অনুসরণকারী

বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর, ২০২০

E- Book

 





আমার প্রথম ই-বুকের প্রচেষ্টা google play books -র হাত ধরে।ভিন্নধর্মী পাঁচটি ভালোবাসার গল্প।sample পড়ে দেখার সুবিধা আছে।মূল্য মাত্র কুড়ি টাকা।

অনেকেই হয়তো গল্পগুলো পড়েছেন তবে আমার প্রথম প্রয়াস হিসাবে সংগ্রহে রাখতে পারেন।










Buy Now








শনিবার, ১০ অক্টোবর, ২০২০

নির্বাক (পঞ্চম পর্ব)


 



নির্বাক


সাথী দাস


পঞ্চম পর্ব







-ডাকলে শুনতে পাও না নাকি গো!বলছি ওপরে এসো, আমার কাপড়খানা,মামনির জামাটা দেখে যাও একটু।

সৌদামিনী দেবী হাসিমুখে চৈতীর সঙ্গে তিনতলায় উঠে গেলেন....

বাড়ি থেকে বেরোতে আজ বেশ কিছুটা দেরিই হয়ে গেছে রাত্রির।রাস্তায় বেরিয়েই হুড়োহুড়ি করছিলো ও।গত এক বছর ধরে স্টুডিও-পাড়ায় রাত্রির যাতায়াত শুরু হয়েছে।রেডিও জকি হিসেবে কাজটা শুরু করার পর থেকেই,নতুন-নতুন অনেক কাজের সুযোগ আসছে রাত্রির সামনে।সকালের দিকে এই একটা শো থাকে,তারপর দুপুরের পর আরও একটা।এছাড়াও গত দুমাস ধরে টিভির পর্দায় একটা সান্ধ্য কুইজের অনুষ্ঠানে,সহ-সঞ্চালনার অনুরোধ আসছে।কিন্তু আরও কতগুলো সৃজনশীল কাজে একটু ব্যস্ত থাকায়,আপাতত ওই অনুরোধগুলো ঠেকিয়ে রেখেছে রাত্রি।তথাকথিত শিক্ষিত-আধুনিক পাত্রের বাড়ি থেকে ওর কাজ করা নিয়ে কোনো অসুবিধে নেই।বরং ওরা রাত্রির কর্মজীবনে বেশ খুশিই।কিন্তু কাজটাই কি সব?আর সুখ?বিয়ের পর হয়তো চরম একাকীত্বের জীবনে মানিয়ে নিতে হবে রাত্রিকেই।তখন কি ওর আরও বেশি করে নীলদার কথা মনে পড়বে?!কি করে মনে পড়বে?কোনোদিন তো ভুলতেই পারেনি তাকে।ও সত্যিই এই মুহূর্তে বিয়েটা করতে চায় কিনা,সেই প্রশ্নের উত্তর রাত্রি নিজেও জানে না।শুধু এটুকু জানে,আজও নীলদার কথা মনে পড়লেই চোখের জল বড় বেশিই অবাধ্য হয়ে ওঠে....বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালো ও।একটু আগেই বাসটা বেরিয়ে গেছে।আবারও পনেরো মিনিটের অপেক্ষা।চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো রাত্রি।ওর সামনে এসে দাঁড়ালো একজোড়া কপোত-কপোতী।কলেজ পড়ুয়া হয়তো।রাত্রির বেশ লাগছিলো ওদের খুনসুটি দেখতে।ছেলেটি তার মেয়েটির লম্বা বিনুনীটা টেনে ধরলে,মেয়েটা ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো ছেলেটির পিঠে...মৃদু হেসে ফেললো রাত্রিও।পিছনে বসে নিজের ব্যাগটা কোলের ওপর রেখে,ও হারিয়ে গেলো অতীতে...

-শোন রাত্রি!মা কিন্তু ঠাম্মির সঙ্গে অনেক ঝামেলা করে তোকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে।এরপর তুই যদি ফাঁকি মারিস না,তোর চুল টেনে ছিঁড়ে দেবো কিন্তু....
-মণিমা!নীল দা আবার আমার চুল টেনে ধরছে!
-এই চুপ!নালিশ করছিস কেন?শুধু নালিশ না!!তুই যখন ঘুমিয়ে থাকবি,তোকে একদম ন্যাড়া করে দেবো!
-ও মণিমা....
-এই মেয়ে!এত চিৎকার করছিস কেন রে?মা ঠাকুর পুজো করতে বসেছে না?
-সরি পিসিমনি!রাত্রি আর চেঁচাবে না।আমিই ওকে মারছিলাম।আর মারবো না!
-নীল শোন?
-বলো পিসিমনি?
-তোর স্যার তোকে আজও তোকে পড়াতে এলো না তো?সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হয়ে গেলো যে!
-আজ তো স্যার আসবে না পিসিমনি!
-কেন?
-স্যারের জ্বর হয়েছে।ওই জন্যই তো আমি রাত্রিকে পড়াচ্ছিলাম আর মারছিলাম।একদম পড়ে না!ভীষণ ফাঁকিবাজ।
-কবে থেকে জ্বর?আমাকে বলিসনি তো!
-যাঃ বাবা!স্যারের জ্বর তো তোমাকে বলবো কেন?তুমি কি স্যারের ছাত্রী নাকি!পড়ি তো আমি আর রাত্রি!স্যার পড়াতে এলো কি না এলো,সেসব জেনে তুমি কি করবে?!
-এই নীল!খুব মুখে-মুখে কথা শিখেছিস না রে!!যেটা জিজ্ঞেস করবো,শুধু সেটুকুরই উত্তর দিবি।এত একঝুড়ি কথা তোকে কে বলতে বলেছে রে!কবে থেকে জ্বর তার?এখানে তো একা-একা ওই মেসে পড়ে থাকে।কি খাচ্ছে,ডাক্তার দেখিয়েছে কিনা,সেই খোঁজ নিয়েছিস?আমার স্যার,আমার স্যার বলে তো খুব লাফাচ্ছিস!জানিস সেসব কিছু?
-নাতো...কাল আসেনি,তাই বাবা ফোন করেছিলো।ওসব আমি জানবো কি করে!আমি শুধু জানি স্যার কদিন আসবে না।এতকিছু তো জানি না!!
-জানিস না যখন বেশি কথা বলবি না!কেউ কোনো খোঁজ রাখে না!!
-যাঃ বাবা!আমি কি করলাম!তুমি আমার ওপর এত চেঁচাচ্ছ কেন পিসিমনি?
-কিছুনা....যা পারিস কর!!

নীলের ঘর পেরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দুম করে দরজা বন্ধ করলো চৈতী...তখনই সৌদামিনী দেবী এসে ছেলের ঘরে ঢুকলেন....

-মা দেখো পিসিমনি...

চোখ বড় করলেন সৌদামিনী দেবী।চুপ করে গেলো নীল।মণিমার রাগ দেখে রাত্রিও নালিশ করতে ভুলে গিয়ে,তাড়াতাড়ি বই খুলে পড়ায় মন দিলো...মা সরে যেতেই আবার একবার রাত্রির চুল টেনে দিলো নীল...

-উফফ!
-চুপ...পড়!নইলে কাঁচি দিয়ে কুচ করে তোর বিনুনী কেটে দেবো!

বাস এসে যাওয়ায় অতীতের সুন্দর স্মৃতিচারণের হাতছানি উপেক্ষা করে,বাসের দিকেই তড়িঘড়ি এগিয়ে গেলো রাত্রি....

-এই শাড়িটা ভালো না বৌদি?

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেও,চৈতীর দিকে একভাবে চেয়ে রইলেন সৌদামিনী দেবী।ওনার নিজের দুচোখের পাতাও ভারী হয়ে এসেছে।এই হালকা হলদেটে রংটা চৈতী আজও ছাড়তে পারে না।বৌদির দৃষ্টি ননদ কতখানি পড়তে পারলো,তা জানা নেই সৌদামিনী দেবীর।কিন্তু উনি এগিয়ে গিয়ে চৈতীর হাতের ওপর হাত রাখলেন...

-ও মামী,খিদে পেয়েছে তো!

তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে এসে,চৈতীর একমাত্র কন্যা মামনিকে জড়িয়ে ধরে আদর করে নীচে নামলেন সৌদামিনী দেবী।এগিয়ে গেলেন ডাইনিং টেবিলের দিকে....হলুদ শাড়িটার ওপর হাত রেখে চুপ করে বসে রইলো চৈতী।সমস্ত ভালোবাসা আজও যেন হলুদ রঙয়ের মোড়কেই বন্দী হয়ে রয়েছে।বিছানা থেকে নেমে,নিজের ঘরের কাঁচের শো-কেস খুলে চৈতী বের করে আনলো ছোট্ট একটা মাটির রাধাকৃষ্ণের মূর্তি...এটা একদিন রাসের মেলা থেকে কিনে দিয়েছিলো সে....সেদিন মা গিয়েছিলেন কাকিমাদের বাড়ির রাধাগোবিন্দর পুজোয়।দাদা সেদিন,নীল-রাত্রি আর চৈতীকে নিয়ে বেরোচ্ছিলো মেলায় যাবে বলে।সেই সময়ই মাস শেষ হওয়ার আগে,নিজের প্রাপ্য বেতন থেকে কিছু টাকা আগাম নিতে,সে এসে দাঁড়ায় ওদের বাড়িতে।তাকে হাসিমুখে সেই টাকা দেওয়ার পর,সেদিন সন্ধ্যায় দাদার অনুরোধে সেও ওদের সঙ্গী হয়েছিলো।মেলার ভিড়ে নীল আর রাত্রির দৌড়াদৌড়ি-হুড়োহুড়ি সামলাতে দাদা যখন নাজেহাল হয়ে যাচ্ছিলো,তখন ওদের দুটিকে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলো একটা খেলনার দোকানের দিকে।সেই সময় চৈতালী ব্যস্ত ছিলো কিছু বাহারি গয়না-চুড়ির দোকানগুলোতে।একের পর এক দোকানী পসরা সাজিয়ে বসেছিলো মেলাপ্রাঙ্গনে।বেশ কয়েকটা কানের দুল দেখার পর,একজোড়া কানের দুল পছন্দ করায়,দোকানী সেদিন তার দিকে এগিয়ে দিয়েছিলেন একটা ছোট আয়না...

আয়নার সামনে ওই রাধাকৃষ্ণের মূর্তিটা হাতে নিয়ে দাঁড়ালো চৈতী।ওর অতীতটা জলছবির মতো এক মুহূর্তেই ভেসে উঠলো ওই আয়নায়...যুবতী চৈতী এসে হাজির হলো ওর সম্মুখে।মুহূর্তেই মনটা পৌঁছে গেলো মেলাপ্রাঙ্গনে....

-ও দাদা!শুনুন না,এটার ঝুমকোগুলো আর একটু বড় হবে না?এটা ভালো লাগছে না!
-না দিদি!এটা একটাই আছে।
-ওঃ!!কিন্তু এটা না আর একটু বড় হলে....

কানের ওপর দুলটা ধরে আয়নায় চোখ রেখেই,অবাক হয়ে গেলো চৈতী।একটু দূরে দাঁড়িয়ে সেই লাজুক যুবক চশমার ভিতর থেকে একভাবে ওর দিকেই চেয়ে আছে,আয়না দিয়ে চৈতী স্পষ্টই দেখলো।মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে চাইতেই,সে অন্যদিকে ফিরলো ঠিকই।তবে দাঁড়িয়ে রইলো ওইদিকেই....কানের ওপর আবার ওই দুলটা ধরলো চৈতী।তারপর চাইলো তার দিকে।সে আবার চেয়ে রয়েছে।একটু যেন ঠোঁটের কোণে আলগা হাসির ছোঁয়ায় পছন্দের ইশারা....দুলটা দোকানীর হাতে তুলে দিয়ে চৈতী বললো,

-এটাই দিন!

দুলটা হাতে নিয়ে মেলার অপর প্রান্তের দিকে এগোলো চৈতী।কিন্তু দাদা,রাত্রি বা নীল,কাউকেই খুঁজে পেলো না।

-এদিকে আসুন।ওরা ওই জিলিপির দোকানের ওদিকে আছে।
-আপনি দেখেছেন?
-হ্যাঁ।আমি তো খেয়াল রাখছিলাম কে-কোথায় যাচ্ছে!হারিয়ে গেলে এই ভিড়ে খুঁজে পাওয়াটাই তো মুশকিল!
-খুব খেয়াল রাখছিলেন তো!আমি দেখলাম,আপনি তো শুধু আমাকেই দেখেছিলেন!
-কি!!নানা...তা নয়!ওরা সত্যিই ওইদিকে আছে,আপনি আসুন!

অপ্রস্তুত হয়ে গেলো রুদ্রশেখর.....

-খুব তো মুখ লুকিয়ে পালাচ্ছেন রুদ্রদা!বাদামভাজা খাবেন নাকি?
-আসুন।আমি খাওয়াচ্ছি!
-থাক!মাস শেষ না হতেই দাদার থেকে মাইনেটা আগাম চেয়ে নিলেন।সেটা কি ছাত্রের পিসিমনিকে বাদামভাজা খাওয়ানোর জন্য?
-না!তা ঠিক নয়।আসলে বড্ড দরকার।মেসের দু মাসের টাকা বাকি পড়েছে।কিছু টাকা না দিলেই নয়।দুটো ছোট-বড় কথা বলে দিলে,বড় সম্মানে লাগে চৈতালীদেবী!
-আপনি চাকরীর চেষ্টা করছেন না কেন?
-করছি তো!করলেই কি আর চাকরী পাওয়া যায়,বলুন তো?আপাতত এই কয়েকটা টিউশনিই যা ভরসা।নিজের খরচ চালিয়ে,মেসের টাকা দিয়ে,তার ওপর গতমাসে মা অসুস্থ থাকায় বাড়িতে একটু বেশি টাকা পাঠাতে হয়েছে,তাই এইদিকে টান পড়ে গেছে।ওই জন্যই দাদার থেকে কিছু টাকা চেয়ে নিলাম।জানি রজতদা আমায় না বলবেন না!তাই সেই ভরসা থেকে বাইরে ধার না করে,মুখ ফুটে চেয়েই ফেললাম।
-বেশ করেছেন।প্রয়োজন হলে আবার চাইবেন।টাকার জন্য কষ্ট করবেন না যেন।দাদা ঠিক দিয়ে দেবে।শুধু মাইনে নয়,এমনিতেও টাকার প্রয়োজন হলে,আমাদের বাড়িতে একটিবার জানাবেন রুদ্রদা...
-সাহস বাড়িয়ে দিচ্ছেন কিন্তু!এবার যে কোনো ধরনের প্রয়োজনে আপনাদের কাছেই হাত পাতবো।তখন কিন্তু আর ফেরাতে পারবেন না।
-ফেরাবো না!
-কথা দিচ্ছেন তো চৈতালীদেবী?

-স্যার!!শিগগির আসুন এদিকে।একটা বই পেয়েছি....আপনি সেদিন পড়াতে বসে বিবেকানন্দের গল্প করছিলেন না....
-না স্বপ্ননীল!!আমি তো এখনও বিবেকানন্দ পর্যন্ত পৌঁছইনি।আমি তো তোমাকে বিলে আর নরেনের গল্প করেছিলাম।বিবেকানন্দকে বুঝতে গেলে তোমাকে আরও একটু বড় হতে হবে।আরও পড়তে হবে...
-আচ্ছা আসুন না!দেখে যান না বইটা।কিনবো?বাবা বললো,আপনাকে নিয়ে যেতে।রাত্রি কতগুলো ছবির বই কিনেছে দেখবেন আসুন....

নীলের টানাটানি আর জোরাজুরিতে ওরা সেদিন হারিয়ে গিয়েছিলো মেলার ভিড়ে....

-রুদ্রদা?
-বলুন?
-আপনি ঈশ্বরপ্রেম বলতে কি বোঝেন?সেদিন আমি শুনছিলাম,আপনি নীলকে বোঝাচ্ছিলেন ঈশ্বরপ্রেমের কথা....বাইরে থেকে শুনছিলাম অবশ্য।আপনার জানার কথা নয়।বেশ লাগছিলো কিন্তু শুনতে!
-তা হলে আমার বেতন কিন্তু বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।আমি তো পড়াচ্ছি রাত্রি আর নীলকে।কিন্তু ফাঁকতালে শিক্ষা নিচ্ছে বাড়তি আরও একজন!এ তো ভালো কথা নয়!ফাঁকি দিয়ে চুরি করে পড়ে নেওয়া....
-ভারি অন্যায় হয়ে গেছে তো!
-হয়েছেই তো!
-তার শাস্তি কি কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা?এই রে!গেলো জামা নষ্ট হয়ে....এই জিলিপির সব ভালো।কিন্তু কথা নেই-বার্তা নেই,কামড় দিলেই এমনভাবে রস গড়িয়ে পড়ে হাত দিয়ে....
-চৈতালীদেবী...এই নিন!রুমাল!
-হুম।ধন্যবাদ!বললেন না তো...ঈশ্বরপ্রেম কি ও কেন?
-আপনারা তো মূর্তিপুজোয় বিশ্বাসী?তাই না?
-না মানে মা বাড়িতে পুজো করে।আমিও ওই একটু প্রণাম ঠুকে আসি।
-আমি কিন্তু মূর্তিপুজোর ঘোর বিরোধী চৈতালীদেবী।
-বলেন কি!তাহলে তো আপনার সঙ্গে আমার মায়ের একেবারেই আড়ি!
-না...তা নয়।আমি মূর্তিপূজায় একটু অবিশ্বাসী ঠিকই,কিন্তু মানুষের মাঝে অবস্থিত ভগবানে বিশ্বাসী!কেউ মূর্তিকে পুজো করলে,ভক্তি করলে,কোনো নির্দিষ্ট মূর্তির দিকে চেয়ে প্রার্থনা করে মনের শান্তি খুঁজে পেলে,তাকে যেমন সম্মান করতে আমাকে আমার বিমূর্ত ভগবান শিখিয়েছেন,ঠিক তেমনিভাবে কেউ আমার দলে নাম লেখালে,তাকে ভালোবাসতে,সম্মান করতেও আমার কোনো অসুবিধেই নেই।নীল-রাত্রিকে যখন পড়াতে যাই,তখন প্রতিদিন সন্ধ্যায় শঙ্খ-ঘন্টা বাজিয়ে পুজো দিয়ে আপনার মা বাড়ি মাথায় করেন।আমার তো বেশ ভালোই লাগে ওই ধুনোর গন্ধ।আপনার মায়ের কাছে যদি ধুনো সংসারের মঙ্গল কামনায় পবিত্র সুগন্ধী হয়,তবে আমার কাছে তা মশা তাড়ানোর অব্যর্থ ওষুধ।তাই ধুনো ভালো,ধূপ ভালো...সব ভালো!আমি যে মানুষ যেমন,তাকে ঠিক তেমনভাবেই ভালোবাসি চৈতালীদেবী।তাই বিচার করতেই ভুলে যাই।আমার কাছে মানবপ্রেমই ঈশ্বরপ্রেম!এবার বলুন....আর কি জানতে চান!
-মা যদি জানতে পারে,পড়ার বইয়ের পাশাপাশি আপনি তার একমাত্র নাতিকে এইসবও শেখাচ্ছেন,আপনার কিন্তু চাকরি গেলো!
-গেলে আর কি করা যাবে!আবার প্রয়োজনে না হয় আপনাদের কাছে গিয়েই বলবো,একটু সাহায্য চাই!চাকরি ছেড়ে দিলেও,আমাকে বিপদের দিনে ফিরিয়ে দেবেন না আশা করি।এটুকু ভরসা রজতদার ওপর আমার আছে।এই শহরে আসার পর ওনার মতো দরাজ মনের মানুষ,আমি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি।হ্যাঁ যদি ভগবানের কোনো মূর্তি থাকে,তবে তা আমার আছে আপনার দাদার মতোই দেখতে হবে!এটা আমি নিশ্চিতরূপে বলতে পারি!
-হুম....দাদাকে নিয়ে মায়েরও গর্বের শেষ নেই।মানুষটাও ভালো।শুধু ওই বিয়েটা এমনভাবে করে বসলো।এতগুলো বছর পরেও,মা আজও বৌদিকে ঠিক মানতে পারে নি....

চুপ করে রইলেন রুদ্রশেখর....

-কি হলো?কথা বলছেন না যে!
-আমি একজন বাইরের মানুষ চৈতালীদেবী।আপনাদের পারিবারিক ব্যাপারে কথা বলা নিতান্তই অনুচিত।এ ধৃষ্টতা দেখাই কোন দুঃসাহসে?তবে কানাঘুষোয় শুনেছিলাম ওনাদের প্রেমের বিয়ে!
-ঠিকই শুনেছেন!মা মানেনি কিছুতেই।নেহাৎ দায়ে না পড়লে,কেউ ওইরকম একটা বোবা মেয়েকে বাড়ির বউ করে আনে নাকি!!দাদা সেই সময় ওকে বিয়ে করবে বলে যা শুরু করেছিলো....
-প্রেমই তো!
-আরে প্রেম হোক আর যাই হোক!একটামাত্র ছেলের বউকে কেউ অমন মানতে পারে!!মা বলে,দাদার তখন মাথা খারাপ হয়ে গেছিলো...মানসিক বিকারগ্রস্ত হলে,তবেই মানুষ জেনেশুনে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেয়!
-হাসালেন চৈতালীদেবী!!
-কেন?!
-পৃথিবীর সর্বাধিক বিকৃত ও বিক্রীত বিষয় কি জানেন?
-কি?!
-দেখুন জীবনে চাহিদার কথা বলতে গেলে খিদে-তৃষ্ণা-আশ্রয় তো একেবারে প্রথম সারিতে পড়বে।কিন্তু তারপরই বিলাসিতার কথায় এলে,একেবারে প্রথমেই আসবে কিন্তু প্রেম!এই শব্দটাকে আপনি কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারবেন না।আর এই প্রেম যতটা সুন্দর,ঠিক ততটাই কিন্তু বিকৃত!আবার একইসঙ্গে বিক্রীতও বটে!অস্বীকার করতে পারবেন?
-বিকৃত?কেন?
-কারণ পৃথিবীর সমস্তরকম সম্পর্কের মধ্যে,একমাত্র প্রেমের সম্পর্কেই কিন্তু বৈধতা-অবৈধতা আছে।আর এইমাত্র আপনিই বললেন,প্রেমে পড়লে,আপনার মায়ের কথা অনুযায়ী মানুষ বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে,লোপ পায় বাহ্যজ্ঞান।তাই যে প্রেম রজতদার কাছে পবিত্র,সেই প্রেমই আপনার মায়ের দৃষ্টিতে বিকৃত।তিনি সন্তুষ্ট নন ছেলের সিদ্ধান্তে।আর বিক্রীত কেন?তা তো সকলেরই জানা!চৈতালীদেবী,এই মনের কাছেই তো আমরা বিকিয়ে যাই প্রতিটা মুহূর্তে,নিজেদেরই অজান্তে।প্রেমের চেয়ে বড় পণ্য,আপনি আর কোথায় পাবেন চৈতালীদেবী!প্রেমকে সামনে রেখেই তো কতশত ব্যবসা!আমরা শৈশবে কি জানতাম,ভালোবাসারও কোনো দিন হয়!!আমাদের কাছে প্রতিটা দিনই ছিলো ভালোবাসার দিন।কিন্তু এখনকার প্রজন্মর কাছে শিখলাম,ভালোবাসারও নাকি একটা নির্দিষ্ট দিন হয়।সেদিন প্রেমিক প্রেমিকাকে,এবং প্রেমিকা প্রেমিককে উপহার সামগ্রী দেয়।প্রেমকে সামনে রেখে ওই একটি দিনের জন্য এত আয়োজন,এত ব্যবসা!সেজে ওঠে শহর।ওটা ছাড়াও দুই প্রেমাস্পদের চারহাত পরিবারিকভাবে একত্রিত করে দেওয়ার জন্য এত আড়ম্বর,এত খরচখরচা...সবই তো প্রেমের পরিণতি প্রদানের জন্য,প্রেমের জন্যই তো...এরপরেও আপনি বলবেন,প্রেম বিক্রীত নয়!!
-বৌদিকে বুঝতে পারিনি কোনোদিন।অন্তত আপনার মত করে তো নয় রুদ্রদা।কি জানি,হয়তো বুঝতেই চাইনি...
-সৌদামিনী বৌদি আমার কাছে মায়ের সমান চৈতালীদেবী।আর আমরা এতটাও বড় হয়ে যাইনি,যে মায়েদের বুঝে উঠতে পারবো।সে আপনার মা বলুন,আমার মা,বা মায়ের সমতুল্য সৌদামিনী বৌদি।এনাদের সবাইকেই আমি একটা শ্রদ্ধার জায়গায় বসিয়েছি।তাই বেশি বুঝতেও চাই না।বিচার করতে বসলে,ভালোবাসার মূল্যবান সময়টা যে হেলায় হারিয়ে ফেলবো!
-নীলকে নিজের মতো করে তৈরি করুন রুদ্রদা!আমার মা বা আমার মতো যেন না হয়!
-না।স্বপ্ননীল মুখার্জী নিজের মতো হবে।কাউকে অনুসরণ বা অনুকরণ করবে না।আমার অনেকখানি আশা আছে ওকে নিয়ে।ও একদিন অনেক বড় হবে।অবশ্য জীবনে যত এগোবে,তত ওর শিক্ষাগুরু পরিবর্তন হতে থাকবে।আমি হয়তো আর কিছুদিন পর ওর জীবনে থাকবো না।কিন্তু আমার শিক্ষার এক শতাংশ যদি ও মনে রাখে,সেখানেই তো আমি সফল।সেদিন হয়তো নিজের কোনো কাজের মধ্যে দিয়েই ও আমাকে মনে রাখবে....আর আপনার বা আপনার মায়ের মতো নয় কেন বলছেন!আপনারা তো সবাই আমার কাছে সমান,সম্মানীয়া।আমি আপনাদের সকলকেই নিজের জন মনে করি।সম্মান করি,ভালোবাসি....
-ভালোবাসেন?!

-ও পিসিমনি!চলো না।ওই নাগরদোলাটা চড়বে।কেমন বনবন করে মাথা ঘুরবে,দেখবে চলো!!

রুদ্রশেখরের সঙ্গে কথায় বিভোর হয়ে গিয়েছিলো চৈতালী।নিজের চটচটে হাতটা রুদ্রদার রুমালে মুছে,ওই রুমালটা রুদ্রকে আবার ফিরিয়ে দিলো ও।স্বপ্ননীলের পিছনে রাত্রির হাত ধরে দাদা আসছে।চেঁচিয়ে উঠলো রজত,

-এই নীল!আর না!রাত্রি বমি করছে!আমারও পেট গুড়গুড় করছে!আমি আর চড়তে পারবো না!
-চৈতালীদেবী?যাবেন নাকি!!
-না বাবা!আমার খুব ভয় করে।সেই জন্যই তো দাঁড়িয়ে আছি।গেলে তো আগেই যেতে পারতাম।
-স্যার আমি যাবো।আরও একবার চড়বো।আপনি চলুন না আমার সঙ্গে!
-আচ্ছা চলো।রজতদা,আমি নীলকে নিয়ে উঠছি।আপনি রাত্রি আর চৈতালীদেবীকে নিয়ে এখানেই অপেক্ষা করুন।
-এ পেঁচি!চললাম।তুই বমি কর,আর দেখ!আমি আবার হুশ করে ওপরে উঠবো আর নীচে নামবো!তুই ভীতুর ডিম!

হাসিমুখে স্বপ্ননীলের হাত ধরে নাগরদোলার দিকে এগোলো রুদ্রশেখর....

-এখন আমারই মাথা ঘুরছে!
-কেন?খুব তো বীরপুরুষ হয়ে গেলেন!
-না সত্যি!অনেকদিন পর তো!বুকের ভেতর কেমন যেন ঢিপঢিপ করছে।গলা শুকিয়ে গেছে!
-আমি একটু আসছি!
-এই চৈতী,কোথায় চললি?অ...মাটির পুতুল!
-আসছি রে দাদা!দাঁড়া!
-কি জ্বালা বলো তো রুদ্র!তিনটেই ছেলেমানুষ।আমি কোনটাকে সামলাই!?চৈতীটা এতবড় হয়ে গিয়ে,এখনও পুতুল দেখে কেমন দৌড়াদৌড়ি করছে!
-আমি দেখছি।রাত্রি বোধহয় ঘুমিয়ে পড়লো।
-হ্যাঁ।বমি করে ক্লান্ত হয়ে গেছে!
-নীল যাবে?পুতুল কিনবে?তোমার পিসি তো ওইদিকেই গেলো!
-না স্যার!আমি কি পুতুল খেলবো?আমি আমার পছন্দের কয়েকটা বই কিনে নিয়েছি।আর কিছু লাগবে না।আচ্ছা চলুন,পেঁচিটার রান্না করার জন্য খেলনা হাঁড়ি-বাসন কিনে আনি।ও তো বাবার কোলে ঘুমিয়েই পড়লো।বাবা টাকা দাও তো...
-না রজতদা।লাগবে না।আমিই কিনে দেবো।চলো নীল!
-কি দরকার রুদ্র!?আমি দিয়ে দিচ্ছি!
-ঠিক আছে।এটুকু আমি পারবো।চলো নীল!কি কিনবে আমাকে দেখাও...

ছাত্রের হাত ধরে সেই দোকানের দিকে এগিয়ে গেলো রুদ্র,যেখানে রংবেরংয়ের মাটির পুতুল সাজানো রয়েছে।আর সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখছে চৈতালী....

-কি নেবেন আপনি?এই যে,নীলও কিসব কিনবে!
-তুই কি কিনবি নীল?
-পিসিমনি রান্নাবাটি কিনবো!
-কি!!
-পেঁচি খেলবে।ও রান্না করবে,আমি ও চুল ধরে টেনেই পালাবো।আর ও রান্না করতে-করতে চেঁচাবে!!

হেসে উঠে একটা প্লাস্টিকের মধ্যে ভরে রাখা কতগুলো থালা-বাসন-হাতা-খুন্তি-চামচ নীলের হাতে তুলে দিলো রুদ্রশেখর।

-আর আপনি কি নিচ্ছেন চৈতালীদেবী?
-দেখছি!এই রাধাকৃষ্ণের মূর্তিটা আমার বেশ লেগেছে!তবে কৃষ্ণের নাকটা একটু যেন ত্যাবড়া!আর নেই বলছে।আমার কপালটাই খারাপ জানেন তো রুদ্রদা!তখন কানের দুলও একটাই ছিলো,এখন এই মূর্তিও একটাই রয়েছে।এইরকম জিনিস আর দ্বিতীয়টি নেই!
-তাহলে তো আপনার নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করা উচিত!যে অন্তিম জিনিসটি অন্তিম মুহূর্তে এসেও আপনারই হলো,অন্তত হাতছাড়া তো হলো না!
-ধুর!ভাঙা মেলায় এইরকম জিনিস পাওয়া যায়।আমি প্রথমে এসে টাকা দিয়ে কেন নেবো এসব নাক ত্যাবড়া জিনিস!?
-রাসের মেলায় এসেছেন,আবার রাধাকৃষ্ণের মূর্তিই হাতে তুলে নিয়েছেন।এরপরেও এত হিসেব করবেন চৈতালীদেবী?আপনি প্রেমিকের প্রেমটুকু উপলব্ধি করুন না!!সেই উপলব্ধির মাঝে প্রেমিকের নিখুঁত চেহারা কি খুব প্রয়োজন!!যদি নিতান্তই প্রয়োজন হয়,প্রেমিকের রূপে প্রেম আটকায়,তবে না হয় চোখ বন্ধ করেই তাকে ভালোবাসবেন!তারপর যখন চোখ খুলে তাকে দেখবেন,তখন আর তার কোনো খুঁত খুঁজে পাবেন না!এত ভাববেন না।নিয়ে নিন!আমি কিনে দিচ্ছি!!
-এই নানা!
-আরে সবই তো আপনি আর রজতদাই করলেন,এমনকি জিলিপি,বাদামভাজাও আপনারাই খাওয়ালেন।এটুকু না করতে দিলে আমার বড় খারাপ লাগবে!দাদা,এই খেলনা আর এই রাধাকৃষ্ণের দাম কত?

-মা....খেয়ে যাও!মামী ডাকছে তো!
-আসছি মামনি!

মেয়ের ডাকে মেলাপ্রাঙ্গণ থেকে ফিরলো চৈতী।আজ ওর চোখ থেকে বহুদিন পরে ভালোবাসার কারণে জল বেরোলো।ভালোবাসতেই ভুলে গেছে ও।শ্বশুরবাড়িতে থাকতে দুচোখে যেটুকু জল আসে,বিদ্যুতের মানসিক অত্যাচারের কারণে আসে।বহুদিন হয়ে গেলো,ভালোবেসে কাঁদা হয় না।রাধাকৃষ্ণের মূর্তিটা আবার যথাস্থানে সযত্নে ঢুকিয়ে রাখলো চৈতী।আয়নার সামনে দাঁড়ালো ও....সেইদিনের মেলাপ্রাঙ্গন থেকে হাতে করে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি বয়ে নিয়ে আসা সেই ষোড়শী চৈতালীর সঙ্গে,আজকের মা হয়ে যাওয়া চৈতীর কোনো সাদৃশ্যই নেই।মেদ জমেছে শরীরের প্রতিটি ভাঁজে।চোখের কোলে গভীর কালি।মুখে বিন্দুমাত্র লালিত্যের আভাসটুকুও নেই।সব রং,সব আভা শুষে নিয়েছে ওই সংসার।চৈতীর পরিপূর্ণ সংসার।স্বামীসুখে আজ অতিরিক্ত সুখী সে।তবে যে সেদিন রুদ্রদা বলেছিলো,

"চোখ বন্ধ করেই তাকে ভালোবাসবেন!তারপর যখন চোখ খুলে তাকে দেখবেন,তখন আর তার কোনো খুঁত খুঁজে পাবেন না!"

ভবিতব্যকে মেনে নিয়ে চোখ বুজেই তো বিদ্যুৎকে ভালোবেসেছিলো চৈতী।বিয়ের পর তো স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষকে মনের ঘরে সামান্য প্রশ্রয়টুকুও দেয়নি।তবে আজ হঠাৎ করে এত বছর পর মেলাপ্রাঙ্গনে মনটা হারিয়ে গেলো কেন!কেন আজও হলদেটে রং দেখলে,বুকের মাঝে মৃদু কম্পন অনুভূত হয়?!কেন আজ এত বছর পর আবার তার স্মৃতি কাঁদিয়ে দিলো!?তার কোনো সংবাদই তো,চৈতী আর রাখেনি।শেষ সংবাদ অনুযায়ী কোন এক আপিসে দপ্তরীর কাজ পেয়েছিলো সে।তারপরই হঠাৎই একদিন এ টিউশনি ছেড়ে দেয়।নীল ওই স্যারের কাছে পড়বে বলে কেঁদে ভাসিয়ে দিলেও,আর ফেরেনি সে!কেন?সে উত্তর আজ আর কেউ জানে না।মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গে হারিয়ে গেছে সকল প্রশ্নের উত্তরও....চৈতীর কাছে রয়ে গেছে শুধু এই রাধাকৃষ্ণের অনন্ত প্রেম....

বুকটা ভারী হয়ে গেছে।সদাসর্বদা মুখ চালাতে থাকা চৈতালী,জীবনের একটা পর্যায়ে পৌঁছে হঠাৎ করেই আজ নির্বাক হয়ে গেলো।বুক ফেটে যেতে লাগলো এক অব্যক্ত কষ্টে।কিন্তু কথার খেই হারিয়ে যাওয়ায়,কয়েক মুহূর্তের জন্য নিজেকে আড়াল করতে মৌনতার পথই বেছে নিলো চৈতী....সিঁড়ি বেয়ে চুপচাপ নেমে গেলো দোতলায়....

-কি হে খুদে মাস্টার?ভালো আছো তো?

ছাদে উঠেই অন্তু দেখলো পাশের বাড়ির ডাক্তার জ্যেঠু ওই ছাদে পায়চারি করছে।ও বইটা রেখে পকেট থেকে হাত বের করে নিলো।হাসিমুখে এগিয়ে গেলো ছাদের কার্নিশের দিকে....

-আমি ভালো আছি ডাক্তার জ্যেঠু।তুমি কেমন আছো?আজ বেরোওনি তোমাদের লাফিং ক্লাবে?!বাবাও তো বেরোলো না।শুয়ে আছে দেখলাম।
-না মাস্টার!ঠান্ডা লেগেছে বড্ড।বুকে কফ বসে গেছে।ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে আসে।আর গায়ে ঘাম বসে ঠান্ডা হাওয়াটা লেগে আরও সর্দি বসে গেছে।তাই দুটো দিন একটু বিশ্রাম নিচ্ছি।শরীরটা একটু সুস্থ হোক,তারপর আবার বেরোবো!আমি নামলাম খুদে মাস্টার।অনেকক্ষণ উঠেছি ওপরে।
-এসো জ্যেঠু!
-এবার কদিন আছো তুমি?
-এই আর তিন দিন।তারপর আবার ফিরে যাবো।
-আচ্ছা-আচ্ছা!ভালো থেকো,শরীরের যত্ন নিও।
-হুম!
-এলাম...
-আচ্ছা!!

ছাদে উঠেই জ্যেঠুর মুখোমুখি পড়ে গিয়ে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলো আন্তরিক।সিগারেটের প্যাকেটে হাতটা রেখেও,আবার হাতটা পকেট থেকে বের করে নিতে হয়েছিলো।বড্ড কাঁদতে ইচ্ছে করছে।যতবার ওর কাঁদতে ইচ্ছে করে,ততবার ও সিগারেটের ধোঁয়ায় কষ্টগুলোকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।কিন্তু তাতে ফুসফুস আরও একটু ঝাঁঝরা হয় ঠিকই,কিন্তু বুকের চাপা কষ্টটা একটুও প্রশমিত হয় না!সিগারেটটা হাতে নিয়ে অন্যমনস্কভাবে আকাশের দিকে চেয়ে রইলো আন্তরিক।পাশে হেলানো আরামকেদারাটায় "সঞ্চয়িতা" পড়ে রয়েছে।আন্তরিকের মন দূর আকাশে ওই নাম-না-জানা উড়ন্ত কৃষ্ণবর্ণ পাখিগুলোর সঙ্গেই ঘরছাড়া হয়ে গেছে।আর কোনো কর্তৃত্ব নেই মনের ওপর।বারংবার সে ফিরতে চায় সুন্দর অতীতে।আকাশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আন্তরিক চাইলো "সঞ্চয়িতা"-র দিকে।লাল চামড়া দিয়ে বইটা বাঁধাই করা রয়েছে।ঝুমই করে দিয়েছিলো।আন্তরিক বইয়ের পোকা হলেও,বইপত্র যত্নের বেলায় অষ্টরম্ভা।সেসব জেনেই বইটা সুন্দর করে বাঁধিয়ে দিয়েছিলো ঝুমুর।লাল চামড়াটার ওপর পরম মমতায় হাত বোলালো আন্তরিক।এইরকম লাল রক্তেই সেদিন ভিজে গিয়েছিলো ঝুমুরের কপালটা...নতুন চশমা পরে ওর জন্য রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে-করতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলো আন্তরিক।প্রথমদিনে ফোন নম্বরও আদান-প্রদান হয়নি,যে ফোন করে জিজ্ঞেস করবে ও কোথায় আছে!শেষ পর্যন্ত একরাশ দুশ্চিন্তাকে সঙ্গী করে হাসপাতালের অভিমুখে রওনা দিয়েছিলো অন্তু....কিন্তু সেখানে পৌঁছেই মুখোমুখি হয়েছিলো এক মর্মান্তিক দৃশ্যের....

সারি-সারি এম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে রয়েছে হাসপাতালের সামনে।পাশেই পুলিশের গাড়ি।লোকজন গিজগিজ করছে হাসপাতাল চত্বরে।দৌড়ে গিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলো আন্তরিক,

-কি হয়েছে এখানে?এত ভিড়?
-দেখুন না দাদা,ডাক্তারদের কি গাফিলতি!!একজন বাচ্চা হতে এসেছিলো,মরেই গেছে।তার বাড়ির লোক হাসপাতাল ভাঙচুর করছে।মারুক!মেরে একেবারে ফাটিয়ে দিক সবকটাকে!

কেঁপে উঠলো আন্তরিক।সবাইকে ঠেলে সামনের দিকে এগোতে চাইলেও,প্রবলভাবে বাধা পেলো পুলিশের কাছে।কথার অবাধ্য হওয়ায় পুলিশের লাঠি এসে পিঠে পড়তে-পড়তে বেঁচে গেলো ও।পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তখন মরিয়া স্থানীয় পুলিশও....কয়েকজন ডাক্তার সামনে এসে দাঁড়ালে জনরোষ যখন আরও বেড়ে উঠলো,সেই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে সামান্য সুযোগে পাশ কাটিয়ে একদৌড়ে ভিতরে ঢুকলো আন্তরিক।দুজন ওয়ার্ড-বয় চেঁচিয়ে ওর দিকে আসতে গিয়েও ওকে লাঠিসোঁটা ছাড়া একা দেখে নিরাপদ মনে করে,আর এদিকে এলো না।আবার দৌড়োলো গেটের দিকে।ভিতরে ঢুকেই আন্তরিক ছুটলো এমার্জেন্সির দিকে।সামনেই দরজার কাঁচ ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে।কেউ কোত্থাও নেই।সাবধানে ভাঙা কাঁচ পেরিয়ে অনুসন্ধানে ঢুকে আন্তরিক দেখলো,চেয়ার উল্টে পড়ে রয়েছে।কাগজপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে,কম্পিউটার,ল্যান্ডফোন ভেঙেচুরে লন্ডভন্ড অবস্থা!কয়েকজন কর্তব্যরত পুলিশ ওখানে উপস্থিত রয়েছেন,আর রয়েছেন হাসপাতালের জনাকয়েক কর্মরতা মহিলা।কিন্তু তাকে তো কোথাও খুঁজে পেলো না আন্তরিক।একজন মহিলাকে ডেকে ও জিজ্ঞেস করলো,

-ঝুমুর প্রামাণিক কি বেরিয়ে গেছেন?ওনার তো ডিউটি আওয়ার পাঁচটার অনেক আগেই ওভার হয়ে গেছে!
-দিদি?!দিদি তো চেঞ্জ করে বেরিয়েই যাচ্ছিলো।আবার চেঁচামেচি শুনে ঘুরে এসেছে।ব্যাস!!দিদির কপালটাই তো ফেটে গেছে।ওরা বাইরে থেকে ইঁট ছুঁড়েছে,দিদি তো সামনেই ছিলো।মাথায় লেগে গেছে।কপালে ব্যান্ডেজ করে দিদি ভিতরে শুয়ে আছে!
-হোয়াট!আমাকে একটু ওনার কাছে নিয়ে যাবেন প্লিজ!কোথায় উনি?
-আপনি কে হন ওনার?
-আমি ওনার বিশেষ পরিচিত।একটু বলুন উনি কোথায় আছেন?!
-সোজা গিয়ে বাঁদিকে যান...

কাগজপত্র,অসংখ্য রোগীর একগাদা রিপোর্ট গোছাতে,আবারও ব্যস্ত হয়ে পড়েন দিশেহারা ওই ভদ্রমহিলা।সেইসঙ্গে উত্তর দিতে থাকেন পুলিশ অফিসারের প্রশ্নেরও....ওনার নির্দেশ অনুযায়ী সামনের দিকে এগোয় আন্তরিক।গিয়ে দেখে একটা বেডের ওপর উঠে বসেছে ঝুমুর।ওড়না ঠিক করে নিয়ে একমনে নিজের ব্যাগ ঘাঁটছিলো ও।

-ঝুমুর!
-এ কি!আপনি!?এখানে এলেন কিভাবে?আরে কিভাবে ছাড়ুন,আপনি এলেনই বা কেন?বাইরে কি অবস্থা!

ঝুমুরের কপালে একটা ছোট ব্যান্ডেজ করা রয়েছে।তাতে রক্তের লালচে বিন্দু হালকাভাবে ফুটে উঠেছে।কিন্তু সেদিকে কোনো হুঁশ নেই মেয়েটার।ও কাজ নিয়েই ব্যস্ত রয়েছে....

-আপনার এ কি অবস্থা!!আরে আপনি কোথায় চললেন?একটু রেস্ট নিন আগে!মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে এভাবে দৌড়োচ্ছেন কেন?

হতবাক আন্তরিক....

-নানা,আমি ঠিক আছি।ও সামান্য একটু কেটে গেছে।রক্তপাতও সামান্যই।আরও দুজন ইনজুওর্ড।ওদের কি অবস্থা একটু দেখে আসি!আপনি বরং আসুন এখন।আমি একটু ব্যস্ত আছি।সাবধানে যাবেন।বাইরে বিক্ষোভের মুখে পড়ে গেলে আর কিন্তু বাঁচতে পারবেন না।পিটিয়ে দেবে।
-আমি কোথাও যাচ্ছি না।এইখানেই আছি।আপনি কাজ সেরে আসুন।আমি অপেক্ষা করছি!

