অসমাপ্ত
অষ্টম পর্ব
সাথী দাস
-কেন আমার সঙ্গে নিজেকে জড়াচ্ছ সৌর?পারবে না।ভেসে যাবে তুমি...
সৌর মিছরিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের মধ্যে মিশিয়ে নিলো।মিছরি টেনে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো নিজেকে।কিন্তু সৌরর সঙ্গে গায়ের জোরে পারলো না।সৌর ওকে আবার কাছে টেনে ওর মুখের ওপর থেকে অবিন্যস্ত চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললো,
-হুম!ভাসতেই তো চাই...সাঁতার জানা সত্ত্বেও আমি ডুবতে চাই মিছরি।তোমার সঙ্গে...প্লিজ আমাকে তুমি ফিরিয়ে দিও না...
তিলোত্তমার দুটো পেলব গাল-কপাল-ঠোঁট-গলা সৌর নিজের ঠোঁটের স্পর্শে ভরিয়ে দিলো।নিজের ঠোঁট দিয়ে মুছিয়ে দিলো ওর চোখের জল।সৌরকে আর বাধা দিলো না তিলোত্তমা।জড়িয়ে ধরলো সৌরকে।উন্মত্ত সৌর সামান্যতম প্রশ্রয়ে আরও পাগল হয়ে উঠলো....হাঁপাতে-হাঁপাতে বললো,
-বলো মিছরি...
-কি শুনতে চাও বলো?
-আমায় ভালোবাসো তো?
-আমি তোমাকে ভালোবাসি সৌর!!
-তাহলে দূরে ঠেলে দিচ্ছ কেন?
-আমার কতগুলো স্বপ্ন আছে সৌর,আমার কিছু এমবিশন আছে।আর সেখানে ভালোবাসার কোনো জায়গা নেই!
-মানে?আমি তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করবো মিছরি।তোমার অধরা-অপূর্ণ স্বপ্নরা আজ থেকে আমারও লক্ষ্য।আমাকে শুধু নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে একটু সময় দাও,আমিই দাঁড়াবো তোমার পাশে।আর তুমি জানো মিছরি,আই এম লিমিটেড এডিশন,আমি যা বলি,ঠিক সেটাই করি!আজ আমি,সৌরদীপ সাহা,তোমাকে কথা দিচ্ছে,সে কোনোদিনও তোমার আর তোমার স্বপ্নের মাঝে আসবে না।শুধু তুমি আমাকে তোমার জীবন থেকে সরিয়ে দিও না,মাঝে আসতে দিও না,ঠিক আছে।কিন্তু পাশে থাকতে দাও।নইলে মরে যাবো আমি!!প্লিজ....
-কিন্তু সৌর,তুমি তো জানোই না,আমি কি....
আর কথা বলতে পারলো না তিলোত্তমা।সৌর নিজের ঠোঁট দিয়ে ওর মুখ বন্ধ করে দিয়েছে।জমাট অন্ধকারে তিলোত্তমা নিজেকে এলিয়ে দিলো সৌরর বুকে....
-মিছরি?
-ভালোবাসি সৌর!এটাই জানতে চাও তো?হ্যাঁ,ভালোবাসি।আর ভালোবাসি বলেই দূরে সরে যাচ্ছিলাম....
-জানতাম আমি,তুমিও আমাকে ভালোবাসো।তাই তো এতটা সাহস পেয়েছি।কিন্তু এটা কেমন কথা মিছরি?ভালোবাসলে তো কাছে আসতে হয়।তুমি আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছ কেন?
ঘ্যাক করে উঠলো টাইগার।অনেকক্ষণ ধরে মশার কামড় খেয়েও,লক্ষী হয়ে চুপটি করেই ছিলো ও।সৌর আর তিলোত্তমাকে একটুও বিরক্ত করেনি।কিন্তু আর সহ্য করতে না পেরে,বেজায় বিরক্ত হয়ে ঘেউ-ঘেউ করে ডেকে উঠে,লেজ ধরার জন্য বোঁ-বোঁ করে ঘুরতে শুরু করলো।ওকে দেখে সৌর আর মিছরি দুজনেই হেসে ওঠে সশব্দে....সৌরর বুকে মাথা রেখেই তিলোত্তমা বলে,
-আমি যাই সৌর।টাইগার মশার কামড় একদম সহ্য করতে পারে না।
-আর একটু থাকো প্লিজ!কাল থেকে আর তো দেখাই হবে না!প্লিজ-প্লিজ,আর একটুখানি....
-না!এবার আমি আসি!অনেকক্ষণ বেরিয়েছি।বাবাই চিন্তা করবে।অফিস থেকে ফিরে আমাকে না জড়িয়ে ধরলে,বাবাই থাকতেই পারে না।বলে,বাড়িতে ঢুকেই আগে সোনামাকে দেখতেই হবে....
সৌর দেখলো,তিলোত্তমা চলে যাবেই।কিছুতেই ওকে আর আটকানো যাবে না দেখে,ওকে আরও একবার জড়িয়ে ধরলো সৌর।আগামী কয়েকদিনের জন্য নিজের সবটুকু আদর,তিলোত্তমার ঠোঁটে উজাড় করে দিলো।সৌর ছাড়লে পাগলিনীর মতো এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলো ঠিক করে নিয়ে,তিলোত্তমা মৃদুস্বরে ডাক দিলো,
-টাইগার?আয়...
সৌর দেখলো তিলোত্তমা আর ঘুরলো না একবারও।ও নিজেই দৌড়ে গিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো তিলোত্তমার কোমর।ওর চুলের সৌরভে মুখ ডুবিয়ে বললো,
-তোমাকে মিস করবো মিছরি।পাগল হয়ে থাকবো!
-কেন পাগল হবে?!আজ তো সবটুকু আদর করেই নিলে!
-তাও পাগল হয়ে যাবো!আমি রোজ ফোন করবো,প্রতিদিন রাতে,দিনের বেলাও।তুমিও করবে,যখন তোমার মন চাইবে।আমি ফোন করলে ধরবে কিন্তু....
-আচ্ছা!আসি....
টাইগার একবার এগিয়ে এসে সৌরর পায়ের কাছে মাথা রেখে ওর গা শুঁকলো।দুহাতে জড়িয়ে ধরে টাইগারকে আদর করলো সৌর....তারপর টাইগার গুটিগুটি পায়ে চলে গেলো তিলোত্তমার সঙ্গে....কয়েক পা এগিয়েই সৌরর ডাকে ঘুরে দাঁড়ালো তিলোত্তমা...
-মিছরি?
-বলো?
জিন্সের প্যান্টের পকেটে দুটো হাত ঢুকিয়ে দিয়ে সৌর ফুরফুরে-খুশি মেজাজে জিজ্ঞেস করলো,
-প্রাণভরে আদর তো হলো,কিন্তু তোমার স্বপ্নটা কি,সেটাই তো জানা হলো না!
-পরীক্ষাটা আগে ভালো করে দাও সৌর।তারপর আমরা এই বিষয়ে কথা বলবো।হ্যাঁ এটা ঠিক,যে আমরা ভালোবাসি একে-অপরকে।আমিও তোমাকে ভীষণই ভালোবাসি।কিন্তু আমার অপূরণীয় স্বপ্নটা জানার পর,তুমি সিদ্ধান্ত নেবে,আমার একসঙ্গে থাকবে কিনা!!কারণ,"ভালোবাসি",এই চারটে অক্ষর বলাটা যতটা সহজ,ভালোবাসাটা কিন্তু ততটাও সহজ না!!
-মানে?
-তোমার পরীক্ষার পর আমরা কথা বলছি।এখন ওইটুকু মাথায় বেশি চাপ নিও না।পড়ায় মন দাও!জেনেই তো গেলে,যে আমিও তোমাকে ভালোবাসি।আর নিশ্চয়ই পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে কোনো অসুবিধে হবে না।আমি তো আছিই,এবার নিজের ভবিষ্যতের দিকে নজর দাও।তারপর আমার দিকটা শোনার পরও যদি তোমার মনে হয়,তুমি আমার সঙ্গেই থাকতে চাও,বা থাকতে পারবে,আমার ইচ্ছেগুলোকে মানতে পারবে,সম্মান দিতে পারবে,তারপর আমরা দুজনে ভেবে দেখবো।
চমকে উঠে সৌর দৌড়ে এলো মিছরির দিকে...ওর সামনে এসে ওর দুটো হাত ধরে বললো,
-এই এক মিনিট!ভেবে দেখবো মানে?আমরা দুজনেই দুজনকে ভালোবাসি।তাই আমরা একসঙ্গেই থাকবো।এখন যার-যার মতো সে-সে নিজের ভবিষ্যৎ তৈরি করবো,তারপর বিয়ে করবো আমরা....এর মধ্যে আবার ভাবাভাবির কথা আসছে কেন মিছরি?আমরা ভালোবাসি,আমরা কমিটেড,আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ,তাই তো?!
সৌরর হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে ওর কাছে এগিয়ে এলো তিলোত্তমা।সৌরর গালে হাত রাখলো,ভয়ে কেঁপে উঠলো সৌর,
-প্লিজ মিছরি,এমন কিছু বোলো না,যাতে আমি শেষ হয়ে যাই!মুখ খোলার আগে,কথা বলার আগে ভেবে বলবে... প্লিজ...
সৌর দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো তিলোত্তমার কোমর...তিলোত্তমা বলতে শুরু করলো,
-তুমি প্রথম নও সৌর,যে আমাকে নিজের করে পেতে চেয়েছো।আমাকে পাওয়ার জন্য,তোমার চেয়েও বেশি পাগলামি করেছে একাধিকজন।কখনও টিউশন টিচার,কখনও স্কুলের বন্ধুরা,কখনও আবার ফ্যামিলি ফ্রেন্ড তার বা তাদের ছেলেদের জন্য আমাকে এডভান্স বুকিং করে রাখতে চেয়েছে।কিন্তু সেই সমস্ত প্রস্তাব আমি হেলায় সরিয়ে দিয়েছি,বাবাইও আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনোদিনই আমায় জোর করবে না।সবাইকে না বলতে-বলতে,না বলাটাই আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে সৌর।তোমাকেও ভেবেছিলাম সরিয়ে রাখবো।কিন্তু বিশ্বাস করো,কিছুতেই পারলাম না।তোমাকে আর সরাতে পারলাম না কিছুতেই।কেন তুমি এত ভালোবাসলে আমায়?কেন আমিও তোমাকে ভালোবেসে ফেললাম?!
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সৌর...তিলোত্তমার গালে গাল রাখলো ও....ভাবলো এটুকুই হয়তো ওর বক্তব্য,যে সৌর ওর কাছে কতখানি বিশেষ!!কিন্তু সৌরর তখনও আরও অনেক কিছু জানতে বাকি ছিলো.... তিলোত্তমা বলছে,
-ভালোবাসা মানেই কিন্তু প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া নয় সৌর,ভালোবাসা মানেই একে-অপরের সঙ্গে থাকতেই হবে,এমনটাও নয়।একসঙ্গে থাকার জন্য হয়তো,আমাদের দুজনকেই অনেক বড় মূল্য দিতে হতে পারে।আর আজ আমি তোমাকে একটা কথা একদম পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছি সৌর,আমি জীবনেও কোনোদিন আমার কমফোর্ট-জোনের বাইরে বেরোইনি,ভবিষ্যতেও বেরোবো না।স্যাক্রিফাইজ,স্বার্থত্যাগ,এইসব ভারী-ভারী শব্দগুলোকে,আমি কিন্তু আমার ডিকশনারিতে কোনোদিনই জায়গা দিইনি,আগামী দিনেও দেবও না।আমার যেটা চাই,সেটা যেকোনো মূল্যে চাই-ই চাই।আমি না বলতে অভ্যস্ত,কিন্তু না শুনতে অভ্যস্ত নই।তাই সবার আগে প্রয়োজন আমাদের দুজনের মানসিকতা ম্যাচ করা।ভালোবাসা দিয়ে শুধু ভালোই বাসা যায় সৌর,কিন্তু জীবন চলে না।সবসময় কিন্তু শুধুমাত্র ভালোবাসার ওপর ভিত্তি করে,একসঙ্গে থাকা যায় না!আর আমি নিজেকে খুব ভালোভাবে চিনি।তুমিও আমাকে ভালোভাবে চিনে নাও।আমি কিন্তু আমার ইচ্ছে,আমার স্বপ্নপূরণের জন্য যে কোনো মূল্য দিতে পারি।জীবনের সমস্ত প্রতিবন্ধকতা,এমনকি সমস্ত সীমারেখাও উল্লঙ্ঘন করতে পারি....
-আমি বুঝলাম না মিছরি!!তোমার কি এমন ইচ্ছে,যার জন্য এতগুলো কথা আসছে?!
কোনো উত্তর দিলো না তিলোত্তমা।শুধু দুহাতে সৌরর গলাটা জড়িয়ে ধরলো।তারপর আলতো করে ঠোঁট রাখলো ওর ঠোঁটে...কথার খেই হারিয়ে ফেললো সৌর।ও মিছরির ঠোঁটটাকে নিয়ে আরও একটু খেলা শুরু করলো....কয়েক মুহূর্ত পর তিলোত্তমা নিজের ওষ্ঠ ও অধর মুক্ত করে বললো,
-আজ আসি!বললাম তো সৌর,পরীক্ষার পর প্রথম যেদিন দেখা করবে,সেদিনই সব বলবো তোমায়।আজ আর নষ্ট করার মতো সময়,আমার কাছে একদম নেই।বাই....
-বেশ,তাই হবে।আমি কোনদিন কোনো ব্যাপারেই তোমায় জোর করবো না।মিছরি শোনো,কটাদিন আমি জলে থাকবো না,তুমি কিন্তু সাঁতারটা ভালোভাবে প্র্যাকটিস করবে।আমি চাই ইন্টার-পুল কম্পিটিশনের দিন,তুমি জলে জাস্ট আগুন লাগিয়ে দাও,ঠিক যেমনভাবে আমার মনে আগুন লাগিয়েছো!!
সৌর আর তিলোত্তমা দুজনেই মৃদু স্বরে চাপা হাসি হেসে উঠলো....
-তুমি আমার নিজের হাতে তৈরি মিছরি।স্যারের সামনে অনেক বড় মুখ করে,আমি তোমার নামটা বলেছি।আমার সম্মান কিন্তু রাখতেই হবে।কি?বুঝলে তো?
-বুঝেছি!আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো।আমার দিক থেকে চেষ্টার কোনো খামতি থাকবে না সৌর,প্রমিস!
-হুম!!
একেবারে চলে যাওয়ার আগে পর্যন্তও সৌরর হাতে মিছরির হাতটা রাখা ছিলো।মিছরির হাতেও আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়েছে সৌর।
-তোমাকে ছাড়তেই তো ইচ্ছে করছে না মিছরি!
-তবু ছাড়তে তো হবেই।
-এভাবে বোলো না প্লিজ!ছাড়তে হবে আবার কি কথা!!বলো,যেতে দিতে হবে....
-যাইহোক,একই তো ব্যাপার!বাই সৌর!
-বাই.....
যতক্ষণ পর্যন্ত মিছরি আর টাইগার গলির বাঁকের অন্ধকার রাস্তায় ধীরে-ধীরে মিলিয়ে না গেলো,ততক্ষণ পর্যন্ত ওদের দিকেই চেয়ে রইলো সৌর।আজ ফিরে দেখেছে সে।একেবারে মিলিয়ে যাওয়ার আগে,ঘাড় ঘুরিয়ে একবার হাত নাড়লো তিলোত্তমা....ওর দিকে চেয়ে হাতটা নেড়ে বাই করলো সৌরও।মনটা অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে গেলো।আজ নিজেকে পূর্ণ মনে হলো সৌরর।ঋষি আর সমুর মতো,ওর জীবনে আর কোনো অধ্যায় অসমাপ্ত রইলো না,এটা ভেবেই ভালো লাগছে ভীষণ...সেই মুহূর্তেই ওর পকেটের ফোনটা সশব্দে বেজে উঠলো।নিজের কাজের ব্যাপারে বরাবরই যত্নবান সৌর।তাই আজ পর্যন্ত ওর ব্যক্তিগত পরিসরে বাবা-মা প্রবেশ করেনি,কারণ প্রয়োজনই পড়েনি।যখন যে জায়গায় সৌর পা রেখেছে,তা সে সাঁতার হোক,বা পড়াশোনা,শরীরচর্চা হোক বা খেলাধূলা,সাফল্যের সর্বোচ্চ শীর্ষে নিজেকে নিয়ে গিয়ে,তবেই থেমেছে।আজ পর্যন্ত কোনো ক্ষেত্র বা বিষয়ে ও হাত দিয়েছে,আর সেটা অসমাপ্ত রয়েছে,এমনটা কোনোদিন হয়নি।তিলোত্তমাও তার ব্যতিক্রম নয়!!বছর শেষে ওর দুর্ধর্ষ রেজাল্ট দেখে,বাবা-মায়ের আর কোনো কথা বলার জায়গাই থাকতো না।ও বাড়িতে কখন ফিরলো,কেমন বন্ধুদের সঙ্গে মিশলো,কোথায় গেলো,সেই নিয়ে তাদের বড় বিশেষ মাথাব্যথা নেই।কারণ,দিনের শেষে তাদের সন্তানের দিকে আঙুল তোলার ক্ষমতা কারোর নেই।তাই তারা একপ্রকার নিশ্চিন্তই থাকে।সেই কারণে বাড়ির বাইরে বেরোলে,বাবা-মায়ের ফোন একেবারেই আশা করে না সৌর।বন্ধুরাও সবাই ঠিকই আছে।আর মিছরি তো সবেই গেলো।তবে কার ফোন?তাড়াতাড়ি করে পকেট থেকে ফোনটা বের করলো সৌর.....অসময়ে অপ্রত্যাশিত এই নম্বরটা দেখে,বেশ অবাকই হলো ও...
-হ্যাঁ স্যার বলুন!
-সৌর?ফ্রি আছো?কথা বলা যাবে একটু?!
হেসেই ফেললো সৌর...
-কি যে বলেন স্যার?!নিজের ছেলের সঙ্গে কথা বলার জন্য আবার সময়-অসময়?!প্লিজ বলুন!
-না মানে,সেদিন আমার কথার মাঝেই তুমি যেভাবে ছুটলে,এখন আর কি করে বলি বলো,ইউ আর মাই বয়!!এখন তুমি ভাগ হয়ে গেছো....
স্যারের কথা শুনে লজ্জায় সৌরর কান পর্যন্ত অনুরাগের লালে রক্তিম হয়ে উঠলো।সত্যিই তো,স্যারের অনুমতি ছাড়া ওনার সামনে থেকে,সৌর এক-পা নড়তো না পর্যন্ত!!আর সেদিন বিচ্ছিরিভাবে মিছরির পিছনে ও এক অমোঘ টানে ছুটে গিয়েছিলো।বাঁধতেই পারেনি নিজেকে।ফোনে কথা বললেও,ঘন অন্ধকারের মধ্যেই লজ্জায় অবনত হলো সৌরর মাথা....নিজের ডান হাতের তর্জনীটা নাকে ঘষে নিয়ে লজ্জায় মরে গিয়ে কোনোরকমে বললো,
-এক্সট্রিমলি সরি স্যার!!আসলে সেদিন....
-আরে দূর!আমি কোনো এক্সপ্লেনেশন চেয়েছি নাকি তোমার কাছে?!আমি তো একটু মজাই করছিলাম!ছেলে আমার বড় হয়ে গেছে....
আর কথা বলতে পারলো না সৌর।ধীরে-ধীরে সাইকেলের সামনে এসে দাঁড়ালো।স্যার তখনও বলে চলেছেন,
-শোনো,কাজের কথায় আসি এবার!
-ইয়েস স্যার,বলুন!
-পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন?
-আমার দিক থেকে এক্সিলেন্ট স্যার!একটা ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট এক্সপেক্ট করছি...
-ভেরি গুড!
-থ্যাঙ্কু স্যার!!
-একটু আগেই আমি তোমার বাবাকে ফোন করেছিলাম।
এবার বেজায় ঘাবড়ে গেলো সৌর...
-বাবাকে?কেন....বাবাকে কেন স্যার?
-একটা দারুণ সুখবর দেওয়ার জন্য!চেয়েছিলাম,উনিই তোমায় বলুক।কিন্তু উনি বললেন,যেহেতু তোমাকে এই জায়গায় এনে পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্ব সম্পূর্ণ আমার,তাই আমি যেন নিজের মুখে তোমায় এই খবরটা দিই....কিন্তু উনি ভুল বলেছেন।আমি তোমার ট্রেইনার ঠিকই,পথপ্রদর্শক ঠিকই,কিন্তু তোমার জেদ আর কঠিন অধ্যবসায়ই তোমাকে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে।সেই কৃতিত্ব সম্পূর্ণই তোমার...
-স্যার,আমি না কিচ্ছু বুঝতে পারছি না,কি বিষয়ে কথা হচ্ছে?
-স্পোর্টস কোটা থেকে তোমার একটা চাকরির কথা চলছে সৌর।তোমার নাম এনলিস্টেড!জান লড়িয়ে দিতে হবে কিন্তু।প্রত্যেকটা মাইক্রো-সেকেন্ডের মূল্য তুমি তো বোঝোই।পরীক্ষাটা আগে ভালো করে দাও,তারপর জল-তুমি-আমি-আমার হাতের স্টপওয়াচ আর ফিনিসিং লাইন,এগুলো ছাড়া পৃথিবীর সব ভুলে যাবে তুমি...সুযোগটাকে যেন হাতছাড়া না হয়....
-অপারচুনিটি একবার সৌরদীপ সাহার কাছে আসুক স্যার,জাস্ট একবারের জন্যই আসুক।বাকিটা সৌরদীপ সাহা বুঝে নেবে!তাকে কিভাবে কাজে লাগাতে হয়,সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না....
-দ্যাটস মাই বয়!
-থ্যাঙ্কু স্যার!
-পরীক্ষা না থাকলে কাল থেকেই জোরকদমে প্র্যাকটিস শুরু করতে বলতাম।কিন্তু পরীক্ষার জন্য আটকে গেলাম।তোমার পরীক্ষার পর,সময়টা কিন্তু আরও কমে যাবে।হাতে আর মাত্র কয়েকটা মাস পাবে তুমি....
-আপনি কিচ্ছু ভাববেন না স্যার,আমি ম্যানেজ করে নেবো!
-টাফ কম্পিটিটর আছে সৌর!!
-ডোন্ট ওয়ারি স্যার!ইফ দে আর পজিটিভ,আই এম সুপারলেটিভ!দা টাফেস্ট ওয়ান!আমার তাদের খবরে কোনো প্রয়োজন নেই স্যার!কারণ,স্থলে তারা কোথায় থাকলো,আমার জানার দরকার নেই।কিন্তু জলে তারা আমার পিছনেই থাকবে।আর আমার কম্পেটিশন আমি নিজেই।আমি নিজে নিজের সময়কে বিট করি।তার জন্য পিছনে কে আসছে,বা পাশে কে আছে,দেখার কোনো প্রয়োজনই মনে করি না।কারণ,পিছনে বা আশেপাশে দেখতে গেলে,ফিনিসিং লাইন মিস হয়ে যাবে স্যার,সামনে এগোতে পারবো না যে....
-ব্রিলিয়ান্ট!এজ এক্সপেক্টেড!!বাড়িতে ফিজিক্যাল এক্সারসাইজটুকু কোরো।বডি যেন বসে না যায়!বাকিটা জলে তো আমি সঙ্গে আছিই....
-ডেফিনিটলি স্যার!!আমার মনে থাকবে,জল-আমি-আপনি-আপনার স্টপওয়াচ,আর ফিনিসিং লাইন...ব্যাস!!আর কিচ্ছু না!
-তাই?ব্যাস!!ঠিক তো?আর কিছু নাতো?!
স্যারের কথা বলার ধরনে হেসে ফেললো সৌর...সঙ্গে স্যারও...
-ওকে চলো!পরীক্ষার জন্য অল দা বেস্ট সৌর!!
-থ্যাঙ্কু স্যার!!
ফোনটা রেখে দিয়ে সাইকেলে উঠে বসলো সৌর...তারপর মনে-মনে বললো,
"আর কিছু?আর সে!!শুধুই সে....শুধু জলে নয়,মনেও আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে যাওয়া,সে....আর কিছুক্ষণ আগে ফোনটা এলে,সেও সামনাসামনি জেনে যেতে পারতো।সে জেনে যেতে পারতো,যে পড়াশোনা শেষ করে সৌরদীপ সাহাকে আর হন্যে হয়ে চাকরীর জন্য বসে থাকতে হবে না।যেভাবেই হোক,এটা তো আমায় জিততেই হবে।তাকে একেবারে নিজের করে পাওয়ার প্রথম সিঁড়ি এটা....সুযোগ যখন নিজে থেকেই যেচে এসেছে,একে কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না....জীবন দিয়ে দিতে হবে..."
সাইকেলটা চালিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো সৌর....
-মায়ের হাতটা অকেজো হয়ে যাওয়ার জন্য ঘরের কাজকর্মও এখন করতে হচ্ছে।নইলে আরও একটু পড়ায় সময় দিতে পারতাম রে....
টিউশন শেষে সমুদ্র আর ঋষি বাড়ি চলে গেছে অনেক আগেই।কিন্তু রূপ দেখা করতে এসেছিলো নিশার সঙ্গে।সাইকেল দুটো রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে,একটু এদিকটায় এসে বসেছিলো রূপ আর নিশা...
-ঠিক হয়ে যাবে মা!চিন্তা করছিস কেন?
অন্ধকার বৃত্তের মাঝে নিশার কাঁধে হাত রেখে,ওকে নিজের বুকের কাছে টেনে রূপ বললো...
-হুম!জানি...
-তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি নিশা?
রূপের পেটে আর কোমর দুহাতে জড়িয়ে ধরে,ওর গালের ওপর গাল ছুঁইয়ে দিয়ে নিশা বললো,
-বল না!
-এতদিন ধরে তোকে কাছ থেকে দেখছি।তুই আর মা!মামা আসেন মাঝে-মধ্যে।কিন্তু তোর বোন একদম আসে না,নারে?গত দু-বছরে শুধু শুনেই গেলাম,তোরা দুই বোন।রঞ্জার মুখে,তোর মুখে।কিন্তু তাকে তো দেখলামই না।মানে স্কুলের ছুটিতেও তো বাড়িতে আসা উচিত!
রূপের বুকে মুখ লুকোলো নিশা....
-টিউশনের আজই শেষ দিন।আবার কবে দেখা হবে ঠিক নেই।আজ এই প্রসঙ্গটা না তুললেই হতো না রূপ?!
-কেন?আমি কি তোকে কোনোভাবে কষ্ট দিয়ে ফেললাম?সরি....
-না!তা নয়!রূপ?
-বল!
-আমি তোকে বিয়ে করতে চাই!
-এটা হঠাৎ কোথা থেকে এলো?!মানে কোন কথার পিঠে কোন কথা?!
-না,আমার কাছে এইসব প্রেমের জন্য সত্যি সময় ছিলো না রে।তার এটা কারণ নয়,যে আমি ভালোবাসতে পারি না।তার কারণ এটাই,যে প্রেম-ভালোবাসা আমার কাছে বিলাসিতা!আমার খুব ভয় করে রে....যদি আমাকে ছেড়ে সে চলে যায়?!আমার বদনাম,আমার মায়ের অসহায়তা...
-ওই পাগলী?এসব কি বলছিস তুই?
-না,সত্যিই আমি ভয় পেতাম।প্রতি মুহূর্তে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই তো!নতুন করে আর কোনো লড়াইতে নামতে ভয় লাগে রে....সাহসে কুলোয় না!
-আমি সবসময় তোর পাশে আছি নিশা।শক্ত করে তোর হাত ধরে...
-হুম!তুই বলেই এগোতে সাহস পেয়েছি আমি।জানি তুই কোনোদিন আমাকে ছাড়বি না।আমিও তোকে ছাড়বো না....আর সেই কারণেই সবটা তোকে বলবো....
-সবটা মানে?
-আমার পরিবারের কথা!
-আচ্ছা!বল....
-বাজারে আমার বাবার পাইকারি সবজির দোকান ছিলো।মায়ের মুখে শুনেছি,একসময় নাকি খুব রমরমা ছিলো আমাদের,টাকাও ছিলো।যখন জ্যেঠুর কারখানা বন্ধ হয়ে যায়,তখনও ঠাকুমা বেঁচে ছিলো।আমার বাবা-ই নাকি সেই সময় পুরো পরিবারটাকে টানতো।জ্যেঠু-জেম্মা-বড়দা-ঠাম্মি-আর আমার মা।আমরা তখনও হইনি।অমানুষিক পরিশ্রম করতো বাবা।কিন্তু মুখে নাকি সবসময় একটা সুন্দর হাসি লেগেই থাকতো।ধীরে-ধীরে আমরা দুই বোন হলাম,সংসার বড় হলো।তাও বাবা একাই সবাইকে টানছিলো।দাদার পড়াশোনা,সংসার খরচ সবটাই বাবার ওপর।চিন্তা-ভাবনায় ডুবতে শুরু করেছিলো বাবা।ঠিক সেই সময়ই জ্যেঠুর কারখানা খুললো,আর ঠাকুমাও মারা গেলো।কিন্তু ঠাকুমার মৃত্যুর পরই জ্যেঠু সংসার ভাগ করতে বললো।এমনকি জমি-জায়গা,ঠাকুমার হাঁড়ি-বাসন,সবকিছু ভাগ করার জন্য উঠে-পড়ে লাগলো....মা বলে,এটাই না বাবা আর সহ্যই করতে পারেনি।একেবারে ভিতর থেকে ভেঙে পড়েছিলো।কথাবার্তা আর কারোর সঙ্গে বলতো না বিশেষ।সংসারে অশান্তি,জেম্মার সঙ্গে কারণে-অকারণে মায়ের নিত্যদিন ঝামেলা,এইসব কারণে ভাঙলো সংসার।এক বাড়ির মধ্যেই আলাদা হলো হাঁড়ি।বাবা ছোট হয়েও জ্যেঠুর জন্য অনেক করেছিলো তো,আর বড়দাকেও বড্ড ভালোবাসতো,একেবারে কাকাইয়ের হাতের ওপর ছোটবেলা থেকেই দাদা মানুষ হয়েছে....সেই দাদাকেও আর খেলতে আসতে দিতো না আমাদের ঘরে।বাবা ভিতর-ভিতর ভাঙতে-ভাঙতে একদিন ভোরবেলা পাইকারী বাজার থেকে ভ্যানে করে সবজি আনার সময়,করে বসলো এক্সিডেন্ট।দুটো পা অকেজো হলো,কিন্তু তাও মানুষটা ছিলো।টাকার অভাবে প্লেট বসাতে পারেনি মা।মামারবাড়ি থেকেই বাবার সমস্ত চিকিৎসা করেছে,মানে তাদের পক্ষে যতটা করা সম্ভব হয়েছে আর কি!!তারপর একদিন ধুঁকতে-ধুঁকতে বিছানায় শয্যাশায়ী মানুষটা কাউকে জানতে না দিয়ে,ঘুমের মধ্যেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলো।শেষদিকে নাকি বেডসোর হয়ে গিয়েছিলো শরীরের নিম্নাঙ্গে।আরও নানারকম কঠিন রোগ।জ্যেঠু আসেনি দেখতে।কাল-অশৌচও মানেনি।ওদের তখন অনেক পয়সা।ছেলে বড় হচ্ছে,আলাদা ঘরের প্রয়োজন।আমাদের আর বাড়িতে রাখা যাবে না।বাবাও মারা গেলো,আমাদেরও বাড়ি ছাড়তে বললো।বেশিরভাগ জমির ওপরে ঠাকুরদাদার তৈরি ওই সম্পূর্ণ বাড়িটা জ্যেঠু নিয়ে নিলো।পাশে যেখানে আমরা এখন থাকি,ওখানে ওই একটা ঘর করে দিলো মাকে,দুই বাড়ির মাঝে উঁচু করে পাঁচিল দিয়ে দিলো।মামা মাকে বলেছিলো,চল!এখানে থাকতে পারবি না,বাড়ি চল।কিন্তু মা ওই ভিটে ছাড়েনি।আগলে আজও বসে আছে।মামা তখন বললো,তুই যখন যাবিই না,এভাবে একা দুটো মেয়েকে মানুষ করবি কি করে?!ছোটটাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি!ব্যাস!!সেদিন থেকেই আলাদা হয়ে গেলাম আমরা দুই বোন!আমি মায়ের কাছে,বোন মামার কাছে....মামারা আজও প্রতিমাসে টাকা পাঠায়।বোনকেও ভালো স্কুলে পড়াচ্ছে।আমার চেয়েও ভালো স্কুলে রূপ,অনেক বড় স্কুল।কিন্তু বোন আর এখানে আসে না।মায়ের সঙ্গেও সেভাবে কথা বলে না।আমি ফোন করলেও দায়সারা কথা বলে রেখে দেয়....আসতেই চায় না এখানে।আমার ছুটি থাকলে,মাকে নিয়ে আমি ওখানে যাই...ও এড়িয়ে চলে আমাদের....আমি জানিনা রূপ,ও কেন এমন করে?!
রূপের জামার মধ্যে মুখ গুঁজে নিজের চোখের জলটুকু মুছে নিলো নিশান্তিকা....রূপ ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো বুকে...ও রূপের বুকে মুখ লুকিয়েই বললো,
-জেম্মাদের এখন দোতলা বাড়ি!কিন্তু ওরা ভুলে গেছে,রোদে তেতে-পুড়ে,মাথায় গামছা বেঁধে,মিস্ত্রীদের সঙ্গে হাতে-হাত মিলিয়ে,ওই বাড়ির ভিত আমার বাবা তৈরি করে গেছে।ওরা ভুলে গেছে রে রূপ....
-চুপ কর!!ওসব বেইমানদের জন্য নিজের চোখের এক ফোঁটা জলও,তুই নষ্ট করবি না!
-হুম!আমি কাঁদি নারে একদম!মায়ের সামনে একটুও কাঁদি না!মা কষ্ট পাবে ভেবে!কিন্তু তুই,তুই তো আমার নিজের,আমার আপন,সবচেয়ে কাছের মানুষ।তোর কাছে তো প্রাণখুলে একটু কাঁদতে পারি বল!?
-হুম!!
নিশাকে নিজের বুকের মধ্যে মিশিয়ে নিলো রূপ....
-জেম্মাদের ব্যাপারটা আমাকে ততটাও কষ্ট দেয় না,যতটা ছুটকির আচরণ,ওর অবহেলা,আমার প্রতি-মায়ের প্রতি ওর উদাসীনতা,আমাকে কষ্ট দেয়...
-ছুটকি কে?
-আমার বোন!তমিস্রা!!ও তমিস্রা,আমি নিশান্তিকা....ও মিশকালো রাত,আর আমি সেই রাতের অসমাপ্ত অধ্যায়,অন্তিম লগ্ন....
-বাঃ!ভারী সুন্দর নাম তো,তমিস্রা!!
-হুম!!সে দেখতে আরও সুন্দরী!!আজ ওর কথা তোকে বিশেষ কিছু বলবো না,ওর রূপের বর্ণনা দিলে,তুই আমাকেই ভুলে যাবি!আমি মায়ের মতো হয়েছি,ছুটকি বাবার মতো।ব্যস!!আর কিছু বলবো না।এমনিতেই তো শালি,অর্ধেকটা তো তোরই...আর তাকে দেখলে আবার তুই হড়কে,পুরোটাই না তার হয়ে যাস!তোকে বাবা বলবোই না তার কথা!!
মৃদু হাসলো নিশা...
-ঠিক আছে।বলিস না!সে না হয় আমি নিজের চোখেই দেখে নেবোখন!একমাত্র জামাইবাবু বলে কথা,একটু তো শালিকে দেখেশুনে নিতেই হবে....
-একটা চড় মারবো!!
সপাটে রূপের গায়ে হাত চালিয়ে দেয় নিশা...রূপ ওর হাতটা চেপে ধরে ওকে জড়িয়ে ধরে সোহাগ-চিহ্ন এঁকে দেয় ওর গালে....
-এই আমাকে ছাড়,ওঠ!তুই আবার বাড়াবাড়ি শুরু করবি!!
-বাড়াবাড়ি করবো না নিশা!প্লিজ....একটু....
-না...চল ওঠ-ওঠ!বাড়ি যাবো!!রাত হয়ে যাচ্ছে...
-তুই চলে যা!আমি পরে আসছি!
অভিমান করে মুখ গোঁজ করে বসে রইলো রূপ...
-অমনি বাবুর রাগ হয়ে গেলো...
-তুই কিন্তু আমাকে এখনও বলিসনি নিশা!
-কি?
-ভালোবাসি....
মিথ্যে অভিমান দেখানো রূপকে নিজের দিকে ফিরিয়ে, দুহাতে ওর দুটো কান টেনে ধরলো নিশা.... তারপর বললো,
-আবার বল,কি বলিনি?
-ভালোবাসি!!
মৃদু হেসে দুটো কান ছেড়ে,একটা হাত দিয়ে রূপের দুটো চোখ চেপে ধরলো নিশা।চোখ বন্ধ অবস্থায় ওর ঠোঁটের ওপর নিজের ঠোঁট মৃদু স্পর্শ করে বললো,
-আমিও....
বলেই উঠে দৌড় দিলো সাইকেলের দিকে।রূপ ওকে ধরতে গিয়েও,একটুর জন্য বেরিয়ে গেলো হাত থেকে।খেপে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো রূপ,
-হবেনা!চিটিং!তোকে আমি ওটা বলতে বলিনি....
-একবারে বলে দিলে তুই পালাবি হতচ্ছাড়া!তাই ইন্সটলমেন্টে বলবো!!টাটা....মন দিয়ে পড়বি...ফেল করে বেকার থাকলে কিন্তু,তোকে বিয়েই করবো না...
হাসতে-হাসতে দৌড়ে এসে নিশার সাইকেলের হ্যান্ডেল চেপে ধরলো রূপ...
-তুই চাকরি করবি,আমি বসে খাবো!
-এখন থেকেই পিঠ বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা,তাই না?!যা,বাড়ি গিয়ে পড়তে বোস!আমিও যাই....
-মন দিয়ে পড়তে পারবো না নিশা!!
-কেন?মন কোন বনে বন্ধক দিয়েছিস তুই?
-তোর কাছে বন্ধক দিয়েছি!কিছু তো দিয়ে যা...এই কদিনের জন্য!!প্লিজ....
আবার সাইকেলের স্ট্যান্ড ফেললো নিশা।এগিয়ে এলো রূপের কাছে।রূপের ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো আলতো করে।তারপর জোরে কামড়ে দিলো...দিশেহারা হয়ে গেলো রূপ।প্রথমবার নিশাকে এতটা পায়নি ও,এভাবে পায়নি...ওর অবস্থা দেখে,নিশা হেসে ছেড়ে দিলো ওকে....
-বাচ্চা ছেলে!!
-ওই....
-কি?কি হয়েছে কি?গলাবাজি করছিস কেন?বাচ্চাকে বাচ্চা বলবো না তো কি বলবো?!গার্লফ্রেন্ড ঠোঁটে ঠোঁট রাখলে,কি করবি না করবি দিশা পাচ্ছিস না....দেখি....
রূপের হাত ধরলো নিশা।তারপর ওর হাতটা ওর গালেই ঠেকিয়ে দিলো।
-দেখ!কি এটা?তোর হাত ঠান্ডা হয়ে গেছে!!
মাথা নীচু করে নিলো রূপ....নিশা বললো,
-সামলাতে পারবি না যখন,চাস কেন?
-তাতে কি হয়েছে?তুই-ই তো!!তোর কাছে অক্ষমতায় লজ্জা কিসের?তুই নিজের মতো করে তৈরি করে নিবি আমায়!সেদিনও চেয়েছিলাম,তুই ঠোঁটে একটু ঠোঁট ঠেকিয়েই দৌড় দিলি!ভেবেছিলাম আজও তাই করবি!আজ মহারানী আজ যে এমন ঘ্যাক করে কামড়ে দেবে,বুঝবো কি করে?!
-কি-কি?কি করে কামড়ে দেবে?!
-কিছুনা!সরি!
-তুই আর একদম আমার চোখের সামনে আসবি না হতভাগা!!
-আচ্ছা,ঠোঁটের সামনে এলে চলবে?
-দূর হ!!
-তুই একটু দূরে যা,আমি দূর হয়ে ঘুরে তোর কাছেই আসছি!
-ইডিয়ট!!
সাইকেলে উঠে পড়লো নিশা.... ও চলে যাচ্ছে দেখে রূপ চেঁচালো,
-লাভ ইউ!!
দূরে মিলিয়ে যেতে-যেতে ভেসে এলো নিশার কণ্ঠস্বর,
-আমিও...
হেসে মাথা নামিয়ে নিলো রূপ,
"আবারও চিটিং!তুই কি কোনোদিনও নিজের মুখে বলবি না নিশা!!একবারও কি বলবি না?তোকে ভালোবাসি রূপ!"
সাইকেলে উঠে উল্টোদিকের রাস্তায় বেরিয়ে গেলো রূপায়ণ....
পরবর্তী সময়টুকু সরস্বতী দেবীর শ্রীচরণে নিজেদের সবটুকু উজাড় করে দিলো সকলেই,একমাত্র সমুদ্র ছাড়া....ওর তখন অর্ধন্মাদ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা!বাবা গিটারটা ফেরত দিলোই না আর।পড়াশোনায়ও সেভাবে মন বসে না।সৌর আসতে চায় সমুর কাছে,পড়াশোনায় সাহায্য করবে বলে,কিন্তু সমুই বারণ করে।এতরকম সাফল্যের চাদরে আবৃত সৌরকে দেখলে,ওর বাবা-মা আরও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।সমুদ্রর ওপরে মানসিক অত্যাচারের পরিমাণটা আরও একটু বেড়ে যায়।সারাদিন কানের সামনে ওই সৌররই গুণকীর্তন চলতে থাকে।তাই প্রয়োজনে সমু চলে যায় ওর কাছে,কিন্তু নিজের বাড়িতে ওকে ডাকে না খুব একটা....
রুটিনমাফিক সমস্ত পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেও,গন্ডগোলটা কিন্তু প্রথমেই বেঁধে গেছিলো।আর সেটা ইংরেজি পরীক্ষা নিয়ে।প্রশ্নপত্র বেশ কিছুদিন আগে ফাঁস হয়ে যাওয়ায়,সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পরবর্তীকালে সেই পরীক্ষা পুনরায় নেওয়ার।তাই অন্য সকল পরীক্ষা সুচারুভাবে হয়ে গেলেও,বাকি থেকে যায় রানী ম্যামের বিষয়টাই,ইংরেজি....
ইংরেজি পরীক্ষার দিন দুয়েক আগে একদিন রাত্রিবেলা মন দিয়েই পড়াশোনা করছিলো সমুদ্র।বেশ অনেকক্ষণ একভাবে পড়ার ফলে বিরক্ত লাগছিলো ওর।কানে হেডফোন গুঁজে দিয়ে গান চালিয়ে বালিশের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে থেকে তার কথাই ভাবছিলো ও।অনুপ্রেরণা....কি করছে এখন তার অনুপ্রেরণা?!ভীষণ ক্লান্ত কি?তার ভালোবাসার বুকের ওপর নিজের ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়েছে নিশ্চয়ই।কান থেকে একটানে ঢাউস হেডফোনটা খুলে ফেললো সমুদ্র।রানী ম্যামের কথা ভাবতে গেলেই,আগে তার সিঁথির ওই লালচে সিঁদুরের আভাটুকু মনে পড়ে।তারপরই এইসব উল্টোপাল্টা চিন্তা মাথায় এসে ভিড় করে,আর পাগল-পাগল লাগে।কান-মাথা একেবারে গরম হয়ে যায়!চোখ বন্ধ করে ওকে বলা ম্যামের কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করছিলো সমুদ্র....চোখের সামনে ভাসছিলো শুধুমাত্র তারই মুখ....
"কি ব্যাপার বলো তো সমুদ্র,তুমি কি আমার বাড়িতে সিসিটিভি লাগিয়ে রেখেছো নাকি!মানে বেশিরভাগ দিনই আমার শাড়ির সঙ্গে তোমার আনা ফুলের রঙ মিলে যায় কি করে?"
"একি?আজ খালি হাতে?"
"তুমি বলো সমুদ্র,পরীক্ষা তো প্রায় দরজায় কড়া নাড়ছে।প্রিপারেশন কেমন?প্রতিটা বিষয় তো বটেই,আমার সাবজেক্টে এ প্লাস আসবে তো?কিছু ডাউট থাকলে,এক্সট্রা ক্লাসে ক্লিয়ার করে নিতে পারো!"
ফোনের যান্ত্রিক শব্দে চোখ মেললো সমুদ্র....তখনও কাজে বাজছে তারই সুমধুর কণ্ঠস্বর।
"প্রতিটা বিষয় তো বটেই,আমার সাবজেক্টে এ প্লাস আসবে তো?"
ফোনে একটা ই-মেইল ঢুকেছে।তড়াক করে উঠে বসলো সমুদ্র।ওর সারাটা শরীর কাঁপছে....যা ভেবেছিলো,ঠিক তাই।গানের যে অনলাইন অডিশনটা দিয়েছিলো,তারই ডাক পাঠিয়েছে ওরা।সেই বহুকাঙ্খিত ই-মেইল!সম্পূর্ণ মেইলটা পড়তে-পড়তে উত্তেজনায় তিরতির করে কাঁপছিলো সমুদ্র।আনন্দে গান বাদ দিয়ে একটু নেচে নিতে ইচ্ছে করছিলো ওর....কিন্তু ওখানে পৌঁছনোর জন্য নির্ধারিত সময় এবং তারিখ দেখে,ওর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো।ওখানে পৌঁছনোর সময় এবং তারিখ,আর ইংরেজি পরীক্ষার সময় এবং তারিখের মধ্যে কোনো বৈসাদৃশ্য নেই,তারা হুবহু এক....অর্থাৎ জীবনের চরম সিদ্ধান্তের সময় উপস্থিত।হয় পরীক্ষা তথা পড়াশোনা,নয় গান....যেকোনো একটাকে বেছে নেওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণ আগত....দুটোর মধ্যে যেকোনো একটাকে বেছে নিলেই,চিরকালের মতো অসমাপ্ত রয়ে যাবে অন্যটা।এইখানে গান গেয়ে একবার উত্তীর্ণ হয়ে গেলে,আর দ্বিতীয় কোনো সুযোগের অপেক্ষা করতে হবে না সমুদ্রকে।আর পিছন ফিরে চাইতে হবে না।প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে একেবারে চুক্তিপত্রে সই করিয়েই নেবে ওরা।জীবন তৈরি হয়ে যাবে।এইরকম একটা সুযোগের জন্যই তো আজীবন নিজেকে তৈরি করেছে সমুদ্র....আর পরীক্ষা দিতে গেলে,হাতছাড়া হয়ে যাবে এই সুবর্ণ সুযোগ।আবার ওই পড়াশোনার যাঁতাকলে,বাবা-মা ওকে একেবারে পিষে মেরে ফেলবে!!কোনদিকে যাবে সমুদ্র।যদি জিততে পারে,তবেই পাবে সমস্ত সুযোগ!কিন্তু হেরে গেলে!?একদম মনের জোর পাচ্ছে না সমুদ্র।অনেক বড় একটা ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যাবে....হয়তো জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি....মাথায় এইসব চলছে বিন্দুমাত্র আভাস পেলেও,বাবা-মা খুন করে ফেলবে ওকে....আর ভাবতে পারে না সমুদ্র...কাকে বলবে ও?বন্ধুদের এসব কথা বললে,সৌর ওকে যতই ভালোবাসুক,কেটে ফেলে দেবে!ঠিক মাকে জানিয়ে দেবে...কাকে বলবে ও?কি বলবে?কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেই সুমধুর শব্দবন্ধ,
"প্রতিটা বিষয় তো বটেই,আমার সাবজেক্টে এ প্লাস আসবে তো?"
বিদ্যুৎচমকের মতো তারই বলা আরও একটা কথা মনে পড়ে গেলো সমুদ্রর,
"ভালো করে পরীক্ষাটা দিও সমুদ্র।কিন্তু গানটা ছেড়ো না।জীবনে যা চাও,তাই নিয়েই সুপ্রতিষ্ঠিত হও..."
আমূল কেঁপে উঠলো সমুদ্র....হেডফোনের পাশে রাখা ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে ই-মেইল,সামনে ইংরেজি বই খোলা....ফোন দিচ্ছে অপূরণীয় রঙিন স্বপ্নের হাতছানি,আর বই জানান দিচ্ছে কঠোর বাস্তব!!সমুদ্র ঠিক করে উঠতে পারলো না,কোনটা অসমাপ্ত রাখবে ও?বাস্তব না স্বপ্ন?!
চোখ দুটো প্রচন্ড জ্বালা করে উঠলো।বইয়ের কালো-কালো অক্ষরগুলো ধীরে-ধীরে ঝাপসা হয়ে গেলো....নিশ্চুপে চশমার কাঁচ ভিজিয়ে,সমুদ্রর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো লবণাক্ত জল....
(চলবে.....)
ছবি: সংগৃহীত
সৌর মিছরিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের মধ্যে মিশিয়ে নিলো।মিছরি টেনে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো নিজেকে।কিন্তু সৌরর সঙ্গে গায়ের জোরে পারলো না।সৌর ওকে আবার কাছে টেনে ওর মুখের ওপর থেকে অবিন্যস্ত চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললো,
-হুম!ভাসতেই তো চাই...সাঁতার জানা সত্ত্বেও আমি ডুবতে চাই মিছরি।তোমার সঙ্গে...প্লিজ আমাকে তুমি ফিরিয়ে দিও না...
তিলোত্তমার দুটো পেলব গাল-কপাল-ঠোঁট-গলা সৌর নিজের ঠোঁটের স্পর্শে ভরিয়ে দিলো।নিজের ঠোঁট দিয়ে মুছিয়ে দিলো ওর চোখের জল।সৌরকে আর বাধা দিলো না তিলোত্তমা।জড়িয়ে ধরলো সৌরকে।উন্মত্ত সৌর সামান্যতম প্রশ্রয়ে আরও পাগল হয়ে উঠলো....হাঁপাতে-হাঁপাতে বললো,
-বলো মিছরি...
-কি শুনতে চাও বলো?
-আমায় ভালোবাসো তো?
-আমি তোমাকে ভালোবাসি সৌর!!
-তাহলে দূরে ঠেলে দিচ্ছ কেন?
-আমার কতগুলো স্বপ্ন আছে সৌর,আমার কিছু এমবিশন আছে।আর সেখানে ভালোবাসার কোনো জায়গা নেই!
-মানে?আমি তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করবো মিছরি।তোমার অধরা-অপূর্ণ স্বপ্নরা আজ থেকে আমারও লক্ষ্য।আমাকে শুধু নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে একটু সময় দাও,আমিই দাঁড়াবো তোমার পাশে।আর তুমি জানো মিছরি,আই এম লিমিটেড এডিশন,আমি যা বলি,ঠিক সেটাই করি!আজ আমি,সৌরদীপ সাহা,তোমাকে কথা দিচ্ছে,সে কোনোদিনও তোমার আর তোমার স্বপ্নের মাঝে আসবে না।শুধু তুমি আমাকে তোমার জীবন থেকে সরিয়ে দিও না,মাঝে আসতে দিও না,ঠিক আছে।কিন্তু পাশে থাকতে দাও।নইলে মরে যাবো আমি!!প্লিজ....
-কিন্তু সৌর,তুমি তো জানোই না,আমি কি....
আর কথা বলতে পারলো না তিলোত্তমা।সৌর নিজের ঠোঁট দিয়ে ওর মুখ বন্ধ করে দিয়েছে।জমাট অন্ধকারে তিলোত্তমা নিজেকে এলিয়ে দিলো সৌরর বুকে....
-মিছরি?
-ভালোবাসি সৌর!এটাই জানতে চাও তো?হ্যাঁ,ভালোবাসি।আর ভালোবাসি বলেই দূরে সরে যাচ্ছিলাম....
-জানতাম আমি,তুমিও আমাকে ভালোবাসো।তাই তো এতটা সাহস পেয়েছি।কিন্তু এটা কেমন কথা মিছরি?ভালোবাসলে তো কাছে আসতে হয়।তুমি আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছ কেন?
ঘ্যাক করে উঠলো টাইগার।অনেকক্ষণ ধরে মশার কামড় খেয়েও,লক্ষী হয়ে চুপটি করেই ছিলো ও।সৌর আর তিলোত্তমাকে একটুও বিরক্ত করেনি।কিন্তু আর সহ্য করতে না পেরে,বেজায় বিরক্ত হয়ে ঘেউ-ঘেউ করে ডেকে উঠে,লেজ ধরার জন্য বোঁ-বোঁ করে ঘুরতে শুরু করলো।ওকে দেখে সৌর আর মিছরি দুজনেই হেসে ওঠে সশব্দে....সৌরর বুকে মাথা রেখেই তিলোত্তমা বলে,
-আমি যাই সৌর।টাইগার মশার কামড় একদম সহ্য করতে পারে না।
-আর একটু থাকো প্লিজ!কাল থেকে আর তো দেখাই হবে না!প্লিজ-প্লিজ,আর একটুখানি....
-না!এবার আমি আসি!অনেকক্ষণ বেরিয়েছি।বাবাই চিন্তা করবে।অফিস থেকে ফিরে আমাকে না জড়িয়ে ধরলে,বাবাই থাকতেই পারে না।বলে,বাড়িতে ঢুকেই আগে সোনামাকে দেখতেই হবে....
সৌর দেখলো,তিলোত্তমা চলে যাবেই।কিছুতেই ওকে আর আটকানো যাবে না দেখে,ওকে আরও একবার জড়িয়ে ধরলো সৌর।আগামী কয়েকদিনের জন্য নিজের সবটুকু আদর,তিলোত্তমার ঠোঁটে উজাড় করে দিলো।সৌর ছাড়লে পাগলিনীর মতো এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলো ঠিক করে নিয়ে,তিলোত্তমা মৃদুস্বরে ডাক দিলো,
-টাইগার?আয়...
সৌর দেখলো তিলোত্তমা আর ঘুরলো না একবারও।ও নিজেই দৌড়ে গিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো তিলোত্তমার কোমর।ওর চুলের সৌরভে মুখ ডুবিয়ে বললো,
-তোমাকে মিস করবো মিছরি।পাগল হয়ে থাকবো!
-কেন পাগল হবে?!আজ তো সবটুকু আদর করেই নিলে!
-তাও পাগল হয়ে যাবো!আমি রোজ ফোন করবো,প্রতিদিন রাতে,দিনের বেলাও।তুমিও করবে,যখন তোমার মন চাইবে।আমি ফোন করলে ধরবে কিন্তু....
-আচ্ছা!আসি....
টাইগার একবার এগিয়ে এসে সৌরর পায়ের কাছে মাথা রেখে ওর গা শুঁকলো।দুহাতে জড়িয়ে ধরে টাইগারকে আদর করলো সৌর....তারপর টাইগার গুটিগুটি পায়ে চলে গেলো তিলোত্তমার সঙ্গে....কয়েক পা এগিয়েই সৌরর ডাকে ঘুরে দাঁড়ালো তিলোত্তমা...
-মিছরি?
-বলো?
জিন্সের প্যান্টের পকেটে দুটো হাত ঢুকিয়ে দিয়ে সৌর ফুরফুরে-খুশি মেজাজে জিজ্ঞেস করলো,
-প্রাণভরে আদর তো হলো,কিন্তু তোমার স্বপ্নটা কি,সেটাই তো জানা হলো না!
-পরীক্ষাটা আগে ভালো করে দাও সৌর।তারপর আমরা এই বিষয়ে কথা বলবো।হ্যাঁ এটা ঠিক,যে আমরা ভালোবাসি একে-অপরকে।আমিও তোমাকে ভীষণই ভালোবাসি।কিন্তু আমার অপূরণীয় স্বপ্নটা জানার পর,তুমি সিদ্ধান্ত নেবে,আমার একসঙ্গে থাকবে কিনা!!কারণ,"ভালোবাসি",এই চারটে অক্ষর বলাটা যতটা সহজ,ভালোবাসাটা কিন্তু ততটাও সহজ না!!
-মানে?
-তোমার পরীক্ষার পর আমরা কথা বলছি।এখন ওইটুকু মাথায় বেশি চাপ নিও না।পড়ায় মন দাও!জেনেই তো গেলে,যে আমিও তোমাকে ভালোবাসি।আর নিশ্চয়ই পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে কোনো অসুবিধে হবে না।আমি তো আছিই,এবার নিজের ভবিষ্যতের দিকে নজর দাও।তারপর আমার দিকটা শোনার পরও যদি তোমার মনে হয়,তুমি আমার সঙ্গেই থাকতে চাও,বা থাকতে পারবে,আমার ইচ্ছেগুলোকে মানতে পারবে,সম্মান দিতে পারবে,তারপর আমরা দুজনে ভেবে দেখবো।
চমকে উঠে সৌর দৌড়ে এলো মিছরির দিকে...ওর সামনে এসে ওর দুটো হাত ধরে বললো,
-এই এক মিনিট!ভেবে দেখবো মানে?আমরা দুজনেই দুজনকে ভালোবাসি।তাই আমরা একসঙ্গেই থাকবো।এখন যার-যার মতো সে-সে নিজের ভবিষ্যৎ তৈরি করবো,তারপর বিয়ে করবো আমরা....এর মধ্যে আবার ভাবাভাবির কথা আসছে কেন মিছরি?আমরা ভালোবাসি,আমরা কমিটেড,আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ,তাই তো?!
সৌরর হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে ওর কাছে এগিয়ে এলো তিলোত্তমা।সৌরর গালে হাত রাখলো,ভয়ে কেঁপে উঠলো সৌর,
-প্লিজ মিছরি,এমন কিছু বোলো না,যাতে আমি শেষ হয়ে যাই!মুখ খোলার আগে,কথা বলার আগে ভেবে বলবে... প্লিজ...
সৌর দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো তিলোত্তমার কোমর...তিলোত্তমা বলতে শুরু করলো,
-তুমি প্রথম নও সৌর,যে আমাকে নিজের করে পেতে চেয়েছো।আমাকে পাওয়ার জন্য,তোমার চেয়েও বেশি পাগলামি করেছে একাধিকজন।কখনও টিউশন টিচার,কখনও স্কুলের বন্ধুরা,কখনও আবার ফ্যামিলি ফ্রেন্ড তার বা তাদের ছেলেদের জন্য আমাকে এডভান্স বুকিং করে রাখতে চেয়েছে।কিন্তু সেই সমস্ত প্রস্তাব আমি হেলায় সরিয়ে দিয়েছি,বাবাইও আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনোদিনই আমায় জোর করবে না।সবাইকে না বলতে-বলতে,না বলাটাই আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে সৌর।তোমাকেও ভেবেছিলাম সরিয়ে রাখবো।কিন্তু বিশ্বাস করো,কিছুতেই পারলাম না।তোমাকে আর সরাতে পারলাম না কিছুতেই।কেন তুমি এত ভালোবাসলে আমায়?কেন আমিও তোমাকে ভালোবেসে ফেললাম?!
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সৌর...তিলোত্তমার গালে গাল রাখলো ও....ভাবলো এটুকুই হয়তো ওর বক্তব্য,যে সৌর ওর কাছে কতখানি বিশেষ!!কিন্তু সৌরর তখনও আরও অনেক কিছু জানতে বাকি ছিলো.... তিলোত্তমা বলছে,
-ভালোবাসা মানেই কিন্তু প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া নয় সৌর,ভালোবাসা মানেই একে-অপরের সঙ্গে থাকতেই হবে,এমনটাও নয়।একসঙ্গে থাকার জন্য হয়তো,আমাদের দুজনকেই অনেক বড় মূল্য দিতে হতে পারে।আর আজ আমি তোমাকে একটা কথা একদম পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছি সৌর,আমি জীবনেও কোনোদিন আমার কমফোর্ট-জোনের বাইরে বেরোইনি,ভবিষ্যতেও বেরোবো না।স্যাক্রিফাইজ,স্বার্থত্যাগ,এইসব ভারী-ভারী শব্দগুলোকে,আমি কিন্তু আমার ডিকশনারিতে কোনোদিনই জায়গা দিইনি,আগামী দিনেও দেবও না।আমার যেটা চাই,সেটা যেকোনো মূল্যে চাই-ই চাই।আমি না বলতে অভ্যস্ত,কিন্তু না শুনতে অভ্যস্ত নই।তাই সবার আগে প্রয়োজন আমাদের দুজনের মানসিকতা ম্যাচ করা।ভালোবাসা দিয়ে শুধু ভালোই বাসা যায় সৌর,কিন্তু জীবন চলে না।সবসময় কিন্তু শুধুমাত্র ভালোবাসার ওপর ভিত্তি করে,একসঙ্গে থাকা যায় না!আর আমি নিজেকে খুব ভালোভাবে চিনি।তুমিও আমাকে ভালোভাবে চিনে নাও।আমি কিন্তু আমার ইচ্ছে,আমার স্বপ্নপূরণের জন্য যে কোনো মূল্য দিতে পারি।জীবনের সমস্ত প্রতিবন্ধকতা,এমনকি সমস্ত সীমারেখাও উল্লঙ্ঘন করতে পারি....
-আমি বুঝলাম না মিছরি!!তোমার কি এমন ইচ্ছে,যার জন্য এতগুলো কথা আসছে?!
কোনো উত্তর দিলো না তিলোত্তমা।শুধু দুহাতে সৌরর গলাটা জড়িয়ে ধরলো।তারপর আলতো করে ঠোঁট রাখলো ওর ঠোঁটে...কথার খেই হারিয়ে ফেললো সৌর।ও মিছরির ঠোঁটটাকে নিয়ে আরও একটু খেলা শুরু করলো....কয়েক মুহূর্ত পর তিলোত্তমা নিজের ওষ্ঠ ও অধর মুক্ত করে বললো,
-আজ আসি!বললাম তো সৌর,পরীক্ষার পর প্রথম যেদিন দেখা করবে,সেদিনই সব বলবো তোমায়।আজ আর নষ্ট করার মতো সময়,আমার কাছে একদম নেই।বাই....
-বেশ,তাই হবে।আমি কোনদিন কোনো ব্যাপারেই তোমায় জোর করবো না।মিছরি শোনো,কটাদিন আমি জলে থাকবো না,তুমি কিন্তু সাঁতারটা ভালোভাবে প্র্যাকটিস করবে।আমি চাই ইন্টার-পুল কম্পিটিশনের দিন,তুমি জলে জাস্ট আগুন লাগিয়ে দাও,ঠিক যেমনভাবে আমার মনে আগুন লাগিয়েছো!!
সৌর আর তিলোত্তমা দুজনেই মৃদু স্বরে চাপা হাসি হেসে উঠলো....
-তুমি আমার নিজের হাতে তৈরি মিছরি।স্যারের সামনে অনেক বড় মুখ করে,আমি তোমার নামটা বলেছি।আমার সম্মান কিন্তু রাখতেই হবে।কি?বুঝলে তো?
-বুঝেছি!আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো।আমার দিক থেকে চেষ্টার কোনো খামতি থাকবে না সৌর,প্রমিস!
-হুম!!
একেবারে চলে যাওয়ার আগে পর্যন্তও সৌরর হাতে মিছরির হাতটা রাখা ছিলো।মিছরির হাতেও আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়েছে সৌর।
-তোমাকে ছাড়তেই তো ইচ্ছে করছে না মিছরি!
-তবু ছাড়তে তো হবেই।
-এভাবে বোলো না প্লিজ!ছাড়তে হবে আবার কি কথা!!বলো,যেতে দিতে হবে....
-যাইহোক,একই তো ব্যাপার!বাই সৌর!
-বাই.....
যতক্ষণ পর্যন্ত মিছরি আর টাইগার গলির বাঁকের অন্ধকার রাস্তায় ধীরে-ধীরে মিলিয়ে না গেলো,ততক্ষণ পর্যন্ত ওদের দিকেই চেয়ে রইলো সৌর।আজ ফিরে দেখেছে সে।একেবারে মিলিয়ে যাওয়ার আগে,ঘাড় ঘুরিয়ে একবার হাত নাড়লো তিলোত্তমা....ওর দিকে চেয়ে হাতটা নেড়ে বাই করলো সৌরও।মনটা অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে গেলো।আজ নিজেকে পূর্ণ মনে হলো সৌরর।ঋষি আর সমুর মতো,ওর জীবনে আর কোনো অধ্যায় অসমাপ্ত রইলো না,এটা ভেবেই ভালো লাগছে ভীষণ...সেই মুহূর্তেই ওর পকেটের ফোনটা সশব্দে বেজে উঠলো।নিজের কাজের ব্যাপারে বরাবরই যত্নবান সৌর।তাই আজ পর্যন্ত ওর ব্যক্তিগত পরিসরে বাবা-মা প্রবেশ করেনি,কারণ প্রয়োজনই পড়েনি।যখন যে জায়গায় সৌর পা রেখেছে,তা সে সাঁতার হোক,বা পড়াশোনা,শরীরচর্চা হোক বা খেলাধূলা,সাফল্যের সর্বোচ্চ শীর্ষে নিজেকে নিয়ে গিয়ে,তবেই থেমেছে।আজ পর্যন্ত কোনো ক্ষেত্র বা বিষয়ে ও হাত দিয়েছে,আর সেটা অসমাপ্ত রয়েছে,এমনটা কোনোদিন হয়নি।তিলোত্তমাও তার ব্যতিক্রম নয়!!বছর শেষে ওর দুর্ধর্ষ রেজাল্ট দেখে,বাবা-মায়ের আর কোনো কথা বলার জায়গাই থাকতো না।ও বাড়িতে কখন ফিরলো,কেমন বন্ধুদের সঙ্গে মিশলো,কোথায় গেলো,সেই নিয়ে তাদের বড় বিশেষ মাথাব্যথা নেই।কারণ,দিনের শেষে তাদের সন্তানের দিকে আঙুল তোলার ক্ষমতা কারোর নেই।তাই তারা একপ্রকার নিশ্চিন্তই থাকে।সেই কারণে বাড়ির বাইরে বেরোলে,বাবা-মায়ের ফোন একেবারেই আশা করে না সৌর।বন্ধুরাও সবাই ঠিকই আছে।আর মিছরি তো সবেই গেলো।তবে কার ফোন?তাড়াতাড়ি করে পকেট থেকে ফোনটা বের করলো সৌর.....অসময়ে অপ্রত্যাশিত এই নম্বরটা দেখে,বেশ অবাকই হলো ও...
-হ্যাঁ স্যার বলুন!
-সৌর?ফ্রি আছো?কথা বলা যাবে একটু?!
হেসেই ফেললো সৌর...
-কি যে বলেন স্যার?!নিজের ছেলের সঙ্গে কথা বলার জন্য আবার সময়-অসময়?!প্লিজ বলুন!
-না মানে,সেদিন আমার কথার মাঝেই তুমি যেভাবে ছুটলে,এখন আর কি করে বলি বলো,ইউ আর মাই বয়!!এখন তুমি ভাগ হয়ে গেছো....
স্যারের কথা শুনে লজ্জায় সৌরর কান পর্যন্ত অনুরাগের লালে রক্তিম হয়ে উঠলো।সত্যিই তো,স্যারের অনুমতি ছাড়া ওনার সামনে থেকে,সৌর এক-পা নড়তো না পর্যন্ত!!আর সেদিন বিচ্ছিরিভাবে মিছরির পিছনে ও এক অমোঘ টানে ছুটে গিয়েছিলো।বাঁধতেই পারেনি নিজেকে।ফোনে কথা বললেও,ঘন অন্ধকারের মধ্যেই লজ্জায় অবনত হলো সৌরর মাথা....নিজের ডান হাতের তর্জনীটা নাকে ঘষে নিয়ে লজ্জায় মরে গিয়ে কোনোরকমে বললো,
-এক্সট্রিমলি সরি স্যার!!আসলে সেদিন....
-আরে দূর!আমি কোনো এক্সপ্লেনেশন চেয়েছি নাকি তোমার কাছে?!আমি তো একটু মজাই করছিলাম!ছেলে আমার বড় হয়ে গেছে....
আর কথা বলতে পারলো না সৌর।ধীরে-ধীরে সাইকেলের সামনে এসে দাঁড়ালো।স্যার তখনও বলে চলেছেন,
-শোনো,কাজের কথায় আসি এবার!
-ইয়েস স্যার,বলুন!
-পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন?
-আমার দিক থেকে এক্সিলেন্ট স্যার!একটা ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট এক্সপেক্ট করছি...
-ভেরি গুড!
-থ্যাঙ্কু স্যার!!
-একটু আগেই আমি তোমার বাবাকে ফোন করেছিলাম।
এবার বেজায় ঘাবড়ে গেলো সৌর...
-বাবাকে?কেন....বাবাকে কেন স্যার?
-একটা দারুণ সুখবর দেওয়ার জন্য!চেয়েছিলাম,উনিই তোমায় বলুক।কিন্তু উনি বললেন,যেহেতু তোমাকে এই জায়গায় এনে পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্ব সম্পূর্ণ আমার,তাই আমি যেন নিজের মুখে তোমায় এই খবরটা দিই....কিন্তু উনি ভুল বলেছেন।আমি তোমার ট্রেইনার ঠিকই,পথপ্রদর্শক ঠিকই,কিন্তু তোমার জেদ আর কঠিন অধ্যবসায়ই তোমাকে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে।সেই কৃতিত্ব সম্পূর্ণই তোমার...
-স্যার,আমি না কিচ্ছু বুঝতে পারছি না,কি বিষয়ে কথা হচ্ছে?
-স্পোর্টস কোটা থেকে তোমার একটা চাকরির কথা চলছে সৌর।তোমার নাম এনলিস্টেড!জান লড়িয়ে দিতে হবে কিন্তু।প্রত্যেকটা মাইক্রো-সেকেন্ডের মূল্য তুমি তো বোঝোই।পরীক্ষাটা আগে ভালো করে দাও,তারপর জল-তুমি-আমি-আমার হাতের স্টপওয়াচ আর ফিনিসিং লাইন,এগুলো ছাড়া পৃথিবীর সব ভুলে যাবে তুমি...সুযোগটাকে যেন হাতছাড়া না হয়....
-অপারচুনিটি একবার সৌরদীপ সাহার কাছে আসুক স্যার,জাস্ট একবারের জন্যই আসুক।বাকিটা সৌরদীপ সাহা বুঝে নেবে!তাকে কিভাবে কাজে লাগাতে হয়,সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না....
-দ্যাটস মাই বয়!
-থ্যাঙ্কু স্যার!
-পরীক্ষা না থাকলে কাল থেকেই জোরকদমে প্র্যাকটিস শুরু করতে বলতাম।কিন্তু পরীক্ষার জন্য আটকে গেলাম।তোমার পরীক্ষার পর,সময়টা কিন্তু আরও কমে যাবে।হাতে আর মাত্র কয়েকটা মাস পাবে তুমি....
-আপনি কিচ্ছু ভাববেন না স্যার,আমি ম্যানেজ করে নেবো!
-টাফ কম্পিটিটর আছে সৌর!!
-ডোন্ট ওয়ারি স্যার!ইফ দে আর পজিটিভ,আই এম সুপারলেটিভ!দা টাফেস্ট ওয়ান!আমার তাদের খবরে কোনো প্রয়োজন নেই স্যার!কারণ,স্থলে তারা কোথায় থাকলো,আমার জানার দরকার নেই।কিন্তু জলে তারা আমার পিছনেই থাকবে।আর আমার কম্পেটিশন আমি নিজেই।আমি নিজে নিজের সময়কে বিট করি।তার জন্য পিছনে কে আসছে,বা পাশে কে আছে,দেখার কোনো প্রয়োজনই মনে করি না।কারণ,পিছনে বা আশেপাশে দেখতে গেলে,ফিনিসিং লাইন মিস হয়ে যাবে স্যার,সামনে এগোতে পারবো না যে....
-ব্রিলিয়ান্ট!এজ এক্সপেক্টেড!!বাড়িতে ফিজিক্যাল এক্সারসাইজটুকু কোরো।বডি যেন বসে না যায়!বাকিটা জলে তো আমি সঙ্গে আছিই....
-ডেফিনিটলি স্যার!!আমার মনে থাকবে,জল-আমি-আপনি-আপনার স্টপওয়াচ,আর ফিনিসিং লাইন...ব্যাস!!আর কিচ্ছু না!
-তাই?ব্যাস!!ঠিক তো?আর কিছু নাতো?!
স্যারের কথা বলার ধরনে হেসে ফেললো সৌর...সঙ্গে স্যারও...
-ওকে চলো!পরীক্ষার জন্য অল দা বেস্ট সৌর!!
-থ্যাঙ্কু স্যার!!
ফোনটা রেখে দিয়ে সাইকেলে উঠে বসলো সৌর...তারপর মনে-মনে বললো,
"আর কিছু?আর সে!!শুধুই সে....শুধু জলে নয়,মনেও আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে যাওয়া,সে....আর কিছুক্ষণ আগে ফোনটা এলে,সেও সামনাসামনি জেনে যেতে পারতো।সে জেনে যেতে পারতো,যে পড়াশোনা শেষ করে সৌরদীপ সাহাকে আর হন্যে হয়ে চাকরীর জন্য বসে থাকতে হবে না।যেভাবেই হোক,এটা তো আমায় জিততেই হবে।তাকে একেবারে নিজের করে পাওয়ার প্রথম সিঁড়ি এটা....সুযোগ যখন নিজে থেকেই যেচে এসেছে,একে কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না....জীবন দিয়ে দিতে হবে..."
সাইকেলটা চালিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো সৌর....
-মায়ের হাতটা অকেজো হয়ে যাওয়ার জন্য ঘরের কাজকর্মও এখন করতে হচ্ছে।নইলে আরও একটু পড়ায় সময় দিতে পারতাম রে....
টিউশন শেষে সমুদ্র আর ঋষি বাড়ি চলে গেছে অনেক আগেই।কিন্তু রূপ দেখা করতে এসেছিলো নিশার সঙ্গে।সাইকেল দুটো রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে,একটু এদিকটায় এসে বসেছিলো রূপ আর নিশা...
-ঠিক হয়ে যাবে মা!চিন্তা করছিস কেন?
অন্ধকার বৃত্তের মাঝে নিশার কাঁধে হাত রেখে,ওকে নিজের বুকের কাছে টেনে রূপ বললো...
-হুম!জানি...
-তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি নিশা?
রূপের পেটে আর কোমর দুহাতে জড়িয়ে ধরে,ওর গালের ওপর গাল ছুঁইয়ে দিয়ে নিশা বললো,
-বল না!
-এতদিন ধরে তোকে কাছ থেকে দেখছি।তুই আর মা!মামা আসেন মাঝে-মধ্যে।কিন্তু তোর বোন একদম আসে না,নারে?গত দু-বছরে শুধু শুনেই গেলাম,তোরা দুই বোন।রঞ্জার মুখে,তোর মুখে।কিন্তু তাকে তো দেখলামই না।মানে স্কুলের ছুটিতেও তো বাড়িতে আসা উচিত!
রূপের বুকে মুখ লুকোলো নিশা....
-টিউশনের আজই শেষ দিন।আবার কবে দেখা হবে ঠিক নেই।আজ এই প্রসঙ্গটা না তুললেই হতো না রূপ?!
-কেন?আমি কি তোকে কোনোভাবে কষ্ট দিয়ে ফেললাম?সরি....
-না!তা নয়!রূপ?
-বল!
-আমি তোকে বিয়ে করতে চাই!
-এটা হঠাৎ কোথা থেকে এলো?!মানে কোন কথার পিঠে কোন কথা?!
-না,আমার কাছে এইসব প্রেমের জন্য সত্যি সময় ছিলো না রে।তার এটা কারণ নয়,যে আমি ভালোবাসতে পারি না।তার কারণ এটাই,যে প্রেম-ভালোবাসা আমার কাছে বিলাসিতা!আমার খুব ভয় করে রে....যদি আমাকে ছেড়ে সে চলে যায়?!আমার বদনাম,আমার মায়ের অসহায়তা...
-ওই পাগলী?এসব কি বলছিস তুই?
-না,সত্যিই আমি ভয় পেতাম।প্রতি মুহূর্তে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই তো!নতুন করে আর কোনো লড়াইতে নামতে ভয় লাগে রে....সাহসে কুলোয় না!
-আমি সবসময় তোর পাশে আছি নিশা।শক্ত করে তোর হাত ধরে...
-হুম!তুই বলেই এগোতে সাহস পেয়েছি আমি।জানি তুই কোনোদিন আমাকে ছাড়বি না।আমিও তোকে ছাড়বো না....আর সেই কারণেই সবটা তোকে বলবো....
-সবটা মানে?
-আমার পরিবারের কথা!
-আচ্ছা!বল....
-বাজারে আমার বাবার পাইকারি সবজির দোকান ছিলো।মায়ের মুখে শুনেছি,একসময় নাকি খুব রমরমা ছিলো আমাদের,টাকাও ছিলো।যখন জ্যেঠুর কারখানা বন্ধ হয়ে যায়,তখনও ঠাকুমা বেঁচে ছিলো।আমার বাবা-ই নাকি সেই সময় পুরো পরিবারটাকে টানতো।জ্যেঠু-জেম্মা-বড়দা-ঠাম্মি-আর আমার মা।আমরা তখনও হইনি।অমানুষিক পরিশ্রম করতো বাবা।কিন্তু মুখে নাকি সবসময় একটা সুন্দর হাসি লেগেই থাকতো।ধীরে-ধীরে আমরা দুই বোন হলাম,সংসার বড় হলো।তাও বাবা একাই সবাইকে টানছিলো।দাদার পড়াশোনা,সংসার খরচ সবটাই বাবার ওপর।চিন্তা-ভাবনায় ডুবতে শুরু করেছিলো বাবা।ঠিক সেই সময়ই জ্যেঠুর কারখানা খুললো,আর ঠাকুমাও মারা গেলো।কিন্তু ঠাকুমার মৃত্যুর পরই জ্যেঠু সংসার ভাগ করতে বললো।এমনকি জমি-জায়গা,ঠাকুমার হাঁড়ি-বাসন,সবকিছু ভাগ করার জন্য উঠে-পড়ে লাগলো....মা বলে,এটাই না বাবা আর সহ্যই করতে পারেনি।একেবারে ভিতর থেকে ভেঙে পড়েছিলো।কথাবার্তা আর কারোর সঙ্গে বলতো না বিশেষ।সংসারে অশান্তি,জেম্মার সঙ্গে কারণে-অকারণে মায়ের নিত্যদিন ঝামেলা,এইসব কারণে ভাঙলো সংসার।এক বাড়ির মধ্যেই আলাদা হলো হাঁড়ি।বাবা ছোট হয়েও জ্যেঠুর জন্য অনেক করেছিলো তো,আর বড়দাকেও বড্ড ভালোবাসতো,একেবারে কাকাইয়ের হাতের ওপর ছোটবেলা থেকেই দাদা মানুষ হয়েছে....সেই দাদাকেও আর খেলতে আসতে দিতো না আমাদের ঘরে।বাবা ভিতর-ভিতর ভাঙতে-ভাঙতে একদিন ভোরবেলা পাইকারী বাজার থেকে ভ্যানে করে সবজি আনার সময়,করে বসলো এক্সিডেন্ট।দুটো পা অকেজো হলো,কিন্তু তাও মানুষটা ছিলো।টাকার অভাবে প্লেট বসাতে পারেনি মা।মামারবাড়ি থেকেই বাবার সমস্ত চিকিৎসা করেছে,মানে তাদের পক্ষে যতটা করা সম্ভব হয়েছে আর কি!!তারপর একদিন ধুঁকতে-ধুঁকতে বিছানায় শয্যাশায়ী মানুষটা কাউকে জানতে না দিয়ে,ঘুমের মধ্যেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলো।শেষদিকে নাকি বেডসোর হয়ে গিয়েছিলো শরীরের নিম্নাঙ্গে।আরও নানারকম কঠিন রোগ।জ্যেঠু আসেনি দেখতে।কাল-অশৌচও মানেনি।ওদের তখন অনেক পয়সা।ছেলে বড় হচ্ছে,আলাদা ঘরের প্রয়োজন।আমাদের আর বাড়িতে রাখা যাবে না।বাবাও মারা গেলো,আমাদেরও বাড়ি ছাড়তে বললো।বেশিরভাগ জমির ওপরে ঠাকুরদাদার তৈরি ওই সম্পূর্ণ বাড়িটা জ্যেঠু নিয়ে নিলো।পাশে যেখানে আমরা এখন থাকি,ওখানে ওই একটা ঘর করে দিলো মাকে,দুই বাড়ির মাঝে উঁচু করে পাঁচিল দিয়ে দিলো।মামা মাকে বলেছিলো,চল!এখানে থাকতে পারবি না,বাড়ি চল।কিন্তু মা ওই ভিটে ছাড়েনি।আগলে আজও বসে আছে।মামা তখন বললো,তুই যখন যাবিই না,এভাবে একা দুটো মেয়েকে মানুষ করবি কি করে?!ছোটটাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি!ব্যাস!!সেদিন থেকেই আলাদা হয়ে গেলাম আমরা দুই বোন!আমি মায়ের কাছে,বোন মামার কাছে....মামারা আজও প্রতিমাসে টাকা পাঠায়।বোনকেও ভালো স্কুলে পড়াচ্ছে।আমার চেয়েও ভালো স্কুলে রূপ,অনেক বড় স্কুল।কিন্তু বোন আর এখানে আসে না।মায়ের সঙ্গেও সেভাবে কথা বলে না।আমি ফোন করলেও দায়সারা কথা বলে রেখে দেয়....আসতেই চায় না এখানে।আমার ছুটি থাকলে,মাকে নিয়ে আমি ওখানে যাই...ও এড়িয়ে চলে আমাদের....আমি জানিনা রূপ,ও কেন এমন করে?!
রূপের জামার মধ্যে মুখ গুঁজে নিজের চোখের জলটুকু মুছে নিলো নিশান্তিকা....রূপ ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো বুকে...ও রূপের বুকে মুখ লুকিয়েই বললো,
-জেম্মাদের এখন দোতলা বাড়ি!কিন্তু ওরা ভুলে গেছে,রোদে তেতে-পুড়ে,মাথায় গামছা বেঁধে,মিস্ত্রীদের সঙ্গে হাতে-হাত মিলিয়ে,ওই বাড়ির ভিত আমার বাবা তৈরি করে গেছে।ওরা ভুলে গেছে রে রূপ....
-চুপ কর!!ওসব বেইমানদের জন্য নিজের চোখের এক ফোঁটা জলও,তুই নষ্ট করবি না!
-হুম!আমি কাঁদি নারে একদম!মায়ের সামনে একটুও কাঁদি না!মা কষ্ট পাবে ভেবে!কিন্তু তুই,তুই তো আমার নিজের,আমার আপন,সবচেয়ে কাছের মানুষ।তোর কাছে তো প্রাণখুলে একটু কাঁদতে পারি বল!?
-হুম!!
নিশাকে নিজের বুকের মধ্যে মিশিয়ে নিলো রূপ....
-জেম্মাদের ব্যাপারটা আমাকে ততটাও কষ্ট দেয় না,যতটা ছুটকির আচরণ,ওর অবহেলা,আমার প্রতি-মায়ের প্রতি ওর উদাসীনতা,আমাকে কষ্ট দেয়...
-ছুটকি কে?
-আমার বোন!তমিস্রা!!ও তমিস্রা,আমি নিশান্তিকা....ও মিশকালো রাত,আর আমি সেই রাতের অসমাপ্ত অধ্যায়,অন্তিম লগ্ন....
-বাঃ!ভারী সুন্দর নাম তো,তমিস্রা!!
-হুম!!সে দেখতে আরও সুন্দরী!!আজ ওর কথা তোকে বিশেষ কিছু বলবো না,ওর রূপের বর্ণনা দিলে,তুই আমাকেই ভুলে যাবি!আমি মায়ের মতো হয়েছি,ছুটকি বাবার মতো।ব্যস!!আর কিছু বলবো না।এমনিতেই তো শালি,অর্ধেকটা তো তোরই...আর তাকে দেখলে আবার তুই হড়কে,পুরোটাই না তার হয়ে যাস!তোকে বাবা বলবোই না তার কথা!!
মৃদু হাসলো নিশা...
-ঠিক আছে।বলিস না!সে না হয় আমি নিজের চোখেই দেখে নেবোখন!একমাত্র জামাইবাবু বলে কথা,একটু তো শালিকে দেখেশুনে নিতেই হবে....
-একটা চড় মারবো!!
সপাটে রূপের গায়ে হাত চালিয়ে দেয় নিশা...রূপ ওর হাতটা চেপে ধরে ওকে জড়িয়ে ধরে সোহাগ-চিহ্ন এঁকে দেয় ওর গালে....
-এই আমাকে ছাড়,ওঠ!তুই আবার বাড়াবাড়ি শুরু করবি!!
-বাড়াবাড়ি করবো না নিশা!প্লিজ....একটু....
-না...চল ওঠ-ওঠ!বাড়ি যাবো!!রাত হয়ে যাচ্ছে...
-তুই চলে যা!আমি পরে আসছি!
অভিমান করে মুখ গোঁজ করে বসে রইলো রূপ...
-অমনি বাবুর রাগ হয়ে গেলো...
-তুই কিন্তু আমাকে এখনও বলিসনি নিশা!
-কি?
-ভালোবাসি....
মিথ্যে অভিমান দেখানো রূপকে নিজের দিকে ফিরিয়ে, দুহাতে ওর দুটো কান টেনে ধরলো নিশা.... তারপর বললো,
-আবার বল,কি বলিনি?
-ভালোবাসি!!
মৃদু হেসে দুটো কান ছেড়ে,একটা হাত দিয়ে রূপের দুটো চোখ চেপে ধরলো নিশা।চোখ বন্ধ অবস্থায় ওর ঠোঁটের ওপর নিজের ঠোঁট মৃদু স্পর্শ করে বললো,
-আমিও....
বলেই উঠে দৌড় দিলো সাইকেলের দিকে।রূপ ওকে ধরতে গিয়েও,একটুর জন্য বেরিয়ে গেলো হাত থেকে।খেপে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো রূপ,
-হবেনা!চিটিং!তোকে আমি ওটা বলতে বলিনি....
-একবারে বলে দিলে তুই পালাবি হতচ্ছাড়া!তাই ইন্সটলমেন্টে বলবো!!টাটা....মন দিয়ে পড়বি...ফেল করে বেকার থাকলে কিন্তু,তোকে বিয়েই করবো না...
হাসতে-হাসতে দৌড়ে এসে নিশার সাইকেলের হ্যান্ডেল চেপে ধরলো রূপ...
-তুই চাকরি করবি,আমি বসে খাবো!
-এখন থেকেই পিঠ বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা,তাই না?!যা,বাড়ি গিয়ে পড়তে বোস!আমিও যাই....
-মন দিয়ে পড়তে পারবো না নিশা!!
-কেন?মন কোন বনে বন্ধক দিয়েছিস তুই?
-তোর কাছে বন্ধক দিয়েছি!কিছু তো দিয়ে যা...এই কদিনের জন্য!!প্লিজ....
আবার সাইকেলের স্ট্যান্ড ফেললো নিশা।এগিয়ে এলো রূপের কাছে।রূপের ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো আলতো করে।তারপর জোরে কামড়ে দিলো...দিশেহারা হয়ে গেলো রূপ।প্রথমবার নিশাকে এতটা পায়নি ও,এভাবে পায়নি...ওর অবস্থা দেখে,নিশা হেসে ছেড়ে দিলো ওকে....
-বাচ্চা ছেলে!!
-ওই....
-কি?কি হয়েছে কি?গলাবাজি করছিস কেন?বাচ্চাকে বাচ্চা বলবো না তো কি বলবো?!গার্লফ্রেন্ড ঠোঁটে ঠোঁট রাখলে,কি করবি না করবি দিশা পাচ্ছিস না....দেখি....
রূপের হাত ধরলো নিশা।তারপর ওর হাতটা ওর গালেই ঠেকিয়ে দিলো।
-দেখ!কি এটা?তোর হাত ঠান্ডা হয়ে গেছে!!
মাথা নীচু করে নিলো রূপ....নিশা বললো,
-সামলাতে পারবি না যখন,চাস কেন?
-তাতে কি হয়েছে?তুই-ই তো!!তোর কাছে অক্ষমতায় লজ্জা কিসের?তুই নিজের মতো করে তৈরি করে নিবি আমায়!সেদিনও চেয়েছিলাম,তুই ঠোঁটে একটু ঠোঁট ঠেকিয়েই দৌড় দিলি!ভেবেছিলাম আজও তাই করবি!আজ মহারানী আজ যে এমন ঘ্যাক করে কামড়ে দেবে,বুঝবো কি করে?!
-কি-কি?কি করে কামড়ে দেবে?!
-কিছুনা!সরি!
-তুই আর একদম আমার চোখের সামনে আসবি না হতভাগা!!
-আচ্ছা,ঠোঁটের সামনে এলে চলবে?
-দূর হ!!
-তুই একটু দূরে যা,আমি দূর হয়ে ঘুরে তোর কাছেই আসছি!
-ইডিয়ট!!
সাইকেলে উঠে পড়লো নিশা.... ও চলে যাচ্ছে দেখে রূপ চেঁচালো,
-লাভ ইউ!!
দূরে মিলিয়ে যেতে-যেতে ভেসে এলো নিশার কণ্ঠস্বর,
-আমিও...
হেসে মাথা নামিয়ে নিলো রূপ,
"আবারও চিটিং!তুই কি কোনোদিনও নিজের মুখে বলবি না নিশা!!একবারও কি বলবি না?তোকে ভালোবাসি রূপ!"
সাইকেলে উঠে উল্টোদিকের রাস্তায় বেরিয়ে গেলো রূপায়ণ....
পরবর্তী সময়টুকু সরস্বতী দেবীর শ্রীচরণে নিজেদের সবটুকু উজাড় করে দিলো সকলেই,একমাত্র সমুদ্র ছাড়া....ওর তখন অর্ধন্মাদ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা!বাবা গিটারটা ফেরত দিলোই না আর।পড়াশোনায়ও সেভাবে মন বসে না।সৌর আসতে চায় সমুর কাছে,পড়াশোনায় সাহায্য করবে বলে,কিন্তু সমুই বারণ করে।এতরকম সাফল্যের চাদরে আবৃত সৌরকে দেখলে,ওর বাবা-মা আরও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।সমুদ্রর ওপরে মানসিক অত্যাচারের পরিমাণটা আরও একটু বেড়ে যায়।সারাদিন কানের সামনে ওই সৌররই গুণকীর্তন চলতে থাকে।তাই প্রয়োজনে সমু চলে যায় ওর কাছে,কিন্তু নিজের বাড়িতে ওকে ডাকে না খুব একটা....
রুটিনমাফিক সমস্ত পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেও,গন্ডগোলটা কিন্তু প্রথমেই বেঁধে গেছিলো।আর সেটা ইংরেজি পরীক্ষা নিয়ে।প্রশ্নপত্র বেশ কিছুদিন আগে ফাঁস হয়ে যাওয়ায়,সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পরবর্তীকালে সেই পরীক্ষা পুনরায় নেওয়ার।তাই অন্য সকল পরীক্ষা সুচারুভাবে হয়ে গেলেও,বাকি থেকে যায় রানী ম্যামের বিষয়টাই,ইংরেজি....
ইংরেজি পরীক্ষার দিন দুয়েক আগে একদিন রাত্রিবেলা মন দিয়েই পড়াশোনা করছিলো সমুদ্র।বেশ অনেকক্ষণ একভাবে পড়ার ফলে বিরক্ত লাগছিলো ওর।কানে হেডফোন গুঁজে দিয়ে গান চালিয়ে বালিশের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে থেকে তার কথাই ভাবছিলো ও।অনুপ্রেরণা....কি করছে এখন তার অনুপ্রেরণা?!ভীষণ ক্লান্ত কি?তার ভালোবাসার বুকের ওপর নিজের ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়েছে নিশ্চয়ই।কান থেকে একটানে ঢাউস হেডফোনটা খুলে ফেললো সমুদ্র।রানী ম্যামের কথা ভাবতে গেলেই,আগে তার সিঁথির ওই লালচে সিঁদুরের আভাটুকু মনে পড়ে।তারপরই এইসব উল্টোপাল্টা চিন্তা মাথায় এসে ভিড় করে,আর পাগল-পাগল লাগে।কান-মাথা একেবারে গরম হয়ে যায়!চোখ বন্ধ করে ওকে বলা ম্যামের কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করছিলো সমুদ্র....চোখের সামনে ভাসছিলো শুধুমাত্র তারই মুখ....
"কি ব্যাপার বলো তো সমুদ্র,তুমি কি আমার বাড়িতে সিসিটিভি লাগিয়ে রেখেছো নাকি!মানে বেশিরভাগ দিনই আমার শাড়ির সঙ্গে তোমার আনা ফুলের রঙ মিলে যায় কি করে?"
"একি?আজ খালি হাতে?"
"তুমি বলো সমুদ্র,পরীক্ষা তো প্রায় দরজায় কড়া নাড়ছে।প্রিপারেশন কেমন?প্রতিটা বিষয় তো বটেই,আমার সাবজেক্টে এ প্লাস আসবে তো?কিছু ডাউট থাকলে,এক্সট্রা ক্লাসে ক্লিয়ার করে নিতে পারো!"
ফোনের যান্ত্রিক শব্দে চোখ মেললো সমুদ্র....তখনও কাজে বাজছে তারই সুমধুর কণ্ঠস্বর।
"প্রতিটা বিষয় তো বটেই,আমার সাবজেক্টে এ প্লাস আসবে তো?"
ফোনে একটা ই-মেইল ঢুকেছে।তড়াক করে উঠে বসলো সমুদ্র।ওর সারাটা শরীর কাঁপছে....যা ভেবেছিলো,ঠিক তাই।গানের যে অনলাইন অডিশনটা দিয়েছিলো,তারই ডাক পাঠিয়েছে ওরা।সেই বহুকাঙ্খিত ই-মেইল!সম্পূর্ণ মেইলটা পড়তে-পড়তে উত্তেজনায় তিরতির করে কাঁপছিলো সমুদ্র।আনন্দে গান বাদ দিয়ে একটু নেচে নিতে ইচ্ছে করছিলো ওর....কিন্তু ওখানে পৌঁছনোর জন্য নির্ধারিত সময় এবং তারিখ দেখে,ওর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো।ওখানে পৌঁছনোর সময় এবং তারিখ,আর ইংরেজি পরীক্ষার সময় এবং তারিখের মধ্যে কোনো বৈসাদৃশ্য নেই,তারা হুবহু এক....অর্থাৎ জীবনের চরম সিদ্ধান্তের সময় উপস্থিত।হয় পরীক্ষা তথা পড়াশোনা,নয় গান....যেকোনো একটাকে বেছে নেওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণ আগত....দুটোর মধ্যে যেকোনো একটাকে বেছে নিলেই,চিরকালের মতো অসমাপ্ত রয়ে যাবে অন্যটা।এইখানে গান গেয়ে একবার উত্তীর্ণ হয়ে গেলে,আর দ্বিতীয় কোনো সুযোগের অপেক্ষা করতে হবে না সমুদ্রকে।আর পিছন ফিরে চাইতে হবে না।প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে একেবারে চুক্তিপত্রে সই করিয়েই নেবে ওরা।জীবন তৈরি হয়ে যাবে।এইরকম একটা সুযোগের জন্যই তো আজীবন নিজেকে তৈরি করেছে সমুদ্র....আর পরীক্ষা দিতে গেলে,হাতছাড়া হয়ে যাবে এই সুবর্ণ সুযোগ।আবার ওই পড়াশোনার যাঁতাকলে,বাবা-মা ওকে একেবারে পিষে মেরে ফেলবে!!কোনদিকে যাবে সমুদ্র।যদি জিততে পারে,তবেই পাবে সমস্ত সুযোগ!কিন্তু হেরে গেলে!?একদম মনের জোর পাচ্ছে না সমুদ্র।অনেক বড় একটা ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যাবে....হয়তো জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি....মাথায় এইসব চলছে বিন্দুমাত্র আভাস পেলেও,বাবা-মা খুন করে ফেলবে ওকে....আর ভাবতে পারে না সমুদ্র...কাকে বলবে ও?বন্ধুদের এসব কথা বললে,সৌর ওকে যতই ভালোবাসুক,কেটে ফেলে দেবে!ঠিক মাকে জানিয়ে দেবে...কাকে বলবে ও?কি বলবে?কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেই সুমধুর শব্দবন্ধ,
"প্রতিটা বিষয় তো বটেই,আমার সাবজেক্টে এ প্লাস আসবে তো?"
বিদ্যুৎচমকের মতো তারই বলা আরও একটা কথা মনে পড়ে গেলো সমুদ্রর,
"ভালো করে পরীক্ষাটা দিও সমুদ্র।কিন্তু গানটা ছেড়ো না।জীবনে যা চাও,তাই নিয়েই সুপ্রতিষ্ঠিত হও..."
আমূল কেঁপে উঠলো সমুদ্র....হেডফোনের পাশে রাখা ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে ই-মেইল,সামনে ইংরেজি বই খোলা....ফোন দিচ্ছে অপূরণীয় রঙিন স্বপ্নের হাতছানি,আর বই জানান দিচ্ছে কঠোর বাস্তব!!সমুদ্র ঠিক করে উঠতে পারলো না,কোনটা অসমাপ্ত রাখবে ও?বাস্তব না স্বপ্ন?!
চোখ দুটো প্রচন্ড জ্বালা করে উঠলো।বইয়ের কালো-কালো অক্ষরগুলো ধীরে-ধীরে ঝাপসা হয়ে গেলো....নিশ্চুপে চশমার কাঁচ ভিজিয়ে,সমুদ্রর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো লবণাক্ত জল....
(চলবে.....)
ছবি: সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন