য ওই হাতে তালি দিলো না। বরং ধীরে-ধীরে নিজের বাঁ হাতটা উজ্জয়িনীর ডান হাতের ওপর আলতো করে ছুঁইয়ে রাখলো। উজ্জয়িনী হাত সরিয়ে নিলো না। সৌজন্যর হাতের তালুর উষ্ণতা, স্পর্শ করলো উজ্জয়িনীকে। ওর আঙুলগুলোও পরস্পরের সঙ্গে দূরত্ব বৃদ্ধি করলো। ওর আঙুলের ফাঁকে-ফাঁকে নিজের আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে, উজ্জয়িনীর আঙুলগুলো নিয়ে পিয়ানোর মতো খেলতে-খেলতে, সৌজন্য সজোরে ওর হাতটাই চেপে ধরলো।
-এটা কি হলো সৌজন্য?
-ম্যাম আপনিও আমার হাতটা চেপে ধরুন!
-কেন ধরবো?
-ধরুন না। এটা একটা খেলা!
-সৌজন্য তুমি বড্ড ছেলেমানুষ!
-ধরুন না ম্যাম!
একটু হেসে সৌজন্যর হাতটা চেপে ধরলো উজ্জয়িনী। দুজনের মুষ্টিবদ্ধ হাতের দিকে চেয়ে উজ্জয়িনী বলে উঠলো,
-কি খেলা এটা?
-দেখুন-দেখুন ম্যাম! কাল থেকে একসঙ্গে কাটানো আমাদের সব মুহূর্তগুলো, দুজনের হাতের মুঠোর মধ্যে বন্দী! ওরা আর কোনোদিনও হারাবে না। আমরা হারাতে দেবো না।
-মুহূর্তেরা বন্দী? তাই না সৌজন্য?
উজ্জয়িনীর হাতটা আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ওর দিকে চেয়ে সৌজন্য বলে উঠলো,
-হ্যাঁ ম্যাম! মুহূর্তেরা বন্দী!
(চলবে....)
ছবি : সংগৃহীত
শুরু হচ্ছে লালমাটি থেকে প্রকাশিত আমার বই 'ত্রিভুজ' 'সূর্যোদয়ের আগে' এবং 'নির্বাক' এ বিশেষ ছাড়। আগামী ৮ জুন পর্যন্ত লালমাটির বই ঘরে বসে ২২-২৫ শতাংশ ছাড়ে হাতে পান শুধুমাত্র