আর কোনো উত্তর দিলো না ঝুমুর।হয়তো দায়িত্বশীলা-কর্মব্যস্ত একজন সেবিকার নিজের ব্যক্তিগত জীবনের কথা ভাবার বড় বিশেষ অবকাশ থাকে না।আন্তরিকের কথায় কর্ণপাত না করে,ঝুমুর বেরিয়ে গেলো ঘর ছেড়ে।হাসপাতালের ওষুধ আর ফিনাইলের গন্ধে কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে বমি পেয়ে গেলো অনভ্যস্ত আন্তরিকের।ও একটা চেয়ারে চুপ করে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো ঝুমুরের জন্য....বাইরে কোলাহল একটু যেন স্তিমিত হলো....

-আপনি এখনও বসে আছেন?যাননি?
-আপনি কেমন আছেন?
-ভালো আছি!

ঝুমুরের কপালের দিকে চেয়ে কান্না পেয়ে গেলো আন্তরিকের।কপালে ব্যান্ডেজ নিয়েও বলছে,"ভালো আছি!" মাথা নামিয়ে নিলো ও...

-এবার আমি বেরোবো!কি হলো?
-এভাবে আহত হয়ে আবারও....

আর বলতে পারলো না আন্তরিক।শব্দরা ভিজে গেছে কান্নার স্রোতে....

-চলুন!নাকি থাকবেন এখানে?
-নাঃ!চলুন!এখানে থাকলে ধরেবেঁধে আবার আমাকে ইনজেকশন দিয়ে দেবে।বাইরে ঝামেলা থেমেছে মনে হয়।
-না!বাচ্চাটার বাবা,মানে বউটার স্বামী কাঁদছে!কান পেতে শুনুন।গোঙানি শুনতে পাবেন।এইসব ঝামেলা একটু পরই থেমে যাবে।কিন্তু শিশুটার জীবনের ঝামেলা তো আর কোনোদিনই থামবে না।
-বাচ্চাটা আছে?
-হুম!মা মারা গেছে।বাইরে আসুন বলছি।আপনি এগোন।আমি একটু ওদের সঙ্গে কথা বলে আসি।আমার মাথা একটু কেটেছে কি না কেটেছে,ওরা চিৎকার করে মাত করে দিয়েছে।একটু বলে যাই!সবদিক সামলে বেরোতে অনেকটা রাত হয়ে গেলো আজ!নিজের মাথাটার জন্য আরও সময় নষ্ট হলো!
-আমি আছি।যত রাতই হোক আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত ছেড়ে আসবো।আপনি কথা বলে আসুন।আমি বাইরে অপেক্ষা করছি!

বেরোনোর সময় আন্তরিক দেখলো,দরজার সামনে সিমেন্টের বাঁধানো চাতালটায় বসে একজন পুরুষ কপাল চাপড়াচ্ছে।তার সঙ্গে সুর করে কাঁদছে আরও কয়েকজন নারী-পুরুষের সম্মিলিত জটলা।অসহায় আন্তরিক এগিয়ে গেলো বাইরের দিকে।হাসপাতালের বাতাস শোকের কারণে কি ভীষণরকম ভারী হয়ে রয়েছে।নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো ওর।কত কষ্ট করে মা একজন সন্তানকে জন্ম দেন!একজন মা তো মরেই গেলেন আজ!ওই পুরুষটির আর্ত-গোঙানিতে মাথাটা ধরে গেলো আন্তরিকের।কার জন্য প্রার্থনা করবে ও!?সদ্য জীবন-সঙ্গিনীহারা ওই পুরুষটির জন্য,সদ্য কন্যাহারা ওই নারীর মায়ের জন্য,নাকি সদ্য-মাতৃহারা ওই একরত্তি শিশুর জন্য!?নাকি এদের হাতে আহত ঝুমুর আর ওর সহকর্মীদের জন্য?!কেঁদেই ফেললো আন্তরিক।চশমাটা খুলে সকলের অলক্ষ্যে চোখটা মুছে নিচ্ছিলো,তখনই ঝুমুর বলে উঠলো,

-কাঁদছিলেন নাকি?!
-কার জন্য কাঁদবো ঝুমুর?বুঝতেই তো পারছি না!
-ওয়াটার ব্রেক করে গেছে অনেক আগেই।বাড়িতে ডেলিভারি হবে বলে বসেছিলো,হসপিটালে আসেনি।অথচ বেবির যা পজিশন,নরম্যাল ডেলভারি হওয়া কোনোভাবেই পসিবল ছিলো না।পেশেন্ট ডাইং কন্ডিশনেই এসেছে।কিচ্ছু করা যায়নি,একজনকেই রাখা গেছে।ওরা বুঝবে না।ওরা বোঝে না।আর ওদের আপনজন মারা গেছে তো!তাই আপনি বরং ওদের জন্যই প্রার্থনা করুন।যে মারা গেছে,তার আত্মার শান্তি কামনা করুন।আর কি বলবো বলুন?
-দাঁড়ান ঝুমুর!যাদের চিকিৎসা করছেন,তাদের কাছ থেকে এভাবে আহত হয়ে,এরপরেও....
-কি এরপরেও?
-এরপরেও তাদের চিকিৎসা করবেন?মনে হয় না,আবার তো এদিক-ওদিক হলেই ওরা ঠিক এইভাবেই মেরে ফাটিয়ে দেবে!

হাঁটতে-হাঁটতেই একটু হাসলো ঝুমুর।সঙ্গে-সঙ্গে যন্ত্রণায় কারণে মাথার ব্যান্ডেজ চেপে ধরলো...

-থাক!আপনার কষ্ট হচ্ছে।কথা বলতে হবে না।চুপচাপ চলুন।এই একটা মৃত্যুতে আমিই বড্ড বেশি আবেগী হয়ে পড়েছি।
-আপনি আমাকে একটা কথা বলুন তো!আপনার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা কি বলে?প্রথম সারির ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে-সঙ্গে,আপনি শেষের বেঞ্চে বসে থাকা ছাত্রছাত্রীকেও তো একই শিক্ষা দেন।আপনি আপনার কাজটুকু করার সময় কি মেপে করেন?সেখানে নিশ্চয়ই কোনো কার্পণ্য করেন না!?তারা আপনার শিক্ষার বিনিময়ে কতটুকু আপনাকে ফিরিয়ে দেবে,দারুণ কোনো রেজাল্ট,নাকি একরাশ হতাশা,শিক্ষাদানের সময় সেটা ভাবতে বসেন কি?
-না!
-শুধু নিজের কাজটুকুই করেন তো?
-হুম!
-আমরাও তাই করি।কি করবো বলুন?আমাদের কাজ আমরা করি,তাদের কাজ তারা করে।তারা সম্পূর্ণ ঘটনা না জেনে,না বুঝে দুর্ব্যবহার করলে,আমরা কি নিজেদের জায়গা থেকে সরে আসতে পারি?সম্ভব নয়!ভুল কি আমাদের তরফ থেকেও থাকে না!?থাকে তো!কখনও তারা ঠিক,কখনও আমরা।তারা ঠিক হলে এইটুকু শাস্তি তো আমাদের প্রাপ্য,এই যেটা আজ আমার কপালে আঁকা রইলো।কারণ আমাদের ভুলের মূল্যটা অনেক বড়!আর সেই মূল্যটা রোগীর পরিবারকেই দিতে হয়।আজকের এই ব্যাপারটা না হয় হলোই বা অকারণে।হয়তো আমাদের তরফ থেকে কোনোদিনও কোনো ভুল হয়েছিলো,এটা তারই শাস্তি।কারোর না কারোর ভুলের শাস্তি আমি পেলাম।এভাবেই মনকে প্রবোধ দেবো,আবারও নতুনভাবে কাজে ফিরবো!এসব হয়েই থাকে।আপনি এত ভাববেন না!দুদিন খবরের হেডলাইনে থাকবে,তারপর বড় কোনো ক্ষতি না হলে আমরাও আর সেভাবে মনে রাখবো না।কাজে নিজেকে ডুবিয়ে দেবো।আর তারাও অসুস্থ হলে আমাদের কাছেই তো চিকিৎসার জন্য আসবে।আবারও সেই আমাদেরই ভরসা করবে।নইলে আর যাবেই বা কোথায়?তাই কি হবে,এতসব মনে রেখে!যত তাড়াতাড়ি কাজের স্বাভাবিক ছন্দে ফেরা যায় আর কি!শুধু পেশেন্টকে তার বাড়ির লোকের সঙ্গে হাসিমুখে ফিরে যেতে না দেখলে,আমার বড় কষ্ট হয়!কিন্তু এরা মাঝে-মধ্যে নিজেদের ভুলে পরিস্থিতিটা এমন জটিল করে ফেলে,কি আর বলবো?!
-মৃত্যু খুব কঠিন একটা পরিস্থিতি!ওই ভদ্রলোক করিডোরে বসে কাঁদছিলো!আমি সহ্য করতে পারছিলাম না ঝুমুর!
-হুম!!
-আমি মরে গেলেও সবাই এইভাবেই কাঁদবে!কিন্তু আমি তো তখন জানতেও পারবো না।তাই না!?
-এ আবার কেমন কথা!
-না...আমি মরে গেলে?কাঁদবে তো আপনজনরা!কাছের মানুষরা?

রাস্তার পাশে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো ঝুমুর।তারপর বললো,

-শুধু আপনি কেন আন্তরিক!আপনি-আমি সবাই মরে গেলেই,আমাদের আপনজনরা অবশ্যই কাঁদবে।অন্তত যাদের জন্য কাঁদার লোক আছে!এটা তো নতুন কিছু নয়!কিন্তু তখন তাতে আমাদের কি হবে আন্তরিক?
-মানে?আমাদের ভালোবাসার জন চোখের জল ফেলবে আমাদের জন্য....
-শুধুই কি ভালোবাসার জন?আপনার মৃত্যুর পর আপনার শত্রুও কিন্তু আপনার মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে দু-ফোঁটা চোখের জল ফেলে বলে যাবে,আহা!মানুষটা বড় ভালো ছিলো!কিন্তু সেই কথায় সেই মুহূর্তে আপনার আর কোনো লাভ-ক্ষতি,কিছুই হবে না!তাই অকারণে আবেগী হবেন না।মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে শিখুন!যতদিন বেঁচে আছেন,কর্মে বিশ্বাস রাখুন।আমার মৃত্যুর পর আমার জন্য কে কাঁদবে,আদৌ কেউ কাঁদবে কিনা,সেসব চিন্তাধারাকে মনে জায়গা দেবেন না!কিভাবে নিজে ভালোভাবে আরও দুটো দিন এই সুন্দর পৃথিবীর বুকে বাঁচবেন,ভালোবাসার মানুষদের সুখ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখবেন,সেটা ভাবুন!তারপর মৃত্যু যখন আসার,তখন তো আসবেই।তার সময় হলে আপনি তো তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না!সে ক্ষমতা আপনার-আমার কারোরই হাতে নেই।
-আচ্ছা বেশ!মৃত্যুর কথা আজ না হয় থাক।জীবদ্দশায় কেউ আপনার জন্য কাঁদলে আপনার কিছু আসে-যায় না ঝুমুর?আপনি কি সত্যিই এতটা অনুভূতিহীন?

ঝুমুর কয়েক মুহূর্ত আন্তরিকের চোখের দিকে চেয়ে রইলো,তারপর বললো,

-বাসস্ট্যান্ড প্রায় এসেই গেছে।আমি যেখানে পিজি থাকি,সেই বাড়িটা বাস থেকে নেমে খুব বেশি দূরে নয়।আমি একা চলে যেতে পারবো আন্তরিক।আপনাকে আসতে হবে না।
-প্রথমত,আমি সঙ্গে যাবোই।আপনার কোনো বারণ আজ অন্তত আমি শুনবো না।আর দ্বিতীয়ত,এটা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়।আপনি এড়িয়ে গেলেন কিন্তু....
-ইস!!চশমা পরে তো বেশ সুন্দর লাগছে আপনাকে!
-আপনার মুখে এই ইস শুনলেই আমি সব কষ্ট ভুলে যাই।কিন্তু আজ আর ভুলবো না।চশমা পরে আমাকে ভালো লাগছে,তার জন্য আপনাকেই ধন্যবাদ।তাও আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম না!
-কি জানতে চান,বলুন?
-ধরুন আপনি বেঁচে থাকতেই,কেউ আপনার জন্য কাঁদলে আপনার কিছু আসে-যায় না?
-দেখুন আমি এতকিছু বুঝি না,আমি শুধু এটুকুই বুঝি,আমি আজ মারা গেলে আমার জন্য অনেকেই কাঁদবে।আমার কাকুমণি,জ্যেঠুমণি,বড়মা,ছোটমা,দাদা-ভাই-বোনেরা,আর আর্থ্রাইটিসে ভুগতে থাকা আমার অসুস্থ মা-ও।সব্বাই কাঁদবে।আমি বাবাকে অনেক আগেই হারিয়েছি।একান্নবর্তী পরিবারে এদের মধ্যে বড় হয়ে ওঠা আমি,পরিবার ছাড়া কিছুই বুঝি না।এরা সবাই আমার আপনজন।আমাকে চোখে হারায়।সব মানি।কিন্তু আন্তরিক....

অন্তুর দিকে ঘুরে দাঁড়ালো ঝুমুর।

-বলুন....থামলেন কেন?
-তবুও আমি জীবনের সেই সঠিক মানুষটার জন্যই অপেক্ষা করছি,যে আমার চোখ থেকে একবিন্দু জল বেরোলে নিজেই মরে যাবে।আর সেই কারণেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য,সে আমার চোখে কোনোদিনও জল আসতে দেবে না!কারণ সে মনে করবে,আমার চোখে আসা একফোঁটা জলই হবে তার মৃত্যুর কারণ!

আন্তরিক ভাষা হারিয়ে নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলো ঝুমুরের দিকে...

-কি হলো?এখনও কি আপনার মনে হয়,আমি অনুভূতিহীন?যান্ত্রিক?

উত্তর হাতড়ে বেড়ালো আন্তরিক।কিন্তু কোনো জুতসই জবাব ওর মস্তিষ্কে এলো না।হেসে ঝুমুরই আবার বললো,

-আমার বাস আসছে।আপনি কোনদিকে যাবেন?
-আপনার সঙ্গেই যাবো!

কোনোক্রমে বললো আন্তরিক।তারপর ওরা দুজনেই এগিয়ে গেলো বাসের দিকে।আন্তরিকের মাথায় তখন একটাই কথা ঘুরছে,

"আমার চোখে আসা একফোঁটা জলই হবে তার মৃত্যুর কারণ!"

অর্থাৎ,ঝুমুরকে এতটাই ভালোবাসতে হবে,ওর চোখে কোনোদিনও জল আসতে দেওয়া যাবে না।আর ও যদি কোনো কারণে কষ্ট পেয়ে কেঁদেও ফেলে,জীবিত থাকাকালীন প্রতিটা মুহূর্তে শত-সহস্রবার মরতে হবে আন্তরিককেই...

সিগারেটের আগুনটা প্রায় আঙুল স্পর্শ করে ফেলেছিলো।ওটাকে নিভিয়ে ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেললো আন্তরিক।দিনের আলো সম্পূর্ণভাবে নিভে গিয়ে সন্ধ্যে নামার সঙ্গে-সঙ্গে,লাল চামড়ায় বাঁধানো বইটা বুকে জড়িয়ে ধরে,আরও একবার মরে গেলো কাঁদতে না পারা,অব্যক্ত কষ্টগুলো জাহির করতে না পারা নির্বাক আন্তরিক....

(চলবে.....)

ছবি : সংগৃহীত

ধারাবাহিকটি ভালো লাগলে ব্লগ থেকে নির্দ্বিধায় শেয়ার করুন ও সবাইকে পড়ার সুযোগ করে দিন।😊😊

সূর্যোদয়ের আগে
প্রিবুকিং চলবে পনেরো তারিখ পর্যন্ত।প্রিবুকিং এ থাকছে বিশেষ পঁচিশ শতাংশ ছাড়।তোমরা যারা প্রিয়মশ্রীকে নিজের সংগ্রহে রাখতে চাও,তারা বুকিং করতে পারো পাঠকবন্ধুর এই নম্বরে ফোন অথবা whatsaap করে।
পাঠকবন্ধুর নম্বর - 7439112665

মঙ্গলবার, ৬ অক্টোবর, ২০২০

নির্বাক (চতুর্থ পর্ব)


 


নির্বাক


সাথী দাস


চতুর্থ পর্ব




হাসিমুখে ছবির ফ্রেমখানা কাপড়ের আঁচল দিয়ে যত্ন করে মুছলেন সৌদামিনী দেবী।তারপর টুপ ডুব দিলেন নিজের অতীতে....

-ওই সামনের গাছগুলো দেখছো রজত!?ওই গাছগুলো পর্যন্ত আমাদের জমির সীমানা!
-বাপরে!অনেকটা জমি তো বড়দা!
-হ্যাঁ ভাই!ওই আর কি!মা চন্ডীর কৃপায় লবণ আর জ্বালানীর কেরোসিনটুকু ছাড়া,আর বিশেষ কিছুই কিনতে হয় না।মাঠে ধান আছে,বাগানে ফল-ফলাদি-সবজি,আর পুকুরের মাছ!এই নিয়েই বেশ কেটে যাচ্ছে।তা তুমি আমার ভাইয়ের বন্ধু পল্লবের ভাই,মানে আমারও ভাই।পুজোয় তো ঠাকুর-দালানে থাকছোই,তিনবেলা পাত পেড়ে খাবে কিন্তু।তারপরেও আমাদের বাড়িতে একদিন তোমার নেমন্তন্ন রইলো।পুজোর কদিন তো রান্নার ঠাকুর রাঁধবে,তারপর আমার মায়ের হাতের,বৌদিদিদের হাতের রান্না খেয়ে যেও!
-আসবো দাদা!পল্লবের সঙ্গেই আসবো!
-এই ভুতো!

সজোরে হেসে ফেললো রজতশুভ্র....

-হাসলে যে!
-ভুতো?নামটা কেমন যেন!
-আরে আর বোলো না,সেবার তো বসন্ত হয়ে মরেই যাচ্ছিলো হতভাগা।ওকে বাঁচানোর জন্য শেতলাতলা ছেড়ে,বুড়ো শিবতলায় মা মানত করেছিলো।পচে মরতে গিয়েও বেঁচেও গেছে আমার ভাইটা!দেখছো না,ওর সারাটা মুখে কেমন দাগ!ওইরকম সারা গায়েও আছে।চোখদুটোও তো খোয়া যেতে বসেছিলো।ওই বুড়ো শিবতলার ঠাকুরথানে আমার মা সোনার চোখ,সোনার বেলপাতা মানত করেছিলো।ভাই বেঁচে যাওয়ার পর দিয়েছে।বাবার বড় মূর্তিতে তো পরানো যায় না,অনেক উঁচুতে।তবে সামনের ছোটো শিবলিঙ্গে ওগুলো পরানো আছে দেখবে।ওই তারপর থেকেই ঠাকুমা ওকে ভূতনাথ বলে ডাকে।সেই থেকেই ভুতো হয়ে গেছে।আর আমার কাছে ভূত....এ ভূত,এদিকে আয়!ব্যাটার আসল নামটাই ভুলে গেছি,বুঝলে রজত!এক্ষুণি বলবে,দাদা আবার তুমি সবার সামনে আমাকে ভূত বলে ডাকছো!?হে হে....

কথা বলতে-বলতেই বড়দাদার থেকেই বহু অজানা সংবাদ জানলো রজত।বড়দাদা,মেজদাদা,ভুতোদাদা...তিন দাদা,বড় বৌদিদি,দুই বোন,বাবা-মা,আর বিধবা ঠাকুমার পরিপূর্ণ সংসারে,সৌদামিনী সবার ছোটো।জন্ম হওয়ার পর তার মুখ থেকে কোনো শব্দ শোনা যায়নি।সর্বকনিষ্ঠা কন্যার মুখ হতে মা ডাক শোনার আশায়,গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার,বড় ডাক্তার এমনকি সদরের নামকরা ডাক্তারও দেখিয়ে আনা হয়েছিলো একরত্তি মিনীকে।কিন্তু ঈশ্বর ওই শিশুকন্যার শ্রবনেন্দ্রিয় সম্পূর্ণ নিখুঁতভাবে সৃষ্টি করলেও,বাকযন্ত্র প্রস্তুত করার সময় বুঝিবা কিঞ্চিৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন।তাই অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে সেই কাজ।মুখে ভুবন-ভোলানো হাসি থাকলেও,মুখগহ্বরের অভ্যন্তরে অবস্থিত সচল জিহ্বা উচ্চারণ করতে পারে না শব্দের ভান্ডার।প্রকৃতির নিয়মে নির্বাক মেয়েটির বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই,পরিবারের সকলেরই করুণার পাত্রী হয়ে ওঠে ও।সকলেই ওর আসন্ন ভবিষ্যৎ নিয়ে কমবেশি চিন্তিত,একমাত্র ভুতোদাদা ছাড়া।জগৎ-সংসারের কোনো বিষয়েই ওই ছেলেটির কোনো আগ্রহ নেই।মনে হিংসার লেশমাত্র নেই।দায়িত্ব-কর্তব্যজ্ঞানও নেই।হাতে-পায়ে বড়ো হয়ে দীর্ঘকায় যুবক হয়ে উঠলেও,ভুতোর মনের মধ্যে সর্বদাই বাঁচে এক আপনভোলা কিশোর।সংসারের যাঁতাকলে পিষে,সকলের বাক্যবাণ সয়ে,এই ভুতোদাদা আর হাসিদিদিই ছিলো,নির্বাক সৌদামিনীর একমাত্র সহচর ও সহচরী।পেয়ারা চুরি করে খাওয়া,আচার চুরি করে খাওয়া,অসময়ে পুকুরে ডুব দিয়ে বাড়ি ফেরার মতো নজিরবিহীন দুঃসহসিকতার পরিচয় বহন করার সঙ্গী ছিলো,ওই দুটি মানুষই....তাদের সঙ্গেই মিনীর যত মান-অভিমান,হাসি-খেলা....বড়দাদার কথা শুনতে-শুনতে,সিক্ত পদ্মের গভীরে বুঝি হারিয়েই যাচ্ছিলো রজত।এমন সময় ভটভট করে তুমুল শব্দ করে একটা মোটরে আঁটা ভ্যান এলো।একটু দূরেই অসংখ্য গর্তে ভরা পিচঢালা রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়লো ভ্যানটা।ভটভটির বীভৎস শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে রজত দেখলো,একটি মেয়ে ছুটতে-ছুটতে নেমে এলো সেই ভ্যান থেকে...

সৌদামিনী চুপ করে বসেছিলো ওই ভ্যানেই।সে মাথা ঘুরিয়েই অপলক দৃষ্টিতে চেয়েছিলো ওর দিকেই।তার দৃষ্টিতে লজ্জায় মরে গিয়ে,মনের সুখে আখ চিবোনোই বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো ওর।মুখের মধ্যে জমিয়ে রাখা ছিবড়েটুকু ফেলে দিয়ে,মুখ মুছে চুপ করে ভ্যানের পিছনে বসে,সেদিন পা দোলাচ্ছিলো সৌদামিনী।ওর হাসিদিদি ছুটে গিয়েছিলো বড়দাদার কাছে,

-ও দাদা!এই যে ফর্দ।আমি সারা গ্রাম তোমাকে খুঁজে-খুঁজে সাড়া হলাম গো!তুমি এইখানে দাঁড়িয়ে আছো!?বাবা এই জিনিসগুলো সব আনতে বললো।এনে ঠাকুর-দালানে রাখতে হবে...
-পুজোর বাকি বাজার তো?
-হুম!
-আচ্ছা যাচ্ছি!এই শোন হাসি,এর নাম রজত।তোর ভূতদাদার বন্ধু আছে না,পল্লব।ওই পল্লবের ভাই।এখন তোর দাদারও ভাই বলতে পারিস।অনেকদিন পর শহর থেকে এই গ্রামে মাসির বাড়িতে বেড়াতে এসেছে।আমাদের পুজোর জন্য এখানে এসেছে পল্লবের সঙ্গে।পুজোর কদিন থাকবে।রজত এবার জলপানি পেয়ে পাশ দিয়েছে।অনেক পড়ালেখা জানে কিন্তু।আমাদের মত পাড়াগেঁয়ে নয়।কলেজে যায়।আবার মোক্তার হওয়ার কলেজ!কদিন পর মোক্তারও হয়ে যাবে।কত নামডাক হবে!কত বড় মানুষ হবে!একটু দেখবি,যত্ন-আত্তির যেন কোনো খামতি না থাকে!
-পল্লবদা,মানে পলুদার ভাই।তার মানে তো ডাক্তারবাবুর আত্মীয় গো বড়দা!
-হুম।তোমাদের গ্রামের ডাক্তারবাবু আমার নিজের মেসোমশাই হন।মাসির শরীরটা ভালো ছিলো না।মায়ের কথায় তাই মাসিকে দেখতে এসেছিলাম।পুজোর আগেই বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা ছিলো।কিন্তু মাসি কিছুতেই ছাড়লো না।বলে শহরের পুজো তো সবসময়েই দেখিস রজত,এবার গ্রামের পুজো দেখে যা।জোর করে রেখে দিলো।পলুদাদাও ধরে-বেঁধে নিয়ে এলো এখানে।
-বেশ করেছে।মা ঘরে আসছে,তুমি এই সময় গ্রাম ছেড়ে যাবেই বা কেন!আমাদের ডাক্তার-জ্যাঠা তো ধন্বন্তরী।তার পরিবারের নামেই গ্রামের সবাই হাতজোড় করে গড় করে।আর আমাদের ভটচাজ বাড়ির ঠাকুর-দালানের নামেও কিন্তু,সবাই একটু ভক্তি করেই চলে,বুঝলে রজত!
-হ্যাঁ বড়দা!খুব ভালো লাগছে এখানে এসে।আমার গ্রাম খুব ভালো লাগে।সেই কোন ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে আসতাম।তারপর লেখাপড়ার চাপে আর আসা হয়ে ওঠেনি।তবে গ্রামে বেড়াতে আমার বেশ লাগে!
-হ্যাঁ,বেড়াবে তো!এই ভূত?
-আঃ!দাদা!
-এদিকে আয়,দুই বন্ধু একেবারে যেন গলাগলি মানিকজোড়।এসেই প্যান্ট গুটিয়ে ক্ষেতে নেমে পড়েছে।আঃ-উঃ পরে করবি!ওপরে ওঠ।এদিকে যায়।এই যে,শোনো পল্লব!
-বলো বড়দা!
-আমি একটু বেরোলাম বুঝলে!তোমরা ওই ভটভটি করেই গোটা গ্রামটা একটু ঘুরে এসো না!তোমারও খুব ভালো লাগবে রজত!এই মিনী?তুই আর হাসি যা!ওদের বুড়ো শিবতলার ঠাকুরথানটা ঘুরিয়ে নিয়ে আয়...
-ও দাদা!আমরা এখন যেতে পারবো নাকো।আমরা তো এখন মাধবীর বাড়ি যাচ্ছি!ওকে তো আজ ওর বর দেখতে আসবে।কাত্তিক বাদেই আসছে অগঘানে ওর বিয়ে না!!পুজোর ছুটিতে বর বাড়িতে এসেছে,তাই আজ পাশের গ্রাম থেকে মাধুকে দেখতে আসবে।সবাই কখন চলে গেছে।এখন আমি আর মিনী যাচ্ছি।তাই তোমার হাতে ফর্দ ধরিয়ে দিতে কত্ত দেরি হয়ে গেলো।আর না!ও রজতদাদা,ওই ভুতোদাদা আর পলুদাদার সঙ্গে তুমি এই বেলাটা ঘুরে নাও না গো!মাধুর বরের নাকটা খ্যাদা না ব্যাকা,বর শুঁটকো না মুটকো,তালগাছ না তুলসিগাছ,চোখ ট্যারা কিনা,দাঁত উঁচু কিনা,একটু মাধুর বরকে দেখতে যাবো না বলো!!
-বাবা!!তোমরা বর দেখার সময় এতকিছু দেখো বুঝি?!কিন্তু বিয়ে তো তোমাদের বন্ধুর।তোমরা এতকিছু দেখে কি করবে?

দরাজ কণ্ঠে প্রাণখোলা হাসি হেসে উঠলো রজত....

-বাঃ রে!বিয়ের দিন 'মাধু তোর বর এসেছে' বলে চেঁচাতে হবে না?!তখন বলতে হবে তো,ওই তোর নাকবোঁচা বর এলো।ওই তোর শুঁটকো বর এসে গেছে তোকে বিয়ে করতে,ওটাই তো মজা গো!আজ না দেখলে আর ওই বরকে আমরা ফাঁকে পাবো!?যাই গো,বেলা যে বয়ে গেলো...
-আচ্ছা ঠিক আছে।তোমরা কোথায় যাবে যাও না!আমি তো কদিন আছিই...
-এই মিনী!!আয়-আয়!!একদৌড়ে আয়!

পা দোলানো বন্ধ করে ভ্যান থেকে নেমে আখ হাতে ছুটে এসে,দিদির হাত ধরেছিলো মিনী।কতগুলো লাল-হলুদ-নীল-সবুজ রঙের কাঁচের চুড়ি ঝমঝমিয়ে উঠলো ওর হাতে।মেটে-মেটে লাল কাপড়ের সঙ্গে রং মিলিয়ে,ঘটিহাতা ফুলো-ফুলো লাল ব্লাউজ,আর সেই সঙ্গে লাল ফিতে দিয়ে দুদিকে যত্ন করে বিনুনী বাঁধা ওর মাথায় একঢাল চুল।দিদির হাত ধরেই নবযৌবনা মিনী নেমে গেলো ক্ষেতের মাঝে।ব্যস্ত পায়ে আল ধরে দৌড়োতে লাগলো।দূরের সবুজ ধানক্ষেতের একেবারে শেষপ্রান্তে ওই দুই নারী মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত চেয়ে রইলো রজতশুভ্র।একসময় দূরে অদৃশ্য হলো তার হাতে ধরে থাকা ওই লম্বা আখটা...

-চল রজত।তোকে ভূতোদের পানের বরোজ দেখিয়ে আনি!
-আর লঙ্কা ক্ষেতও তোর ভাইকে দেখাবো পলু!এই পলু!ওই পাড়ায় যাবি নাকি?
-আর বাড়িতে কি বলবি?
-আরে বলবো কেন?এট্টু সুযোগ বুঝে পালাবো তো!

ভটভটির কানফাটা শব্দে কোনো কথা শুনতে পাওয়াই বড় দায়।সেই শব্দকে ছাপিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগলো দুজন গ্রাম্য ও একজন শহুরে যুবক।চেঁচিয়ে উঠলো রজতও,

-কেন?পালাবো কেন?কোথায় যাবো?বাড়িতে বলে গেলেই তো হয়!
-এই পলু!কি বলে রে তোর ভাই!আমার বড়দা জানতে পারলে ঠ্যাং ভেঙে দেবে!
-কেন?কোথায় যাবে তোমরা?
-ও গান শুনতে যাওয়ার কথা বলছে রজত।ভালো বাড়ির ছেলেরা রাত জেগে ওসব নাচগান দেখে না।ওখানে অনেকরকম মেয়েরা থাকে।হেলেদুলে নাচগান করে।বখে যাওয়া বড়োরা যায়।আমিও এই বাউন্ডুলে ভূতের পাল্লায় পড়ে দু-একবার গেছি।এবার যাবো না।তুই সঙ্গে আছিস।বাড়ি গিয়ে হুড়মুড় করে সব বলে দিবি।
-বলবো না।আমিও যাবো তোমাদের সঙ্গে!

রজতের কথা শুনে চুপ করে গেলো পল্লব আর ভুতো।রজত আবার বললো,

-উফফ!!বাবা রে!এর চেয়ে হেঁটে যাওয়া ভালো।এই রাস্তায় ভটভটিতে চড়লে,হাড়ের খোলনলচে সব একেবারে খুলে যাবে।বললাম তো পলুদা,আমি কাউকে কিছু বলবো না।কখন যাবে তোমরা?
-দেখছি!যখন ডাকবো তখনই বেরিয়ে আসতে হবে কিন্তু...ঠাকুর-দালানে বসে থাকলে হবে না।
-আচ্ছা!
-আরে পলু,আমরা রাতে তো তিনজন এক ঘরেই শোবো।উঠেই টর্চ নিয়ে পালাবো।কেউ জানতেই পারবে না....
-কোনোদিনও আমার মাকে বলবি না কিন্তু রজত।মা বাবার কানে তুলে দিলে,বাবা আমাকে বাড়িছাড়া করবে।
-নানা!মাসি কিচ্ছু জানবে না।আমি যাবো তোমাদের সঙ্গে....
-আচ্ছা!তবে অষ্টমীর রাতে।সবাই যখন সন্ধিপুজোর কাজে ব্যস্ত থাকবে,তখনই....এই তো এসে গেছি।ও কাকা!আরে থামো-থামো!শহরের অতিথকে একটু মিষ্টি পান,সাঁচি পান খাইয়ে নিয়ে আসি দাঁড়াও।এসো রজত!

চারদিক দিয়ে সবুজ আস্তরণে ঘেরা স্যাঁতসেঁতে পানের বরোজের ভিতরে মাথা নীচু করে ঢুকলো ওরা....

-এই শোনো?

ঘর থেকে বেরিয়েই বারান্দা পেরিয়ে কোমরে কাপড় গুঁজে ছুটতে যাচ্ছিলো সৌদামিনী।রজতের ডাকে দাঁড়িয়ে পড়লো।

-সারাদিন এভাবে ছুটে বেড়াও কেন?পড়ে গেলে তো হাত-পা ভেঙে বসে থাকবে।যখনই দেখো দুম-দুম করে দৌড়োচ্ছে!তোমার পড়াশোনা নেই?

দুদিকে ঘাড় নাড়লো সৌদামিনী....

-কেন?

মাথা নীচু করেই দাঁড়িয়ে রইলো ও...

-এখন কোথায় চললে?

আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে গেলো সৌদামিনীর মুখশ্রী...ও হাত নেড়ে কত কি বললো রজতকে।কিন্তু অনভ্যাসের কারণে কোনো নির্বাক নারীর ভাষা বোঝার ক্ষমতা রজতের নেই।ওকে দেখেই সৌদামিনী বুঝতে পারলো,রজত কিছুই বুঝতে পারছে না।তখন হাল ছেড়ে দিয়ে আবার পিছন ফিরে দৌড়োতে গেলো ও...

-এই!দাঁড়াও!

কাপড়ের আঁচল ঠিক করতে-করতেই পেটের কাছে গুটিয়ে রাখা আঁচলের ভাঁজ থেকে খসে পড়লো একটা ছোট্ট কৌটো...

-কি গো ওটা?

সৌদামিনী ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারা করে রজতকে চুপ করতে বললো।তারপর ওটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে,ওকে বাড়ির পিছনদিকে ডাকলো।সবার চোখ এড়িয়ে ওর সঙ্গে রজত সেদিকে গেলে,ওই কৌটোটা বের করে রজতের হাতে দিলো মিনী...রজত ওটা খুলে দেখলো,ভিতরে লাল-সাদা কিসব রয়েছে...

-কি এটা?

নিজের জিভে হাত ঠেকিয়ে ওটা রজতকে খেতে বললো মিনী।আঙুলে একটুখানি নিয়ে মুখে ঠেকিয়েই রজত বুঝলো,ওটা ঝালনুন....

-কোথায় যাচ্ছ এটা নিয়ে?নুন আবার কেউ চুরি করে খায় নাকি!!তাও আবার নিজের বাড়ি থেকে!!

দূরে হাত দেখিয়ে গোল-গোল আকৃতির কিছু একটা দেখালো মিনী...তারপর নিজের মাথার চুল দেখিয়ে,হাত নেড়ে মারার কথাও বললো....অর্থাৎ সেই বুড়ি ওকে মারবে,যার মাথায় পাকা চুল...হেসেই ফেললো রজত।

-তোমার ঠাকুমা মারবে?তোমাকে?কেন?নুন চুরি করেছো বলে?

দুদিকে ঘাড় নেড়ে না বললো মিনী।

-তবে?

আবার গোল-গোল আকৃতি দেখিয়ে কিছু বোঝালো মিনী...

-কি?ওহ...পেয়ারা!!

এবার জোরে-জোরে মাথা নেড়ে হাসিমুখে হ্যাঁ বললো মিনী।রজত দেখলো,ওকে বোঝাতে পারার আনন্দে সৌদামিনীর দুটো চোখ হাসছে!!ঈশ্বর সর্বশক্তিমানের সৃষ্টি বড়ই অদ্ভুত!যাকে একদিকে নিঃস্ব করে রাখে,তাকে অপরদিকে ভরিয়ে দেয়।যে নারীর বাকশক্তি নেই,তাকেই সে দিয়ে রেখেছে স্বচ্ছ-সদাহাস্য একজোড়া উজ্জ্বল টানা-টানা চোখ।যে চোখের আয়নায় ফুটে ওঠে,তার নির্বাক মনের প্রতিটি কথা!মুখ দিয়ে বলতে না পারা প্রতিটা কথার প্রতিফলন হয়,ওই দুটি কাজল-কালো দীঘল চোখের গভীরেই....হেসে রজত বললো,

-তুমি পেয়ারা চুরি করে খাবে?কি আশ্চর্য!কেন?তোমাদের নিজেদের বাগানেই তো এত পেয়ারা রয়েছে!!

হাত নেড়ে চোখের ভাষায় সৌদামিনী এরপর যেটা বললো,সেটা বুঝতে আর বিন্দুমাত্র অসুবিধে হলো না রজতের।মিনী বললো,

"আরে চুপিচুপি গাছে চড়ে অন্যের বাগান থেকে পেয়ারা চুরি করে,ঠাকুমার ঘর থেকে চুরি করা ঝালনুন দিয়ে খাওয়ার মজাই আলাদা...নিজের বাগানের পেয়ারায় সেই মজা কোথায়!!"

হেসে ফেলে রজত জিজ্ঞেস করলো,

-কাল বন্ধুর বর দেখলে?পছন্দ হলো বর?!

ঘাড় নেড়ে ঠোঁট উল্টে মুখ ভেংচে মিনী না বললো।ওর মাধুর বরকে একটুও পছন্দ হয়নি...

-সেকি!!কেন?বর বেচারা আবার কি করলো?

মিনীর কথায় বর খুব মোটা।মস্ত বড় পেট!পাঞ্জাবী ঠেলে নাকি পেট বেরিয়ে আসছিলো বাইরে।নাকের জায়গায় একটা শুঁড় থাকলেই,ও অনায়াসে গণেশঠাকুর বলে দুহাত জোড় করে,বরকে একটা গড় করে আসতো!

মিনীর কথা বুঝে,হেসে গড়িয়েই পড়লো রজত।তারপরই ঝালনুনের কৌটোটা রজতের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে,ওটাকে আবার জায়গামতো রেখে,ভালো করে শাড়ির আঁচলটা কোমরে পেঁচিয়ে নিয়ে,একদৌড়ে পেয়ারার সন্ধানে চলে গেলো সৌদামিনী।হয়তো ওর বন্ধুরা গাছতলায় অপেক্ষা করছে ওর জন্য....দূরে ঠাকুর-দালানে ঢাক বেজে উঠলো....সঙ্গে কাঁসর-ঘন্টাও...

-ওই রজত!কিরে?
-হ্যাঁ পলু দা,বলো!
-তুই এখানে!এদিকে কি করছিস?আমি দালানে তোকে খুঁজেই মরছি!চল-চল!পুজো শুরু হয়ে গেলো তো!আজ মায়ের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে।আজ পুজোর পর একবার দেখবি মায়ের চোখদুটো।দেখলেই মনে হবে,মা মুখে একটাও কথা বলেন না,কিন্তু ওই দুচোখের দিকে চাইলেই সবটুকু পড়ে ফেলা যায়।দশমীর দিন ওই চোখদুটো যখন ছলছল করে,কি ভীষণ মন খারাপ হয় রে ভাই!আমরা ওই দুঃখ ঢাকতেই তো চেঁচিয়ে উঠি,"আসছে বছর আবার হবে!!" চল-চল!মাকে দেখবি চল!
-হ্যাঁ পলুদাদা!নারী মূর্ত হোক বা বিমূর্ত,যেখানে চোখই মনের আয়না,সেখানে ঠোঁটের আর কাজ কি!!সে তো নিতান্তই অকেজো....
-কি!

আলতার কাঁচের শিশিটা আজ ময়নাদি নিতে বলেছিলো।ভুলেই গেছে মিনী।আবার একদৌড়ে ঘরে ফিরছিলো ও।ঠাকুমা দেখতে পেলেই,এক্ষুণি ঘাড় ধরে ঠাকুর-দালানে নিয়ে যাবে।তাই চুপিচুপি বাড়ির পিছন দিয়ে মাচার লাউগাছটাকে পাশ কাটিয়ে,সবে উঠোনে আসছিলো মিনী।তখনই শুনতে পেলো তার কন্ঠস্বর,

-আরে আমি মা দুর্গার কথা বলছি!আচ্ছা পলুদা,এই ভুতোদার বোন মিনী কি ছোটোবেলা থেকেই বোবা?ও লেখাপড়া করে না?পড়াশোনা কি কিচ্ছু জানে না?

তার মুখে নিজের নাম শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো সৌদামিনী....

-কি জানি ভাই!না জানে বোধহয়।আগে তো সবার সঙ্গে বসে পড়তে দেখতাম।এখন আর পড়ে না মনে হয়।পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে হয়তো।আমাদের এদিকে ছেলেদেরই কেউ অত পড়াশোনা করে না।সব ব্যবসা-চাষ-আবাদ নিয়েই আছে!তার মধ্যে কেউ কয়েকটা পাশ দিলেই ব্যাস!!হীরের টুকরো ছেলে....গ্রাম ভেঙে পড়ে তাকে দেখার জন্য!
-কিসের কথা হচ্ছে পলু?
-ভুতো!আয় ভাই!ঘুম ভাঙলো?সকালে তো তোকে ডেকে,উত্তরে তোর নাসিকা গর্জন শুনে আমি স্নান করে সেজেগুজে নিলাম,পুজো দেখতে যাবো....দেখ আমার ভাইও তৈরি।তোর বাড়ি,তোর বাড়ির পুজো,তুই নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিস!!বড়দা তোকে এই কারণেই ভূত বলে ডাকে....রাতে যত রাজ্যের অকাজ-কুকাজ করে জাগবি,আর দিনে ঘুমোবি....

নিমের দাঁতনটা নিজের দাঁতে মহাসুখে ঘষছিলো ভুতো।বলে উঠলো,

-হ্যাঁ রে পলু।আজ বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেলো।এই যাই,এবার পুকুরে দুটো ডুব দিয়ে আসি!তারপর ঠাকুর-দালানে যাবো।নইলে বুড়ি খুব চেঁচাবে।বলে সুদ্দু হয়ে দালানে না গেলে,ঠাকুর বড় দোষ নেয়!ও ভাই রজত!আমি না হয় আকাট মুক্কু-সুক্কু মানুষ,তুই নাকি অনেক লেখাপড়া শিখেছিস!মোক্তার হয়ে কোটে কেস লড়বি,তা তুই বল তো,ঠাকুর কি সত্যি-সত্যিই দোষ নেয় নাকি রে?আমরাও তো তারই ছেলেপুলে!মা নাকি কোনো কিছুতেই সন্তানের দোষ নেয় না!তা ওই পুকুরে দুটো ডুব না দিলেই,দোষ নেবে কেন?
-মন শুদ্ধ হলে,সব শুদ্ধ!এটাই আমি মানি!এর বেশি আমি তো আর কিছু জানি না ভুতোদাদা।আমি শাস্ত্র পড়িনি!এখন পড়ার বড় চাপ।কলেজ পাশ দিয়ে,পরে বড় হয়ে পড়বো।তখন আবার তুমি এই প্রশ্ন আমাকে কোরো।সেদিন আমি তোমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবো!

স্তব্ধ হয়ে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো সৌদামিনী....

-আরে রাখ তোর শাস্তর!কি দুপাতা লিখে দিলো,ও মুখস্ত করে নিয়েই পন্ডিত হয়ে যায় নাকি কেউ!তুই যা জানিস,তাই ঠিক।আর এই যে আমি,ছোটো পাঁচিল পেরিয়ে,বড় পাঁচিলে ঢুকতেই পারলাম না,তার মানেই কি আমি মুক্কু!!
-ছোট পাঁচিল,বড় পাঁচিল....মানে?
-এই পলু,বোঝা তোর ভাইকে....

পল্লব হেসে বলে উঠলো,

-ভুতোর আমাদের বিদ্যের দৌড় ওই ছোট পাঁচিল পর্যন্ত।মানে ওইখানেই বারবার আটকে,ও লেখাপড়াকে সসম্মানে বিদায় জানিয়েছে।আমাদের বন্ধুত্বটা সেই স্কুলের সময় থেকে হলেও,পড়াশোনায় আমি অনেকটা এগিয়ে গেছি।কিন্তু ভূত অষ্টরম্ভা!তবে আমাদের বন্ধুত্বটা আজও অটুট।ওদের ক্ষেতের ফলানো নতুন ধানের চাল থেকে শুরু করে শীতকালে বাঁধাকপি,ফুলকপি,মূলো,এমনকি গাছের মোচা,কলার কাঁদি,সব ভটভটি করে আগে আমাদের বাড়িতে যাবে,তারপর বাজারে।ডাক্তারবাবুর বাড়ির জন্য আগেই সবকিছু আলাদা করে এই পাগলটা সরিয়ে রাখে।পাগলটার সব ভালো।কিন্তু আটকে গেলো ওই ছোটো পাঁচিলেই।রজত,ভাই আমাদের এখানে ছোটো পাঁচিল মানে প্রাইমারি স্কুল,আর বড় পাঁচিল মানে হাইস্কুল।মানে আমাদের এই ভূত ফোর ক্লাসও পাশ করতে পারেনি।ছোটো পাঁচিল পেরিয়ে বড় পাঁচিলে আর ঢুকতেই পারেনি।
-এই রে!ও ভুতোদাদা,তুমি তো দেখছি অনেক শিক্ষিত!তারপরেও কাল তুমি কত গল্প করলে,কত জানো তুমি!
-আরে বইয়ের পাতায় কি আর,সব লেখা থাকে রজত!?জীবনটা তো শুরু হয়,যখন তুই বই থেকে মাথা তুলবি!তাই আমি...
-ক্লাস ফোরেই মাথা তুলে নিলে!তাড়াহুড়ো করে...ইস!বইপত্তর শিকেয় তুলেছো ঠিক আছে ভুতোদাদা।তবে তুমি যদি আর একটু জোরে লাফ দিতে পারতে,তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস,তুমি ঠিক ওই ছোটো পাঁচিলটা টপকে বড় পাঁচিলে ঢুকে যেতে পারতে!!

রজতের সূক্ষ রসবোধে পল্লব আর ভুতো তো হেসেই গড়াগড়ি।সেই সঙ্গে সকলের অলক্ষ্যে প্রজাপতির কৃপায় দেওয়ালের সঙ্গে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এক নির্বাক নারীও,রজতের কথা শুনে নিঃশব্দে হেসে ফেললো ফিক করে....

-হে হে!!দাঁড়া-দাঁড়া!গামছাটা কোমরে পেঁচিয়ে নিই ভালো করে।ঝপাং করে পুকুরে ঝাঁপাবো আজ!যাবি আমাদের পুকুরে?ওই কলাবাগান পেরিয়ে।চল...
-ঠাকুর-দালান?পুজো যে শুরু হয়ে গেলো ভূত!আমাদের সবাইকে একসঙ্গে না দেখলে,তোর ঠাকুমা,বাবা-দাদা সবাই বকবে।
-তাও তো!আচ্ছা পলু,তোরা যা!আমি একদৌড়ে আসছি...
-আচ্ছা!!
-চল রজত!কি ভাবছিস?
-চোখ দেখবো।চোখ পড়বো!
-কার?
-মায়ের!চলো পলুদা!
-এই তোর আবার কি হলো রে?কাল থেকে দেখছি কথায়-কথায় আনমনা হয়ে যাচ্ছিস?!বাড়ির জন্য মন কেমন করছে,তাই না?মাসির কথা মনে পড়ছে?
-নানা!ও এমনিই!কিছু না পলুদা!চলো,ঠাকুর দেখে আসি!পুজো শুরু হয়ে গেলো যে....

নিজের মাসতুতো ভাইয়ের সঙ্গে ঠাকুর-দালানের দিকে এগোলো রজত...

-যা...বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো।আজ কপালে শনি নাচছে পলু!আগে দৌড় মার!

সেই অষ্টমীর রাতে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে আল ধরে সাবধানে ছুটতে লাগলো ভুতো।কিন্তু অনভ্যস্ত রজতের জন্য পল্লব তড়িঘড়ি ছুটতে পারলো না....রজত চেঁচিয়ে উঠলো,

-ভুতোদাদা!আমি কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না যে অন্ধকারে।আমাকে রেখে পালিও না,দাঁড়াও!
-এই ভূত!দাঁড়া না...দেখছিস রজত অন্ধকারে হাতড়াচ্ছে!তুই তার মধ্যে ওকে আল বেয়ে দৌড়োতে বলছিস!মহা ঝামেলা তো...
-ও পলুদাদা....হাতটা ধরো না গো আমার!আর কোনোদিনও যাবো না তোমাদের সঙ্গে!
-আমি তো যাবো না-ই বলেছিলাম।তুই তো জোর করলি!
-পাড়ার অনুষ্ঠান তো অনেক দেখেছি।কিন্তু তোমাদের গ্রামের এমন গান তো কখনও শুনিনি।কি সুন্দর গান গাইলো না ওই মেয়েগুলো!সবাইকে ঠাকুর সেজে যেন সত্যি-সত্যি ঠাকুরের মতোই লাগছিলো...
-এই চুপ!কারোর সামনে এইসব কথা বললে,আমাদের তিনজনের মুন্ডুই উড়ে যাবে।যা দেখেছিস ওখানেই দেখেছিস রজত।এখন কিন্তু একদম চুপ!এই ভূত!!ভূত...ও মরা ভুতো!কোথায় মরলি হারামজাদা!!
-ও পলুদাদা!ভুতদাদা কোথায় গেলো গো!
-এই দাঁড়া!অন্ধকারে কিছু দেখতেও পাচ্ছি না।
-তোমাদের গ্রামের এদিকটায় আলো নেই কেন পলুদাদা?
-কে বললো আলো নেই?আছে তো!সেই স্টেশন রোড থেকে ভূতদের বাড়ি পর্যন্ত বারোটা খুঁটি ভূতের বড়দা একা টেনেছে।কিন্তু এত খরচপাতি করে কারেন্ট এনে কি হলো?!এখন টিউব জ্বলে কিনা,হ্যারিকেন-কুপি জ্বালিয়ে দেখতে হয়।
-কেন?
-আরে লো-ভোল্টেজ!সেদিক থেকে আমাদের ওদিকে ভালো বাবা!কিন্তু ভূতটা গেলো কোথায়!এ হারামি ভূত!!

ধানক্ষেতের কোনো প্রান্ত থেকেই কোনো উত্তর এলো না।স্তব্ধ চতুর্দিক!

-এ রজত!তুই এখানে চুপটি করে দাঁড়া তো...আমি দেখি!
-নানা!আমিও যাবো।অন্ধকারে তুমিও আবার হারিয়ে যাবে।
-তুই দাঁড়া না...আসছি আমি।ভূত!

পলুদাদা ভুতোদাদার নাম ধরে ডাকতে-ডাকতে হেদিয়ে গেলো।কিন্তু কোনো সাড়া পেলো না।একটু দূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা রজতের হঠাৎ মনে হলো,ওর পায়ের পাতার ওপর,কেউ যেন নড়েচড়ে সাড়া দিয়ে উঠলো।প্রচন্ডরকম ভয় পেয়ে গেলো রজত।এদিকে অনেকরকম লম্বা-চওড়া বিছে থাকে,মাসির কাছে আগেই গল্প শুনেছে ও।কাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠে দৌড়ে পলুদাদার কাছে আসতে গিয়েই বৃষ্টির মধ্যে নিজেকে সামলাতে না পেরে,পা পিছলে চিৎপাত হয়ে আছাড় খেয়ে আল থেকে নেমে সোজা সেঁধিয়ে গেলো ধানক্ষেতের মধ্যে।ভাইয়ের আর্তনাদ শুনে দৌড়ে এলো পল্লব।

-এই রজত!কি হলো রে!
-ও দাদা!পড়ে গেছি আমি!
-এই কোথায় তুই!কোনদিকে?
-এই যে,কাদায় ঢুকে গেছি,এইদিকে...ছি!ছি!কি নোংরা!হড়কে যাচ্ছি যে!!উঠতেই পারছি না!

অন্ধকারে হাতড়ে-হাতড়ে ভাইকে হাত ধরে টেনে তুলতে যাচ্ছিলো পল্লব।তখনই দূর থেকে একটা টর্চের আলো এসে পড়লো ওদের মুখের ওপর....

-এ পলু!?কই তুই!
-ভুতো!এদিকে...এই তো!ভাই পড়ে গেছে।তুই কোথায় মরেছিলি হারামজাদা!
-আরে আমরা বেরোনোর সময় তো টর্চ নিয়ে বেরোতেই ভুলে গেছিলাম।এখানেই পঞ্চার বাড়ি।রজতের পথ চলতে অসুবিধে হচ্ছিলো,তাই ওর থেকে টর্চ ধার নিয়ে এলাম।কাল ফিরিয়ে দেবো।
-তা বলে যেতে কি হয়েছিলো?
-আরে দৌড়ে চলে গেলাম তো!বললাম আর কখন!রজত পড়লো কি করে?
-ওরে আমি তোকে খুঁজতে গেছি!এখানে ও মনে হয় নাচানাচি করছিলো,ধাম করে পড়ে গেছে!
-না দাদা!আমি নাচছিলাম না।খামোখা রাতদুপুরে আলের ওপর নাচতে যাবো কেন!?আমি কি পাগল!আমার পায়ের ওপর দিয়ে কি যেন একটা সুড়সুড় করে চলে গেলো।ওটাকে সরিয়ে তোমার কাছে দৌড়োতে গিয়েই,পড়ে গেছি!

কাঁদো-কাঁদো কণ্ঠে এটুকু বলেই জলকাদা মেখে উঠে দাঁড়ালো নধরকান্তি রজত।টর্চের আলোয় ওকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে চাপা হাসি হেসে উঠলো পল্লব আর ভুতো....

-হাসবে না তোমরা।আমার গা চুলকোচ্ছে!
-চল বাড়িতে।
-সবাইকে কি বলবে?!সবাই তো জেনে যাবে।
-না!আমার বোন হাসি আর মিনী আছে না?!সব্বাইকে বাঁচিয়ে দেবে।চল-চল...

-এই....আরে ওই মেয়ে।ওই মিনী?!

কলঘরের দিকে যাচ্ছিলো সৌদামিনী।ভুতোদাদার গলা পেয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ালো।ঠাকুরদালানে প্রতিমার সামনে তখন টিমটিম করে আলো জ্বলছে....

-এদিকে আয়...

লণ্ঠনটা মুখের সামনে নিয়ে এসে তিনজনের অবস্থা দেখে হেসেই ফেললো কৌতূহলী সৌদামিনী।কাদার মধ্যে জলকেলি করে আসা রজত,মাথা নীচু করে চুপটি করে দূরে দাঁড়িয়ে রইলো....

-ওই মেয়ে!খিক-খিক করে হাসবি না।আমার ঘর থেকে জামাকাপড় নিয়ে আয়।রজত পরবে।ওকে পুকুরে চুবিয়ে আনবো!

ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেই দৌড়ে গিয়ে দাদার ঘর থেকে জামাকাপড় এনে দিলো মিনী।হাতের লণ্ঠনটা ধরিয়ে দিলো পল্লবের হাতে।তারপর নিজের ঘরে ঢুকে যখন দরজা বন্ধ করলো,তখন ওর বিছানায় হাসিদিদি ঘুমিয়ে অসাড়।বিছানায় না শুয়ে আস্তে-আস্তে মাথার দিকের জানালাটা খুলে মিনী দেখলো,পলুদাদা আর ভুতোদাদার সঙ্গে ভূতের মতো কাদা মেখে,সে পুকুরের দিকে চলেছে।একটু আগে দেখা তার কাদামাখা অবয়বের কথা মনে করে,আবারও ফিক করে হেসে ফেললো সৌদামিনী....

-এই আমাকে দেখে হাসছো কেন গো তুমি?!হ্যাঁচ্চ....
কাল মাঝরাতে বৃষ্টিতে ভিজে,পুকুরে ডুব দিয়ে হালকা সর্দিজ্বর বাধিয়ে বসেছে রজত।বারান্দায় তক্তপোশের ওপর বসে পা দোলাচ্ছিলো মিনী।আর ওকে দেখে,গতরাতের কথা মনে করে ফিকফিক করে হাসছিলো।হাসিদিদির চুল ঠাকুমা বেঁধে দিচ্ছে।বাঁধা হয়ে গেলেই,ওরা দুজন ছুটবে ঠাকুরদালানে।নির্বাক মিনীর দিক থেকে নিজের প্রশ্নের কোনো উত্তর পেলো না রজত।উত্তর এলো ঠাকুমার দিক থেকে।হাসির চুল বাঁধতে-বাঁধতে উনি বলে উঠলেন,

-আর কতদিন ওই মেয়ের সঙ্গে এরম ধিঙ্গিপনা চলবে তোর?ওর তো না হয় আজীবন এই বাপের ভিটে আগলেই পড়ে থাকতে হবে,কোন পাত্তর ওকে এসে উদ্ধার করবে?নাম জিজ্ঞেস করলেই তো ব্যাস!ওইখানেই মুখ থুবড়ে পড়বে।কিন্তু তোর তো আসছে মাঘেই বে রে হাসি!তুই এখনও বনে-বাদাড়ে বোনের সঙ্গে নেচে-নেচে বেড়াবি!?সংসারে তো কুটোটি নেড়ে দেখিস না!কাজকম্ম কর একটু!নইলে তো পরের ঘরে গে শুনতে হবে,বাপের ঘর থেকে মা-ঠাকমা কিছুই শিখিয়ে পাঠায়নি!ড্যাং-ড্যাং করে শাড়ি-গয়না জড়িয়ে পাঠিয়ে দেছে!তখন খুব ভালো লাগবে তো গালমন্দ শুনতে?
-আরে ও ঠাকমা,আমার মা সয়ে নিলে,আমি পারবো না কেন?আমি মায়েরই তো মেয়ে!
-কি বললি!!
-ধুর!!তাড়াতাড়ি চুলটা বেঁধে ছাড়ো না।ওরা সবাই এসে যাবে তো।
-ওই হাবাগোবা মেয়ের সঙ্গে জোড় বেঁধে তুই উড়ে বেড়া।তারপর শউর ঘর থেকে খেদিয়ে দিলে,আর এখেনে উঠতে দেবো না কিন্তু...
-কেন?তোমার বাড়ি নাকি!
-কি!আবার মুখে-মুখে চোপা!আমার বাড়ি না তো কার বাড়ি শুনি!!তোদের সবার মাথার ওপরে আমি ছাড়া আর কে আছে!

চুল বাঁধা হয়ে যেতেই,ঘুরে বসে ঠাকুমার দুটো গাল আদর করে টিপে দিলো হাসি।বললো,

-বাড়ি তো আমার ঠাকুর্দার গো!এ বাড়ি যেমন আমার নয়,তোমারও তো নয়।আমার তাও না হয় বাপের বাড়ি!কিন্তু তুমিও তো এখানে পরের বাড়ি থেকেই এসেছো গো বুড়ি!বাপের বাড়ি,শউর বাড়ি,ছেলের বাড়ি....সবই তো কারোর না কারোর।আমাদের তো কোনো বাড়িই হয় না গো বুড়ি!তাই বাড়ি দেখাবে না!এটা যদি তোমার বাড়ি হয়,তবে আমারও।আর আমার না হলে,তোমারও নয়!তুমিও যা,আমিও তাই....আমরা তো সবাই পর!তুমি পরের ছেলেকে আপন করে রেখে,এত বচ্ছর ধরে সংসার করে,এটাকে নিজের বাড়ি বলতে পারো,আর আমি এখানে জন্মে আমার বাপের বাড়িতে এসে উঠলে,তখন আমারে নামিয়ে দেবে!ও হবু মোক্তারদাদা!কি বলে গো তোমাদের আইন-কানুন?হয় নাকি এমনটা!!
-না....হয় না!
-দেখলে!ও বুড়ি!এই জন্যই তো বলি,সারাদিন পান-সুপারি নিয়ে বসে থেকে বকবক না করে,দুপাতা বই পড়ো।বোবা বলে তো মিনীটার স্কুল যাওয়া বন্ধই করে দিলে।আমিও রাগের ঠেলায় লেখাপড়া জলাঞ্জলি দিলাম।তাও দেখো,শিক্ষে কিন্তু আমার আছে!চিন্তা নেই,ফেরত আসবো না গো বুড়ি!তুমিও পরের ছেলেকে আপন করে সংসার করে যেমন ভাবছো,এটাই তোমার বাড়ি,আমিও না হয় তাই ভাববো....তবু আসবো না আর ফিরে....এ মিনী চল!বুড়ির সামনে থাকলেই জ্ঞান দেবে!
-হ্যাঁ ওই করো!মা-টা যেমন আমায় বিয়ে ইস্তক জ্বালিয়ে খেলে,ওই মায়েরই তো মেয়ে!এখন এই মেয়ের মুখের বাক্যি শুনলে,গা জ্বালা করে,মাথায় একেবারে রক্ত উঠে যায়...তাও একটার মুখে ভগবান বুলি দেছে।দুটোয় মিলে বললে তো....দেবো যেদিন আমার বাড়ি থেকে সবকটাকে খেদিয়ে....

স্তব্ধ হয়ে গেলেন ঠাকুমা।মনে পড়লো নাতনির মুখের বাক্যি,
"বাড়ি তো আমার ঠাকুর্দার গো!এ বাড়ি যেমন আমার নয়,তোমারও তো নয়।"

বৃদ্ধা চোখের জলটুকু মুছে নিয়ে,নির্বাক সৌদামিনীকে জন্ম দেওয়ার জন্য,পুত্রবধূর গতজন্মের পাপের কারণ অনুসন্ধানে মত্ত হলেন...

-এই মিনী!ছুটছিস কেন?দাঁড়া...

পিছন থেকে ছুটে এসে ওকে টেনে ধরলো হাসি....

-কিরে?ঠাকুরদালানে যাবি না?কোথায় পালাচ্ছিস?

দুদিকে ঘাড় নেড়ে না বললো সৌদামিনী।

-আবার ওই বুড়ির কথা তুই মনে ধরছিস?জানিস তো,ও সারাদিনই বলে...আমি তো জানি,টোপর মাথায় তোর জন্যও বর আসবে।এই এত্ত বরযাত্রী নিয়ে,তোকে বিয়ে করতে।আমিও তখন আনন্দে চিৎকার করবো,আমার মিনীর বর এসেছে....

দুদিকে জোরে-জোরে মাথা নেড়ে হাসিকে জড়িয়ে ধরলো মিনী...

-আবার কাঁদে!করবিনে বিয়ে?!সে এসে তোকে বিয়ে করতে চেয়ে তোর সামনে দাঁড়ালে,তখনও করবিনে?ধুর বোকা মেয়ে!এমনটা হয় নাকি!সে আসবেই,দেখবি তুই!আমার সঙ্গে নির্জলা উপোস করে বুড়ো শিবতলার ঠাকুরথানে শিবের মাথায় জল ঢেলেছিস তো তুইও।ঠিক অমন শিবের মতোই বর পাবি!

-হাসি?
-রজতদাদা?তুমি এখানে?
-তোমার বিয়ে?

নিজের বিয়ের কথায় মাথা নামিয়ে,মৃদু হেসে সলজ্জে হ্যাঁ বললো হাসি...

-তোমার ঠাকুমা মিনীকে পড়তে দেয়নি?
-না!ঠাকুমা বলে,ও বোবামেয়ে,এত কি পড়বে ও!!তিন কেলাস পড়িয়েই স্কুল ছাড়িয়ে দিয়েছে।কিন্তু মিনী বই পড়তে পারে।লিখতেও পারে।ও পড়া ছেড়ে দিলো,আমিও আর একা-একা স্কুলে যেতাম না।খুব কান্না পেতো।তাই আমিও পরের বছর ছেড়ে দিয়েছি।বড় পাঁচিলে আর যাইনি!
-হুম!
-চল মিনী....ঠাকুরদালানে...

দুদিকে ঘাড় নাড়লো মিনী...

-চল না!আরে ওই বুড়ির কথায় রাগ করিস না।
-মিনী?
-দেখো না রজতদাদা!বুড়ির কথায়...
-মিনী,কি হয়েছে তোমার?ঠাকুমা বলেছেন বলে...

দুদিকে মাথা নেড়ে না বললো মিনী।রজত শুধালো,

-তবে?কি হয়েছে তোমার?

হাসির দিকে চেয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওর গলা জড়িয়ে ধরলো মিনী।রজত সেই মুহূর্তেই বুঝতে পারলো নির্বাক নারীর ব্যথা কোথায়!!বুকের কোন গভীরে!

-তোমার বিয়ে হয়ে যাবে তো হাসি।ও হয়তো একেবারে একা হয়ে যাবে।এটা ভেবেই ও কাঁদছে!তাই তো মিনী?

রজতের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না সৌদামিনী।শুধু আজন্মের সখী হাসিদিদিকে জড়িয়ে ধরে,ওর কান্নার বেগ আরও বেড়েই চললো।যারপরনাই অবাক হলো হাসি।মিনীকে ও আর ভুতোদাদা ছাড়াও,তৃতীয় কেউ মাত্র এই কয়েকদিনের মধ্যেই যে এত ভালোভাবে বুঝতে পারে,এ তো ওর ধারণারও অতীত।চুপ করে বোনকে জড়িয়ে ধরে পিত্রালয় ত্যাগ করার বেদনা স্মরণ করে,নিজেও কেঁদে ফেললো হাসি...

-চল!আর কাঁদিস না বোন!মায়ের কাছে বসবি চল...
-তোমার বোন কাল পেয়ারা আর ঝালনুনের কত্ত গল্প করে,আমাকে লোভ দেখিয়ে ছুটে চলে গেলো হাসি।কিন্তু চুরি করা পেয়ারার কেমন স্বাদ,আমার তো অজানাই রয়ে গেলো।এখনও দেয়নি!
-কিরে?মিনী!!কি বলছে রজতদাদা!

চোখ ভালো করে মুছে কাপড়ের আঁচল থেকে পেয়ারা বের করতে গিয়ে হুড়মুড় করে সব পেয়ারা মাটিতে পড়ে ছড়িয়ে গেলো।হাসি আর মিনীর সঙ্গে রজতও বসে পড়লো পেয়ারা কুড়োতে।সব পেয়ারা গুছিয়ে তুলে,পাতশুদ্ধু একটা পেয়ারা ভালো করে নিজের কাপড়ের আঁচলে মুছে,রজতের হাতে তুলে দিলো মিনী।রজত একটা কামড় বসালো তাতে...মিনী হাত নেড়ে ইশারা করে জানতে চাইলো,

"ভালো?"

এই নির্বাক নারীর জন্য আর একটিও শব্দ খরচ করতে ইচ্ছে করলো না রজতের।ও নিজেও শব্দের ঊর্ধ্বে পৌঁছে অন্তর দিয়ে অনুভব করতে চাইলো ভাষাহীনা ওই নারীর মন।মিনীর মতোই মাথা নেড়ে ও হ্যাঁ বললো....পেয়ারা খুব ভালো!

হেসে ফেলে বাকি পেয়ারাগুলো থেকে একটা পেয়ারা দিদিকে দিয়ে,নিজেও একটা পেয়ারায় কামড় বসিয়ে হেলতে-দুলতে চলে গেলো ঠাকুরদালানের দিকে....

সকাল থেকেই বড় মনখারাপ মিনীর।মহানবমী পেরিয়ে আজ দশমী।একটু পরেই সবাইকে কাঁদিয়ে মা আবার ফিরে যাবে শিবঠাকুরের বাড়ি।বাড়ির সবার সঙ্গে হাসিদিদিও পুজোর জোগাড় করতে ব্যস্ত।একটা ছোট্ট ছাগলছানাকে বুকে জড়িয়ে ধরে,একভাবে মায়ের পিছনদিকে রাখা শিবঠাকুরের ছবির দিকে চেয়েছিলো মিনী।সত্যিই কি শিবঠাকুরের মতো বর হয়!আর সে কি আসবে মিনীর জন্য?কিন্তু এলেও বুঝবে কি করে ওকে!!এই যে আজ পুজো শেষ বলে,ওর কত মন খারাপ করছে,মায়ের দিকে চাইলেই কি ভীষণ কান্না পাচ্ছে,বুঝবে সে?!

-ওই মেয়ে!পুজো শেষ বলে মনখারাপ!!

চমকে উঠলো মিনী।ছাগলছানাটা মিনীর কোল থেকে নেমে,বারকয়েক মিনীর হাত চেটে দিয়ে,রজতকে শুঁকে চলে গেলো দালানের বাইরে...

-রজত?
-বলো ভুতোদাদা!?
-আজ বাওড়ে ভাসান হবে।যাবি কিন্তু...
-যাবো তো!ভাসান দিয়েই যাবো।যাতে আসছে বছর আবার হয়!
-সামনের বছর তুই এখানে আসবি রজত?খুব মজা হবে!
-আসবো!এবার থেকে প্রতি বছর পুজোয় এখানেই আসবো।ঠিক আসবোই...

শেষের সবটুকু কথা যে মিনীর দিকে চোখ রেখেই রজত খরচ করলো,সেটা সকলের চোখ এড়িয়ে গেলেও,হাসির চোখ এড়ালো না।ও চুপ করে রইলো শুধু....মিনী মাথা তুলে তার দিকে চাইতেই,তার চোখে চোখ পড়ে গেলো।সেও মিনীর দিকেই চেয়েছিলো।কম্পিত বক্ষে একদৌড়ে ওখান থেকে পালিয়ে বাঁচলো মিনী।দূরে ওর চলে যাওয়ার দিকেই চেয়ে রইলো রজত।হাসি এগোতে যাচ্ছিলো মিনীর দিকেই।কিন্তু বড়দাদা আর বড়বৌদিদির ডাকে আবার ঠাকুরের পুজোর যোগান দিতে,ওদিকেই এগিয়ে গেলো....পল্লব ভুতোর সঙ্গে গল্পে মত্ত।বাইরে বেরিয়ে এলো রজত...

-এই যে শোনো!সকালে আমাকে দেখে তুমি অত হাসছিলে কেন?

আর দাঁড়ালোই না মিনী।তার গলার স্বর শুনেই,দৌড়ে পালাতে গেলো।অদূরেই পেয়ারা বাগান।পাশেই সবুজ শ্যাওলা ও কচুরীপানায় আবৃত সুবৃহৎ পুকুর।বেশ ছায়াঘেরা নিবিড়-শান্ত গ্রাম্য সবুজায়নের মাঝে,মিনীর পথ আগলে দাঁড়ালো রজত।

-কি হলো?আমার কথার উত্তর দিচ্ছ না যে!

তাও কোনো উত্তর নেই।

-আমার খিদে পেয়েছে।পেয়ারা খাওয়াবে!?তোমার কাছে তো সবসময় পেয়ারা বাগান তৈরি থাকে।

হাত তুলে ওই দূরে নিজেদের পেয়ারা-বাগান দেখিয়ে দিলো মিনী।অর্থাৎ,যত খুশি পেড়ে খাও।কেউ কিচ্ছু বলবে না।

-না!তোমার চুরি করা পেয়ারাই খাবো!কেউ আমাকে বলেছিলো,চুরি করে খাওয়ার মজাই আলাদা!

রজতের প্রখর অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে কেঁপে উঠলো মিনী।ও একটা পেয়ারা বের করে রজতের হাতে দিতে গেলে,রজত পেয়ারাশুদ্ধু মিনীর হাতটাই চেপে ধরলো।আর কিছুতেই ছাড়লো না।রঙিন কাঁচের চুরির প্রবল রিনিঝিনি সত্ত্বেও,রজতের হাত থেকে নিজের হাতটা,কিছুতেই মুক্ত করতে পারলো না সৌদামিনী....

-মিনী,শোনো....

-এ রজত!!রজত....

ঠাকুরদালানের দিক থেকে পল্লবের গলা শুনেই মিনীর হাতটা ছেড়ে দিলো রজত।একদৌড়ে মিনী মিশে গেলো পেয়ারা বাগানের ভিতর....

-বলো দাদা!এখানে আমি!
-শিগগির এদিকে আয়!

সে চলে গেলো পলুদাদার সঙ্গে।কিন্তু মিনীর বুকের কম্পন কিছুতেই স্তিমিত হলো না।পেয়ারা গাছের বাকল উঠে যাওয়া সরু গুঁড়ি জড়িয়ে ধরে,আড়াল থেকে তার চলে যাওয়ার দিকে একভাবে চেয়ে রইলো দীঘল একজোড়া চোখ....

কিছুক্ষণ পরেই মা-বৌদিদি,গ্রামের সবাই মাকে বরণ করে সিঁদুর খেলা শুরু করবে।সারাটা ঠাকুরদালান খুঁজেও তাকে আর দেখতে পায়নি মিনী।তাই বাড়ির দিকেই আসছিলো ও।কলঘরের সামনে বেশ অনেকগুলো ঠাকুরের বাসন নিয়ে তেঁতুল ঘষতে বসেছিলো হাসিদিদি।হাতে একটা শুকনো পেয়ারার ডাল নিয়ে,হেলতে-দুলতে উঠোনে প্রবেশ করে দিদির পাশে বসে পড়লো মিনী।তেঁতুল নিয়ে বাসনে হাত দিয়েই ও শুনলো ঠাকুমার কথা,

-ও বড় খোকা!মেজোখোকা সঙ্গে না গিয়ে,তুই তো যেতে পারতিস!পরের ছেলে!আমাদের এখানে এসেছিলো।আমাদের একটা দায় তো থাকে...
-ভুতো তো সঙ্গে গেলো মা।মেজো আছে।পলু আছে।আমি গেলে এদিকে মাকে বাওড়ে কে নিয়ে যাবে বলো!!

হাসির হাত ধরে একটা টান মারলো মিনী।হাত নেড়ে জিজ্ঞেস করলো,কার কি হয়েছে!!

-রজতদাদার বাবার বুকের ব্যামো হয়েছে।কাল রাতে তাদের বাড়িতে নাকি ডাক্তার এসেছিলো।আজ সকালে রজতদাদাকে নিতে শহর থেকে লোক এসেছে!তাই তো সরকার কাকুদের মোটরগাড়িটা নিয়ে,রজতদাদা একটু আগেই মাসিরবাড়ি চলে গেলো!ভুতোদাদা আর পলুদাদা সঙ্গে গেছে যদিও....ওখান থেকে শহরে নিজের বাড়ি ফিরে যাবে।তবে যাওয়ার আগে আমাকে বললো,এই গ্রামের পেয়ারা ওর খুব ভালো লেগেছে!এখন বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে ঠিকই,কিন্তু ও আবার এখানে আসবে!আসবেই....

চোখ থেকে নিঃশব্দে জল গড়িয়ে পড়ছিলো মিনীর।মাথা নীচু করে রেখেছিলো ও।ঝনাৎ করে পিতলের ঘটিটা ফেলে রেখেই,উঠে দৌড় দিলো বড় রাস্তার দিকে।বড় রাস্তায় উঠতে গিয়েও ও ধরলো পেয়ারা বাগানের রাস্তা।নির্বাক এক নারী কাঁদতে-কাঁদতে গ্রামের অলিগলি দিয়ে দ্রুত পৌঁছনোর চেষ্টা করলো বড় রাস্তায়।একেবারে বড় রাস্তায় ওঠার মুখে বেলতলা দিয়ে যাওয়ার সময়,মিনীর নগ্ন পায়ের তলায় ফুটে গেলো বেলকাঁটা।দাঁড়িয়ে পড়ে নিঃশব্দে কেঁদে ফেললো মিনী।কাঁটাটা হাত দিয়ে টেনে বের করে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে ধুলোমাখা রক্তাক্ত পায়ে পৌঁছলো বড় রাস্তার কিনারায়।তার কয়েক মুহূর্ত আগেই মোটর গাড়িটা হুশ করে বেরিয়ে গেছে,ওই বড় রাস্তার বুক চিরে।পিছনে কেবল উড়ছে কুণ্ডলী পাকানো ধুলোর ঝড়।প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে,শরীরে যৌবন ছুঁয়ে গেছে সৌদামিনীর।কিন্তু এতদিন পর্যন্ত কিশোরীর মনের দরজায় কড়া নাড়েনি কেউ।আজ মিনীর নিজেকে হঠাৎ করেই একেবারে রিক্ত মনে হলো।বুঝতে পারলো না কেন এই অসহায়তা....ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামলো মাঠের প্রান্তে,পেয়ারা-বাগানে,ধানের শিষের আগায়,মিনীর মনের আঙিনায়।নির্বাক নারীর দুচোখের কোল বেয়ে বেরিয়ে এলো অবাধ্য জল।ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বৃষ্টির মধ্যে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলো ও।রঙিন কাঁচের চুরিগুলোকে স্পর্শ করলো বৃষ্টির প্রতিটা বিন্দু....কানের কাছে এসে সে বলে উঠলো,

"মিনী,শোনো...."

শোনা হলো না তো আর!কি বলতে চেয়েছিলো সে!!বৃষ্টি ভিজিয়ে দিয়ে গেলো সৌদামিনীর ভারাক্রান্ত মন....

-ও বৌদি!তোমার এই দোর আটকে ঘাপটি মেরে ঘরের মধ্যে বসে থাকার স্বভাব,আজও গেলো না গো!?কখন থেকে ডাকছি তো...

চৈতীর ডাকে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে সৌদামিনী দেবী দেখলেন,ওনার চোখের কোণে লবণাক্ত জলের স্রোত।সেদিনের সেই ষোড়শীর চোখের জল,আজও এই বৃদ্ধার চোখের কোণে এসে জমা হয়,তার নিজেরই অজান্তে....পরিবর্তন হয়নি কিছুই।শুধু মাঝে কেটে গেছে কয়েকটা বসন্ত।আর কোনোদিনও না ফেরা রঙিন বসন্ত....

চোখের জল মুছে,হাতের ফটোফ্রেমটা টেবিলের ওপর স্বপ্ননীলের ছবির পাশে পূর্বের মতো সাজিয়ে রেখে,দরজা খুলতে গেলেন সৌদামিনী দেবী....

(চলবে.....)

ছবি : সংগৃহীত

ধারাবাহিকটি ভালো লাগলে ব্লগ থেকে নির্দ্বিধায় শেয়ার করুন ও সবাইকে পড়ার সুযোগ করে দিন।😊😊
কেমন লাগছে রজতশুভ্র আর সৌদামিনীকে?
জানার অপেক্ষায় রইলাম।☺️

সূর্যোদয়ের_আগে
প্রিবুকিং চলবে পনেরো তারিখ পর্যন্ত।প্রিবুকিং এ থাকছে বিশেষ পঁচিশ শতাংশ ছাড়।তোমরা যারা প্রিয়মশ্রীকে নিজের সংগ্রহে রাখতে চাও,তারা বুকিং করতে পারো পাঠকবন্ধুর এই নম্বরে ফোন অথবা whatsapp করে।
পাঠকবন্ধুর নম্বর - 7439112665

রবিবার, ৪ অক্টোবর, ২০২০

সূর্যোদয়ের আগে Pre-Booking

 ধর্ষণ—জগতের ঘৃণ্যতম অপরাধগুলির মধ্যে একটি। অসহায় নারী শরীরের উপর পৈশাচিক অত্যাচারের মাধ্যমে বর্বর আনন্দলাভের মধ্যে দিয়ে নিজের যৌন কামনার তৃপ্তি ঘটায় ধর্ষক। শেষ করে দেয় একটা জীবন, একটা স্বপ্ন,একটা সম্ভাবনা কখনো বা একটা তরতাজা প্রাণ। ধর্ষকের মনস্তত্ত্বিক বিশ্লেষণ করার চেষ্টা হয়েছে বহু। নারী শরীরের প্রতি যৌন লালসাই এর একমাত্র কারন নয়, ধর্ষকের পাশবিক মনোবৃত্তিই এর জন্য দায়ী। আর এই পাশবিকতার জন্ম সমাজের এক নিকষ কালো কুধারনার গহ্বর থেকে— মেয়ে মানেই দুর্বল। তাই ধর্ষনের পরে আঙুল ওঠে ধর্ষিতার দিকে,তার পোশাকের দিকে,তার সময়জ্ঞানের দিকে।

এইরকমই এক পেক্ষাপটে এক ধর্ষিতার শেষ হয়ে যাওয়া স্বপ্ন, থেমে যাওয়া হৃৎস্পন্দনের কাহিনী সাথী দাসের—“সূর্যোদয়ের আগে”। এক ধর্ষিতার মর্মস্পর্শী যন্ত্রণার বাস্তবরূপ উঠে এসেছে লেখিকার লেখায়—যা আমাদের সমাজের অনাকাঙ্ক্ষিত কালো সত্য।

শুরু হলো প্রিবুকিং।চলবে পনেরো তারিখ পর্যন্ত।প্রিবুকিং এ থাকছে বিশেষ পঁচিশ শতাংশ ছাড়।তোমরা যারা প্রিয়মশ্রীকে নিজের সংগ্রহে রাখতে চাও,তারা বুকিং করতে পারো পাঠকবন্ধুর এই নম্বরে ফোন অথবা whatsapp করে।
পাঠকবন্ধুর নম্বর - 7439112665









শুক্রবার, ২ অক্টোবর, ২০২০

নির্বাক (তৃতীয় পর্ব)



নির্বাক


সাথী দাস


তৃতীয় পর্ব




-আসেননি এখনও?

-আপনি তখন থেকে বসেই আছেন?আপনার তো কখন চোখ দেখানো হয় গেছে।দেখুন,অযথা ভিড় বাড়াবেন না।কাইন্ডলি বাইরে গিয়ে বসুন...

-ওনার কথা যে জিজ্ঞেস করলাম।

-দিদি এখনও নীচে আসেননি।পরে হয়তো নামবেন।আপনি কি ওনার পরিচিত?বিশেষ কোনো প্রয়োজন?


চুপ করে গেলো আন্তরিক।এবার কিছু বলতে গেলেই মিথ্যে বলতে হবে।আর সেটা বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই।ও মুখ তুলে ওই ওয়ার্ডবয়ের দিকে চেয়েই বললো,


-হুম!ওনাকে গিয়ে বলুন,ওনার বাড়ি থেকে আন্তরিক গোস্বামী এসেছেন।ভীষণ প্রয়োজন।এক্ষুণি যেন একবার নীচে নামেন।

-ওঃ!বাড়ি থেকে...দাঁড়ান-দাঁড়ান!ফোন করে আসেননি?দিদি জানেন না...

-আপনি খবরটা দিন।উনি নিজেই আসবেন!


ভদ্রলোক চলে যেতেই এবার ভয় করতে লাগলো আন্তরিকের।স্কুলে প্রথম একটা পিরিয়ড করেই শরীর খারাপ বলে বেরিয়ে এসেছে।চোখ তো দেখানো হলো।চোখে যে নতুন গয়না নিতে হবে,সেটাও জানা হলো।কিন্তু তার তো দেখা পাওয়া গেলো না।তাই আগেপিছে কিছু না ভেবে ডাহা মিথ্যে কথাই বলে বসলো আন্তরিক....একটু এগিয়ে গিয়ে সবুজ পর্দার পাশে রাখা বেঞ্চটাতে গিয়ে বসলো ও...যা হবে দেখা যাবে....


-আপনি?


ঘাড় ঘুরিয়েই ভাবনার জাল ছিন্ন হয়ে গেলো আন্তরিকের।সেবিকার পোশাকে সেই সেদিনের সে এসে সামনে দাঁড়িয়েছে।তার হাতে আবার কি যেন একটা বন্য ফুল!চোখের দৃষ্টিতে অনেক প্রশ্ন,আর একইসঙ্গে বোধহয় বিশ্বাসঘাতক স্মৃতি হাতড়ে,সে মনে করার চেষ্টা করছে সামনের মানুষটার সঙ্গে জড়িত কোনো ঘটনাপ্রবাহ....


-আপনিই কি...

-হ্যাঁ আমিই....

-বলুন!আপনি নাকি আমার বাড়ি থেকে এসেছেন?আপনি চেনেন আমায়?!ক্ষমা করবেন,আমি কিন্তু আপনাকে চিনতে পারছি না!

-দুঃখিত মিথ্যে কথা বলার জন্য।আমি আপনার বাড়ি থেকে আসিনি।এত পেশেন্টের মধ্যে আপনার আমার কথা মনে থাকার কথাও না।আসলে আমি আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাইছিলাম।কিছুদিন আগেই আমার একটা ছোটখাটো একসিডেন্ট হয়েছিলো।তখন আমি এখানেই এসেছিলাম।টিটেনাস নেওয়ার সময় হাত-পা ছড়িয়ে গলা ছেড়ে কাঁদছিলাম,আপনিই তখন ইনজেক্ট করেছিলেন।তারপর এখানে এসে ড্রেসিং করিয়ে গেছি একবার।কিন্তু আপনার সঙ্গে আর দেখা হয়নি।আজ আবার একটু বিশেষ প্রয়োজনে এসেছি,তাই ভাবলাম আজ আপনাকে খুঁজে বের করে একটা ধন্যবাদ জানাতেই হবে।সেজন্যই এটুকু মিথ্যের আশ্রয় নিলাম।ক্ষমা করবেন প্লিজ...থ্যাঙ্কু,সেদিনের জন্য...


কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থেকে উনি বললেন,


-আরে এটা তো আমাদের কাজ।ধন্যবাদ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।আপনি ভালো আছেন তো এখন?হাত কেমন আছে?

-ঠিক আছে।

-তবে আজ আবার হসপিটালে?খুব প্রয়োজন ছাড়া তো কেউ এদিকে আসে না...

-চোখ দেখাতে এসেছিলাম।একটু সমস্যা আছে।গয়না পরতে বললেন উনি।

-চশমা...

-হুম!ওই আর কি!চোখের গয়না...

-বেশ।আপনি সুস্থ থাকুন।যাতে হসপিটালের আশেপাশেও আর আসতে না হয়...এলাম আমি।একটু ব্যস্ত আছি।একটা পেশেন্টের ডিসচার্জ আছে!

-ম্যাডাম?

-হ্যাঁ বলুন?


আন্তরিক দু-পা এগিয়ে গিয়েছিলো।কি করে পরেরবার আবার দেখা করা যায়,তাই ভাবতে লাগলো ও।কিন্তু বলার মতো কিছু খুঁজেই পেলো না।তারপর সেই নারীর হাতের দিকে চেয়ে বললো,


-এই হসপিটালের ভিতরে কি নার্সারী আছে কোনো?না মানে এই ফুল...

-ওহ এটা!এটা আমার বয়ফ্রেন্ড আমাকে দিয়েছে!

-হ্যাঁ!?


একটু ধাক্কা খেলো আন্তরিক।এভাবে প্রথমবারের কথাতেই,কোনো নারী এত খোলাখুলি নিজের প্রেমাস্পদের কথা বলতে পারে বুঝি!কি জানি!হবে হয়তো!যুগ ওকে পিছনে ফেলে রেখে অনেকটা এগিয়ে গেছে,নাকি ওই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে,আন্তরিক ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না।জীবনের অর্ধেকটা সময়ই তো,আন্তরিক পড়ার বইতে মুখ গুঁজে কাটিয়ে দিয়েছে।তাই ও এত খোলামেলা কথায় ঠিক অভ্যস্ত নয়।বেশ একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলো আন্তরিক।সেই সঙ্গে মন ভাঙার চিনচিনে ব্যথায় বুকটাও যেন একটু ভারী হয়ে এলো।তাকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে মনের বেলুন ফুলে আকাশে ওড়ার আগেই,ফুস করে সবটুকু হাওয়া বেরিয়ে গেলো বাইরে...চুপ করে গেলো আন্তরিক....কিন্তু সেই নারী হাসিমুখে তখনও বলে চলেছে,


-হুম!আমার সাত বছরের এক খুদে প্রেমিক।এতদিন আমাদের মধ্যে খুব ভালোবাসা ছিলো।আমার ডিউটি আওয়ারে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই,আমার সঙ্গে সে একঝুড়ি গল্প করতো।আজ ডিসচার্জ হয়ে যাচ্ছে বলে মাকে বলেছে,আমার জন্য ফুল আনতে।আমি কাল ওকে বললাম,তুই বড় হয়ে কি করবি?এখানে কত্ত ডাক্তার আছে।তুই এইরকম ডাক্তার হবি?তখন আমার ওপরেও বেশ ডাক্তারি করবি!আজ সে ছেলে আমার হাতে এই ফুলটা ধরিয়ে দিয়ে বলে কিনা,বড় হয়ে তোমাকে বিয়ে করবো।


মনখারাপের সমস্ত মেঘ কাটিয়ে,সজোরে হেসে উঠলো আন্তরিক...


-সে আজ ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছে।তাই আমার বড্ড তাড়া!আসছি....আপনি নিজের শরীরের যত্ন নেবেন।আর ইনজেকশনে একদম ভয় পাবেন না।

-ম্যাডাম!

-কিই?!!


বিরক্ত হয়ে সে বলে উঠলো...


-এটা কি আমার সেদিনের কার্যকলাপ মনে করে বললেন?নাকি এমনিই...আচ্ছা সত্যি বলুন তো,আপনি আমায় চিনতে পেরেছেন?!


-তুমি এখানে?আমি মাকে কখন থেকে তোমার কথা বলছি....আমি খুঁজছিলাম তো তোমাকে....


মাথা ঘুরিয়ে ঝুমুর দেখলো লিফট থেকে একটা হুইল চেয়ার বেরিয়ে আসছে।তাতে ওর অপরিণত রুগ্ন প্রেমিক বসে আছে।ওখান থেকে বসে-বসেই ডাকছে ও।ওয়ার্ডবয় হুইল চেয়ারটা খানিক এগিয়ে নিয়ে এলে,ঝুমুর দৌড়ে গেলো ওই দিকে।দুহাতে জড়িয়ে ধরলো ওকে...ঠোঁট ঠেকিয়ে দিলো ওর চুলহীন মসৃণ মাথায়....


-এই তো সোনা আমি!

-তোমাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না তো!কোথায় চলে গেছিলে তুমি...

-এই যে আমি...তোমার দেওয়া ফুলটা যত্ন করে কোথায় রাখা যায়,সেই জায়গা খুঁজছিলাম।

-এটা তুমি হারাবে না কিন্তু...

-একদম না!


আন্তরিক একটু দূরে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে উপভোগ করছিলো নিষ্পাপ-নির্ভেজাল একটি ভালোবাসার মুহূর্ত।অসুস্থ সন্তানকে সুস্থ করে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ছেলেটির বাবা-মা।কিন্তু তাদের মুখে একটুও হাসি নেই কেন!!মায়ের চোখের কোণে জল,কান্নাভেজা মুখশ্রী,বাবাও কেমন যেন নিষ্প্রাণ!তার চেয়ে বরং ঝুমুর অনেক বেশি প্রাণোচ্ছল-সপ্রতিভ!এমনকি তার ক্ষুদ্র প্রেমিকের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখাবয়বেও নির্মল হাসির ছোঁয়া!ওর চোখদুটো যেন হাসছে!বাবা-মায়ের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে অসমবয়সী প্রেমিক-প্রেমিকাকেই একভাবে দেখতে লাগলো আন্তরিক....


-টাটা!আমি আবার আসবো!


একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সিতে উঠে চলে গেলো ঝুমুরের খুদে প্রেমিক।হাত নেড়ে ও সরে এলো কাঁচের জানলা থেকে।


-ঝুমুর কখন বেরোবি?

-এই জাস্ট চেঞ্জ করে আসছি!


অনুসন্ধানে বসে থাকা নারীর প্রশ্নের উত্তরে ঝুমুর বললো।


-আমার আজ দেরি হবে রে।কতগুলো রিপোর্ট আছে,পেশেন্ট পার্টিকে হ্যান্ডওভার করে তবে বেরোবো।পাঁচটা বেজে যাবে মনে হয়।তাছাড়া কিছু কেনাকাটাও আছে,সেগুলো সেরে যাবো।তুই বেরিয়ে যাস!

-আচ্ছা ঠিক আছে।আমিও আজ ভীষণ টায়ার্ড!


-ম্যাডাম?

-আবার কি?কিছু বলবেন?

-ছেলেটির কি হয়েছে?আপনার প্রেমিকের?বাবা-মা সন্তানকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময়ও এমন উদাস কেন?

-কোনো বাবা-মা মৃত্যুপথযাত্রী সন্তানকে কিছুদিনের জন্য ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে,কিভাবে সুখী হবে বলুন তো?

-মানে?কি হয়েছে!

-অ্যাকিউট লিউকেমিয়া!

-মাই গড!ব্লাড ক্যান্সার!

-হুম!এই যাচ্ছে!আবার কদিন পরে ঘুরে এখানেই আসবে হয়তো!তখন হয়তো আরও বেশি অসুস্থ থাকবে,বা হয়তো আর কোনদিন আসবেই না!


চুপ করে গেলো আন্তরিক।বসে পড়লো সামনের ওই বেঞ্চে।ওর নিজের তো কেউ না।ও চেনেও না ওই বাচ্চাটিকে।তাও এত কষ্ট হচ্ছে কেন!যখন ও মাথা তুললো,তখন সামনে আর সে দাঁড়িয়ে নেই।শুন্য বারান্দা।অনুসন্ধানে সেই নারীকন্ঠ ব্যস্ত হয়ে রয়েছেন টেলিফোনের রিসিভারে....ধীরে-ধীরে বাইরে বেরিয়ে এলো আন্তরিক....


-আপনি?


আন্তরিক অনেকবার ভেবেছে এখান থেকে পালাবে।কারণ,বলার মতো তো ও আর কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছে না।আর এসব ব্যাপারে ও বরাবরই বড্ড আনাড়ি!একদিন স্যার হয়ে সেই ছাত্রীর হাত থেকেই পালিয়ে বেঁচেছিলো।বাবা কারণ জিজ্ঞেস করায়,কোনো উত্তর পর্যন্ত দিতে পারেনি।বাবা কি বুঝেছিলো কে জানে!আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি।কিন্তু এখানে গল্প তো অন্যরকম।এখানে অন্তু নিজেই কড়কে গিয়ে হড়কে গেছে।তাই মান খুইয়েও,প্রাণ বাঁচিয়ে প্রেমের পথেই ওকে হাঁটতে হবে।আজ প্রাণ পালাই-পালাই করলেও,মন কান ধরিয়ে হাসপাতালের উল্টোদিকের চায়ের দোকানটায় ওকে দাঁড় করিয়ে রাখলো।কান্না পেয়ে গেলো আন্তরিকের।এ তো রীতিমতো শাস্তি!এতদিন পড়া না পারলে ছাত্রছাত্রীদের শাস্তি দিয়েছে ও।কিন্তু এবার অন্তুর নিজেরই শাস্তিভোগের পালা।কিন্তু তবুও ও কিছুতেই পালাতে পারলো না।চা খেয়ে সবে সিগারেট ধরিয়ে একটা সুখটান দিয়েছে অন্তু,তখনই সে আকাশী রঙের ছাতা মাথায় দিয়ে বেরিয়ে এলো হাসপাতালের গেট দিয়ে।পরনে চুড়িদার।হালকা শীতের আমেজ থাকলেও,শেষ বেলায় রোদ্দুরটা বড্ড গায়ে লাগে।এখানকার রোদ এতটাই চড়া,মুখচোখ রীতিমতো ঝলসে গিয়ে ওই রুক্ষ লালমাটির মতোই হয়ে যায়।এবার বাড়ি ফেরার পর বাবা বলেছিলো,


"ইস!অন্তু পুড়ে গেছিস তো পুরো!কয়েক বছরেই তুই মুখপোড়া হনুমান হয়ে যাবি!"


নিজের দিকে আন্তরিক কোনদিনই ফিরে চায় না।তাই বাবা সেদিন ওই কথা বলতে,ও হেসেই ফেলেছিলো।ওর এতটাই ভুলো মন,ছাতা আর রুমাল ও এত্ত হারায়,তাই ছাতা নামক বস্তুটা ব্যবহার করাই ছেড়ে দিয়েছে।তবে আজ ও বেরোনোর আগে আয়নার দিকে চেয়ে দেখেছে।সত্যিই কয়েক মাসের মধ্যেই বীভৎসরকম ট্যান হয়ে গেছে ও।বাঁকুড়ার জ্বালাময়ী সূর্য জ্বালিয়ে দিয়েছে ওকে।তবে সেসবের পরোয়া ও করে না।শার্ট আর পছন্দের জিন্সে নিজেকে মুড়ে প্রতিদিনের মতোই আজও বেরিয়ে এসেছিলো।সে ছাতা খুলে রাস্তার ওপর উঠে আসতেই,অন্তু পায়ের তলায় সিগারেটটা পিষে দিয়ে,পিছন দিক থেকে এগিয়ে গিয়েছিলো ওর দিকে....ডাকতেই চমকে উঠেছিলো সে,


-হুম ম্যাডাম...আমি।ভয় পাওয়ার কিছু নেই।এই একটু চায়ের দোকানেই ছিলাম।চা খাচ্ছিলাম!

-স্বাভাবিক!চায়ের দোকানে বসে নিশ্চয়ই এগরোল-চাউমিন খাবেন না!আপনি কি চান বলুন তো?আমাকে ফলো করছেন কেন?কি ধান্দা!কেটে পড়ুন!

-নিতান্ত ব্যক্তিগত স্বার্থেই ফলো করছি।ইঞ্জেকশনকে ভয় না পাওয়ার দশটি কারণ....এই বইটা কোথায় পাওয়া যায় বলতে পারেন!


রাস্তার মাঝে আন্তরিকের ডাকে দাঁড়ায়নি ও।তবে আন্তরিকের কথা শুনে হাঁটতে-হাঁটতে হেসেই ফেললো ঝুমুর....আন্তরিকও ওর সঙ্গে হাসিতে যোগ দিয়ে বললো,


-আসলে ম্যাডাম,আপনাকে দেখে ভাবলাম,আমার সঙ্গে একটু কথা বলতে আপনার বোধহয় কোনো অসুবিধে হবে না!

-তা হঠাৎ এই রকম ভাবনার কারণ?

-জানি না...জাস্ট মনে হলো।

-আপনি এবার আসুন।আমিও আসি।বাসে উঠবো...

-চোখের ডাক্তারের খবরটা বৌদি দিয়েছিলো।এবার চশমার দোকানের খবর কোথায় যে পাই...শহরে নতুন হলে যা হয় আর কি!সবই অচেনা।বারবার হোঁচট খাচ্ছি,প্রতিপদে....আসলে হাত ধরার মতো কেউ নেই তো!তার মধ্যে চোখেও আবার একটু কম দেখি!চশমাটা না আসা পর্যন্ত....


কোনো কথার উত্তর দিলো না ঝুমুর।ছাতাটা বন্ধ করে হাত দেখিয়ে সোজা এগিয়ে গেলো বাসের দিকে।থমকে গেলো আন্তরিক।ও জানে না কিভাবে কথা শুরু করতে হয়,বা কোথায় থামতে হয়!বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো মনে হয়।এবার আর জীবনেও কথা বলবে না।কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে পিছন ফিরলো সে...


-কি হলো?দাঁড়িয়ে রইলেন যে?আসুন!চশমার দোকান সামনেই পড়বে।আপনাকে নামিয়ে দেবো।হাতে লাঠি দিতে হবে না নিশ্চয়ই....হাত ধরতেও পারবো না কিন্তু।অন্ধের যষ্টি হওয়ার ক্ষমতা নেই!এমনি আসলে আসুন....


আন্তরিক মাথা নামিয়ে হেসে ফেললো।একদৌড়ে এগিয়ে গেলো বাসের দিকে....


-জানেন ঝুমুর দেবী....

-ইস!ম্যাডাম পর্যন্ত তাও ঠিক ছিলো,দেবী!!আপনি বড্ড সেকেলে!আমি নিতান্তই সাধারণ মানবী!নিখাদ মানবসন্তান!দেবী-টেবী কিসব বলছেন!

-ওটা সম্মান!

-আমি এত সম্মানে অভ্যস্ত নই।ইস...

-আপনি খুব সুন্দর করে ইস বলেন তো!

-কি!!

-ইস!

-সত্যিই ইস!এই ফ্রেমটা ভালো লাগছে না।বয়স্কদের মতো।আপনার পছন্দ পাতে দেওয়ার মতো না।

-সেই জন্যই তো একরকম জোর করে আপনাকে মাঝপথে নামালাম।ফ্রেম পছন্দ করে দেওয়ার জন্য।দেখুন এটা...

-এটা তাও যায়!রিমলেস আপনাকে মানবে না।চওড়া ফ্রেম নিন।সাহিত্যের শিক্ষক যখন।বেশ একটা ভারিক্কি ব্যাপার আসবে।এটা দুর্দান্ত কিন্তু...

-এটাই থাকবে।দাদা এই যে প্রেসক্রিপশন।কবে নিতে আসবো?

-পরশু বিকেলে আসুন!

-আচ্ছা!


-দিব্যি আচ্ছা বলে তো বেরিয়ে এলেন।এবার পরশু বিকেল পর্যন্ত চশমা ছাড়া একা কাটাবেন কি করে?একটু আগেই তো এক মুহূর্তও কাটাতে পারছিলেন না!!আপনি তো নাকি আবার চোখেই দেখেন না...


ঝলমলে হাসি হেসে বলে উঠলো ঝুমুর....আন্তরিক বললো,


-দেখুন ঝুমুর দেবী...

-আবার দেবী?এত দেবী-দেবী করলে নৈবেদ্য দিতে হবে কিন্তু....তাও নিয়ম করে দুবেলা!

-রাজি!

-কি!!

-না সত্যিই!আদ্যোপান্ত বামুনঘরের নিপাট ভদ্রসন্তান আমি!আমার ঘরে নৈবেদ্যর অভাব হবে না!পাত পেড়ে আপনার সামনে সাজিয়ে দেবো,তাও নিজের হাতে...

-আপনি ব্রাহ্মণ?

-হুম!আন্তরিক গোস্বামী!

-ওহ!শুধু ব্রাহ্মণই নয়,রীতিমতো ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ যাকে বলে,সেই দলে পড়েন তো আপনি....এলাম....

-এই দাঁড়ান!কি হলো?ব্রাহ্মণ হয়ে অপরাধ করে ফেললাম নাকি!

-আমার সঙ্গে মিশবেন না।আপনার জাত চলে যাবে।

-জাত আবার কি?

-সেটা আপনারা ভালোই বোঝেন!

-না বুঝি না।বোঝান!

-আমার পুরো নাম জানেন?পদবী সহ?জানলে ছিটকে সরে যাবেন।

-কি?

-ঝুমুর প্রামাণিক!

-তো?রক্তের রঙ তো লাল!


অবাক হয়ে আন্তরিকের মুখের দিকে চেয়ে রইলো ঝুমুর।তারপর মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো.... আন্তরিক মৃদুস্বরে বললো,


-জানেন ঝুমুর দেবী,আজ হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আমরা বেশ অনেকটা সুন্দর সময় একসঙ্গে কাটালাম।তবুও একটা ব্যাপার আমি কিন্তু কিছুতেই মন থেকে বের করতে পারছি না।

-কি ব্যাপার?

-আপনার প্রেমিকের অসুখটার কথা শুনে বড্ড আঘাত পেয়েছি!এসব জাত-ধর্ম কি!পেশেন্টকে ক্রাইসিসের সময় রক্ত দেওয়ার হলে,চিকিৎসার সময় আপনারা জাত-ধর্ম বিচার করতে বসেন!ওইটুকু বাচ্চার ওই অবস্থা দেখে আমারই কি ভীষণ খারাপ লাগছে।আপনার খারাপ লাগে না?

-লাগে।কিন্তু মনকে শক্ত করতে হয়।নইলে কাজ করতে পারবো না।মৃত্যু বড় সহজ আমাদের কাছে!বরং জীবনটা টিকিয়ে রাখাই কঠিন।আর ওই কঠিন কাজটাই আমরা করি!জীবনকে ধরে রাখার সর্বান্তকরণে চেষ্টা...জানেন তো,সবচেয়ে সহজ সমাধানকে হারাতেও কিন্তু কঠিন অধ্যবসায় লাগে!আমরা যারা এই সেবা নামক প্রফেশনের সঙ্গে যুক্ত,ডাক্তার-নার্স,প্রতিটা মানুষ....তারা ওই সহজ সমাধানের বিরুদ্ধেই প্রতিমুহূর্তে পাঞ্জা লড়ি।আর আমাদের ভুল হওয়ারও কোনো জায়গাই নেই।সরি বলি আমরা অনেক জ্বালায়!যতক্ষণ না বলে পারা যায়!বুঝলেন?!

-ছেলেটি কি সত্যিই বাঁচবে না?মানে আমি জানি না এসব রোগের চিকিৎসা...রক্ত দিয়ে বা কোনো অপারেশন করে যদি...

-বাঁচবে...

-সত্যি!?

-হুম!এটা সবসময় ওর পরিবারকে বলতে হবে।ওনাদের সন্তান সুস্থ হয়ে যাবে।এটাই বারংবার বলে মানাতে হবে ওদের।যাতে ওনারা ভেঙে না পড়েন।সন্তানের আসন্ন মৃত্যুভয়ে,যেন হেরে না যান!আমরা পুরোপুরি হেরে না যাওয়া পর্যন্ত,কিছুতেই হার মানি না!

-আইসক্রিম খাবেন ঝুমুর দেবী?

-না!থ্যাঙ্কু!

-রেগে আছেন নাকি কোনো কারণে?

-ইস!!নানা!

-আবার ইস!উফ!কি কিউট আপনি!

-এই নানা....আমি রাগি না তো!আমার মতো শান্ত মেয়ে পুরো বাঁকুড়া টাউনে আর দুটি নেই!

-তাই!!তবে আপনাকে রাগী দেখায় কেন?এত গম্ভীর!?

-কি আশ্চর্য!আমার মুখটাই তো এইরকম রাগী-রাগী!আমি কি করবো?

-কিচ্ছু করতে হবে না।ভালো লাগে তো বেশ।ব্যক্তিত্বময়ী!

সহজে কথা বলতে ভয় করে!তবে হাসলেই বেশী ভালোলাগে।আপনার প্রেমিকের কিন্তু এলেম আছে বলতে হবে।দিব্যি আপনার প্রেমে পড়ে গেলো।আবার বলেও দিলো কত্ত সহজে!ভীষণ কিউট বাচ্চা...

-হুম!ভীষণই মিষ্টি!তারপর...আপনি বলুন,আপনার ক্লাসের সবচেয়ে পচা স্টুডেন্টটি কে?কি তার কার্যকলাপ?

-হোয়াট!খুব খারাপ প্রশ্ন এটা!আমি আমার সব ছাত্রছাত্রীদের ভালোবাসি!আমার কাছে কেউ খারাপ নয়!সবাই সমান!

-ইস!বললেই হলো?!

-আপনি ইস বলতে থাকুন....অসম্ভব ভালো লাগে!কিন্তু সত্যিই আমার কোনো অপছন্দের স্টুডেন্ট নেই!

-হতেই পারে না!আমারও ঘাড়-ত্যারা পেশেন্ট আছে।ভীষণ কথার অবাধ্য।সব জায়গায় অপছন্দ থাকতে বাধ্য।আপনারও আছে...থাকবেই!

-ওয়েল....বলেই ফেলি তবে!?

-একদম...সচ্ছন্দে!

-এই সত্যিই আপনি কিছু খাবেন না?

-কেন বলুন তো?আপনার কি খিদে পেয়েছে?বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত হেঁটে যাবো,এইটুকু তো রাস্তা!তার মধ্যে আপনি অন্তত বার তিনেক খাবার কথা বললেন!

-আসলে আমি রন্ধনে অষ্টরম্ভা!তবে আদ্যোপান্ত খেকো একজন মানুষ!


সশব্দে হেসে উঠলো ঝুমুর।পুরো ভেবলে গেলো আন্তরিক।হাসির মতো ও কি বললো,সেটাই ওর মাথায় ঢুকলো না...


-সরি!আমি কি বললাম!?ভুল কিছু বললাম?

-খেকো একজন মানুষ!নাকি মানুষখেকো!?

-নাঃ!মানুষে অরুচি!বাকি সব চলে!

-সত্যি!

-একদম!আমি বিশাল ফুডি!

-এই জন্যই খাই-খাই করছেন!

-এভাবে বলবেন?

-আচ্ছা সরি!আপনি কি বলছিলেন,আপনার অপছন্দের স্টুডেন্ট?

-হুম!আছে বুঝলেন তো!দুজন ছাত্র!তারা বেস্টফ্রেন্ড!আর তাদের আমাকে নিয়ে বড্ড বেশি প্রব্লেম।প্রথম দিন থেকেই।কেন জানি না!আমি ক্লাসে ঢোকার পরও ওরা কথা বলেই যাবে গুজগুজ করে।আমি জানি,আমার পিছনেও ওরা আমাকে নকল করে হেব্বি মজা পায়।ওই দুজনের ওপর না,আমার খুব রাগ হয়।আবার ওদের সামনে গেলে হেসেও ফেলি!মনে হয় যেন নিজের সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।নিজেও তো এককালে স্কুলে থাকতে এমনটাই করতাম।ওরাই বা করবে না কেন!তবে একটা ব্যাপার আছে।সেটা হলো,তারা আমার ক্লাসে পড়া পারলো তো বেঁচে গেলো।আর না পারলে অন্যদের চেয়ে তাদের শাস্তিটা একটু বেশিই হয়।

-যেমন?

-যেমন...অন্যরা যদি ক্লাসের মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকে,তারা ক্লাসের বাইরে...

-এটুকু?!ব্যাস!হাতে বেত নিয়ে টিকি দুলিয়ে পড়ান না!তেল-মাখানো বেত দিয়ে সাঁই-সাঁই করে পেটান না?

-এ কি কথা!আমি কোনোদিনও কোনো ছাত্রছাত্রীর গায়ে হাত দিইনি,দেবোও না।যেটুকু শাসন ওই মুখেই।আর তাছাড়া,একটা হাইস্কুলের বাংলার টিচার আমি।ফিনফিনে ধুতি পড়ে পাঠশালায় পড়াই নাকি,যে টিকি থাকবে!

-না,বামুনদের তো পৈতে থাকে,টিকিও থাকে।টিকিতে একটা গাঁদাফুলও থাকে।আপনার নেই কেন?


বলেই হেসে ফেললো ঝুমুর।সঙ্গে আন্তরিকও...


-উফফ!আপনি পারেন বটে!পৈতে সে একবার টাকলু হয়ে উপনয়নের পর গয়নার মতো পরেছিলাম ঠিকই,তারপর সে ছিঁড়ে-ফেঁড়ে কোথায় অদৃশ্য হয়েছে,আজ তার আর কোনো অস্তিত্বই নেই!চলুন না,কিছু খাই...

-ইস!!খালি খাই-খাই!আমি খাবো না....আপনি খেলে খান!

-না থাক!তবে একটু চা পেলে মন্দ হতো না অবশ্য!চা আর সিগারেট ছাড়া একজন ব্যাচেলরের জীবনে আর আছেটা কি!!মনটা বড্ড চা-চা করছে!

-জীবনে আরও অনেক কিছু আছে!আপনি জানেন,সিগারেট ক্যানসারের....

-জানি!

-তাও...

-ছাড়তে পারি না!

-দাঁড়ান!আপনাকে একদিন আমাদের ওয়ার্ড থেকে ঘুরিয়ে আনবো।দেখবেন,কারোর গাল খুবলে কাটা,কারোর গলার একাংশ কাটা,কারোর তো সারা জীবনের মতো,আর কথা বলার ক্ষমতাই নেই।নিজে ডেকে আনা রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে,এখন হাতের শেষ সম্বল দু-চারগাছা সোনার চুড়ি,এমনকি ঘটি-বাটি পর্যন্ত বিক্রি করতে হচ্ছে।সবকিছুর কারণ এই তামাক!তাও তো এগুলো দেখতে পাচ্ছেন!শরীরের ওপরকার ক্ষত!আর আপনার শরীরের ভিতরে নিকোটিন কত ক্ষতি করছে জানেন!ফুসফুসের হাল কি করছেন,সে খেয়াল আছে?!সিগারেটের প্যাকেটের ওপরের অমন মর্মান্তিক ছবি দেখেও কি আপনাদের শিক্ষা হয় না!?সত্যি....আপনারা দেখে নয়,ঠেকে শেখেন!যখন ঠেকবেন,তখন ছাড়বেন!

-তাও পারবো না বোধহয়!

-কি অবস্থা!মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও...

-ওরে বাপ রে!আচ্ছা খুব ভুল হয়ে গেছে।চা-সিগারেট সমস্ত ক্যানসেল!আসলে ভুলতে চাইছিলাম!

-কাকে?প্রাক্তনীকে?এভাবে নিজেকে শেষ করে!

-নানা!আমার প্রাক্তনী কেউ নেই।কোনোদিন কেউ ছিলোই না!কারোর প্রাক্তন হয়ে ওঠার সৌভাগ্য,আমার আজ পর্যন্ত হলো না!

-ইস!

-উফ!

-কি?

-কিছুনা!!

-আপনার কত্ত সৌভাগ্য!আমার কিন্তু ভীষণ হিংসে হচ্ছে!আপনার মন ভাঙেনি!আপনি তো তবে কোটিতে একজন মশাই!

-আপনি?

-কি করবেন জেনে!কোনো প্রয়োজন আছে কি!আমি কেন বলবো আপনাকে?

-ঠিক!এটা বললে মানতে পারি।আপনি আমার মতো স্বল্পপরিচিত একজনের কাছে কেন এসব ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে কথা বলবেন!এটা মেনেই নিলাম।কিন্তু ওটা মানবো না।

-কোনটা?

-ওই যে,কোনো প্রয়োজন আছে কি!কেন?সবসময় কি প্রয়োজন-স্বার্থ থাকাটা খুব প্রয়োজন?বন্ধু হয়ে বন্ধুকেও তো বলা যায়!

-ইস!ভারী মজা!!নার্সের সঙ্গে বন্ধুত্ব?ভেবে বলছেন তো?কথার আগেই কিন্তু সূঁচ ফুটিয়ে দেবো!তখন আবার চেল্লাবেন!

-ভালোই তো!আপনার কারণে আহত হলে,আপনিই সেবা করবেন।সেবাই আপনার পরম ধর্ম!ঠিক কিনা!


একরাশ হাসি জুড়ে রইলো ঝুমুরের সারাটা মুখাবয়বে...


-খুব তো কথার মারপ্যাঁচ জানেন!তা কাকে ভুলতে চাইছেন,বললেন না তো?

-ওই বাচ্চাটিকে।আমি শুধু ভাবছি,আমরা কত সামান্য কারণেই অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি।আর ওই একরত্তি বাচ্চাটা লড়াই করেই যাচ্ছে,করেই যাচ্ছে।কত্ত কষ্ট পাচ্ছে!শারীরিক,মানসিক!আর ওর বাবা-মা চোখের সামনে এভাবে নিজের সন্তানকে দেখছেন!সন্তানের মর্মান্তিক পরিণতির জন্য নিজেদের প্রস্তুত করা....উফ!

-হুম!

-সত্যিই বড্ড খারাপ লাগছে বাচ্চাটার জন্য।

-কি আর করা যাবে!?আমি আসছি!বাসে উঠবো।আপনি তো উল্টোদিকে যাবেন?আসুন তাহলে!

-বলছিলাম কি!নেহাৎ হাত-পা কেটেকুটে না ফেললে আপনার হসপিটালে আসা যায় না!তাই না!!

-না!ওখানে আসতে হলে,রোগী হয়ে রোগ বাধিয়েই আসতে হবে।

-ও আচ্ছা....রোজ-রোজ কিভাবে অসুস্থ হই বলুন তো!

-আপনি মশাই ঠিক সুবিধের ঠেকছেন না!কি চান বলুন তো?

-ভরসা করতে পারেন।

-কেন করবো?

-তার কারণ দেখানোর জন্যও তো আমাকে অসুস্থ হয়ে হসপিটালে যেতে হবে।আপনার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে।কি বিড়ম্বনা!!আর তো কোনো উপায় নেই!

-তাহলে আর কি করা যাবে?!স্কুল আর বাড়িই করুন,নিশ্চিন্ত মনে...

-হুম!কিচ্ছু করার নেই।আমার কপাল!

-বেশ!তবে...আমার পছন্দের চশমা পরে আপনাকে দেখতে কেমন লাগছে,সেটা আমায় জানাবেন না?


মাথা নামিয়ে হাসলো আন্তরিক....


-আপনি না হয় নিজেই দেখে নেবেন!পরশু!এইখানেই...ওই চশমার দোকানের সামনে।ঠিক বিকেল পাঁচটা!সেদিন কিন্তু আপনাকে চা খাওয়াবোই!

-শুধু চায়ের জন্য ব্রেক-জার্নি পোষাবে না মশাই!

-চায়ের সঙ্গে টা-টাও না হয় জুড়ে দেবো,নৈবেদ্য হিসেবে!আশা করি এই অধমের হাতের নৈবেদ্য গ্রহণ করবেন!

-আসছি....

-আসুন!


বাসটা ঝুমুরকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো আন্তরিকের চোখের সামনে দিয়ে।আন্তরিক রাস্তা পেরিয়ে এপারে এলো।বাড়ি যাওয়ার জন্য ফিরতি-বাসে উঠবে বলে....মনে-মনে একবার শুধু বললো,

"ইস!!!!"


-অন্তু দাদা!কখন থেকে ডাকছি!শুনতে পাও না নাকি!


আনোয়ারের মায়ের এক ধাক্কায় অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এলো আন্তরিক।উঠে বসলো বিছানার ওপরে।বন্ধ করে বালিশের পাশে সরিয়ে রাখলো "সঞ্চয়িতা"....


-আপা!তুমি?ডাকছিলে আমায়?

-ডাকছিলে মানে!কখন থেকে ডাকছি।নীচ থেকে ডাকতে-ডাকতে গলা ফেটে গেলো তো!তোমার বাবা কখন থেকে বসে রয়েছে,একসঙ্গে বসে খাবে বলে!আমি ডাকতে এসে দেখি,তুমি চোখ বন্ধ করে হাসছো!জেগে-জেগেই স্বপ্ন দেখছিলে!নাকি ঘুমুচ্ছিলে?

-ওই চোখটা একটুখানি লেগে এসেছিলো আপা!চলো,বাবা বসে আছে না?তুমি খেয়েছো?

-হ্যাঁ....এই তোমাদের খেতে দিয়েই খাবো....


আনোয়ারের মায়ের সঙ্গে কথা বলতে-বলতেই চশমার কাঁচটা জামার এককোণ দিয়ে ঘষে মুছে নিচ্ছিলো আন্তরিক।তারপর চশমাটা চোখে পরে নিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘরের বাইরে...বালিশের পাশে অবহেলায় আত্মগোপন করে পড়ে রইলো অতীতের একমুঠো স্মৃতিস্বরূপ "সঞ্চয়িতা"....


-বলো মণিমা!ডেকেছিলে?


হাত নাড়িয়ে ঘড়ির দিকে ইশারা করলেন সৌদামিনী দেবী।


-এই মিনিট দশেকের মধ্যেই বেরোবো!রেডি হচ্ছি।


আলমারী খুলে কতগুলো শাড়ি বের করে দিলেন সৌদামিনী দেবী।তার মধ্যে বিয়ের লাল বেনারসীটাও রয়েছে।রাত্রির পরনের শাড়িটা টেনে ওর ব্লাউজে হাত রাখলেন উনি!তারপর দেখালেন টেবিলের ওপরে রাখা বাংলা ক্যালেন্ডারের দিকে....রাত্রি মৃদু হেসে বললো,


-জানি মণিমা!বিয়ের আর বেশিদিন বাকি নেই।শাড়ি ফলস-পিকো-ব্লাউজ সব হবে।তুমি ঘরে বসে-বসে এত চিন্তা কোরো না তো!দেখছি কবে যাওয়া যায়!


হাত নেড়ে চোখ রাঙালেন সৌদামিনী দেবী।


-অসম্ভব!আজ হবেই না!কাজ আছে।


আলমারী খুলে কতগুলো বড়-বড় নোট রাত্রির হাতে গুঁজে দিতে গেলেন সৌদামিনী দেবী।


-মণিমা,আমার কাছে আছে।এত টাকা লাগবে না!আছে তো...


সেই মুহূর্তেই ওপর থেকে নেমে শাশুড়ির ঘরে পা রাখলো অফিসযাত্রী স্বর্ণালী।রাত্রি আর সৌদামিনী দেবী দুজনেই থমকে গেলেন।পুত্রবধূকে দেখে হাতের টাকাটা আবার আলমারীতে রাখলেন সৌদামিনী দেবী....


-সরিয়ে রেখে কি হবে মা!দিয়েই দিন!সত্যিই এমন কপাল পেতে অনেক ভাগ্য লাগে রাত্রি।একদিকে স্বপ্ন,একদিকে তার মা,টাকা ঢেলে দিচ্ছে তোমার জন্য!


রাত্রি মাথা নামিয়ে নিলো।সৌদামিনী চির-নির্বাক....


-তা বাড়ির বউয়ের প্রতি কেউ কোনো দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করুক বা না করুক,বউয়ের তো বাড়ির প্রতিটা সদস্যের প্রতি একটা দায়িত্ব থেকেই যায়।সেটা আমি অস্বীকার করি কি করে?

-স্বর্ণ নীচে এসো।রোজ-রোজ তোমার জন্য আমার অফিসে ঢুকতে দেরি হয়ে যাচ্ছে।

-তুমি যাও!আমি আসছি!


তাও মায়ের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়েই রইলো স্বপ্ননীল....


-কি হলো?যাও!

-মা আসছি!রাত্রি এলাম!

-হুম...


স্বপ্ননীল নীচে নেমে গেলে স্বর্ণালী বললো,

-রাত্রি সামনেই তোমার বিয়ে।সবাই তোমার জন্য অনেক করছে।আমার আলাদা করে আর কিছু করার প্রয়োজন পড়ে না।বা কেউ আমাকে ডাকবেও না কিছু করতে।কিন্তু আমি তো দূরে সরে থাকতে পারি না।যেহেতু আমার বাড়িতেই একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে।তোমার বিয়েতে কিছু একটা গয়না দেবো।আমার বাজেট ভাই এদের মতো এত আনলিমিটেড নয়!ছোটখাটো কিছুই নিও।আমার সঙ্গে গিয়ে পছন্দ করে কিনে নেবে।ওটা আমার তরফ থেকে তোমার নতুন জীবন শুরু করার শুভকামনায় একটা সামান্য উপহার...কবে বেরোবে বলো?আজ!কতক্ষণ তোমার শিফট?

-বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত।দুটো শো আছে।তুমি ছেড়ে দাও না বৌমনি।সবাই তো এত দিচ্ছে।আর দরকার নেই।এই অনেক....

-না!সবাই দিলেও আমার দিক থেকে কিছু একটা তোমায় নিতেই হবে।যাতে ও বাড়ি যাওয়ার পর ওই গয়নাটা তোমাকে আমার কথা মনে করিয়ে দেয়।তুমি যেন ভুলে না যাও,স্বপ্ননীল মুখার্জী বিবাহিত!

-সেটা আমি কোনোদিনও ভুলবো না বৌমনি!এভাবে একথা বলার মানে কি!

-মানেটা না বুঝতে পারার মতো অবুঝ তো তুমি নও!

-আমার কোনো গয়না লাগবেনা।

-কেন?তোমার নীল দা না দিয়ে,নীল দার বউ দিচ্ছে তাই?!

-আমার অযথা তর্ক করতে ভালো লাগছে না।আমি বেরোবো বৌমনি!তোমারও বোধহয় দেরী হয়ে যাচ্ছে!

-হুম....আমার দিকটা কে কোনদিন বুঝেছে!তোমার কাছে তো কিছু আশাই করি না।তুমি তো বাইরের মেয়ে।কিন্তু মা আপনার কাছ থেকেও কোনোদিনও একটু সম্মান পেলাম না...আমি অফিস থেকে বেরিয়ে তোমাকে ফোন করবো রাত্রি।তারপর সোনার দোকানে যাবো।এলাম!মা আসছি....


সৌদামিনী স্বর্ণালীর হাত টেনে ধরলো।হাত গোল করে দেখালো....স্বর্ণালী কোনোরকমে দায়সারা উত্তর দিলো,


-না মা,রাত্রি বলেছিলো।আমিই কিছু টিফিন নিইনি।আজ ক্যান্টিনেই কিছু খেয়ে নেবো।পিসিমনি ছাদে জামাকাপড় মেলতে গেছে মা।নামলে মামনিকে নতুন ড্রেসটা পরে দেখতে বলবেন।অল্টার করতে হলে,আজ-কালের মধ্যেই পিসিমনি আর মামনিকে নিয়ে বেরোবো।বিয়ের তো আর বেশিদিন বাকি নেই।রাত্রি,তুমি কবে যাবে ব্লাউজ বানাতে...আমি যাবো সঙ্গে?

-নাঃ!থাক!

-ও....তোমার বর আসবে বুঝি?

-দেখি,ও কি বলে!

-ঠিক আছে,দেখো।দরকার হলে আমাকে বলবে।আমি আছি।

-বৌমনি....


সৌদামিনীর ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছিলো স্বর্ণালী।আবার রাত্রির ডাকে ও ফিরলো,


-কিছু বলবে?

-কাল রাতে তোমাকে অনেকবার ডেকেছিলাম শাড়ি দেখতে...তুমি তো শাড়ি কেনার সময় ছিলে না,তাই....

-রাত্রি কাল রাতে আমার একটু মেজাজটা বিগড়ে ছিলো ভাই।সরি!কিছু মনে কোরো না।

-না!ঠিক আছে!

-তুমি নিতান্ত অবুঝ নও,তাই তুমি বুঝবে!সবকিছু ভাগ করা যায়,কিন্তু ভালোবাসা না!ভালোবাসার মানুষটাকেও না।তোমাকে আর বেশি কিছু বোঝাতে হবে না আশা করি।বিয়েটা করো,ভালো থাকো,সুখে সংসার করো।দূরে থাকো!আমাকেও ভালো থাকতে দাও!দেখো,তোমার সঙ্গে আমার কোনো দ্বন্দ্বের জায়গাই নেই।তোমার সঙ্গে আমার তুলনাই চলে না...

-তাহলে করছো কেন?

-এটা তুলনা নয়।এটা ভয়!হারিয়ে ফেলার ভয়।

-তোমার কোনো ভয় নেই!

-মুখে সেটা বলে-বলেই তো তুমি আজ এই পর্যন্ত পৌঁছে গেছো!পিসিমনি বলে....

-পিসিমনি যা বলে,ভুল বলে!একটা কথা ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করো বৌমনি,কেউ নিজে ভালো না থাকলে,সে কিন্তু কারোর ভালো থাকাটাও সহ্য করতে পারে না!তার চোখে লাগে সেটা!কেউ এতটাও উদার না।তোমারটা বোঝা যায়,কারণ তুমি কষ্ট পেলে মুখের ওপর বলে ফেলো তো!সেইজন্য!!কিন্তু পিসিমনিরটা বোঝা যায় না!সে নিজে শেষ হয়ে যাচ্ছে!এই সংসারটাও শেষ করে দেবে।আমার কি!আমি আজ বাদে কাল চলেই যাবো।মণিমার অবর্তমানে এই বাড়িতে আর পা-ও রাখবো না।কিন্তু পিসিমনির কথা শুনে তুমি ওই মানুষটাকে কষ্ট দিও না।মণিমার তো তোমরা ছাড়া আর কেউ নেই....ছুরি-দা-কাটারি তো মিথ্যে-মিথ্যেই এত বদনাম কুড়োয় বৌমনি!সবচেয়ে বেশি আঘাত কিন্তু কথাই করে!এর বেশি আমার আর কিছু বলা মানায় না।কারণ,এই সংসারটা তোমারই...যাও!সাবধানে এসো...


স্বর্ণালী আর একটা কথাও বলতে পারলো না।চুপ করে বেরিয়ে গেলো।সৌদামিনী দেবীর ঘরের দিকে ফিরেই রাত্রি দেখলো,মণিমা ঠিক দরজার সামনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে....রাত্রি ঢুকতেই উনি বিয়ের বেনারসীটা রাত্রির দিকে এগিয়ে দিলেন।ওটা কাঁধের ওপর ফেলে,রাত্রি এগোলো আয়নার দিকে....বিভোর হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইলেন সৌদামিনী দেবী....দুটো চোখ ওনার জুড়িয়ে গেলো....


-আজ বৌমনি গয়নার দোকানে যাবে বললো।এগুলো নিয়ে কাল যাবো মণিমা।আসছি আমি।শো-এর সময় হয়ে যাচ্ছে!এরপর দেরি হয়ে যাবে।


মণিমাকে প্রণাম করে দোতলা ছেড়ে নীচে নেমে গেলো রাত্রি।ওর বিয়ের বেনারসীটা হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পালঙ্কের পাশে বসে রইলেন সৌদামিনী দেবী।তারপর ধীরে-ধীরে এগোলেন নিজের আলমারীর দিকে।বের করে আনলেন পিঁজে ফেঁসে যাওয়া লাল চেলিটা।চুমকি ঝরে গিয়ে শতছিদ্র হয়ে যাওয়া,জালের মতো জরি দেওয়া মাথার ওড়নাটা।ওইগুলো বুকে করে নিয়ে,ঘরের দরজাটা বন্ধ করলেন উনি।টেবিলে ফ্রেমবন্দী হয়ে একমাত্র পুত্রসন্তান স্বপ্ননীল হাসছে।তার পাশেই ফ্রেমবন্দী সাদাকালো ছবিতে পাশাপাশি নবদম্পতি।সাদা-কালো একটি ছবি।চেয়ারে সোজা হয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বসে রয়েছেন নববধূ সৌদামিনী মুখার্জী,পাশেই দুটো হাত বুকের কাছে নিয়ে যন্ত্রমানবের মতো সটান দাঁড়িয়ে রয়েছেন রজতশুভ্র মুখার্জী!বহু বছর ধরে সযত্নে আগলে রাখা ছবিটা,একেবারেই খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।রাত্রি গত বছর বিবাহবার্ষিকীতে জোর করে এটা বের করে নিয়ে গিয়ে,ফ্রেমে মুড়ে এনে দিয়েছে।মুখগুলো আবছা হলেও,এখন বেশ বোঝা যায়।নিজের সিঁদুরে রাঙা লাজুক মুখ,আর স্বামীর প্রখর ব্যক্তিত্বে আজও মোহিত হয়ে গেলেন সৌদামিনী দেবী।চুপিচুপি চুরি করে ছবিটা একবার বুকে চেপে ধরলেন।ড্রয়ার থেকে বের করে আনলেন রজতশুভ্র বাবুর শেষ জীবনে ব্যবহার করা হাতঘড়িটা...ওটাকে কানে ধরলেন।চলে না আর....কাঁটাও নড়ে না।সময় যেন থমকে রয়েছে অতীতেই...রাত্রির বিয়ের কারণে আয়োজিত এই বৈবাহিক পরিমণ্ডলে,নিজের বিয়ের দিনটা মনে পড়ে গেলো সৌদামিনী দেবীর।তবে গল্পটা তো শুরু হয়েছিলো,তারও আগে।যেদিন সে বড়দাদার সঙ্গে এসে দাঁড়িয়েছিলো ঠাকুর-দালানে....হাতের ছবিতে চোখ রেখে অতীতের সুন্দর স্মৃতিচারণে মগ্ন হলেন সৌদামিনী দেবী....


তখন সদ্য জামা ছেড়ে কাপড় পরেছে নবযৌবনা সৌদামিনী।কাপড় ঠিকমতো সামলাতেও পারে না।আর সেদিন?সেদিন তো শরতের আকাশে ছিলো ভাসমান মেঘের আনাগোনা।গ্রামের ভটচাজ বাড়ির ঠাকুর-দালানে ডাকের সাজের একচালার ঠাকুর এসে গিয়েছে আগের দিনই।সকাল থেকেই বিস্তর হুড়োহুড়ি,চরম ব্যস্ততা।সেবার পুজোয় প্রথমবার কাপড় পরেছে সৌদামিনী।সবাই ওকে রকমারি ফ্রক না দিয়ে,কাপড় উপহার দিয়েছে।বালিকা থেকে নারীত্ব বরণ করে নিয়েছে সে।কিন্তু ওর দস্যিপনায় কেউ একটুও লাগাম দিতে পারেনি।সেদিনও কোমরে কাপড় গুঁজে দুহাতে একগাদা সিক্ত পদ্মফুল হাতে নিয়ে ছুটতে-ছুটতে সৌদামিনী পৌঁছেছিল বাড়ির চৌকাঠে।কাপড় ছিলো আলুথালু!লাল-লাল ফিতে দিয়ে দুদিকে কলা-বিনুনী করে দেওয়া চুলগুলো ছিলো অবিন্যস্ত....আর সেই সঙ্গে নূপুর পরা দু-পায়ে পুকুরের পাঁক শুকিয়ে একেবারে মাখামাখি অবস্থা....ভিজে পায়ে সদ্য গোবর-নিকোনো উঠোনে ঢুকতে যেতেই পেল্লায় একখানা রাম-আছাড় খাচ্ছিলো সৌদামিনী!সে সামনে না থাকলে,বোধহয় পড়ে গিয়ে পুজো-বাড়িতেই একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলতো।সেই সেদিন ওকে ধরে বলছিলো,


-এই রে!তোমার লাগেনি তো!যাঃ!!ফুলগুলো তো সব আমার পায়ের ওপরেই পড়ে গেলো।এবার তুমি পুজো দেবে কি দিয়ে?এভাবে কেউ দৌড়োয়?লেগেছে?কি হলো....!!


রজতশুভ্রর হাত ছাড়িয়ে সেদিন ঠাকুর-দালানের দিকে দৌড় দিয়েছিলো সৌদামিনী।এতগুলো কথার একটাও উত্তর না পাওয়ায়,বেশ একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলো রজতশুভ্র।দৌড়োতে-দৌড়োতেই সৌদামিনী শুনেছিলো সেদিন,বড়দাদা তাকে বলেছিলো,


-ও মিনী!আমাদের ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোটো ও।মিনী কথা বলতে পারে না রজত।ও বোবা!


সেদিন সৌদামিনী ঠাকুর-দালানের আড়াল থেকেই দেখেছিলো,চমকে উঠে সে চেয়েছিলো তার নিজের পায়ের দিকেই।তার পায়ের ওপরেই বুঝি তখনও পড়েছিলো সৌদামিনীর হাত থেকে অর্পণ করা একগুচ্ছ পদ্মফুল...হেঁট হয়ে সেই ফুল নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলো সে।তারপর তার দুচোখ খুঁজছিলো মিনীকেই।মিনী সেটা বুঝেই নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছিলো মা দুর্গার মূর্তির অন্তরালে...তারপর ছুটেছিলো ঠাকুমার কাছে....


(চলবে.....)


ছবি : সংগৃহীত


ধারাবাহিকটি ভালো লাগলে ব্লগ থেকে নির্দ্বিধায় শেয়ার করুন ও সবাইকে পড়ার সুযোগ করে দিন।😊😊

 

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট